20160905

মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর উৎসব আসলে জমি হাঙরদের সহর্ষ আস্ফালন

সূর্য মিশ্র

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে সিঙ্গুরে টাটা মোটর্সের গাড়ি কারখানা তৈরির জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এতই আনন্দিত হয়েছেন যে তিনি রাজ্যজুড়ে সিঙ্গুর উৎসব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর দলবল গ্রামে, শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে উৎসবের আয়োজন করেছে। শিক্ষামন্ত্রী আরো একধাপ এগিয়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যসূচীতে সমগ্র বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এইসবের পিছনে আসলে মনে হচ্ছে রাজ্যবাসীর পয়সায় রাজ্যে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে।

এতকিছু করলেও বিষয়টির কিন্তু শেষ ঘটে যায়নি। এখনো কফিনের শেষ পেরেক পোঁতা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় দুই বিচারপতি সিঙ্গুরের জমি নিয়ে মোট ৯টি বিষয়কে বিবেচনার জন্য নির্ধারণ করে।  বিচারপতিদের মোট ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের ৭২-৭৩ পৃষ্ঠায় এই বিষয়গুলিকে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই ৯টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র ৩টি বিষয়ে দুই বিচারপতি সহমত হয়েছেন। ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ে মতৈক্যের অংশ মাত্র দেড় পৃষ্ঠার মতন (১০৫-১০৬ পৃষ্ঠা)। এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগও রাখা রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ বাতিল করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে যে মামলা হয়েছিল, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি একটি রায়ে তা খারিজ করে দিয়েছিলকিন্তু সিঙ্গুর সংক্রান্ত অন্যান্য মামলাগুলির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলি এখনো বিচারাধীন। যেমন, ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরানোর যে বিল এনেছিলেন তা কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খারিজ করে দেয়। সেই বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতিও পায়নি। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়ে এই বিলের কথা উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তা এখানে বিচার্য হয়নি। ২০১১ সালে বিধানসভায় এই বিল আনার সময়েই আমরা বলেছিলাম, এই বিল অসাংবিধানিক, এটা আটকে যাবে। সরকারকে সতর্ক করে আমরা বলেছিলাম যে জমি ফেরাতে চাইলে ইচ্ছুক এবং অনিচ্ছুকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করবেন না। যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার থাকতে সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি হওয়ার আর কোনো বাস্তবতা ছিল না, সেই কারণে আমরা ইচ্ছুক অনিচ্ছুক নির্বিশেষে সবাইকে জমি ফেরৎ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম এবং সরকারকে এরজন্য একটি বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছিলাম যা সংবিধান ও আইনসম্মত ছিলসুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায় থেকে এটা স্পষ্ট যে তৃণমূল সরকারের আনা সিঙ্গুর বিল মাফিক অনিচ্ছুকদের জমি ফেরতের কোনো সুযোগ নেই, ঐ বিল এখন বিশ বাঁও জলে।

তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর এই উৎসব পালনের কারণ কী? এটা ওঁর বিরাট জয়? আর পূর্বতন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের বিরাট পরাজয়? সিঙ্গুরের সব মামলার জল কোথা থেকে কোথায় গড়ায় তার তোয়াক্কা না করেই মুখ্যমন্ত্রী এখন উৎসবের আয়োজন করেছেন। সিঙ্গুর নিয়ে একশো আশি ডিগ্রি ভোল বদলে এখন অনেকেই অনেক কিছু বলছেন। তখন তাঁরা কে কী বলেছিলেন তার বিস্তারিত উল্লেখ এখানে কুলোবে না। অতএব যে যা বলতে চান বলুনকিন্তু আমরা গিরগিটি নই, কোনো মৌলিক বিষয়ে ওরকমভাবে ঘন ঘন অবস্থান বদলানো আমাদের কাজ নয়।

আমাদের অবস্থান কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পায়নের পক্ষে। কৃষি আমাদের ভিত্তি, তাকে শক্তিশালী করে পৃথিবীর যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের মতোই আমাদের দেশ ও রাজ্যকেও কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের দিকে যেতে হবে। কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ, এর কোনো বিকল্প নেই। সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের ‘ডেস্টিনেশন’ হবে। যার রাজত্বে রাজ্যে কৃষিতে সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে, কৃষকের আত্মহত্যা ঘটে চলেছে, চা বাগান, চটকল থেকে শুরু করে হিন্দমোটরসহ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পগুলির অন্তর্জলি যাত্রা প্রতিদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, তিনি ছাড়া এমন ঘোষণা আর কে করবেন! তাঁর পথ বি-শিল্পায়নের পথ। সারদা-নারদা, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, জমির দালালি আর মাফিয়াবৃত্তির পথ, পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের পথ। ক্রমবর্ধমান বেকার বাহিনীকে লুম্পেনবৃত্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার পথ। সমাজের বুকে এর মারাত্মক ফলাফল আমরা ঘনঘন দেখতে পাচ্ছি। অতি সম্প্রতি কলকাতায় এক কিশোরীকে গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করে খুনের যে বীভৎস ঘটনা ঘটেছে, সেটাও এই পথেরই ফলাফল। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এতে উদ্বিগ্ন নন, তিনি মনে করছেন, এইসব নিয়েই উৎসব হবে।

বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়নের জন্য, কৃষির ওপরে চাপ কমানোর জন্য এবং কৃষিতে আরো বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাকে শক্তিশালী করার জন্য। শিল্পায়ন মানে কী? আমরা বুঝেছিলাম, শিল্পায়নের পথ মানে বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের আনুপাতিক ভারসাম্য ও সমন্বয় বজায় রেখে এগোনো। কোনো একটাকে বাদ দিয়ে কেবল আরেকটাকে নিয়ে এগোনো যায় না। অযথা সময় নষ্ট না করেও কৃষিজমির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলিতে সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রেখে, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয়ে সচেতন থেকে অগ্রসর হওয়া। এসবের মধ্যে কোথাও কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটেনি বা ঘটবে না, এমন দাবি করা অবাস্তব। কিন্তু বর্তমান সরকার তো আইন সংবিধান কিছুই মানে না। শিল্পক্ষেত্রে সমন্বয়, ভারসাম্য এসব তো এই সরকারের কাছে অনেক দূরের কথা। এই সরকার নৈরাজ্যের উৎস এবং উৎসবের সরকার।

সিঙ্গুরের জমি নিয়ে মামলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। অধিগ্রহণের সময় থেকে সুপ্রিম কোর্টে মামলার সময়ের মধ্যে সরকার বদলে গেছে। তাই মামলাতেও সরকারেই হারতে হবে- এটাই ছিল সরকারের মনোভাব। মামলা চলাকালীন আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করা হবে কিনা, তথ্য আড়াল করা হবে কিনা, এসব সরকারের সদিচ্ছার ওপরে নির্ভর করে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী হবে সেসব বিবেচনা না করে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থপূরণ হতে পারে, রাজ্যের জনগণের সামগ্রিক স্বার্থপূরণ হবে না। মুখ্যমন্ত্রী যে বিমানবন্দরের উদ্বোধন করেছেন (যদিও এরমধ্যেই সেটা বন্ধ হয়ে গেছে), সেখানকার জমিও যদি সিঙ্গুরের মতো একই কায়দায় ফেরতের দাবি ওঠে তখন কী হবে?

