20160229

‘তুমি তো মানুষ নও, গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও’

নীলোৎপল বসু

আচমকাই শুরু হয়েছে বিতর্ক। দেশপ্রেমিকআর দেশবিরোধীদের। কিংবা জাতীয়তাবাদীআর জাতীয়তা-বিরোধীদের মধ্যে। হেঁয়ালি না করে খোলসা করেই বলা যাক।
৯ই ফেব্রুয়ারির একটি ঘটনা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গোষ্ঠী একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। প্রথমে অনুমতি দিলেও অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব মুহূর্তে সেই অনুমতি প্রত্যাহারও হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ আর এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এ ভি বি পি-র অভিযোগ এবং দাবি মেনে অনুমতি বাতিল করে দেয়। এই অনুষ্ঠানে কথিত কিছু স্লোগান ওঠে। কথিতশব্দটি এইজন্য ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ এই অনুষ্ঠানের কোনো প্রামাণ্য সাক্ষ্য নেই। একটি হিন্দি চ্যানেলে যে ভিডিও রেকর্ডিং হয়েছিল এবং যেটি এই চ্যানেল সহ আরো কয়েকটি চ্যানেলে দেখানো হয় তার ভিত্তিতেই গোটা দেশ তোলপাড়। কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত যে, এই ভিডিওটির বিষয়বস্তু সত্যঘটনা নির্ভর নয়, বিকৃত করা হয়েছে সচেতনভাবে।
৯ তারিখের ঐ ঘটনার পর পুলিশ যে এফ আই আর করে তাতে অনুষ্ঠানের আয়োজক এবং এ ভি বি পি-র মধ্যে বচসার পরে কারুরই নাম উল্লিখিত ছিল না। পরবর্তীতে দিল্লির একজন বি জে পি এম পি মহেশ গিরি ২০ জন বামপন্থী ছাত্রছাত্রীর নাম দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে। একনম্বরেই থাকে নির্বাচিত ছাত্রসংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারের নাম।
পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গরম বক্তৃতা দিয়ে দিল্লি পুলিশকে ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। গোলমালটা শুরু হলো এখান থেকেই। এতদিন পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে সংসদ আর বিধানসভায় পাশ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ভিত্তিতে। এর মূল বনিয়াদ স্বায়ত্তশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতেই সম্পূর্ণ অধিকার এবং আইনি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা । যার সমাধান হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় চৌহদ্দিতেই সেটাই হয়ে উঠল জাতীয়তাবাদএবং জাতীয়তা-বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দু।
১.
আসলে জে এনইউ-র ঐ বিতর্কিত ঘটনা নিছকই উপলক্ষ। পরিকল্পনাটা আগেই ছিল। এবং আচমকাও নয়। উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার মতাদর্শের দখল চাই। এটাই আর এস এস-এর দীর্ঘলালিত স্বপ্ন বলা যেতে পারে। সরকার তৈরি হওয়ার পরেই দীননাথ বাত্রা, সুদর্শন রাও-দের সরস্বতীর কমলবনে মত্ত হস্তীসুলভ সশব্দ পদচারণা বৌদ্ধিক জগৎকে সচকিত করেছে। পুনের এফ টি আই আই-এ গজেন্দ্র চৌহান আর এস এস-এর তত্ত্বাবধানে স্বনামধন্য চেয়ারম্যান। আই আই টি চেন্নাইয়ের দলিত ছাত্রদের আলোচনার কেন্দ্র পেরিয়ার আম্বেদকার স্টাডি সার্কেল স্মৃতি ইরানির হস্তক্ষেপে রাষ্ট্ররোষের সম্মুখীন। আর হিন্দুত্বের অবিচ্ছেদ্য উপাদান বর্ণাশ্রম, দলিতদেরও এই রোষ থেকে বঞ্চিত করছে না! আসলে উচ্চশিক্ষায় দলিত ছাত্রদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের ইতিহাস অধুনা নয়। কিন্তু আর এস এস এবং মোদী সরকারের বদান্যতায় তা তীব্র গতিবেগ অর্জন করেছে। অতঃপর রোহিত ভেমুলা। এবং আত্মহত্যার প্রাক্‌মুহূর্তে জবানবন্দি ঐতিহাসিক চেহারা নিয়ে তুফান তুলেছে গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধির মননে। দলিতদের সামাজিক যন্ত্রণার শরিক হয়েছে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ। হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরে গোটা দেশেই ঝড় উঠেছে। প্রাথমিকভাবে ছাত্রদের মধ্যে কিন্তু পরবর্তীতে সামগ্রিকভাবে সমাজেই। কোণঠাসা হয়েছে সরকার। কারণ সেখানেও স্পষ্ট স্থানীয় এম পি যিনি মোদী সরকারের সদস্যও বটে - বান্দারু দত্তাত্রেয় এবং মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অতিসক্রিয়তা। আর এস এস নামেই সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন! ভোটটা ভালোই বোঝে! অতঃ কিম্‌? বৌদ্ধিক জগতের দখল নিতে গেলে আক্রমণের বর্শাফলক ঘোরাতে হবে বামপন্থীদের দিকে। ফলে মিশন জে এন ইউ। আর ছিটপুট মূল ধারা বিচ্ছিন্ন কোনো ক্ষুদ্র ছাত্রগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কামান দেগে লাভ কী আছে, ফলে গল্পের গোরু গাছে উঠল’! ৯ তারিখের ঘটনায় দেশদ্রোহ আইনে ১২ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেল থেকে গ্রেপ্তার হলো ছাত্রসংসদের নির্বাচিত সভাপতি কানহাইয়া কুমার।
২.
দু-তিনটি চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’ – বামপন্থীরা জাতীয়তা-বিরোধীযুদ্ধের সময়ে যে ধরনের উগ্র জাত্যাভিমান তৈরি করা হয় ঠিক একই কায়দায় চলল গোয়েবেলসীয় অভিযান। ইতিমধ্যে প্রতিরোধের গ্রানাইট পাঁচিলও উঠে গেছে। জে এন ইউ-তে তৈরি হয়েছে দলমত নির্বিশেষে ছাত্রসমাজের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। অবশ্যই জে এন ইউ-র ছাত্রসংসদের নেতৃত্বে এবং বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলির সম্মিলিত উদ্যোগে। পাশে এসে দাঁড়ালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ। নির্বাচিত জে এন ইউটিএ। আর  প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে পড়ল দেশের নানা প্রান্তে। ছাত্ররা তো বটেই, সমাজের বিভিন্ন অংশের গণতান্ত্রিকরাও শামিল।
৩.
