20161207

#Demonetization কালো টাকা উদ্ধার, নাকি সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা?

#Demonetization

গত ৮ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী রাতারাতি ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণা করেন টেলিভিশনে। শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে অস্থিরতা। কোটি কোটি মানুষ ব্যাঙ্কের সামে দীর্ঘ লাইন দিতে বাধ্য হন ঘন্টার পর ঘন্টা। ৮৬শতাংশই মুদ্রাই ছিলো ওই দুই নোটে। ভারতের মতো নগদ-নির্ভর অর্থনীতিতে এই ধাক্কা  বিরাট। কার্ড, ডিজিটালের মতো অ-নগদ পদ্ধতিতে লেনদেন হয় মাত্র ৮শতাংশ। সরকারের প্রস্তুতির অভাব স্পষ্ট ১৭বার নিয়ম পরিবর্তনের ঘটনাতেই। উপরন্তু পুরনো নোট বাতিল হলেও নতুন নোট জোগানে ব্যর্থতা সংকট বাড়িয়ে তুলছে।

ভারতের অর্থনীতিতে কালো টাকার দাপট অনেক দিন ধরেই। কালো টাকা উদ্ধারে কঠোর ও আন্তরিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে অবশ্যই তা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু নোট বাতিলের এই পদ্ধতিতে কি আদৌ কালো টাকা উদ্ধার হবে, নাকি জনগণের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক বিরাট অর্থনৈতিক দুর্দশার বোঝা?

কালো টাকা কাকে বলে?

সব টাকাই বা নোট হলো সাদা টাকা। যখন টাকা আয় বৈধভাবে করা হয় না বা আয় নিয়ে বৈধ কর দেওয়া হয় না সেটাই হয় কালো টাকা (বলা ভালো কালো সম্পদ)। শুধু প্রত্যক্ষ কর নয়, পণ্য কেনা বেচায় বৈধ কর না দিয়ে যে আয় করা হয় সেটা কালো টাকা। সরকারের প্রাপ্য বা সাধারণ মানুষের টাকা প্রতারণা করে গায়েব করা টাকা হলো কালো টাকা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কালো টাকার ৮০% মজুত করে বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি যার বিরাট অংশই তারা বিদেশে পাচার করে ব্যাঙ্কে জমা রাখছে। এই কালো টাকা কোম্পানিগুলি আয় করে উৎপাদিত পণ্য কম দেখিয়ে, শ্রমের ব্যবহার বেশি দেখিয়ে বাড়তি সুযোগের রফা করে, মুনাফা কম দেখিয়ে, কর কম দিয়ে। কালো টাকা পাচারের বড় পথ হলো আমদানি রপ্তানি কারবারের লেনদেনের হিসাবে কারচুপির করা। মোদী সরকার বা তার আগের সরকার কেউ এই মুখ্য অপরাধী কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে  কোন উদ্যোগ নেয়নি।

দেশে কত কালো টাকা আছে ?

বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা ও কমিটি দেশে কত কালো টাকা আছে তার অনুমান করার চেষ্টা করেছে। যেহেতু বিষয়টি গোপন তার পুরো সঠিক হিসাব এখনো সম্ভব হয়নি। তবে কিছু হিসাবে বলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির মোট টাকার ২০%থেকে ৬৬% হলো কালো টাকা। বর্তমানে ২০১৫-১৬ সালে ভারতের জিডিপির পরিমাণ হলো আনুমানিক ১৩৬ লক্ষ কোটি টাকা। এতে কালো টাকার পরিমাণ হবে ২৭লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৯০ লক্ষ কোটি টাকা।


এই কালো টাকা কি ৫০০ বা ১০০০টাকার নোটে মজুত করে রাখা হয়?