১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন যে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয়, সেই আইনের খোলনলচে যে বদলানো দরকার, সেই দাবি বামফ্রন্ট সরকার ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই আইনে কৃষক ও বর্গাদারদের স্বার্থবাহী অনেকগুলি সংশোধনীও বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে করা হয়েছিল যা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনও পেয়েছিলকেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যান্য রাজ্যগুলিও বিভিন্ন সময়ে এই জমি অধিগ্রহণ আইনে কিছু কিছু ইতিবাচক সংশোধন করেছিলকিন্তু এটাই ছিল কেন্দ্রীয় আইন এবং ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত ঐ আইনটিই ছিল জমি অধিগ্রহণের একমাত্র আইন। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন বলবৎ হওয়ার পরেও সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এমন বলা যাবে না। কারণ আমাদের কাছে মূল প্রশ্নগুলি জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্য, নীতি ও অভিমুখ ঘিরে। কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে শিল্প বা জনস্বার্থবাহী প্রকল্পের জন্য, পরিকাঠামোর জন্য জমি সংগ্রহ করতেই হবে। প্রশ্ন হলো, এতে কি সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না? সরকারের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন থাকবে না? কৃষকদের কি জমি হাঙরের মুখে ছেড়ে দেওয়া হবে?

এই প্রশ্নগুলির নিরিখে ভাবতে হবে কী ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে? এখন কী ঘটছে এরাজ্যে? বামফ্রন্ট সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে? সড়ক, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, ইত্যাদি নির্মাণের জন্য এখন কীভাবে কতখানি জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এখন জমি মাফিয়াদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর উৎসবে জমির মাফিয়া, সিন্ডিকেট, প্রোমোটারি বাণিজ্য, বেসরকারী শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলির বাণিজ্যিক মালিকদের সহর্ষ আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। সেটা কি নজরে পড়ছে না? নাকি এগুলি উপেক্ষা করার মতো? জমিবাণিজ্য থেকে সুবিধাভোগী এইসব আস্ফালনকারীদের মধ্যে শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুরা রয়েছেন, মন্ত্রীসান্ত্রীরা আছেন, আছেন ভাই-ভাইপোরাও। সততার প্রতীকের রাজত্বে এই ক’বছরে কার কত সম্পত্তি হলো তা থেকেই আস্ফালনের কারণ বোঝা যায়। ৩৪বছরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের ভাই-ভাইপোদের এমন হয়েছিল নাকি?

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও আমরা বলেছিলাম, সিঙ্গুরের বিবাদ আমরা মেটানোর পক্ষে। আমরা চেয়েছিলাম কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করেই সিঙ্গুর-শালবনী-রঘুনাথপুরে শিল্প হবে। নির্বাচনে যে ২কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ তৃণমূল-বি জে পি-র বিরুদ্ধে ভোট দিলেন, তাঁরা তো এসব জেনেবুঝে ভেবেই ভোট দিয়েছেন। এই নির্বাচন প্রকৃত অর্থে সর্বত্র অবাধ হলে এবং ৪শতাংশ ভোট এদিক-ওদিক হলে ফলাফল কী হতো তা বলা যায় না।

এখন মুখ্যমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায় পেয়ে উৎসবে মেতে আছেন। আপনি জমি জরিপের কাজ শুরু করে দিন, তবে মানবজমিনের কথাটাও মাথায় রাখবেন। সিঙ্গুরের যেসব যুবকযুবতী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের কী হবে? তাঁদের কাছে কী কৈফিয়ৎ দেবেন? সিঙ্গুরের জমির কতটা চাষযোগ্য করে দেবেন? যেটা চাষযোগ্য নয়, সেটার কী করবেন? জমি না হয় দিলেন, কিন্তু যারা ফেরৎ পেলো তাঁদের আয় ও কর্মসংস্থানের সমাধান কীভাবে করবেন? ফেরৎ পাওয়া জমি শেষপর্যন্ত কৃষকদের হাতে থাকবে তো? নাকি সিঙ্গুর উৎসবের উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাবে? অথবা তাঁদের মাধ্যমে অন্য কোথাও হস্তান্তরিত হয়ে যাবে? আপনি যতই উৎসব করুন, আপনার এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। হ্যাঁ, উৎসবের মরশুম আসছে। ঈদ আসছে, শারদোৎসব আসছে। কিন্তু সরকারের উৎসব করা সাজে না। বাংলার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষ যে সরকারের উৎসবে মেতে ওঠার মেজাজে নেই, তা ২রা সেপ্টেম্বরেই আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, ধীরে, রজনী ধীরে।

আর যারা এখন ভোল বদলাচ্ছেন, তাঁদের বলি, সাধু সাবধান।


গণশক্তি, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, রবিবার, ২০১৬

বিশ্বব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদের মন্তব্য প্রসঙ্গে

ড. অসীম দাশগুপ্ত

কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু কলকাতায় একটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে হঠাৎই বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নাকি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি হয়েছে! যেহেতু আর কিছুই নির্দিষ্টভাবে বলা নেই, তাই আলোচনার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি, বলার চেষ্টা হয়েছে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠা‍‌মো, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই বামফ্রন্টের আমলে ক্ষতি হয়েছে। আমরা এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেরই প্রকৃত তথ্যগুলি পেশ করছি, এবং লক্ষ্য করছি, তার থেকে কিন্তু উঠে আসছে অন্য একটি চিত্র। এই তথ্যগুলির উৎস হলো প্রধানত ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকারের প্রকাশিত রিপোর্টসমূহ।

কৃষিতে প্রকৃত তথ্য
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শুরুর বছর (১৯৭৭-৭৮) থেকেই কৃষির ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের ওপর বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করার পাশাপাশি, সেচের সম্প্রসারণ, উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহার এবং এই সকল বিষয়ে নির্বাচিত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এলাকার মানুষদের যুক্ত করার ফলে কৃষিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক ধারাবাহিক বৃদ্ধিই পরিলক্ষিত হ‌য়। বামফ্রন্ট সরকারে আসার আগের বছরে (১৯৭৬-৭৭), রাজ্যে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৫৯ লক্ষ মেট্রিক টন, এবং তখন পশ্চিমবঙ্গ ছিল চালের ক্ষেত্রে ঘাটতি রাজ্য। কিন্তু ভূমি সংস্কারকে ভিত্তি করে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করার ফলে চালের উৎপাদন ধাপে ধাপে ১০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে শেষ বছরগুলিতে গড়ে ১৪০ লক্ষ মেট্রিক টনে পৌঁছায় এবং চালের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ উন্নীত হয় উদ্বৃত্ত রাজ্যে, এবং চালের উৎপাদনে সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয় সর্বপ্রথম। আলুর ক্ষেত্রে এ-রাজ্যের মোট উৎপাদন চমক সৃষ্টি করেই ১৯৭৬-৭৭ সালে ১৭ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সপ্তম বামফ্রন্টের শেষ বছরে (২০১০-১১) ১০০ লক্ষ মেট্রিক টনকে অতিক্রম করে, এবং দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয় দ্বিতীয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১০-১১ সালে এ-রাজ্যে সামগ্রিকভাবে সবজির মোট উৎপাদন হয় ১৩০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি, এবং এই মোট সবজির উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হয় সর্বপ্রথম। এর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি হয় উদ্যান চাষ, মৎস্য চাষ এবং প্রাণীসম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে। ৮০-র দশকেই মৎস্য উৎপাদনে সমগ্র দেশে এ-রাজ্য প্রথম স্থান অধিকার করে। বনায়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক বনসৃজনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয় প্রথমসারিতে এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষদের যুক্ত করে বনরক্ষার সাফল্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গ লাভ করে আন্তর্জাতিক সম্মান (পল গেটি পদক)।