একদিকে যখন জোরালো প্রতিবাদ - ষড়যন্ত্রের জালও বিস্তৃত হলো। ১৩ই ফেব্রুয়ারি বামপন্থী দলের নেতারা অন্য কয়েকটি সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর সাথে। প্রশ্ন তোলা হলো সরকারের নিশানায় কেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন এবং তাদের নেতৃত্ব? বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে কোনোদিন কেউ তাদের নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তুলতে পারেনি। তাহলে কেন কানহাইয়া কুমার বা অভিযোগে কেন বামপন্থী ছাত্রদের নাম? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরুত্তর। প্রশ্ন উঠল সাক্ষ্য নিয়েও। জে এন ইউ-তে সিসিটিভি নেই, দিল্লি পুলিশের নিযুক্ত কোনো ভিডিওগ্রাফারও ঐ ভিডিও তোলে নি, তাহলে কোথা থেকে এল ঐ ভিডিও? যা গোটা দেশকে বিভাজিত করে দিচ্ছে সংঘের শাখা সংগঠনগুলির সক্রিয় এবং সহিংস উদ্যোগের? দাবি তোলা হলো ঐ ভিডিও নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার- যা সন্দেহাতীতভাবেই ভিডিওটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
কিন্তু নৈব নৈব চ! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তেজনার পারদ চড়ালেন। তিনি তখন শিকারি। কারণ আগের সন্ধেতেই বিশাল সংহতি সভা হয়েছে কানহাইয়া কুমারের মুক্তির দাবিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। বামপন্থীরা তো বটেই, কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সেখানে হাজির। জাতীয়তা-বিরোধীদের তালিকাও দীর্ঘ হলো! এককথায় যারাই বি জে পি সংঘের সঙ্গে নেই-তারাই জাতীয়তা-বিরোধী। অনেকটাই জর্জ বুশ মাফিক ইফ্‌ ইউ আর নট উইথ আস্‌, ইউ আর উইথ দেম্‌’ ! কারণটাও সর্বজনবিদিত। আর এস এস-এর মতাদর্শের প্রাথমিক পাঠ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ধরেই। মোদী-ভাগবতদের হাত ধরে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছেকাজেই বামপন্থীদের পিছনে যে সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদীরাও রয়েছে এটা প্রমাণ করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করলেন জে এন ইউ-র ছাত্রদের পাশে হাফিজ সৈয়দের উপস্থিতি। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল পঁচা শামুকে পা কেটেছে! হাফিজ সৈয়দের যে টুইটার বার্তাকে ভিত্তি করে রাজনাথ সিং-এর এই মন্তব্য, পরিষ্কার হলো যে সেটি একটি ফেক অ্যাকাউন্ট। লজ্জা শরম থাকলে হয়তো ক্ষমা চাইতেন। যেকোনো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নিশ্চয়ই লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন সেদিন।
৪.
কিন্তু জে এন ইউতে আটকে থাকলে তো চলবে না। আরো আক্রমণ। সি পি আই (এম)এর কেন্দ্রীয় দপ্তর আক্রমণ করা, টেলিফোনে সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদীয় নেতা সীতারাম ইয়েচুরিকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি -  এ প্রায় তিরিশের দশকের জার্মানির মার্টিন নিয়েমুলারের কবিতার পুনরাবৃত্ত ভারতীয় দৃশ্যপট। বাড়তি আকর্ষণ আসন্ন আগামীতেই পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার মধ্যে দুটির নাম পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালা। মেরুকরণের প্রয়োগ এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে গণউন্মাদনা সৃষ্টি করার সুবর্ণ সুযোগ। অনিবার্যভাবেই বাঙ্ময় তৃণমূল কংগ্রেসের হৃদয়বিদারক নৈঃশব্দ!
৫.
কিন্তু ফ্যাসিবাদী হামলার একটি অন্যতম লক্ষণ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপরে আক্রমণ। স্পষ্ট হলো দিল্লির পাতিয়ালা হাউজের ঘটনায়। দেশের রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে সেশন কোর্ট। কালো কোর্টে ভূষিত উকিলরূপী সংঘের ঝটিকাবাহিনীর মত্ততার অভিযান। কানহাইয়াকে কার্যত আদালতে তুলতেই পারল না পুলিশ। আক্রান্ত হলেন জে এন ইউর অধ্যাপক অধ্যাপিকারা, সংবাদকর্মীরা। ফেলে পেটানো হলো। টিভির পর্দায় দেখা গেল নির্বাচিত বি জে পি-র বিধায়ক সেই শারীরিক আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রশ্ন করলেই ছুঁড়ে দেওয়া হয় উদ্ধত উত্তর। ওরা সবাই পাকিস্তানপন্থী, ‘জাতীয়তাবিরোধী’! ফলে জাতীয়তাবাদীদের দেশের আইন মানার কোনো দরকার নেই। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করল দুদিন পর। কিন্তু আবারো প্রায় একইরকম ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। আহত হলেন কানহাইয়া কুমার। পুলিশের দেওয়া মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু কোনো অনুশোচনা নেই, কোনো নিন্দাও শোনা গেল না সরকার বা শাসকদলের পক্ষ থেকে। কারণটাও স্পষ্ট। জাতীয়তাবাদীপ্রচারের ক্ষতি হতে পারে। ইতিমধ্যেই রাজধানীতে সাংবাদিকদের বিপুল প্রতিবাদ। বাজপেয়ী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরাবজী সহ দেশের অগ্রগণ্য আইনজীবী- বিশেষজ্ঞরা সরকারের বিরুদ্ধে মুখর। প্রশাসন বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে পারছে না। কিন্তু মেরুকরণের স্বপ্নে উদ্ভাষিত আর এস এস মশগুল। বাংলায় বলতে গেলে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’!
৬.
কিন্তু শেষপর্যন্ত বোমাটা ফাটল। একটি মিডিয়া চ্যানেলই যা সরকারের করার কথা ছিল তাই করে দেখালো। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত পরীক্ষার মধ্যে পুনরাভিনীত হলো কীভাবে যে ভিডিও পুলিশি তৎপরতার ভিত্তি, আর এস এস-এর প্রচারের বর্শাফলক সেই ভিডিওটিই আসলে ভিত্তিহীন, সচেতনভাবেই পুনর্নির্মিত। অন্য কেউ হলে লজ্জায় ধরণী দ্বিধা হওবলে উধাও হতো। কিন্তু আর এস এস এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের চোখের চামড়া আছে বলে কেউ অভিযোগ করতে পারবে না! তাই অভিযান চলছে। জে এন ইউ থেকে যাদবপুর, দেশের সর্বত্র। বিজেপি নেতারা গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন জাতীয়তাবিরোধী দেখলেই আগে ফেলে পেটাও, পরে বিচারএই তালিকায় বঙ্গবাসী রাহুল সিংহ তার নাম যুক্ত করেছেন
৭.
