20161026

নভেম্বর বিপ্লব: মানবজাতির জন্য এক নতুন দিশা

শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানব ইতিহাসে প্রথম অগ্রগতি হলো মহান নভেম্বর বিপ্লব। নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে শ্রমিক কৃষক ও অন্যান্য শোষিত অংশের মানুষের এটি প্রথম সফল বিপ্লব।

নভেম্বর বিপ্লব কি?
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লব বিশ্ব ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন সমাজন্ত্রিক রাষ্ট্র —— সোভিয়েত ইউনিয়ন। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলনকে তা বিশ্বের সামনে নিয়ে আসে।
রাশিয়ার এই বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৯১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর (প্রাচীন রাশিয়ার বর্ষপঞ্জী অনুসারে এই তারিখ ছিল ২৫শে অক্টোবর)।
জার রাজতন্ত্রের কেন্দ্র ছিল রাশিয়াএই রাজত্বের হাতে ছিল গোটা মধ্য—এশিয়াসহ বিশাল সাম্রাজ্য। জারের শাসন পদ্ধতির ভিত্তি ছিল বৃহৎ জমিদারতন্ত্র। এই সাম্রাজ্যের উৎকৃষ্ট জমির ৮০ লক্ষ হেক্টর ছিল সর্বশেষ জারের মালিকানায়। সেই সময়ে ছিল ২৮,০০০ বৃহৎ জমির মালিক যাদের হাতে ছিল ১৬.৭৪ কোটি একর জমি।
এই আধা সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথার পাশপাশি পুঁজিবাদী বিকাশ শিল্পখনি ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির উদ্ভব ঘটায়। দ্রুততার সঙ্গে পুঁজিবাদের বিকাশ হলেও বৃহৎ ইউরোপীয় দেশগুলির পুঁজিবাদী বিকাশের তুলনায় রাশিয়া ছিল তখনও পশ্চাদপদ।
জার ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেন। জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উপনিবেশ ও সম্পদ দখলের প্রতিযোগিতার কারণে এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাধে।
লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও কৃষককে জারের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করে এই যুদ্ধে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে রুশ পক্ষ জার্মানির কাছে হারছিল এবং হাজার হাজার রুশ সেনা প্রাণ হারান। দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকরা জমিদারদের হুকুমে দাসদের মতো যন্ত্রণা ভোগ করছিল।



প্রথম, ফেব্রয়ারি বিপ্লব
এই পরিস্থিতিতে গণ অসন্তোষ তীব্র আকার নেয়। বিপ্লবী শক্তিগুলি বিশেষত বলশেভিক পার্টি জার রাজত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংগঠিত করে। এই গণ অভ্যুত্থান বিপ্লবের রূপ নেয়। যা ঘটে ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭ সালে। জার স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হয় এবং তার জায়গায় বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার গঠিত হয়, যেখানে কয়েকটি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিও যোগ দেয়। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে গঠিত অস্থায়ী সরকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে আপস করে রুশ বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার রাস্তা নেয়। যুদ্ধে বিপর্যয় এবং অসংখ্য সৈন্যের মৃত্যুর পরিস্থিতিতে এই সরকার ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারায়।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব জনগণের হাতে ক্ষমতায় নতুন এক হাতিয়ারকে সামনে নিয়ে আসে- সোভিয়েত সমূহ। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বড় বড় শহরে এবং গ্রামীন এলাকায় শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের সোভিয়েত গড়ে ওঠে।
শ্রমিকদের সোভিয়েত এবং সৈন্যদের মধ্যে গঠিত সোভিয়েতগুলির মধ্য থেকে বলশেভিক পার্টি ( বিপ্লবের পর হয় কমিউনিস্ট পার্টি) ক্রমবর্ধমান সমর্থন পেতে থাকে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে অস্থায়ী সরকার শ্রমিক কৃষক ও সৈন্যদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখোমুখি হয়। চলমান বিপ্লবকে রক্ষা করতে সর্বহারারা রাজধানী পেট্রোগ্রাড এবং মস্কোর মতো শহরে নিজেদের সোভিয়েত ও সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে। গ্রামীন রাশিয়া জুড়ে কৃষক এবং খেতমজুররা জমিদার ও রাজন্যবর্গের জমি দখল করতে থাকে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে সৈন্যরা নিজেদের সোভিয়েত নির্বাচিত করে যুদ্ধের অবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি করতে থাকে। লেনিন বলেছিলেন এই সৈন্যদের বেশিরভাগটাই ‘‘ উর্দি পরিধান করা কৃষক’’

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে: সোভিয়েতগুলিকে সমস্ত ক্ষমতা প্রদানের দাবি
এই পরিস্থিতিতে বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন ঘোষণা করেন যে দেশ বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্বের থেকে দ্বিতীয় পর্বের দিকে যাচ্ছে এবং ক্ষমতা দিতে হবে সর্বহারা ও কৃষকদের গরিবতম অংশের হাতে।
‘‘সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েগুলিকে দাও’’ বলশেভিক পার্টির এই ডাকে চূড়ান্তভাবে ২৫শে অক্টোবর (৭ই নভেম্বর) শ্রমিকদের সশস্ত্র অংশ (লাল ফৌজ) এবং সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সেনারা অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করতে এগিয়ে যান। রাজধানী পেট্রোগ্রাডে ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব সফল হয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রতিবিপ্লবী সেনাদের প্রতিরোধ ভেঙে মস্কো এবং অন্যান্য কেন্দ্রে, গোটা রাশিয়ায় এবং পুরনো জার সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই বিপ্লবের পরে লেনিনের নেতৃত্বে জনগণের কমিশারদের পরিষদ নিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়।
জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করেছিল। নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল শ্রমিক, সৈন্য ও কৃষকদের ডেপুটিদের সর্ব রাশিয়ান কংগ্রেস-এ জমি ও শান্তির জন্য ডিক্রি পেশ করাএই কংগ্রেসের গৃহীত জমি ডিক্রিতে গির্জা-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা জমি, তাদের গবাদি পশু ও কৃষির সরঞ্জাম ও বাড়িঘর অধিগ্রহণ করে স্থানীয় জমি কমিটি ও কৃষক ডেপুটিদের জেলা সোভিয়েতগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
যুদ্ধলিপ্ত সব সরকারগুলি ও জনগণের মধ্যে অবিলম্বে শান্তি আলোচনাসহ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ডাক দেওয়া হয় শান্তি ডিক্রিতে। ক্ষয়ক্ষতি ও এলাকাভুক্ত ছাড়াই অবিলম্বে শান্তি চুক্তি করার সংকল্প ঘোষণা করে নতুন সোভিয়েত সরকার।
অন্যান্য ডিক্রিগুলি ছিল নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন সম্পর্কিত।
জারের রাশিয়া ছিল ‘‘জাতিসমূহের বন্দীশালা’’। রুশ বিপ্লব ঔপনিবেশিক জোয়াল থেকে বিভিন্ন অ-রুশ জাতি সমূহকে মুক্তি দেয় এবং ইউনিয়নের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র বিষয় হিসেবে তাদের দেয় এক স্বয়ংশাসিত ব্যবস্থা।
নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্র সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ শুরু করার আগেই এই বিপ্লব প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে। বেধে যায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। লাল ফৌজকে লড়াই করতে হয় শ্বেত ফৌজ ও প্রতিবিপ্লবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে। ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ দশটি পুঁজিবাদী দেশ প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে মদত দেয়।
চার বছরের গৃহযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লালফৌজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ধ্বংস করে চূড়ান্ত জয়লাভ করে। এই প্রক্রিয়ায় লালফৌজকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে এবং লালফৌজের হাজার হাজার শ্রেণী সচেতন শ্রমিক ও কৃষক গৃহযুদ্ধে প্রাণ দেয়।

কেন এটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব?
পৃথিবীতে আগে যা বিপ্লব হয়েছে তার থেকে নভেম্বর বিপ্লব পৃথক। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব দিয়ে শুরু করে পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর কাছ থেকে বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিভিন্ন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
অতীতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে নানা বিপ্লব হয়েছে যখন শোষকদের নতুন শ্রেণী পুরনো শোষকদের শাসনকে উৎখাত করেছিল। এটাই ঘটেছে যখন বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বিপ্লব পূর্ণ সামন্ত শোষক শ্রেণীগুলিকে উৎখাত করেছিল।
নভেম্বর বিপ্লব তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই প্রথম শ্রমিক শ্রেণী ও তার সহযোগী শোষিত শ্রেণী গরিব কৃষকসহ মিত্ররা শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী ও শোষকশ্রেণীগুলিকে উৎখাত করতে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে। রাশিয়াতে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে নভেম্বর বিপ্লবকে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয়। লেনিন বলেছিলেন যে, বিপ্লব তখনই সফল হয় যখন পুরনো রাষ্ট্র ক্ষমতা ভেঙ্গে নতুন ধরণের রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। রুশ বিপ্লবে তা-ই ঘটেছে। এই বিপ্লব পুরনো রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ভেঙ্গে তার জায়গায় সোভিয়েত ধরণের নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই সোভিয়েতগুলি ছিল শ্রমিক এবং গরিব কৃষক স্বার্থের প্রতিনিধি।
সমাজতন্ত্রের অর্থ উৎপাদনের উপকরণ সমূহের সামাজিকীকরণ। শিল্প, জমি ও কৃষি এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ রাষ্ট্র হাতে তুলে নিয়ে এবং যৌথ মালিকানায় নিয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এই কাজ সম্পন্ন হয়। এই প্রথম পৃথিবীতে উৎপাদনের নতুন সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বিপ্লবের সাফল্য
১৯৬০-র দশক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সোভিয়েত ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়। এমনকি সবচেয়ে ঘোর সমালোচকরাও এই সত্য স্বীকার করে। সম্মানিত ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন উল্লেখ করেছিলেন: ‘‘সমস্ত বড় অথবা উন্নত দেশগুলির মধ্যে ১৯১৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে মাথা পিছু সোভিয়েত আর্থিক সমৃদ্ধি সবচেয়ে দ্রুততর, এমনকি তখনকার জাপানের চেয়েও দ্রুততর। জাপানে উৎপাদন বৃদ্ধি হয় ৪০০ শতাংশ, সোভিয়েত ইউনিয়নে হয় ৪৪০ শতাংশ।’’
·       গৃহযুদ্ধের পর এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীভূত
·       সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে সাত বছরের সার্বজনীন শিক্ষা এবং দশ বছরের সার্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা যা সেই সময়ে ইউরোপের অন্য কোনো দেশ অর্জন করতে পারেনি।
·       জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং গরিব কৃষক ও খেতমজুরদের যৌথ খামার এবং সমবায়ে অংশীদারিত্ব
·       বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই সমস্ত নাগরিকদের নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা।
·       বেকারত্ব দূর করে সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা। প্রত্যেকের জন্য কাজের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১৯৩৬ সালের মধ্যে সমস্ত এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
·       নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মহিলাদের সমানাধিকার, সবার সমান মজুরি, মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধার অধিকার এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করা। এছাড়াও মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার। এই অধিকার ১৯২৮ সালে একমাত্র ব্রিটেন দিয়েছিল তাদের দেশের মহিলাদের।
·       সাংস্কৃতিক সম্পদের বিরাট সম্প্রসারণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় খরচে বিভিন্ন বইপত্র, তার সঙ্গে চলচিত্র, সঙ্গীত ও শিল্পকলা নিয়ে প্রকাশ ও পরিবেশনা।



