20170211

দিশাহীন, ভাঁওতাসর্বস্ব, দেউলিয়া বাজেট: সূর্য মিশ্র





শুক্রবার বিধানসভায় তৃণমূল সরকারের পেশ করা ২০১৭-১৮ সালের রাজ্য বাজেট সম্পর্কে এক প্রতিক্রিয়ায় সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন:

‘‘একটা দিশাহীন, ভাঁওতাসর্বস্ব, দেউলিয়া বাজেট।

বেকার যুবক-যুবতীদের আগামীদিনে কর্মসংস্থান সম্পর্কে এই বাজেটে কোনও দিশাই দেখানো হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী যে কর্মসংস্থান করার এত হিসেব দেন, সেসব কোথায় গেলো? এটা স্পষ্ট, ওঁর প্রতিশ্রুতির কোনও মূল্য নেই। সবই ভাঁওতা।

চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর লুটের টাকা উদ্ধার সম্পর্কেও কোনও কথা নেই এই বাজেটে।

আই সি ডি এস এবং আশা কর্মীদের ভাতা কিছুটা বাড়ানো হলেও তাঁদের অবসরের সময় এককালীন অনুদান দেওয়া এবং কাজের নিরাপত্তা সম্পর্কে, কর্মক্ষেত্রে যে আক্রমণ নেমে আসছে, সেগুলি মোকাবিলা করার কোনও কথা বলা হয়নি। ভাতা আংশিক বৃদ্ধি এই কর্মীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের জয়। অন্যদিকে, অন্যান্য স্কিম ওয়ার্কাস বা প্রকল্পভিত্তিক কর্মীদের ভাতা বৃদ্ধি সম্পর্কে বাজেটে উচ্চবাচ্য করা হয়নি। প্যারা টিচার, এস এস কে, এম এস কে, সিভিক ভলান্টিয়ার্স ইত্যাদি কর্মীদের ভাতাবৃদ্ধি সম্পর্কে বাজেট নিশ্চুপ। বামফ্রন্ট সরকারের সময় যে সুবিধা এরা পেতেন, তা এখন পাচ্ছেন না। বামফ্রন্ট সরকার এই সমস্ত কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা দিয়েছিল, ছাঁটাই না হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। একইসঙ্গে, নিয়মিত ভাতা বাড়ানো হচ্ছিলো। সেসব এখন হচ্ছে না।

রাজ্য সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীসহ অন্যান্য কর্মীদের যে বিপুল পরিমাণ মহার্ঘ ভাতা বকেয়া আছে, তার কী হলো? বাজেটে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার সময় রাজ্যের ওপর ঋণ ছিল ১লক্ষ ৮৬হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শুধু তৃণমূল সরকারের আমলে মাত্র ৬বছরেই ঋণ নেওয়া হচ্ছে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। বাজেটের বাইরে এবং পরিকল্পনা-বহির্ভূত যে বিপুল পরিমাণ খরচ করা হচ্ছে, তার জন্যই এইভাবে বেপরোয়া ঋণ নেওয়া হচ্ছে।

কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য ফসলের সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা, কৃষিবীমা সম্পর্কে কোনও উল্লেখই নেই এই বাজেটে। বন্ধ কল-কারখানা, বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য কোনও কথা নেই। তফশিলী জাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের কোনও দিশা দেখাতে পারেনি তৃণমূল সরকার। খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্পর্কেও কোনও বার্তা নেই।

আমরা এই বাজেটের তীব্র বিরোধিতা করছি।

শ্রমিক-কৃষক, বেকার যুবক-যুবতী, মহিলা, চিট ফান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী, তফশিলী জাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থে, তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে আমাদের লড়াই জারি থাকবে।’’


১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

রাজ্য বাজেটে মূল বিষয়গুলির উত্তর নেই, আছে অনেক বিভ্রান্তি


ড. অসীম দাশগুপ্ত

এবারের রাজ্য বাজেটে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই উত্তর নেই, কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা আছে। আমরা কিছু মূল বিষয় ও বিভ্রান্তির ওপর আমাদের বক্তব্য রাখছি।