ভূমি সংস্কার থেকে শুরু করে এই প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে, কৃষি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তাই নয়, খেতমজুরদের মজুরির হারও, শুধু টাকার অঙ্কে নয়, মূল্যবৃদ্ধি ধরেও অধিকাংশ সময়েই প্রকৃত অর্থেই বৃদ্ধি পায়। যেহেতু ভূমি সংস্কারের কারণে কৃষিতে এই উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেছে সাধারণ কৃষকদের জমি‍‌তেই, তাই তাঁদের আয় এবং ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় ধারাবাহিকভাবেই। এর প্রতিফলন ঘটেছে তাঁদের শিল্পপণ্যের চাহিদার বৃদ্ধিতেও। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (৬৯তম রাউন্ডের) তথ্যাবলির ভিত্তিতেও দেখা যায় যে, ২০১০-১১ সালে এ-রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের শিল্পপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকায়।

শিল্প এবং পরিষেবার প্রকৃত তথ্য
শিল্পপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারের এই ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা, দক্ষ শ্রমিক ও প্রযুক্তিবিদদের অবস্থান এবং বামফ্রন্ট সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এই কারণগুলিই এরাজ্যে শিল্পোন্নয়নের বস্তুগত ভিত্তি স্থাপন করেছে। এছাড়া, কেন্দ্রীয় সরকারের মাসুল সমীকরণের নীতি এবং লাইসেন্স প্রদানের বৈষম্যমূলক নীতি যা এরাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বারংবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তা ৯০-র দশক থেকে কিছুটা প্রত্যাহৃত হওয়ায় শিল্পস্থাপনের ক্ষেত্রে তারও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই সামগ্রিক কারণগুলিরই প্রতিফলন ঘটেছে শিল্প বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠী স্থাপন এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কালে (যে সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হলদিয়াপেট্রোরসায়ন প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে ১৯৯৮ সালের বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পনীতি) এ-রাজ্যের সংগঠিত বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মোট ২,৫৩১টি শিল্প সংস্থায় শুধুমাত্র প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নয়, কারখানাগুলি চালু হয়ে উৎপাদনও শুরু করে বাস্তবায়িত হয়েছে ৬৫,৬৮৬ কোটি টাকার প্রকৃত বিনিয়োগ, এবং প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২.৯৮ লক্ষ জনের (এবং এর অন্তত দ্বিগুণ সংখ্যক সৃষ্টি হয়েছে পরোক্ষ কর্মসংস্থান)। উল্লেখনীয় যে, এই শুরু হওয়া শিল্প সংস্থাগুলির মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই হলো মাঝারি শিল্প সংস্থা। আরও লক্ষণীয় যে, এই সময়কালে শুধুমাত্র শেষ বছরেই (২০১০ সালে) স্থাপিত হয়েছে ৩২২টি নতুন শিল্প সংস্থা এবং এখানে বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণ হয়েছে ১৫,০৫২ কোটি টাকা। প্রধানত যে শিল্পগুলিতে বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলি হলো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, লোহা ও ইস্পাত, রসায়ন ও পেট্রোরসায়ন এবং তথ্য প্রযুক্তি।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে, শিল্পের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য স্থানে উঠে এসেছে রাজ্যের ক্ষুদ্রশিল্প সংস্থাগুলি। এই বিষয়ে ভারত সরকারের নমুনা সমীক্ষার (২০০৫-০৬) তথ্য অনুযায়ী ক্ষুদ্রশিল্পের সংখ্যা (এরাজ্যে ২৭.৫৯ লক্ষ) এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি (এ রাজ্যে ৫৪.৯৩ লক্ষ), উভয় ক্ষেত্রেই সমস্ত রাজ্যকে অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়েছে সর্বপ্রথম।

পরিষেবার ক্ষেত্রেও ভারত সরকারের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে (২০০৯)। এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার তথ্যাবলি থেকেও দেখা যাচ্ছে, পরিষেবার ক্ষেত্রে এরাজ্যের পরিষেবা সংস্থার সংখ্যা ২০০৬-০৭ সালে হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ এবং এক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়েছে দ্বিতীয়।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সাধারণ উদ্যোগীদের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি। এ-রাজ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সংখ্যা ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ১৪.৭০ লক্ষে (যাঁদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই হলো মহিলা গোষ্ঠী) এবং এই গোষ্ঠীগুলির সদস্যা/সদস্য সংখ্যাও অতিক্রম করে ১ কোটিকে।

পরিকাঠামোর ক্ষেত্র
যেহেতু কৃষিতে ও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন সাধারণ পরিকাঠামোর, তাই বামফ্রন্ট সরকার, তার ক্ষমতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, ধারাবাহিকভাবেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেতু, উড়াল পুল, রাস্তা এবং বিদ্যুতের উন্নতির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে সেতু এবং উড়াল পুলের ক্ষেত্রে পূর্ত ও পূর্ত (সড়ক) দপ্তর একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম চার বছরে (২০০৭-১১) মধ্যেই ৪৭টি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। রাস্তার ক্ষেত্রেও এই চার বছরের মধ্যে শেষ হয় প্রায় ৪,১০৯ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নের কাজ। এর পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৫৮,২৭৪ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নের দায়িত্ব ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত এবং ১৪,৮৯৮ কিলোমিটারের রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব বহন করে পৌর সংস্থাগুলি।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ব্যাপক বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট সরকার প্রথম বছর থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার সংযোজন করা এবং রাজ্য সরকারের অধীন বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বৃদ্ধি করার। এর ফলে, বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিতে উৎপাদন ক্ষমতা ১৯৭৬-৭৭ সালে ১,৬১৫ মেগাওয়াট থেকে লক্ষণীয়ভাবে ৫০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৯,৯৭৪ মেগাওয়াটে, এবং অভ্যন্তরীণ দক্ষতার মাপকাঠি হিসেবে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ১৯৭৬-৭৭ সালে ৩৩ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় প্রায় ৭১ শতাংশেএর ফলে, শুধু যে রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জিত হয় তাই নয়, রাজ্য সরকারের অধীন বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির লাভও ২০১০-১১ সালে প্রায় ৪৬৪.১০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়ে সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যেই এক নজির স্থাপন করে।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র
সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন-সহায়ক সাধারণ পরিকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় সামাজিক পরিকাঠামোর, বিশেষ করে, জনস্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থারও ধারাবাহিক উন্নতির।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের তরফ থেকে জোর দেওয়া হয় বিকেন্দ্রীকৃত নিবারণমূলক চিকিৎসার ওপর, এবং নিরাময়মূলক চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণের ওপর। এই লক্ষ্যে যেখানে সম্ভব স্বাস্থ্য দপ্তরের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করা হয় পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির উদ্যোগও। এর ফলে, ভারত সরকারের রাজ্যওয়াড়ি তথ্যাবলি (উৎস: এস আর এস, স্বাস্থ্য মন্ত্রক, ভারত সরকার) অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে হাজার প্রতি মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে ২০১০ সালে হয়েছে ৬.০, যা শুধু সর্বভারতীয় মৃত্যু হারের (৭.২) থেকে অনেক কম তাই নয়, সমস্ত প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম। হাজার প্রতি শিশুমৃত্যুর হারও এরাজ্যে ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৩১, যা সর্বভারতীয় হারের (৪৭) থেকে পুনরায় অনেক কম, এবং সাফল্যের দিক থেকে প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে।