কিন্তু কেন এই বিতর্ক? আসলে এই মতাদর্শগত অভিযান শুরু করার একটি অন্যতম কারণ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি উপলব্ধি। আচ্ছে দিনআসলে আচ্ছে নয়। সাধারণ মানুষের। অবশ্যই আম্বানি, আদানিরা এর মধ্যে নেই। তাদের নিশ্চয়ই সুদিন। বড়জোর নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে মুনাফার মাত্রা নিয়ে। কৃষকরা আত্মহত্যা করছে অনেক বেশি সংখ্যায়। চাবাগান শ্রমিকরা মরছে অনাহারে। চটকল, অন্যান্য কল-কারখানা বন্ধ। শিল্প উৎপাদনের সূচকও নিম্নগামী। কৃষি উৎপাদনেরও তাই। আবহাওয়ার পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিপূরণের অপ্রতুলতায় গ্রামের শ্রমজীবীদের ত্রাহি ত্রাহি রব। বাজেট অধিবেশন আসছে। ব্যাঙ্কগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের ঋণের টাকা পুনরুদ্ধার করতে না পেরে। ট্যাক্স উশুল করার বদলে বড়লোকদের ছাড় দিতেই ব্যস্ত সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান প্রকল্পে বিনিয়োগ করার টাকা নেই বাড়ন্ত। গ্রামে শহরে মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রবণতার লক্ষণগুলি স্পষ্ট। কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হবে সংসদের বাজেট অধিবেশন। সরকারের আর্থিক সমীক্ষাই আর বাজেটের পরিসংখ্যানই আচ্ছে দিন’-এর বুরে হালটা ঢেকে রাখতে পারবে না। রোহিত ভেমুলার ধাক্কায় দলিতরাও সোচ্চার। আর বামপন্থীরা জাতীয়তা-বিরোধীএই রণধ্বনি তোলাটা জরুরি কারণ এরাই কর্পোরেট এবং হিন্দুত্বের যৌথ কার্যকলাপের ইতিবৃত্তটি রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রশ্নে  সক্ষম এবং দৃঢ় একটি শক্তি। এরাই পারে অনেককে জড়িয়ে নিতে। সুতরাং, ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়ামিশন মেরুকরণ। জাতীয়তাবাদআর জাতীয়তা-বিরোধিতার। দেশভক্তিআর দেশদ্রোহের।
৮.
গল্পটা শেষ হলেও নটে গাছটা মুড়োয় না। জাতীয়তাবাদের এই সশব্দ অভিযানের পেছনে আরেকটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যও আছে। আসলে যারা অকাতরে জাতীয়তাবাদের, দেশভক্তির সার্টিফিকেট বিলি করছে তাদের জন্ম যে বিশ্বাসঘাতকতার ঔরসেই, তা কারোরই অজানা নয়। ১৯২৫-এ যাদের জন্ম তাদের বৌদ্ধিক মতাদর্শগত প্রাথমিক পাঠ জেমস মিলের ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’-র ইতিহাসকথনে। ভারতবর্ষের ইতিহাস হিন্দু আর মুসলমান জাতিসত্তা আর তার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতের ইতিহাস! যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের ডিভাইড এন্ড রুল’-এর জনক, সেটাই হিন্দু জাতীয়তাবাদেরও ধাতৃ। তাই আগাগোড়া দেশজোড়া ব্রিটিশবিরোধী সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সযত্নে এড়িয়ে চলা। ১৯৪৩-৪৪ সালে হিন্দু মহাসভার মুসলিম লিগের সঙ্গে মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা, সাভারকার, অটলবিহারীর মুচলেকা আর শেষমেশ গান্ধীহত্যা গডসের হাতে। দোষ তো স্খালন করতেই হবে। প্যাটেল নেতাজীর জন্য কুম্ভীরাশ্রু বইয়ে দিয়েও নিজেদের জাতীয়তাবাদী ক্রেডেনশিয়াল বিশ্বাসযোগ্যতার ধারেকাছেও যেতে পারছে না। ব্রিটিশ সরকারের গোপন নথিতে লেখা আর এস এস-এর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট কি এত সহজে মোছা যায়!  তাই এই ছদ্মযুদ্ধ!  ছদ্ম জাতীয়তাবাদীদের। চেনা হয়ে গেছে তুমি তো আসলে-গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বওকিন্তু এ যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। বামপন্থীরা তো আছেই। দেশের সংবিধানের ভিত্তিতে যাদের বিশ্বাস তারা সবাই আছে, আছেন রবীন্দ্রনাথ, আম্বেদকার। আরো অনেকে। যাঁরা ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ রাস্তায়; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনায়। ভোটে জিতে মোদীর হাত ধরে যতই সুখস্বপ্ন হাজির হোক না কেন ধর্মনিরপেক্ষ আর্থিক সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রবাদী ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিকে প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা অটুট রাখবেনই।

সত্যমেব জয়তে। জয়তু ভারতবর্ষ।

দেশদ্রোহী কে?


ইরফান হাবিব

দেশদ্রোহীতা কি? কে দেশদ্রোহী আর কে নয়? দেশের অর্থ কখনোই এটা নয় যে যাদের সরকার চলছে তাদের মান্যতা দেওয়াই দেশপ্রেম। বলা হয়ে থাকে কোনো দেশের সীমাটাই দেশ। জন স্টুয়ার্ট মিল বা অন্য কারো কথা দেখে নিন, কোথাও বলা নেই যে শুধু জমিটাই দেশ। দেশ তৈরি হয় জনগণকে নিয়ে। নাগরিকদের নিয়েই দেশ। তাদের মধ্যে একটা চেতনাবোধ থাকা প্রয়োজন যে আমরা একজোট, একটা দেশ। মানুষ যেখানে থাকে সেখানে দেশ স্থাপন করে। আমাদের সীমানা সিয়াচেন পর্যন্ত না তার থেকে বেশি অথবা আকসাই চীন আমাদের কী আমাদের নয়, এর সঙ্গে দেশের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের অর্থ তার নাগরিকদের কল্যাণে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করা প্রয়োজন যে দেশপ্রেমী অথবা দেশদ্রোহী কে?
