অজয় দাশগুপ্ত
২০০৫সালে সিপিআই(এম)-র দিল্লি পার্টি কংগ্রেস ছিল সবদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রে তখন বামপন্থীদের সমর্থনে ইউপিএ সরকার চলছে, আর বামপন্থীদের মধ্যে মূল শক্তি সিপিআই(এম)-ই। ফলে পার্টি কংগ্রেসে সিপিআই(এম) কী আলোচনা করে তারদিকে নজর ছিল সবার। পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকেই তা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দিনের পর দিন প্রতিবেদন প্রকাশ, আলাপ-আলোচনা চলছিল। এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ, সোজাকথায় দেশীয় শিল্পে বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগ নিয়ে পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে; বিশ্বব্যাঙ্ক, এডিবি বা আইএমএফ-র প্রকল্পগুলিকে পার্টি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি কীভাবে গ্রহণ করবে; এনজিও-গুলিকে কী চোখে দেখা হবে, তাতে পার্টিকর্মীরা কী ভূমিকা নেবেন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে পার্টির নীতি অভিমুখ এই পার্টি কংগ্রেসেই ঠিক হয়।
দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন অথবা অনেকদিন ধরে লেফট-বিট করছেন, সেইসব সাংবাদিকদের অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, তখন দিল্লিতে সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর একে গোপালন ভবনকে পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে লাল আলো এবং লাল পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। একে গোপালন ভবনে ঢোকার ঠিক মুখেই একটা বিশাল হোর্ডিং লাগানো হয়েছিল। তাতে জ্যোতি বসু এবং হরকিষেণ সিং সুরজিৎ-এর ছবি লাগিয়ে লেখা ছিল: “Living Legends of Indian Communist Movement” অর্থাৎ ‘‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তী’’। বিশেষণ সঠিক হলেও, কমিউনিস্ট পার্টিতে জীবিত অবস্থায় এধরণের সম্মাননা ছিল একেবারেই ব্যাতিক্রমী।
এই দুই জীবন্ত কিংবদন্তীর মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কও
ছিল খুবই গভীর এবং পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত। দুজনের এই সম্পর্কের একটি
বিরল ও অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল,
যা চিরকাল মনে থাকবে। ২০০৮সালের ১আগস্ট কমরেড
হরকিষেণ সিং সুরজিতের জীবনাবসান হয়। তারআগে সেবছরই মে মাসে একবার তিনি প্রায়
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। ঘটনাটি সেই সময়ের।
এধরনের পরিস্থিতিতে সব সংবাদমাধ্যমেই কিছু আগাম কাজ
সেরে নেওয়া হয়। সেই ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, ছবি এবং জীবনপঞ্জী চূড়ান্ত করা ছাড়াও তাঁর
সম্পর্কে ঘনিষ্ঠদের স্মৃতিচারণা সংগ্রহ করা। স্বাভাবিকভাবেই আমার ওপরে ভার পড়েছিল
সুরজিৎ সম্পর্কে জ্যোতি বসুর একটি লেখা তৈরি করার। জয়কৃষ্ণ ঘোষের সঙ্গে কথা বলে ২১
তারিখ সকালে ইন্দিরা ভবনে পৌঁছে গেলাম। নির্দিস্ট সময়ে জ্যোতিবাবুর ঘরে আমাকে জয়দা
পৌঁছে দিলেন।
আমি জ্যোতিবাবুকে বললাম, ‘‘কমরেড সুরজিৎ হাসপাতালে খুবই সঙ্কটজনক অবস্থায় রয়েছেন। বিমানদা বললেন, আপনার কাছথেকে একটা বার্তা নিতে।’’
জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘ও কি আছে, না নেই?’’ তারপর জয়কৃষ্ণ ঘোষের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘‘তুমি যে বললে,
অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।’’
জয়দা বললেন, ‘‘আমাকে তো সিসি অফিস থেকে তাই জানালো একটু
আগে।’’
জ্যোতিবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘‘ও তো আমার থেকেও বয়সে
ছোট। ওর আগে যাওয়ার কথা নয়।’’
তারপর বললেন, ‘‘ঠিক আছে, তুমি এসেছ যখন, আমি একটা মেসেজ দিচ্ছি। তুমি বিমানকে দিও,
ও পাঠিয়ে দেবে।’’
এরপর গড়গড় করে ইংরেজীতে বলতে শুরু করলেন। আমি গণশক্তির হয়ে ২০০০সাল থেকে জ্যোতিবাবুর বিভিন্ন লেখার ডিকটেশন নিয়েছি, কিন্তু তার সবই বাংলায়। হঠাৎ ইংরেজীতে নিতে গিয়ে একটু ঘাবড়েই গেছিলাম সেদিন। কারণ, ওঁকে তো আর রিপিট করতে বলা যায় না! যাইহোক, উনি যা বললেন, আমার সীমিত ইংরেজী বিদ্যায় তা লিখে নিলাম। নোট দেওয়ার পরেও কিছু কথা বললেন সুরজিৎ সম্পর্কে এবং তা লেখার জন্য নয়, সেটাও বলে দিলেন।
জ্যোতিবাবুর ঘর থেকে বের হওয়ার পর জয়দা আমাকে বললেন, ‘কি, তুমি যা চাইছিলে, তা পেলে না তো? উনি এরকমই, ডেথ নিউজ না পেলে কিছু বলবেন না।’’ আমি বললাম, ‘‘যা পেয়েছি, তা একটা দুর্লভ ব্যাপার!’’