শিক্ষার ক্ষেত্র
শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে তা হলো, শিক্ষার সুযোগ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা এবং সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাকে সমন্বিত করা, যাতে সামগ্রিকভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে পারে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে।

সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষার সুযোগ সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে, প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই বিদ্যালয়স্তরে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে করা হয় অবৈতনিক এবং সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিটি মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও ধার্য করা হয় অপেক্ষাকৃত স্বল্প ফি। এর পাশাপাশি বামফ্রন্ট সরকারের তরফ থেকে মাননীয় শিক্ষক-অধ্যাপকদের মর্যাদা প্রদানের অঙ্গ হিসেবেই বহন করা হয় তাঁদের বেতন ও অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের মূল দায়িত্ব।

অগ্রাধিকার আরোপ ও এই আর্থিক দায়িত্বভার গ্রহণ করার ফলে এ-রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার সুযোগ প্রাসঙ্গিক বয়সসীমার (৫+ থেকে ৮+) মধ্যে সমস্ত শিশুর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার নিট অনুপাত ধাপে ধাপে উন্নীত হয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৯৯ শতাংশে।

শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে ভর্তি করা নয়, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাতও যাতে হ্রাস পায় তার জন্য জোর দেওয়া হয় দুপুরে রান্না করে খাওয়ানোর কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ওপর। মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের যুক্ত করে, দুপুরে রান্না করে খাওয়ানোর কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয় ৯৬.৫ শতাংশ বিদ্যালয়কে। এছাড়া, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ সালে প্রাথমিক স্তরে নিযুক্ত করা সম্ভব হয় ৪৯,১৬১ জন এবং উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ২৬,৬০৮ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এর ফলে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হ্রাস পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৩১.৫ : ১-এ। এই পদক্ষেপগুলির ফল হিসেবে প্রাথমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাত ২০১০-১১ সালে হ্রাস পেয়ে হয় ৪.৫ শতাংশ, এবং প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়- ছুটের এই অনুপাত হ্রাস পাওয়ার ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির অনুপাতও বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১-তে দাঁড়ায় ৮৯.৬ শতাংশেএছাড়া, উচ্চ-প্রাথমিক স্তরেও বিদ্যালয়-ছুটের অনুপাত দাঁড়ায় ৫.৪ শতাংশে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই উন্নতির সামগ্রিক ফল হিসেবে এ-রাজ্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় ধারাবাহিকভাবে। এই উদ্যোগগুলির সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় পঠন-পাঠনের উন্নতির ওপর, বিশেষ করে বিদ্যালয় ভিত্তিক মাতা-শিক্ষক সমিতি এবং বিদ্যালয় পরিদর্শনের কাজকর্মের ক্ষেত্রে। এই পদক্ষেপগুলির ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, জাতীয় শিক্ষা গবেষণা পর্ষদের (NCERT) প্রকাশিত রাজ্যওয়াড়ি তথ্যাবলি (২০০৮) অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির শেষে ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও ভাষা জ্ঞানের মূল্যায়নে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সমগ্র দেশে হয়েছে দ্বিতীয়।

শিক্ষার সুযোগের সম্প্রসারণ এবং মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যাতে ছাত্রছাত্রীদের উৎপাদনে অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হয়, তার জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রসারের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এর ফলে রাজ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্ষেত্র/প্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০-১১ সালে পৌঁছায় ৩,১৮৬-তে এবং এই ক্ষেত্র/প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় প্রায় ৩.১১ লক্ষ ছাত্রছাত্রী।

একই দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার সুযোগের সম্প্রসারণের সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির ওপর, এর ফলে রাজ্যে মোট মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫৪-তে এবং কারিগরি/পেশাদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/বিভাগের সংখ্যা ৪১৪-তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও উন্নীত হয় ২০-তে। গুণমানের দিক থেকে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উৎকর্ষের নিরিখে সর্বভারতীয় স্তর থেকে চিহ্নিত হয় রাজ্যের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৭টি মহাবিদ্যালয়।

এর পাশাপাশি সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার মূল অগ্রাধিকার আরোপ করে শিক্ষার প্রসারে পরিকাঠামোর উন্নতি, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর। একইভাবে, অনগ্রসর শ্রেণির কল্যাণের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার প্রদান করা হয় শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং কর্মসংস্থানমুখী ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে।

শিক্ষার প্রতিটি স্তরে সুযোগের সম্প্রসারণ ও পঠন-পাঠনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে, বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উপযুক্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও পরিবেশ।

বিকেন্দ্রীকরণ
প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, নির্বাচিত পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই, এবং এই উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয়ও করা হয় বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগকে জেলা পরিচালনা কমিটি এবং ব্লক পরিচালনা কমিটিগুলির মাধ্যমে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যগুলির পঞ্চায়েতী রাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে সমগ্র দেশের মডেল হিসেবেই চিহ্নিত করেন। এই ধারণাকে সামনে রেখেই পরে (১৯৯২) পঞ্চায়েত এবং পৌর সংস্থাগুলির মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনও (যথাক্রমে ৭৩তম এবং ৭৪তম সংশোধন) করা সম্ভব হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, ভারত সরকারের পঞ্চায়েতী রাজ মন্ত্রকের রাজ্যওয়াড়ি পর্যালোচনার (২০০৯-১০) প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের নিরিখে সমস্ত দেশের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ অর্জন করে প্রথম স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্মান।

দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
এই সামগ্রিক উদ্যোগের ফলে এ-রাজ্যে বামফ্রন্টের আমলে শুধু যে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠামো, জনস্বাস্থ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার উন্নতি পরিলক্ষিত হয় তাই নয়, এই উন্নতির প্রভাবে দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পায় দারিদ্র্যের অভিঘাতও। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় যোজনা আয়োগের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৭৭-৭৮ সালে ৬০.৫ শতাংশ থেকে ২০০৪-০৫ সালে লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২০.৬ শতাংশে। এর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ওপর জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য (২০০৯-১০) থেকেও দেখা যাচ্ছে যে, যেখানে ১৯৯৯-২০০০ সাল এবং ২০০৯-১০ সালের সময়কালের মধ্যে সমগ্র দেশে প্রধান কাজ এবং দৈনিক কাজের ভিত্তিতে গড় বার্ষিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার হয়েছে যথাক্রমে ১.৬ শতাংশ এবং ৪.২ শতাংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই গড় বার্ষিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার থেকেছে অনেক উঁচুতে-যথাক্রমে ২.১ শতাংশ এবং ৪.২ শতাংশে।

