20200719

রাষ্ট্রনায়ক জ্যোতি বসু



রবীন দেব



জীবিত অবস্থাতেই জ্যোতি বসু ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন কিংবদন্তী (Living Legend) নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। শুধু বামপন্থী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনেই না, ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অর্ধশতবর্ষব্যাপী কাজ করার সুবাদে দেশের  ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো  ও যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের বিকাশে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তা জ্যোতি বসুকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছিল। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর আগেও বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এবং জীবনাবসানের পরেও দেশ-বিদেশের রাজনীতিক-বিশ্লেষকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে তাঁর এই ভূমিকার কথা। এই রকম একজন অসাধারণ কমিউনিস্ট নেতার জন্মশতবর্ষে তাঁর এই অবদানগুলি আলোচনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের শিক্ষিত করতে সাহায্য করবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একজন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েও সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তপ্ত প্রবাহে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন জ্যোতি বসু। বিলেতেই হাতেখড়ি কমিউনিজমের প্রথম পাঠের, সেখানেই সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হবেন। দেশে এসেই যোগ দিলেন পার্টির কাজে, শ্রমিকদের সংগঠিত করার যে কাজ তিনি শুরু করলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার থেকে কখনো বিযুক্ত হননি। জীবনের শেষ বছরগুলিতেও তিনি সি আই টি ইউ-র একজন নেতা হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠেছিল মতাদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, অসমসাহসী মনোভাব।

অসম্ভব পরিশ্রম করে ব্রিটিশ আমলে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার দুরূহ কাজে সাফল্য তাঁকে অল্পদিনের মধ্যেই নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। জ্যোতি বসু হয়ে উঠেছিলেন রেল শ্রমিকদের জনপ্রিয় নেতা। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন আসন্ন হলে কমিউনিস্ট পার্টি রেল শ্রমিক কেন্দ্রে সেই সময় নামজাদা কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে তাঁকে পার্টির প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে জ্যোতি বসু এই কেন্দ্রে জয়ী হন। সংসদীয় রাজনীতিতে সেই থেকে শুরু - মাঝখানে বাহাত্তরের জালিয়াতি নির্বাচনের পাঁচ বছর বাদ দিলে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা ৫০ বছর ধরে মানুষের রায়ে নির্বাচিত হওয়ার অনন্য নজির তিনি গড়েছেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন থেকে ২০০০সালের ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত লাগাতার ৮৫৪০দিন ধরে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার বিরলতম নজিরও তিনি গোটা দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে, ক্ষমতায় যেনতেন প্রকারেণ টিঁকে থাকার জন্য ভারতের রাজনীতিতে যখন আত্মসর্বস্বতার নিকৃষ্ট উদাহরণ আকছার মিলছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিয়ে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে আত্মত্যাগের নজিরবিহীন উপমা তুলে ধরেছেন জ্যোতি বসু।

ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে শ্রমজীবী মানুষের কন্ঠস্বর তুলে ধরার অনন্য পথিকৃৎ ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় এবং পরে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টির অপর দুই বিধায়ক কমরেড রতনলাল ব্রাহ্মণ ও কমরেড রূপনারায়ণ রায় (স্বাধীনতার পরে পূর্ব পাকিস্তানে)-এর সাথে কমরেড জ্যোতি বসু শ্রমিক-কৃষকসহ সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কথা মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাইরে মাঠে-ময়দানে জমি-ফসলের আন্দোলন এবং কলে-কারখানায় রুটি-রুজির আন্দোলনের সার্থক প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন আইনসভার অভ্যন্তরেস্বাধীনতার পর প্রথমে প্রফুল্ল ঘোষ এবং পরে বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভার বিরোধী দলের নেতা হিসাবে জ্যোতি বসু বিধানসভার বিভিন্ন বিতর্কে যে তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার যুক্তিসহ বক্তব্য পেশ করেছেন, বাইরের আন্দোলনেও তা সাহায্য করেছে কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তিকে প্রসারিত করতে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে দীর্ঘসময় থাকার কারণে জ্যোতি বসুকে কখনো বিরোধী দলের বিধায়ক, কখনো বিরোধী দলের নেতা, কখনো উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা শুধু তত্ত্বগতভাবেই নয়, বাস্তবেও তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরেছেন। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায়, সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করায় তিনি যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সেই সময়ের বিধানসভার অধিবেশনের কার্যবিবরণী দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন।

স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, তা রাজ্যে রাজ্যে এবং পরবর্তীতে গোটা দেশের ক্ষেত্রে খর্ব করতে কোয়ালিশন পলিটিকস্‌বা জোট রাজনীতির কৌশল প্রয়োগ করার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার পিছনে ছিল এই রাজনীতিই--ছিল কমিউনিস্টদের কৌশল। ১৯৬৭ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের ৮টি রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকার কায়েম হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালাতে কংগ্রেসবিরোধী দলগুলির মধ্যে সি পি ‌আই (এম)-ই প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। কেরালাতে সি পি আই (এম) নেতা কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ-ই মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সি পি ‌আই (এম) ৪৩টি আসন পেলেও যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে ৩২টি আসন পাওয়া বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখার্জিকেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৬৯ সালেও। সেবার সি পি ‌আই (এম) পেয়েছিল ৮০টি আসন। তা সত্ত্বেও জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে যুক্তফ্রন্টের কৌশল ও তার প্রয়োগ এবং সমস্ত সহযোগী দলকে একসাথে নিয়ে চলার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পরে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিকল্পের উদাহরণ তুলে ধরে অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলিকে একই মঞ্চে সমবেত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। সে আলোচনায় পরে আসছি।