সিয়াচেনে কিছুদিন আগে আমাদের কয়েকজন জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন। একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে তিনিও মারা যান। এখন কেউ যদি ব‍‌লেন ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় আমাদের জওয়ানদের পাঠাবেন না, তাহলে তিনি কি দেশদ্রোহী? পা‍‌কিস্তান যদি বলে আমরা সেনা সরিয়ে নিচ্ছি, আপনারাও সরিয়ে নিন। এখন যেটা বর্ডার তাকে মেনে নেওয়া হোক। একটা টিম বানানো হোক, যারা দেখবে দুদিক থেকে এর উলঙ্ঘন হচ্ছে না। এটা মানতে কী বিরোধিতা হয়? সংবাদপত্রে খবর হয়েছে এর আগে পাকিস্তানে সেনারা যখন এভাবে মারা গেছি‍‌লেন তখন বড় বড় সেনা জেনারেল, মেজর জেনারেল সেখানে ‍গিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তান প্রস্তাব দিয়েছিল যে দুদিক থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া হোক। এবারও এই ঘটনার পর পাকিস্তান ফের প্রস্তাব দিয়েছে দুদিক থেকে সেনা সরানো হোক। আমাদের বড় বড় সেনা আধিকারিকরা তা খারিজ করে দিয়েছেন। তারা তো এখানে এ. সি. ঘরে বসে আছেন। এরা জাতীয়তাবাদী? যারা এখানে বসে সিয়াচেনে সেনাদের পাঠাচ্ছেন‍‌ তাদের মৃত্যু হতে পারে জেনেও, তারা  দেশদ্রোহী নয়, কিন্তু যারা বলছেন ওখানে জওয়ানদের পাঠিও নাগরিব লোক, এভাবে মেরো না। তারা দেশদ্রোহী? তাহলে কাকে বলবো জাতীয়বাদী? জে এন ইউ-র ঘটনাতেও এই দেশদ্রোহীতার অভিযোগ লাগানো হয়েছে। সিয়াচেনে আমাদের জওয়ান শহীদ হচ্ছে আর এরা এখানে দেশ বিরোধিতা করছে- এমনই বক্তব্য। জওয়ানদের ওখানে কে পাঠাচ্ছে? জে এন ইউ-র ছাত্ররা?
আমাদের সংবিধানে বাক্‌স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। সংবিধানেও এই অধিকার দেওয়া হয়েছে যে কেউ চাইলে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। আজকাল যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা বলা হচ্ছে কোথাও তা লেখা নেই। সরকারের সাথে কেউ সহমত হোক বা না হোক তার বাক্‌স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার আছে।
জে এন ইউ-তে অনেক ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তার মধ্যে কিছু ভুল স্লোগানও থাকতে পারে। যা অন্য কারো ভাবনায় আঘাত দিয়ে থাকতে পারে। সত্যি-মিথ্যে বলতে পারবো না, কিন্তু কিছু লোক দাবি করছেন ওখানে স্লোগান দেওয়া হয়েছে ভারতের বরবাদির। যারা এই ধরনের স্লোগান দেন তাদের কাছে আমার একটাই বক্তব্য বি জে পির হাত শক্ত করবেন না। ভারত বিরাট বড় বিষয়। আপনারা বল‍‌লেই ভারত বরবাদ হবে না। কিন্তু এমন কাজ করবেন না যাতে বি জে পি মজবুত হয়। আপনারা বরবাদ করুন না করুন, কিন্তু বি জে পি নিশ্চয়ই বরবাদ করবে। বি জে পি-কে এই কাজ করার সুযোগ দেবেন না। কিন্তু এর সঙ্গেই আমি বলবো যতটা সম্ভব আজাদিদেওয়া যায়, তা দেওয়া উচিত। যতক্ষণ বিতর্ক হবে না, কথা হবে না, ভাবের আদান প্রদান হবে না, ভারত এগোবে না। এই জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে সকলে নিজের মত জানাতে পারবে। হিন্দুস্তান সবার। সব অংশের মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা দিতে হবে। সে মণিপুর হোক, নাগাল্যান্ড হোক অথবা কাশ্মীর। শুধু কাশ্মীর ভারতের অংশ না, কাশ্মীরীরাও ভারতীয়। কিন্তু বি জে পি-র নীতি আলাদা। নাগপুর (আর এস এস সদর দপ্তর) মনে করে নাগাল্যান্ড, মণিপুর তাদের গোলাম। আমাদের তা নীতি নয়। আমরা মনে করি সবাই তাদের কথা বলবেন। এটা আমাদের কর্তব্য আমরা যদি সত্যিই কাশ্মীরকে ভারতের অংশ মনে করি, তাহলে কাশ্মীরীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন? তাদের ভুয়ো সংঘর্ষে মারা হবে না। তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে না। ওদের যাতে এটা মনে না হয় যে, যারা হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো কিন্তু আফজল গুরুকে শূলে চড়ানো হলো। এই ধারণা যেন না হয় যে ওকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে কারণ সে মুসলমান ছিল, কাশ্মীরী ছিল। কারো যদি মনে হয় যে এটা ন্যায়বিচার হলো না। আমি ন্যায় পেলাম না। এই কথা বলার য‍‌দি অধিকার না থাকে তাহলে গণতন্ত্রই থাকবে না ভারতে। তাই যদি আমাদের দেশের কাজ করতে হয়, তাহলে প্রত্যেককে বলতে দিতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়ন হবে না। যারা মানুষকে কথা বলতে বাধা দিচ্ছে তারাই দেশদ্রোহী। যারা গুন্ডামি করছে তারাই দেশদ্রোহী। এরা কারা যারা অন্যকে দেশদ্রোহী বলছে? গুণ্ডারা সব সময় নিজেদের সব থেকে বড় দেশপ্রেমিক বলে, জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে। আপনারা টিভিতে দেখেছেন, কাগজেও এসেছে, ‘গুন্ডা ন্যাশনালিজমশব্দটা। আদালত চত্বরে আইনজীবীরা বলছেন মেরে ফেলবো। গুলি করবো। তখন এই গুন্ডা ন্যাশনালিজমশব্দটাই যথার্থ মনে হয়।
আর এস এস, বি জে পি নিজেদের সব থেকে বড় দেশভক্ত বলে। ১৯২৫ সালে আর এস এসের প্রতিষ্ঠা। অসহযোগ আন্দোলনের পরে কিছু লোক মুসলিম লিগে, কিছু লোক হিন্দু মহাসভায় চলে যায়। আর কিছু লোক আর এস এসে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। শুরু থেকেই এদের প্রতারণা ছিল। গোলওয়ালকার বলেছেন, আমরা চাইতাম হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ বানাতে। কিন্তু কেউ কেউ পরামর্শ দি‌য়েছিলেন যে নামের মধ্যে রাষ্ট্রীয়শব্দটা রাখো। এটা শুধু হিন্দুদের বিষয় তা গোপন কর। সম্ভবত ব্রিটিশকে কোনো কারণে খুশি করার জন্য সেই সময় রাষ্ট্রীয়নাম রাখে। অর্থাৎ শুরু থেকেই ধোঁকাদারি।
শুরু থেকেই তাদের শত্রু কে ছিল? ব্রিটিশরা নয়। যারা ভারতে শাসন করছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতা ছিল। তারাও তো হিন্দুদের মত ব্রিটিশ শাসনে নিস্পেষিত ছিল। মুসলিম লি‍গের মত যারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ছিল। আর অপরদিকে আর এস এস, হিন্দু মহাসভা মুসলিমদের বিরুদ্ধে। পারস্পরিক বিরোধের জেরে আসলে ব্রিটিশদের হয়েই কাজ করছিল এরা। তাদের সুবিধে করছিল।
১৯৩৮ সা‍‌লে আর এস এসের সরসংঘচালক গোলওয়ালকার ‘‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইন্ডবই লেখেন। সেখানেই স্পষ্ট ছিল হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্য। এরা যখন ১৯২৫ সালে আর এস এস তৈরি করে তখনই এটা স্থির করেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের নীতি শুধু মুসলিম লিগের নয়। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের স্লোগান তো আগেই দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি হয়েও সাভারকার একই কথা বলে‍‌ছিলেন। হিন্দু আর মুসলিম দুটি আলাদা রাষ্ট্র হবে। এরা জাতীয়তাবাদী? রাষ্ট্র, জাতির ভাগ চায় যারা, তারা রাষ্ট্রভক্ত? এরা বলে হিন্দুস্তানের বরবাদী শুরু হয়েছে যবে থেকে মুসলমানরা এখানে এসেছে। সব সময় বলে আমরা এক হাজার বছর পরাধীন ছিলাম। কিন্তু দুশো বছরের ব্রিটিশের গোলামির বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি এরা। ১৯২৫ থেকে ৪৭ পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ করেনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। এরা হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলে, মোদী যা বানাতে চায়। এই প্রসঙ্গে গোলওয়ালকার কী বলেছে? সেই হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলমানদের কী হবে? হয় হিন্দু হয়ে যেতে হবে নতুবা হিন্দুরাষ্ট্রের গোলাম হয়ে থাকতে হবে। কোনো অধিকার থাকবে না। কোনো ন্যায়বিচারের অধিকার থাকবে না এমনকি তাদের নাগরিকত্বও থাকবে না। ভারতের জনগণের একটা বড় অংশকে বলে দেওয়া হলো তাদের কোনো অধিকার থাকবে না। এরা দেশদ্রোহী নয়?