* * *
সুতরাং ওপরের আলোচনার মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের (যার অধিকাংশই হলো ভারত সরকারেরই তথ্য) ভিত্তিতে আমরা অধ্যাপক কৌশিক বসুর বক্তব্যটি সমস্ত দিক থেকেই খন্ডন করে প্রমাণ করলাম যে বামফ্রন্টের আমলে এ-রাজ্যে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষতি নয়, ধারাবাহিকভাবে উন্নতিই পরিলক্ষিত হয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হয়েছে সর্বোচ্চ স্তরে। তবে শুধু অধ্যাপক বসু নন, অন্যান্য কিছু ব্যক্তিত্বও মাঝে মাঝেই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ না করে, হালকাভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ-রাজ্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের ভিত্তিহীন বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তথ্যের ভিত্তিতে তা খন্ডন করে প্রকৃত তথ্যগুলি বারংবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। এর পাশাপাশির কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা থাকলে, তাও স্বচ্ছতার সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে তা অতিক্রম করতে চাইছি তাও মানুষের কাছে বলতে হবে, তাঁদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে। 

সিঙ্গুর: সংক্ষেপে




·    মোট অধিগৃহীত জমি: ৯৯৭.১১ একর
·    মোট জমির মালিক ১৩হাজার ৪৯১জন
·    ক্ষতিপূরণ নিয়ে স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন ৬৭১একর জমির মালিক
·    ‘ইচ্ছুক’ জমির মালিকের সংখ্যা ১০হাজার ৮৫২জন
·    মোট জমিদাতার ৮২.৮২শতাংশ শিল্প গড়তে ‘ইচ্ছুক’
·    খাস জমি, রাস্তা, মালিকানাহীন, বিচারাধীন জমির মোট পরিমাণ ১৬৯একর
·    ক্ষতিপূরণ নেয়নি ১৫৭একর জমির মালিক
·    ‘অনিচ্ছুক’ জমির মালিকের সংখ্যা ২হাজার ৬৩৯জন
·    ক্ষতিপূরণের মোট পরিমাণ ১১৮কোটি ৯৫লক্ষ টাকা
·    ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ৯০কোটি ৮৭লক্ষ টাকা
·    নথিভূক্ত বর্গাদার ৩৩৬জন
·    বর্গাদার ক্ষতিপূরণ নিয়েছেন ২৪৯জন
·    বর্গাদার ক্ষতিপূরণ নেননি ৮৭জন


৩১শে আগস্ট দিকে দিকে শহীদ দিবস পালন করুন-গণ-আন্দোলন গড়ে তুলুন

মানবেশ চৌধুরী

(নতুন প্রজন্মের অনেক কমরেড ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের বিষয়ে কম জানেন। মূলত তাঁদের জন্য ঘটনাগুলি সাজিয়ে দিলাম।)

১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হবার পর কেন্দ্রে ও রাজ্যে যাদের হাতে শাসনভার আসে, তারা হলো দেশী-বিদেশী পুঁজিপতি ও গ্রামীণ জমিদারজোতদারদের তল্পিবাহক। তাদের তোষন করার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে দেশে খাদ্য সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
১৯৫৯ সাল ছিল একটা ঘটনাবহুল বছর, এই বছরে খাদ্য সংকট চরমে ওঠে। খোলা বাজার থেকে চাল, গম প্রভৃতির মতো অনেকগুলি অত্যাবশ্যক দ্রব্য উধাও হয়ে যায় এবং বহু গ্রামে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়। 
শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনসাধারণের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাঁরা খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং লাগাতার গণ আন্দোলন ও গন-বিক্ষোভ প্রদর্শণের রাস্তা গ্রহণ করেন। জনসাধারণের দাবিগুলি সহানুভুতির সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পরিবর্তে তখনকার পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার বিক্ষোভকারীদের উপর নির্মম দমন-পীড়ণের রাস্তা গ্রহণ করে।
জনসাধারন চেয়েছিলেন সস্তা দরে তাঁদের প্রয়োজনের খাদ্য পরিবর্তে পেলেন তাঁরা লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং বুলেট।
১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলন পরিচালনা করে বামপন্থী দলগুলি ও গণ সংগঠন সমুহ। মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধগঠন করে এই আন্দোলন গড়ে তোলা হয়।
১৯৫৯ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি বিধান সভায় দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম পর্যায়।
১৫ই জুন কংগ্রেস সরকারের খাদ্য নীতির প্রতিবাদে কলকাতায় প্রথম কেন্দ্রীয় সমাবেশ সংগঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে জেলায় জেলায় চলতে থাকে বিক্ষোভ সমাবেশ।
২৫ শে জুন পালিত হয় রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল।
১৩ ই জুলাই শুরু হলো জেল ভরো আন্দোলন। এক মাসের মধ্যে ১৬৩৪ জন গ্রেপ্তার হলেন।
৮ই আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো খাদ্য কনভেনশন।
এতো ঘটনার পরেও বধির সরকারের ঘুম ভাঙ্গলো না।
এই পরিস্থিতিতে ১৭ ই আগস্ট বামপন্থী দল ও গণ সংগঠন সমুহের ঐ মঞ্চ –‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটিঘোষণা করল ২৩ আগস্ট থেকে সারা পচ্ছিমবঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে খাদ্যের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করা হবে।
এই ঘোষণায় জনবিরোধী কংগ্রেসী সরকার আতঙ্কিত হয়ে উঠল এবং এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য এলাকায় এলাকায় হিংসার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। কিন্তু খাদ্যের ব্যবস্থা করলো না! বড়লোকদের দল তার শ্রেণীর স্বার্থ দেখা শুরু করলো।
২৩শে আগস্ট থেকে শুরু হলো খাদ্য আন্দলনের দ্বিতীয় পর্যায়।
২৬ শে আগস্ট মাঝরাতে বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের ধড়পাকড় ও ঘরে ঘরে খানাতল্লসী শুরু হলো। দুই সপ্তাহে মোট ২৬৩৪ জনকে সরকার গ্রেপ্তার করলো।
কিন্তু বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের উপর দমনপীড়ণের প্রতিবাদে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলেন। কলকারখানা-হাটে-বাজারে, মহল্লায়, গঞ্জে সর্বত্র মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রতিবাদে শামিল হলেন। কারন, লড়াইটা তো তাঁদেরই জন্য তাঁদেরই লড়াই।
কংগ্রেস সরকারের দমন-পীড়ণ সত্বেও ২৩শে আগস্ট থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের খাদ্য আন্দোলন দমন করা সম্ভব হলো না। সাধারন মানুষও গ্রেপ্তার হতে শুরু করলেন। ২৭ শে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭০০০ জন নর-নারী গ্রেপ্তার হলেন। 
৩১ শে আগস্ট খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ ও খাদ্যের দাবিতে এবং পুলিশি দমন-পীড়নের প্রতিবাদে কলকাতার শহীদ মিনার ময়দানে লক্ষ লক্ষ নরনারীর জমায়েত হলো। মহাকরণ অভিমুখে চলমান শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ লাঠি চালায়। সহস্রাধিক মানুষ পুলিশের আক্রমণে আহত হলেন। সাধারণভাবে বলা হয় ৮০ জন, কিন্তু কয়েকশত মানুষ ঐ বর্বর আক্রমণে মারা যান। শেষ রাতে প্রচুর মৃতদেহ পাচার করে দেয় সরকারী বাহিনী। 
ঐদিন গঙ্গারামপুর, বর্ধমান, বহরমপুর ও মেদিনীপুরেও পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
শুরু হলো খাদ্য আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল কংগ্রেসী সরকারের এই বর্বরতার কাহিনী।
১লা সেপ্টেম্বর পুলিশের লাঠি চালনা ও হিংস্র তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। এই ধর্মঘটি ছাত্রদের উপরেও পুলিশ আক্রমণ করে লাঠি চার্জ করে, গুলি চালায়। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনার ফলে ৮ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হলেন।
এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩রা সেপ্টেম্বর পালিত হলো সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। সেদিনও রাজ্যের বভিন্ন স্থানে গুলি চললো। মারা গেলেন ১২ জন এবং আহত হলেন ১৭২ জন। গ্রেপ্তার করা হলো নির্বিচারে।
কংগ্রেস সরকার কালোবাজারী ও মুনাফাখোরদের স্বার্থে, এভাবে শত শত নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় নর-নারীর উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকলো।
কিন্তু এতো অত্যাচার সত্বেও মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করা গেল না। মানুষ খাদ্যের দাবিতে আরও উত্তাল হয়ে উঠলেন।
৮ই সেপ্টেম্বর সারা রাজ্যে পালিত হলো ছাত্রদের ডাকে শহীদ দিবস। 
রক্তস্নাত কলকাতার বুকে ১০ই সেপ্টেম্বর সংগঠিত হলো অবিস্মরণীয় মৌন মিছিল। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য তদন্ত চাই, খাদ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। ১৮৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
১৯শে সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লনে শহীদ স্তম্ভ বানানো হলো। 
২৪শে সেপ্টেম্বর সত্যাগ্রহ পালান করলেন নানা সংগঠন।
২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ স্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলো। 
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, ব্যাপ্তি ও সংঘর্ষের বিচারে ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিরাট। 
বামপন্থী দল ও গণসংগঠনসমূহ ঠিক করলো, প্রতি বছর ৩১শে আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হবে।
পরে ঠিক হয়, শুধু খাদ্য আন্দোলনের শহীদ নন, সকল শহীদের স্মরণেই ৩১শে আগস্ট শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হবে। এবং সে ভাবেই হয়ে আসছে।
শুধু শহীদদের স্মরণ করা নয়, কঠিন কঠোর লড়াইয়ের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার শপথ নেবার দিন ৩১শে আগস্ট।
প্রতিবছরই এই শহীদ দিবসটি খাদ্যের দাবির লড়াইয়ের বিষয় সহ লড়াইয়ের ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এবারও তাই ই হয়েছে।

