20181215

After the culmination of a farmer's march in Kolkata, 100,000 farmers have gathered in the capital city of Delhi to protest against the agrarian crisis.

আত্মহত্যা থেকে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের পথে কৃষকরা: এক ঐতিহাসিক সূচনা

পি সাইনাথ 

over-a-lakh-protesting-farmers-take-out-kisan-mukti-march-in-delhi-500210



ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি আর ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে ২৯ এবং ৩০ নভেম্বর দিল্লির রাজপথ কাঁপিয়েছেন কৃষকরা। হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত সাংবাদিক পবন দহতের নেওয়া একটি সাক্ষাৎাকারে এই আন্দোলনকে ঐতিহাসিক সূচনা বলে চিহ্নিত করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথ। এখানে সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা হলো।
--------------------------------------------------------------

প্রশ্ন: ‘দিল্লি চলো’ মার্চ কীসের জন্যে?

অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি (এ.আই.কে.এস.সি.সি) প্রায় ১৫০ থেকে ২০০টা কৃষক সংগঠনের একটি সংঘ, তাদের কেউ কেউ খুব ছোটো, কেউ কেউ খুব বড়ো। তারা একটা ডাক দিয়েছে নভেম্বরের ২৯ আর ৩০ তারিখ সংসদ ভবন যাওয়ার। এই ভাবনাটা এসেছে নাসিক মুম্বাই মার্চের পরে, যেখানে এই বছরের শুরুতে ৪০ হাজার আদিবাসী কৃষক মুম্বাই এসেছিলেন আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ১০ হাজার সাধারণ মানুষএকেবারে পদ্ধতিগত ভাবে কৃষকদের কোনও গুরুত্বপূর্ণ দাবিকেই সংসদ এতদিন নজর দেয়নি। স্বামীনাথন কমিশনের প্রথম রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। আর শেষ রিপোর্ট জমা পড়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবরে। গত ১৪ বছর ধরে কৃষকদের জাতীয় কমিশন সংসদে স্রেফ পড়ে আছে, এত বছরে সংসদ এক ঘণ্টা সময়ও বার করতে পারেনি সে বিষয়ে আলোচনার জন্যে। কিন্তু যখন কর্পোরেট সেক্টর বা জিএসটি-র মতো বিষয় আসে, যেগুলো একেবারে দায়িত্ব নিয়ে হাজার হাজার ছোটো মাঝারি সংস্থাকে ধ্বংস করছে, তখন সংসদ এক সপ্তাহের মধ্যে বিশেষ অধিবেশন ডেকে মাঝরাতে সেই বিল পাস করতে পারে। কিন্তু ১৪ বছর ধরে তাঁরা সময় পায়নি কৃষকদের জাতীয় কমিশন নিয়ে আলোচনার জন্যে.আই.কে.এস.সি.সি প্রধানত দুটি দাবি নিয়ে জোর দিচ্ছে। একটি হল ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আর অনুদানমূলক মূল্য বিষয়ে সংসদে একটা প্রাইভেট মেম্বর বিল আনা। আর দ্বিতীয়টি হল কৃষিঋণ থেকে মুক্তির বিল। কিন্তু কৃষি সংকট একটা বড়ো বিষয়, সেটা ঠিক দুয়েকটা বিলের বিষয় নয়।

আমি মনে করি, নাসিক-মুম্বাই মার্চ একটা টার্নিং পয়েন্ট যা গোটা দেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দিয়েছে। তারপর থেকে দেশের নানা জায়গায় অন্তত কুড়িটা কৃষক মার্চ হয়েছে। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা যে কৃষকেরা তাদের বিগত বিশ বছরের হতোদ্যম অবস্থা থেকে জেগে উঠছেন এই হতোদ্যম অবস্থা তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, জেগে উঠে তাঁরা প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটছেন যেটা তাঁদের অধিকার আদায়ের দিকে নিয়ে যাবে। আমি মনে করি, এটা একটা খুবই ভালো জিনিস ঘটছে। আমি প্রস্তাব দিয়েছি, তাদের একটা দাবি হওয়া উচিত যে, সংসদকে কেবলমাত্র কৃষি সংকট নিয়ে তিন সপ্তাহের একটা বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হবে। যেখানে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সেখানে এই বিষয়ে সারা দেশের নজর পড়া উচিত। গোটা দেশের কৃষকদের এটা বলা দরকার যে, তাঁরা দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, দেশ তাদের ব্যাপারে ভাবুকযখন এ.আই.কে.এস.সি.সি আর বাকিরা কৃষক মার্চের দাবিকে সমর্থন করল তখন বিভিন্ন মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এই বছরের অগাস্ট মাসে দিল্লিতে একসঙ্গে বসে। একটা ফোরাম তৈরি হয়েছে, নাম ‘নেশন ফর ফার্মার’।

শেষ কবে বলুন তো মধ্যবিত্ত মানুষেরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন? নাসিক-মুম্বাই মার্চের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে সেটা আবার শুরু হয়েছে। কৃষক এবং মজুর গণপরিসরে সাধারণ মানুষের আলোচনার মধ্যে উঠে আসছে, মধ্যবিত্ত অঙ্গনওয়ারীর মানুষের সঙ্গে কথা বলছে, কৃষক আর খেতমজুরের সঙ্গে কথা বলছে। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো, এটা সমতার, সাম্যের পক্ষে ভালো।

প্রশ্ন: সংসদে ২১ দিনের বিশেষ অধিবেশনের দাবির ক্ষেত্রে ভাবনাটা কী?

‘নেশন ফর ফার্মার’ এর ভাবনাটা এরকম যে, সংসদে কমপক্ষে তিন সপ্তাহের একটা বিশেষ অধিবেশন প্রয়োজন কারণ তাদের অনেকগুলো বিষয়ে নজর দিতে হবে। অন্তত তিন দিন লাগবে স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্টের অনুপুঙ্খ আলোচনার জন্য। কয়েক দিন লাগবে সহায়ক মূল্য আর কৃষিঋণ মুকুবের বিল দুটো পাস করতে, কারণ অনেকগুলি রাজনৈতিক দল এতে সই করেছে এই বলে যে এই বিষয়ে সমর্থন আছে ফলে তাঁরা এই দুটি বিল খুব সহজেই তাড়াতাড়ি পাস করাতে পারেন। তিন দিন ঋণ সংকট নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার জন্যে, যেটা কেবল একটা কৃষিঋণ মুকুবের থেকে অনেক বড়ো বিষয়। আমি কৃষিঋণ মুকুবের পক্ষে, কিন্তু যতক্ষণ না আপনি ঋণ ব্যবস্থাকে নতুন করে পর্যালোচনা করছেন পরের বছরে আবার কৃষকেরা এসে একই সমস্যার মুখে পড়বেন কারণ কৃষি ঋণের সুযোগকে কৃষকের দিক থেকে কৃষি ব্যবসায়ীর দিকে ঘুরয়ে দেওয়া হয়েছেছোটো এবং প্রান্তিক কৃষকের কাছে ক্ষুদ্র ঋণের নামে দিনে দিনে আরও কম টাকা যাচ্ছে। তাই তিন দিন আলোচনা হোক ঋণ সংকট আটকাতেএর আরেকটা অর্থ সরকারি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ করা যাবে না। নয়তো এই মানুষগুলো কোনও ঋণ পাবেন না। উলটে এদের প্রাপ্য ঋণের টাকা আবার পাঠিয়ে দেওয়া হবে বড়ো কর্পোরেট কোম্পানির কাছে। তিন দিন আলোচনা হোক কৃষিতে যে ভয়ংকর জলসংকট চলছে তাই নিয়ে, এটা কিন্তু খরার থেকেও অনেক বড়ো সমস্যা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই দেশ এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কিছু ভাবছেই না। দেশে জল সংকটের ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্থানান্তর বা হাত বদল হয়ে গেছে, যেমন জল চলে গেছে গরিবের থেকে বড়োলোকের হাতে, কৃষির থেকে শিল্পের হাতে, খাদ্য শস্যের বদলে অর্থকরী ফসলের হাতে, গ্রাম থেকে শহরের হাতে, জীবিকা থেকে লাইফস্টাইলের হাতে। জল নিয়ে একটা আইন থাকা দরকার যে এটা পণ্য বা ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, এটা মৌলিক মানবাধিকার। সমানাধিকার আর ন্যায়বিচারের আরও কিছু বিষয় আছে এখানে। গ্রামাঞ্চলে জলের অধিকার নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত, বিশেষত যাদের জমি নেই, যাঁরা কৃষক নন তাদেরও জলের অধিকার নিয়ে।

তিন দিন এই আলোচনায় সময় দেওয়া হোক মহিলা কৃষকদের নিয়ে, যেটা আমার মনে হয় আলোচনা না করলে কখনওই কৃষি সংকটের সমাধান হবে নাআলোচনা করতে হবে মহিলা কৃষকদের কৃষিরঅধিকার এবং স্বীকৃতি, মহিলা কৃষকদের জমির অধিকার নিয়ে, যারা কৃষিক্ষেত্রের ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্ত। যেমন দলিত কৃষকদের জমির অধিকার, যারা জমি প্রদানের ২০ বছর পরেও পাট্টা পাচ্ছেন না, রাষ্ট্র সেই জমি দখল করছে আদানি বা অন্য কারোর নামে। সেখানে গরিব আদিবাসী কৃষক জানেনই না পাট্টার ব্যবস্থা সম্পর্কে। তাই জমির অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তিন দিন ভুমি সংস্কারের যে কাজ পড়ে আছে সেই নিয়ে আলোচনা হোকতিন দিন আলোচনা হোক যে, ২০ বছর পরে দেশে কী ধরণের কৃষির প্রয়োজন তাই নিয়ে। কর্পোরেট চালিত, কেমিক্যাল কোম্পানি নির্ভর কৃষি নাকি জনগোষ্ঠী চালিত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নির্ভর চাষ? খুব গুরুত্ব দিয়ে আইনসম্মত ভাবে ভাবা দরকার যে বছরের পর বছর ধরে যে নাটকীয় ভাবে কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যয় বরাদ্দ কমছে সেই বিষয়ে। কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে রক্ষা করতে হবে এবং বাড়াতে হবে। তিন দিন আলোচনা হোক কৃষি সংকটের আক্রান্তদের বিষয়ে, বিদর্ভের বিধবা, অনন্তপুরের অনাথেরা প্রথমবার ঐতিহাসিক পদক্ষেপে এগিয়ে আসুন পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে, তাঁরা সংসদ আর দেশবাসীদের জানান যে কৃষি সংকট আসলে কী আর সেটা তাদের জীবনে কী নিয়ে এসেছে। তবেই একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের মনোভঙ্গী পাওয়া যাবে এদের সম্পর্কে। ‘নেশন ফর ফার্মার’ সংসদে একটা বিশেষ অধিবেশন চাইছে। আমাদের যা বলার তা হল, প্রত্যেকটি নাগরিক, সকলেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত, কেবল খাবারের জন্যে নয় আমরা প্রত্যেকেই মাত্র দুতিনটি প্রজন্ম আগেই গ্রামে থাকতাম। এই পরিস্থিতিতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এই কৃষকদের প্রাথমিক শ্রেণির যোগাযোগটা নতুন করে স্থাপন করতে হবে।

প্রশ্ন: বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন আছে। আমাদের সংসদে কৃষি সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া আছে এমন সাংসদ খুব কম। এমনকি এই বিষয়গুলো যদি তোলাও হয়, আপনার মনে হয় সেখানে কোনও সত্যিকারের আলোচনা হবে?