নভেম্বর বিপ্লবের ঐতিহাসিক প্রভাব
১৯১৭ সালের আগে পৃথিবী যা ছিল, বিংশ শতাব্দীর শেষে এবং আজকের তুলনায় তা সম্পূর্ণ আলাদা। বিংশ শতাব্দীর শুরুটা তখন ছিল সাম্রাজ্যের যুগ- সাম্রাজ্যবাদ ছিল উচ্চ শিখরে। পৃথিবীকে ভাগ করে কর্তৃত্ব নিয়েছিল বৃটিশ, জার্মান, ফরাসি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, রাশিয়ান ও জাপানি সাম্রাজ্য। এর নিচে সাম্রাজ্য ছিল ইতালিয়ান, পর্তুগীজ ইত্যাদিরপৃথিবীর জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ এসব সাম্রাজ্যের অধীনে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের বাসিন্দা ছিল। এই পুরনো ধরণের উপনিবেশবাদের অবসান ঘটে রুশ বিপ্লবের সূচনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদের মৃত্যু যাত্রা শুরু হয়। জার সাম্রাজ্যের উৎখাতের ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুকে আর কোনো সাম্রাজ্য ছিল না বললেই চলে। নভেম্বর বিপ্লব জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলিকে উদ্দীপ্ত করে। এই মুক্তি সংগ্রামগুলি ঔপনিবেধিক শাসনগুলিকে উৎখাত করে। প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম উচ্চতর মাত্রায় পৌঁছায়। রুশ বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা পায় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে।
নভেম্বর বিপ্লবের ভিত্তি ছিলো শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর বিপ্লবী রণনীতি। এই শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর রণনীতিই পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ও আধাঔপনিবেশিক দেশগুলিতে ব্যপক কৃষক সমাজকে সমবেত করতে ব্যবহার করা হয়। নভেম্বর বিপ্লবের প্রদর্শিত পথে তিন দশক পরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যুগান্তকারী চীন বিপ্লব সংগঠিত হয়। এরপরে হয় ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার বিপ্লব। এই সমস্ত বিপ্লব বিশ্বব্যপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ১৯৩০- দশকের ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয়েছে। এর পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক শিবির।
মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত সংগ্রামের জন্যই বিংশ শতাব্দীর সেরা বিপদ ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের দেশপ্রেমিক যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২কোটিরও বেশি সেনা ও মানুষ প্রাণ হারায়। নাৎসী যুদ্ধ সম্পর্কে ধংস করার নেতৃত্ব দেয় লাল ফৌজ।
নভেম্বর বিপ্লবের মুক্তিকামী অবদানে রয়েছে বিশ্বব্যপী প্রভাব। রুশ বিপ্লবের সাফল্য বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলির প্রভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী সরকারগুলি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় মডেল চালু করতে বাধ্য হয়। এই সব দেশের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।



ভারতে প্রভাব
নভেম্বর বিপ্লবের সংবাদ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে এবং বাইরের বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
১) কংগ্রেসের মধ্যে মডারেট অংশ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট র‌্যাডিক্যাল অংশ যেমন বাল গঙ্গাধর তিলক এবং অন্যান্যরা রাশিয়ার বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান এবং তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত করার পক্ষে ছিলেন।
২) রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯০৮ সালের আগে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত করার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিলো না। ধর্মঘটও হতো কচিৎ। ১৯১৮ সালে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের সূচনা হয় এবং অনেকগুলি শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন গড়ে ওঠে ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে দেশে বেশকিছু ধর্মঘটের জোয়ার বয়ে যায়।
৩) মোহাজীর গোষ্ঠীগুলির রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পরিচিত হতে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। খিলাফৎ আন্দোলনের পরিণামে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন ক্ষুব্ধ। এদের মধ্যে কয়েকজন ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট
৪) নভেম্বর বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রের সাফল্যে মুগ্ধ হন বিশিষ্ট লেখক কবি যেমন সুব্রহ্মনিয়াম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সফর করে যে নতুন সমাজ গড়া হচ্ছে তাতে মুগ্ধ হয়ে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায় নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্যেও এদের সমান চেষ্টা। অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষেরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে, দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে। মানুষকে যারা কেবলই ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে। অনেক কথা বলবার আছে। এরকম তথ্য সংগ্রহ করে লেখা আমার অভ্যস্ত নয়, কিন্তু না-লেখা আমার অন্যায় হবে বলে লিখতে বসেছি। রাশিয়ার শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে লিখব বলে আমার সংকল্প আছে। কতবার মনে হয়েছে আর-কোথাও নয়, রাশিয়ায় এসে একবার তোমাদের সব দেখে যাওয়া উচিত।’’ 
জওহরলাল নেহরু থেকে পেরিয়ার রামস্বামী পর্যন্ত যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সফর করেছিলেন তাঁরা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডরা রুশ বিপ্লব ও লেনিনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩০ সালের ২১শে জানুয়ারি আদালত কক্ষ থেকে তাঁরা মস্কোর উদ্দেশ্যে এই টেলিগ্রাম করেছিলেন, -‘লেনিন দিবসে মহান লেনিনের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যারা কিছু কাজ করছেন তাঁদের সকলের উদ্দেশ্যে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। রাশিয়া যে মহান পরীক্ষানিরিক্ষা করছে আমরা তার সাফল্য কামনা করি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের কন্ঠেই আমরা কন্ঠ মেলাচ্ছি।’
একারণে, ভারতের স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম রুশ বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।

কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি ঘটলো? 
পুঁজিবাদী বেষ্টনী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সবসময় সাম্রাজ্যবাদী হুমকির মুখে থাকতে হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনেরও লক্ষ্যবস্তু। এসমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন পথে উদ্ভাসিত হয় এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঠিক আমেরিকার পরেই শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত বিরাট সাফল্যের সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় সোভিয়ত ইউনিয়নে দ্রুত আর্থিক বিকাশ, বেকারীত্বের অবসান, সার্বজনীন শিক্ষা স্বাস্থ্যরক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং জনগণের বস্তুগত সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে
অবশ্য ক্রমশ বিশেষত শেষ দুই দশকে কিছু ত্রুটি ও ঘাটতি দেখা দেয়। নতুন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সাফল্যকে কাজে লাগাতে অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কার করা হয়নি; অর্থনীতির পরিচালনায় পুণর্গঠনের ব্যর্থতা দেখা যায়; জনগণের বৈষয়িক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সম্প্রসারণের ঘাটতি আমলাতান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিকাশ ঘটাতে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শগত ব্যর্থতা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ডেকে আনে।
সমাজতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র নির্মাণে বিকৃতি এবং মতাদর্শগত বিচ্যুতি সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যর্থতা ঘটায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র নির্মাণে অভিজ্ঞতার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটা বলা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তিতে বর্তমান বিশ্বে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে যায় না।



নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা
নভেম্বর বিপ্লব মানব সমাজের কাছে দেখিয়েছে যে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
নভেম্বর বিপ্লবের দৃষ্টান্ত বিংশ শতাব্দীতে শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের বিকল্প পথকে আলোকিত করে চলেছে নভেম্বর বিপ্লব।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর বিশ্ব পুঁজিবাদের ও সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য এসেছে। একবিংশ শতাব্দীতে নয়া উদারনীতির পুঁজিবাদ গোটা পৃথিবীকে মুষ্ঠিমেয় ধনী এবং দারিদ্র, বেকারী ও ক্ষুধায় আক্রান্ত বিশাল জনগণের মধ্যে বিভাজনকে প্রশস্ত করেছে।
দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে অসাম্যের। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১শতাংশের সম্পদের পরিমান ১, ১০,০০,০০০ কোটি টাকা যা পৃথিবীর জনসংখ্যার নিচের তলার অর্ধেকের মোট সম্পদের ৬৫গুন বেশি। পৃথিবীর ১৩০কোটি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করছেন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব আধিপত্যের জন্য আগ্রাসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ধংসাত্মক সংঘর্ষ চাপিয়ে দিয়েছে যা এখনো চলছে ইরাক সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে।
নয়া উদারনীতির আক্রমণ, ব্যয়সংকোচের নামে জনগণের ওপরে আঘাত এবং সাম্রাজ্যবাদের কাছে পদানত করার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যপী শ্রমিকশ্রেণী ও শ্রমজীবী জনগণের অন্যান্য অংশ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আলোকবর্তিকা।
সমস্ত বিপ্লবী ও প্রগতিশীল শক্তির কাছে নভেম্বর বিপ্লব অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রেণীহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা সংগ্রাম করছেন তাঁদের কাছে নভেম্বর বিপ্লব এই বার্তা দিয়ে যাচ্ছে যে সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ।

************


20161017

কখন ‘আহারে বাংলা’ ?

#অনাহারে_বাংলা



শারদোৎসব শেষ হতে না হতেই রাজ্য সরকারের আরেক মোচ্ছব ‘আহারে বাংলা’। সরকারী পয়সায় ‘জমিয়ে পেটপূজো’, খাওয়া দাওয়ার রাজকীয় আয়োজন। পাঁচদিন ধরে এই উৎসবে ‘হরেক রকম’ খানাপিনার লোভনীয় বিজ্ঞাপন।

কখন?