সাভারকার তো ব্রিটিশকে মুচলেকা দিয়ে এসেছিলেন। গোটা জীবনে আর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ১৯৪৩-এ ব্রিটিশ যখন এদের প্যারেড, অস্ত্র চালনার আপত্তি জানালো, গোলওয়ালকার লিখে দিলেন প্যারেড করবো না। কোনো ইউনিফর্ম পরবো না। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছিল, এদের নিয়ে ব্রিটিশদের কোনো বিপদ নেই, মুসলিমদের থাকলে থাকতে পারে।
এরপর ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা এলো। গান্ধীজী হত্যার পর সর্দার প্যাটেল যিনি এদের উপর নিষেধাজ্ঞা তোলার সও‌য়াল করেছিলেন, তিনি চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে লিখলেন- গান্ধীজী হত্যায় এদের হাত আছে কিনা তার প্রমাণ মেলেনি, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এরা নিরীহ মুসলমানদের অনেক মেরেছে। রক্তে রাঙা এদের হাত। ব্রিটিশদের নিয়ে এই আর এস এসের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না, কিন্তু নিরীহ নারী-শিশুদের মারতে এরা দক্ষ ছিল। গান্ধীজীর মৃত্যুতে এরা মিষ্টি বিলি করেছিল। এরা দেশদ্রোহী নয় তো কে দেশদ্রোহী? দেশভাগের পর মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং আর এস এস-ই দুপক্ষে গণহত্যা করিয়েছে। কে হিসেব রাখবে কে আগে কে পরে করেছে?
নিষেধাজ্ঞা তোলা হবে কি না সেই আলোচনার সময় ১৯৪৮ সালে সর্দার প্যাটেল যখন ভারতের সংবিধান এবং জাতীয় পতাকাকে স্বীকার করার কথা বলেছিলেন, তখন অস্বীকার করেছিল আর এস এস। এখন নির্দেশ দিচ্ছেন সব জায়গায় ঝান্ডা লাগাতে হবে। ৪৮-এ মানেননি কেন? এখন জাতীয়তাবাদী আর দেশদ্রোহী বিতর্ক তুলে জাতীয় পতাকা মনে পড়েছে?
এরপর কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল, তাহলে আর এস এসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠবে না। জেলেই থাকতে হবে নেতাদের। তখন বাধ্য হয়ে মুচলেকা দিয়েছিল বলেছিল, সংবিধান মানবে এবং জাতীয় পতাকাকে স্বীকার করবে। জেলে থাকতে হবে শুনেই মুচলেকা দিয়েছিল। এত বাহাদুর ছিল এরা! মুচলেকা দি‌য়ে বলেছিল, জাতীয় পতাকাকেও মানি, সংবিধানও মানি। আসলে সবই ধোঁকাবাজি ছিল। মা‍নতো না কোনোটাই। চিরকাল ওরা গেরুয়া পতাকাকেই স্যালুট করেছে। জাতীয় পতাকাকে নয়। স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার এদের দেশবিরোধী বলে ঘোষণা করেছিল। তারা এখন অন্যদের দেশবিরোধী বলছে।
দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে খুব সম্মান হচ্ছে এখন। রাস্তাও হচ্ছে। ১৯৬১ সালে উনি বলেছিলেন গান্ধীজী রাষ্ট্রপিতা নন। কল্যাণ সিং যখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ‍‌তিনিও ঐ একই কথা বলেছিলেন। ও‍‌দের দাবি বেদের সময় থেকে আমাদের রাষ্ট্র। গান্ধীজী কীভাবে রাষ্ট্রপিতা হবেন? বেদে তো রাষ্ট্রের কোনো বিষয় নেই। ভারত নামই নেই বেদের কোথাও। কী করে রাষ্ট্র বেদের সময় থেকে হয়ে গেল?