১. কর্মসংস্থান
এই বাজেটে একেবারে শেষের পাতায় হঠাৎই বলা হয়েছে, এই ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে এ-রাজ্যে ১৩.২৭ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে (পৃঃ ৩৬)। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী সমগ্র দেশে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১.৫ লক্ষেরও কম। তাহলে এক‍‌টি রাজ্যে কিভাবে ১৩.২৭ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে? উত্তর নেই। এই বিষয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলো জানা যে, রাজ্যের কোন কোন ক্ষেত্রে (যথা, কৃষি, শিল্প, পরিষেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে) কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো জেলাওয়াড়ি তথ্য আছে? পুনরায় উত্তর নেই। তাহলে এই ভিত্তিহীন এবং তথ্যহীন দাবিটি হঠাৎ বাজেটের শেষে একটা বিচ্ছিন্ন পংক্তিতে বলে বেকার যুবক-যুবতীদের মনে কেন এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হলো?

২. শিল্পে বিনিয়োগ
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অবশ্যই নির্ভর করে রাজ্যে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত বিনিয়োগের ওপর। এখানে লক্ষণীয় যে, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের প্রথম দুবছরের আর্থিক সমীক্ষারই ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬.৬ সারণির তথ্যাবলী অনুযায়ী, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে ২০১০ সালে যেখানে সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে ৩২২টি নতুন শিল্প সংস্থায় ১৫,০৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়ে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়েছিল, সেখানে তৃণমূল সরকার আসার পর ২০১২ সালে নতুন চালু হওয়া শিল্প সংস্থার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১২টিতে, এবং বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়ায় ৩১২ কোটি টাকায়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, এর ঠিক পরের বছরগুলি থেকে বর্তমান বছর পর্যন্ত রাজ্যের আর্থিক সমীক্ষায় এই সারণিটিই উধাও করে দেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে একটি নতুন সারণি বা পরিচ্ছেদ এনে (এ-বছরে পরিচ্ছেদ ৮.৩) নির্মীয়মাণ শিল্প এবং নির্মিত শিল্প একত্রিত করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু কত পরিমাণ বিনিয়োগ কত নির্মিত শিল্প সংস্থাতে বাস্তবায়িত হয়েছে তা কিছুতেই জানানো হচ্ছে না। এত গোপনীয়তা কেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন শিল্পে বাস্তবায়িত বিনিয়োগের তথ্য না থাকলে কিভাবে রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির দাবি করা হচ্ছে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে?

৩. কর রাজস্ব আদায়
রাজ্যের কর রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দাবি করা হয়েছে যে ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ২০১০-১২ সালের তুলনায়, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণের সামান্য বেশি। কিন্তু যা বলা হয়নি, তাহলো, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পাঁচ বছরেও রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১০,৮৮৮ কোটি টাকা থেকে ২১,২২৩ কোটি টাকা, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এটাও বলা হয়নি যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই রাজ্যগুলিতে মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট) চালু হয়েছিল, যেখানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার, এবং যা প্রত্যেক রাজ্যেই কর রাজস্ব বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। এছাড়া, কর রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। আত্মপ্রচারের তাগিদে তাও উহ্য রাখা হয়েছে এবারের বাজেট বিবৃতিতে।

