20161101

বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পায়ন কর্মসূচী — দু-চার কথা

স্বপন সিনহা

বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট পরাজিত হওয়ার ফলে ৩৪ বছর পর বামবিরোধীরা রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এই পরিবর্তনে নিশ্চয় আশা করা হয়েছিল নতুন সরকার জনগণের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করবে এবং বিরোধীরা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট থাকবে।

যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বামফ্রন্ট সরকারের সময় বিশেষ করে শেষের কয়েক বছর বর্তমান শাসকদল বিরোধীপক্ষে থাকাকালীন সংঘটিত করে সেই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি যে বামপন্থীরা করবে না এটা সাধারণ উপলব্ধি। বামফ্রন্ট মানুষের সেই বিশ্বাসের প্রতি যথাযথ মর্যাদা অবশ্যই রাখতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান শাসকদল? মানুষের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা এই যে নির্লজ্জ দলবাজি, ব্যাপক দুর্নীতি, চরম অগণতান্ত্রিক আচরণ, সীমাহীন ঔদ্ধত্য অপদার্থতা এবং শুধুমাত্র আত্মপ্রচারের ঢাক পেটানো ছাড়া উল্লেখ করার মতো একটা কাজও তারা করে দেখাতে পারেনি। বিশেষ করে নতুন শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে নিজেদের চরম ব্যর্থতা ঢাকতে তারা প্রচার চালাতে চেষ্টা করছে যে, ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট শিল্পের ব্যাপারে কিছুই করেনি। সেই কারণে বাকি রাজ্য শিল্পের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। বামফ্রন্ট বিরোধী মহল থেকে প্রধানত দুটি বিষয় আগেও তোলা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। প্রথমত, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য বামফ্রন্ট শিল্পায়নের শোরগোল তোলে কিন্ত কার্যত কিছুই করেনি। দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্ট একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের উদার অর্থনৈতিক নীতি শিল্পনীতির বিরোধিতা করেছে অন্যদিকে সেই একই নীতিই তারা পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর করেছে। সেই কারণে বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যারা সেই সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন তাদের অবগতির প্রয়োজনে প্রসঙ্গে কিছু আলোচনার উদ্দেশ্যে বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।

মানবজীবনের মহত্তম লক্ষ্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ দেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অনুপ্রেরণা থেকেই মার্কসবাদীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া। তাদের প্রতিটি পদ‍‌ক্ষেপ, প্রতিটি কর্মসূচী মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য। ইতিহাসের গতিশীল অনুধাবন প্রক্রিয়া আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মার্কসবাদ কোন কাল্পনিক ধারণা নয়। এটি বিজ্ঞান এবং গতিশীল বিজ্ঞান। প্রতিটি দেশকালের বাস্তব অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ করেই তার প্রয়োগ করতে হয় মার্কসবাদীরা সেই সৃজনশীল কাজেই নিয়োজিত। তারা জানে গোটা ভারতে এক ধরনের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল বিরাজ করলে পশ্চিমবাংলা তার থেকে খুব বেশি আলাদাভাবে কাজ করতে পারে না। সারা দেশে গঙ্গার জল যদি দূষিত হয়, যদি হরিদ্বার, বারাণসী এবং পাটনার ঘাটে ঘোলা জল বয়ে যায় তাহলে কি কলকাতার বাবুঘাটে ফিলটার ওয়াটার পাওয়া সম্ভব? যেটা করা যেতে পারে তা হলো ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদি ছড়িয়ে জলকে খানিকটা পরিশুদ্ধ করা এবং সমগ্র গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা। এই রূঢ় বাস্তবকে সামনে রেখেই বামপন্থীরা বিভিন্নভাবে তাদের কার্যক্রমকে পরিচালিত করতে সচেষ্ট থেকে‍‌ছে। একদিকে কেন্দ্রীয় সর্বনাশা উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করা অন্যদিকে রাজ্যে যেটুকু সম্ভব শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ। এক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অবকাশটা কোথায়? একে স্ববিরোধিতা বলে না। এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত প্রক্রিয়া।

৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট এরাজ্যে সরকার পরিচালনা করেছে। মামুলী ধরনের বা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সরকার ছিল না এটা। লক্ষ মানুষের ঘাম, রক্ত, অশ্রু এবং সহস্র শহীদের আত্মত্যাগ আর অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের ফসল এই বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট এক নীতি আদর্শভিত্তিক কর্মসূচী সংগ্রামের এক সুনির্দিষ্ট রূপ। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার তার পরিকল্পনা, তার বাজেটের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। এর ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকেই বামফ্রন্ট। গ্যাটচুক্তির প্রধান সারমর্মই রাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব করা। গ্যাট পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বলতে এতদিন যা বোঝাতো তা আর প্রাসঙ্গিক রইলো না। শিল্প-বাণিজ্য তথা স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে এই পর্যায়ে দারুণভাবে আঘাত হানার চেষ্টা হয়েছে যা প্রতিহত করার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা কংগ্রেস থেকে বি জে পি-জোট কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল না। বিদেশী ঋণের শর্তাবলীর কারণে নির্বিচারে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেশীয় বাজারে বিদেশী পণ্যের ব্যাপক প্রবেশের পথ খুলে দেওয়া হয়। এরফলে বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান অর্থাৎ বাণিজ্যঘাটতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, অনুসৃত এই নয়া উদারনীতি অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে বিদেশী বহুজাতিকদের সাম‍‌নে দেশীয় শিল্প সংস্থাগুলিকে এক অসমান প্রতিযোগিতার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে সামগ্রিকভাবে ধ্বংসের মুখে দাঁড়ায় দেশীয় শিল্প। এই রকম এক পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধ নিয়ে সঙ্কটজর্জরিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার তার শিল্পায়ন কর্মসূচী রূপায়ণের চেষ্টা করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির সাথে রাজ্য সরকার গৃহীত নীতির পার্থক্যটা কোথায়?

এটা সকলেরই জানা যে, এরাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে এক নির্দিষ্ট আর্থিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিগুলি খাতায় কলমে থাকলেও রাজ্যগুলি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা পায়নি। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার তার নিজস্ব শ্রেণীস্বার্থেই দীর্ঘদিন ধরে এক বৈরী মনোভাব নেওয়ায় এরাজ্য বিশেষ অসুবিধা ভোগ করেছে। এছাড়া পশ্চিমবাংলার ভয়াবহ বেকারসমস্যা এবং তার সমাধানে কেন্দ্রের অসহযোগিতা এবং শত সহস্র বাধানিষেধের কথাও কারও অজানা নয়। তা সত্ত্বেও এই বাস্তব অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যে নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সু‍‌যোগ সম্ভাবনা সৃষ্টির যথাসাধ্য আন্তরিক প্রয়াস রাখার সাথে সাথে বামফ্রন্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে যে, যেহেতু দেশের পরিকল্পনা অর্থনৈতিক সমন্বয়ের মূল ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে, সেইজন্য তাদের নীতি হলো অর্থনীতি পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানানো, কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা রচয়িতাদের কাছে তাদের বিকল্পনীতিগুলি উপস্থিত করা এবং জনসাধারণের চরম দুর্দশা লাঘব করার প্রচেষ্টা চালানো। সাথে সাথে তারা এও বলে যে, সেই কারণে তারা কখনওই একটা নেতিবাচক অবস্থান নিতে পারে না এবং যেহেতু পশ্চিমবাংলায় একটা বামপন্থী সরকার রাজ্যশাসন করছে সেহেতু বেসরকারী পুঁজি এরাজ্যে লগ্নি হবে না এটাও হতে পারে না।
সাতের দশকে ভারতের অর্থনীতি একটার পর একটা সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারী জনসাধারণের দুর্দশা সীমাহীনভাবে বেড়েছে। জরুরী অবস্থাকালে কোন না কোন সময়ে লে-অফ, ছাঁটাই, লক আউটের দরুন পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজ হারায়। সরকারী ব্যয় হ্রাসের নামে কেন্দ্র রাজ্যগুলিতে হাজার হাজার সরকারী কর্মচারীকে চাকরি থেকে অপসারণ বরখাস্ত করা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর বিশ দফা কর্মসূচীতে গ্রামীণ কর্মসংস্থান স্কিমের বিজ্ঞপ্তি সত্ত্বেও গ্রামীণ বেকারী দুর্দশা হু হু করে বেড়ে চলে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা চল্লিশ লক্ষ অতিক্রম করে যায়। এরাজ্যে ৭০ থেকে ৭৭ এক অন্ধকারময় পর্যায়, যাকে বলা হয় সাতের দশকের কালো দিন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টুঁটি টিপে এরা‍‌জ্যে কায়েম হয় এক আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। খাদ্যের প্রশ্নে রাজ্য পরিণত হয় ঘাটতি রাজ্যে। লোডশেডিং মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলো এক ভয়াবহ বিভীষিকা। শিক্ষার কথা উল্লেখ না করাই ভালো।