এই পু‍‌রো সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় অবদান আছে। জে এন ইউ-র আগে হায়দরাবাদে হয়েছে। এটা পুরো ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্র। ঠিক যেভাবে নাৎসিরা জার্মানিতে করেছিল। জনগণের স্বাধীনতা হরণ করছে এরা। যেখানে এদের সরকার আছে সেখানেই চেষ্টা চলছে, সর্বত্র পারছে না। চেষ্টা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে কোনো বিতর্ক না হয়। গুন্ডাগর্দি করছে। এ বি‍‌ ভি পি-কে ব্যবহার করছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার ক্ষেত্রে যা করেছেন। হায়দরাবাদেও এই ঘটনার পিছনে এ বি ভি পি ছিল। জে এন ইউতেও এ বি ভি পি-কে দিয়ে এত নোংরাভাবে এই কাজ‍‌ করালো যে প্রতিবাদে তাদের তিন নেতাই ইস্তফা দিয়েছে। এসবই নাৎসি জার্মানি থেকে এরা শিখেছে। গোলওয়ালকার বলেছিল, যেভাবে নাৎসিরা ইহুদিদের হত্যা করেছিল, এখানেও তাই হওয়া উচিত অর্থাৎ মুসলিমদের খুন করো।
ভারতের সংবিধানে বলা হয়েছে সরকার মিশ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে। এন ডি এ সরকার ছাড়া এদের আগে কংগ্রেস এবং অন্য যে সরকার ছিল তাদের আর যে ত্রুটিই থাক, সকলেই মিশ্র সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে। আর এস এস মিশ্র সংস্কৃতির সব সময় বিরোধিতা করেছে। আদবানিজী আজকাল খুব নরমপন্থী হয়েছেন। তিনি এক সময়ে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, মিশ্র সংস্কৃতির মত খারাপ জিনিস আর কিছু নেই। হিন্দু আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি হওয়া চাই। মিশ্র সংস্কৃতিতে তো মুসলিম, খ্রিস্টান, পারসি, সবাই থাকবে। এই মিশ্র সংস্কৃতিকে ধংস করতে চায় আর এস এস। এটাই সবথেকে ভয়ংকর।
তাই যে বিবাদ এসেছে তা খুব বড় বিপদ। এদের আগের সরকার স্কুল পাঠ্যবই বদলে দিয়েছিল। এবার ক্ষমতা বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করেছে। সারা দেশের জনতার এখন একজোট হওয়া প্রয়োজন এদের বিরুদ্ধে। মাত্র ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে এরা সরকার চালাচ্ছে। ৬৯ শতাংশ এদের বিরুদ্ধে। এখন যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানেই এদের ফল খারাপ হচ্ছে। ফলে এদের ফ্যাসিস্ট গুন্ডাগিরি আরো বাড়বে। যে যে শক্তি এদের মোকাবিলা করতে পারবে তাদের এক জায়গায় আসতে হবে। যতক্ষণ না তা হচ্ছে ফ্যাসিবাদকে রোখা যাবে না। তাই বামপন্থী এবং অবামপন্থী এমন গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক মঞ্চে আসতে হবে। যদি এক মঞ্চে আসতে না-ও পারেন, তাহলে যেভাবে সম্ভব পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। যা জে এন ইউয়ের ঘটনায় হয়েছে। কংগ্রেস এবং সব বামপন্থীরা এক জায়গায় এসেছে। তাই যত বদমাশি এরা করছে জে এন ইউ নিয়ে, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদীদের টেনে এনেছে, ভুয়ো ভিডিও বানিয়েছে- তাতে সফল হয়নি। কারণ বিরোধীরা একটা বড় ফ্রন্ট বানাতে পেরেছে। আমাদের ছোট মতপার্থক্যকে পাশে সরিয়ে রেখে এখন একজোট হতে হবে, কারণ এতেই দেশকে রক্ষা করা যাবে।

কে দেশদ্রোহী — কানহাইয়া? ছোঃ!

শ্রুতিনাথ প্রহরাজ

একটু একটু করে ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ঘিরে বি জে পি তথা আর এস এস-এর নখ দাঁত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। নিজেদের উগ্র সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কর্মসূচিকে সফল করতে আর এস এস এখন ক্যাম্পাস দখলের নেশায় মত্ত। ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসবার পর ভারতবর্ষের দীর্ঘদিন ধরে লালিত বহুত্ববাদের সংস্কৃতি, ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানেরঐতিহ্য এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির ধারাবাহিক আক্রমণের শিকার। গান্ধীজীর খুনি নাথুরাম গডসে-কে এখন দেশপ্রেমিক বানিয়ে দেশদ্রোহী তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে নিরীহ সেই সব ছাত্রছাত্রীদের গায়ে, যারা আর এস এস-এর এই হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ কর্মসূচির বিরোধিতায় সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘা শুকোতে না শুকোতে আক্রান্ত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আগামী দিনে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠিত বা সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের আক্রমণের শিকার হতে পারে। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক রোহিত ভেমুলাকে অসহায়ভাবে অকালে হারিয়ে যেতে যারা বাধ্য করেছে বা প্রত্যক্ষ প্ররোচনা জুগিয়েছে তারাই ষড়যন্ত্রের জাল পেতে কানহাইয়া ও তার সহযোগী ছাত্র রাজনীতির সংগঠকদের দেশদ্রোহী বানিয়ে জে এন ইউ ক্যাম্পাসের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আম্বেদকর স্টু‍‌ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান সংগঠক ছিল রোহিত। হতদরিদ্র দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা এই গবেষক ছাত্রটি আজ দেশজুড়ে বিপজ্জনকভাবে সংক্রামিত হওয়া অসহিষ্ণু সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায় দরিদ্র আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করবার স্বপ্ন দেখেছিল। শুধুমাত্র এই অপরাধে মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে রোহিতের উপর ধারাবাহিক মানসিক নির্যাতন শুরু হয় যার নেতৃত্ব দেন স্থানীয় সাংসদ তথা কেন্দ্রের বি জে পি সরকারের শ্রমমন্ত্রী, যিনি আর এস এস-র অন্যতম সংগঠকও বটে। রোহিতকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই এক ঘরে করে দেওয়া হয় যাতে বন্ধুবান্ধবদের সাথেও দেখা করতে না পারে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী নজিরবিহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একের পর এক চিঠি লিখে রোহিতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও তাকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন। শেষমেশ মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এই সম্ভাবনাময় তরুণ গবেষকটি, যার প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়ে ছিলেন বি জে পি তথা আর এস এস-র নেতা মন্ত্রীরা। সেই রোহিত ভেমুলার খুনিরাই এখন নতুন উদ্যমে হিংস্র নখ দাঁত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জে এন ইউ ক্যাম্পাসে। ওদের টার্গেট শুধু কানহাইয়া নয়, বরং তার চাইতেও অনেক বেশি বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন, যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। আর এস এস বাহিনীর টার্গেট এখন বামপন্থা ও বামপন্থী রাজনীতি যার আদর্শগত অবস্থান ঠিক ওদের বিপরীত মেরুতে। সেই কারণেই বামপন্থীরা বি জে পি তথা আর এস এস বাহিনীর প্রধান শত্রু। গত লোকসভা নির্বাচনের পর স্বয়ং সংঘ প্রচারক মোদী প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার কারণে দেশজুড়ে বামপন্থীদের শক্ত জমিতে আঁচড় কাটতে আর এস এস তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গ ওদের দীর্ঘমেয়াদী টার্গেট। এরাজ্যে সাম্প্রতিককালে বেড়ে ওঠা ওদের নানাবিধ কর্মসূচিগুলি লক্ষ্য কর‍‌লে আরও বিপদের মাত্রা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যাদবপুরের আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এমন কি মাননীয় উপাচার্যকে যে ভাষায় বি জে পি-র নেতারা আক্রমণ করেছেন, তাকে শুধু নিম্নরুচির কাজ বলে থেমে গেলে আসল বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে রক্ষার তাগিদে আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বি জে পি এবং তার সহযোগী শক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার তাগিদে ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