১৯৬৭সালে প্রফুল্ল ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটেছিল। নেমে এসেছিল চরম আক্রমণ। রাজপথে এই আক্রমণের সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দান করেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৬৭ সালের ২রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিনে অজয় মুখার্জিকে সামনে রেখে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটাবার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিলে মিছিলে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনরোল তৈরি হয়। পিছু হটে ষড়যন্ত্রকারীরা, অক্টোবরে প্রফুল্ল ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে, পি. ডি. এফ-এর একটি সরকার গঠিত হয়। কিন্তু বিধানসভার তদানীন্তন স্পীকার বিজয় ব্যানার্জির ঐতিহাসিক রুলিং-এ সরকারের পতন ঘটে। জারি হয় রাষ্ট্রপতির শাসন।

প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন থেকে ১৯৬৯সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার কায়েম (যে নির্বাচন রাষ্ট্রপতি শাসনেই হয়েছিল) ১০৫ থেকে কংগ্রেসের আসন নেমে গিয়েছিল ৫৫-তেএই পর্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে রাজ্যের বুকে। ভাঙা-গড়া হয়েছে শরিকদলগুলিতে। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের সময়েও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, ১৯৬৯ সালের ৩১শে জুলাই বিধানসভা ভবনে উপমুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিসমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরে একদল উন্মত্ত পুলিসের হামলা। কিন্তু জ্যোতিবাবুর অসমসাহসী ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের সামনে সেই পুলিসের দল পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পরেও বাংলা কংগ্রেস ছাড়া বাকিদের নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ার সুযোগ থাকলেও কেন্দ্রের নির্দেশে জ্যোতি বসুকে সরকার গড়ার জন্য ডাকা হয়নি। ডাকেননি তৎকালীন রাজ্যপাল। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তখন যে বামদলগুলি অন্ধভাবে সি পি আই (এম) বিরোধিতায় নেমেছিল, তাদের জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সরকার গড়ায় সমর্থন জানাতে আকুল আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সাড়া দেয়নি কিছু বামদল।

এরই মাঝে উগ্রপন্থী রাজনীতির সুত্রপাত হয় এই রাজ্যে। উগ্রপন্থীদের ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে সঠিক মার্কসবাদী পথ গ্রহণে প্রয়াত কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত ও কমরেড জ্যোতি বসু পালন করেছেন দৃঢ় ভূমিকা।

দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর রাজ্যজুড়ে প্রচার আন্দোলনের ঝড় ওঠে। নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। খুন, সন্ত্রাস, বিনা বিচারে আটক, মিথ্যা মামলায় জড়ানো সহ স্বৈরাচারী কাজ চলে ব্যাপকভাবে। তারই মধ্যে পাটনায় ১৯৭০ সালে ৩১শে মার্চ জ্যোতি বসুকে লক্ষ্য করে আনন্দমার্গীরা গুলি চালায়। জীবনবীমা কর্মী কমরেড আলি ইমাম নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে জ্যোতি বসুর প্রাণ রক্ষা করেন। পাটনায় জ্যোতি বসুর উপর এই আক্রমণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রাজ্যজুড়ে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পালিত হয় ধর্মঘট। আমার এখনো মনে পড়ে সেই দিনটির কথা আগরপাড়ায় দেবেন সেন রোডে দাদার বাড়িতে সংবাদপত্র পড়ছিলাম। সংবাদ জানার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। ছাত্রকর্মী হিসাবে স্কুল ছাত্রদের নিয়ে সংগঠিত হয় বিশাল মিছিল। সামিল হন অগণিত মানুষ। পরের দিন শহীদ মিনারে বিশাল সমাবেশে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্ত হয় তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার।

ছাত্র-যুব আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে জ্যোতি বসুকে ১৯৬৫ সাল থেকে প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ে নানা সময়ে যেভাবে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি, তা এই প্রবন্ধে সবটা বিবৃত করা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে ২০শে ফেব্রুয়ারি হেমন্ত বসুকে হত্যা করে জ্যোতি বসুকে সেই বছরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেয়নি দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়ার শক্তি। সেবারও জ্যোতি বসু বরাহনগরে জয়ী হয়েছিলেন মহাজোট প্রার্থী অজয় মুখার্জিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেই। সি পি ‌আই (এম) নেতৃত্বাধীন ৬দলের জোট ১২৩টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও জ্যোতি বসুকে সরকার গড়তে ডাকেননি রাজ্যপাল। অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হয় এবং ৭১দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটে।

১৯৭২-এ সংসদীয় গণতন্ত্রকে কোতল করার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর লেখা ‘Subversion of Parliamentary Democracy’ নামে একটি পুস্তিকা দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ই জুন BBC থেকে এই মর্মে প্রচারিত হয় জ্যোতি বসুর বেতার ভাষণ।