নগদে কালো টাকার সম্পদের মজুত আছে বড়জোর ৩-৫%। সংবাদ মাধ্যমে কেন্দ্রের তরফে দাবি করা হয়েছে নোট বাতিলে উদ্ধার হবে ৪ থেকে ৬লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ যদি সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়িতও হয় এত নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে, বাগাড়ম্বর করেও আসলে ৯৫ থেকে ৯৭শতাংশ কালো সম্পদই এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকছে।
 
সব কালো টাকা বস্তায় বা বেনামি অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে বা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে যে প্রচার চলছে তা-ও ওই ৩-৪%র মধ্যেই। তা-ও সংগৃহীত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম ধনীদের কাছ থেকে। সরকার ১০০০টাকার নোটে কালো টাকা মজুত হয় বলে তা বাতিল করলো আবার উলটে ২হাজার টাকার নতুন নোট  চালু করলো। এর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হলো না। কালো টাকার বড় বড় রাঘব বোয়ালদের আসলে ধরাই হলো না।

কোথায় আছে কালো টাকা ?

দেশে ও বিদেশে কালো টাকা রোধে পদক্ষেপ নিয়ে কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রকে একটি রিপোর্টও জমা আছে। ২০১২ সালে অর্থমন্ত্রকের বিশিষ্ট অফিসার ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি ঐ রিপোর্ট পেশ করে। তাতে কমিটি জানিয়েছে, নোট বাতিল কালো টাকার সমস্যার কোন সুরাহা করবে না। বেশি কালো টাকা এতে উদ্ধার হবে না। কারণ কালো টাকা নোটে নয় মজুত আছে বেনামে সোনার বার, অলংকার, জমি, বাড়ি সহ নানা সম্পত্তিতে। সুইস ব্যাঙ্কে দেশের যাদের বিপুল টাকা জমা রয়েছে এরকম ৬৮০ জনের অ্যাকাউন্টের তালিকা রয়েছে কেন্দ্রের কাছে। উইলিকস-পানামার সংবাদপত্রে দেশের ধনীদের কার কার বিদেশে বিভিন্ন সংস্থায় শেয়ারে টাকা জমা আছে তার তালিকা প্রকাশ হয়েছে। কেন্দ্রের কাছে তার তালিকাও আছে। যেসব দেশে কর ছাড়ের সুযোগ রয়েছে সেখানে বিদেশি ব্যাঙ্কে দেশের ধনীরা  যারা টাকা জমা রেখেছেন সেই বেআইনি  টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন্দ্র। সেসব দেশ ভারত সরকারকে সহযোগিতা করতে রাজি হলেও সে টাকা উদ্ধারের কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। উলটে সে কালো টাকা সরকারের সাহায্যে ঘুরপথে দেশে চলে আসছেতাকে সরকার থেকে আবার আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

নোট বাতিলে জাল নোট বন্ধ হবে?

হবে না। দেশের শীর্ষ তদন্ত সংস্থা এন আই এ (জাতীয় তদন্ত সংস্থা) কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটকে এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিল। অর্থনীতিতে কত অংশে জাল নোট ঘুরছে তার রিপোর্ট দেয় তারা। এন আই এ-র পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা যার মধ্যে রয়েছে সি বি আই, আই বি, ডি আর আই, ‘এবং রাজ্যগুলির পুলিশের থেকে তথ্য নেওয়া হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি ১০লক্ষ টাকার মধ্যে ২৫০টাকা মূল্যের জাল নোট থাকে। শতাংশে ০.০২৫। সরকার নিজেও সংসদে এই তথ্যই পেশ করেছে। সমীক্ষায় স্পষ্ট বলা হয়, জাল নোট বাজেয়াপ্ত করার জন্য চালু ব্যবস্থাই যথেষ্ট।
যে কোনো মানুষ বোঝেন, জাল নোটের কারবার যারা করে তাদের ধরা না গেলে নতুন নোট ফের জাল করা হবে। জাল নোটের কারবার রুখতে ১৪লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া আজগুবি ব্যাপার।

বন্ধ হবে সন্ত্রাসবাদ?

আমরা সকলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, সন্ত্রাসবাদীরা টাকার থলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় যে পরিস্থিতি, যে রাজনীতি তা থেকে নজর সরানো অনুচিত। একটি ঘটনা লক্ষ্য করুন। কাশ্মীরে নিহত দুই সন্ত্রাসবাদীর কাছে পাওয়া গিয়েছে নতুন ২০০০টাকার নোট। নোট বন্ধ বা চালু করে নয়, সন্ত্রাসবাদীদের কাছে টাকাটা যাওয়ার পথ বন্ধ হওয়া দরকার।

সরকার বলছে, বিরাট লাভের জন্য সামান্য লোকসান। একথা কি সত্যি?