তাঁরা সত্যিকারের আলোচনা করবেন কি করবেন না সেটা কোনও প্রশ্নই নয়তাঁদের সত্যিকারের আলোচনা করতে বাধ্য করা নির্ভর করছে আমাদের ওপরদেখুন আমাদের একটা বিকল্প আছে, ধরা যাক বললাম, তাঁরা সংসদে এই নিয়ে সত্যিকারের আলোচনা করলেন নাএখন বিষয়টা হল, একজন নাগরিক হিসেবে আপনি কি চান যে সাধারণ মানুষের কাজ করানোয় সংসদকে বাধ্য করতে? নাকি আপনি চান সংসদ থাকুক কেবল কর্পোরেট দুনিয়ার জন্যে? যেখানে বসে কেবল জিও আর জিএসটি-র জন্যে কাজ হবে, কেবল ডিজিটাল কোম্পানি আর নোটবন্দীর কাজ হবে?

সংসদ ভালো হবে না খারাপ হবে সেটা আমাদের ওপর নির্ভর করবে, আমাদের সমাজের ওপর, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপরআমার যেটা বলার তা হল, আমার কি এটা বলা কাজ যে ওরা আমার অধিকার রক্ষা করছে না, আমার অধিকার প্রয়োগ করতে দিচ্ছে না, তাই আমি আমার সব অধিকার ত্যাগ করলাম? এটা আমার কাছে একটা মুর্খের রাজনীতি বলে মনে হয়। আমি বলব যে সংসদ তৈরিই হয়েছে মানুষের কাজ করার জন্য ২৯ আর ৩০ তারিখে দিল্লি মার্চের একটা ভালো বিষয় হল, আমাদের সংবিধান যে মানুষের জন্য সেটা নতুন করে দাবি করা, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র যে সাধারণ মানুষের সেটা নতুন করে দাবি করা। সংসদ মানুষের জন্যে কাজ করবে এর থেকে গণতান্ত্রিক দাবি আর কী হতে পারে?

প্রশ্ন: সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের মধ্যে নানারকম আদর্শগত ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। আপনি কি মনে করেন যেভাবে আমাদের রাজনীতিক পরিবেশ প্রতিদিন আরও বেশি বেশি করে আঞ্চলিক হয়ে যাচ্ছে সেখানে তাঁরা এমন একটা বোঝাপড়ায় যেতে পারবে?

অবশ্যই একটা আদর্শগত ভিন্নতা আছে, নয়তো ২০০টা সংগঠন থাকত না, একটাই থাকত। সেটা আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবিও দেখায় – কেন ৩০ খানা রাজনৈতিক দল রয়েছে? এটা আমাদের সমাজের বিভেদ আর বর্ণ-সংকরতার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই সেখানে আদিবাসী কৃষক আছে যাদের জন্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রধান ইস্যু নয়। তাদের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন হবে। আমি মনে করি না যে এই মার্চ সবকিছুর জন্যে একটা চরম উত্তর। আমি মনে করি এটা একটা শুরু, যেমন মুম্বাইতে হয়েছিল, তেমনই দিল্লিতে মধ্যবিত্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবে। আমি কেবল এই বিষয়ে আগ্রহী যে, আমরা এই মধ্যবিত্ত পেশাদার শ্রেণি, আমাদের নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পারি এই লড়াইয়ের মধ্যে, এই দাবিগুলির মধ্যে যেগুলো সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি। আপনি একজন সাংবাদিক কিন্তু আপনি একজন মানুষ তো, একজন নাগরিকও তো।

আমি তেমন ভয়ংকর কিছু পার্থক্য দেখছি না। আমরা এমন একটা দেশে থাকি যেখানে ৭৮০ টা ভাষায় কথা বলা হয়, আর আপনি দেখছেন যে একটা প্রবণতা যেখানে সেই সব কিছু শেষ করে হিন্দি সব জায়গায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছেআমার কাছে ৭৮০টা ভাষা নিয়ে আমরা আশ্চর্যজনক সম্পদশালী। যদি আপনারা একটা একমাত্রিক, একরঙা সমাজ চান, যেখানে ১৩০ কোটি মানুষ বাস করে, যাদের মধ্যে কোনও রকম কোনও পার্থক্য নেই, আমি সেই পৃথিবীতে থাকতে ঘৃণা বোধ করব। আমি চাইব বৈচিত্র্য থাকুক। যাতে অনেক পার্থক্য জেগে ওঠে যেখান থেকে আপনি এসেছেন আর যেখানে আপনি আছেন তার মধ্যে। যদি আপনি জম্মু কাশ্মীরের একজন কৃষক হন, তাহলে আপনার এমন অনেক দাবির বিষয় থাকবে যা বাংলার কৃষকের থেকে আলাদা। কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যাতে যেখানে তাঁরা এক হতে পারেন। আপনি এমন কতজন কৃষককে চেনেন যারা স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্টের বিরোধিতা করছেন? আপনি যেখানেই যান, তাঁরা অন্তত এই বিষয়ে শুনেছে। কতজন কৃষক আছেন যাঁরা আরেকটু ভালো ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিরোধিতা করছেন? তাহলে, এমন কতগুলো মৌলিক বিষয় আছে যেখানে তাঁরা একসঙ্গে আসবেন, আর এর প্রক্রিয়াটা একটা ছোটো বিষয় নয়। যত আপনি এগিয়ে যাবেন, আরও আরও বেশি করে মানুষ ভাববে এই বিষয়গুলো নিয়ে। একটা স্বামীনাথন কমিশনের ধারণার জন্যেও প্রত্যেককে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

(অনুবাদ: কণিষ্ক ভট্টাচার্য)
--------

20181205

#দিদিভাই-মোদীভাই: ফ্রেন্ডশিপ আনলিমিটেড



অজয় দাশগুপ্ত   

গত ১০ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮। পেট্রল-ডিজেলের দামে আগুন, বাজারে জিনিসপত্রের দামও একইভাবে হুহু করে বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই বামপন্থী দলগুলিসহ প্রায় সমস্ত বিরোধী দল ভারত বনধ্‌-এর ডাক দিলো। তৃণমূলের অবস্থান ছিল দেখার মতো, একেবারে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ গোছের! বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বন্‌ধ-এ ওদের ‘না’ (যদিও বামফ্রন্ট সরকারের সময় এরাজ্যে মুড়ি-মুড়কির মতো বনধ্‌ ডাকতো তৃণমূল); কিন্তু বিজেপি-বিরোধী হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টায় নাম কা ওয়াস্তে পড়ন্ত বিকেলে একটা ছোটোখাটো প্রতিবাদ মিছিল। শুধু কি তাই, বিজেপি-র কাছে নাম্বার বাড়াতে বন্‌ধ ব্যর্থ করার মরিয়া চেষ্টায় নামলো তৃণমূলী প্রশাসন, পুলিশ ও ঠ্যাঙারেবাহিনী। ভারতের কোনো রাজ্যে, এমনকি বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেও যেটা হয়নি, সেই ‘ডায়াস-নন’ নামে সরকারী ও আধা-সরকারী কর্মচারীদের স্বার্থবিরোধী ফতোয়া জারি করলো তৃণমূল সরকার! সরকারী বাস-ট্রাম অন্যদিনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি চালিয়ে সচল রাখার চেষ্টা। যদিও সে চেষ্টা সফল হয়নি।

সে যাইহোক, এই আনুগত্যের ফলাফল কিন্তু হাতেনাতে পেয়েছে তৃণমূল। এর দুদিনের মধ্যেই, গত ১২ই সেপ্টেম্বর সংসদের নীতিবিষয়ক (এথিক্স) কমিটি পুনর্গঠিত করলেন লোকসভার অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন এবং নারদ ঘুষকান্ডের তদন্তে গত আড়াই বছর ধরে একটিও মিটিং না ডেকে শীতঘুমে থাকা এই কমিটির চেয়ারম্যান আবার হলেন বিজেপি-র প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি। গত ১লা আগস্ট দিল্লিতে সংসদ ভবনে তাঁর কক্ষে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে মমতা ব্যানার্জির প্রণাম করার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ তাঁরা ‘সৌজন্যমূলক’ আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন, বলেও আমরা সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছিলাম! 

আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ২০১৭সালের ২১শে নভেম্বর ভদ্রেশ্বর পৌরসভার তৃণমূল বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোজ উপাধ্যায় খুন হলেন। এই ঘটনায় বি জে পি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘মনোজ উপাধ্যায়কে অনেকদিন ধরে চিনি। উনি দীর্ঘদিনের আর এস এস কার্যকর্তা। উনি রামনবমীর মিছিলও করেছেন।’’ এরকম আরও অনেক আর এস এস স্বয়ংসেবক তৃণমূলের মধ্যে যে কাজ করছে, তা তৃণমূলের উদ্যোগে রামনবমী, গণেশপুজো, জন্মাষ্টমীর বহর দেখলেই বোঝা যায়সদ্য দলত্যাগী, তৃণমূলের একদা ‘সেকেন্ড-ইন কম্যান্ড’ মুকুল রায় কিছুদিন আগেই সাংবাদিক সম্মেলনে খোলসা করে বলেছেন, ‘‘জন্মলগ্ন থেকেই বি জে পি-র সহযোগিতা, সাহায্য নিয়েই এগিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের যে সাংগঠনিক শক্তি এত বেড়েছে তা বি জে পি-র সাহায্যেই হয়েছে।’’

এটা কোনও গোপন বিষয় নয়, সবারই জানা। তবুও তৃণমূলের নেতানেত্রীরা এবং তাদের প্রসাদপুষ্ট মিডিয়া বারবার মানুষের মধ্যে এই ধারণাই গড়ে তুলতে চায়, যে বি জে পি-র বিরুদ্ধে লড়ছে একমাত্র তৃণমূলই! এই লক্ষ্যেই বামপন্থীদের সমস্ত আন্দোলন-কর্মসূচির খবর কর্পোরেট মিডিয়া ব্ল্যাক আউট করার অঘোষিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে ‘মহাপডাও’ বা এরাজ্যে বি পি এম ও পদযাত্রার মতো কয়েকটি ঘটনায় এটা প্রমাণিত। অথচ, এটা ঘটনা যে বি জে পি এবং তৃণমূল, এরাজ্যে এই দুই দলই কাজ করছে পরস্পরকে পুষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে, ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’র কৌশল অবলম্বন করে।

(২)

আসলে, পশ্চিমবাংলায় বি জে পি-আর এস এস-এর ভিত তৈরির জন্যই কংগ্রেস ভেঙে জন্ম হয়েছিল তৃণমূল নামে দলটার। তৃণমূল তৈরির আগে থেকে আজ পর্যন্ত এই দল এবং দলের সুপ্রিমোর গতি-প্রকৃতি একটু তলিয়ে বিচার করলেই সেটা সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, বি জে পি-আর এস এস ‘মুখ’, আর তৃণমূল ‘মুখোশ’-এর কাজ করে চলেছে বিভিন্ন সময়। যেখানে এবং যখন ‘মুখ’ দেখিয়ে কাজ হবে না, তখন ‘মুখোশ’ দেখাও! কিছু লোকদেখানো নাটকবাজি সঙ্গে যুক্ত করো, ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য! তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে ইতিহাস একটু খতিয়ে দেখলেই এটা আরও স্পষ্ট হবে। 

১৯৯২সালের ৬ই ডিসেম্বর। গোটা বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো চারশো বছরের পুরানো বাবরি মসজিদের ইমারতকে। মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসে, কেন্দ্রে নরসিমা রাও সরকারের মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখন বারবার প্রধানমন্ত্রীকে বি জে পি-আর এস এস যে বাবরি মসজিদ ভাঙতে চলেছে, তানিয়ে সতর্ক করছিলেন। ৪ঠা ডিসেম্বর বামফ্রন্ট প্রতিবাদ সমাবেশও করে কলকাতায়। সেদিনই পালটা সভা করে মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘‘অযোধ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে সি পি এম। বি জে পি অযোধ্যায় কিছুই করতে পারবে না। এসব সি পি এম-এর ষড়যন্ত্র।’’ মসজিদ ভাঙার পর অবশ্য এনিয়ে তিনি এই সেদিন পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করেননি। আচমকা এবছর তিনি ৬ই ডিসেম্বর মুখ খুলে নানারকম আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েছেন!