১৯৭২থেকে ৭৭আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, জরুরী অবস্থার দিনগুলিতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে। বারুইপুরে কমরেড জ্যোতির্ময় বসুর সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিল জ্যোতি বসুর গাড়ী১৯৭৩ সালের ২৮শে মার্চ সিদো কানহু ডহরে বেকারী বিরোধী অবস্থানে অংশ নেন জ্যোতি বসু। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের ৩রা জুন শহীদ মিনারে সমাবেশ, ২৭শে জুলাই বাংলা বন্‌ধ, ১৫ই নভেম্বর আইন অমান্য, ১৭ই নভেম্বর বাংলা বন্‌ধ, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট, ৭ই মে বাংলা বন্‌ধ, রেলকর্মীদের ধর্মঘট, ১৯৭৫-এর ২০শে জুন বাংলা বন্‌ধ এবং ২৫শে জুন জরুরী অবস্থা জারির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সব সময়ই জ্যোতি বসু সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরই মধ্যে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী জোটে প্রফুল্লচন্দ্র সেনসহ অনেককে সামিল করা হয়েছে। ১৯৭৫-এর ২রা এপ্রিল সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ন কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সভা করতে এসেছিলেন, কিন্তু তখনকার কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখার্জিরা সেই সভা করতে দেননি। ভন্ডুল করে দেওয়া হয়। তখন তিনি এসেছিলেন কংগ্রেস (ও)-র ডাকে। পরে ১৯৭৫ সালের ৫ই জুন বামপন্থীদের ডাকে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে থেকে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী মহামিছিল সংগঠিত হয়েছিল, যেখানে জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে সংক্ষিপ্ত সভার সভাপতি ছিলেন ড. অশোক মিত্র। তিনিই মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯৭২ থেকে ৭৭, এই সময়ে বামপন্থীদের মধ্যে জোটে কয়েকবার ভাঙ্গাগড়া হয়েছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই বামফ্রন্ট তৈরি হয়েছে। প্রথমে ৬দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন সরকার গঠন করে। ১৯৮০ সালে সি পি আই যুক্ত হলো। পরে ৮দল এবং সর্বশেষে দশটি দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন জ্যোতি বসু। এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে এস পি, ডি এস পি প্রভৃতি দলগুলি। আজকের বামফ্রন্ট গড়ার প্রক্রিয়াতেও অনেক জটিলতার অবসান ঘটিয়েছেন জ্যোতি বসু। এইভাবে অজস্র ষড়যন্ত্র কুৎসা, অপবাদ, হুমকি, কারাবাস, মিথ্যা মামলা, সব কিছুকে ভেদ করেই জ্যোতি বসু ৮৫৪০দিন মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। ষড়যন্ত্র কুৎসা অপপ্রচারের জালকে যেমন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছেন, তেমনি উদ্দীপ্ত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ছাত্র-যুব-মহিলা আন্দোলনকে। পুষ্ট করেছেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে, আমাদের দেশের ও আমাদের রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বাস্তবানুগ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। প্রায় ২৪বছরের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে গণসংগঠনগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে কাজ করার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করছেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৮সালের বন্যা, বন্যা পরবর্তীতে উদ্ধার, ত্রাণ, পুণর্বাসন, পুনর্গঠনের কাজে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তি ও উগ্র বামপন্থীদের কাছ থেকে ছাত্র-যুবসহ শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে সঠিক দিশাদানে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছে জ্যোতি বসুর বক্তব্য, কর্মকাণ্ড, পরামর্শ প্রভৃতি।

এই রাজ্যে শিল্পস্থাপনে নতুন জোয়ার সৃষ্টিতে বহু বিতর্কের মধ্যেও সঠিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৮সালে হেমবতী নন্দন বহুগুণা সম্মতি দিলেও ১৯৮৪ সালের ৬ই জুলাই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার পেট্রোরসায়ন দপ্তরের মন্ত্রী পি শিবশংকর এই রাজ্যে পেট্রোকেমিক্যাল হবে নাএই ঘোষণা করলেন। পরবর্তীতে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জ্যোতি বসুর সরকার-তা নিয়েও বহু বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করেছি যুব তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মাদনা। ১৯৮৫ সালের ১৪-১৯শে সেপ্টেম্বর সল্টলেক থেকে হলদিয়া পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, ১৯শে সেপ্টেম্বর হলদিয়ায় পদযাত্রীদের উদ্দেশ্যে জ্যোতি বসুর দৃপ্ত ঘোষণা হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ হবেই১৯৮৯সালের ১৫ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জ্যোতি বসুকে সঙ্গে নিয়ে হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। যদিও পরে শোনা যায়-৩দিন পর নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে যোজনা পর্ষদের অনুমোদন না নিয়েই নির্বাচনী চমক সৃষ্টিতে তিনি এই কাজ করেছিলেন। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস্‌, বক্রেশ্বরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি দাবিতে ছাত্র-যুবদের উত্তাল আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন জ্যোতি বসু। ২০০০সালের ২রা এপ্রিল হলদিয়া পেট্রোকেমিক‌্যালস্‌ জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত করেছিলেন জ্যোতি বসু।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্যে সীমিত আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিকল্প কী কর্মসূচী নেওয়া সম্ভব হতে পারে তা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে হাতেকলমে সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছিল। দেশে জোট রাজনীতির যুগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর ধরে চলা ৯ দলের একটি দৃঢ় জোট হিসাবে বামফ্রন্ট সরকার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরেছিল। কারণ জোট সরকার মানেই যখন অস্থিতিশীল, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বলে প্রমাণ হচ্ছিলো, তখন এরাজ্যে এই জোট স্থিতিশীল, শান্তির পরিবেশ এবং জনমুখী উন্নয়নের নজির তৈরি করে গোটা দেশের সামনে একটি উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম তুলে ধরেছিল। একথা আজ সকলেরই জানা যে এরাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে অনুকরণ করেই গোটা দেশে তা রূপায়ণের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে। ভূমি সংস্কার, কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে। পাশাপাশি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, শান্তি-সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় ক্ষেত্রেও দেশের সামনে জ্যোতি বসুর পশ্চিমবাংলা উদাহরণ তৈরি করেছিল। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূলস্তরে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের সামনে মডেল হিসাবে স্বীকৃত।