এখন পর্যন্ত আমাদের কমপক্ষে ৭১জন সহনাগরিকের মৃত্যু হয়েছে নোট বাতিল ঘোষণার জেরে। পুরানো নোট নার্সিংহোমে না নেওয়ায় মৃত্যু হয়েছে শিশুর। আরেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বাবার কোলে ব্যাঙ্কের লাইনে থাকার ধকল নিতে না পেরে।
প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে জওয়ানদের তুলনা টানছেন। বলছেন তাঁরা যদি সীমান্তে বিনিদ্র রাত কাটাতে পারেন তাহলে আমরা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াতে পারব না কেনজওয়ানদের অনেকে কিন্তু কৃষকসন্তান। আজকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এবং কৃষিজীবী মানুষ। কৃষকরা তাঁদের ফসল মান্ডিতে আনলেও বিক্রি হচ্ছে না। দূরের ব্যাঙ্কের শাখায় লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। এখন তাঁরা লাইন দিচ্ছেন সরকারি বীজ সরবরাহের দোকানে। কৃষকরা উদ্বিগ্ন, রবিশস্যের চাষের কী হবে। ফসল তোলার সময়ে সঙ্কট নেমে এসেছে গ্রাম ভারতে। এই অবস্থায় জওয়ানরা খুশি থাকতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী জোয়ানদের জন্য মেকি দরদ, মেকি জাতীয়তাবাদ দেখাচ্ছেন।
বিপুল অংশের মানুষের জীবিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থনীতির বিপুল অংশ নগদের ভরসায় চলে। পুরো থমকে গিয়েছে অর্থনীতির এই অংশের লেনদেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কম মজুরির অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা মানুষরা, যারা মজুরি পান নগদে। ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের হিসেব, শ্রম নিবিড় ক্ষেত্রে এর মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন ৪লক্ষ শ্রমিক। বস্ত্র, চামড়া, অলঙ্কারের মতো শিল্পেই কেবল ৬০লক্ষ মানুষ বেতন পাননি। বাগিচা শিল্পে তীব্র সংকটে আরো ২০লক্ষ শ্রমিক। অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ খুইয়ে দলে দলে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষি, খুচরো ব্যবসা ও নির্মাণেই দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ যুক্ত। ক্ষতি তাদেরই সর্বাধিক।
ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট ডাকলে যারা অর্থনীতির লোকসানের হিসেব দিতে উঠেপড়ে নামে তারা এখন চুপ। দিনের পর দিন কাজ বন্ধ হয়ে বিপুল লোকসানে তাদের চোখ বন্ধ।


প্রধানমন্ত্রীর দাবি এই পদক্ষেপ গরিবের জন্য। কথাটা কি ঠিক?

গরিবের স্বার্থে বলাটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটেমোদী সরকার তার সরকারের প্রথমার্ধ  কাটিয়েছে কেবল তথাকথিত ব্যবসা মসৃণ করারকাজে। দেশি-বিদেশি বড় পুঁজির মালিকের স্বার্থ দেখেই এতটা সময় কাটিয়েছে মোদী সরকার। এখন সরকার জোর করে সাধারণ মানুষকে ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখতে বলছে কিন্তু তা তাদের প্রয়োজনমতো তুলতে দিচ্ছে না।  সরকার বলেছিলো কালো টাকা উদ্ধার করে প্রতি অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা দেবে। তা আজ তামাশার পর্যায়ে চলে গেছে। তার বদলে নিজের টাকা তুলতে গেলে হাতে লাগছে কালো কালি।
সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের মানুষ। অনেকেই সমবায় ব্যাঙ্কে তাদের টাকা রাখেন। এখন সরকার সেখানেই পুরানো নোট বদল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গ্রাম ভারতে লেনদেন বন্ধ হয়ে চরম সংকট নেমে এসেছে।