সন্ত্রাসের সেই বীভৎসতাকে ছুঁড়েফেলে এবং জরুরী অবস্থার কালোরাত্রির অবসানে দীর্ঘ তিন দশকব্যাপী কংগ্রেসের একচেটিয়া ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে জনজাগরণের তরঙ্গশীর্ষে ১৯৭৭ সালের জুন মাসে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচীতে বলা হয় — ‘বামপন্থী‍‌ ফ্রন্টের সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচী রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থের সেবা করবে, তাঁদের জীবনযাত্রার মান সংরক্ষণ উন্নয়নে সহায়তা করবে ত্রিশ বছরের কংগ্রেসী অপশাসনে তাঁরা যে চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন তার কিছুটা উপশমের ব্যবস্থা করতে প্রয়াস রাখবে।নিজেদের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যথাযোগ্য ভূমিকা পালনে বামফ্রন্ট আন্তরিক প্রয়াস রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। মানুষের জন্য স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি তারা কখনোই দেয়নি। বরং মানুষের দুঃখ-কষ্ট খানিকটা প্রশমনে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতার কথা স্বীকার করতে বামপন্থীরা ছিল দ্বিধাহীন। নিজেদের কর্মতৎপরতাকে আরও গতিশীল করে মানুষের প্রত্যাশার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে এটাই ছিল বামপন্থীদের অঙ্গীকার।

 এরাজ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? নিঃসন্দেহে বেকার সমস্যা। বামফ্রন্ট বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলো যে, কৃষির অগ্রগতির সাথে সাথে শিল্পের অগ্রগতি ঘটাতে না পারলে রাজ্যের সামগ্রিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। ৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে বামফ্রন্ট দেখতে পায় তাদের হাতে বিনিয়োগের উপযোগী পুঁজি নেই। কিন্তু গ্রামে আছে প্রচুর জমি আর অফুরন্ত শ্রমশক্তি (অর্থাৎ বেকার বাহিনী) এরাজ্যে যে সম্ভাবনাময় বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি বেকার অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তাদের জন্য অর্থবহ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা দরকার। সেই কারণে কৃষি, ক্ষুদ্রায়তন শিল্পক্ষেত্র এবং গ্রামোন্নয়নের মতো জায়গাগুলিতে প্রথমে নজর দেওয়া হয়। শহরের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প নেওয়ায় অসুবিধেটা দেখা দেয় এই যে, এখানে যদি বা শ্রমশক্তির সরবরাহ যথেষ্ট কিন্তু জমি নেই আর পুঁজির অভাব তো আছেই। সেই কারণে শহরে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ ভারী ‍‌শিল্পের দিকে নজর দেওয়া হয়। বিষয়টি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় এক্তিয়ারে এবং এক্ষেত্রে বিনিয়োগের উপযোগী পুঁজি পশ্চিমবাংলা কেন, কোন রাজ্য সরকারেরই নেই। সেই কারণে এইসব ক্ষেত্রে লগ্নি করার জন্য কেন্দ্রকে বারবার অনুরোধ জানানো হয়। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় টালবাহানার কথা তো আজ ইতিহাস।

দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে কেন্দ্র রাজ্যের এই দ্বন্দ্ব তীব্র আকার নেয়। প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক বৈষম্য বাধাদানের হাতিয়ার অবলম্বন করে যাতে এই মন্ত্রীসভাকে বিপাকে ফেলা যায় এবং জনগণের সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়।

এই অবস্থায় প্রশ্ন ছিল, এই শ্রেণী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে? অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের এই পরিকল্পনাকে সফল হতে দেওয়া হবে এবং ক্রমবর্ধমান বেকারীর সামনে এরাজ্য শিল্পের দিক থেকে মরুভূমি হয়ে যাবে। এই পটভূমিকাতেই এরাজ্যে যৌথ ব্যক্তি উদ্যোগের শিল্প সম্পর্কিত বিষয়ের বিচার-বিবেচনা জরুরী হয়ে পড়ে।

এটা বামফ্রন্টের ঘোষিত নীতি যে, বেসরকারী ক্ষেত্রের ওপর সব সময় সরকারী ক্ষেত্রের প্রাধান্য থাকবে। একই সাথে এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কেন্দ্র পশ্চিমবাংলার সংগ্রাম। একটানা কেন্দ্র এটা দেখাতে চেষ্টা করে যে যতদিন বামফ্রন্ট সরকার থাকবে ততদিন এখানে শিল্পের অগ্রগতি হবে না এবং কংগ্রেস এরাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে না আসা পর্যন্ত কর্মসংস্থান বাড়ানোর সব আশা শিকেয় তুলে রাখতে হবে। এই পরিস্থিতিতে যুবমানসের জীবনযন্ত্রণার প্রতি যথার্থ অনুভূতি সহমর্মিতার উপলব্ধি নিয়ে এবং আত্মমর্যাদাবোধ সংগ্রামী মানসিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এরাজ্যে শিল্প গড়ার উদ্যোগকে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখি শিল্প গড়ার সুযোগসুবিধা এবং অনুকূল পরিস্থিতির কারণেই ইংরেজ আমলে বিদেশী শিল্পপতিরা এখানে শিল্প গড়তে এগিয়ে আসে। পরিকাঠামো বলে বিশেষ কিছুই তখন এখানে ছিলো না। তা সত্ত্বেও চা, চট, ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যালস প্রভৃতি শিল্প কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র পূর্বাঞ্চলকেই অবহেলা করায় এখানকার শিল্পের ওপর দারুণ আঘাত পড়ে। তারওপর মাশুল সমীকরণ নীতি, শিল্প লাইসেন্স প্রথা, কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরূপ আচরণকে কাজে লাগিয়ে এখানকার শিল্প সম্ভাবনাকে একেবারে বিপর্যয়ের মু‍‌খে ঠেলে দেওয়া হয়। ১৯৭২-৭৭ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার রাজ্যের অর্থনীতিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়ে শিল্প সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয়।