শুধু জোট রাজনীতির প্রশ্নই নয়, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও সামনে তুলে এনেছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারই। রাজ্যগুলির হাতে আরো বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দাবিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের ইস্যুকে সামনে রেখে গোটা দেশে অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলি এবং বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসবিরোধী দলের দ্বারা পরিচালিত সরকারগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। শ্রীনগর, কলকাতা ও বিজয়ওয়াড়ায় বিরোধী দলগুলির কনক্লেভের নেতৃত্ব দেন তিনিই। কংগ্রেসের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙার লক্ষ্যে কোয়ালিশন রাজনীতির সূচনা এভাবেই তাঁর নেতৃত্বে ভারতে শুরু হয়েছিল। একটি রাজ্যের সফল ও জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনো প্রাদেশিকতার গন্ডির মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ না থাকায় জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা ও নেতৃত্বের আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের অখন্ডতা, সংসদীয় গণতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাঁর ঋজু ও দৃঢ় অবস্থান সমগ্র ভারতেই দল-মত-নির্বিশেষে উচ্চপ্রশংসিত হতো। ১৯৮৭ সালের ২৫শে এপ্রিল দিল্লির অন্ধ্র হলে বিরোধী দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে জ্যোতি বসু যে অসাধারণ বক্তব্য রেখেছিলেন, তার পরদিন তাঁর কট্টর সমালোচক আনন্দবাজার পত্রিকাও লিখতে বাধ্য হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রনায়কের মত বক্তব্য করেছেন জ্যোতি বসু।১৯৮৯ সালে ভি পি সিং-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকার গড়ারও অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। এই সময়েই ভারতে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেলসন ম‌্যান্ডেলা। ১৯৯০ সালের ১৮ই অক্টোবর ইডেন উদ‌্যানে বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং-এর উপস্থিতিতে জ্যোতি বসু সংবর্ধনা জানান ম‌্যান্ডেলাকে। এই সমাবেশ শেষেই ভি পি সিং এবং জ্যোতি বসু দিল্লিতে গিয়ে যৌথভাবে রথযাত্রার নামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি বন্ধ করতে আবেদন জানিয়েছিলেন বি জে পি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিকে। এই বছরেই ১৯শে মে কমরেড হো চি মিন-এর জন্মশতবর্ষে ভিয়েতনাম সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন জ্যোতি বসু। সঙ্গে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

জাতীয় রাজনীতিতে অকংগ্রেসী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর নেতৃত্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে রাজী হয়েছিল। এইচ ডি দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে সংযুক্ত মোর্চার সরকার গঠিত হলে গঙ্গার জলবন্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি করার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ-এর মধ্যে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

২০০০ সালের ৬ই নভেম্বর জ্যোতি বসু শারীরিক কারণে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। অবসর নিলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আমাদের রাজ্য এবং গোটা দেশের গণ-আন্দোলনে অন্যতম পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘কমিউনিস্টদের কাছে কোনো অবসর নেই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত‌্যাগ করা পর্যন্ত তাদের মানুষের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে।

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউ পি এ সরকার গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি এবং সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক হরকিষাণ সিং সুরজিৎ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেকথা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ইউ পি এ চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী বারেবারে স্বীকার করেছেন।  

২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারি জ্যোতি বসু শেষ নিঃশ্বাস ত‌্যাগ করেন। ২০১০র ১৯শে জানুয়ারি এক কমিউনিস্ট নেতার মরদেহ রাষ্ট্রীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রী, বিদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রনেতাদের ও তাঁদের প্রতিনিধিদের উপস্থি‍‌তিতে এক জনজোয়ারে শেষ বিদায় জানানো হয় কমরেড জ্যোতি বসুকে। সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় রেড রোড হয়ে উঠেছিল প্রকৃতই রেড রোড। জীবনাবসানের সময় সরকারী পদাধিকারী না হয়েও তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান দিয়ে গান-স্যালুটে শেষ বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এরপরেও কী তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক বলা যাবে না?

জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের পর তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা ও শোক জানাতে গিয়ে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতারা রাষ্ট্রনায়কহিসাবে তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন। দিল্লিতে বিদেশী অতিথি আসায় কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কলকাতায় আসতে পারেননি। কিন্তু প্রয়াত জ্যোতি বসুর শেষযাত্রার আগেরদিন দিল্লিতে সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় দপ্তরে গিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শোকপুস্তিকায় লিখে এসেছিলেন : ‘‘দেশ তার এক মহান সন্তানকে হারালো, যিনি ছিলেন এক মহান রাষ্ট্রনেতা ও মহান দেশপ্রেমিক। আমি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের এবং তাঁর অগণিত গুণগ্রাহীদের, কমরেডদের ও অনুগামীদের আমার গভীর শোকজ্ঞাপন করছি।’’ কলকাতায় এসেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া, ইন্দ্রকুমার গুজরাল, প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানিসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। ইউ পি এ-র চেয়ারপারসন ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও এসেছিলেন প্রয়াত জ্যোতি বসুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। বিশেষ বিমানে কলকাতায় পৌঁছে সোজা বিধানসভা ভবনে গিয়ে সেখানে শায়িত প্রবীণ জননেতার মরদেহে মালা দিয়ে শোকপুস্তিকায় তিনি লেখেন : ‘‘কংগ্রেস দল ও আমার নিজের পক্ষ থেকে কমরেড বসুর প্রতি আমি গভীর শোক জানাই। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী, দৃঢ়চেতা, দূরদৃষ্টি ও বাস্তববোধসম্পন্ন নেতা। তিনি দেশ, নিজের দল ও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর অভাব আমরা সকলেই অনুভব করবো।’’

শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ বিমানে কলকাতায় এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জ্যোতি বসুকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম অগ্রণী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বহিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর মৃত্যু শুধু ভারতের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিরাট ক্ষতি। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক।গভীর কৃতজ্ঞতায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা স্মরণ করেছিলেন, ‘১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়বসুর বিপুল সমর্থনেরকথা। সেইসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা ও উদ্যোগ শক্তিশালী করেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে।  প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে বিশেষ বিমানে একই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদও। ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ সেদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের ইতিহাসেও নজিরবিহীন ঘটনা।

কমরেড জ্যোতি বসু মানে জীবন্ত ইতিহাস। কমরেড জ্যোতি বসু মানে শুধু ভারতের নয়, এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা।এভাবেই প্রয়াত কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন শোক প্রকাশ করেছিলেন নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল। মাধব কুমার নেপাল বলেছিলেন, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাত দশকের ওপর রাজনৈতিক জীবন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আর আমাদের নেপালী জনগণের কাছে কমরেড জ্যোতি বসু প্রিয়তম, মহান বন্ধু।কলকাতায় চীনের কনসাল জেনারেল মাও সিওয়েই এক শোকবার্তায় বলেন, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ও চীনের মহান বন্ধু জ্যোতি বসুর জীবনাবসানে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।

কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে মানুষই ছিল শেষ কথা, জনগণই ছিল তাঁর শক্তির উৎস। তাঁর সত্তর বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম-আন্দোলন-ধর্মঘটে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কেবল যখন বিরোধীপক্ষের বিধায়ক বা বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তখনই নয়, যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী কিংবা বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও। মানুষের প্রতি অপরিসীম আস্থা ও ভালোবাসা থেকেই তিনি পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। তাঁর এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যই তাঁর শেষযাত্রায় যেমন টেনে এনেছিল দেশ-বিদেশের নেতা-নেত্রীকে, তেমনি অগণিত সাধারণ মানুষকে। জ্যোতি বসুর জন্মশতবর্ষে তাঁর জীবনের এই উজ্জ্বল দিকগুলিকে বুকে আঁকড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলাই আমাদের দায়িত্ব। আগামীদিনে এটাই হোক আমাদের শপথ। 
*********

ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বন্ধ হোক


জ্যোতি বসু
(১৯৪৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় আইনসভায় ভাষণ)


মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমি মনে করি শ্রমিক শ্রেণীর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে এই আলোচনায় আমার অবশ্যই অংশগ্রহণ করা উচিত। যে কেন্দ্রে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মালম্বীই আছেন। গোটা শহর জুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এই মহানগরীকে হতমান করেছে এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে আমাদের রাজনৈতিক জীবনকে কালিমালিপ্ত করেছে, তখন কলকাতা ও শহরতলির শ্রমিকশ্রেণী এই ঘটনা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে দূরে থেকেছেন। আসুন, এর জন্য তাঁদের আমরা সম্মান জানাই।

হাজার হাজার মানুষ কীভাবে নৃশংসতা, কাপুরুষতা ও অমানবিকতায় পতিত হয়েছিল তার বিশদ ব্যাখ্যা আমি করছি না। বরং আমি সভার সমস্ত সদস্য ও দেশবাসীকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এটাই বলব যে, এক মুহূর্তের জন্যও ভুলবেন না, আমরা যাই বলি, যাই করিনা কেন, তার উদ্দেশ্য হবে উদ্ধারকার্য। তার প্রতি দৃষ্টি রেখেই সমস্ত বক্তব্য এবং কাজ করার জন্য আন্তরিক আবেদন জানাবো। এই মুহূর্তে সমস্ত শুভেচ্ছা সহ দেশবাসীর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি উদ্দীপনা ও শক্তিকে নির্ভর করে ও সাম্রাজ্যবাদী কৌশল মোকাবিলায় এবং স্বাধীনতার জন্য তাঁদের নিঃসংশয় সংকল্পকে স্মরণে রেখেই যা কিছু করতে হবে। যে লক্ষ্য আইনের জন্যই হিন্দু ও মুসলিম ক্ষুধা তৃষ্ণা ও যন্ত্রণার মোকাবিলা করেছেন। বাংলায় মুক্ত জীবন ও স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র পথ ইউরোপীয়ানদের বাদ দিয়ে একটি প্রগতিশীল কর্মসূচির ভিত্তিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন। এই লক্ষ্য অর্জন ভোটের মাধ্যমে হবে না। সম্ভব আলোচনার মধ্য দিয়েই, মন্ত্রিসভাকে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য অভিযুক্ত করার আগে, আসুন পর্যায়ক্রমে আমরা বিষয়গুলি আলোচনা করি। যদিও এই মন্ত্রিসভা বহুবিধ অপকর্ম করেছে। যাই হোক, দেখুন আমাদের বিরুদ্ধে কাপুরুষোচিত ছলের মূল পান্ডা কারা; যাবতীয় ঘৃণার সঙ্গেই আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই আমাদের পয়লা নম্বর শত্রু। তারা আমাদের অবদমিত করেছে, পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, জনগণকে ভুল পথে চালিত করেছে এবং এখন সগর্বে কলকাতায় নিদারুণ শ্মশানের শান্তি বজায় রাখলেও, যে কোনো সময় তা ভেঙে যেতে পারে।