আসলে অতি-ধনীদের সাহায্য করা হচ্ছে

গরিবদের সাহায্য দূরের কথা, বড় ব্যবসায়ী এবং ধনীদের ঋণ মাফ করে দেওয়ার নির্দেশিকা আসলে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছে দেশের সরকার। এই অংশের থেকে ব্যাঙ্কগুলির পাওনা ১১লক্ষ কোটি টাকার বেশি। একজন কৃষক বা ছাত্র বা ছোট দোকানদার ধার নিলে সুদসহ তা ফেরত না দিলে ব্যাঙ্ক নোটিস পাঠায়, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, জেলেও পাঠায়। এই সরকার কোনো একজন বড় ব্যবসায়ী ঋণখেলাপিকে শাস্তি দিয়েছে? বরং, এই সময়ে বড়লোকদের ২লক্ষ কোটি টাকা ধার মকুব করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এই অনাদায়ী ঋণের ভারে সম্খটগ্রস্ত। এখন নোট অচলের ঘোষণার মাধ্যমে মানুষকে টাকা জমা রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে ব্যাঙ্কে। ফলে, ব্যাঙ্কে বড়লোকদের অনাদায়ী ঋণ, ধার মকুব করার লোকসান অংশত মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষের এই টাকা দিয়েই। অতি-ধনী ঋণখেলাপিদের আবার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

এই সমস্যা কি সাময়িক?

লোকসানের বহর কতো সঠিক হিসেব করে ওঠা মুশকিল। কিন্তু, কিছু বেসরকারি সমীক্ষা যে হিসেব দিচ্ছে তা চমকে দেয়ার মতো। অ্যাম্বিট ক্যাপিটালের হিসেব, ২০১৬-১৭অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ভাগে মোট জাতীয় উৎপাদন ০.৫শতাংশ কমবে। সারা বছরে এই হার দাঁড়াবে ৩.৫শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৫.৮শতাংশ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র হিসেব, স্বল্পমেয়াদেই লোকসানের অঙ্ক ১.২৮লক্ষ কোটি টাকা। মানে, প্রত্যেক ভারতীয়ের ১০০০টাকা করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে গরিবদের উপর যাঁরা নগদ অর্থনীতির ওপর বেশি নির্ভর করেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি জানাচ্ছে, অর্থনীতি সংকোচনের ফলে যে প্রভাব পড়বে তার তুলনায় বেআইনি অর্থনীতিতে প্রভাব সামান্যই। মানে, গরিব এবং সাধারণ মানুষের ওপর বিপুল ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। অথচ, কালো টাকা উদ্ধারে প্রভাব সামান্য। দেশে মন্দা, কর্মসংস্থানের সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী চেহারা নিতে পারে।

মোদী এবং বি জে পি যে ব্যাপারে চুপ

দুর্নীতির সবচেয়ে জঘন্য চেহারা রাজনৈতিক দুর্নীতি। কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের চক্র। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে চুপ। সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টিতে একটি মামলা চলছে। ২০১৩-তে সি বি আই দুই শিল্পগোষ্ঠী বিড়লা এবং সাহারায় তল্লাশি চালায়। কাগজপত্রে পাওয়া যায় রাজনীতিবিদদের তালিকা সঙ্গে টাকার অঙ্কের উল্লেখ। বিড়লা ২৫কোটি টাকা এবং সাহারার ৫৫কোটি টাকা দুই তালিকায় পাওয়া যায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীরউল্লেখ। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী কে ছিলেন? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আবেদন গ্রহণ করার জন্য আরো কাগজপত্র দিতে হবে।
৮ই নভেম্বর ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কলকাতায় তারা আগেই বি জে পি ৫০০ ও ১০০০টাকার নোটে কোটি টাকা জমা করে। বিহারের মতো বিভিন্ন রাজ্যে হঠাৎই বিপুল পরিমাণে জমি বা অন্য সম্পত্তি কিনেছে বি জে পি। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নামেই এই সম্পত্তি কেনা হয়েছে। এসব কি কাকতালীয়? বাছাই করা কেউ কেউ যে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত আগাম জানতেন, তার ইঙ্গিত মিলছে। এই কারণেই যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ে তদন্তের দাবি জানাচ্ছে সি পি আই (এম)।