এমত পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালে রাজ্য সরকার পরিচালনার দায়িত্বে এসে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করায় পশ্চিমবাংলার অর্থনীতিতে তার প্রতিফলন ঘটে। কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সামাজিক বনসৃজন, শিক্ষার প্রসার, সাক্ষরতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পরিলক্ষিত হয়। দেশের শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষির উন্নতি ছাড়া শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভন নয়। আমূল ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর সাফল্য এক্ষেত্রে এক নতুন দিশা নিয়ে আসে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই পরিবর্তনের ফলে গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা কম‍‌তে থাকে। গ্রামীণ জনগণের ক্রয় ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজ্যে শিল্পপণ্যের এক বাজার তৈরি হয়। ফলে হাজার প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এখানে শিল্পায়নের এক শক্তিশালী বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। শিল্পের প্রাথমিক প্রয়োজন বিদ্যুৎ। ১৯৭৬-৭৭ সালে অর্থাৎ কংগ্রেস শাসনের শেষ বছর রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল ক্ষমতা ছিল ১৬২৫ মেগাওয়াট। বামফ্রন্ট আমলে ১৯৮৫-৮৬ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৫৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মাত্র বছরে অতিরিক্ত ১৭২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতা পশ্চিমবাংলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। কংগ্রেস শাসনে ১৯৭০-৭১ থেকে ১৯৭৬-৭৭ সালের মধ্যে রাজ্যে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা যুক্ত হয় মাত্র ৯৯ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বামফ্রন্ট সরকারের দেওয়া বক্রেশ্বর, সাগরদিঘি সহ প্রায় ৬০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনু‍‌মোদন লাভে ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার ষষ্ঠ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় বিদ্যুৎখাতে যোজনা কমিশনের বরাদ্দ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ছিল সবচেয়ে কম। ফলে কেন্দ্রের লাগাতার বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পশ্চিমবাংলার আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। রক্ত দিয়ে বক্রেশ্বর গড়ার সংকল্প তো আর এমনি এমনি আসেনি। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটিকে প্রযুক্তিগত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজ্য সরকারের প্রকল্প হিসেবে অনুমোদন দেয়। পরবর্তীকালে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে এটি সপ্তম যোজনায় রাজ্যের প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনকি ১৯৮৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ‍‌ঘোষণাও করেন যে, মাস তিনেকের মধ্যেই বক্রেশ্বর প্রকল্প ছাড়পত্র পাবে। কিন্তু তারপরেই কেন্দ্রীয় সরকার ভোলবদল করে। ১৯৮৭ সালের ২৯শে অক্টোবর কেন্দ্রীয় শক্তিমন্ত্রী টেলেক্স বার্তায় রাজ্য সরকারকে জানায় যে, প্রকল্পের জন্য সোভিয়েত ঋণ পাওয়ার প্রাকশর্ত হলো প্রকল্পটিকে কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রে রূপায়িত করতে হবে। অথচ কিছুদিন বাদে ভারতে অবস্থিত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জ্যোতি বসুর সাথে দেখা করে জানালেন যে, এসব ভুল কথা। উনি বলেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে এরকম কোন শর্ত দেওয়া হয়নি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন কেন্দ্রকে জানানো হয় যে, সোভিয়েত ঋণ পশ্চিমবাংলাকে না দিলে সেটা হবে চরম অবিচার। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারকে সমস্তরকমভাবে অপদস্থ করতে তখন কেন্দ্র মরিয়া। ফলে এক রকম বাধ্য হয়ে নিজস্ব উদ্যোগেই বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। ১৯৮৮ ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রকল্পটির শিলান্যাস করতে গিয়ে জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন — ‘বক্রেশ্বর প্রকল্পের রূপায়ণের সাথে জড়িয়ে আছে এরাজ্যের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা অবিচারের সমুচিত জবাব এরাজ্যের মানুষ প্রকল্পটির সার্থক রূপায়ণের মধ্যে দিয়েই দেবে।