অতীতে যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনই আমরা, সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদকে তার প্রধান উস্কানিদাতা হিসেবে ভৎর্সনা করেছি এবং আমরা দেখেছি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে দেশবাসী কীরকম অসহায় দুর্বল দাবার বোড়েতে পরিণত হয়। এবারেও দাঙ্গা সম্পর্কে আলাদা করে কিছু ভাবনার কোনো কারণ নেই। প্রভাবিত করতে পারে এমন সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির সঙ্গে আমিও এই দাঙ্গার প্রধান অপরাধীদের অভিযুক্ত করছি। যাঁরা হোয়াইট হল অথবা দিল্লি অথবা কলকাতার গভর্নর হাউসে আত্মতৃপ্তি নিয়ে অবস্থান করছে এবং সুতোর টানে আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করছে। গত ছ'মাসে ক্যাবিনেট মন্ত্রী কি নিখুঁত খেলাই না খেললেন। কখনো কংগ্রেস এবং কখনো লীগের কানে অমৃতবাণী বর্ষণ করেছেন। এমন সব প্রস্তাব তারা পেশ করলেন যেগুলিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সবশেষে স্বাধীনতাও নয়, এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেবার পরিবর্তে তারা যা করল, আমাদের দেশবাসীর এক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধকে পরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রাখা ও জনমানসকে বিষিয়ে তোলা এসবের চূড়ান্ত পরিণতি হলো কলকাতার মারাত্মক দাঙ্গা। 

মাননীয় উপাধ্যক্ষ, এই সমস্ত কিছুর সঙ্গেই আমার প্রশ্ন, ভাইসরয়ের সভাপতিত্বে গভর্নরদের সম্মেলনের কি গোপন পরিকল্পনা আলোচিত হয়েছিল যার ফলে কলকাতার গভর্নর ঠিক তার বিপরীত কাজ করলেন? কি কারণেই বা কলকাতায় সরকার দুদিনের জন্য আক্ষরিক অর্থে অপসৃত হয়েছিল এবং যার ফলে পুলিস তার নির্ধারিত কাজের বদলে লুঠ ও অগ্নিসংযোগের কাজে সহায়তা করেছিল? পুলিস কিভাবে ধর্মঘট ভাঙে আমরা সবাই জেনেছি। রশিদ আলি দিবসে আমাদের বিপ্লবী যুবকদের মিছিল ভেঙে দিতে তারা কিভাবে তৎপর হয়েছিল তাও আমরা দেখেছি। অর্থাৎ কিভাবে তারা গণঅভ্যুত্থান দমন করে! আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, কেমন করে ১৯৪২ সালে সরকারকে অন্ধকারে রেখে কিভাবে পুলিস তার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু এই দাঙ্গার সময় জনগণ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং পুলিসবাহিনী বুঝে নেয় যে তাদেরই জমানা আরো জোরদার হবে। সুতরাং এই স্বৈরতান্ত্রিকদের সংবিধানিক রীতির আড়ালে আশ্রয়ও নিতে দিলে হবে না। যদি ইংরেজরা পথিমধ্যে আক্রান্ত হতেন বা তাদের সম্পত্তি লুঠ হতো কিম্বা মিলিটারি ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়া হতো, তাহলেও কি তারা একই আচরণ করতেন? উত্তর সহজেই অনুমেয় এবং চোখে পড়বার মতো বিষয়। সিআইডি’র তান্ডবের নারকীয় প্রক্রিয়া পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া অনুমান করাও অসম্ভব। কারণ দাঙ্গার প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্ভাবত তারা ওয়াকিবহাল ছিল। সুতরাং, মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, গভর্নর এবং পুলিস কমিশনারের ছদ্ম-নিরপেক্ষতা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।

মিঃ সুরাবর্দি এবং তাঁর মন্ত্রীরা বলার চেষ্টা করছেন যে, তাঁদের দায়িত্ব কেবল আদেশ করা, আর তা পালন করা পুলিস কমিশনারের কাজ। কিন্তু মিঃ সুরাবর্দি জানেন, তাঁর গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন ১৬আগষ্ট দুপুরবেলা যে জনসমাগম তা কেমন করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। তাঁরই অধীনস্থ পুলিস কমিশনার দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা দেখা মিঃ সুরাবর্দির দায়িত্ব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে তাঁর ডেপুটি কমিশনারদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার কথা ভাবছেন? তাঁর সে সাহস নেই কারণ তিনি নিজের ব্যর্থতা তদোপরি সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতার কথা জানেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার মুসলিম লীগ দল থেকে পৃথক নয় এবং শেষোক্তটিকে অবশ্যই ত্রুটি-বিচ্যুতির দায়িত্ব নিতে হবে। এসব সত্ত্বেও আমি মনে করি, সাম্রাজ্যবাদী নীতি কখনোই আমাদের এমন দুর্দশা করতে পারতো না, যদি না লীগ এবং কংগ্রেস সেই অশুভ চক্রান্তের শিকারে পরিণত না হতো।

আমি প্রথমে লীগের দায়িত্ব সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি:

১) ১৬ আগস্টের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৫ আগস্ট ‘আজাদ’ সম্পাদকীয় লিখেছিল যে ওইদিন পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ শুরু হবে।

