নীলোৎপল বসু
আচমকাই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ‘দেশপ্রেমিক’
আর ‘দেশবিরোধী’দের।
কিংবা ‘জাতীয়তাবাদী’ আর ‘জাতীয়তা-বিরোধী’দের মধ্যে। হেঁয়ালি না করে খোলসা
করেই বলা যাক।
৯ই ফেব্রুয়ারির একটি ঘটনা
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
গোষ্ঠী একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। প্রথমে অনুমতি দিলেও অনুষ্ঠানটি
শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব মুহূর্তে সেই অনুমতি প্রত্যাহারও হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ আর
এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এ ভি বি পি-র অভিযোগ এবং দাবি মেনে অনুমতি বাতিল করে দেয়। এই
অনুষ্ঠানে কথিত কিছু স্লোগান ওঠে। ‘কথিত’ শব্দটি এইজন্য
ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ এই অনুষ্ঠানের কোনো প্রামাণ্য সাক্ষ্য নেই। একটি হিন্দি
চ্যানেলে যে ভিডিও রেকর্ডিং হয়েছিল এবং যেটি এই চ্যানেল সহ আরো কয়েকটি চ্যানেলে
দেখানো হয় – তার ভিত্তিতেই গোটা দেশ তোলপাড়। কিন্তু এখন এটা
প্রমাণিত যে, এই ভিডিওটির বিষয়বস্তু সত্যঘটনা নির্ভর নয়,
বিকৃত করা হয়েছে সচেতনভাবে।
৯ তারিখের ঐ ঘটনার পর পুলিশ যে
এফ আই আর করে তাতে অনুষ্ঠানের আয়োজক এবং এ ভি বি পি-র মধ্যে বচসার পরে কারুরই নাম
উল্লিখিত ছিল না। পরবর্তীতে দিল্লির একজন বি জে পি এম পি মহেশ গিরি ২০ জন বামপন্থী
ছাত্রছাত্রীর নাম দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের
কাছে। একনম্বরেই থাকে নির্বাচিত ছাত্রসংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারের নাম।
পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ
সিং গরম বক্তৃতা দিয়ে দিল্লি পুলিশকে ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
গোলমালটা শুরু হলো এখান থেকেই। এতদিন পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে
সংসদ আর বিধানসভায় পাশ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ভিত্তিতে। এর মূল বনিয়াদ
স্বায়ত্তশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতেই সম্পূর্ণ অধিকার এবং আইনি
ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা । যার সমাধান হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় চৌহদ্দিতেই সেটাই হয়ে
উঠল ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘জাতীয়তা-বিরোধিতা’র কেন্দ্রবিন্দু।
১.
আসলে জে এনইউ-র ঐ বিতর্কিত ঘটনা
নিছকই উপলক্ষ। পরিকল্পনাটা আগেই ছিল। এবং আচমকাও নয়। উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার মতাদর্শের দখল চাই। এটাই আর এস এস-এর দীর্ঘলালিত স্বপ্ন বলা
যেতে পারে। সরকার তৈরি হওয়ার পরেই দীননাথ বাত্রা, সুদর্শন রাও-দের ‘সরস্বতীর কমলবনে মত্ত হস্তী’সুলভ সশব্দ পদচারণা
বৌদ্ধিক জগৎকে সচকিত করেছে। পুনের এফ টি আই আই-এ গজেন্দ্র চৌহান আর এস এস-এর
তত্ত্বাবধানে স্বনামধন্য চেয়ারম্যান। আই আই টি চেন্নাইয়ের দলিত ছাত্রদের আলোচনার
কেন্দ্র পেরিয়ার আম্বেদকার স্টাডি সার্কেল স্মৃতি ইরানির হস্তক্ষেপে রাষ্ট্ররোষের
সম্মুখীন। আর হিন্দুত্বের অবিচ্ছেদ্য উপাদান বর্ণাশ্রম, দলিতদেরও
এই রোষ থেকে বঞ্চিত করছে না! আসলে উচ্চশিক্ষায় দলিত ছাত্রদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের
ইতিহাস অধুনা নয়। কিন্তু আর এস এস এবং মোদী সরকারের বদান্যতায় তা তীব্র গতিবেগ
অর্জন করেছে। অতঃপর রোহিত ভেমুলা। এবং আত্মহত্যার প্রাক্মুহূর্তে জবানবন্দি
ঐতিহাসিক চেহারা নিয়ে তুফান তুলেছে গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধির মননে। দলিতদের
সামাজিক যন্ত্রণার শরিক হয়েছে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ। হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরে গোটা দেশেই ঝড় উঠেছে। প্রাথমিকভাবে ছাত্রদের
মধ্যে কিন্তু পরবর্তীতে সামগ্রিকভাবে সমাজেই। কোণঠাসা হয়েছে সরকার। কারণ সেখানেও
স্পষ্ট স্থানীয় এম পি যিনি মোদী সরকারের সদস্যও বটে - বান্দারু দত্তাত্রেয় এবং
মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অতিসক্রিয়তা। আর এস এস নামেই সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন!