যখন উত্তরবঙ্গের চা বাগানে অনাহার-অপুষ্টিতে মৃত্যুর মিছিল চলছে। একের পর এক বাগান বন্ধ, নেই খাবার, নেই ওষুধ। গত চার বছরে প্রায় ৬০০ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। শুধু আলিপুরদুয়ার জেলাতেই দেড় বছরে ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বাগানের অন্ধকারে। সুখে আছেন শুধু বাগান মালিকরা, রাজ্য সরকার অধিগ্রহণের পরে বাগানের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে রেশনের নামে চলছে কালোবাজারীর কারবার। দলে দলে মানুষ যে কোনো কাজের খোঁজে পালিয়ে যাচ্ছেন। নারী পাচারের ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে।

বাংলা কখন ‘আহারে’?

যখন রাজ্যে একের পর এক কারখানায় তালা পড়ছে। হিন্দ মোটর্স, ডানলপ, জেশপ বন্ধ হয়েছে; কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে হিন্দুস্তান কেবলস চিরতরে বন্ধ হয়েছে; রাজ্য সরকার বেচে দিচ্ছে দুর্গাপুর কেমিক্যালস, তুলে দেওয়া হচ্ছে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেস। আসানসোল-দুর্গাপুর, হুগলীর শিল্পাঞ্চলে প্রায় প্রত্যেক দিন চলছে কারখানা বন্ধের পালা। এ রাজ্যের চট শিল্প ধুঁকছে। প্রতারক মালিকরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন আর ফিরে এসেই কয়েক হাজার শ্রমিকের রুজি কেড়ে তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন জুট মিলে। চটকলের শ্রমিক মহল্লায় এই উৎসবের দিনেও জ্বলেনি আলো।

রাজ্যের সরকারী পরিবহনের শ্রমিকদের বকেয়া মিলছে না, পেনশন মিলছে না, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। পরিবহনের জমি বেসরকারী আবাসন মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রীর ‘অনুপ্রেরণায়’ কখন ভূরিভোজের প্রদর্শনী?

এ রাজ্য যখন শিল্পের মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। শুধু সিঙ্গুরেই ডিনামাইট দিয়ে কারখানার শেড ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে, তাই নয়। শালবনীর কারখানা তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে, রঘুনাথপুরে প্রস্তাবিত প্রায় সব শিল্পই পাততাড়ি গুটিয়েছে, অন্ডালে বন্ধ হয়েছে বিমানবন্দর, তোলা দিতে দিতে রাজ্য ছেড়েছে বিদেশী সংস্থা। ইস্পাত, ধাতব এবং বিভিন্ন অনুসারী শিল্প বন্ধ হয়েছে দেদার। প্রায় ৪০হাজার ছোট শিল্প রুগ্‌ণ অথবা বন্ধ হয়েছে।

কোথায় কাজ পাবেন এ রাজ্যের যুবকরা? বহুঘোষিত এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে কাজ চেয়ে নাম লিখিয়েছিলেন ১৮লক্ষ যুবক, কাজ মিলেছে মেরেকেটে দেড় হাজারের। মুখ্যমন্ত্রীর বাগাড়ম্বরের ‘হাব’-গুলিতে ফাঁকা ময়দান, কোনো শিল্পেরই দেখা নেই। একমাত্র সম্ভাবনার স্কুল শিক্ষকের চাকরিতে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা হতাশগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

তুলনামূলক ভাবে কম লেখাপড়া জানা মানুষেরও কাজ নেই। কাজ নেই গ্রামে। পঞ্চায়েত দুর্নীতির আখড়া, ঠিকাদারের পোয়াবারো। রেগার কাজে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই চলে যাচ্ছে পিছনের সারিতে। উপরন্তু রেগায় কাজ করিয়ে মজুরি বকেয়া রাখায় দেশের শীর্ষে এই বাংলা। রেগায় মজুরি পেতেও শাসক দলকে তোলা দিতে হয়, সে শুধু এ বাংলায়। মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষ লক্ষ কাজের গল্প ছেড়ে প্রকৃত কাজের খোঁজে হাজার হাজার যুবক রাজ্য ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনোক্রমে খাবারের সংস্থানটুকু করতেই। এ সময়ে কীসের খাদ্য উৎসব?

এই হেমন্তে কেমন আছেন বাংলার কৃষক? ফসলের দাম না পেয়ে দুর্দশার দায়ে ফসল বিক্রির ঘটনা ঘটছে গ্রামের পর গ্রামে। কখনও ধানচাষী, কখনও আলুচাষী দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন। 

কখন এই ভোজসভা?

বাজার যখন অগ্নিমূল্য। সামান্য ডাল–রুটি যোগাড় করতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। বহু তরিতরকারির দাম বাড়তে বাড়তে তা নাগালের বাইরে। রাজ্য প্রশাসন নিষ্ক্রিয়, দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকাই নেই উৎসবে ডুবে থাকা সরকারের। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ, লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষকে আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। এইসব মানুষজনের জন্য কোনো হুঁশ নেই রাজ্য সরকারের।

কখনও উৎসব খুব কুৎসিত মনে হয়। অমানবিক। মুখ্যমন্ত্রী উৎসবের নাম করে রাজ্যের বিবর্ণ অবস্থা ঢাকা দিতে চাইছেন।


বন্ধ হোক সরকারী কোষাগারের মদতে এই মজলিশ। বন্ধ হোক শ্রমজীবী মানুষসহ সাধারণ গরিব মানুষের জীবনকে ঠাট্টা করার এই আয়োজন। 

‘‘মধ্যপথেই রুখে দিতে হবে ফ্যাসিস্তধর্মী শক্তির কর্মসূচি’’: সাক্ষাৎকারে বললেন সীতারাম ইয়েচুরি


ধর্মনিরপেক্ষতা-গণতন্ত্রের বিপদকে লড়াই করেই রুখে দিতে হবে
দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ বাড়ছেসেই বিপদে মদত দিচ্ছে বি জে পির সরকার। ধর্মনিরপেক্ষতাগণতান্ত্রিক কাঠামো আক্রান্ত হচ্ছে। কেন্দ্রের সরকার খোলাখুলি ধনীদের স্বার্থে কাজ করছে। গণশক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। নয়াদিল্লিতে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গণশক্তির প্রতিনিধি।

১২ই সেপ্টেম্বর গত আড়াই বছরে আমরা যে ট্রেলারদেখেছি, তারপরে আর এস এস-র নেতৃত্বে পূর্ণ বিকশিত ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের ভয়ংকর, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদকে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে এই বিপদকে মধ্যপথেই বাধা দিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ কথা বলেছেন। সোমবার গণশক্তি-র সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি বলেছেন, মেরুকরণকে তীব্র করার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে নতুন বিষয় তোলা হচ্ছে। তথাকথিত লাভ জিহাদ, ঘর ওয়াপসি, জোর করে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি। এখন চলছে গোরক্ষার নামে হাঙ্গামা। ঈদ-উল-জোহা উৎসবের প্রাক্কালে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করতে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। জঘন্য মনোবৃত্তির এই ধরনের নানা বাহিনী ক্রমেই সামনে আসতে থাকবে। বি জে পি সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার বদলে মদতই দিচ্ছে।

ইয়েচুরি বলেছেন, মোদী সরকারের নীতি প্রকটভাবেই ধনীমুখী, কর্পোরেটমুখী, বিদেশি পুঁজির প্রতি পক্ষপাতমুখী। চলছে ধান্দার ধনতন্ত্রের দাপাদাপি। আড়াই বছরে আমাদের সংবিধানের চার স্তম্ভধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদুর্বল হয়েছে।

ইয়েচুরি বলেছেন, আর এস এস-র কর্মসূচি হলো ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে খোলাখুলি অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত ধাঁচের হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই লক্ষ্য পূরণে আর এস এস ধারাবাহিকভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এস এস যদি সফল হয় তাহলে গুণগতভাবে পৃথক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। কিন্তু বামপন্থীদের দেখতে হবে যাতে ওই পরিস্থিতি বাস্তবায়িত না হয়। প্রস্তুতিপর্বেই মুখোমুখি, ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে রুখে দিতে হবে ওই বিপদের আশঙ্কাকে।

সাক্ষাৎকারের পূর্ণাঙ্গ বয়ান: 

গণশক্তি: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি জয়ী হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এই পথেই কি লড়াই হবে

ইয়েচুরি: হ্যাঁ, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ জয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ হচ্ছিল, এই প্রতিষ্ঠানের প্রগতিশীল চরিত্রের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। এই প্রেক্ষাপটে এই জয় খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। যদিও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির ঐক্য আরো শক্তিশালী হতে পারত। এতদসত্ত্বেও জে এন ইউ-র ছাত্ররা আর এস এস-বি জে পির মতাদর্শগত কর্মসূচী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে, সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এ বি ভি পি-কে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

দেশের কথা যদি বলা যায়, সাম্প্রদায়িক বিপদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নিশ্চয়ই বামপন্থী ঐক্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য জে এন ইউ-র ছাত্রদের মতো নয়। সি পি আই (এম)-র ২১তম কংগ্রেসে বলা হয়েছিল, ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যকে বামপন্থীদের পক্ষে পরিবর্তন করতে হলে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের জোরই নির্ণায়ক উপাদান। মোদী সরকারের সার্বিক আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম গড়ে তুলেই এই ঐক্য অর্জন সম্ভব। সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপরে, দেশের ঐক্য-সংহতির ওপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীরা তেমন সমস্ত শক্তিকে সমবেত করার চেষ্টা করবে যারা এই পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। জনগণের সংগ্রামকে শক্তিশালী করেই বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তিশালী করা যাবে। 

গণশক্তি: কাশ্মীর জ্বলছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সফর, ফিরে এসে সর্বসম্মত প্রস্তাবের পরেও কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি চলছেই। এই একটানা অশান্তি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন?