১৯৯৬ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩দিনের সরকারের পতন হলো। গঠিত হলো সংযুক্ত মোর্চার সরকার। এই সময় জাতীয় রাজনীতিতে বি জে পি যখন একেবারে কোণঠাসা, কার্যত আঞ্চলিক দলগুলি যখন বি জে পি-কে একঘরে করে দিয়েছিল, ঠিক তখনই বি জে পি-কে বাঁচাতে মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে মমতা ব্যানার্জির। কংগ্রেস ভেঙে তখন তিনি নতুন দল গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তৃণমূল তৈরি হওয়ার আগেই, ১৯৯৭ সা‌লের ডি‌সেম্বর মা‌সে, মমতা ব্যানার্জিই প্রথম বলেন, ‘‘বি‌ জে ‌পি অচ্ছুৎ নয়’’। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষদের অনেকেই তখন অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু নতুন দল গড়ার মদতটা কোন জায়গা থেকে এসেছিল, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। ১৯৯৮সা‌লের লোকসভা ভো‌টে জোট বাঁধ‌লেন বি‌ জে ‌পি-র স‌ঙ্গে। বি জে পি সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি তখন বলেছিলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে বি জে পি-র সঙ্গে তৃণমূলের এই জোট একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।’’ জ্যোতি বসু এই প্রসঙ্গে বারবার বলতেন, ‘‘তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ ওরা সাম্প্রদায়িক বি জে পি-কে এরাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে।’’

(৩)
১৯৯৮ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর প্রথম এন ডি এ সরকারের রেল মন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপারসন হয়ে তৃণমূলনেত্রী ক্ষমতার অলিন্দে। ১৯৯৯ সালে আবার বি জে পি-র সঙ্গে জোট, আবার সরকারে, এবার রেলমন্ত্রী। যদিও ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্য এন ডি এ থেকে বের হয়ে এসে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধেন। কিন্তু কলকাতা কর্পোরেশনে সেই সময়েও তাদের সঙ্গে বি জে পি-র জোট পুরোদস্তুর বহাল ছিল। তৃণমূলের সুব্রত মুখার্জি মেয়র এবং বি জে পি-র মীনাদেবী পুরোহিত ডেপুটি মেয়রবিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর মমতা ব্যানার্জি আবার ফিরে যান এন ডি এ-তে। এবার হন কয়লামন্ত্রী। সেই সময়, ২০০১ সালের ২৪শে আগস্ট বি বি সি-র ‘হার্ডটক ইন্ডিয়া’ অনুষ্ঠানে করণ থাপারের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা ব্যানার্জি স্পষ্ট বলেন, ‘‘বি জে পি আমাদের স্বাভাবিক মিত্র..।’’

এন ডি এ আমলেই ২০০২ সালের গোড়াতে হয় গুজরাটে সংখ্যালঘু গণহত্যা, ভারতের ইতিহাসে যা বর্বরতম ঘটনা। বিশ্বজুড়ে এর নিন্দা হয়েছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি এই হত্যাকাণ্ডের কোনও প্রতিবাদ করেননি। তখন তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এটা বি জে পি-র অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।’ ওই বছরই গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনে বি জে পি আবার জয়ী হলে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফুলের তোড়া পাঠিয়ে সবার আগে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।

২০০৩ সা‌লে ১৫ই সেপ্টেম্বর নয়া‌দি‌ল্লি‌তে আর এস এস-এর মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-র সম্পাদক তরুণ বিজয় সম্পাদিত ‘কমিউনিস্ট টেররিজম’ নামে পুস্তক প্রকাশ অনুষ্ঠা‌নে মমতা ব্যানার্জি ব‌লেন, ‘‘কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমি আপনাদের পাশে আছি। য‌দি আপনারা আমায় ১শতাংশ সাহায্য ক‌রেন, আমরা ক‌মিউ‌নিস্ট‌দের সরা‌তে পার‌বো।’’ মমতা ব্যানার্জির আহ্বা‌নে আর এস এস স্বয়ংসেবকরা খুবই উৎসা‌হিত হয়অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোহন ভাগবত, মদনদাস দেবী, এইচ ভি শেষাদ্রির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী শীর্ষ নেতারা। তাঁদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানে মমতা বলেন, ‘‘..আপনারাই হলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।’’ ‌বি‌ জে পি-র তৎকা‌লীন রাজ্যসভা সাংসদ বলবীর পুঞ্জ, ওই সভা‌তেই ব‌লেন,‘‘আমা‌দের প্রিয় মমতাদি‌দি সাক্ষাৎ দুর্গা।’’

আর এস এস-এর অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের ‘খাঁটি দেশপ্রেমিক’ বলে যে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি, তা কিন্তু স্বয়ংসেবকরা ভোলেনি। গত লোকসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে, ২০১৩সালের ৪ঠা আগস্ট ‘সঙ্ঘ পরিবার’ টুইট করে জানিয়েছিল যে মমতা সেদিন তাঁদের ‘প্রশংসায় পঞ্চমুখ’ হয়েছিলেন! মমতা ব্যানার্জির প্রতি সঙ্ঘ পরিবারের কৃতজ্ঞতা এখনও যে ম্লান হয়নি, তা ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরেও তারা জানিয়েছে।

২০০৪-র লোকসভা নির্বাচনেও বি জে পি-র সঙ্গেই ছিল তৃণমূল। ২০০৪ সা‌লে ৮ই এপ্রিল নয়া‌দি‌ল্লি‌তে বিজে‌পি নেতৃত্বাধীন এন‌ ডি এ-র লোকসভা নির্বাচ‌নের ইশ‌্‌তেহার প্রকা‌শিত হয়। প্রকাশ ক‌রেন অটলবিহারী বাজ‌পেয়ী। ইশ‌্‌তেহা‌রে রামম‌ন্দির ‌নির্মা‌ণের ইস্যু, গোহত্যা বন্ধের মতো বিষয় লেখা হ‌য়ে‌ছিল। আবার সরকা‌রে এলে কয়লাখ‌নি বেসরকারি হাতেই যা‌বে, সেকথাও বলা হয়েছিল। ‌বি‌ জে ‌পি-র এতগু‌লো লক্ষ্য উল্লেখ ক‌রা হয়ে‌ছি‌ল ওই ইশ্‌তেহার। ওইদিন মঞ্চে হা‌জির ছি‌লেন, এন‌ ডি এ-র ১১টি শ‌রিক দ‌লের মধ্যে মাত্র ৫টি দলের প্রতি‌নি‌ধি। সেই ৫জনের মধ্যে একজন হ‌লেন মমতা ব্যানা‌র্জি। সে‌দিন ইশ‌্‌তেহার প্রকা‌শিত হওয়ার আগেই সম্ম‌তি জা‌নি‌য়ে তাতে সই করে‌ছি‌লেন তি‌নি।

২০০৫ সা‌লের ৪ঠা আগস্ট সংসদে প‌শ্চিমব‌ঙ্গে ‘অনুপ্রবেশ’-এর অভিযোগ তুলে, এবিষয়ে আর এস এস-র বহুলপ্রচারিত বক্তব্যই আওড়াতে থাকেন মমতা ব্যানার্জি। আসলে তার মাধ্যমে তিনি সঙ্ঘ পরিবারকে বার্তা দিতে চাইছিলেন: ‘‘আমি তোমা‌দেরই লোক।’’

২০০৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূল বি জে পি-র সঙ্গে জোট বেঁধেই এরাজ্যে লড়েছিল। নির্বাচনের পরে ওই বছরের ২৫শে ডিসেম্বর ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে তৃণমূলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। বামফ্রন্টবিরোধী যাবতীয় ষড়যন্ত্র, হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনে বরাবর তৃণমূলকে মদত জুগিয়েছে বি জে পি–আর এস এস।

এমনকি, ২০০৯-র লোকসভা ভোটে এবং ২০১১সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল জোট বাঁধলেও বি জে পি-আর এস এস বামফ্রন্টকে পরাস্ত করতে তৃণমূলের হয়েই যে গোপনে কাজ করেছিল, পরে বি জে পি-আর এস এস-র নেতারা বিভিন্ন প্রকাশ্য সভায় তা বলেছেন। চরম বামপন্থী থেকে উগ্র দক্ষিণপন্থী-মাওবাদী থেকে আর এস এস-সমস্ত শক্তির তখন একটাই লক্ষ্য ছিল বামফ্রন্টকে হটানো। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের পর ২০১২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর তৃণমূল দ্বিতীয় ইউ পি এ মন্ত্রিসভা থেকে সরে যায়।

(৪)
২০১১-য় রাজ্যে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-র পরে মমতা ব্যানার্জিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি। তবু ‘কমিউনিস্ট’ নিধনের আহ্বানটিই যেন মমতা ব্যানার্জিকে মনে করিয়ে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন —‘‘প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে দিন।’’ ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ে উল্লসিত আর এস এস তাদের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’র ২৩শে মে, ২০১১ তারিখের সম্পাদকীয়তে লেখে: ‘‘অবশেষে দুঃশাসনের অবসান।...ইহা স্বীকার করিতেই হইবে, পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী সরকার ও ক্যাডারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁহারই নেতৃত্বে তৃণমূল জোটের এই বিরাট জয়।’’

২০১৩সালে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বি জে পি প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। দেওয়ালে বি জে পি প্রার্থীর নাম লেখাও শুরু হয়েছিল। এই অবস্থায় দিল্লিতে বি জে পি সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের বাড়িতে হাজির তখন তৃণমূলের প্রভাবশালী সাংসদ, চিট ফান্ড মালিক কে ডি সিং। বি জে পি-র সাধারণ সম্পাদক রাজীব প্রতাপ রুডির উপস্থিতিতে আঁতাত সম্পন্নএকেবারে শেষ মুহূর্তে বি জে পি প্রার্থীর নাম প্রত্যাহার।