৪. পরিকল্পনা ব্যয়
এই বাজেটে বলা হয়েছে রাজ্যের পরিকল্পনা খাতে ব্যয় ২০১০-১১ এর তুলনায় ২০১৬-১৭-তে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেতে চলেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ চিত্রটি একটু ভিন্ন। সাধারণত এরাজ্যে পরিকল্পনা ব্যয় প্রতি চার বছরের সময়ে দ্বিগুণের মতন বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে, ২০০৯-১০ সালে রাজ্যে যে পরিকল্পনা ব্যয় ছিল ১২,১২১ কোটি টাকা, তা পরের চার বছরে ২০১৩-১৪ সালে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ২৪,১০৭ কোটি টাকায়। কিন্তু ঠিক তার পরের বছরেই অর্থাৎ ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়কে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে দেখানো হল ৪৪,০৪৪ কোটি টাকায়। এবং এখন আগাম বলা হচ্ছে ২০১৬-১৭ সালে তা বৃদ্ধি পাবে ৬ গুণ। এটা কি করে  সম্ভব হচ্ছে? আমরা জানি যে, কেন্দ্রীয় সহায়তাভিত্তিক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ব্যয়ের একটি অংশ দেয় রাজ্য সরকার, এবং বাকিটা প্রদান করে কেন্দ্রীয় সরকার। উদাহরণ হিসেবে, যদি কোনো পরিকল্পনা ব্যয়ের ২৫% দেয় রাজ্য সরকার তাহলে বাকি ৭৫% দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অর্থ সরকারের প্রদেয় এই অর্থ কেন্দ্রীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং রাজ্য সরকারের প্রদেয় অর্থটি  রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়ের অংশ হবে।। কিন্তু গত ২ বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি যে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ৭৫% অর্থও রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে যুক্ত করে দিয়ে এত বেশি পরিকল্পনা ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু  পদ্ধতির এই পরিবর্তনের কথা রাজ্য সরকার খোলাখুলি বলছেন না কেন? খোলাখুলি না বলে, উহ্য রেখে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে চাইছেন কেন?

৫. রাজ্য সরকারের ঋণের বোঝা
এই বাজেটে বলা হয়েছে, ২০০৬-০৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার যে ঋণ নিয়েছিল ১০ বছর পরে এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে ইত্যাদি। আমরা বারংবার বলেছি যে রাজ্য সরকারের ঋণের বোঝার মূল কারণ হলো, স্বল্প সঞ্চয় সংক্রান্ত ঋণ। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প রাজ্য সরকারের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। এই প্রকল্পে যে নিয়ম কেন্দ্রীয় সরকার স্থির করেছে, তাহলো কোনো একটি বছর রাজ্যের সাধারণ মানুষ স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে যে অর্থ জমাবেন, তার ৮০% অর্থ বাধ্যতামূলকভাবেই রাজ্য সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে খুব চড়া সুদে। যেহেতু স্বল্প সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এরাজ্যের স্থান হয়েছিল প্রথম, তাই কেন্দ্রের নিয়মে এই খাতে চাপানো ঋণই বড় বোঝা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওপর। এই ঋণের বিষয়ে রাজ্য সরকারের কোনো যোগ নেই, তাই কেন্দ্রের এই চাপানো ঋণের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজ্যই বারংবার দাবি জানিয়েছে। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার বলার পরও এই ঋণের বোঝা রয়েই গেছে। এই ঋণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর মূলধনের অংশটি ফেরত দিতে হয় ছবছরের পর থেকে, এবং ২০ বছর ধরে। এই বিষয়টি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির সংশ্লিষ্টসকলেই জানে, এবং তৃণমূল সরকারেরও জানা উচিত কারণ এই কেন্দ্রীয় নিয়মগুলি যখন লাগু করা হয় তখন তারাও কেন্দ্রীয় সরকারের অংশীদার। এই প্রেক্ষিতটা না বলে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার মানে হলো, হয় এই তৃণমূল সরকার এর প্রেক্ষিতটা জানে না, অথবা জানলেও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

৬. চিট ফান্ডের প্রসঙ্গ
যখন কালো টাকা উদ্ধারের কথা উত্থাপিত হয়েছে, তখন মনে রাখা উচিত, নিয়ম ভেঙে চিট ফান্ডগুলির লুট করা টাকা এবং তাদের থেকে পুনরায় ভাগ বসানো অর্থ উভয়ই হলো কালো টাকা। এই মোট কালো টাকা  উদ্ধার করে সঞ্চয়ীদের কাছে ফেরত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকদেরও (দুটি স্তরেই) শাস্তি প্রদানের বিষয়টিতে বিস্ময়করভাবে একেবারে নীরব থেকে গেছে এই রাজ্য বাজেট।

