20211205

রাত জাগা প্রত্যয়ের কাছে সেদিন হেরেছিল উন্মাদনা

 

সুদীপ্ত বসু

 

রাত জাগা সুরু সেই রবিবার থেকেই।

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ থেকে খিদিরপুর, এন্টালি, ট্যাংরা, তিলজলা, পার্কসার্কাস, বেনিয়াপুকুর, বেলগাছিয়া। কোথাও ত্রিপল খাটিয়ে কোথাও বা পার্টি অফিসেই ক্যাম্প করে রাতের শহরের গলি, বড় রাস্তা, মহল্লার দখল নিয়েছিল লাল ঝান্ডার কর্মী,সংগঠকরা।

সেদিন শুক্রবার (৪ঠা ডিসেম্বর)। করসেবকরা তখন অযোধ্যামুখী।

অন্যদিকে শহীদ মিনারে তখন বামফ্রন্টের জনসভা। জ্যোতি বসুর বার্তা, ‘আমরা কোন মধ্যযুগে আছি তা আত্মসমীক্ষা করা দরকার। রামের নামে মানুষ খুন চলতে পারে না। সাধু সন্তরা ধ্যান করুন, উপাসনা করুন, অসুবিধা নেই, কিন্তু দেশ চালাবেন এটা হতে পারে নাস্পষ্ট বার্তা। সেই জনসভা থেকে বামফ্রন্ট কর্মী ও রাজ্যের মানুষের কাছে আবেদন কোনভাবেই এবাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্য দুষ্কৃতীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তা যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে।

সেদিনই শহরের অন্যপ্রান্তে তখন চলছে কংগ্রেসের সভা। মমতা ব্যানার্জি তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। রাম মন্দির, বাবরি মসজিদ নিয়ে কোন শব্দ নেই সেই সভায়। বরং সি পি এম ক্যাডার নামিয়ে এসব উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, ওসব কিছু হবেনা এসব বলে ৬ই ডিসেম্বরের আগে সেই সভা থেকে সি পি আই(এম)র বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আন্দোলন গড়ার ডাক দেন মমতা ব্যানার্জি।

 

মন্বন্তর থেকে খাদ্য আন্দোলন, জমির আন্দোলনে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া শহর, এমনকি ১৯৮৪ সালে শিখ বিরোধী দাঙ্গাও  রুখে দেওয়া কলকাতা তখন এক অজানা শঙ্কা ঠেকানোর প্রস্তুতিতে।

    ৬ই ডিসেম্বর,দুপুর ১:৫৫মিনিট, সৌধের গম্বুজ ভেঙে ফেললো কয়েক হাজার করসেবক। তার মাত্র দুমাস পরে কলকাতায় এসে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং বলেছিলেন, ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া এটা সম্ভব ছিলো না।যদি আমরা ঠিকাদার নিয়োগ করতাম এই সৌধ ভাঙার জন্য তাহলেও কমপক্ষে দেড় মাস সময় লাগতো ভাঙতেবর্বরতার উচ্ছ্বাস!

      দুপুর থেকেই সেই ধ্বংসলীলার ছবি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশ জুড়ে। উত্তেজনা, আশঙ্কা বাড়তে থাকে প্রতি সেকেন্ডে। কালক্ষেপ করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। সন্ধ্যা থেকেই রাস্তায় নামেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। একের পর এক খবর আসতে শুরু করে। তাতে গুজবও ছিল। এন্টালিতে বোমা পড়েছে, গার্ডেনরিচে হামলা শুরু হয়েছে, খিদিরপুরে, ট্যাংরায় প্রকাশ্যে বাড়তে শুরু করেছে দুষ্কৃতীদের জমায়েত।

২৫ বছর আগের এক সকালে সতর্কবার্তা গিয়েছিল এই শহর থেকেই। না শোনার মাশুল আজও গুনছে বৃহত্ত গণতন্ত্র।

 


দিনরাতের প্রহরী, কঠোর সরকার...