(যাঁরা বলবেন তাঁদেরকে বর্তমান সময়ের বিষয়গুলি অতঃপর ব্যাখ্যা করতে হবে।)
 

নয়া-উদারবাদের ২৫বছর: শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিরোধ


এ কে পদ্মনাভন

শ্রমিকশ্রেণী হলো দেশে নয়া-উদারবাদী জমানায় আক্রমণের মুখ্য লক্ষ্যবস্তু। ১৯৯১ সালে এই নীতি ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই শাসকশ্রেণী এবং নীতি-নির্ধারকরা শ্রমজীবী মানুষ এবং তাঁদের কষ্টার্জিত অধিকারকে আক্রমণ করেই নীতি শানিয়েছে।

এমনকি যখন আরও বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হয়, তখনও কর্তৃপক্ষ কেবলমাত্র ‘ব্যাঙের ছাতা’-র মতো গজিয়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যাধিক্য এবং শ্রম আইনগুলির অনমনীয়তাকেই দোষারোপ করতে থাকেন। এরসঙ্গে, এখন ‘নমনীয়তা’ এবং ‘কর্মসঙ্কোচন’-এর মতো স্লোগানগুলি গোটা দেশে যে সঙ্কট নেমে এসেছে, তার থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। 

গত ২৫বছরে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর অভিজ্ঞতা হলো, দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলির আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে, যদিও তখন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়নি। একমাত্র যারা বামপন্থী বৃত্তে ছিলেন, তাঁরাই উপলব্ধি করেছিলেন যে এই নীতিগুলি রূপায়িত হলে দেশে বিপর্যয় নেমে আসবে। 

১৯৯১সাল থেকে এই নয়া-উদারবাদী ‘সংস্কার’ রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের  শ্রমজীবী জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল শ্রম আইনগুলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। শ্রমিকের তাঁর পছন্দমতো একটি ইউনিয়ন গড়ার অধিকারও এর মধ্যে পড়ে। ১৯২৬সালে দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আইন প্রণয়ন হয়। এটা ঘটনা যে ব্রিটিশ আমলে এই আইন প্রণীত হলেও জাতীয় স্তরে কর্তৃপক্ষকে একটি ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করায় স্বাধীন ভারতে এখনও পর্যন্ত শ্রমিকদের যৌথভাবে দর কষাকষির অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি। 

শ্রম আইনগুলির ক্ষেত্রে এই ‘সংস্কার’-এর রূপায়ণের বিভিন্ন দিক আছে, যারমধ্যে রয়েছে বর্তমানে চালু শ্রম আইনগুলি প্রয়োগ না করা; এই আইনগুলিকে প্রয়োগে বাধ্য করার জন্য সরকারী যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেগুলি গুটিয়ে ফেলা এবং চালু আইনগুলিতে নতুন করে শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী সংশোধনী আনা। কিন্তু, ব্যাপক ধর্মঘটসহ তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন এবং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রধান দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কেন্দ্রে পরপর জোট সরকার গঠিত হওয়ায় এই প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।   

গত ২৫বছর ধরে গণতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের ওপর আক্রমণ নেমে আসা সত্ত্বেও তাই বড় আকারের কোনো সংশোধনী গৃহীত হতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন যে সব শিল্প গড়ে উঠেছে, সেসব জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কার্যত অস্বীকার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র বহুজাতিক সংস্থাগুলিতেই নয়, ভারতীয় কর্পোরেটরাও, যাদের অন্যত্র তাদের সংস্থায় এই অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হয়েছে, তারাও এই ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলিক অনুকরণ করছে।