২) সারা ভারত লীগ কাউন্সিল ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস উভয়কেই শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।

৩) মৌলানা আক্রম খান এবং ওসমান সাহেব মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দায়িত্ব স্মরণ করে দিয়েছিলেন।

৪) পরহিতব্রতী নাজিবুদ্দিন সাহেব বারংবার ঘোষণা করেছেন, মুসলিমরা অহিংসতার প্রতি অঙ্গীকার বদ্ধ নয়।

৫। সাহসী সুরাবর্দি ঘোষণা করেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে একতরফা বোঝাপড়া করলে তিনি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ অবজ্ঞা করবেন এবং বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করবেন।

৬। সারা ভারত লীগ কাউন্সিলের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ছিল ১৬মে ক্যাবিনেট মিশনের বিজ্ঞপ্তি মেনে নিতে কংগ্রেসকে বাধ্য করার জন্য। এই বিজ্ঞপ্তিতে কাউকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি এবং মানুষের ভোট ছাড়াই সম্প্রদায়ভিত্তিক আসন বিভাজন নীতিকে মেনে নেওয়া। (এই অবস্থায় সদস্য তাঁর নির্ধারিত সময়সীমা পৌঁছান)

মহাশয়, আমি আর কয়েক মিনিট পেতে পারি?
উপাধ্যক্ষ:...
শ্রী জ্যোতি বসু : মহাশয়, মাননীয় অধ্যক্ষ আমাকে দশ মিনিট সময় বরাদ্দ করেছিলেন। আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে দুমিনিট সময় দিতে পারেন ?

উপাধ্যক্ষ :...
শ্রী জ্যোতি বসু : আমি আর দুমিনিট সময় চাই। এতে কি আশ্চর্যের কিছু আছে স্যার, যে মুসলিমদের একাংশ তাঁদের নেতাদের গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের হাতে কলমে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং এরই পরিণতিতে এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। এর দ্বারা ব্রিটিশ আমাদের উপর নতুন করে শৃঙ্খল চাপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে একমাত্র ব্রিটিশ সম্পত্তি সুরক্ষিত হয় এবং হিন্দু ও মুসলিম পরস্পরকে শঙ্কা ও অবিশ্বাস নিয়ে দেখবে। অন্যদিকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন সংগঠিত করার বদলে কংগ্রেস ব্রিটিশ পরিকল্পনাকেই গ্রহণ করেছে। এবং এটা জেনেবুঝেই যে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ভারত ত্যাগ করছে না, রাজন্যবর্গের নিয়ন্ত্রণকারী আধিপত্য থাকছে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা ব্রিটিশের হাতেই রয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই ব্রিটিশ পরিকল্পনায় কংগ্রেস মুসলিম লীগের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে এবং কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে এর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই কারণেই মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ’ কংগ্রেসের কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছিল এবং একটি সফল হরতাল তাদের কাছে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। সুতরাং ১৫ আগস্ট দেশপ্রিয় পার্কের জনসভায় ১৬ আগস্টের বিরুদ্ধে আবেগ সঞ্চারিত করা হয়েছিল।

এমনকি, এখনও সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা বলছি যে, ব্রিটিশ সেনা আমাদের শান্তি দিতে পারে না; কার্ফিউ ঘোষণা, ১৪৪ ধারা জারি এবং নাগরিক স্বাধীনতা অপহরণ কখনোই ভ্রাতৃপ্রতিম আস্থা এবং সহানুভূতির জন্ম দেয় না। ভাইসরয়ের কাছে এই মন্ত্রীসভার অপসারণ চেয়ে আবেদন-নিবেদনে ফল হবে না। সরকার ফেলে দেবার চেষ্টাও আমাদের সমস্যার সমাধান করবে না। কারণ মানুষ প্রশ্ন করবেন ‘এরপরে কি’কেন্দ্রে কোয়ালিশন ছাড়া বাংলায় কোয়ালিশন সম্ভব নয়, লীগের এই যুক্তি অর্থহীন। তাদের অনুধাবন করতে হবে, একদলীয় সরকারের আমলে দেশবাসী কী দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলেন। একমাত্র দেশপ্রেমের উদ্দীপনা থেকে রাজনৈতিক দলগুলি একযোগে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলাকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করতে পারে। আমি উল্লেখ করেছি, ইউরোপীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই সরকারের কর্মসূচি হবে প্রগতিশীল আইন। বাঁচার মতো মজুরি, ইউনিয়নের সুরক্ষা, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, পাটের ন্যায্য ন্যূনতম মূল্য, সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও বস্ত্র, সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার এবং অবশিষ্ট রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান।