এরপর ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির চাপে অন্যান্য বিষয়ের সাথে শিল্প লাইসেন্স প্রথা বাতিল মাশুল সমীকরণ নীতি শিথিল করা হয়। বিশ্বব্যাঙ্ক-আই এম এফ নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক নীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বেসরকারীকরণ। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে প্রথমে রুগ্ অলাভজনক এমনকি লাভজনক সংস্থার শেয়ার বিক্রি অগ্রাধিকার তালিকায় চলে আসে। কেন্দ্রের এই উদার অর্থনীতির তীব্র বিরোধিতা করে বামফ্রন্ট। কারণ এই নীতির দরুণ আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে প্রধান ভূমিকায় রেখে শিল্প বিকাশের যে ভিত্তি গড়ে উঠেছিল তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বিচারে বিদেশী পুঁজি প্রযুক্তি আমাদানির ফলে দেশীয় শিল্প এক অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে দুর্বল হবে এবং আমাদের আর্থিক স্বয়ংভরতা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

বামফ্রন্টের স্পষ্ট বক্তব্য দেশের স্বনির্ভরতার স্বার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র শক্তিশালী হোক। কিন্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটা অঙ্গরাজ্যে সরকারে এসে তো কেউ তাদের নীতিকে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক শিল্পনীতির আওতায় থেকেই তাদের কাজ করতে হয়। স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে কেন্দ্রের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ছিল অগ্রাধিকার তালিকায় (commanding light of economy) সেই সময় রাজ্যের ক্ষেত্রেও সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু কেন্দ্রের গৃহীত উদার অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কাছে ব্যক্তিপুঁজির বিকল্প আর কিছু রইলো না। এই রূঢ় বাস্তবকে কি ইচ্ছে করলেই অস্বীকার করা যায়? কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া অর্থনীতি গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদের সভায় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই নীতির শুধু বিরোধিতাই করা হয়নি বিকল্প প্রস্তাবও রাখা হয়েছিল। এর মাধ্যমে এক নতুন বিকল্প আর্থ-সামাজিক নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা যা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করবে এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে অটুটু রাখবে, তা তুলে ধরার চেষ্টা হয়। এই বিকল্প নীতি যদি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ কর‍‌তো তাহলে তার পটভূমিতে জাঁকিয়ে আমাদের রাজ্যে শিল্পায়নের বিষয়টি অন্যভাবে ভাবা যেতে পারতো। যেহেতু তা হয়নি সেই কারণে অন্যকিছু ভাবার অবকাশ বিশেষ ছিল না। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেয় সরকারী বিনিয়োগ কমিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের ঢালাও ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে রাজ্য সরকার কী করবে? শুধু নীতিগত অবস্থানের কথা বলে হাত গুটিয়েবসে থাকবে? সেটাতো মূর্খের আচরণ। রাজ্যকে উদ্যোগ নিতেই হয় এবং কেন্দ্রীয় নীতির বাইরেও খুব একটা যাওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এই নীতিগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল না। সদিচ্ছা ‍‌নৈতিক বল থাকলেই তারা অন্য পক্ষ নিতে পারতেন। সে বিকল্প প্রস্তাব বামপন্থীরা দিয়েও ছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলেই কেন্দ্রীয় নীতিকে উপেক্ষা করতে পারতো না।

এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে রাজ্যের শিল্পায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেহেতু বড় মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কোনও স্বাধীন নীতি ঘোষণা করতে পারে না, সেই কারণে ১৯৯৪ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বিধানসভায় শিল্পায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে এক নীতি-বিবৃতি (Policy statement on Industrial development) পেশ করা হয়। এতে বলা হয় — () রাজ্য সরকার উপযুক্ত ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধাজনক শর্তে বৈদেশিক পুঁজি প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাবে। () রাজ্য সরকার সামাজিক ন্যায়বিচার ভারসাম্যমূলক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সরকারী সরকার অধিগৃহীত ক্ষেত্রগুলিকে প্রধান চালিকাশক্তি মনে করে। রাজ্য সরকার এটাও স্বীকার করে যে, কয়েকটি কারণে অগ্রগতির স্বার্থে বেসরকারী উদ্যোগেরও গুরুত্ব ভূমিকা থাকবে। যেমন, প্রধান প্রধান শিল্পে বিদ্যুৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগের এক তাৎপর্যময় ভূমিকা আছে বিশেষ করে মূল্যায়নের রাশ টেনে রাখার ক্ষেত্রে। তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের স্বার্থে এবং রাজ্য সরকারের নিজস্ব আর্থিক সীমাবদ্ধতার দরুণ রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারী বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবে। () সরকারী বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি রাজ্য সরকার যৌথ সহযোগী উদ্যোগগুলিকে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে মূলধন সংগ্রহ করা এবং অন্যান্য কিছু বিশেষ কাজে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বলে মনে করে। () শিল্পের পরিকাঠামোর উন্নয়ন ক্রম অগ্রগতিশিল্পের অগ্রগতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করে রাজ্য বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আগামী দশ বছরে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে। সরকারী, বেসরকারী, যৌথ উদ্যোগেই এটা করা সম্ভব। এছাড়া রাস্তা যোগা‍‌যোগ ব্যবস্থা শিল্পবিকাশ কেন্দ্রগুলির উন্নয়ন ঘটানো হবে। () সামাজিক পরিকাঠামো যথা উপনগরী নির্মাণ, আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল সরবরাহ, হোটেল নির্মাণ, উন্নতমানের স্কুল-কলেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে। কারিগরি শিক্ষা প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্প্রসারণের উপর জোর দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নতমানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাকেন্দ্র স্থা‍‌পনের জন্য বেসরকারী যৌথ উদ্যোগকে উৎসাহিত করার প্রয়াস জারি থাকবে।

এই শিল্প সংক্রান্ত নীতি-বিবৃতিঘোষণার সাথে সাথে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয় যে, এরাজ্যে শ্রমজীবী মানুষ বহু সংগ্রাম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বারে বারে এই সরকারের ওপর তাদের গভীর আস্থার প্রমাণ রেখেছে। এরাজ্যের স্বার্থবিরোধী কোন শিল্প প্রকল্প কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার কোনরকম সহায়তা করবে না। বামফ্রন্ট চায় শ্রমজীবী মানুষ শিল্প উদ্যোগী উভয়েই তাদের অধিকার কর্তব্য দুটি বিষয়েই সমান গুরুত্ব আরোপ করুন যাতে করে এখানে একটা শিল্পের অনুকূল বাতাবরণ গড়ে ওঠে।

বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে জ্যোতি বসু বলেন — ‘বিকল্প ব্যবস্থার ভিত্তি হওয়া উচিত স্বনির্ভরতা, অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো, আমাদের দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক মানবিক সম্পদ রয়েছে যার অনেকটাই এখনও অব্যবহৃত। এখন দেখতে হবে সাধারণ মানুষের কৃষি শিল্পপণ্যের প্রয়োজন মেটানো সামাজিকভাবে উপযুক্ত উৎপাদন সৃষ্টি কতোটা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে হতে পারে আর কতোটা বিদেশী বাণিজ্যের মাধ্যমে হতে পারে। স্বনির্ভরতা মানে বিদেশী বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া নয়। বরং যে সব ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা ( গতিশীল সুবিধা) আছে সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাণিজ্য করতে হবে। অর্থাৎ শক্তি আত্মমর্যাদার অবস্থান থেকেই বাণিজ্য করতে হবে (মার্কসবাদী পথ, ফেব্রুয়া‍‌রি-১৯৯২) বামফ্রন্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানায়, বিদেশী পুঁজির ক্ষেত্রে ‍‌নির্বিচার প্রবেশের পরিবর্তে জাতীয় অগ্রাধিকার, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা এবং সামগ্রিক সুবিধা অসুবিধা মনে রেখে নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বিশেষেই এই পুঁজি গ্রহণ যুক্তিযুক্ত। সমগ্র পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এরাজ্যে উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর, কর্মসংস্থান অভিমুখী এবং কৃষিভিত্তিক এই ধরনের শিল্পায়নেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। রাজ্যের মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পেট্রোরসায়ন, ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ প্রভৃতি শিল্প স্থাপনের কাজ থাকবে অগ্রাধিকার তালিকায়। রাজ্যের চিরাচরিত শিল্পগুলি রক্ষা করা এবং আধুনিকীকরণ সম্প্রসারণ কর্মসূচীর মাধ্যমে সেগুলির বিকাশ ঘটাতে সব ধরনের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।