২০১৩সালের পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূল-বি জে পি সুযোগ বুঝে আঁতাত করেছে। যেমন, পাঁশকুড়ার চৈতন্যপুর-১নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতে বি জে পি-কে সঙ্গে নিয়েই পঞ্চায়েত গঠন করেছিল তৃণমূল। প্রধান বি জে পি-র, উপপ্রধান তৃণমূলের! মিনাখাঁ, বামনপুকুর, চৈতল—তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতই চলেছে তৃণমূল-বি জে পি-র যৌথ বোঝাপড়ায়, একেবারে প্রকাশ্যে। উদাহরণ আরও আছে। অবশ্য, পরে বেশ কিছু জায়গায় অন্য দলের মতই বি জে পি-র পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদেরও দল ভাঙিয়েছে তৃণমূল।

সারদাসহ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি এবং নারদ ঘুষকাণ্ডে এই দুই দলের গোপন বোঝাপড়া দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৪সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন বক্তৃতায় চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি, যেমন সি বি আই, ই ডি, এস এফ আই ও কি করেছে? চার বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমাগত টালবাহানা করে এই তদন্ত বিলম্বিত করে চলেছে।

মণিপুরে, ২০১৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর বি জে পি-র সরকার গড়তে সমর্থন করে একমাত্র তৃণমূল বিধায়ক টি রবীন্দ্র সিং। আস্থাভোটে বি জে পি-কে সমর্থন করার পর ওই তৃণমূল বিধায়ক বলে ‘দলের নির্দেশেই সমর্থন।’ আজ পর্যন্ত সেই বিধায়ককে তৃণমূল আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করেনি। 

অন্যদিকে, ত্রিপুরার ঘটনায় তৃণমূল যে আদতে বি জে পি-কেই পুষ্ট করতে কাজ করছে, তা একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেসের ৬বিধায়ক ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রথমে তৃণমূলে যোগ দেয়। কিন্তু এবছর এপ্রিল মাসে এই ৬বিধায়কই বি জে পি-তে যোগ দেয়। এমনকি, তৃণমূলের রাজ্যদপ্তরের সাইনবোর্ড পর্যন্ত তারা উলটে দিয়ে তাকে বি জে পি-র দপ্তরে পরিণত করেছে!

সংসদে বিভিন্ন ঘটনায় তৃণমূলের সঙ্গে বি জে পি-র গোপন বোঝাপড়া স্পষ্ট! ২০১৭ সালের ২৯শে মার্চ রাজ্যসভায় অর্থবিল পাশ করাতে তৃণমূল ওয়াক-আউট করে। রাজ্যসভায় অর্থবিলের বিরুদ্ধে তৃণমূল ভোট দিলে তা অনুমোদন হতো না, বেকায়দায় পড়তো মোদী সরকার। কিন্তু সমস্ত বিরোধী দল ভোট দিলেও তৃণমূল অধিবেশন বয়কট করে ওই বিল অনুমোদনের সুযোগ করে দেয় বি জে পি-কে। সংসদে বারেবারে বিজেপি সরকারকে সাহায্য করে চলেছে তৃণমূল। সংসদে বিভিন্ন প্রশ্নে তৃণমূল কিভাবে বিজেপি-র ‘অনুগত বিরোধী’র ভূমিকা পালন করে চলেছে, তা গত ৪ঠা মার্চ, ২০১৬ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদ (TMC plays 'loyal Opposition', only for PM) দেখলেই বোঝা যাবে। ঠিক বিধানসভা নির্বাচনের আগে সংসদের অধিবেশনে যখন বিরোধীরা মোদী সরকারকে তুলোধোনা করছেন, তখন তৃণমূল সাংসদদের কাছে খোদ মমতা ব্যানার্জির কাছথেকে নির্দেশ আসে যে ‘অনুগত বিরোধী’র ভূমিকা পালন করতে হবে, যা শুনে এমনকি তৃণমূল সাংসদরাও বিস্মিত হয়ে যান। বিরোধী দলগুলি যখনই এককাট্টা হয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে নেমেছে, তখনই ছলেবলে কৌশলে তৃণমূল তা এড়িয়ে গেছে, বা বানচাল করার চেষ্টা করেছে। ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ তারই একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ!

নারদ ঘুষকান্ডর কথা আগেই বলা হয়েছে। নারদকাণ্ডের জেরে গঠিত লোকসভার এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বি জে পি-র বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি‘এক্স ফাইলস’-এর ভিডিও ফুটেজে তৃণমূলের যে সব সাংসদকে দেখা গিয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এই কমিটি। লোকসভায় নারদা স্টিং অপারেশনের টেপ জমা পড়ার আড়াই বছর বাদেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, একটি বৈঠকও ডাকা হয়নি। শুধু তাই নয়, রাজ্যসভায় এথিক্স কমিটি গঠনের বিরোধিতা করেছে স্বয়ং মোদী সরকার। কেন? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে পর্যাপ্ত নথিপত্র দেওয়ার পরেও চিট ফান্ড মালিক তৃণমূল সাংসদ (বর্তমানে সাসপেন্ডেড) কে ডি সিংয়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

অথচ ইউ পি এ সরকারের আমলে যখন লোকসভার অধ্যক্ষ ছিলেন সোমনাথ চ্যাটার্জি, তখন ঘুষকান্ডে জড়িত সাংসদদের বিরুদ্ধো মাত্র ১২দিনের মধ্যে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ২০০৫সালের ১২ই ডিসেম্বর গোটা দেশ তোলপাড় হয়েছিল ১১জন সাংসদের ঘুষ নেওয়ার ক্যামেরাবন্দি দৃশ্যে। ১০জন লোকসভার ও ১জন রাজ্যসভার সদস্যকে সেদিনও এক স্টিং অপরেশনে দেখা গিয়েছিল ঘুষ নিতে। তারমধ্যে ৬ই জনই ছিল বিজেপি-র সাংসদ। ২০০৫সালের ২৪শে ডিসেম্বর মাত্র ১২দিনের মধ্যে লোকসভার ১০জন সাংসদ ও রাজ্যসভার ১জন সাংসদকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এখন আড়াই বছর আগে নারদ ঘুষকান্ডে তৃণমূল সাংসদদের ক্যামেরাবন্দী ভিডিও ফরেনসিক টেস্টে প্রমাণিত হওয়ার পরেও তাঁদের সদস্যপদ টিঁকিয়ে রেখে বিজেপি-র কী লাভ, এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই!

(৫)
২০১৬সালের বিধানসভা নির্বাচনেও যে অন্তত ১০০টা কেন্দ্রে বি জে পি প্রার্থীরা বিরোধী ভোট কেটে তৃণমূলকে সহযোগিতা করেছে, কলকাতায় এসে সেকথা বলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী। বি জে পি না থাকলে তৃণমূলের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা যে সহজ হতো না তা মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। আর এস এস-র সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বিধানসভা ভোটের আগে সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের সভায় খোলাখুলি বলেছেন, ‘‘আমরা এখানে এমন কিছু করতে পারি না, যাতে কমিউনিস্টরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে।’’

তৃণমূলের নীতির কারণেই পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত। বি জে পি-র হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে উসকানি দিচ্ছে তৃণমূল, যাতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাই আরও পুষ্ট হচ্ছে। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে বামফ্রন্ট সরকারের সময় বাংলায় আর এস এস-র শাখা ছিল মাত্র ৪৭৫টি। কিন্তু গত ছয় বছরে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সংগঠনটির শাখা পশ্চিমবঙ্গে তিনগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০০। রাজ্যে আর এস এস পরিচালিত প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা বর্তমানে ৩০৯টি। এছাড়া ১৬টিতে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা হয়। আর এরমধ্যে ১৫টি গড়ে উঠেছে গত পাঁচ বছরে। এই তিনশোর বেশি হিন্দুত্ববাদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬৬হাজার ৯০ জন। ৫০০টি শিশুমন্দির ও ৫০টি বিদ্যালয়মন্দির (হাইস্কুল) প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে দ্রুত এগচ্ছে আর এস এস।

গত তিন বছরে রাজ্যে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে ধূলাগড়, বসিরহাট, নোয়াপাড়ার মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা। এই সবকটি ঘটনাতেই স্পষ্ট, বি জে পি-আর এস এস-হিন্দু সংহতি সমিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সাম্প্রদায়িক বিভাজনে নেমেছে তৃণমূল, যাতে ভোটের রাজনীতির ফায়দা হয়। পরস্পরকে পুষ্ট করার লক্ষ্য নিয়েই এই দুই দল এগচ্ছে। ‘রামনবমী’র মিছিলের পালটা ‘হনুমান জয়ন্তী’ করা তারই একটি উদাহরণ। এরাজ্যে প্রথম গোরক্ষকদের হাতে খুন হয়েছিল ধূপগুড়িতে, গরিব পরিবারের দুই ১৯ বছরের কিশোর। গ্রেপ্তার হলো পাঁচ-তিনজন তৃণমূলের, দুইজন আর এস এস’র.! কেশিয়াড়িতে ১৫একর জমিতে আর এস এস গোশালা করলো..গোমূত্র মেলে সেখানে....জমি দিল তৃণমূল.....গোমূত্র বিক্রিও করছে তৃণমূল.....এরাজ্যের বুকে গণতন্ত্র রক্ষা, শ্রমিকের লড়াই, কৃষকের লড়াই, ছাত্রদের ক্যাম্পাস রক্ষার লড়াই, বিভাজনের রাজনীতির ঠেকানোর লড়াই এমনকি বি জে পি’র বিরুদ্ধে লড়াই- এসবের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বাধা তৃণমূল..মমতার বাহিনীর এই উন্মত্ত ভোটলুটের একটা উদ্দেশ্য হলো বিজেপি’কে জায়গা করে দেওয়া...প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গো, গত ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকারটা (নিশ্চয়ই পড়েছেন) আরেকবার পড়ে নিতে অনুরোধ করছি। ওখানে তৃণমূলের 'স্বৈরতান্ত্রিক' চরিত্র উল্লেখ করে উনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন কেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলালে বামপন্থীদের ক্ষতিই হবে। বরং বিজেপি-র বিরুদ্ধে অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে ঐক‍্যবদ্ধ প্রতিরোধে নামাটাই জরুরী কাজ এই মুহূর্তে। তৃণমূল যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাও উনি  স্পষ্টভাষায় বলেছেন।

তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপসারণ আর এস এস-র লক্ষ্য নয়। আর এস এস মমতা ব্যানার্জির ‘আত্মশুদ্ধি’ চায়। চায় তৃণমূল কংগ্রেসের ‘রিফর্ম’। ২০১৬ সালের অক্টোবরে হায়দরাবাদে তিনদিনের জাতীয় কার্যনির্বাহী বৈঠকে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৪ই জানুয়ারি ব্রিগেডের সভাতেও আর এস এস-র সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। বি জে পি এবং সর্বোপরি আর এস এস-এর হয়ে কিভাবে তৃণমূল দল কাজ করছে, আর বি জে পি-আর এস এস কিভাবে তৃণমূলকে টিকিয়ে রেখেছে, তৃণমূল যে আদতে বি‌ জে‌ পি-র ‘মু‌খোশ’ তা যত দিন যাবে, ততই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
********
২১শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮

‘দুন্দুভি’ শারদ সংকলন

20180701

আক্রমণ বহুমুখী গণপ্রতিরোধই একমাত্র বিকল্প


সূর্য মিশ্র

আজকের দিনে বামপন্থীদের রাজনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বুঝতে হলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আগে ভালো করে বুঝে নিতে হবে। একটা অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি।  একথা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতেই সত্য নয়, সারা দেশে এবং সারা দুনিয়ার পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের দেশের শুধু বামপন্থীদের কাছেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সমস্ত শক্তির কাছেই এত বড় চ্যালেঞ্জ আগে কখনো আসেনি। সারা দুনিয়াতেও যারা বামপন্থার জন্য লড়ছেন, গণতন্ত্র প্রসারের জন্য লড়ছেন তাঁরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখেননি। পরিস্থিতির এই জটিলতা এবং তা কতো কঠিন তা গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতেই হবে। তা না হলে আমরা কীসের বিরুদ্ধে লড়ছি, বেড়ালের সঙ্গে নাকি হায়নার সঙ্গে লড়ছি তা না বুঝে লড়াইয়ের জন্য নিজেদের ঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারবো না। বাস্তবকে ঠিকমতো বুঝে না নিলে প্রত্যাশার সঙ্গে মিলবে না, হতাশা গ্রাস করবে।
*********
অতীতে আমরা বহু আক্রমণ সন্ত্রাস দেখেছি, এরাজ্যেও দেখেছি, সারা দেশেও দেখেছি। জরুরি অবস্থা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস দেখেছি এবং আরও অনেক অত্যাচার দেখেছি। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা সেসবের থেকেও অনেক বড় আক্রমণ। অনেক ব্যাপকতর এবং তীব্র। সাতের দশকে সন্ত্রাস রাজ্যের সব জেলায় ছিল না, কয়েকটি জেলায় সীমিত ছিল। এখন তা সারা রাজ্যে ব্যাপ্ত। রাজ্যের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত, নাগরিক অধিকার আক্রান্ত। পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা সারা রাজ্যেই সন্ত্রাস দেখেছি। ব্যাপকতম এলাকাজুড়ে নজিরবিহীন সন্ত্রাস চলেছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় ব্লক অফিস, মহকুমাশাসকের অফিস এমনকি জেলাশাসকের অফিসগুলিও শাসকদলের সমাজবিরোধীরা পুলিশ প্রশাসনের প্রশ্রয়ে দখল নিয়েছে। মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, তারপরে প্রত্যাহারের জন্য কেবল প্রার্থী নয় শিশু মহিলা সহ তাঁদের পরিবার পরিজনদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, ভোটের দিনে ভোট লুট করতে এবং সবশেষে ভোট গণনার দিনে গণনাকেন্দ্রেও ছাপ্পা ও আক্রমণ হয়েছে। যত ভোট পড়েছে তার চেয়ে বেশি ভোট গণনা হয়েছে, জয়ী প্রার্থীকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার পরেও ফের গণনার নামে শাসকদলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এমন আক্রমণ সন্ত্রাসের কোনও নজির আমাদের রাজ্যে তো বটেই সারা দেশের কোথাও নেই।
*********
ব্যাপক এবং তীব্র হলেও সন্ত্রাসই কিন্তু বর্তমান সময়ের একমাত্র বিষয় নয়। এমনকি মুখ্য বিষয়ও নয়। দৈহিক আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেয়ে মনোজগতে আক্রমণ মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। মিথ্যার মোহজালে যুক্তিবাদ বাঁধা পড়লে যুক্তিহীন মেরুকরণ ও বিভাজনের রাজনীতির উত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। বোধবুদ্ধিহীন উন্মাদনায় মেহনতি মানুষের ঐক্যকে ভেঙে ভ্রাতৃঘাতী বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করতে পারলে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসের প্রয়োজন হয় না। সাতের দশক এবং অতীতের থেকে বর্তমান পরিস্থিতি আলাদা হওয়ার অন্যতম কারণ এখন বহুমাত্রিক মেরুকরণের রাজনীতি চলছে। সারা দেশের সঙ্গে আমাদের রাজ্যেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা হচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার করে। ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও সম্পর্ক নেই, পৃথিবীর কোনও ধর্মে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কথা বলা নেই। তবুও ধর্মকে বাহন করেই সাম্প্রদায়িকতা আক্রমণ হানে। সম্প্রতি কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছে কেন্দ্রের বি জে পি সরকার। কাশ্মীরের মানুষের বিরুদ্ধে তারা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে যে কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা হবে। কেন্দ্রে বি জে পি সরকার আসার পরে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের চার বছরের সময়কালে এরাজ্যে আর এস এস-এর শাখার সংখ্যা ১১গুণ বেড়েছে। এছাড়াও তাদের অজস্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নামে বেনামে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। খোলা চোখে এদের দেখা না গেলেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজ তারা করে চলেছে। আর তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় নেমেছে। কে বেশি রামভক্ত তা দেখাতে রামনবমীর প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে বেশি হনুমানভক্ত তার প্রতিযোগিতায় হনুমানজয়ন্তী পালন হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।


শুধু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ নয়, এখন বহুমাত্রিক মেরুকরণ করা হচ্ছে মানুষের নানা সত্তাকে ঘিরে। ভাষা নিয়ে কীভাবে মেরুকরণ ঘটানো যায় তা আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই দেখিয়েছেন পাহাড়ে। সেখানে তিনিই প্রথম আগুন জ্বালান বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করে চাপিয়ে দিয়ে। একইভাবে উত্তরবঙ্গে কামতাপুরী এবং রাজবংশী ভাষার স্বীকৃতির নামে উসকানি চলছে। একটাই ভাষা কিংবা উপভাষা কিন্তু সেটাকে দুটি নামে দাবি করা হচ্ছে, আর মুখ্যমন্ত্রী তাতেই প্ররোচনা দিয়ে দুটি নামেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন। আদিবাসীদের মধ্যে আর এস এস খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এমনকি আদিবাসীদের ভিতরের গোষ্ঠীগুলির ফারাক তুলে এনে তারা ভেদাভেদ চাগিয়ে তুলছে। সব অংশের আদিবাসীরাই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছে, কিন্তু আর এস এস সাঁওতালদের সঙ্গে মুণ্ডাদের প্রভেদ করছে। হুল তথা সাঁওতাল বিদ্রোহের সঙ্গে উলগুলান তথা মুণ্ডা বিদ্রোহের ফারাক নিয়ে রাজনীতি করছে। এক অংশের বিরুদ্ধে আরেক অংশকে লাগানোর এই কৌশল তারা উত্তর প্রদেশে দলিত এবং ও বি সি-দের নিয়েও করেছে। এরাজ্যের আসানসোলে হিন্দিভাষীদের ও বাংলাভাষীদের মধ্যে বিরোধ বাধানো হচ্ছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটানো হচ্ছে। ‘এখন তৃণমূলকে হটানোর মুরোদ বামপন্থীদের নেই, অতএব বি জে পি-কে লাগবে।’ এই প্রচারের মাধ্যমে বলা হচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যারা লড়তে চাও মতাদর্শ ছেড়ে সবাই একজোট হয়ে যাও। এর বিপরীতে তৃণমূলই বাংলায় বি জে পি-কে ঠেকাতে পারবে এইরূপ আরেকটি মিথ্যার মোহজাল নির্মাণ করা সহজ।
এই সমস্ত ঘটনা ঘটছে এমন একটা সময়ে যখন সারা বিশ্ব ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পায়নি। দশবছর ধরে চলতে থাকা এই মন্দার সঙ্গে প্রায় নব্বই বছর আগের মহামন্দার তুলনা করা চলে যার প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। এখনও মন্দার কারণে ক্রেতা নেই, শিল্পোৎপাদন প্রায় স্তব্ধ। সারা দুনিয়ায় অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা, বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন, ইংল্যান্ড ব্রেক্সিটের পথে চলে যাচ্ছে। জি সেভেনের বৈঠকে বাজার দখলে রাখতে কর বসানো নিয়ে বিরোধ চরমে উঠেছে। ৮০বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের ইতিহাসকে এই পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমরা এখনই একথা বলতে পারি না যে আবার একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে যে বোঝাপড়াটা ছিল সেটা আর আগের মতো নেই, তাতে গুরুতর ফাটল দেখা দিয়েছে।
আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদীর আমলে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে। কাজ নেই, শিল্পে, কৃষিতে সংকট চলছে, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে, রেগায় কাজ কমছে, শ্রমিকের মজুরি কমছে, কাজের কোনও নিরাপত্তা নেই। মোদী সরকার আসার আগে দেশের ১শতাংশ ধনীদের হাতে দেশের ৪৯শতাংশ সম্পদ ছিল। এখন তা ৭৩শতাংশ হয়ে গেছে। সম্পদের দ্রুত কেন্দ্রীভবন ঘটছে। নীরব মোদী, বিজয় মালিয়ারা ব্যাঙ্কের ১১হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। অমিত শাহের ছেলের সম্পত্তি ১৬হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরাজ্যে ভাইপোর সম্পত্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে চোখ ধাঁধিয়ে। সারদা নারদ কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোল নেই। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। গণবিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলেই নানা ধরনের মেরুকরণের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ করার দরকার হয়ে পড়েছে শাসকদের। এভাবেই উগ্র দক্ষিণপন্থা সহ নানা ধরনের ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটে।
মানুষের জীবনের দুর্দশা এবং তাঁদের ক্ষোভই এই সময়ের সত্য, কিন্তু সেই সত্যকে চাপা দিতে মিথ্যার প্রচার চলছে। মনোজগতের ওপরে আক্রমণের এই প্রক্রিয়ার জন্য এটাকে পোস্ট ট্রুথ বা ‘উত্তর-সত্য’ বলা হচ্ছে। মিথ্যাকে বার বার বলো, বেশি বেশি করে বলো, বড় বড় মিথ্যা বলো, তাহলে মানুষ সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করবে এবং যে বলছে সে নিজেও একসময়ে সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করা শুরু করবে। গোয়েবলসের এই তত্ত্বকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী অনুসরণ করে চলেছেন। মিথ্যার নির্মাণ করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে। তারা ক্রমাগত বি জে পি এবং তৃণমূলের মধ্যে লড়াইকে দেখিয়ে চলেছে, আর প্রচার করছে বামপন্থীরা মুছে গেছে। তৃণমূল এবং বি জে পি-র মধ্যে মেরুকরণের মিথ্যা নির্মাণের জন্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বামপন্থী পরিচয় দিয়ে সঙ্ঘীরাই বলছে ‘আমি আর এস এস তথা কেন্দ্রের সরকারের ঐ বি জে পি নই, আমি বামপন্থীই আছি। কিন্তু এখন বি জে পি-র পথে হেঁটে তৃণমূলকে হটাতে হবে, তারপরে আবার আমরা বামপন্থী হয়ে বি জে পি-কে হটাবো।’ বলা বাহুল্য এটা আরেকটা বৃহদাকার মিথ্যা। উলটোদিকে আরেকপক্ষ একইসময়ে বি জে পি-র হাত থেকে বাঁচানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যদের তৃণমূলের পাশে জড়ো করছে। এভাবে মিথ্যায় অন্ধ করে দিয়ে উন্মত্ত দাঙ্গায় শামিল করা যায়, কিন্তু রাজনৈতিক লড়াই করা যায় না। শুধু বাহুবলে তৃণমূলকে হারানো যাবে না, বি জে পি-কেও হটানো যাবে না। তার জন্য চাই যুক্তি-মতাদর্শ, মনোবল এবং জনবল। সেগুলি বর্জন করে আমরা বামপন্থীরা কোনও মিথ্যার উন্মত্ততার স্রোতে ভেসে যেতে পারি না।
**********