ভোটটা ভালোই বোঝে! অতঃ কিম্? বৌদ্ধিক জগতের দখল নিতে গেলে
আক্রমণের বর্শাফলক ঘোরাতে হবে বামপন্থীদের দিকে। ফলে মিশন জে এন ইউ। আর ছিটপুট মূল
ধারা বিচ্ছিন্ন কোনো ক্ষুদ্র ছাত্রগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কামান দেগে লাভ কী আছে,
ফলে ‘গল্পের গোরু গাছে উঠল’! ৯ তারিখের ঘটনায় দেশদ্রোহ আইনে ১২ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেল থেকে গ্রেপ্তার
হলো ছাত্রসংসদের নির্বাচিত সভাপতি কানহাইয়া কুমার।
২.
দু-তিনটি চ্যানেলের মাধ্যমে ‘গ্রামে গ্রামে
সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’ – বামপন্থীরা ‘জাতীয়তা-বিরোধী’। যুদ্ধের সময়ে যে ধরনের উগ্র
জাত্যাভিমান তৈরি করা হয় ঠিক একই কায়দায় চলল গোয়েবেলসীয় অভিযান। ইতিমধ্যে
প্রতিরোধের গ্রানাইট পাঁচিলও উঠে গেছে। জে এন ইউ-তে তৈরি হয়েছে দলমত নির্বিশেষে
ছাত্রসমাজের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। অবশ্যই জে এন ইউ-র ছাত্রসংসদের নেতৃত্বে এবং
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলির সম্মিলিত উদ্যোগে। পাশে এসে দাঁড়ালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষকসমাজ। নির্বাচিত জে এন ইউটিএ। আর
প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে পড়ল দেশের নানা প্রান্তে। ছাত্ররা তো বটেই, সমাজের বিভিন্ন
অংশের গণতান্ত্রিকরাও শামিল।
৩.
