20220905

‘‘জুতোটা ঠিক জায়গায় লেগেছে তো?’’


অজয় দাশগুপ্ত
 

সেদিন অফিসে ঢুকতেই অভীকদা বললো, ‘‘একবার ওবাড়িতে যাও। বিমানদা তোমাকে ডেকেছেন!’’

আমি ব্যাগটা রেখে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আলিমুদ্দিনে ছুটলাম।

বিমানদা আমাকে দেখেই বললেন, ‘‘শোনো, তোমাকে কাল একবার জ্যোতিবাবুর বাড়ি যেতে হবে। ৩১ তারিখের সমাবেশের জন্য ওনার একটা শুভেচ্ছা বার্তা আনতে হবে।’’

২০০৯ সালের ৩১আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে বামফ্রন্ট ধর্মতলায় বিশাল সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। তার দু’দিন আগের এই ঘটনা।

আমি বিমানদাকে বললাম, ‘‘জ্যোতিবাবুর একটা লেখা তো করে এনেছি। সেটা ৩১তারিখ গণশক্তিতে ছাপা হবে।’’

বিমানদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, জানি সেটা। এটা শুভেচ্ছা বার্তা, সমাবেশে পাঠ করা হবে। জ্যোতিবাবু তো তোমার কথা বললেন।’’

বলে বিমানদা হাসতে লাগলেন, ‘‘জ্যোতিবাবু বললেন, ‘তোমার ওই মোটা ছেলেটাকে পাঠিও, ও নিয়ে যাবে।’ উনি মোটা ছেলেটা বলতে কাকে বলেন, সেটা আমি জানি। যাইহোক, তুমি কখন যাবে, সেটা জয়ের সঙ্গে কথা বলে নিও।’’

**********************

অফিসে এসে জয়কৃষ্ণ ঘোষকে ফোন করলাম। পরদিন সকাল দশটায় ইন্দিরা ভবনে যেতে বললেন। নিয়মমতো দশটার আগেই পৌঁছে গেলাম। কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় উনি বাইরের ঘরে এলেন। এসেই বললেন, ‘‘বিমান এসেছিল। ও বললো, যা প্রস্তুতির খবর এসেছে, তাতে বিশাল সমাবেশ হবে। এত মানুষ আসবেন, আপনি একটা শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিলে ভালো হয়আমি বলছি, তুমি লিখে নাও।’’

উনি খুব সংক্ষেপে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিলেন। খুব তাড়াতাড়িই আমার কাজ শেষ হয়ে গেল। 

**********************

 

                                                  সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ

১৯৫৯ সালের ৩১আগস্টের ঘটনার পর ২১ সেপ্টেম্বর বিধানসভার অধিবেশন শুরু হলে খাদ্য আন্দোলনের ফলে পুলিশী আক্রমণে নিহত ৮০ জন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালনের দাবি জানানো হলে তা মানতে অস্বীকার করে শাসক কংগ্রেস ও পিএসপি-র সদস্যরা। তখন তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। এমনকি জুতো ছোড়াছুড়িও হয়েছিল বলে জানা যায়হইচই থামলে জ্যোতিবাবু খাদ্য আন্দোলনের প্রসঙ্গে মুলতবি প্রস্তাব এনে তৎকালীন রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বিধানসভায় ভাষণ দেন। পরে বিধান রায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলের সদস্যরা। ২৮ সেপ্টেম্বর অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরেও ভাষণ দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু।

সেদিনের গণশক্তিতে জ্যোতিবাবুর ২১ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতাটিই পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছিল। আমি ওঁর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই ওনাকে ওই বক্তৃতাটা ছাপানোর কথা বললাম।

জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘হ্যাঁ, জয় আমাকে বলেছে। তোমরা তো অনেক কিছু ছেপেছো।’’

তারপর উনি সেই অধিবেশনের ঘটনার কথা বলতে শুরু করলেন। একেবারে ফোটোগ্রাফিক মেমোরি!

‘‘ওইদিন তো খুব গোলমাল হয়েছিল হাউসে। চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছিলো। কংগ্রেসের এমএলএ’রা বললো, আমি নাকি জুতো ছুড়ে মেরেছি। আমি পা থেকে জুতো খুলে দেখিয়ে বললাম, আমার জুতো আমার পায়েই আছে। আমি জুতো ছুড়িনি। আসলে মণিকুন্তলা ছুড়েছিল।’’

তারপর একটু থেমে বললেন, ‘‘সাউথ ইন্ডিয়া থেকে আমাদের পার্টির কয়েকজন নেতা এখানে এসেছিলেন। তাঁরা সেদিন অধিবেশন দেখতে বিধানসভায় ভিজিটার্স গ্যালারিতে ছিলেন। তাঁরা পরে পার্টি অফিসে এসে বললেন, বিধানসভায় এসব আবার কী হচ্ছে?’’