মূলত সেই তাগিদ থেকেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। কোনো একদিনের কর্মসূচি নয়, ধারাবাহিক আন্দোলন যা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এতেই ভয় পেয়েছে আর এস এস। ওদের হিন্দুরাষ্ট্র গঠন ও হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রচারের কর্মসূচিতে জে এন ইউ-র মতো দেশের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-শিক্ষকরা যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার প্রভাব পড়বে সারা দেশজুড়ে। তাই ভয় পেয়েছে ওরা। আর সেই ভয় থেকেই সম্পূর্ণ মিথ্যা মনগড়া অভিযোগ সাজিয়ে জে এন ইউ ক্যাম্পাসের মধ্যে পুলিশ ঢুকিয়ে এই ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সংগঠক তথা ঐ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলার মতো এই কানহাইয়াও উঠে এসেছে বিহারের এক অসহায় হতদরিদ্র অনগ্রসর পরিবার থেকে। রোহিতের মতো কানহাইয়ার বিরুদ্ধেও সংসদ আক্রমণের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত আফজল গুরু বা সৈয়দ গিলানিদের সমর্থনে স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। খোদ দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও বলবার চেষ্টা করা হয় যে কানহাইয়ার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। অথচ দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে এধরনের কোনো তথ্যই আদালতে পেশ করা সম্ভব হয়নি। উলটে পাতিয়ালা আদালতে কানহাইয়াকে হাজির করার সময় পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সামনেই শারীরিক নিগ্রহ করা হয়। আবারো দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে দিয়ে সংঘ প্রচারকের স্টাইলে বলবার চেষ্টা করা হয় যে কানহাইয়াকে মারধর করা হয়নি। কিন্তু ওর মেডিক্যাল রিপোর্টে শরীরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট বলে উল্লেখ করা আছে। এত সব কুকর্ম করে ধরা পড়বার পরেও আর এস এস দমবার পাত্র নয়। সোস্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক-এ কানহাইয়ার বক্তৃতারত একটি ছবি জাল করে তার সাথে ভারতের মানচিত্র বিকৃত করে জুড়ে দিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে কানহাইয়া সম্পর্কে জনমানসে একটা ঘৃণা বা বিদ্বেষের মনোভাব তৈরি করা যায়। দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির চক্রান্তে যুক্ত দেশদ্রোহীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়ার একাংশের সাহায্য নিয়ে নিষ্পাপ, নির্দোষ কানহাইয়াসহ তার সহযোগী বন্ধুদের দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার নোংরা খেলায় মেতেছে। সঙ্গত কারণে দেশ তথা আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে দেশ ও বিদেশের বহু খ্যাতনামা চিন্তাবিদ এই ঘটনার নিন্দা করে কানহাইয়ার দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন। গুজরাট, মুজফ্‌ফরনগর, দাদরি বা অন্যবহু জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের যারা নির্বিচারে হত্যা করেছে, একের পর এক মিশনারি স্কুল, চার্চ যারা পুড়িয়ে দিয়েছে, খ্রীষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের যারা জোর করে ভয় দেখিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ধর্মান্তরিত করছে তারা এখন এদেশে রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় দেশপ্রেমিক সেজেছে। আর দেশদ্রোহী বানানোর চেষ্টা চলছে রোহিত ভেমুলা, কানহাইয়া কুমারকে, যারা ঐ দেশ বিরোধী শক্তির প্রকৃত স্বরূপটা চিনিয়ে দিয়ে দেশ বাঁচানো ও সমাজ পালটানোর আন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও বলতে বাধ্য হয়েছে কানহাইয়াকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে এবং তা পূর্বপরিকল্পিত। প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঐভাবে পুলিশ ঢোকা নিয়েও। জে এন ইউ-র উপাচার্য প্রথম অস্বীকার করলেও পরে জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশমতোই পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না জে এন ইউ-র মতো প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারও আজ বিপন্ন, এ রাজ্যে যে ঘটনার প্রায় প্রতিনিয়ত সাক্ষী‍‌ আমরা।
কানহাইয়া আজ না হোক কাল মুক্তি পাবে একথা ঠিক। তবে তাতে বি জে পি, আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের হিন্দুত্ব কর্মসূচি থেমে থাকবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ দেখি না। বরং আশঙ্কায় আছি, আবার নতুন করে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আক্রান্ত হয় এই ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত শক্তির হাতে। কানহাইয়ারা আফজল গুরুর সমর্থনে সেদিন কোনো স্লোগান দেয়নি বরং গোটা ব্যাপারটা সাজানো হয়েছিল ওদের ফাঁসাবার জন্য এ সত্য আজ কারো জানতে বাকি নেই। গোটাটাই একটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই কেউ বলেছে যে আফজলকে ফাঁসি দেওয়া ঠিক হয়নি’ — তাহলে কি সেই ছাত্র বা ছাত্রীটিকে সাথে সাথে দেশদ্রোহী বলে দেওয়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয় নামক জ্ঞানচর্চা ও মুক্তচিন্তার অঙ্গনে দাঁড়িয়ে সে কি তার স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পাবে না। শুধু মাত্র এধরনের কথা বললেই কি সে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এমন দাবি করা যায়? জে এন ইউ কাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার এক শিক্ষক সমাবেশে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরির পেশ করা লিখিত বক্তব্যের একাংশ এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে। উনি লিখেছেন, ‘‘সেই সঙ্গে শিক্ষক হিসাবে আমাদের উপর একটা বিশেষ দায় বর্তায়, যাতে যে পক্ষ নির্বিশেষে যে কোনও অনাচারের হোতাদের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা না হারাই। দেখা যাচ্ছে, বাক্‌স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে সওয়াল করতে নেমে আমরা প্রায় সকলে গোড়াতেই বলে নিচ্ছি যে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে বিশেষ চরমপন্থী মতগুলি উচ্চারিত হয়েছে, সেগুলি আমরা নিন্দা করি। অর্থাৎ আমাদের মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষার প্রচেষ্টায় কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে প্রচার পাচ্ছে এমন কিছু মতবাদ যা আমরা অধিকাংশেই অনুচিত বা অন্যায় মনে করি, আইনগ্রাহ্য অপরাধ হোক চাই না হোক। এতে এই মতবাদগুলি একধরনের  স্বীকৃতি পাচ্ছে, যার ফলে বাক্‌স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার বৃহত্তর আন্দোলনের ক্ষতি হতে বাধ্য কেবল সরকারি দমনপীড়নের বিপদ ডেকে এনে নয়, সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়ে এবং নিজেদেরও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে।