ইয়েচুরি: কাশ্মীরে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাশ্মীরী যুবকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। অন্তত চার জেলায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের প্রস্তাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে সমস্ত অংশেরসঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা শুরুর জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। এখনও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরা খুব কঠিন। দুঃখজনক হলো সরকার এখনও কাশ্মীর সমস্যাকে দেখছে সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত এবং তাদের তৈরি করা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে। কাশ্মীরে পাকিস্তানের যোগাযোগ সকলেই জানে, ভারতের রাজনৈতিক মহলের সব অংশই তার নিন্দা করেছে, সরকারকে তা প্রতিহত করার জন্য বারংবার বলেওছে। কিন্তু সমস্ত অংশের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

সি পি আই (এম) দুপথে চলার প্রস্তাব দিয়েছে। একদিকে, ভারতে সংশ্লিষ্ট সব অংশের সঙ্গে শর্তহীন ভাবে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করো। একই সঙ্গে আমরা বলেছি, আসন্ন সার্ক শীর্ষ বৈঠককে ভারত-পাক আলোচনা পুনরায় শুরুর জন্য প্রধানমন্ত্রী ব্যবহার করুন।

অন্যদিকে, আস্থাবর্ধক কিছু পদক্ষেপ এখনই ঘোষণা করা দরকার। যেমন, পেলেট বন্দুক ব্যবহার বন্ধ করা, যে সমস্ত পরিবারের সন্তানরা মারা গেছে তাদের এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা বাহিনীর তরফে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের অভিযোগের যথাযথ বিচার ও দোষীদের শাস্তি, অসামরিক এলাকা থেকে আফস্পা প্রত্যাহার করা, কাশ্মীরী যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের কর্মসূচি অবিলম্বে শুরু করা। এইভাবে দুপথেই যদি আন্তরিকভাবে এগোনো না যায় গোটা দেশকেই মূল্য দিতে হবে, ভারতের ঐক্য-সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।

গণশক্তি: কিন্তু সরকারের কোনো আগ্রহ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কেন?

ইয়েচুরি: সরকার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না। তবে মনে হয়, আর এস এস-র রাজনৈতিক শাখা বি জে পি-র সরকার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করতেই আগ্রহী। আর এস এস-র মতাদর্শগত কর্মসূচি হলো ভারতকে অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত-ধাঁচের হিন্দু রাষ্ট্রেরূপান্তরিত করা। বি জে পি সরকার তাকেই এগিয়ে নিতে চায়। তাছাড়া, সামনেই উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। বি জে পি হয়তো ভাবছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ যত বেশি হবে উত্তর প্রদেশ এবং দেশের অন্যত্র তত বেশি নির্বাচনী ফায়দা তুলতে পারবে বি জে পি।

গণশক্তি: বি জে পি সরকার আর কী কী ভাবে আর এস এস-র মতাদর্শগত কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজ করছে?

ইয়েচুরি: নানা ভাবে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করার লক্ষ্যে সময়ে সময়ে নতুন বিষয় তোলা হচ্ছে। তথাকথিত লাভ জিহাদ, ঘর ওয়াপসি, জোর করে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি। এখন চলছে গোরক্ষার নামে হাঙ্গামা। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে গোরক্ষক সমিতি বানানো হয়েছে, এই ঝটিকা বাহিনী গোরু রক্ষা এবং আইন প্রয়োগ করছে বলে নিজেরা দাবি করছে। নির্বিচারে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের ভয় দেখানো হচ্ছে। গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগ তুলে মহম্মদ আখলাক, বা ঝাড়খণ্ডের লাতেহারে দুই যুবককে খুন করা হয়েছে। গুজরাটের উনায় দলিতদের ওপরে নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। পরপর এই আক্রমণের সর্বশেষটি ঘটেছে হরিয়ানার মেওয়াটে। মুসলিম-নিবিড় এই জেলায় গোমাংস রাখার অভিযোগ তুলে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, এক দম্পতি খুন হয়েছেন। গোমাংস আছে কিনা তা তল্লাশি করতেবিরিয়ানির নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। ঈদ-উল-জোহা, যা সাধারণভাবে বকরি-ঈদ বলে পরিচিত সেখানে চিরাচরিত খাদ্যই হলো বিরিয়ানি। ঠিক এই উৎসবের প্রাক্কালে গোটা সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত করে তোলা চলতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পদ্ধতি।

এই গোরক্ষক বাহিনীর সন্ত্রাসের কায়দার সঙ্গে জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত ঝটিকা বাহিনীর কায়দার মিল শিউরে ওঠার মতোই।

অনেক বি জে পি রাজ্য সরকার বা অন্য রাজ্য সরকার গোরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। তা প্রয়োগের দায়িত্ব রাজ্যের আইনরক্ষকদের। স্বঘোষিত পাহারাদাররা এ কাজ করতে পারে না। সরকারি মদতপ্রাপ্ত এইসব গোরক্ষক বাহিনীকে অবিলম্বে আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

পোশাক, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে মহিলাদের ভয় দেখিয়ে বেড়ানো বাহিনী আমরা দেখেছি। জঘন্য মনোবৃত্তির এই ধরনের নানা বাহিনী ক্রমেই সামনে আসতে থাকবে। বি জে পি সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার বদলে মদতই দিচ্ছে।

গণশক্তি: নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে জিতেছিলেন আচ্ছে দিন’, পাঁচ বছরে ১০কোটি কর্মসংস্থানের মতো স্লোগান দিয়ে। মুখে সংস্কারের কথাও তো বলা হচ্ছে। তাহলে এই ধরনের ঘটনা দেশে ঘটছে কেন?

ইয়েচুরি: অর্থনৈতিক বোঝার ভারে ধুঁকতে থাকা জনগণের মধ্যে মিথ্যা আশার জাল বুনে নির্বাচনী সমর্থন লাভের লক্ষ্যে ওই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতির ওইটুকুই অর্থ।

দ্বিতীয়ত, এই সরকারের নীতি প্রকট ভাবেই ধনী-মুখী, কর্পোরেট-মুখী, বিদেশি পুঁজির প্রতি পক্ষপাত-মুখী। এই সরকার জনমুখী বা দরিদ্র মানুষের স্বার্থে নীতি রূপায়ণ করতে অন্তর্নিহিত ভাবেই অক্ষম। এখন আমরা দেখছি ধান্দার ধনতন্ত্রের দাপাদাপি। কর্পোরেট ও ধনীরা কার্যত সম্পদ লুটের মহোৎসব করছে। গত দুবছরেই প্রতি বছর ৫.৫লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের ১.১২লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করা হয়েছে। অথচ যে ভারতীয় কৃষকরা কয়েক হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন তাঁদের ঋণ মকুব করা হচ্ছে না, তাঁদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আমরা দেখছি শিল্পে মন্দা, ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে অবনতি, ২০১৫-তে মাত্র ১.৩৫লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ( যদিও বছরে প্রয়োজন ১.৩কোটি এবং প্রতিশ্রুতির বহর হলো ২কোটি), রেগা, গণবণ্টনের মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বিপুল ছাঁটাই। এক কথায় ধনীদের আরো সম্পদবৃদ্ধি, গরিবরা আরো দরিদ্র হচ্ছেন।

এইসব বাস্তবতা আড়াল করতে তথ্যে কারচুপি হচ্ছে, অর্থনৈতিক বিকাশের উঁচু হার দেখানোর চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ ঘটনা হলো দারিদ্র্যকে পুরো উধাও করে দেওয়া হবে! প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের নীতি আয়োগ বলছে ভারতে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেই তারা অক্ষম!

গণশক্তি: নরেন্দ্র মোদীর সরকার মেয়াদের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এসেছেআপনার মূল্যায়ন কী?

ইয়েচুরি: এই আড়াই বছরে মোদী সরকার দেশে খুব উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা আমাদের সাধারণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। সংক্ষেপে বললে এই সরকারের চার মুখএক, আর এস এস-র কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি। দুই, জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি যা দুই ভারতের ব্যবধানকে আরো চওড়া করছে, পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ও দেশিয় কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে কাজ করছে। তিন, ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী প্রবণতা যা প্রতিফলিত হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়া বা সংসদীয় রীতিনীতি সহ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে খর্ব করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। চার, ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রণনীতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের ছোট শরিকে পরিণত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার সর্বশেষ যৌথ বিবৃতিতে যা স্পষ্টভাবেই উচ্চারিত হয়েছে।

এই আড়াই বছরে আমাদের সংবিধানের চার স্তম্ভধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদুর্বল হয়েছে।

গণশক্তি: অতীতে ৬ বছর বি জে পি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার দেখেছি আমরা। এই বি জে পি সরকার সেই সরকারগুলি থেকে কীভাবে পৃথক?

ইয়েচুরি: হ্যাঁ, বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বি জে পি-নেতৃত্বাধীন এন ডি এ কোয়ালিশন সরকার ছিলো ১৯৯৮-২০০৪পর্বে। কিন্তু এই দুই সরকারের মধ্যে গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। তখন বি জে পি-র একক গরিষ্ঠতা ছিলো না, কোয়ালিশন সরকার চলছিল, ‘কোয়ালিশনের বাধ্যবাধকতায়বি জে পি কট্টর হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে তাকে তুলে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০নং ধারা বাতিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে পিছনে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মোদী সরকারের ক্ষেত্রে বি জে পি-র লোকসভায় গরিষ্ঠতা আছে। সুতরাং তারা আর এস এস-র ফ্যাসিস্তধর্মী কর্মসূচি খোলাখুলি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আর এস এস-র ফ্যাসিস্তধর্মী কর্মসূচি সম্পর্কে সি পি আই (এম)-র সময়োপযোগী কর্মসূচিতে বলা হয়েছে: ‘‘সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আর এস এস পরিচালিত জোটের শক্তিবৃদ্ধি ও কেন্দ্রে তাদের ক্ষমতা দখলের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির বিপদ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে’’ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে এই প্রবণতার বিপদের কথা বলতে গিয়ে কর্মসূচিতে বলা হয়েছে: ‘‘ বি জে পি ও তাদের সাম্প্রদায়িক মঞ্চের প্রতি বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির কোনো কোনো অংশের সমর্থন দেশের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে গুরুতর বিপদের আশঙ্কা তৈরি করেছে’‘(পরিচ্ছেদ ৫.৭)

কর্মসূচিতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উপর ভর করে যে ফ্যাসিস্ত প্রবণতা বিস্তার লাভ করছে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সর্বস্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই চালাতে হবে’’(পরিচ্ছেদ ৫.৮)।