 

   পরেরদিনই বন্‌ধ ডাকে রাজ্য বামফ্রন্ট।  ৮ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয়ভাবে দেশজুড়ে বন্‌ধ ডাকে বামপন্থী দলগুলি। তাতেও সমর্থন জানায় রাজ্য বামফ্রন্ট। টানা ৪৮ ঘণ্টা বন্‌ধ আসলে দুষ্কৃতী, দাঙ্গাবাজদের স্বাভাবিক গতিবিধি ঠেকাতেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তখন পুলিশের পাশাপা‍‌শি আধা সামরিকবাহিনী মোতায়েন করা হয় কলকাতার ৩৫টি থানা এলাকায়। হাওড়া, বর্ধমানেও বেশ কিছু জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়।

৬ই ডিসেম্বর রাতেই জ্যোতি বসুর আবেদন, ‘হাঙ্গামা বাধানোর চেষ্টা হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি। তবে শুধু প্রশাসন নয়, মানুষকেই ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সারা রাত ছিলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে।

এই ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলার মাটি।

ওদিকে তখন বন্দর এলাকার বটতলা, মুদিয়ালি, ফতেপুর, কাচ্চি সড়ক, ধানখেতি, কাশ্যপ পাড়ায় উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। ৬ই ডিসেম্বর রাতে হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে পার্টি অফিসেই হল ক্যাম্প। সারা রাত জেগে সি পি আই (এ‌ম) কর্মীরা। তখন একটাই থানা মেটিয়াবুরুজ।

সেদিনের সেই টানা ছয়দিনের অভিজ্ঞতা এখনও উজ্জ্বল লড়তে থাকা প্রতিটি চেতনায়। নাহ! এর জন্য ব্রাহ্মণ সম্মেলন, ইমাম ভাতা বা পুজো কমিটিকে ভিক্ষার দান দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি

ততক্ষণে বেশ কিছু জায়গায় লুটপাট শুরু হয়ে গেছে, বাড়িঘর ভাঙচুরও হয়েছে। বন্দর এলাকায় বটতলা, মুদিয়ালি, ফতেপুর, কাচ্চি সড়ক, ধানখেতি, কাশ্যপ পাড়ায় উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। মুসলিম মহল্লা, হিন্দু এলাকায় পালা দিয়ে ছুটছেন সি পি আই (এম) কর্মীরা। দাঙ্গা বাধানো সহজ, কিন্তু উন্মত্ত জনতাকে শান্ত রেখে অশান্তি এড়ানো কঠিনতম কাজ। সেই কাজেই তখন হাত লাগিয়েছেন সি পি আই (এম) সহ বামপন্থীরা। জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।যদিও সেনাবাহিনী সামান্য দেরিতে আসা নিয়ে তখন ক্ষোভও তৈরি হয়।

৭ই ডিসেম্বর থেকে মিছিলও শুরু হয় বিভিন্ন এলাকায়, গলির ভিতরে। দুপুরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাকরণে জানান, হাওড়া, আসানসোল, বারাকপুর থেকে গন্ডগোলের খবর আসছে। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আরও সেনা মোতায়েন করছি, কেন্দ্রের সঙ্গে কথা হয়েছে। ততক্ষণে রাজাবাজার, গার্ডেনরিচ, বেনিয়াপুকুর, কড়েয়া, জোড়াসাঁকো থানা এলাকায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। কাশীপুর, চিৎপুর, একবালপুর, ওয়াটগঞ্জ, আমহার্স্ট স্ট্রিট, হেস্টিংস থানা এলাকাতেও চলছে টহল।

এসব নিছকই তথ্য নয়। একটা আস্ত ইতিহাস।

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে একটা রাজ্য সরকারের ইস্পাতদৃঢ়তার সেই ইতিহাস।

৭ই ডিসেম্বরের সফল, সর্বাত্মক বন্‌ধের পরে ১০ই ডিসেম্বর ছিল মহামিছিল। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। দাঙ্গার কবলে পড়া এন্টালি, তপসিয়ার পায়ে হেঁটে ঘুরছেন বিমান বসু।

আরও একটি তাৎপর্যের ঘটনা হল, সেই সময় লাগাতার কয়েকদিন কার্ফু থাকায়, বেশ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় গরিব বস্তিবাসী এলাকায় ঘরে মজুত খাবারে টান পড়ে। সি পি আই (এম) কর্মীরা একদিকে এলাকা পাহারা অন্যদিকে ক্যাম্প করে খিচুড়ি রান্না করে গরিব বস্তিবাসী, আক্রান্তদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন। ঘরে আটকে থাকা শিশু, বৃদ্ধদের জন্য ওষুধের ব্যবস্থাও করেছিলেন তাঁরা।

সম্প্রীতি রক্ষার সেই লড়াই তখন এক অন্য উচ্চতার স্তরে যা মানুষের হৃদয়ে আজও যত্ন করেই রাখা।

 


 

তবু জেগে আছে বুক বেঁধে...