কিন্তু এতকিছুর পরেও এখনও পর্যন্ত আমরা এরাজ্যের মানুষকে কেন এই সত্য বোঝাতে পারছি না? মানুষকে সঙ্গে না নিয়ে আমরা কোনও পরিবর্তনই করতে পারবো না, তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে। জনগণের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে তাঁদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে মুক্তো তুলে আনার মতো করে তাঁদের মনের কথা তুলে আনতে হবে। এইখানেই জনগণের মধ্যে পার্টির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। পার্টির রাজনৈতিক স্লোগান যতক্ষণ না জনগণ গ্রহণ করছে ততক্ষণ পার্টি জনগণকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারে না। আমরা গত চার বছর ধরে ‘তৃণমূল হটাও-বাংলা বাঁচাও, বি জে পি হটাও- দেশ বাঁচাও’ এই স্লোগান দিয়ে চলেছি। কিন্তু জনগণ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় শেখে। আমরা যদি বারবার সত্য কথাটা বলে যাই তাহলে একদিন জনগণ সত্যটাই বুঝবে এবং তাঁরাই বলবেন যে বামপন্থীরাই তো বরাবর সত্যিটা বলে এসেছেন। আমরা মার্কসবাদীরা প্রকৃত সত্যের ওপরে নির্ভর করেই চলি, মার্কসের ভাষায় ‘ভ্রান্ত চেতনা’র ওপরে নির্ভর করে নয়। মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ তা সত্য। কিন্তু মানুষ অনেক সময়েই প্রকৃত সত্যকে সাময়িকভাবে বুঝতে পারেন না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্য বড় নাকি চাঁদ বড় তা বোঝা যায় না। আপাতভাবে ছোট ছোট তারাদের দেখে বোঝাও যায় না সেগুলি গ্রহগুলির থেকে তো বটেই এমনকি সূর্যের থেকেও বহুগুণ বড়। পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে সেই সত্য বলার জন্য গ্যালিলিও থেকে ব্রুনো কতজনকে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো তা সবাই জানি। কাজেই সত্য বলার জন্য বিশেষ জ্ঞান ও দৃষ্টি লাগে এবং সত্য বলার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আমাদের পার্টিকেও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অর্জনের জন্য মতাদর্শকে আয়ত্ত করে তার সঠিক অনুশীলন করতে হবে। শাসকের মোহজালে মানুষ আবিষ্ট হয়ে থাকলে সঠিক পথ খুঁজে পাবে না, কেবল উদভ্রান্তের মতো এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়িয়ে হোঁচট খাবে। তাই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে, যা যা রাজনৈতিক অস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করতে হয় তাই করতে হবে। পরিস্থিতি কঠিন বলে হতাশার কোনও জায়গা নেই, বরং এই কঠিন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকেই আজকের দিনের প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে শিখে নিতে হবে। লড়াই যদি কঠিন না হয় তাহলে সেই লড়াই করায় কৃতিত্ব কীসের!
শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বে হবে না, সাংগঠনিক নেতৃত্বও চাই। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বকে সমান তালে এগতে হবে। শুধু তত্ত্বজ্ঞানে চলবে না, তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে হবে লড়াইয়ের ময়দানে। কার্ল মার্কস তো শুধু দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার কথা বলেননি, তিনি দুনিয়াকে বদলানোর কথা বলেছিলেন। তাই মানুষের আদায়যোগ্য দাবিকে তুলে ধরে লড়াই করতে হবে, রেশন কার্ড, একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরিসহ আদায়যোগ্য সব দাবিকে আদায় করে ছাড়তে হবে। তার জন্য পার্টির শাখাগুলিকে সক্রিয় করতে হবে। সংগ্রাম ছাড়া সংগঠন থাকে না, সংগ্রামের পথেই সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। কেন এখনও সব জায়গায় বুথ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে পারবো না? শাখার দুর্বলতার দায় কেবল শাখায় চাপিয়ে দিলে চলবে না, শাখাকে সক্রিয় করার দায়িত্ব উপরের কমিটিকে নিতে হবে। আমাদের পুরানো নেতারা বলতেন, গোরুর গাড়ির চাকা কাদায় আটকে গেলে গোরুকে শুধু খোঁচা মারলে হয় না। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে কাঁধ লাগিয়ে চাকাকে ঠেলে দিতে হয়। এই কাজ উপরের কমিটির নেতাদের করতে হবে। এরজন্যই তো আমরা সংগঠনকে পুনর্গঠিত করে এরিয়া কমিটি গঠন করেছি। কমিটিগুলিতে বয়সের গড় কমানো হয়েছে। পুনর্গঠনের কাজ অত্যন্ত দ্রুততায় করতে আমরা কিছুটা এগিয়েছি। বাকি কাজও দ্রুত করতে হবে, নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই।
*********

কঠিন পরিস্থিতির উল্লেখ দিয়ে এই নিবন্ধের শুরু। শেষ হবে এই পরিস্থিতির মধ্যেই থাকা চমৎকার উপাদানগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি কবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটতে ঘটতে মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে, গণবিক্ষোভের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং তা দমন করতে শাসকের আক্রমণ তীব্র হওয়ায় প্রতিরোধও তীব্র হচ্ছে। আমরা যদি বিপ্লবী হই তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে সুযোগগুলিকে দেখতে পাবো না? সন্ত্রাস আক্রমণের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও রুপালি রেখা হলো জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের ঘটনাগুলি। ঘন কালো মেঘের গর্জনের পিছনে সেই রুপালি রেখাকে অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে আটশোর বেশি এলাকায় আমাদের কমরেডরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধে ছিলেন, রক্ত ঝরেছে, আমাদের অন্তত দশজন কমরেডের প্রাণ গিয়েছে তবু কেউ লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাননি। গত সাত বছরে এমনটা এই প্রথম। শহীদের তালিকায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে গরিব আদিবাসী, তফসিলি জাতির মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের নামই বেশি। গরিব বলেই এই মানুষজন লড়াইয়ের সামনের সারিতে রয়েছেন। মিথ্যার নির্মাণ সত্ত্বেও মিথ্যার মোহজাল ভেঙে মানুষের প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে। লড়াইয়ের ময়দানে থাকা এই মানুষদের আমাদের পার্টিতে নিয়ে আসতে হবে। আর যারা পার্টিতে থেকেও লড়াইয়ের ময়দানে নেই, তাঁরা পার্টিতে কেন আছেন সেই প্রশ্ন করতে হবে। আমরা কমিউনিস্টরাই নিজেদের বুকচিরে আত্মপর্যালোচনা করে এগতে পারি। জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সম্ভাবনাময় নতুন দিগন্তের সন্ধানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন এই চার অস্ত্রে নিজেদের সাজিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে। হতাশার কোনও জায়গা নেই কমিউনিস্টদের কাছে। আক্রমণ বহুমুখী, তাই গণপ্রতিরোধই একমাত্র বিকল্প।
***********
গণশক্তি, ১লা জুলাই, ২০১৮

20180513

গর্বের পঞ্চায়েতঃ গড়েছে বামফ্রন্ট, ধ্বংস করছে তৃণমূল-২


ভূমিসংস্কারের উলটো পথে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গে যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচী দেশে-বিদেশে উচ্চপ্রশংসিত হলেও ক্ষমতায় এসেই উলটো পথে চলতে শুরু করে মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। ২০১১সালের ১৮ই অক্টোবর (মেমো নম্বর-আই আর সি/৬২৪/১১) একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে তৃণমূল সরকার বলে, ‘‘ভূমিহীনদের মধ্যে মূলত কৃষিজমি বন্টনের যে ধারায় আগের ভূমিসংস্কার চলেছে, তা থেকে সরে আসতে হবে এবার।’’ আরো আগ্রাসী ভাষায় রাজ্য সরকারের জমি নীতি সুপারিশকারী কমিটি বলেছে, ‘‘জমির অবৈধ দখলদারিকে কখনো ভূমিসংস্কার বলা যায় না। বরং এটিকে জমি-ডাকাতি বলা যায়। এই জমি-ডাকাতি বন্ধ করতে সরকার যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।’’
এর পরেই রাজ্যের গ্রামে গ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে পূর্বতন জমিদার, জোতদার এবং লুকোনো জমির মালিকরা। শুরু হয়ে যায় বর্গাদার, পাট্টাদার, এমনকি রায়তি জমির মালিক গরিব কৃষকদের উচ্ছেদের ঘৃণ্য অভিযান। তবে গরিব কৃষকের প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে লক্ষ্যনীয়ভাবে।

পঞ্চায়েত ঠুঁটো জগন্নাথপশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের গ্রামবাসীকে যুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক ও বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন কাঠামোর যে ব্যবস্থা সারা দেশকে পথ দেখিয়েছিলো, ক্ষমতায় এসেই তা ভাঙতে শুরু করেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ক্ষমতায় এসেই তিনি কলকাতার টাউন হলে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের বিডিও, ৬৫জন এসডিও-র সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। সভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘এবার থেকে প্রতিটি জেলায় তিনটি করে কমিটি হবে। ব্লক পর্যায়ে কমিটির মাথা হবেন বিডিও-রা। মহকুমা স্তরে মহকুমাশাসক বা এসডিও-রা। জেলা পর্যায়ে কমিটির কর্তা হবেন জেলাশাসকরা। প্রতিটি পর্যায়ের কমিটিতেই সদস্য হবেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অফিসাররা। এই কমিটিগুলিই গ্রামোন্নয়নের কাজের তদারকি ও নজরদারি করবে।’
এর ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। উন্নয়নের কাজে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা রূপায়নের আসল ক্ষমতা চলে গেলো আমলাদের হাতে। জনগণের সঙ্গে যাদের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। ফলে ক্ষমতা হারালেন গ্রামের সাধারণ মানুষও। অথচ এতদিন গ্রাম সংসদের মাধ্যমে তাঁরা উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও রূপায়ণের কাজে রীতিমতো বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতেন।

কৃষক আত্মহত্যার যে ঘটনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত ছিলো না, বাংলায় তা এখন অহরহ ঘটছে। গত ছ’বছরে রাজ্যে দেড়শোর বেশি কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিয়ে সরকার কৃষকদের এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ায়নি। তারা বরং খেলা মেলা উৎসবে এবং ক্লাবগুলোকে টাকা বিলোনোয় বেশি উৎসাহ দেখিয়েছে। কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। ধান, আলু, পাট থেকে পান, সরষে, ডালশস্য— রাজ্যের প্রতিটি ফসলের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। সরকার এখন ফড়েদের থেকে ধান কিনছে, পঞ্চায়েত ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে ধান কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে অথচ ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা বিপদে পড়ছেন। সারের দোকানের ঋণ, প্রতিবেশীর কাছে ঋণ, মহাজনের ঋণ নিয়ে চাপের মুখে আত্মহত্যা করছেন অনেকেই। নাবার্ডের ফোকাস পেপার, ২০১৬-১৭তে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজীবী পরিবারগুলি প্রতি মাসে গড়ে ১৯০৮টাকার ঋণ জালে জড়াচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে কৃষিতে বিপর্যয়, কখনো বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি, কখনো অনাবৃষ্টিতে, কখনো পোকার আক্রমণে। কিন্তু বাংলার কৃষকদের সামনে এখন বীমার ক্ষতিপূরণের সুযোগ নেই। শস্যবিমার বিধি ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে কৃষকদের আরও বেশি করে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার।