পার্টি কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, ‘‘ বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক মঞ্চের ভারতীয় জনতা পার্টি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল। তাদের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মবস্তুর ভিত্তি হলো অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী জাত্যাভিমান। বি জে পি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া দল নয় কেননা ফ্যাসিস্ত ধাঁচের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের পরিচালনা করে, আধিপত্য করে। বি জে পি ক্ষমতায় আসায় রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে আর এস এস। হিন্দুত্ব মতাদর্শ পুনরুত্থানবাদকে মদত দেয়, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে... সেইসঙ্গে বৃহৎ বাণিজ্য ও জমিদারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদ বি জে পি-কে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে’’ (পরিচ্ছেদ ৭.১৪)।

এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই আদবানির কুখ্যাত রথযাত্রার সময় থেকে আমি বলে থাকি, লিখেও থাকি যে আর এস এস-র কর্মসূচি হলো ভারতকে সাংবিধানিক ভাবে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে খোলাখুলি অসহিষ্ণু ফ্যাসিস্ত ধাঁচের হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। এই লক্ষ্য পূরণে আর এস এস দৃঢ়ভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির বিচার করে এ বছরের জুনে ত্রিচূড়ে ই এম এস স্মৃতির উদ্বোধনী ভাষণে আমি বলেছিলাম, ‘‘ আর এস এস যদি সফল হয় তাহলে গুণগত ভাবে পৃথক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। বিপ্লবী শক্তিকে দেখতে হবে যাতে ওই পরিস্থিতি বাস্তবায়িত না হয়।’’ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে তাঁর রিপোর্টে জর্জি ডিমিট্রভ বলেছিলেন, ‘‘ ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে বুর্জোয়া সরকারগুলি অনেকগুলি প্রাথমিক স্তরের মধ্যে দিয়ে যায়, অনেকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা চালু করে যা ফ্যাসিবাদকে সরাসরি ক্ষমতা দখলে সাহায্য করে। এই প্রস্তুতির স্তরে বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাগুলির বিরুদ্ধে এবং ফ্যাসিবাদের বিকাশের মোকাবিলায় যারা লড়াই চালায় না তারা ফ্যাসিবাদের বিজয় অর্জন প্রতিহত করার অবস্থায় থাকে না, বরং বিপরীতে সেই বিজয়কেই সাহায্য করে’’

মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতো কেন্দ্র কিছু শক্তিকে পেয়েছে যারা পরোক্ষ ভাবে আর এস এস-র সঙ্গেই চলে, পরিকল্পনামাফিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করতে তৎপর। আজকের প্রকৃত বাস্তবতার জমিতে পা রেখে চলা যে কোনো সচেতন মানুষই দেখতে পাবেন কোন অভিমুখে ভারত চলেছে যদি না এই বিপদকে মুখোমুখি এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে মোকাবিলা করা যায়। যদি আমরা এই আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে না লড়াই চালাই ১৯৫০-র পর থেকে ভারতের যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তা-ও খর্ব হবে। গত আড়াই বছরে আমরা যে ট্রেলারদেখেছি, তার পরে আর এস এস-র নেতৃত্বে পূর্ণ বিকশিত ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের ভয়ংকর, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদকে কোনো ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে এই বিপদকে মধ্যপথেই বাধা দিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। এই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের অঙ্গীকার, আমাদের প্রতিজ্ঞা।

গণশক্তি, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬

‘জন্মভূমি আজ’

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

‘‘একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।
এখনো রাত শেষ হয় নি;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিণ পাথরের মত, তুমি নি:শ্বাস নিতে পারছ না।
মাথার ওপর একটা ভয়ঙ্কর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মত থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ঙ্করকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।
মাটি তো আগুনের মত হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।’’


পার্টির সাংগঠনিক রাজ্য প্লেনাম সম্পর্কে

ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র
গত ২৭-৩১শে ডিসেম্বর ২০১৫, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সংগঠন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় প্লেনাম কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। কলকাতা প্লেনামের নির্দেশগুলি কার্যকর করার জন্য রাজ্যগুলিকে বার্ষিক পরিকল্পনা রচনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা-সহ চারটি রাজ্যে নির্বাচনের কারণে এই রাজ্যগুলিকে বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে। তদনুযায়ী পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ১লা অক্টোবর রাজ্য প্লেনাম সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য তার আগে রাজ্য কমিটি যে খসড়া রিপোর্ট পেশ করে তা জেলা কমিটিগুলিতে আলোচনা ও সংযোজনী, সংশোধনী ইত্যাদির ভিত্তিতে রাজ্য প্লেনামের জন্য খসড়া রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়েছে। এই প্লেনামে রাজ্য কমিটির সদস্য ছাড়াও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সকল সদস্য ও বিভিন্ন গণ-ফ্রন্টের রাজ্য স্তরের নেতৃত্ব অংশগ্রহণ করবেন। প্লেনামে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা ছাড়াও তাঁদের সংশোধনী, সংযোজনী, প্রস্তাব, পরামর্শ ইত্যাদি অধিকার থাকবে। এছাড়া প্লেনামে পার্টি সংগঠন, আন্দোলন সংগ্রাম ও নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলিও চূড়ান্ত করা হবে। রাজ্যের বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আগামীদিনে আন্দোলন সংগ্রাম ও সংগঠন সম্পর্কে কলকাতা প্লেনামের নির্দেশগুলি বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমাভিত্তিক রূপরেখা ও তার চেক-আপ সুনিশ্চিত করাই হল রাজ্য প্লেনামের মূল কাজ।

কলকাতা প্লেনামের মূল আহ্বান ছিল গণ-লাইনের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় জনগণের একটি বিপ্লবী পার্টি গঠনের কাজ ত্বরান্বিত করা। পশ্চিমবাংলার বিশেষ পরিস্থিতিতে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। পৃথিবীজুড়ে ৮বছর ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির উত্থানের বিপরীতে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগঠিত হচ্ছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অখণ্ডতা ও স্বাধীন বিদেশনীতির ওপর আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে সংকট-সহ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর আঘাত বহুগুণ বেড়েছে। উগ্র, হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের ফ্যাসিস্ট কায়দায় আক্রমণ, কাশ্মীর পরিস্থিতি, সীমান্তে উত্তেজনা ও যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অপচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য হল জনজীবনে জ্বলন্ত সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে গণ-সংগ্রামগুলিকে বিপথে পরিচালিত করা। বলাবাহুল্য, প্রথম এন ডি এ সরকারের তুলনায় দ্বিতীয় এন ডি এ সরকারে বিজেপি-র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও আর এস এস-র নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাবৃদ্ধি স্বাধীনতার পরে এক নজিরবিহীন সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

আমাদের রাজ্যে দ্বিতীয় তৃণমূল সরকারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফ্যাসিস্টসুলভ আক্রমণ এখন চলতি বছরের মধ্যেই পশ্চিমবাংলাকে বিরোধীমুক্ত করার রূপ নিয়েছে। শিল্প-কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সহ সমস্ত সামাজিক ও পরিষেবা ক্ষেত্রে সংকট গভীরতর হয়েছে। সারদা-নারদা-টেট-স্কুল সার্ভিস কমিশন, উড়ালপুল ভেঙে পড়ার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সিণ্ডিকেট রাজ ও তোলাবাজী দৌরাত্ম্য এখন শাসকদলের মধ্যেই দাঙ্গা ও খুনোখুনির রূপ নিয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট সীমান্তের ওপার থেকে তাড়া খেয়ে জে এম বি-র সন্ত্রাসবাদীরা এখানে শাসকদল ও প্রশাসনের নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। রাজ্যে আর এস এস-র কার্যকলাপও বহুগুণ বেড়েছে। এর অর্থ এই নয় রাজ্যে বা কেন্দ্রে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। কিন্তু এতে সন্দেহ নেই জরুরী অবস্থার একনায়কত্বের তুলনায় বর্তমান সময়ের বিপদের আশঙ্কা অনেক গভীর। একে আগাম প্রতিহত করার মতো আন্দোলন সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তোলাই বাম ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পশ্চিমবাংলার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজ্য সাংগঠনিক প্লেনাম এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য সবরকম প্রস্তুতির আয়োজন করবে।