 

উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া। অনায়াসে দাঙ্গার আগুনে ছারখার হতে পারতোসে সময় বেলগাছিয়া মুসলিম বস্তি, কুন্ডু লেন, রেলওয়ে কলোনী মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের বাস ছিল। তার মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু দাঙ্গার আগুন স্পর্শ করতে পারেনি এই জনপদ। মন্দির, মসজিদের দেওয়ালে একটা আঁচড় পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। পার্টি, গনসংগঠন, শান্তি কমিটি, বস্তি ফেডারেশন তখন অক্লান্ত উদ্যমে ময়দানে, প্রায় এক সপ্তাহ ঘুম নেই যেন কারও। উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা ছিল বেলগাছিয়া আমন কমিটির। কারফিউ জারি হওয়ার ফলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে সি পি আই (এম) কর্মীরা তখন চাল, ডাল, মুড়ি কিনে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন।

এমনকি এই সু‍‌যোগে যাতে জিনিসপত্রের দাম যাতে বাড়তে না পারে তার জন্যও নেমেছিলেন সি পি আই (এম) কর্মীরা। জিনিস মজুত করে দাম বাড়ানোর ফাটকাকারবারীদের কৌশল ব্যর্থ করেছিল সেই লাল ঝান্ডাই। শুধু তাই নয় প্রবীনদের স্মৃতির পাতায় এখনও যেন রোদের উঁকিঝুঁকি। শুধু পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি নয় বেলগাছিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজ যাতে নির্বিঘ্নে কোয়ার্টারে ঝিলে স্নান করতে পারেন সে দিকেও নজর রাখতে হয়েছে।

দাঙ্গার আগুন এখানে নিভেছিল ঐতিহ্যের পরশে।

ট্যাংরার মতো উত্তেজনা প্রবণ এলাকায় এক অনন্য দৃশ্য হিন্দুস্থান গ্যাস মোড়, প্রভুরাম, সরকার লেন, পেমেন্টাল গার্ডেন লেনে রাস্তার মোড়ে দুধারে দাঁড়িয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন।পতাকা ছাড়াই। কোন পক্ষ থেকে যেন কেউ উত্তেজনা ছড়াতে না পারে। মুসমিল সম্প্রদায়ের মানুষ রক্ষা করেছেন হিন্দু গৃহবধূকে, মুসলিম শিশুর দুধ যোগাড় করেছে হিন্দু পরিবার, মন্দির মসজিদে উড়েছে শান্তি শ্বেতপতাকা।

এই দৃশ্যেরও সাক্ষী ছিল কলকাতা!!

১৫ই ডিসেম্বর কলকাতা ও হাওড়ার সিংহভাগ এলাকা থেকে উঠলো কারফিউ। মাত্র এক সপ্তাহে প্রায় তিন হাজারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী জ্যো‍‌তি বসুর কঠোরতম বার্তা, ‘‘পুলিশকে বলেছি হাঙ্গামাকারীরা কোন দল দেখার দরকার নেই। দলমতনির্বিশেষে সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এব্যাপারে আমরা সবাই সাহায্য করবো। কংগ্রেসকেও বলছি আপনারাও সাহায্য করুন। কারণ যারা হাঙ্গামা করছে তাদের রাজ‍‌নৈতিক পরিচ‌য়ের কোনো দরকার নেই, ওরা অপরাধী।’’

এই দৃঢ়তা দেখানোর জন্য কলজে দরকার। কোনো দুর্নীতিতে ফেঁসে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখাভিনয় করতে হয়নি বামপন্থীদের।

গণশক্তির পাতায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপ্লব দাশ্গুপ্তের উত্তর সম্পাদকীয়, ‘১৯৮৪ সালের শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রতিরোধের ক্লাইম্যাক্স হল সেই সত্তর হাজার মানুষের দীর্ঘ মহামিছিল যার পর সাম্প্রদায়িক শক্তি আর ফনা তুলতে পারেনি। আগামী ১৫ই ডিসেম্বরের মহামিছিল হোক আরও বড় আসুক হিন্দু, মুসলিম, শিখ সব অন্য সব মানুষ। মিছিলের জনতরঙ্গে, অসংখ্য মানুষের নিঃশব্দ ঘৃণার বীজ অগ্নি নিঃশ্বাসে পুড়ে যাক ওই অভিশপ্ত, ভয়ঙ্কর দাঙ্গার স্বপ্ন।

১৫ই ডিসেম্বর গোটা দেশ দেখেছিল এক ঐতিহাসিক মহামিছিল।

তৎকালীন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান শৈলেন দাশগুপ্তের আহ্বান, ‘অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি আমরা, আমাদের উত্তীর্ণ হতেই হবে।

ইতিহাস সাক্ষী সেই পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।

সময়ের ব্যবধানে আবার আমরা, আমাদের রাজ্য দেশ পরীক্ষার মুখে। উত্তীর্ণ হতেই হবে।

 


সেদিন কেন ব্যবস্থা নিলেন না সৌধ রক্ষার...