বঞ্চনার বিরুদ্ধে আত্মমর্যাদার প্রতীক বক্রেশ্বর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে রাজ্য আজ লোডশেডিংয়ের রক্তচক্ষু থেকে প্রায় মুক্ত। পরবর্তী পর্যায়ে প্রশাসনিক গাফিলতিতে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ জারি রয়েছে। নন্দীগ্রামকে আর এক হলদিয়ায় পরিণত করার বামফ্রন্টের আন্তরিক সদিচ্ছাকে কায়েমী স্বার্থবাদীরা সর্বশক্তি দিয়ে বানচাল করতে সফল হয়ে‍‌ছে। সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে এক বিশাল শিল্পনগরী গড়ার উদ্যোগ প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বামফ্রন্টের শিল্পায়ন কর্মসূচীকেঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে ২৫৩১টি সংস্থায় বাস্তবায়িত হয়েছিলো ৬৫,৬৮৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ। এরফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় তিন লক্ষ (‍ এবং পরোক্ষভাবে এর দ্বিগুণ) লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সেক্টর ফাইভের তথ্য প্রযুক্তি শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছোট বড় অসংখ্য শিল্প পরিকল্পনা বামফ্রন্টের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে যার বেশ কয়েকটি বর্তমান সরকারের অবিমৃষ্যকারিতায় বাস্তবায়িত হতে পারছে না সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ইনফোসিস।

 তা সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, শিল্পায়ন প্রসঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কুৎসা-অপপ্রচার মোকাবিলায় আমাদের ব্যর্থতা থেকেই গিয়েছে। যে কারণে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে শত্রুরা সাময়িকভাবে ‍‌লেও আমাদের বিরোধী শিবিরে টেনে‍‌ নিতে পেরেছে। সঠিক তথ্য যুক্তির আলোকে সেই মানুষকে আমাদের দিকে নিয়ে আসতেই হবে। প্রয়াত জ্যোতি বসু একটা কথা প্রায় বলতেন, মনে রাখা দরকার মানুষ যেমন ইতিহাস গড়ে আবার মানুষই ভুল করে। ফরাসী বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব সম্পাদন করেছিল মানুষ। আবার মানুষের হাত ধরেই এসেছিল ফ্যাসিবাদ। প্রতিক্রিয়ার প্রচারের সামনে অনেক সময় দেখা যায় প্রগতির বক্তব্য পিছিয়ে পড়ে। গণেশ দুধ খাচ্ছে, এই হুজুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন দেশজুড়ে গ্লাস বা ঘটি ভর্তি দুধ নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সচেতন বিজ্ঞান কর্মীরা যখন থিওরি অব সারফেস টেনশনঅনুসরণ করে এই গুজবের অসারতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়, তখন কিন্তু খুব বেশি মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দেয় না। এক্ষেত্রে বুজরুকি বনাম বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বে বিজ্ঞান সাময়িকভাবে হলেও পিছু হটে। সুতরাং মানুষের সাথে নিরন্তর সম্পর্ক রাখা এবং তাদের বিচার বি‍‌শ্লেষণেরউদ্দেশ্যে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্ত বিষয়গুলো তুলে ধরা প্রতিটি বামপন্থী কর্মীর অবশ্য কর্তব্য। কাজটা কঠিন। সেই কারণে দায়িত্বও বেশি। আমাদের তা পালন করতেই হবে।

[সহায়তা গ্রহণ : বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের বাজেট ভাষণ]