গণ-লাইন সম্পর্কে
একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার রাজনৈতিক সাংগঠনিক লাইনের মুখ্য উপাদান হিসেবে পার্টি গণ-লাইনের ওপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করেছে। আমাদের পার্টির গঠনতন্ত্রের ১১/১(চ) নং ধারায় পার্টি সভ্যদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল ‘‘নিষ্ঠা সহকারে জনগণের সেবা করতে হবে ও ধারাবাহিক জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধন দৃঢ় করে তুলতে হবে। জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং তাঁদের মতামত ও দাবিদাওয়া সম্পর্কে পার্টিকে অবহিত করতে হবে, অব্যাহতি না দেওয়া হলে প্রত্যেককেই পার্টির পরিচালনাধীনে কোনও না কোন গণসংগঠনে কাজ করতে হবে।’’ গণ-লাইনের অর্থ হল এই কথাগুলিকে গঠনতন্ত্রের যে কোনও একটা ধারা হিসেবে গণ্য না করে এখনকার মুখ্য কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
ভেঙে বললে যা দাঁড়ায়: প্রথমত, জনগণের সেবা করতে হবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তা করতে হবে। এর অর্থ তাঁদের কেবল সভা-সমাবেশে সমবেত করা নয়, দৈনন্দিন জীবনে তাঁদের সমস্যাগুলির নিরসনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। শাস্ত্রে যেরকম বলা আছে উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে, শ্মশানে অর্থাৎ এককথায় মানুষের সুখে-দুঃখে সবসময় যে পাশে থাকে তাকেই বন্ধু বলে গণ্য করতে হবে। স্কুলে বা হাসপাতালে ভর্তি, রক্তদান, রেশন দোকান, একশো দিনের কাজ, ‘যুবশ্রী’, ‘কন্যাশ্রী’ ইত্যাদি ‘সুশ্রী-বিশ্রী’ যতরকম সমস্যা আসুক না কেন মানুষের সঙ্গে থেকেই কেবলমাত্র সেগুলির আংশিক সমাধানের মধ্য দিয়েই জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়। এছাড়া মনে রাখা দরকার পূর্বোক্ত শ্লোকের শুরু হচ্ছে ‘উৎসব’ শব্দটি দিয়ে। কেবল দুঃখ নয়, সুখেরও সাথী হতে হবে। কেবল পেটের ক্ষুধা নয়, মনের ক্ষুধাও মেটাতে হবে। তাই খেলাধূলা, সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড-সহ নানারকম জীবনমুখী সামাজিক অনুষ্ঠানে যুক্তিবাদ বিসর্জন না দিয়েই আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। 
দ্বিতীয়ত, এই কাজ ধারাবাহিকভাবে করতে হয়। বছরে দু-একবার যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে ‘জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধন দৃঢ় করে’ তোলা যায় না। 
তৃতীয়ত, ‘জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে’। কেউ কেউ মনে করেন আমরা কেবল জনগণকে শিক্ষা দিতে পারি। অবশ্যই মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম সংগঠনে গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এইসব বিষয় সম্পর্কে আমাদের শিক্ষা প্রয়োগ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রয়োগের অভিজ্ঞতায় শিক্ষা প্রতিদিন সমৃদ্ধ হয়। এবং সেই শিক্ষা জনগণের কাছ থেকেই অর্জন করতে হয়। তাঁদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি তাঁদের আশু সমস্যাগুলি কী? তা থেকে কোন কোন দাবি আংশিকভাবে হলেও আদায়ের সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়। সেই সংগ্রামগুলি পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ ও আমরা উভয়েই শিক্ষা গ্রহণ করি। ছোট ছোট এরকম অসংখ্য সংগ্রামগুলিকে মূল দাবি আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত না করতে পারলে এক পা-ও এগোন সম্ভব নয়।
চতুর্থত, এইসব সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জনগণের ‘মতামত ও দাবিদাওয়া সম্পর্কে পার্টিকে অবহিত করতে হবে’। প্লেনাম যাই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, তার সঠিকতা বিচার হয় প্রয়োগের অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে। সেই জন্য পার্টিকে সিদ্ধান্ত করে জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে হয় এবং সে সম্পর্কে প্রয়োগে তাঁদের মতামত ও অভিজ্ঞতা পার্টিকে অবহিত করতে হয়। পার্টির কাজ হল এই আদানপ্রদানের প্রক্রিয়ায় বোঝাপড়ায় কোনো ভুল থাকলে তাকে সংশোধন করা। এটা ঠিক না ওটা ঠিক তা নিয়ে কেবল অন্তহীন তাত্ত্বিক বিতর্কের আশ্রয় না নিয়ে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য জনগণের সঙ্গে অভিজ্ঞতার বিনিময়ই হল গণ-লাইনের মর্মবস্তু। 
পঞ্চমত, অব্যাহতি না দেওয়া হলে প্রত্যেককেই পার্টির পরিচালনাধীনে কোনও না কোন গণসংগঠনে কাজ করতে হবে। বলাবাহুল্য গণসংযোগ ও গণসংগ্রামগুলির মধ্য থেকেই গণসংগঠনগুলি গড়ে ওঠে ও শক্তিসঞ্চয় করে। এগুলিতে অংশগ্রহণ না করে কেউ পার্টি সদস্য হতে পারে না। পার্টি সদস্যরা পার্টির পরিচালনাধীনেই বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা ঐ সংগঠনের স্বাধীন গণতান্ত্রিক কর্মধারায় পার্টির তকমা লাগিয়ে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। গণ-লাইনের সঠিক প্রয়োগের মধ্য দিয়েই গণসংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। জনগণের আস্থা ছাড়া যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।

বিপ্লবী পার্টি সম্পর্কে
‘বিপ্লব’ কথাটি সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এটা নিছক সরকার পরিবর্তনের ব্যাপার নয়। সমাজবিপ্লবই হল পৃথিবীর ইতিহাসে একটা সমাজব্যবস্থা থেকে উন্নততর সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের চালিকাশক্তিভারতের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমাদের পার্টি ১৯৬৪সালে ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম স্তর হিসেবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। যা ২০০০সালে বিশ্ব ও জাতীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সময়োপযোগী করা হয়। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় এটা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ও বিপ্লব সমাধার জন্য বিপ্লবী পার্টি এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটা উপাদানে ঘাটতি থাকলে বিপ্লব সংগঠিত করা অসম্ভব। আমাদের দেশে শ্রেণী ও সামাজিক এই উভয়বিধ বৈষম্য থেকে মুক্ত একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই হল পার্টির লক্ষ্য। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ও অবৃহৎ জাতীয় পুঁজিপতি অংশকে জনগণতান্ত্রিক মোর্চায় সংগঠিত করার লক্ষ্যে রণনীতিগত লক্ষ্যে আপাত রণকৌশলগত লাইন হিসেবে একবিংশতিতম পার্টি কংগ্রেস এই শ্রেণীগুলিকে বাম ও গণতান্ত্রিক মোর্চায় সমবেত করার পাশাপাশি বামপন্থীসহ সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির ব্যপকতম মঞ্চে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে। এই কর্তব্য সম্পাদনের জন্য কলকাতা প্লেনাম একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে। একটা বিপ্লবী পার্টিতে নিষ্ক্রিয় ও অবাঞ্ছিত সদস্যদের কোন স্থান নেই। পার্টির বিপ্লবী চরিত্রের গুণগত মান পার্টির সংখ্যাগত বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ার পথে সব বাধাগুলি অতিক্রম করাই হল আসন্ন রাজ্য প্লেনামের অন্যতম মুখ্য আলোচ্য বিষয়। পার্টি সদস্য ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের শ্রেণীগত সামাজিক বিন্যাস ও গড় বয়স পরিবর্তনের জন্য গণসংগ্রামের ময়দান থেকে বর্তমান পরিস্থিতির চাহিদা পূরণের উপযোগী অগ্রগামী অংশকে অন্তর্ভুক্তির ওপরে অগ্রাধিকার আরোপ করবে। গ্রাম ও শহরের শ্রমজীবী অংশ, মহিলা আদিবাসী, তপসিলী, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অনগ্রসর অংশের জনগণের মধ্য থেকে তরুণতর কর্মীদের নিয়ে আসা, মতাদর্শগত শিক্ষায় সমৃদ্ধ করা, রাজনৈতিক সাংগঠনিক নেতৃত্বদানে উপযোগী করে গড়ে তোলাই হল আমাদের সামনে প্রধান কাজ।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রকৃত অর্থে শেষপর্যন্ত জনগণই ইতিহাস রচনা করেনদলত্যাগী আত্মসমর্পণকারীরা ইতিহাস গড়ে না, তাদের স্থান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে যে ২কোটি ১৫লক্ষ মানুষ জীবন-জীবিকার ওপর সবরকম আক্রমণের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে তৃণমূল ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন তাঁদের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন অংশকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে সমবেত করার ব্যপক সম্ভাবনা রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই নিহিত আছে। রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের জন্য সর্বব্যাপক গণসংগ্রাম গড়ে তোলার উপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে রাজ্যে সাংগঠনিক প্লেনামকে নতুন প্রত্যয়সিদ্ধ শপথ গ্রহণের মঞ্চ হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হব —এই আত্মবিশ্বাস আমাদের আছে।
******

গণশক্তি, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে আমাদের পার্টিই

ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র

গত এক বছরের মধ্যে দুনিয়া, দেশ ও রাজ্যের পরিস্থিতিতে অনেক নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একটা সাধারণ ও অতি বিপজ্জনক প্রবণতা হলো এই তিন ক্ষেত্রেই দক্ষিণপন্থার উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কটের আট বছর পরেও সেই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের মহামন্দা থেকে এবারের মন্দা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সেই মন্দা পরিস্থিতি চার বছর ধরে চলেছিল। এবার আট বছর পরেও সেই লক্ষ্মণ তো দেখাই যাচ্ছে না, উলটে আবার নতুন করে আরেকটা মন্দার সম্ভাবনাই প্রবলতর হচ্ছে। খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ (আমাদের দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো) সহ সভাপতি স্ট্যানলি ফিসার সেখানকার অর্থনীতির হার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ১৯৭৯ সালের পরে অর্থনীতিতে এটাই সবচেয়ে খারাপ সময়। গত তিন মাসেই উৎপাদনের সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড দেখা যাচ্ছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ২০০৫ সালের তুলনায় ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের সময়কালে উৎপাদনশীলতার হার ১.২৫ শতাংশ কমেছে। তাঁর মতে, যদি এমন চলতে থাকে তাহলে কর্মসংস্থান এবং প্রকৃত মজুরির ওপরে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ কমছে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের গতি শ্লথ হয়েছে, সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই ঋণের বোঝা বিপুল পরিমানে বাড়ছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সিলার মনে করেন, বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁরা আস্থা হারাচ্ছেন। কারণ ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন, সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপট।

আসলে সিলার যা বলেননি তা হলো, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের মদতে। আর অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যা তার থেকেই। আবার তার বিরুদ্ধেই পালটা মাথা চাড়া দিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বর্গরাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে জাতীয় পুঁজি আস্ফালন দেখাচ্ছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট। তাই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেটা আবার মাথা তুলতে শুরু করেছে।

অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে মহামন্দার পরে যেরকম আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী বা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, এখনও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাবে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সালের সময়কালের তুলনায় বিশ্বের মোট উৎপাদন (ওয়ার্ল্ড জি ডি পি) বৃদ্ধির হার ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। এর পাশাপাশি দুনিয়াজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী, নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির বৃদ্ধি ঘটছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যত কমছে দুনিয়াজুড়ে এদের দাপাদাপি তত বাড়ছে। দুবছর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে এক চতুর্থাংশই ছিল এইসব নিও ফ্যাসিস্ত বা চরম দক্ষিণপন্থী শিবিরের। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই প্রথম ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন উগ্র জাতীয়তাবাদীর কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এমনকি বলিভিয়ায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের দাপাদাপি দেখা যাচ্ছে গত একবছর ধরে। আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে উত্তরে, তুরস্ক থেকে ভারতে সর্বত্র দক্ষিণপন্থীদের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে।