লিবেরহান কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন ‘...বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দুদিন আগে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলাম, চারদিক দিয়ে উদ্বেগজনক সব খবর আসছে। করসেবকরা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়ে। তবে উনি আমায় বলেন, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক আছে, সেখানে পরিস্থিতি আলোচনা করে তবে কেন্দ্রের তরফে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলো। মসজিদের কাঠামো মাটিতে মিশে গেলো, মানুষ দেখল তা। জানা গেছে বেশ কয়েকজন বি জে পি শীর্ষনেতা ঘটনাস্থলে ছিলেন। এখন তাঁদের কয়েকজন বি জে পি সরকারের মন্ত্রিসভাতেও রয়েছেন। এরপরে যখন হরকিষেন সিং সুরজিৎ আর আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম তখন জিজ্ঞাসা করি, কেন মসজিদ রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নিলেন না। উনি শুধু বললেন, আমি কী করে একজন মুখ্যমন্ত্রীকে (উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং) অবিশ্বাস করবো। উনি আমায় কথা দিয়েছেন সেরকম কিছু হবে না।

হয়েছিল ঠিক উল্টো।

 

দ্য মোস্ট সিভিলাইজড মেট্রোপলিস...

জীবনের জন্য আকুতি কী তীব্র হতে পারে, কী হৃদয়স্পর্শী হতে পারে তাঁর এক ছবিতেই তা দেখেছিল গোটা দেশ।বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের দুই সন্তান, স্ত্রীর প্রানভিক্ষার আর্তি,চোখে মুখে আতঙ্ক- ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছিল সেই একটি ছবি-ই। কুতুবুদ্দিন আনসারি। আশ্রয় পেয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গেই, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে এসেছিলেন এই শহরেই।২০১২ সালে গুজরাট নির্বাচনে প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। হাত ধরে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘আপনারা আক্রান্তকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ যেন এমনই থাকে, তা যেন গুজরাট না হয়

১৯৯৯ সাল।মুম্বাইতে বি জে পি-আর এস এস বাহিনীর মুখে আক্রান্ত বলিউডের কিংবদন্তী দিলীপ কুমার। এদেশের বুকে কমিউনিস্ট বিরোধী বলেই পরিচিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা পর্যন্ত ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় লিখল: ‘Dilip says he may be forced to abandon Mumbai and live else-where. If he wants to live in the most civilised metropolis in the country he come to Calcutta..’ অর্থাৎ স্টেটসম্যানের মত কাগজও লিখতে বাধ্য হয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির আস্ফালন থেকে যদি রক্ষা পেতে হয় তবে পশ্চিমবঙ্গই আদর্শ আশ্রয়স্থল। তখন রাজ্য বামফ্রন্ট সরকার।

এই ঐতিহ্য-ই আমাদের গর্ব।আমাদের শ্লাঘা বোধ। তা রক্ষা করাই সময়ের ডাক।

 

আজকের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা...

সেই ঐতিহ্যের মাটিতেই গো-রক্ষার নামে ধূপগুড়িতে ১৯ বছর বয়সী দুই কিশোরকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাটের মত এরাজ্যেও গো-রক্ষার ব্যানারে মানুষ খুন। ধূপগুড়ির ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সহ মোট ছয় জন। এই ঘটনায় মোট ৬জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এস এসর চারজন, তৃণমূলের ২জন। ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার এক মডেল হয়ে উঠছে বাংলা।

ইতিহাসের পাতায় লেপ্টে থাকা সাম্প্রদায়িক অশান্তি ঠেকানোর বামপন্থীদের এই ভূমিকার পাশেই আজকের বসিরহাট থেকে ধূলাগড় হয়ে ক্যানিং। রাজ্যে তৃণমূল সরকার। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কৌশলী রাজনীতি নিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতাকে রোখা যায় না তা স্পষ্ট হচ্ছে বারেবারে।

খাস কলকাতা বন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনজনকেই। তিনজনেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী,  একজন আবার  হরিমোহন ঘোষ কলেজের তৃণমূলী ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। তিনজনে বিরুদ্ধেই ছিল মারাত্মক অভিযোগ- পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আই এস আই-র এজেন্ট হিসাবে কাজ করার।