একদিকে যখন জোরালো প্রতিবাদ -
ষড়যন্ত্রের জালও বিস্তৃত হলো। ১৩ই ফেব্রুয়ারি বামপন্থী দলের নেতারা অন্য কয়েকটি
সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ
সিং-এর সাথে। প্রশ্ন তোলা হলো সরকারের নিশানায় কেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন এবং তাদের
নেতৃত্ব? বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে কোনোদিন কেউ তাদের নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন
তুলতে পারেনি। তাহলে কেন কানহাইয়া কুমার বা অভিযোগে কেন বামপন্থী ছাত্রদের নাম?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরুত্তর। প্রশ্ন উঠল সাক্ষ্য নিয়েও। জে এন ইউ-তে
সিসিটিভি নেই, দিল্লি পুলিশের নিযুক্ত কোনো ভিডিওগ্রাফারও ঐ
ভিডিও তোলে নি, তাহলে কোথা থেকে এল ঐ ভিডিও? যা গোটা দেশকে বিভাজিত করে দিচ্ছে সংঘের শাখা সংগঠনগুলির সক্রিয় এবং সহিংস
উদ্যোগের? দাবি তোলা হলো ঐ ভিডিও নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার-
যা সন্দেহাতীতভাবেই ভিডিওটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
কিন্তু নৈব নৈব চ!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তেজনার পারদ চড়ালেন। তিনি তখন শিকারি। কারণ আগের সন্ধেতেই
বিশাল সংহতি সভা হয়েছে কানহাইয়া কুমারের মুক্তির দাবিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে
পুলিশের অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। বামপন্থীরা তো বটেই, কংগ্রেসের
সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সেখানে হাজির। ‘জাতীয়তা-বিরোধী’দের তালিকাও দীর্ঘ হলো! এককথায় যারাই বি জে পি সংঘের সঙ্গে নেই-তারাই
জাতীয়তা-বিরোধী। অনেকটাই জর্জ বুশ মাফিক ‘ইফ্ ইউ আর নট উইথ
আস্, ইউ আর উইথ দেম্’ ! কারণটাও
সর্বজনবিদিত। আর এস এস-এর মতাদর্শের প্রাথমিক পাঠ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ধরেই।
মোদী-ভাগবতদের হাত ধরে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে’। কাজেই বামপন্থীদের পিছনে
যে সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদীরাও রয়েছে এটা প্রমাণ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা
করলেন জে এন ইউ-র ছাত্রদের পাশে হাফিজ সৈয়দের উপস্থিতি। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল
পঁচা শামুকে পা কেটেছে! হাফিজ সৈয়দের যে টুইটার বার্তাকে ভিত্তি করে রাজনাথ সিং-এর
এই মন্তব্য, পরিষ্কার হলো যে সেটি একটি ফেক অ্যাকাউন্ট। লজ্জা শরম থাকলে হয়তো ক্ষমা
চাইতেন। যেকোনো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নিশ্চয়ই লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন সেদিন।
৪.
কিন্তু জে এন ইউতে আটকে থাকলে তো
চলবে না। আরো আক্রমণ। সি পি আই (এম)এর কেন্দ্রীয় দপ্তর আক্রমণ করা, টেলিফোনে সাধারণ
সম্পাদক এবং সংসদীয় নেতা সীতারাম ইয়েচুরিকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি - এ প্রায় তিরিশের দশকের জার্মানির মার্টিন
নিয়েমুলারের কবিতার পুনরাবৃত্ত ভারতীয় দৃশ্যপট। বাড়তি আকর্ষণ আসন্ন আগামীতেই
পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার মধ্যে দু’টির নাম
পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালা। মেরুকরণের প্রয়োগ এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে গণউন্মাদনা
সৃষ্টি করার সুবর্ণ সুযোগ। অনিবার্যভাবেই বাঙ্ময় তৃণমূল কংগ্রেসের হৃদয়বিদারক
নৈঃশব্দ!
৫.