সরকার এই পদক্ষেপ নিলো কেন?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর কে সি চক্রবর্তী সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় বলেছিলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে প্রবল ব্যর্থতা থেকে চোখ ঘোরাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেবল কালো টাকা ফেরানোয় ব্যর্থতাই নয়। তার মধ্যে রয়েছে কাজ, খাদ্য সুরক্ষায় ব্যর্থতা।
অনেকেই মনে করেন গোটা বিষয়টি বিশেষ করে কয়েকটি রাজ্যে আসন্ন ভোটের সঙ্গে জড়িত। এর আগে আর এস এস উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারের বিরোধিতা করলেই দেশবিরোধী বলেছে। এবার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুললেই তাদের দেশদ্রোহী বলে ঘৃণা ছড়ানোর প্রচারে নামা হয়েছে। প্রচারের মাধ্যমে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যায় না।

দাবি কী

বামপন্থী দলগুলির দাবি ৫০০ ও ১০০০টাকার নোট অন্তত ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে দেওয়া হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করা যাচ্ছে না, নতুন নোটের যথেষ্ট যোগান হচ্ছে না ততদিন সাধারণ মানুষকে বৈধ লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হোক।
শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকদের ঋণ মকুব করতে হবে। সমবায় ব্যাঙ্কে পূর্ণাঙ্গ লেনদেনের অনুমতি দিতে হবে। কৃষি উপকরণ কেনায় অসুবিধা দূর করতে হবে।
ব্যাঙ্কে ১১লক্ষ কোটি অনাদায়ী ঋণ বড়লোকদের থেকে আদায় করতে হবেবিদেশী ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখা আমানতকারীদের তালিকা ঘোষণা করতে হবে। করফাঁকির স্বর্গ এমন দেশগুলির সঙ্গে দ্বৈত কর রদ চুক্তি বাতিল করতে হবেসাহারা-বিড়লা তদন্তে মেলা তথ্যের পূর্ণ তদন্ত করতে হবে 
নোট বাতিলে দুর্দশার জেরে যাঁরা প্রাণ হারালেন তাঁদের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যাঁদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হলো তাঁদেরও দিতে হবে ক্ষতিপূরণ।   
 

পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ও সরকারের ভূমিকা কী?

এরাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নিজেরাই বেআইনী চিট ফান্ডের সুবিধাভোগী বলে অভিযুক্ত। রাজ্যের প্রায় ২৫লক্ষ মানুষকে প্রতারণা করে সারদা ও অন্য কয়েকটি চিট ফান্ড যে টাকা যোগাড় করেছিল তা শাসক নেতাদের পুষ্ট করেছে বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকার চিট ফান্ডের প্রকৃত অপরাধীদেৃর আড়াল করেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের পান্ডাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সি বি আই-কে দেওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। উলটে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চ চিট ফান্ডের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য একজনের কমিটি গঠন করলে রাজ্য সরকার অসহযোগিতার পথ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থা ই ডি-ও কমিটি তুলে দিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়, অবশ্য এরা স্থগিতাদেশ পায়নি। নারদা কান্ডেও কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দলের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষণীয়। দুর্নীতি নিয়ে বাইরে মোদী সরকার বাগাড়ম্বর করলেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত শ্লথ করে উভয়ের সমঝোতাই প্রমাণ করেছে।  সংসদে, বিশেষত রাজ্যসভায় বি জে পি তৃণমূলের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ত্রাণকর্তা হিসাবে বি জে পি-র ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিজ নিজ স্বার্থের প্রশ্নে এদের মধ্যে দর কষাকষি এবং গড়াপেটার খেলা দিয়ে এরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
নোট বাতিলের ফলে তৃণমূলের দেশে ও বিদেশে থাকা কালো টাকা উদ্ধার করা যাবে এরকম মোহ পোষণ করার কোনো কারণ নেই। এই পদ্ধতিতে কালো টাকা উদ্ধার হবে না জেনেও বামপন্থীরা নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি তোলেনি। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমানোর জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ দাবি করেছে। সেই দাবিতে বামপন্থীরা দৃঢ় থাকবে। সাধারণ মানুষের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থরক্ষায় প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাবে বামপন্থীরা।

*********