৭. অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়
আই সি ডি এস প্রকল্পের ক্ষেত্রে কর্মীদের সহায়তা করার প্রসঙ্গে বলা উচিত, অসংগঠিত অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই সমস্ত-কর্মীদের (আই সি ডি এস, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, শিশু শিক্ষাকেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের সহায়িকা ও সম্প্রসারিকা এবং অন্যান্যদেরও)  ভাতার বিষয়ে একটি নতুন প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, যেখানে সহায়তা প্রদানের পরিমাণ প্রতি ৩ বছর অন্তরই বৃদ্ধি পাবে।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি যে প্রশ্ন উঠছে, বিশেষ করে সরকারি কর্মী ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে, তাহলো বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বছরে যে অন্তত দুবার মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হতো তার কী হলো? এছাড়া, যে রাজ্য বেতন কমিশন গঠিত হয়েছে তারাই বা কবে সুপারিশ জমা দেবে এবং রাজ্য সরকারই বা কবে সিদ্ধান্ত নেবে? এই বিষয়গুলির ওপর কোনো উত্তর নেই এই বাজেটে, এবং নেই কোনো বাজেট বরাদ্দের ইঙ্গিতও।


গণশক্তি, ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

20170204

বাজেটেও জুমলা

 

সীতারাম ইয়েচুরি

বাজেটেও জুমলা। প্রধানমন্ত্রী, বি জে পি সভাপতির মতো অর্থমন্ত্রীও বাগাড়ম্বরেই মত্ত। মঙ্গলবার পেশ করা আর্থিক সমীক্ষায় স্পষ্টই বলা হয়েছে নোট বাতিলের ধাক্কায় অর্থনৈতিক বিকাশের হার কমবে। তা ৬.৫শতাংশের মতো হবে। অর্থনীতি শ্লথ অবস্থায় চলছে। আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে বিশ্ব সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে তাকাতে হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির দিকে। তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। 

বুধবারের বাজেট ঠিক উলটো পথে হাঁটলো। চাহিদা ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণের বদলে সংকোচন করা হয়েছে। বাজেটের মোট আয়তনই কমে গেছে। বাজেটের মোট আয়তন গত আর্থিক বর্ষে ছিলো মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১৩.৪শতাংশ, তা এবারে কমে হয়েছে ১২.৭ শতাংশ। রাজস্ব ব্যয় কমেছে। অরুণ জেটলি দাবি করেছেন পরিবহন-সহ পরিকাঠামোয় উন্নয়ন ঘটানো হবে, তার ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে। অথচ প্রকৃত হিসেবে দেখা যাচ্ছে মূলধনী ব্যয় কমে গেছে। গত বছরে যা ছিলো ১.৮৬শতাংশ, এবারে রেলকে ঢুকিয়েও তা ১.৮৪শতাংশ। রেলকে বাদ দিলে মাত্র ১.৫১শতাংশ। চাহিদা কোথা থেকে বাড়বে?

অর্থনৈতিক সমীক্ষা এবং জাতীয় লেবার ব্যুরোর সমীক্ষায় দেখা গেছে শ্রমনিবিড় ৮টি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অন্তত ৫৫ হাজার কম কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে যদি মূলধনী ব্যয় কমে তাহলে কর্মসংস্থান আরো সংকটে পড়বে।

রেগার হিসেব দেখলেও বোঝা যাচ্ছে বরাদ্দ আদৌ বাড়েনি। মুদ্রাস্ফীতির হিসাব ধরলে রেগার বরাদ্দ যা ছিলো তা-ই রয়ে গেছে। বাগাড়ম্বরই সার, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের এই প্রকল্পও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

সরকার দাবি করছে কোষাগারীয় ঘাটতি কমিয়ে আনা হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী ভাষণে যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন আর বাজেটের নথিতে যা লেখা আছে তা পৃথক। কোষাগারীয় ঘাটতি কমেছে কীভাবে? পেট্রোপণ্যে অন্তঃশুল্ক থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কমেছে, তখন অন্তঃশুল্কের কারণেই ভারতে তা বেড়েই চলেছে। এ থেকেই সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে রাজস্ব আয় বাজেট অনুমানের তুলনায় কম হয়েছে। এও প্রমাণ করছে অর্থনীতিতে সংকোচন চলছে। এখন রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে জনগণের ওপরে বোঝা চাপানো হচ্ছে। প্রায় ৬০হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপানো হয়েছে।