********
আমাদের দেশে দ্বিতীয় এন ডি এ সরকারের দুবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে এই সরকার বাজপেয়ী আদবানীদের প্রথম এন ডি এ সরকারের থেকে অনেক বেশি দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্র হিন্দুত্ববাদী, সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা, একনায়কতন্ত্রী। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীসুলভ উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি সংঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ এই সরকারের ওপরে অনেক বেশি। বি জে পি এককভাবেই এবার লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিপদ এখন অনেক বেশি।

বলা হচ্ছে, এবছর নাকি ভারত বৃদ্ধির হারে সারা বিশ্বে প্রথম স্থানে থাকবে। অথচ আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো, বৃদ্ধি বলতে মূল্যবৃদ্ধি, বৃদ্ধি বেকারীর, শিল্পে মন্দার, কৃষিতে সঙ্কটের। সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী, মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ধনী গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন বৈদেশিক নীতি ও অখণ্ডতার সামনে বিপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বিপন্ন করে এককেন্দ্রীকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জটিলতা কেমন বাড়ছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো কাশ্মীর। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কাশ্মীর সমস্যা এত জটিল আগে কখনো হয়নি। ভারত ও ভারতবাসীর সুরক্ষার চাইতে তথাকথিত গোরক্ষাই গেরুয়াবাহিনীর এখনকার প্রধান কর্তব্য। নাথুরাম গডসের অনুগামীরা এখন দেশপ্রেমিক সেজেছে। ইতিহাস, পাঠ্যসূচী বিকৃত করা হচ্ছে। হিন্দি, হিন্দুত্ব ও হিন্দিস্তানের স্টিমরোলার দিয়ে এরা বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চা, যুক্তিবাদ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কাঠামোটাকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এক কথায় স্বাধীনতার পরে দেশজুড়ে সমস্ত ক্ষেত্রব্যাপী সঙ্কটের বৃদ্ধি দেশকে এক ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

********
আমাদের রাজ্যে তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয়বারের মেয়াদ চলছে। দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার শুরু থেকেই আরও উগ্র ফ্যাসিবাদী কায়দায় চলছে। বছর শেষ হওয়ার আগেই রাজ্যকে বিরোধীশূণ্য করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে শাসকদল। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ, জীবনজীবিকার ওপরে আক্রমণ এসবই এরাজ্যে তীব্রতর হচ্ছে। একদিকে বি জে পি চায় কংগ্রেসমুক্ত ভারতআর এখানে তৃণমূল চায় বিরোধীশূণ্য পশ্চিমবঙ্গ। আসলে উভয়েরই মূল লক্ষ্য বামপন্থীরা। পশ্চিমবঙ্গ এখনো বামপন্থীদের সবথেকে বড় ভিত্তি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার বিচারেও দেশের বাকি অংশে বামপন্থীদের যা ভোট তার যোগফলের তুলনায় এরাজ্যের বামফ্রন্টের ভোট বেশি। এরাজ্যে সি পি আই (এম)-ই বামপন্থীদের প্রধান শক্তি, তাই স্বাভাবিক কারণে তাদের ওপরেই আক্রমণ নেমে এসেছে সর্বাপেক্ষা তীব্রভাবে। বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শক্তি দুর্বল হলে সারা দেশে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দুর্বল হবে। তাই সাম্রাজ্যবাদ, কেন্দ্র এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসকদল বামপন্থীদের ওপরে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করার প্রশ্নে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির আক্রমণ ও উদারনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বামপন্থীরাই প্রথম সারিতে রয়েছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে বামপন্থীরা শুধু সামনের সারিতেই আছে তাই নয়, মতাদর্শগত বিচারে এই লড়াইয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন জীবিকার সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই সমস্ত প্রশ্নেই এরাজ্যে বামপন্থীদের সংগ্রাম কেবলমাত্র এরাজ্যের মানুষের স্বার্থরক্ষার মধ্যেই সীমিত নেই, তার চেয়েও বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারিত। সমগ্র ভারতীয় জনগণের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ক্ষমতা এর ওপরে নির্ভরশীল। এর বিপরীতে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদসহ দেশ ও রাজ্যের শাসকদলের স্বার্থ। এই দুই স্বার্থের সংঘাতের কেন্দ্র বিন্দু হলো আজকের পশ্চিমবঙ্গ।

দুনিয়া দেশ ও রাজ্যে দ্রুততার সাথে দক্ষিণপন্থা যে আগ্রাসী ভূমিকায় অগ্রসর হচ্ছে তাতে কেবল বামপন্থীদের পক্ষে এককভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব একথা মনে করা সংকীর্ণতাবাদ ও হঠকারিতার শামিল হবে। আবার ব্যাপক মঞ্চ গঠনের নামে বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্পের জন্য পার্টির স্বাধীন উদ্যোগ গ্রহণের কাজ অবহেলা করা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়। রাজ্য ও দেশব্যাপী সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে ব্যাপকতম প্রতিরোধের মঞ্চে সমবেত করেই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। বামপন্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রাম ও সংগঠনকে শক্তিশালী না করে এই মঞ্চ গড়ে তোলা অসম্ভব। এসব প্রশ্নে কেবল কৌশল নিয়ে বিতর্কে অযথা সময় অপচয় না করে ময়দানে নেমে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে লাইনের সঠিকতা যাচাই করাই হলো একমাত্র পথ। সেই জন্য আমাদের পার্টির রাজ্য কমিটি আহবান জানিয়েছেপ্রথমত, সি পি আই (এম)-র নিজস্ব উদ্যোগে শ্রেণি সংগ্রাম ও গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্টের সম্মিলিত সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বামফ্রন্ট বহির্ভুত বামপন্থী ও বাম সহযোগী দলগুলিকে নিয়ে যুক্ত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এবং চতুর্থত, রাজ্যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণ মোকাবিলায় কংগ্রেস ও সব বাম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে নিয়ে ব্যপকতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রাজ্যের আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান ইস্যুগুলি চিহ্নিত করা দরকার। প্রথমত, গণতন্ত্রের ওপরে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ২১১টা আসনে জয়লাভ করেও পুলিশ, প্রশাসন, অর্থবল, পেশীবলের এমন ব্যাপক ব্যবহার করে বিরোধীদের বিধায়ক পদ, পঞ্চায়েত, পৌরসভা দখলের দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গ আগে কখনো দেখেনি। শাসকদল ঘোষণা করে দিয়েছে, এই বছরের মধ্যেই সি পি আই (এম) এবং কংগ্রেসমুক্ত করা হবে পশ্চিমবঙ্গকে। বামপন্থীদের মতাদর্শ, সংগ্রাম ও সংগঠনের দুর্বলতাকে অস্বীকার না করেও একথা বলা যায় যে আসলে এটা শাসকদলেরই দুর্বলতা ও ভীতির প্রতিফলন। ২১১টা আসনে জিতেও আত্মবিশ্বাসের এত অভাব! এর প্রধান কারণ হলো, মানুষের ওপরে আস্থার অভাব। মুখ্যমন্ত্রী মানুষকে ভয় পাচ্ছেন, কারণ তিনি জানেন যে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের ভিত্তিতে তাঁর এই জয় আসেনি। ২কোটি ১৫লক্ষ মানুষ যে তৃণমূল ও বি জে পি-র বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন সেটাই তাঁর মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতাংশের হারের বিচারে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৫শতাংশের কিছু বেশি, আর সংখ্যার বিচারে ৩০লক্ষের মতো বেশি। কোনো সন্দেহ নেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ করে গড়ে ওঠা বিরোধী জোট নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি ছিল, তার সঙ্গে ছিল অপরপক্ষের ভোট লুটের কৌশল। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বুথ বেছে নিয়ে বিপুল অর্থ ও পেশীবল ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট লুটের নিখুঁত পরিকল্পনা সত্ত্বেও বিরোধীদের সঙ্গে মাত্র ৩০লক্ষের ব্যবধান মুখ্যমন্ত্রীর ভয়ের প্রধান কারণ। তিনি বিলক্ষণ বোঝেন, শতকরা ৩ভাগ ভোট এদিক ওদিক হলে ফলাফলটাও বিপরীত হয়ে যেতে পারতো। বি জে পি-র সঙ্গে গোপন বোঝাপড়াটাও চিরকাল যে গোপন থাকবে না সেই আশঙ্কাও তাঁর রয়েছে। সর্বোপরি কৃষকের আত্মহত্যা, শ্রমিকের অনাহারে মৃত্যু, কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিল্পের মড়ক, টেট-এস এস সি-পি এস সি কেলেঙ্কারি, সারদানারদা কেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেট আর তোলাবাজি, দুর্দমনীয় দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্যে নারী শিশু-সহ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, এমনকি শাসকদলের অনুগামীদের মধ্যেও গোষ্ঠী সংঘর্ষ বৃদ্ধি-সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। রাজ্যের ঋণের বোঝা পূর্বাপেক্ষা অনেক দ্রুতহারে বাড়ছে। ২টাকা কেজি দরের চালের পরিমাণ ও গুণমানে অবনতি ঘটছে। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দেওয়া অঢেল প্রতিশ্রুতির বন্যাই এখন তাঁর রাজত্বকে ভাসিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। নির্মাণকারী ঠিকাদারদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার পরে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, কিষাণ মান্ডির কাঠামোগুলি এখন ভগ্নস্তুপের মতো পড়ে রয়েছে। কিছু ঠিকাদার আবার তোলা দিয়েছেন, কিন্তু প্রাপ্য টাকার সবটা পাননি। ৫বছরের উন্নয়নের কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে পড়ছে। সিঙ্গুরে বিজয়োৎসব আসলে মুখ্যমন্ত্রীর নার্ভাস প্রতিক্রিয়া। নির্বাচনের জয় যে জনগণের মধ্যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের রূপ নিতে পারেনি সেটাই তাঁর নার্ভাস হয়ে পড়ার প্রধান কারণতাই বেপরোয়া আক্রমণ। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, নির্বাচিত বিধায়কদের কিংবা পঞ্চায়েত পৌরসভা যেনতেন প্রকারে দখল করলেও মানুষের মনের দখল তিনি নিতে পারবেন না। নির্বাচনের আগেই মানুষের মধ্যে যে মোহমুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা কিছুদিনের মধ্যে আরো তীব্র হতে বাধ্য।