ভোটের নামে প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে যে পঞ্চায়েত ভোট কার্যত উৎসবের পরিবেশে হতো, সেই ভোটই এখন রীতিমতো প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মমতা ব্যানার্জির শাসনে পরপর দু’টি পঞ্চায়েত নির্বাচনই বেপরোয়া সন্ত্রাস, বিরোধী প্রার্থী খুন, ভোট-লুট, আদালতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিশৃঙ্খলার জন্য ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।
তৃণমূল আমলে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩-র জুলাইয়ে। রাজ্যে মোট ৪৮,৮০০টি পঞ্চায়েত আসন। নির্বাচনের আগেই, আতঙ্ক সৃষ্টি করে ৫,৩৫৬টি আসন দখল করেছিলো তৃণমূলতারপরেও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতেও জিততে দেদার ছাপ্পা, ভোট লুঠ, বিরোধীদের মেরে বের করে দেওয়া, বেপরোয়া বুথ দখল চালায় শাসকদল। গণনার সময়েও চলে ব্যাপক জালিয়াতি ও বলপ্রয়োগ। তবুও বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিলো ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২% কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে (???) যথাসম্ভব সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে গিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ বাধার মুখে পড়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো। আদালতের লড়াইয়ে জিতলেও, ভোটের দিন কিন্তু শাসকের সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীর তান্ডব আটকাতে ব্যর্থ হন তিনি।

বেআইনী দখলদারি-র নির্লজ্জ অভিযানে নজির গড়লো তৃণমূল। তীব্র সন্ত্রাস আর আক্রমণ চালিয়েও ২০১৩সালে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূল জিততে পারেনি। একইভাবে বহু পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীদের জয় হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কি! নির্বাচনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় নতুন খেলা। দল ভাঙিয়ে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দখলদারি শুরু হয়। যেখানে বামপন্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করেছিলো, অঙ্ক কষে সেখানে খুনও করা হয়েছে। সভাপতি হিসাবে কাজ শুরুর আগেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে উত্তর ২৪পরগণার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গাজিকে। এরপর সেই সমিতি দখলও করে শাসকদলফরাক্কায় খুন হন পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য হাসমত শেখ। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলদিয়া পৌরসভায় সন্ত্রাস চালিয়ে, কাউন্সিলারদের অপহরণ করে ১৫মাসের মধ্যেই দখল করে নেয় তৃণমূল।
তৃণমূলের দখলের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদএই জেলায় ২৬টির মধ্যে একমাত্র সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতিতে জয়ী হয়েছিলো তৃণমূল। এখন তৃণমূলের দখলে ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতি! আর জেলা পরিষদ? মোট ৭০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল মাত্র ১টি আসনে। বাকি সবই ছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের হাতে। এখন নানা কৌশলে মোট ৪৩ জনকে ভাঙিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ চালাচ্ছে তৃণমূল! ভয় দেখিয়ে দল ভাঙিয়ে দখলদারির এই ফরমুলা সারা রাজ্যেই চালু করেছে মমতার দল।

মুখে গামছা-বাঁধা ‘উন্নয়ন’ দেখছে এখন গ্রামাঞ্চল! তৃণমূলের আমলে দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের (২০১৮) সন্ত্রাস অতীতের সব নজির ছাড়ালো। আগেরবার ভোট লুঠ, নির্বাচনের পর সন্ত্রাস চালিয়ে বোর্ড দখলে নজির গড়েছিলো তৃণমূল। এবার একেবারে মনোনয়ন পর্ব থেকেই গ্রামবাংলায় মুখে গামছা-বাঁধা সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। মনোনয়ন পেশের কেন্দ্রগুলি ঘিরে রেখেছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে তৈরি পুলিশ-তৃণমূলের যৌথ বাহিনী। প্রার্থীকে খুন, জখম, অপহরণ, সন্ত্রাস চালিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো— সবই হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অসহায় চোখের সামনে! বিরোধীদের আবেদনের ভিত্তিতে বারেবারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে হাইকোর্টকে। শাসকের সশস্ত্র গুন্ডাদের মার খেয়ে, রক্ত ঝরিয়ে তবু বিরোধী দলের কিছু প্রার্থী মনোনয়ন পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। অনুব্রত মন্ডল নামে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য দুষ্কৃতী-নেতার কথায়, ‘মমতা ব্যানার্জির উন্নয়ন আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সবই হচ্ছে সেই কারণে।’ গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিনের আলোয় গামছায় মুখ ঢাকা এমন ‘উন্নয়ন’ সারা দেশে সত্যিই বেনজির!

দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। সাধারণ মানুষকে হটিয়ে পঞ্চায়েতগুলি দখল করেছে অর্থলোলুপ কিছু তোলাবাজ। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, যে কোন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পেতে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতাশালী নেতাদের এখন ‘কমিশন’, ‘তোলা’ দিতে হয়। পঞ্চায়েতের কাজের আগেই ১০থেকে ১৫শতাংশ টাকা শাসকদলের নেতাদের পকেটে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকাদাররা।                      নীতি-আদর্শহীন তৃণমূল মূলত ধান্দা-নির্ভর একটি দল। তাই পঞ্চায়েতগুলিও এখন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর ক্ষেত্র। একশ’ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ইত্যাদি প্রকল্পে চলছে দেদার চুরি। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, আদিবাসী বা তফসিলী মানুষের হকের টাকা ‘পাইয়ে দেওয়ার’ নাম করে কাটমানি খাচ্ছে তৃণমূল নেতারা। মানুষের ভুরিভুরি অভিযোগ জমা পড়লেও কোন প্রতিকার করছে না তৃণমূল সরকার।