জ্যোতিবাবু একটু পরিহাসের সুরেই বললেন, ‘‘আসলে এখানকার মানুষের তখন ক্ষোভ কতটা বেশি ছিল, সে সম্পর্কে ওঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। বিধানসভায় তখন একজন নির্দল এমএলএ ছিলেন, আন্দোলনে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন, নামটা এখন মনে পড়ছে না। উনি পরে আমাকে বলেছিলেন, বিধানসভাতেও বলেছেন একটা ঘটনার কথা। উনি বাজারে মাছ কিনতে গেছেন। মাছওলা ওনাকে প্রশ্ন করেছেন, জুতোটা ঠিক জায়গায় লেগেছে তো? সেই সময় মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।’’

 

*********************

 

                                        ২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় বামফ্রন্টের 
                                          সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

ইন্দিরা ভবনে থেকে ফিরে তড়িঘড়ি কম্পোজ করে পার্টি অফিসে দিয়ে এলাম। ঘন্টাখানেক বাদে আবার ওবাড়ি থেকে ফোন। ওপারে বিমানদা। বললেন, ‘‘শোনো, তুমি আরেকবার ইন্দিরা ভবনে যাও। কম্পোজ কপিটার নিচে জ্যোতিবাবুর সই করিয়ে আনতে হবে। প্রেসকে আমরা সেটার কপিই দেবো।’’ বিমানদা আরও বললেন, ‘‘আমি জ্যোতিবাবুকে বলে রেখেছি। তুমি গেলেই সই করে দেবেন।’’

কী আর করা! আবার বিকেলে ছুটলাম। আমাকে দেখেই জ্যোতিবাবুর সস্নেহ হাসি, ‘‘কি, তোমায় আবার আসতে হলো তো! বিমানের যতসব কান্ড!’’

জয়কৃষ্ণ ঘোষ আগে থেকেই একটা সিগনেচার স্ট্যান্ড আনিয়ে রেখেছিলেন। সাদা কাগজের প্যাডও ছিল।

জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘সই-টই করা এখন খুব ঝামেলার ব্যাপার!’’

জয়দা বললেন, ‘‘আপনি ওই সাদা কাগজে তিন-চারবার মকসো করে নিন। তারপর ওই বার্তাটায় সই করবেন।’’

জ্যোতিবাবু তাই করলেন। আমি গোটা তিনেক কপি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবগুলোতেই সই করিয়ে নিলাম।

জয়দা আমাকে বললেন, ‘‘আসলে এখন বছরে একবার সই করতে হয় ওনাকে। প্রাক্তন বিধায়ক হিসেবে যে পেনশন পান, সেটা পার্টির রাজ্য কমিটিকে চেক লিখে দিয়ে দেন। ওটাই বছরে একবার করতে হয়’’ 

 জ্যোতি বসুর স্বাক্ষরিত এই সেই বার্তা

********************

 

                                ২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় বামফ্রন্টের  সমাবেশ

২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় সেবার যে সমাবেশ হয়েছিল, তা সঠিক অর্থেই ছিল ঐতিহাসিক। ‘‘অনুগত’’ সংবাদমাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হলেও ধর্মতলায় অতবড় সমাবেশ এখনও পর্যন্ত কোন দলই ক্ষমতায় থাকতে বা না থাকতে করতে পারে নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রধান বক্তা ছিলেন। বামফ্রন্টের নেতারা বক্তব্য রেখেছিলেন।

সমাবেশের শুরুতেই জ্যোতিবাবুর শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করে বিমানদা কাগজটা সমবেত জনতাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘এটা জ্যোতিবাবুর শুভেচ্ছা বার্তা, এই যে দেখুন ওনার সই করা আছে।’’

লাখো লাখো জনতা মুখরিত সখ্যে সেই বার্তা গ্রহণ করলেন।

********************

সংযোজন: ১৯৫৯ সালের ২৮সেপ্টেম্বর বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা যাচ্ছে, পিএসপি বিধায়ক (১৯৫৭ সালে নির্বাচনে জেতার পর নিজেকে দলের থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে চলছিলেন) সুধীর চন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘....গুলি চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে বসে থাকা মোটেই সম্মানের কাজ নয়। এখানে জুতো ছোড়াছুড়ি নিন্দনীয়, নিশ্চয়ই এবিষয়ে কোন ভুল নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে খুব দুঃখিত হয়েছে তা নয়। এক ভদ্রলোক আমাকে সেদিন বললেন — আচ্ছা, কালীবাবুর মুখে কি জুতা গিয়ে পড়েছিলো? আমি বললাম, অত তো লক্ষ্য করিনি। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন — প্রফুল্লবাবু কি তখন ঘরে ছিলেন না? আমি বললাম — হ্যাঁ, ছিলেন। তখন তিনি বললেন — তার মুখে একটা পড়তে পারল না। এটা একজন সাধারণ মানুষেরই কথা, আমার বানান কথা নয়।’’

স্কেচ সৌজন্য: ইন্দ্রজিৎ নারায়ণ

************

#MartyrsDay

#HistoricalFoodMovement

#LeftFront

#JyotiBasu