20220711

ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো ...মমতা ব্যানার্জির ঘৃণ্য রাজনীতির পথেই চলছে মোদী সরকার

কাজ শুরু বামফ্রন্টের সময়েই, মমতার বাধাতেই প্রকল্পে কালক্ষেপ

-------------------

নিজের ওষুধই এখন তেতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে!

২০০৯সালের ২২ফেব্রুয়ারি ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রয়েছেন প্রণব মুখার্জিসুভাষ চক্রবর্তীমহম্মদ সেলিম সহ আরও অনেকে। (ফাইল চিত্র)

উন্নয়ন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির ঘৃণ্য রাজনীতির পথেই চলছে কেন্দ্রের মোদী সরকার।সোমবার কলকাতায় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অবহেলা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে দিয়ে সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পরিষেবার উদ্বোধন করার ঘোষণা করেছে রেল মন্ত্রক। রবিবার অবশ্য শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণের কথাও জানানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষুব্ধ তৃণমূল সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগ তুলে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোকে মমতা ব্যানার্জির পরিকল্পিত প্রকল্প বলে বর্ণনা শুরু করেছে।

কিন্তু তেরো বছর আগের তথ্য বলছে, বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই হাওড়া থেকে সল্টলেক ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এই প্রকল্পকে ঠেকাতে মমতা ব্যানার্জি সবরকম চেষ্টা করেছিলেন, কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রের সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, রাজ্যে বসে নৈরাজ্য তৈরি করে প্রকল্পের রূপায়ণে বাধা দিয়েছেন এবং সর্বোপরি কেন্দ্রের রেলমন্ত্রীর পদে বসে এবং তারপরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে তাঁর একের পর এক পদক্ষেপে প্রকল্প রূপায়ণে বিলম্ব ঘটিয়েছেন।

সোমবার সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রোরেলের যে প্রকল্পের উদ্বোধন হবে তাকে ‘মমতা ব্যানার্জির প্রকল্প’ বলে দাবি করে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জিই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর প্রকল্পে তাঁকেই বাদ দিয়ে উদ্বোধন? বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবে না।’

বিজেপি’র মতোই ইতিহাসকে নিজের মতো করে লিখছে তৃণমূল। শিলান্যাসের পরদিন, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে লেখা আছে যে ২২ ফেব্রুয়ারি সল্টলেক স্টেডিয়ামে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও। সেই সময় রেলমন্ত্রকের হাতে ছিল না প্রকল্পটি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ প্রকল্প ছিল এটা। সংবাদপত্রের পুরানো পাতা থেকেই দেখা যাচ্ছে, সেদিন প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, আমাদের মতো গরিব দেশে উন্নয়নে অনেক বাধা। টাকার অভাব, প্রযুক্তিও সবসময় থাকে না। কিন্তু তার সঙ্গে যদি আত্মকৃত বাধা এসে জোটে তাহলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু থাকে না। উন্নয়নকে সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখতে না পারলে এগোনোর পথে অনাবশ্যক কাঁটা ছড়ানো হয়। তাতে নিজেদেরই পা ক্ষতবিক্ষত হয়।’

প্রণব মুখার্জির এই মন্তব্যের কারণ ছিল মেট্রো প্রকল্পে মমতা ব্যানার্জির বাধা। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী ইউপিএ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে শিলান্যাস অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন, ‘ঋণভারে জর্জরিত রাজ্যকে কেন্দ্র কেন এত টাকা দিচ্ছে? রাজ্য সরকারকে মদত দেওয়া বন্ধ করুন। লোকসভার ভোট চলে এসেছে, এখনও সিপিএম’কে তোয়াজ করছেন কেন?’

সেদিন দুপুরে সল্টলেকে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যাওয়ার পথে কালো পতাকা দেখানোর চেষ্টা করেছিল তৃণমূল কর্মীরা। আর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিকালে পার্থ চ্যাটার্জিকে সাংবাদিক বৈঠকে বসান মমতা ব্যানার্জি। দলনেত্রীর নির্দেশে সেদিন প্রণব মুখার্জিকে ‘সিপিএম’র পদলেহনকারী বাংলার এক নায়ক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি। তারপরে বলেছিলেন, ‘সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় যাকে দেখা যায়নি, বাংলার মানুষের পাশে যিনি দাঁড়াননি, তাঁকে এখন কথা বলতে শোনা যাচ্ছে।’

উদ্বোধনের আগের দিনরবিবারশিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনের ছবি।


সেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নাকি এখন মমতা ব্যানার্জির প্রকল্প! ২০০৯ সালে শিলান্যাস অনুষ্ঠানের ছবি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও প্রণব মুখার্জির নাম লেখা ফলকের ছবি এখন সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিলান্যাস মঞ্চ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, হাওড়া ময়দান থেকে গঙ্গার তলা দিয়ে (ভারতে নদীর তলা দিয়ে প্রথম ট্রেনলাইন) শিয়ালদহ হয়ে বিধাননগরের সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত এই মেট্রো প্রকল্পের কাজ ২০১৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

হয়নি কেন? ২০২২ সালের জুলাই মাসে এসে প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন করতে হচ্ছে কেন স্মৃতি ইরানিকে? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কৃতিত্বকে মমতা ব্যানার্জির ঝুলিতে ঠেলে দেওয়ার মিথ্যা রাজনৈতিক প্রচারের থেকেও ঘৃণ্য সেই কাহিনি।

শিলান্যাসের কিছুদিন পরেই কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারপরেই রেলমন্ত্রককে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও শিয়ালদহে মেট্রো স্টেশনের পরিকল্পনাকে বানচাল করতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। অথচ হাওড়া ও শিয়ালদহ রেল স্টেশনের সঙ্গে যাত্রাপথে সংযোগ না হলে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের মূল সুবিধাই নিতে পারবেন না যাত্রীরা। তাই বামফ্রন্ট সরকার সেদিন কেবলমাত্র প্রকল্পটির রূপায়ণের স্বার্থে এই কদর্য রাজনীতিকে মর্যাদার লড়াইতে নিয়ে যায়নি। বরং উন্নয়নের স্বার্থে গোটা প্রকল্পটি রেলমন্ত্রকের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়ে যায়। ‘কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগেই হোক, অথবা রেলের মাধ্যমেই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প চালু হলেই নাগরিকদের লাভ।’ ২০১১ সালের গোড়ায় বামফ্রন্ট সরকারের পরিবহণ সচিব সুমন্ত্র চৌধুরি সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী প্রকল্পটি হস্তান্তরিত হয় রেলমন্ত্রকের হাতে। তারপর? কলকাতার কিছু ব্যবসায়ী, জমি মাফিয়াদের স্বার্থে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুটটাই পালটে ফেলে মমতা ব্যানার্জির সরকার। ইঞ্জিনিয়ার ও ভূবিজ্ঞানীদের যাবতীয় সমীক্ষার থেকে বেশি গুরুত্ব পায় তৃণমূল নেতাদের মরজি। ফলাফল? প্রকল্প ব্যয় হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে, দশ বছর সময় নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। বরং মধ্য কলকাতায় বাড়িতে বাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে মেট্রোর নতুন রুটের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে।

স্থায়ী প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক যোগ্যতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাজনীতি করেছেন মমতা ব্যানার্জি। এখন বিজেপি’কে সেই অপকর্মের জন্য দোষারোপ করছেন তিনি। ইউপিএ সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে বামপন্থীরা সমর্থন তুলে নেওয়ার পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন প্রকল্প শিলান্যাসে। লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগেও তাঁরা পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করার বদলে উন্নয়নকে গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। আর এখন স্মৃতি ইরানিরা সেই আচরণই মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে করছেন যা তৃণমূল করেছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে আমন্ত্রণ জানালেও সোমবার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর অনুষ্ঠানে তাঁরা মমতা ব্যানার্জিকে আগে থেকে আমন্ত্রণ জানাননি।

২০০৯ সালেরই আগস্ট মাসের কথা কি মমতা ব্যানার্জির মনে পড়ছে? তখন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে সদ্য রেলমন্ত্রী পদে বসেই মমতা ব্যানার্জি টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া সম্প্রসারিত মেট্রো রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। সেদিন তিনি রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে পাশে বসিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া মেট্রো সম্প্রসারণ আদৌ রেলমন্ত্রকের একার প্রকল্পই ছিল না, ঐ সম্প্রসারণের কাজে ৩৩ শতাংশ ব্যয়বহন করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার।

ক্ষমতায় বসে কেউ ব্যস্ত ইতিহাস থেকে নেহরুদের নাম মুছতে, কেউ ব্যস্ত বামপন্থীদের নাম মুছতে। এরা কি আদৌ অক্ষয় হয়ে থাকবে ভবিষ্যতে?

.........................

গণশক্তি, ১১ জুলাই, ২০২২

..........................