কিন্তু ফ্যাসিবাদী হামলার একটি
অন্যতম লক্ষণ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপরে আক্রমণ। স্পষ্ট হলো দিল্লির
পাতিয়ালা হাউজের ঘটনায়। দেশের রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে সেশন কোর্ট। কালো কোর্টে
ভূষিত উকিলরূপী সংঘের ঝটিকাবাহিনীর মত্ততার অভিযান। কানহাইয়াকে কার্যত আদালতে
তুলতেই পারল না পুলিশ। আক্রান্ত হলেন জে এন ইউর অধ্যাপক অধ্যাপিকারা, সংবাদকর্মীরা।
ফেলে পেটানো হলো। টিভির পর্দায় দেখা গেল নির্বাচিত বি জে পি-র বিধায়ক সেই শারীরিক
আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রশ্ন করলেই ছুঁড়ে দেওয়া হয় উদ্ধত উত্তর। ওরা সবাই
পাকিস্তানপন্থী, ‘জাতীয়তাবিরোধী’! ফলে ‘জাতীয়তাবাদী’দের দেশের আইন মানার কোনো দরকার নেই।
সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করল দু’দিন পর। কিন্তু আবারো প্রায়
একইরকম ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। আহত হলেন কানহাইয়া কুমার। পুলিশের দেওয়া মেডিক্যাল
রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু কোনো অনুশোচনা নেই, কোনো
নিন্দাও শোনা গেল না সরকার বা শাসকদলের পক্ষ থেকে। কারণটাও স্পষ্ট। ‘জাতীয়তাবাদী’ প্রচারের ক্ষতি হতে পারে। ইতিমধ্যেই
রাজধানীতে সাংবাদিকদের বিপুল প্রতিবাদ। বাজপেয়ী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি
সোরাবজী সহ দেশের অগ্রগণ্য আইনজীবী- বিশেষজ্ঞরা সরকারের বিরুদ্ধে মুখর। প্রশাসন
বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে পারছে না। কিন্তু মেরুকরণের স্বপ্নে
উদ্ভাষিত আর এস এস মশগুল। বাংলায় বলতে গেলে ‘চোরা না শোনে
ধর্মের কাহিনী’!
৬.
কিন্তু শেষপর্যন্ত বোমাটা ফাটল।
একটি মিডিয়া চ্যানেলই যা সরকারের করার কথা ছিল তাই করে দেখালো। বৈজ্ঞানিক
প্রযুক্তিগত পরীক্ষার মধ্যে পুনরাভিনীত হলো কীভাবে যে ভিডিও পুলিশি তৎপরতার ভিত্তি, আর এস এস-এর
প্রচারের বর্শাফলক – সেই ভিডিওটিই আসলে ভিত্তিহীন, সচেতনভাবেই পুনর্নির্মিত। অন্য কেউ হলে লজ্জায় ‘ধরণী
দ্বিধা হও’ বলে উধাও হতো। কিন্তু আর এস এস এবং তার
সাঙ্গোপাঙ্গদের চোখের চামড়া আছে বলে কেউ অভিযোগ করতে পারবে না! তাই অভিযান চলছে।
জে এন ইউ থেকে যাদবপুর, দেশের সর্বত্র। বিজেপি নেতারা গলার
শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন জাতীয়তাবিরোধী দেখলেই ‘আগে ফেলে
পেটাও, পরে বিচার’। এই তালিকায় বঙ্গবাসী রাহুল
সিংহ তার নাম যুক্ত করেছেন।
৭.
কিন্তু কেন এই বিতর্ক? আসলে এই
মতাদর্শগত অভিযান শুরু করার একটি অন্যতম কারণ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি উপলব্ধি। ‘আচ্ছে দিন’ আসলে আচ্ছে নয়। সাধারণ মানুষের। অবশ্যই আম্বানি,
আদানিরা এর মধ্যে নেই। তাদের নিশ্চয়ই সুদিন। বড়জোর নিজেদের মধ্যে
পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে মুনাফার মাত্রা নিয়ে। কৃষকরা আত্মহত্যা করছে
অনেক বেশি সংখ্যায়। চাবাগান শ্রমিকরা মরছে অনাহারে। চটকল, অন্যান্য
কল-কারখানা বন্ধ। শিল্প উৎপাদনের সূচকও নিম্নগামী। কৃষি উৎপাদনেরও তাই। আবহাওয়ার
পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিপূরণের অপ্রতুলতায় গ্রামের শ্রমজীবীদের ত্রাহি
ত্রাহি রব। বাজেট অধিবেশন আসছে। ব্যাঙ্কগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে কর্পোরেট
ঋণখেলাপিদের ঋণের টাকা পুনরুদ্ধার করতে না পেরে। ট্যাক্স উশুল করার বদলে বড়লোকদের
ছাড় দিতেই ব্যস্ত সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান
প্রকল্পে বিনিয়োগ করার টাকা নেই – বাড়ন্ত। গ্রামে শহরে
মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রবণতার লক্ষণগুলি স্পষ্ট। কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু
হবে সংসদের বাজেট অধিবেশন। সরকারের আর্থিক সমীক্ষাই আর বাজেটের পরিসংখ্যানই ‘আচ্ছে দিন’-এর ‘বুরে হাল’টা ঢেকে রাখতে পারবে না। রোহিত ভেমুলার ধাক্কায় দলিতরাও সোচ্চার। আর
বামপন্থীরা ‘জাতীয়তা-বিরোধী’। এই রণধ্বনি তোলাটা জরুরি
কারণ এরাই কর্পোরেট এবং হিন্দুত্বের যৌথ কার্যকলাপের ইতিবৃত্তটি রাজনৈতিকভাবে
প্রতিষ্ঠিত করবার প্রশ্নে সক্ষম এবং দৃঢ়
একটি শক্তি। এরাই পারে অনেককে জড়িয়ে নিতে। সুতরাং, ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’। মিশন মেরুকরণ। ‘জাতীয়তাবাদ’
আর ‘জাতীয়তা-বিরোধিতা’র।
‘দেশভক্তি’ আর ‘দেশদ্রোহে’র।
৮.