গণশক্তি, ১৩ই মে, ২০১৮ 

গর্বের পঞ্চায়েতঃ গড়েছে বামফ্রন্ট, ধ্বংস করছে তৃণমূল-১


১৯৭৮সালে ঐতিহাসিক নির্বাচন। আইন সংশোধন করে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই বছরেই প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন করে বামফ্রন্ট সরকার। কংগ্রেস আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছিলো। চলতি ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বামফ্রন্টের সৃষ্টি। আগে নামে পঞ্চায়েত থাকলেও গ্রামের উন্নয়নের পরিবর্তে তা ছিলো শোষণের হাতিয়ার। আগে সরকারি কর্মসূচীর সুযোগ সুবিধা গ্রামের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছতো না। এসব কর্মসূচীর সঙ্গে গ্রামের গরিব মানুষ জড়িতও থাকতেন না। ১৯৭৮সালে নবগঠিত পঞ্চায়েতের ৫৬হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্রামবাংলায় নতুন প্রাণের ছন্দ সৃষ্টি করেন। পঞ্চায়েত হয়ে ওঠে গ্রামের গরিবের বন্ধু। গরিব মানুষ পঞ্চায়েতের কাজকর্মে সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করেন। গ্রামের মানুষের যথাসম্ভব উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয় পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। সারা দেশে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার মডেল হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত। পরে কেন্দ্রীয় আইনও এরাজ্যের অনুকরণেই তৈরি হয়।
নজিরবিহীন গণউদ্যোগ। ১৯৭৮সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই বিধ্বংসী বন্যায় বিপর্যস্ত হয় এরাজ্যের গ্রামাঞ্চল। কোনরকম অতীত অভিজ্ঞতা ছাড়াই সর্বস্তরের মানুষের বেনজির উদ্যোগ গড়ে এই সর্বনাশা বন্যার মোকাবিলা করে পঞ্চায়েত উদ্ধার, ত্রাণ ও পুননির্মাণের কাজে পঞ্চায়েতের সম্মিলিত অভিযান জনমানসে গভীর রেখাপাত করে
১৯৭৮-৭৯সালের ভয়াল বন্যা এবং ১৯৮১-৮২সালের প্রচন্ড খরায় কৃষি উৎপাদনে দারুণ বিঘ্ন ঘটে। ৫৫০কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। বাস্তু ও কৃষিজমির প্রচুর ক্ষতি হয়। বামফ্রন্ট সরকারের পরিচালনায় পঞ্চায়েত শুরু করে পুননির্মাণের অভিযান। ১৯৭৮থেকে প্রথম চার বছরে পঞ্চায়েত ‘কাজের বদলে খাদ্য’ কর্মসূচী অনুযায়ী ১৪লক্ষ শ্রমদিবস সৃষ্টি করে। কৃষি বিভাগের উন্নত জাতের বীজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ও নতুন ফসলের চাষে কৃষকদের সাহায্য করতে মিনিকিট বিতরণ প্রকল্প পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে রূপায়িত হয়। পঞ্চায়েতের সুপারিশে মাছচাষিদের ঋণ দেয় সরকার। পানীয় জল সরবরাহ, নার্সারি, হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি, বাস্তুহারাদের জন্য বসতবাড়ি, স্কুলবাড়ি, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকদের জন্য বাড়ি, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ইত্যাদি প্রকল্প রূপায়িত হয়
অবাধ ও নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচনসারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য, যেখানে নির্দিষ্ট পাঁচ বছর অন্তর ত্রিস্তর পঞ্চায়েতেই নির্বাচন হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের সময়েভোট হয়েছে টানা সাতবার— ১৯৭৮সালে প্রথম, ১৯৮৩সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৮সালে তৃতীয়, ১৯৯৩সালে চতুর্থ, ১৯৯৮সালে পঞ্চম, ২০০৩সালে ষষ্ঠ এবং ২০০৮সালে সপ্তম বার।
ভোটদানের সময় নির্বাচকমন্ডলীর ব্যাপকতম অংশগ্রহণ ঘটতো, গড়ে ৮৫-৯০শতাংশ ভোটদাতা ভোট দিতেন বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম এরাজ্যে ১৮বছরে ভোটাধিকার চালু করেছিলো পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের নির্বাচনে।
প্রতিবারই এই বিশাল নির্বাচনে ভোটদান, গণনা ও ফল ঘোষণার কাজ সারা রাজ্যে সম্পন্ন হয়েছে সুষ্ঠুভাবে। সবটাই মানুষের চোখের সামনে। এটাই ছিলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্যতম গ্যারান্টি।
মহিলা, তফসিলী ও আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণ ১৯৯৩সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে চালু হয়েছিলো। সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম। পরে সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী করে সারা দেশে এই আসন সংরক্ষণ চালু হয়।
দুর্বলতর মানুষকে উন্নয়নের মূলস্রোতে যুক্ত করতেই সব পঞ্চায়েতে তফসিলী জাতি, আদিবাসী, এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের এই পদক্ষেপসংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত এলাকায় মোট জনসংখ্যার সঙ্গে তফসিলী জাতি ও আদিবাসীদের জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতেই আসন সংরক্ষণের সংখ্যা ঠিক হতে থাকে। এক-তৃতীয়াংশ আসন (তফসিলী জাতি ও আদিবাসী আসন-সহ) মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। পর্যায়ক্রমে তা আবর্তিত হয়। ১৯৯৮সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে প্রত্যেক পঞ্চায়েত স্তরে সভাপতি ও সহসভাপতির পদগুলিও তফসিলী জাতি, আদিবাসী, এবং মহিলাদের জন্য একইভাবে সংরক্ষিত।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে (২০০৮) তিনটি স্তরে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মোট ৫১,৪৯৯জন। এর মধ্যে মহিলারা নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯,৮১২টি আসনে। অর্থাৎ ৩৮.৪৭%আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন মহিলারা, যদিও সংরক্ষণ ছিলো ৩৩%। পাশাপাশি, জেলা পরিষদে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১.৩২%। তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন ৩৩.৫০%। পঞ্চায়েত সমিতিতে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১.৯৩% এবং তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন ৩৪.৩৪%। গ্রাম পঞ্চায়েতে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২৩.২৮% এবং তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন ৩৪.৭৮%। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত পৌরসভায় মহিলাদের জন্য ন্যূনতম ৫০শতাংশ আসন সংরক্ষণের আইনও তৈরি করেছিলো। 
গ্রামের মানুষের হাতেই ক্ষমতাযথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচী এবং বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে আসলে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রেরই বিকাশ ঘটিয়েছিলো বামফ্রন্ট। একাজে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ছিলো হাতিয়ার। ভূমিসংস্কার কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছিলো তিনটি পথে। বেনামী ও সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার, ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বন্টন এবং বর্গাদারদের অধিকারের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা।
সারা দেশে ভূমিসংস্কার থেকে উপকৃত পরিবারগুলির শতকরা ৫৩.২ভাগই পশ্চিমবঙ্গের। ৩১শে মার্চ, ২০০৬পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ২৯লক্ষ ৮২হাজার একর বেনামী ও সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার করা হয়েছে। জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে মোট ২৮লক্ষ ৪৯হাজার জনকে। এরাজ্যে যত পরিবারকে খাস জমি বন্টন করা হয়েছে তার ৫৬শতাংশই তফসিলী জাতি ও আদিবাসী পরিবার। ভূমি ও ভূমিসংস্কার দপ্তরের ২০০৮সালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বন্টিত জমির ৩৬.২৪শতাংশ পাট্টা পেয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। নজর করার মতো তথ্য, গোটা দেশে যত জমি এভাবে পুনর্বন্টিত হয়েছে, তার শতকরা ২২ভাগ পশ্চিমবঙ্গের। যদিও গোটা দেশের মোট কৃষিজমির শতকরা মাত্র ৩ভাগ রয়েছে এরাজ্যে।
এই জমি উদ্ধার এবং বন্টনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানার চরিত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বদল এসেছিলো। গোটা দেশের গড় হিসেবে যখন শতকরা ১৫জনের হাতে ৬০শতাংশ কৃষিজমি অর্থাৎ ধনী কৃষকদেরই একচেটিয়া আধিপত্য, তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের হাতে রয়েছে ৮৪শতাংশ জমির মালিকানা।  গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মহিলাদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে যৌথ পাট্টাও বন্টন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যে যৌথ পাট্টার অধিকারী ৬,০৩,৯৮৭টি পরিবার। অর্থাৎপরিবারের জমিতে মহিলা-পুরুষের সমান অধিকার।  পাশাপাশি, ২০১১সালের সেপ্টেম্বরের হিসেব, রাজ্যের ১লক্ষ ৬২হাজারেরও বেশি মহিলা একাই জমির মালিক। রাজ্যে বন্টিত জমির প্রায় ৩০শতাংশে মহিলাদের অধিকার রয়েছে।
বর্গাদারদের অধিকারও সুনিশ্চিত করেছিলো বামফ্রন্ট। ১৯৭৮সালে অপারেশন বর্গা চালু হয়। ১৫লক্ষেরও বেশি বর্গাদারের মেয়াদী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়গোটা দেশে আর কোথাও একাজ হয়নি। বর্গা নথিভুক্তদের মধ্যে শতকরা ৪১.৯২ভাগ তফসিলী জাতি ও আদিবাসী পরিবার।
ভূমিসম্পর্কের পরিবর্তন এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। ভূমিসংস্কার একদিকে কৃষক-সহ গ্রামীণ গরিবের আর্থিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে।
ফলনে রেকর্ড গড়ে গ্রামবাংলা। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সফল রূপায়ণ এবং যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কারণে উদ্দীপ্ত কৃষকরা এরাজ্যের কৃষি উৎপাদনে নজির গড়েন। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য থেকে বাড়তি রাজ্যে পরিণত হয় পশ্চিমবঙ্গ। গড় শস্যনিবিড়তার সূচকের নিরিখে পাঞ্জাবের ঠিক পরেই দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১০সালে পশ্চিমবঙ্গে শস্যচাষের নিবিড়তা ছিলো ১৯২শতাংশ।
ভূমিসংস্কার এরাজ্যে একদিকে উৎপাদন বাড়িয়েছে, আবার গ্রামীণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিবের হাতে জমি যাওয়ায় তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। তাঁদের সম্মিলিত চাহিদার ফলাফল হিসেবে এরাজ্যে গ্রামাঞ্চলে বিপুল বাজার তৈরি হয়।
পঞ্চায়েতের ক্ষমতা বাড়াতে আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই। গ্রামীণ উন্নয়নের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী, পরিবেশ, উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ের কাজ পঞ্চায়েতগুলিই করতে থাকে। ক্ষুদ্র সেচ, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা, পানীয় জল সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য ও রোগ নিবারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা পরিপূরকের। গণবন্টন ব্যবস্থা, দুর্বলতর অংশের মানুষের মধ্যে জমি বন্টনের মতো ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের সুপারিশকে সামনে রেখে কাজ করে সরকারি দপ্তরগুলি।
বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের সমস্ত নথিভুক্ত ভোটারকে নিয়ে গ্রামসংসদ গঠন করা হয়। গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচীতে সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গ্রামসংসদ স্তরে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে ব্লক সংসদজেলা সংসদ গঠন করা হয়। জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে স্থায়ী সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে উপসমিতিগুলিকে আরো বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিটি স্তরের সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি ও সাব কমিটিতে বিরোধী দলের নেতা বা নেত্রী পদাধিকার বলে সদস্য হন। পঞ্চায়েতের কাজে আরো গতি আনার জন্য সরকারের দেয় অর্থ সরাসরি পঞ্চায়েতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হতে থাকে। সমস্ত স্তরেই সরকারি নিয়মমতো হিসেবপত্র পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়।
সম্পদ সংগ্রহের অধিকার। বামফ্রন্টের সময়েই এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ করার অধিকার দেওয়া হয় পঞ্চায়েতগুলিকে। পঞ্চায়েতের সংগৃহীত সম্পদ নিজস্ব এলাকার উন্নয়নেই খরচ হয়। যেসব কাজ সরকারি প্রকল্পে করা সম্ভব নয়, অথচ স্থানীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা এই টাকায় করা হতে থাকে। এর ফলে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হয়। গ্রামবাংলার জীবনে নতুন ছন্দ আনে পঞ্চায়েত।
জনস্বাস্থ্য ও শিশুশিক্ষা কর্মসূচী রূপায়ণেও পঞ্চায়েতগুলি গ্রামীণ জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো। রাজ্যের সমস্ত গ্রামীণ পরিবার, ছাত্র-শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্যবিধিসম্পন্ন আধুনিক শৌচাগারের সুবিধা দিতে সব জেলাতেই সার্বিক স্বাস্থ্যবিধান প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পের সাফল্যের কারণে বহু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নির্মল গ্রাম পুরস্কার’ পায়। শিশুশিক্ষা কর্মসূচী পঞ্চায়েতগুলিতে চালু হয় ১৯৯৭-৯৮সাল থেকেবিভিন্ন গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ৯থেকে ১৩বছরের বালক-বালিকা, যারা নানা কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা কারণে যেতে পারে না, তাদের জন্য খোলা হয় শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। খোলা হয় মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র।
খেতমজুরদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যনিধি প্রকল্প চালু হয়েছিলো ১৯৯৮সালে। পশ্চিমবঙ্গের ১৮থেকে ৫০বছর বয়সী খেতমজুররা মাসে ১০টাকা করে জমা দিয়ে এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করাতে পারতেন। প্রত্যেক নথিভুক্ত কৃষিশ্রমিকের জমা টাকার সমপরিমাণ টাকা রাজ্য সরকার দিতো। মোট জমার ওপর সুদ সংশ্লিষ্ট খেতমজুরের পাশবইতে নথিভুক্ত থাকতো। এই প্রকল্পের কাজও দেখাশোনা করতো পঞ্চায়েত১৯৮০-৮১সালে সারা ভারতে সর্বপ্রথম এরাজ্যে কৃষকদের বার্ধক্যভাতা চালু হয়। পেনশনভোগীর মৃত্যুর পরে তাঁর বিধবা পত্নীও পেনশন পেতে থাকেন।
দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণে জোর দিয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৯৩সালে অনুষ্ঠিত রাজ্যের চতুর্থ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সদস্য, পদাধিকারী ও কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়কল্যানীতে অবস্থিত রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন সংস্থায় এঁদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পরে প্রতিটি জেলায় তৈরি করা হয় প্রশিক্ষক দল।
আত্মমর্যাদা ও অধিকার চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত।  শুধু গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয়, গ্রামের মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও অধিকার চেতনার বিকাশ ঘটানোর কাজেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে পঞ্চায়েতআগে জনগণ সরকারের কাছে করুণাপ্রার্থী হিসেবে করুণাভিক্ষা করতেন। তাঁরা ক্রমশ বুঝেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস তাঁরাই। আত্মমর্যাদায় বলীয়ান গ্রামবাসীরা ক্রমশ বুঝেছেন, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার।
প্রশংসা সকলের মুখে। ১৯৯৩সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত সম্পর্কে জনগণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা করেছিলো দিল্লির ইনস্টিটিউট অব সোসাল সায়েন্স। ১৯৯৬সালে প্রকাশিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত ইলেকশনস-১৯৯৩-এ স্টাডি ইন পার্টিসিপেশন’ শিরোনামের রিপোর্টে তারা জানিয়েছিলো, ‘‘...বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বেশির ভাগ মানুষই বলেন, পঞ্চায়েত ভূমিহীনদের জমি দিয়েছে, গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে, বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষিত করেছে, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি করেছে, রাস্তাঘাট নলকূপ ইত্যাদি গ্রামীণ পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে, সর্বোপরি জনগণকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে।’’
২০০৭সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের ৬১তম রাউন্ডের রিপোর্ট জানিয়েছে, ১৯৭৩-৭৪সালে সারা দেশে গ্রামবাসীদের ৫৬.৪শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। পশ্চিমবঙ্গে তখন এই হার ছিলো ৭৩.২শতাংশ।
কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টই জানিয়েছে, ১৯৭৩সাল থেকে ২০০৫-এর মার্চের মধ্যে সারা দেশে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমার বিচারে প্রথম দু’টি রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াইয়েরই ফল এই সাফল্য।

গণশক্তি, ১৩ই মে, ২০১৮