নোট বাতিলের পূর্ণ ফলাফল এখনও বোঝা যায়নি। তা আরো প্রভাব ফেলবে। সরকার ব্যাঙ্কের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে। ১১লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ রয়েছে কর্পোরেটের কাছে। তা আদায় করার জন্য কেন্দ্রের কোনো উদ্যোগ নেই। যাঁরা বিদেশে পালিয়েছেন শুধু তাঁদের কথা বলা হচ্ছেদেশের মধ্যে থেকেই বহাল তবিয়তে মুনাফা করে চলেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা? বরং কর্পোরেটদের জন্য রাজস্ব ছাড়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

সরকারের উদ্দেশ্য দেশি-বিদেশি পুঁজিকে ছাড় দেওয়া। এফ আই পি বি ছিলো বিদেশি বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তা তুলে দেওয়া হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় পথে বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমেই বাড়ছিল। এখন আর বিদেশি পুঁজির জন্য কোনো নিয়ন্ত্রণই রইলো না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিদেশি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিদেশি বেসরকারি পুঁজি এবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাও কিনবে।


সীতারাম ইয়েচুরি সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক 

সাধারণ মানুষের সমস্যা প্রশমনে ব্যর্থ এই কেন্দ্রীয় সরকার

ড. অসীম দাশগুপ্ত

কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। নোট বাতিলের পর এই কেন্দ্রীয় বাজেটের দিকে তাকিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু কী পাওয়া গেল এই বাজেট থেকে? আশার বাণী ছাড়া আর কিছু কি মিলবে? নাকি বাড়বে সাধারণ মানু‍‌ষের ওপর বোঝা? সেই বিশ্লেষণই রয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের কলামে।

গণশক্তি, ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

কেন্দ্রীয় বাজেট শুধুমাত্র সর্বভারতীয় স্তরে ভারত সরকারের আয় ও ব্যয়ের যান্ত্রিক হিসেব নয়। এই হিসেবের পিছনে যে লক্ষ্যগুলি আছে তা সাধারণ মানুষ জানতে চান, এবং জানতে চান স্বচ্ছতার সঙ্গে। বুঝে নিতে চান এই বাজেটের মাধ্যমে তাঁদের সমস্যাগুলির কতটুকু প্রশমন সম্ভব হবে।

এই সমস্যাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জ্বলন্ত হলো বেকারত্বের সমস্যা। বি জে পির নেতৃত্বে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গত প্রায় তিন বছর ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, প্রতি বছর সমগ্র দেশে নতুন করে অতিরিক্ত ২ কোটি বেকার যুবক-যুবতীর কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু এই সময়কালেই কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে প্রতি বছরে বাস্তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেক কম৫ লক্ষেরও কম, এবং বর্তমান বছরে, বিশেষ করে এই কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর কৃষি, অসংগঠিত শিল্প এবং ‍‍‌ছোট ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই কর্মসংস্থানের পরিমাণ আরো হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৫ লক্ষের মতো। তাই এই কেন্দ্রীয় বাজেটে উচিত ছিল প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে ২০১৬-১৭ সালে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপযুক্ত লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা এবং সেই লক্ষ্যমাত্রাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প ও পরিষেবার ক্ষেত্রে সেই লক্ষ্যমাত্রা ভেঙে ভেঙে দেখানো, এবং বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব, তাও স্বচ্ছতার স‍‌ঙ্গে বলা। কিন্তু এই বাজেটের কোথাও এই লক্ষ্যমাত্রা বা পরবর্তী পদক্ষেপগুলির উল্লেখ নেই। অর্থাৎ নোট বাতিলের মাধ্যমে বেকারত্বের এই সমস্যাটির আরও ব্যাপকভাবে সৃষ্টি করার পর তা প্রশমনের সম্বন্ধে উপলব্ধি করতেই ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সরকারের এই বাজেট।