রাজ্যে বি জে পি-র হাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জরাজীর্ণ। কেন্দ্রের হাত এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় রয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রের নীতিগুলির বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে। ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটই তার প্রমাণ। কিন্তু আর এস এস-এর ফ্যাসিস্তসুলভ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের প্রসার বা বৃদ্ধিকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। জনবিচ্ছিন্নতার বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য কেন্দ্রের শাসকদলের প্রধান হাতিয়ার এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি। সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও এটা গুরুতর বিপদ। আর এস এস-এর এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিপরীতের সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও জমি জোগাতে সাহায্য করছে। সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের এই বিপদও অনেক বেশি। কিন্তু এটা বোঝা দরকার তৃণমূলকে পরাস্ত না করে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষা করা অসম্ভব। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের এই সুবিধাবাদী অবস্থানই উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত ডেকে এনেছে।

********
বামপন্থীদের সামনে রাজ্যে আন্দোলন সংগ্রামের ইস্যু অনেক। কিন্তু এগুলিকে নিয়ে যে ব্যাপক ভিত্তিক গণসংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব তা করা যায়নি। এর কারণগুলি চিহ্নিত করে পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে। এখানে প্রধান দুটি দুর্বলতার উল্লেখ করা হচ্ছে।

প্রথমত, স্থানীয় আশু আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত পৌরসভা গ্রাম শহর কলকারখানা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলায় আমাদের উদ্যোগ অপর্যাপ্ত। বিশেষত কেবল সরকার বিরোধিতা নয়, সরকারী প্রকল্পগুলির রূপায়ণে ঘোষণা ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক, দুর্নীতি, দলবাজি, ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি পার্টি ও গণফ্রন্টের মাধ্যমে রক্তদান, সাক্ষরতা, কোচিং, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষিবিকাশ, সমবায়, শিশুকিশোর সংগঠন, ক্লাব, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমেলা, ইত্যাদি বহুমাত্রিক ইতিবাচক কর্মসূচী নিতে হবে। এসব না করে রাজ্যের দাবিগুলি নিয়ে বড় বড় কেন্দ্রীয় সমাবেশ সব সময় পরিস্থিতির চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এই সংগ্রামগুলিকে স্বতঃস্ফূর্ততার ওপরে ছেড়ে না দিয়ে তাকে সংগঠিত করা ও এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া এখন সব চাইতে জরুরী কাজ। শুরুতেই এলাকা ও আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা দরকার। অগ্রাধিকার ভিত্তিক পরিকল্পনা ছাড়া কিছু বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাতের শক্তি অর্জন করতে পারবে না। অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে শ্রমিক কৃষক খেতমজুরসহ এলাকার নানা রকমের মানুষের শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহিলা, সংখ্যালঘু, তফসিলি ও আদিবাসী মানুষের, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের বিশেষ করে পশ্চাদ্‌পদ অংশের দাবিগুলিকে নিয়ে সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে। সর্বত্রই অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মকে সামনের সারিতে নিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজ্যের জ্বলন্ত ইস্যুগুলি নিয়ে রাজ্য বা জেলাগত আন্দোলনের কর্মসূচী অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু তার পূর্বশর্ত হিসাবে স্থানীয়স্তরে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ দাবিগুলির ভিত্তিতে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয় না। অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চ থেকে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচীর ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায়শই এগুলি এত উপর্যুপরি বা একটার ওপরে একটা চেপে বসে যে ঠাসা কর্মসূচীর ভিড়ে স্থানীয় সংগ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সুনিশ্চিত করার বিষয়টি। কাজেই, রাজ্যভিত্তিক ও স্থানীয় মূলত এই দুই ধরনের সংগ্রামের মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য ও সমন্বয় বজায় রাখার দুর্বলতাগুলি দূর করতেই হবে। এর মধ্য দিয়েই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামে উন্নীত করতে হবে।

স্বতঃস্ফূর্ততার ওপরে নির্ভর না করে সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে তোলার অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে সংগঠন। সাংগঠনিক দুর্বলতাই আমাদের প্রধান দুর্বলতা। এখানে সংগঠন বলতে মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠনের বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি সংগঠনের কথাই বলা হচ্ছে, যা এই চার ফ্রন্টেই সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠন সংক্রান্ত প্লেনাম সেরকম একটি গণলাইন নির্ভর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছে। রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশগুলি কার্যকরী করার জন্য রাজ্যের সংগঠন সংক্রান্ত প্লেনাম হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনামের মূল আহবান ছিল পার্টির দৈনন্দিন কাজে রুটিন সর্বস্ব গতানুগতিকতা বর্জন করে নিরন্তর ও নিবিড় গণসংযোগ গড়ে তোলা। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাঁদের কাছে মতাদর্শ, রাজনীতি ও সংগ্রামের কথা নিয়ে যেতে হবে। আবার তাঁদের কাছ থেকে এসব বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে। এগুলির পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমাদের চার রকমের সংগ্রামেরই পরীক্ষা করতে হবে প্রয়োগের মাপকাঠিতে। এরমাধ্যমে আমাদের ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে হবে, সংশোধন করতে হবে এবং সংশোধন করে তা নিয়ে ফের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের মধ্যে এই নিরন্তর যাওয়া আসা দেওয়া নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সংগঠন অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত ও শক্তিশালী হতে পারে। ত্রুটি সংশোধনের লক্ষ্যে পার্টির বিপ্লবী চরিত্রের অবক্ষয়গুলি চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন ৩৪বছরে একটা অনুকূল পরিস্থিতিতে সংগঠনের যে প্রসার ঘটেছিল বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তা সংহত করা পার্টির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমাদের কাজের মুখ্য অভিমুখ হতে হবে পরিস্থিতির উপযোগী নতুন কাজের ধারা আয়ত্ব করা, সংগ্রাম সংগঠনের পুণর্বিন্যাস করা, নিষ্ক্রিয় সদস্যদের চাপ থেকে সংগঠনকে মুক্ত করে শ্রেণি সামাজিক ও বয়সের গঠনের পরিবর্তনের জন্য নতুন নতুন অংশকে সংগঠনে নিয়ে আসা, কমিটিগুলির সংখ্যা ও স্তরের বাহুল্য কমিয়ে এবং একই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ নিষ্ফলা আলোচনা কমিয়ে কমিটিগুলিকে দ্রুত কর্মসম্পাদনের উপযোগী করে তোলা। অগ্রাধিকার এলাকা ও ফ্রন্ট চিহ্নিত করে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কাজের উদ্যোগ নিতে হবে। ত্রুটি সংশোধন অভিযান উপর থেকে শুরু করতে হবে। সমস্ত ক্ষেত্রেই নেতৃত্বকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন, এই চার ফ্রন্টের সংগ্রাম তিন স্তরেই পরিচালনা করতে হবে। পার্টির বাইরে, পার্টির মধ্যে এবং আমাদের প্রত্যেকের নিজের মধ্যে। পার্টির বাইরে চার ফ্রন্টের সংগ্রামগুলি পার্টির আভ্যন্তরীণ সংগ্রামে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। বাইরের সংগ্রাম যত তীব্র হবে পার্টির ভিতরে সংগ্রামও ততই তীব্র হবে। এই সংগ্রামগুলি আবার পার্টির প্রত্যেকটি পার্টিকর্মীর নিজেকে পরিবর্তন করার সংগ্রামে প্রতিফলিত হবে। এতে কেউ কেউ ভয় পেয়ে যান, শত্রুর কাছে আত্মসমর্পন করেন, সম্পদ, পদ ও নিরাপদ জীবনযাপনের হাতছানিতে প্রলুব্ধ হন। এভাবে তাঁদের পদস্খলন ঘটে। অপরদিকে কেউ কেউ ধৈর্য হারিয়ে অতিবিপ্লবী বাস্তবজ্ঞান বিবর্জিত মনগড়া ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে এমন ধরনের সংগ্রাম শুরু করেন যা কার্যত প্রতিবিপ্লবী শক্তির সুবিধা করে দেয়। আবার মধ্যপন্থার নামে কেউ কেউ এই উভয় রকম বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বদলে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন, পার্টিতে নীতি বিবর্জিত ঐক্য স্থাপনের নিষ্ফলা চেষ্টায় অযথা কালক্ষেপন করেন। শেষোক্ত ঝোঁকটি সবার কাছে ভালো সাজার উদারবাদী ঝোঁক। পার্টির ভিতরের সংগ্রাম নীতি নিয়ে, ব্যক্তি নিয়ে নয়। নীতি স্থির না করে কোনো ব্যক্তিকে সংশোধন করা সম্ভব নয়। পার্টির রণনীতির প্রশ্নে সংগ্রামে আপোষ করা চলে না। কিন্তু দৈনন্দিন কৌশল ও নিছক কাজের প্রশ্নে আপোষহীন সংগ্রাম চলে না। নিজেকে পরিবর্তন করার সংগ্রাম নিজেকেই করতে হয়। কিন্তু কেবল এককভাবে নিজেকে সংশোধন করা যায় না। তার জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগ চাই। কমরেডসুলভ মনোভাব নিয়েই ধৈর্যের সাথে এই কাজ করা সহকর্মীদের দায়িত্ব। বিচ্যুতির প্রাথমিক লক্ষ্মণগুলি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তা সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। পার্টির আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও নিজেকে পরিবর্তনের সংগ্রাম পরিচালনা সম্পর্কে লিও শাও চি আভ্যন্তরীণ সংগ্রামকী করে সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে হবেলিখে গিয়েছেন। আমাদের রাজ্যে আটের দশকের শুরুতেই তা প্রকাশিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রুটি সংশোধন অভিযানের প্রথম দলিল প্রকাশিত হওয়ার বেশ কিছু আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এই সম্পর্কে যে নির্দেশ দিয়েছিল তার মধ্যেও লিও শাও চি-র পুস্তিকাটি পড়তে বলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির এই সংক্রান্ত সর্বশেষ দলিলটি সময়োপযোগী করা হয়েছে, এটাও অবশ্যপাঠ্য বলে বিচার করতে হবে। অবশ্যই এই পাঠ বা চর্চার প্রধান লক্ষ্য হবে পার্টি ও নিজের জীবনে তা নির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করতে পারা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের এবং কেবল আমাদের পার্টিই পারে এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে।

গণশক্তি, শারদ সংখ্যা ২০১৬