এই পরিস্থিতিতে, কর্তৃপক্ষ সহজেই শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারছে। স্থায়ী ধরণের কাজের অস্থায়ীকরণ এবং ঠিকাকরণ করাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন শ্রমিকরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইউনিয়ন গড়ার দাবিতে ময়দানে নামছে, তখনই এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, যে একজনও নিয়মিত শ্রমিক না রেখে কিভাবে কোনো কারখানায় বছরের পর বছর উৎপাদন চালিয়ে গেছে।  

এর ফল হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির ৬০শতাংশের বেশি এমনকি বিধিবদ্ধ ন্যুনতম মজুরি এবং ই এস আই ও ই পি এফ-এর মতো সামাজিক নিরাপত্তাগুলি পাচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ৫০শতাংশের বেশি এবং বেসরকারী ক্ষেত্রের ৭০শতাংশের মতো শ্রমিক ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করছেন। এই সমস্ত শ্রমিক বিভিন্ন নামে স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী এবং ধারাবাহিক কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, যা ঠিক শ্রমিক (নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ) আইন এবং অন্যান্য শ্রম আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। বহু প্রতিষ্ঠানে ১২ঘন্টা কাজ করা এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর আরেকটি দিক হলো, শিল্পক্ষেত্রে মজুরির অংশ ক্রমশ কমছে, ১৯৮২-৮৩সালে যেখানে এটা ছিল ৩০শতাংশ, সেখানে ২০১২-১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১২.৯শতাংশে। আবার মজুরির হার যখন কমছে, তখন মালিকদের মুনাফার অংশ একই সময়ে ২০শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে।

১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩সাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতি একই গতিতে এগিয়েছে, যদিও এই সময়ে বিভিন্ন দল বা জোটের সরকার ছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মোদী সরকার আরও ‌আগ্রাসী পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে।   

কাজের সুযোগ ক্রমশ কমতে থাকায়, শোষণের মাত্রা বহুমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগঠিত, অসংগঠিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারী-সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এদের সঙ্গে রয়েছেন বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে যুক্ত কর্মীরা, যারা শুধুমাত্র একটা সাম্মানিক পান, যাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১কোটি।

কেন্দ্রের মোদী সরকার গত ২৬মাসে একগুচ্ছ শ্রম আইন সংশোধনীর প্রস্তাব রেখেছে। ইতিমধ্যে, সরকার  ঘোষণা করেছে যে ৪৪টি শ্রম আইনকে তারা ৫টি শ্রম কোডে পরিবর্তিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত ধারাগুলি তুলে নেওয়া হবে। সংসদে এই মজুরি কোড বিল ও শিল্প সম্পর্ক কোড বিলের খসড়া পেশ করার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। কারখানাসমূহ সংশোধনী বিল ইতিমধ্যেই সংসদে পেশ করা হয়েছে, সরকার এই বিলের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং কমিটির সমস্ত সুপারিশ বাতিল করেছে এবং এই বিলের পশ্চাদ্‌গামী সংশোধনী কার্যকর করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। একই সঙ্গে, আরেকটি নতুন বিল-ছোট কারখানাসমূহ বিল-ও তৈরি হয়ে গেছে। এই দুটি বিলের নেট ফল হবে যে ৭৫শতাংশের বেশি কারখানা শ্রমিক কারখানাসমূহ আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে এবং ন্যুনতম মজুরি আইন, মাতৃত্বকালীন আইন, ই এস আই, ই পি এফ-সহ ১৪টি মৌলিক শ্রম আইনের বাইরে তাদের ঠেলে দেওয়া হবে।    

শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, অনেক রাজ্য সরকারও, বিশেষ করে বি জে পি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই ধরণের শ্রম আইন সংশোধন চলছে, কেন্দ্রের আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। কার্যত, রাজস্থান সরকার এই প্রশ্নে নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রাজস্থান সরকারকে অনুসরণ করার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে বলা হয়েছে। 

১৯৯১ সাল থেকেই শ্রমজীবী মানুষ এই নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আসছে। বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ নেমে আসা সত্ত্বেও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলছে। দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মঘটে শামিল হয়েছে শ্রমিকশ্রেণী।

দেশের সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন  আন্দোলনের সাফল্য এটাই যে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও জাতীয় স্তরের কর্মচারী ফেডারেশনগুলি নয়া-উদারবাদী নীতিগুলির বিরুদ্ধে যৌথ মঞ্চ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ১২দফা সর্বসম্মত দাবির ভিত্তিতে এই মঞ্চের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়েছে।

১৯৯১সাল থেকে মোট ১৬টি সাধারণ ধর্মঘটে ১৭দিন দেশ স্তব্ধ হয়েছে। গতবছর ২রা   সেপ্টেম্বর বি এম এস শেষ মূহুর্তে প্রত্যাহার করলেও দেশের ১৫কোটি শ্রমজীবী মানুষ এই ধর্মঘটে অংশ নেন, যাদের অনেকেই কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নন।

মোদী সরকার গত সাধারণ ধর্মঘটের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সংস্কার’ আরও ত্বরান্বিত করেছে। এরমধ্যে ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’ সাম্প্রতিকতম, যা বাজপেয়ী সরকারের সময় আনা হলেও বামপন্থীদের চাপে প্রথম ইউ পি এ সরকার প্রত্যাহার করেছিল।

এই পরিস্থিতিতে, নয়া উদারবাদী নীতির ২৫ বছরে আগামী ২রা সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও জাতীয় স্তরের কর্মচারী ফেডারেশনগুলি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।  শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নামিয়ে আনা এই আক্রমণের মুখের মতো জবাব দিতে তৈরি হচ্ছে।  

ধর্মঘট নিয়ে মোদীকে বার্তা মমতার

কেন্দ্রের মোদী সরকারকে বার্তা দেওয়ার সাথে সাথে ‘বন্‌ধ’ নিয়ে তাঁর দলের কলঙ্কজনক ইতিহাসকেও মুছে দিতে চাইছেন মমতা ব্যানার্জি।

১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর থেকে না হয় বাদই দেওয়া গেলো, শুধুমাত্র ২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত রাজ্যসহ বিভিন্ন স্তরে ১৭টা ‘বন্‌ধ’ ডেকেছিল তৃণমূল তার মধ্যে ২০০৭ ও ২০০৮, এই দুই বছরেই ১২বার ১২ঘন্টা (পরে কমে ১০ঘন্টা) ‘বাংলা বনধ্‌’ ডেকেছিল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দল।

এই মমতা ব্যানার্জিই শুক্রবার ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘বাংলায় কোনও বন্‌ধ করতে অ্যালাউ করব না। বন্‌ধ-এর নামে কোনও হুজ্জতি বরদাস্ত করব না। বনধ-এর দিনে দোকানপাট খোলা থাকবে, গাড়ি চলবে।’’

