‘আকর্ষণীয় কথা, সুন্দর সুর দিয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া গান, সঙ্গে
ছোট ছোট ভিডিও-এই প্যাকেজ খুব সহজেই ভাইরাল হতে পারে। তা ব্যবহার করেই মমতা ব্যানার্জির
পাঁচ বছরের সরকারের রিপোর্ট কার্ড মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। মানবিক আবেদনের
স্টোরি। এরকম ছোট ছোট ভিডিও ফেসবুক জুড়ে দারুণ ছড়িয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেস এমন ৩৮টি
ভিডিও ছেড়েছিল ফেসবুকে, যা ভাইরাল হয়েছিল।’
এটা তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী
ফলাফল বিশ্লেষণের রিপোর্ট নয়। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর
কয়েকঘন্টার মধ্যেই এই প্রতিবেদন লিখেছিলেন আঁখি দাস। ১৯ মে একটি সর্বভারতীয় নিউজ
পোর্টালে তা প্রকাশিত হয়।
ফেসবুকের মত শক্তিশালী, গোটা বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যমের ভারতের অন্যতম শীর্ষ
কর্ত্রী একটি রাজনৈতিক দলের ভোটে জেতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখছেন তা! এখানেই থামেননি,
এমনকি যেভাবে নির্বাচনী নির্ঘন্ট প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল
কংগ্রেস প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছিল, সর্বোপরি তৃণমূলের
‘মুখ’ আছে, তাদের যোগ্য ‘নেতা’ আছে তাও বেমালুম লিখেছিলেন এই
ফেসবুক কর্ত্রী। তবে শাসক তৃণমূলের একটি মহলের দাবি, যে ৩৮টা
ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছিল, যেভাবে প্রচারের সুর বেঁধে দেওয়া
হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষত ফেসবুকে, তাতে দলেরই বিধায়ক মন্ত্রীর এই পুত্রবধূর
‘ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ।
ফেসবুকের ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাস। ২০১৩ সাল থেকেই
ফেসবুকে বিজেপি-আরএসএসের ঘৃণ্য প্রচারকে ‘অনুমোদন’ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর
বিরুদ্ধেই। সেই তিনিই একটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে শাসক দলের হয়ে প্রতিবেদন লিখছেন,
এমনকি কীভাবে ফেসবুকে দ্রুত ভাইরাল হয়েছে তৃণমূলের প্রচার ভিডিও,
তারও বর্ণনা দিচ্ছেন।
বিজেপি সখ্যতার অভিযোগ, তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ একজনের বিরুদ্ধেই! একই সঙ্গে বিজেপি’র ঘৃণ্য
বিষাক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সামাজিক মাধ্যমে একাধিক পোস্ট কে ‘মুছে
দেওয়া’, আরএসএসের হিংস্রতার ছবিকে ‘মুছে’ দেওয়া এমনকি
নির্দিষ্ট পোস্টের ‘রিচ’ পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে দেওয়া, সব আসলেই একই খাতে বইছে।
বিজেপি’র সঙ্গে সখ্যতা তৃণমূলের পক্ষে প্রচারে কোন ‘বাধা’ হয়নি!
আঁখি দাসের বিজেপি যোগের
পাশাপাশি তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার চিত্র গণশক্তি সামনে এনেছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি
হয়েছে সব মহলে। যদিও তৃণমূলের তরফে সরকারিভাবে এদিন রাত পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা
হয়নি।
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য
মিশ্র এই প্রসঙ্গেই এদিন ট্যুইটে বলেন ‘‘সংঘ পরিবারের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক, সংঘ ‘দেশপ্রেমিক’ ও তিনি ‘মা দূর্গা’ এই যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে
আসে। সংঘ পরিবার বিজেপি ও তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রন করে। মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি’র মধ্যে
তরজা ভাই-বোনের ঝগড়া। সংঘ নিয়ে তিনি নিশ্চুপ। কারণ একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র
কর্তা আরএসএস।’’
আঁখি দাস মাইক্রোসফ্টেরও ভারতের
পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর, একেবারে শীর্ষস্তরের পদে ছিলেন। ২০০৪ সাল
থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। সেই সময়তেই ২০১১ সালের বিধানসভা
নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার, মূলস্রোতের মিডিয়ায়
প্রচারের ভাষ্য, রুপরেখাকে চোহারা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছিলেন আরো একজন। তাঁর নাম সাবির ভাটিয়া। হটমেল’র অন্যতম সহ প্রতিষ্ঠাতা। সাবির
ভাটিয়া কর্ণধার থাকাকালীনই ১৯৯৮ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে মাইক্রোসফ্ট ‘হটমেল’ কিনে
নেয়। যদিও পরবর্তীকালে মাইক্রোসফ্ট থেকে বেরিয়ে ই-কমার্স ফার্ম তৈরি করেন এই
উদ্যোগপতি।
কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারে বৃহৎ
সংস্থা, বহুজাতিক কর্পোরেশন যে স্বেচ্ছাশ্রম দেয় তা বারেবারেই এদেশে একাধিক
ঘটনাপরম্পরায় সামনে এসেছে।
একজন শিক্ষাবিদের পাশাপাশি আঁখি
দাসের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হস্তক্ষেপে একেবারে শেষমুহুর্তে ২০১১ সালে রবিরঞ্জন
চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই পান। প্রথমবার জিতেই মন্ত্রীও হন।
তাতেও ফেসবুকের এই প্রবল ক্ষমতাশীল কর্ত্রীর যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলেই জানা গেছে খোদ
তৃণমূল সূত্রে। রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের পূত্রবধূ হলেন আঁখি দাস। এদিন যদিও
বারেবারে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। রবিরঞ্জন দাসের
পুত্র কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ আমলা, বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কে ডেপুটেশনে
আছেন। আরএসএস যোগাযোগ স্পষ্ট। আঁখি দাসের দিদি রশ্মি দাস প্রকাশ্যেই নিজের আরএসএস
ঘনিষ্ঠতার দাবি করেন। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ফেসবুকের মত সামাজিক মাধ্যমের
অন্যতম শীর্ষ কর্ত্রী সেই রাজনৈতিক অবস্থানকে ব্যবহার করছেন ফেসবুক পরিচালনায়, তা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে ফেসবুকের অভ্যন্তরেও
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ‘ব্যবসার ক্ষতির’ অজুহাতে ফেসবুক ইন্ডিয়ার বিজেপি’ সখ্যতা
নিয়ে। শুধু তাই , বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফেসবুকের কর্মীরা
সংস্থার অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট ফোরামেই চিঠি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আদৌ সংস্থার নিজস্ব নজরদারির প্রক্রিয়া কী মেনে
চলছে? এমনকি মুসলিম বিরোধী ঘৃণা প্রচারকে যেভাবে সঙ্গত দেওয়া
হচ্ছে তাতেও ক্ষোভ, যন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন খোদ ফেসবুকের
বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা।
ফেসবুকে বিজেপি, আরএসএসের উগ্র, বিষাক্ত প্রচারকে বাড়তি ‘সুরক্ষা’ দেওয়া ব্যবসার স্বার্থে- তা মূলত ২০১৩ সাল থেকেই বেশিরকম ভাবে সামনে আসতে শুরু করে। ভারতে ফেসবুকের পলিসি সংক্রান্ত প্রধানের দায়িত্বে আঁখি দাস যোগ দেন ২০১১ সালের অক্টোবরে। ২০১৪ সাল থেকে ফেসবুকের মত সর্ববৃহৎ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম স্পষ্টতই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ শুরু করে।
গণশক্তি, ২১ আগস্ট, ২০২০