আমরা সেই কারণে অনাস্থা প্রস্তাবের এই বিতর্কে কোনো পক্ষেই ভোট দেব না কারণ এটা কেবলমাত্র ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে ঘৃতাহুতি দেবে। আমরা হিন্দু, মুসলমান সকল সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সকল শক্তি সংগঠিত করতে আবেদন করছি। যাতে তারা বারংবার না পারস্পরিক খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভেঙে যায়, মজুরি বৃদ্ধির এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতির লড়াই ভেঙে পড়ে, আর ইউরোপীয় অশুভ শাসন শক্তিশালী হয়। রশিদ আলি দিবসনৌবিদ্রোহ, আইএনএ, বন্দীদের বিচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২৯জুলাইয়ের সাধারণ ধর্মঘটের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত মানুষ, সংঘবদ্ধ মানুষই নেতাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে বাধ্য করবেন। মানবতার বিভিন্ন আদর্শ অগ্রসর হবে শান্তি এবং স্বাধীনতার পথে। এই মুহূর্ত, তারা বলুন, ‘কখনোই আমরা আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে উদ্যত হবো না; কখনোই আমরা আর তাদের বরদাস্ত করব না, যারা হিন্দু ও মুসলিম পার্থক্যের ভিত্তিতে কথা বলে এবং আমাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়।’
.........................................................................................................................
ফুটনোট: (১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ দিবস’পালনের ডাক দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, দাবি ছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন। সেদিন থেকে পরপর অন্তত তিনদিন কলকাতা প্রত্যক্ষ করেছিল জঘন্যতম ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। ১৯৪৫-এর নভেম্বরে আইএনএ বন্দীদের দাবিতে উত্তাল কলকাতা, ১৯৪৬-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি আইএনএ দিবস পালন উপলক্ষে মহানগরী, নৌবিদ্রোহের সেনানীদের প্রতি হিন্দু-মুসলিম মিলিত সংহতির সাক্ষী এই শহর, ১৯৪৬-এর ২৯জুলাই অবিস্মরণীয় হরতালের সহমর্মী কলকাতা শিউরে উঠেছিল ৪৬-এর মধ্য আগস্টের রক্তস্নানে। অবিভক্ত বাংলায় তখন এইচএ সুরাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার। বাংলা প্রদেশের আইনসভায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। ১২ সেপ্টেম্বর বাংলা বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল কংগ্রেস। বিতর্ক চলেছিল বেশ কয়দিন। ১৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার জ্যোতি বসু বক্তব্য রেখেছিলেন। বসুর ভাষণের সময় সভা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপাধ্যক্ষ তাফাজ্জল আলি। বসুর ভাষণের পর বিকেল ৫.২৫ মিনিটে সভা সেদিনের মত মুলতুবি হয়। ভাষণের শিরোনামটি যুক্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২২ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় কংগ্রেস অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৩ সেপ্টেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় জ্যোতি বসু রূপনারায়ণ পাল এবং রতনলাল ব্রাহ্মণ, বিধানসভায় তিন কমিউনিস্ট সদস্যের যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয় তার বাংলা অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো : ‘‘আমরা, বিধানসভার কমিউনিস্ট সদস্যরা, মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করিনি। আমাদের যুক্তিগুলি খুবই সহজ সরল। একদলীয় মন্ত্রিত্ব হচ্ছে গৃহযুদ্ধের স্থায়ী প্ররোচনা কিন্তু এই মন্ত্রিত্ব অপসারিত করাও ঠিক একই ব্যাপার। এই পরিস্থিতিতে বাঁচার একমাত্র উপায় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা এবং একে অপরকে দোষারোপ করে তা সম্ভব নয়। বরং আলোচনার মাধ্যমে একটি অভিন্ন কর্মসূচীতে উপনীত হবার জন্য অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যা বাংলাকে বাঁচাবে। কলকাতা সম্প্রতি পারস্পরিক হত্যার নজিরবিহীন তান্ডবের মধ্য দিয়ে গেছে। এবং প্রদেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রবল। রাস্তাঘাট সৈন্যবাহিনীর হাতে তুলে দিলে ঝগড়া বিবাদ চালিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আমরা জমিউনিস্টরা কখনোই ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করি না বরং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের একত্রিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে হয়, ভাবছেন যেহেতু কংগ্রেস অন্যান্য প্রদেশে একদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেছে, বাংলাতেও একদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করার অধিকার তাদের রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ মন্ত্রিসভা গঠনের উদ্দ্যেশ্যে কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে লীগ নেতাদের বৈঠক সম্পর্কে লীগ সমর্থক একটি দৈনিক বিরক্তি প্রকাশ করেছে।

আমরা আশা করি, বাংলা-কংগ্রেসের যেমন, ঠিক তেমনই বাংলা-লীগের প্রধান অংশ বাংলা প্রদেশে সম্মিলিত মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই তাঁরা গত দুর্ভিক্ষের সময়ে একদলীয় লীগ মন্ত্রিসভা গঠনে অক্ষমতার কথা ভুলতে পারেন না। আজ যদি তাঁরা মন্ত্রিসভার দুটি আসন অথবা মন্ত্রকের বিতরণ নিয়ে দর কষাকষি করেন এবং তা লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের দ্বিতীয় দুর্ভিক্ষের কবলে ফেলে দেয়, যদি তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্র এবং কায়েমী স্বার্থের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে পারে এমন শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের বাংলা, হিন্দু ও মুসলমানদের বাংলা, তাঁদের ক্ষমা করবে না।

আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলায় কংগ্রেস লীগ কোয়ালিশনের ভিত্তি ডঃ কুমুদ শঙ্কর রায়ের বিবৃতি মতো হতে পারে। কংগ্রেস নেতা, শ্রী কিরণশঙ্কর রায় এবং লীগ নেতা শাহেদ সূরাবর্দি সাম্প্রতিক বিবৃতিতে যে সকল বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, সেগুলি সহজেই দলগুলির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন আলোচনার মাধ্যমে মিটে যেতে পারে। পার্টি যে-কোনো রকম গঠনমূলক কার্যে, এবং সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে - কোনো ধরনের সংগ্রামে, জমিদারদের বিরুদ্ধে, কায়েমী স্বার্থান্বেষী এবং মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে এবং কোনো ধরনের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পূর্ন সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছে।’’)