‘‘মানতেই হয়, যে মত আমরা নিজে পোষণ করি না এমনকি অন্যায় মনে করি, সেটা বলতে দেওয়াই বাক্‌স্বাধীনতার চূড়ান্ত স্বীকৃতি। যাঁরা এইসব মত পোষণ করেন, তাঁরা নিজেদের মঞ্চ থেকে যত খুশি বলুন। তাঁদের প্রতি অন্যায় উৎপীড়ন হলে অন্যান্য সৎ নাগরিকের মতো আমরাও আমাদের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে তার নিন্দা-প্রতিবাদ করব। কিন্তু বাক্‌স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার সাধারণ আন্দোলনের একটা প্রধান স্তম্ভ হিসাবে তাঁদের দেখলে বা দেখালে বৃহত্তর নাগরিক স্বার্থ, বা আজকের বিশেষ প্রসঙ্গে শিক্ষাজগতের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে।’’
জে এন ইউ কাণ্ডের সমর্থনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রাক্তনিদের মিছিল থেকে আজাদীর স্লোগান উঠেছে যা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে কেউ যদি কাশ্মীরের আজাদির প্রসঙ্গ তোলে তাহলে মনে হতেই পারে সে বা তার বন্ধুরা ভারত অধিকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে বলছে। সত্যি যদি তেমন দাবি উঠে আসে তবে তা সমর্থন যোগ্য নয়, এনিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি যদি এদেশে বসবাসকারি সব মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দাবি করি, খেয়ে পড়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দাবি করি, তাহলেও কি আমাকে দেশদ্রোহী বলা যায়? আমার কথা ছেড়ে দিলাম। টাটা-বিড়লা-আম্বানিরা উত্তরোত্তর নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মূল্যবান সম্পদ লুট করবার স্বাধীনতা দাবি করে ওদেরকে কি দেশদ্রোহী বলবার সাহস দেখাতে পারে দেশের বর্তমান সরকার? এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। বছর পাঁচ ছয়েক আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে এক সভায় এদেশের সর্বোচ্চ বিত্তশালী পরিবারের কর্ত্রী নীতা আম্বানি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা দুটো স্বাধীনতা পেয়েছি। প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৪৭ সালে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৯১ সালে। আমাদের দেশের অর্থনীতি স্বাধীন হয়েছে। এখন আমরা তৃতীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক যাবতীয় ক্রিয়াকর্মকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা।মানুষকে সর্বস্বান্ত করবার এই স্বাধীনতা যা দাবি করেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা, তাদের কি দেশদ্রোহী বলার সাহস দেখাতে পারেন মাননীয় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহযোগীরা? তা যদি না পারেন তা হলে শুধু শুধু জে এন ইউ বা যাদবপুরের এই সব নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের উপর আস্ফালন দেখিয়ে কি লাভ? এরাজ্যের বি জে পি-র একনেতা বললেন জে এন ইউ-র ছাত্রদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে দিল্লির বি জে পি বিধায়ক পুণ্য কাজ করেছেন। তার মানে আমাদের সবার পাপপুণ্যের ব্যালান্সশিট বানাবার দায়িত্বটুকুও ওরা একতরফা নিয়ে নিয়েছে। এরপর বাবরি মসজিদ ভাঙবার বিরোধিতা করে স্লোগান দিলেও দেশদ্রোহীর তকমা জুড়ে দিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে আমাদের পেটাবার কর্মসূচি নিতে পারে ওরা।
নাইরোবিতে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দশম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর ভারতের শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সমস্ত জরুরি মৌলিক পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি এখন খোলা বাজারের সম্পত্তি। উচ্চশিক্ষায় সরকারি উদ্যোগে ঢালাও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বন্দোবস্ত পাশ করা হয়েছে। এর ফলে উচ্চশিক্ষা আগামী দিনে আরো মহার্ঘ হবে একথা বলা বাহুল্য। ইউ জি সি, এ আই সি টি ই, এন সি টি ই-র মতো উচ্চশিক্ষার সঙ্গে  যুক্ত নিয়ামক সংস্থাগুলি খোলা বাজারের শর্তে তুলে দেওয়ার প্রস্তাবও বিবেচনা করা শুরু হয়েছে।  এর পাশাপাশি দেশজুড়ে শিক্ষার সর্বস্তরে পাঠ্যসূচির গেরুয়াকরণের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক স্বচ্ছ ধারণাকে সরিয়ে আচার সর্বস্ব ধারণাকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়ে কূপমণ্ডুক বানাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে পুরাণ বা মিথ-কে ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চের দখল নিয়ে অবিজ্ঞান কুসংস্কার প্রচারের চেষ্টা চলছে। এই সর্বনাশা নীতি ও সুস্থ চিন্তা বিরোধী পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রকার বাধার মুখে না পড়তে হয় এর জন্য পরিকল্পনামাফিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিতে সচেতন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক সমাজের উপর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন ছাড়া এই সর্বনাশা শক্তিকে রোখা সম্ভব নয়।

পরিশেষে আসি এরাজ্যের শাসকদল ও তার সরকারের সুবিধাবাদি অবস্থান প্রসঙ্গে জে এন ইউ কাণ্ডে যখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদ করছেন, নিন্দায় সরব হচ্ছেন চিন্তাবিদগণ, মিছিলে শামিল হচ্ছেন এরাজ্যের ছাত্র-শিক্ষকসহ অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, তখন অদ্ভুত এক নীরবতা গ্রাস করেছে শাসকদলকে। ব্যাপারটা শুধুমাত্র বেখেয়ালে ঘটেছে ভাবলে ভুল হবে। প্রথমত, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হবার নতুন সমীকরণের হিসেব নিকেশ তাতে করে এক-আধটা রোহিত যদি অকালে হারিয়ে যায় তা কানহাইয়ার মতো সুস্থ চিন্তার ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের তিহার জেলে পচতে হয়, তাতে ওদের কিছু যায় আসে না। বি জে পি-কে চটানোর ঝুঁকি ওরা নেবেন না, তা তাদের আচরণেই পরিষ্কার। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগ এরাজ্যেও ব্যাপক আকার নিয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ করার সুনাম এদেরও তো কম নয়, তৃতীয়ত, হ্যাঁ ঠিকই, ধর্মের দোহাই দিয়ে তা তারা করেন না, কিন্তু রাজনৈতিক দখলদারি সুনিশ্চিত করতে গত প্রায় পাঁচ বছর জুড়ে যে অরাজক পরিস্থিতি তারা তৈরি করেছেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে তার দায় এড়াবেন কি করে? এ বিপদও আমাদের একইভাবে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা জরুরি। নতুবা আগামী প্রজন্ম সত্যিই আমাদের দেশদ্রোহী চিহ্নিত করবে।