লক্ষ্য করুন ‘বনধ্‌’ শব্দটির দিকে। অন্ততপক্ষে ৬মাস আগে বি এম এস ছাড়া দেশের সবকটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং জাতীয় স্তরের শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন আগামী ২রা সেপ্টেম্বর ১২দফা দাবিতে ‘বনধ্‌’ নয়, ডাক দিয়েছে সাধারণ ধর্মঘটের। গোটা দেশে, এরাজ্যেও দাবিগুলির ভিত্তিতে প্রচার এখন প্রায় তুঙ্গে। কী কী দাবি? আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিরোধে ব্যবস্থা, সীমাহীন বেকারীর বিরুদ্ধে কর্মসংস্থানের দাবি, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা, ১৮হাজার টাকা ন্যুনতম বেতন, ৩হাজার টাকা অবসরকালীন ভাতা ইত্যাদি। এটা মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ‘বন্‌ধ-এর নামে হুজ্জতি’ নয়, শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা, অধিকার রক্ষার লড়াই। সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করে আসলে মমতা ব্যানার্জি এই দাবিগুলিরই বিরোধিতা করছেন  

আর অন্যদিকে, তৃণমূল যে সব কারণে তখন ‘বাংলা বন্‌ধ’ ডেকেছিল, তা আজ ওদের নেতারাও মনে করতে পারবেন না, কারণ নিছক বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা করা ছাড়া সে সবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো যোগ ছিল না। আসলে ‘বন্‌ধ-এর নামে হুজ্জতি’ অথবা তথাকথিত ‘হুজ্জতি’-র ইতিহাস তৃণমূলেরই। ‘বাংলা বন্‌ধ’ ডেকে অথবা না ডেকেই যখন-তখন পথ অবরোধ, রেল অবরোধ, বাস-ট্রাম ভাঙচুর, আগুন লাগানো, বোমা মারার যে ইতিহাস মুখ্যমন্ত্রীর দল তৃণমূল তৈরি করেছে, তা কখনই ভোলার নয়।

২০০৭ও ২০০৮, শুধু এই দুবছরেই কলকাতায় রাস্তা অবরোধ করে ৫৪টা সরকারী বাসে ভাঙচুর, ২৬টা সরকারী বাস পুড়িয়েছিল তৃণমূল। ২০০৬ সালের ৩০শে নভেম্বর স্বয়ং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিধানসভা ভাঙচুর করেছিল তৃণমূল বিধায়করা, যাদের অনেকেই এখন রাজ্যের মন্ত্রিসভা ‘অলঙ্কৃত’ করছেন। ডব্লিউ বি আই ডি সি অফিস ভাঙচুর, বিভিন্ন সরকারী অফিস, থানা ভাঙচুরের কথা এর সঙ্গে যোগ করলে কুল পাওয়া যাবে না।   

আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এরাজ্যে তৃণমূলেরই এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এর নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিজে। ধর্মতলায় অনশনের (!) নামে ২৬দিন মেট্রো চ্যানেল অবরোধ অথবা সিঙ্গুরে মোটরগাড়ি কারখানা তুলে দেওয়ার জন্য দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ১৭ দিন ধরে অবস্থান-অবরোধ ছাড়াও ২০০৭ ও ২০০৮, এই দুবছরে শুধু কলকাতায় বিভিন্ন কারণে ৩২বার রাস্তা অবরোধ করেছে তৃণমূল। আর একই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শহরতলীতে ২৮বার রেল অবরোধ করে মুখ্যমন্ত্রীর দল।   

এই যখন তাঁর দলের ইতিহাস, তখন সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করছেন কেন মমতা ব্যানার্জি? বিশেষ করে যখন এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে গোটা দেশে এবং দাবিগুলি মূলত কেন্দ্রের বি জে পি সরকারের বিরুদ্ধে। আসলে রহস্য অন্য জায়গায়। দেশের অন্য কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করে এখনও পর্যন্ত মুখ খোলেননি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি খুলেছেন, কারণ তিনি বার্তা দিতে চান নরেন্দ্র মোদীকে যে তৃণমূল তাঁর সরকারের পাশেই আছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে সাধারণ মানুষের নজর এড়ানোর জন্য মুখে যতই তর্জন-গর্জন করুন না কেন, লোকসভা বা রাজ্যসভা, সংসদের উভয় কক্ষেই প্রায় প্রতিটি প্রশ্নে তৃণমূলের নিঃশর্ত সমর্থন পেয়েছে মোদী সরকার। 

সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতা করেও একইভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বার্তা দিতে চেয়েছেন।   

বন্‌ধ ও অবরোধ: তৃণমূলের কলঙ্কময় ইতিহাস

২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে  পর্যন্ত রাজ্যসহ বিভিন্ন স্তরে ১৭টা বন্‌ধ ডেকেছিল তৃণমূল

২০০৬, ৩০শে নভেম্বর : বিধানসভা ভাঙচুর, কলকাতায় অবরোধ, বাস ভাঙচুর

২০০৬, ১লা ডিসেম্বর : বন্‌ধ
         ২রা ডিসেম্বর : ট্রেন অবরোধ , হামলা
         ৫ই ডিসেম্বর : এস ইউ সি-নকশাল বন্‌ধ - তৃণমূলের সমর্থন
         ৬ই ডিসেম্বর : রাজ্যে ২ ঘন্টার জন্য রাস্তা ও রেল অবরোধ

২০০৬, ২১শে ও ২২শে ডিসেম্বর: ৪৮ ঘন্টা বন্‌ধ ডেকেছিল, যদিও ২০শে ডিসেম্বর রাতে  প্রত্যাহার  করে  নেয়         
        
২০০৭, ১৬ই মার্চ: তৃণমূলের বাংলা বন্‌ধ

২০০৭, ১২ই নভেম্বর : কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস ও বি জে পি সকলে মিলে বন্‌ধ ডাকে, গোটা রাজ্যে হামলা হয়েছিল

২০০৭  ও ২০০৮ সালে
·       ধর্মতলায় অনশনের (!) নামে ২৬দিন মেট্রো চ্যানেল অবরোধ
·       সিঙ্গুরে মোটরগাড়ি কারখানা তুলে দেওয়ার জন্য দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ১৭ দিন ধরে অবস্থান-অবরোধ
·       শুধু কলকাতায় বিভিন্ন কারণে ৩২বার রাস্তা অবরোধ
·       কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শহরতলীতে ২৮ বার রেল অবরোধ
·       সারা রাজ্যে ১ ঘন্টার জন্য ২বার রেল অবরোধ
·       ১২টা ১২ ঘন্টার (পরে কমে ১০ ঘন্টা) বাংলা বনধ
·       কলকাতায় ৫৪টা সরকারী বাসে ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ
·       কলকাতায় ২৬ টা সরকারী বাস পোড়ানো, রাস্তা অবরোধ

এছাড়া, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ২০০৯সালের ৩রা জানুয়ারি সারারাত রাস্তা অবরোধ, ডব্লিউ বি আই ডি সি অফিস ভাঙচুর, বিভিন্ন সরকারী অফিসে, থানা ভাঙচুর।

vএছাড়া জেলাভিত্তিক বা স্থানীয় স্তরে অসংখ্য বন্‌ধ করেছে তৃণমূল। অবরোধ, সরকারী অফিস-কাছারি ভাঙচুর, থানায় হামলা, বাস পোড়ানো ছিল তৃণমূলের নৈত্যনিমিত্তিক ঘটনা। সরকারে আসার পরেও নানা জায়গায়, বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ‌্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েই যাচ্ছে তৃণমূলীরা, এক্ষেত্রে সরাসরি পুলিস প্রশাসনের মদত পাচ্ছে।