এই বছরে আরেকটি বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কারণে। যেহেতু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় (৮ই নভেম্বর, ২০১৬) বলা হয়েছিল এই পদক্ষেপের পিছনে প্রধান কারণ কালো টাকা উদ্ধার করা, তাই এই সিদ্ধান্তের ফলে শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়, প্রতিদিন ব্যাঙ্ক এবং এ টি এমের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়েছেন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এবং মারাও গেছেন ১০০জনের বেশি ব্যক্তি। তাই এই বাজেটে উচিত ছিল যে, যার জন্য মানুষের এত ক্ষতি স্বীকার সেই কালো টাকার কত পরিমাণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে জানানো এবং কত দিনের মধ্যে নগদ টাকার চাহিদার এবং জোগানের মধ্যে ভারসাম্য স্বাভাবিক হবে, তারও নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া। কিন্তু এই দুটি প্রশ্নেরই কোনো উত্তর পাওয়া গেল না এবারের বাজেটে।

বর্তমান এই বাজেট পেশ করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকেই প্রত্যাশা সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, সমস্ত দরিদ্র মানুষের জন্য একটি ন্যূনতম আয়ের সংস্থানের প্রকল্পের কথা চিন্তা করা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত এবছরের আর্থিক সমীক্ষা (২০১৭, পৃঃ ১৭৩-১৯৫)তে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প চালু করা হোক, অথবা অন্তত আলোচনার জন্য পেশ করা হোক। যেহেতু অর্থমন্ত্রকই এই সমীক্ষার দায়িত্বে থাকে, তাই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বিবৃতিতে কোথাও এই প্রকল্পের উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল এর কোনো উল্লেখই নেই। অর্থাৎ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মন্ত্রকের ভিতরেই রয়েছে সমন্বয়হীনতা।

প্রতি বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট ব্যয়কে পরিকল্পনা খাতে ব্যয় (অর্থাৎ নতুন প্রকল্পগুলির জন্য ব্যয়) এবং পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে (অর্থাৎ চালু প্রকল্প, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয়) আলাদা করে দেখানো হতোএবং এটাই উচিত। এবারই প্রথম দেখা গেলো পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়কে মিশিয়ে দেখানো হয়েছে। এরফলে শুধু নতুন প্রকল্পগুলির ব্যয়ের আলোচনার গুরুত্ব কম হয়েছে তাই নয়, বাড়তি অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে যে আগেকার বছরগুলির সঙ্গে আগামী বছরের পরিকল্পনা খাতে বাজেট বরাদ্দ সঠিকভাবে তুলনাই করা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এবারের বাজেটে দেখা গেল, প্রত্যেকটি মন্ত্রকের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ না করে কতকগুলি মন্ত্রকের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই বাজেট বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও বলা প্রয়োজন যে, কর্মসংস্থানের বিষয়ে প্রকল্প হিসেবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, সেখানে বর্তমান বছরে যে বরাদ্দ ছিল ৪৭,৪৯৯ কোটি টাকা তার থেকে আগামী বছরে অত্যন্ত সামান্য বৃদ্ধি করে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৪৮,০০০ কোটি টাকা। অন্যান্য কর্মসংস্থান প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একইভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে অনুরূপভাবে সামান্য। অর্থাৎ বি জে পি-র আমলে যেখানে বেকারত্বের বৃদ্ধি হয়ে তীব্রভাবে, এবং বিশেষ করে বর্তমান বছরে, সেখানে এই বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হলো না।

এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে এই প্রথম রেল বাজেটকে সাধারণ কেন্দ্রীয় বাজেটের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরফলে ভারতীয় রেলের প্রত্যেকটি রাজ্যের যে সুবিধা অসুবিধা তা উল্লেখ করার কোনো জায়গাই থাকলো না এই বাজেটে।

এছাড়া, এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের করদাতাদের ছাড়ের হিসেব যেখানে মোট ২০,০০০ কোটি টাকা, সেখানে তাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা হিসেবে চাপবে প্রায় ৭৫,০০০ কোটি টাকার পরোক্ষ কর। অর্থাৎ, এই বাজেটের আয় ও ব্যয়ের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা একত্রিত করলে আপেক্ষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ।


সর্বোপরি, এবারের বাজেটে কোনো উল্লেখ নেই যে, প্রতি বছর মোট কর ছাড়ের মাধ্যমে যে ৫ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম থাকছে তার একটি অংশও আদায় করা গেলে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কর্মসংস্থানের প্রকল্পগুলির জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত, এবং সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের প্রকল্পটিও, কিছুটা হলেও, শুরু করা যেত।