আবার, গত দুবছরে শারদোৎসবের পরে বিসর্জন ও মহরমের ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানিতে রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় রীতিমত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, কোথাও কোথাও তা সংঘর্ষের চেহারা নেয়। যেমন নৈহাটির হাজিনগর। ২০১৫ সালে এই ঘটনাতেও পুলিশ বাধ্য হয় এক কাউন্সিলর তৃণমূলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করতে। যদিও রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোনে দুর্বল মামলা রুজু করে তাদেরও ছেড়েও দেওয়া হয়।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল যখন বি জে পি-কে রাজনৈতিকভাবে অচ্ছুৎবলেছিলো, তখন কংগ্রেসের ভিতরে থেকেও মমতা ব্যানার্জি বি জে পি-কে অচ্ছুৎ বলতে চাননি। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরির পরেই হাত মিলিয়েছিলেন বি জে পি-র সঙ্গে।২০০৩ সা‌লে ১৫ই সেপ্টেম্বর নয়া‌দি‌ল্লি‌তে আর এস এস-এর মুখপত্র পাঞ্চজন্য’-কমিউনিস্ট টেররিজমনামে সংকলন প্রকাশ অনুষ্ঠা‌নে মমতা ব্যানার্জিট সগর্ব ঘোষনা , ‘‘ক‌মিউনিস্ট‌দের বিরু‌দ্ধে আপনা‌দের লড়াই‌য়ে আমরা আ‌ছি। য‌দি আপনারা আমায় ১শতাংশ সাহায্য ক‌রেন, আমরা ক‌মিউনি স্ট‌দের সরা‌তে পার‌বো..আপনারাই হলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।‌বি‌ জে পি-র তৎকা‌লীন রাজ্যসভা সাংসদ বলবীর পুঞ্জ প্রত্যুত্তরে ব‌লেছিলেন,‘‘আমা‌দের প্রিয় মমতাদি‌দি সাক্ষাৎ দুর্গা

২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে এসেছে। এর মাঝে শাসকদল হিসাবেই  ৬ই ডিসেম্বর গান্ধীমূর্তির সামনে সভা করেন মমতা ব্যানার্জি। ৬ই ডিসেম্বরের সভা অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংস, আর এস এস এবং বি জে পি-র ভূমিকা অনুচ্চারিত রেখে দেওয়া- সম্ভবত এদেশের বুকে মমতা ব্যানার্জিই তা করে দেখাতে পেরেছেন। বাজপেয়ী অসাম্প্রদায়িক লোক/আদবানী কট্টর লোকআদবানী ভালো লোক/মোদী খারাপ লোকমোদী ভালো লোক/অমিত শাখারাপ লোকখবরের কাগজের পাতায় মমতা ব্যানার্জির বি জে পিবিরোধী অবস্থানের চেহারা এটাই।

শাসকদলের সন্ত্রাস, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত বিরোধী দল মূলত সি পি আই (এম)। সি পি আই(এম)-কে এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে, একইসঙ্গে এরাজ্যে আর এস এস-র এলাকা বাড়ছে। সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা গত পাঁচ বছরে এরাজ্যে বেড়েছে ১৫৭শতাংশ! নাগপুর থেকেও এসেছে অভিনন্দন বার্তা, পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই সম্ভাবনাময়হয়ে উঠছে! বীরভূম থেকে পূর্ব মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার থেকে নদীয়া, হুগলী- সি পি আই (এম) বিরোধী সন্ত্রাসের জমি-ই মোহন ভগবতদের আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিচ্ছে।

তৃণমূলেরই প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর লেখা অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স-এ মমতা ব্যানার্জি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুখোশ বেআব্রু হয়েছে। গুজরাট দাঙ্গা আমার সামনে এক ব্যক্তিগত সঙ্কট তৈরি করে দেয়...কিন্তু আমার দলে আমি ছিলাম একা। এই প্রশ্নে মমতার দুমুখো আচরণে আমি হতাশ ছিলাম..ওকে সবাই ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলিম দরদী বলেই জানত। কিন্তু গুজরাট সঙ্কটের তাৎপর্য ও কেন বুঝতে পারছিল না বা বুঝতে চাইছিলো না, তা আমার কাছে ছিল রহস্য

সেই রহস্য আজ বেআব্রু হয়েছে।

                          ****************************

 

বারেবারে জ্যোতি বসু বলেছেন, তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ এরাজ্যে বি জে পিকে নিয়ে আসা

নাগপুরে আর এস এসর প্রধান দপ্তর কেশবভবন থেকে যেমন দেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া যাবেনা তেমনি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে এরাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইকেও চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে না।