গল্পটা শেষ হলেও নটে গাছটা মুড়োয়
না। জাতীয়তাবাদের এই সশব্দ অভিযানের পেছনে আরেকটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যও আছে। আসলে
যারা অকাতরে জাতীয়তাবাদের,
দেশভক্তির সার্টিফিকেট বিলি করছে তাদের জন্ম যে বিশ্বাসঘাতকতার
ঔরসেই, তা কারোরই অজানা নয়। ১৯২৫-এ যাদের জন্ম তাদের বৌদ্ধিক
মতাদর্শগত প্রাথমিক পাঠ জেমস মিলের ‘ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’-র ইতিহাসকথনে। ভারতবর্ষের ইতিহাস হিন্দু আর মুসলমান জাতিসত্তা আর তার
মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতের ইতিহাস! যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’-এর জনক, সেটাই
হিন্দু জাতীয়তাবাদেরও ধাতৃ। তাই আগাগোড়া দেশজোড়া ব্রিটিশবিরোধী সাধারণ মানুষের
স্বাধীনতা আন্দোলনকে সযত্নে এড়িয়ে চলা। ১৯৪৩-৪৪ সালে হিন্দু মহাসভার মুসলিম লিগের
সঙ্গে মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির
ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা, সাভারকার, অটলবিহারীর মুচলেকা আর শেষমেশ গান্ধীহত্যা গডসের হাতে। দোষ তো স্খালন
করতেই হবে। প্যাটেল নেতাজীর জন্য কুম্ভীরাশ্রু বইয়ে দিয়েও নিজেদের জাতীয়তাবাদী
ক্রেডেনশিয়াল বিশ্বাসযোগ্যতার ধারেকাছেও যেতে পারছে না। ব্রিটিশ সরকারের গোপন
নথিতে লেখা আর এস এস-এর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট কি এত সহজে মোছা যায়! তাই এই ছদ্মযুদ্ধ! ছদ্ম জাতীয়তাবাদীদের। চেনা হয়ে গেছে তুমি তো
আসলে-‘গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও’। কিন্তু এ যুদ্ধে পরাজয়
অনিবার্য। বামপন্থীরা তো আছেই। দেশের সংবিধানের ভিত্তিতে যাদের বিশ্বাস তারা সবাই
আছে, আছেন রবীন্দ্রনাথ, আম্বেদকার। আরো অনেকে। যাঁরা
ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ রাস্তায়; জাতি-ধর্ম
নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের
সাধনায়। ভোটে জিতে মোদীর হাত ধরে যতই সুখস্বপ্ন হাজির হোক না কেন ধর্মনিরপেক্ষ
আর্থিক সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রবাদী ভারতীয়
সংবিধানের ভিত্তিকে প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা অটুট রাখবেনই।
সত্যমেব জয়তে। জয়তু ভারতবর্ষ।