ইন্দিরা ভবন থেকে সোজা গণশক্তি অফিসে এলাম। অভীক দত্ত অফিসেই ছিল, তাঁকে গোটা ঘটনাটা বললাম। অভীকদা সব শুনে বললো, ‘‘তাই নাকি! এতো অসাধারণ ঘটনা! তাড়াতাড়ি লিখে ফেলো, বিমানদাকে দেখিয়ে আনি!’’ দ্রুত কম্পোজ করে প্রিন্ট-আউট বের করে দিলাম। একটু পরে অভীকদা আলিমুদ্দিন থেকে ফিরে এসে বললো, ‘‘বুদ্ধদা পার্টি অফিসেই ছিলেন। উনি এই ঘটনা শুনে, আর লেখাটা দেখেই দিল্লিতে প্রকাশ কারাতকে ফোন করলেন। প্রকাশদাও লেখাটা এক্ষুনি পাঠিয়ে দিতে বললেন।’’ দিল্লিতে পাঠানোর পর বারতিনেক ফোন করে লেখাটার ইংরেজী গঠনগত (যা কিনা আমারই ভুল) ছোটখাটো কিছু সংশোধন করলেন প্রকাশ কারাত। তারপর জানালেন, এই মেসেজটা পার্টির সমস্ত পত্রিকাতে ছাপানোর জন্য আইএনএন থেকে পাঠানো হচ্ছে। পরদিন গণশক্তিতেও তা প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদ আকারে।
মূল ইংরেজী লেখাটা এবং পরে বাংলা অনুবাদটা এখানে দিলাম:
Beloved Comrade Surjeet,
I am deeply grieved
to hear about your continued illness. I was just now reminiscing how for long
years we have been working together particularly after the split of the party.
I can never forget the role you played in organising and giving leadership to
the Party.
I particularly
remember the day when due to my illness I wanted to leave the responsibility
given to me by the Party, as Chief Minister of West Bengal. You came and met me
in my house. Then you seemed to be nervous, thought that this may adversely
affect the Party. After discussion then we worked out a formula that we would
create a new post of Deputy Chief Minister, who will later on be the Chief
Minister and I shall not stand for election. That formula worked very well.
Buddhadeb Bhattacharjee was very well accepted both by the Party and the people
of West Bengal. So, at the end of my tenure, I resigned and Buddhadeb took over
the Chief Ministership. I also remember with pride how you helped the Party to
flourish in different provinces.
I also remember how
you did agree with me that the unity of the Left parties in West Bengal is
essential and I feel proud that the Left Front government carried on thirtyone
years with the support and love of the people of the state.
I remember you also
played host to my family when we went to Punjab. Though I am older than you and
now almost bedridden, I am confident that our Party will go forward from
success to success in many parts of India. Despite many crests and ebbs people
will finally emerge victorious and go in for a classless society free from
exploitation of any form.
At the end, I want
to remember with pride the role you played in the new political situation in
country to keep the communal BJP at bay. We extended our outside support to
Congress, incumbent upon the basis of the Common Minimum Programme and the
interests of the people and the country.
Jyoti Basu
Kolkata,
May 21, 2008
From India News
Network (INN)
Kolkata, May 21,
2008
................
প্রিয় কমরেড সুরজিৎ,
আপনার ধারাবাহিক অসুস্থতার খবরে আমি খুবই বেদনাহত
হয়ে পড়েছি। আমার এখনই মনে পড়ছিল, কত দীর্ঘ সময় ধরে আমরা একসাথে কাজ করেছি,
বিশেষ করে পার্টি ভাগ হওয়ার পর থেকে। পার্টিকে
সংগঠিত করা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি যে ভূমিকা পালন করেছেন,
তা আমি কখনই ভুলতে পারবো না।
বিশেষ করে আমার সেই দিনের কথা মনে হচ্ছে,
যখন অসুস্থতার কারণে পার্টি আমাকে
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে দায়িত্ব দিয়েছিল,
তা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আপনি এলেন এবং বাড়িতে
আমার সঙ্গে দেখা করলেন। আপনাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল,
হয়তো ভাবছিলেন যে পার্টির ওপরে এর প্রতিকূল
প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। আলোচনা করে আমরা একটু সূত্র বের করলাম যে প্রথমে
উপ-মুখ্যমন্ত্রীর একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হবে, যিনি পরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন
এবং পরবর্তী নির্বাচনে আমি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো না। এই সূত্র খুব ভালো কাজ
করেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পার্টি এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুব ভালোভাবে গ্রহণ
করেছেন। সুতরাং আমার টার্ম শেষ হওয়ার মুখে আমি ইস্তফা দিলাম এবং বুদ্ধদেব
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বিভিন্ন প্রদেশে পার্টির বিকাশ ঘটাতে আপনি
কিভাবে সাহায্য করেছেন, আনন্দের
সঙ্গে আমার সেকথাও মনে পড়ছে।
আমার এটাও মনে পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলির ঐক্য কতটা জরুরী
সেই প্রশ্নে আপনি আমার সঙ্গে একমত ছিলেন এবং এই রাজ্যের মানুষের সমর্থন ও
ভালোবাসার ফলে বামফ্রন্ট সরকার যে ৩১বছর ধরে চলছে সেকথা ভেবে আমি গর্বিত বোধ করি।
আমি সপরিবারে যখন পাঞ্জাবে গিয়েছিলাম তখন আপনার
আতিথেয়তায় যে ছিলাম, সেকথাও
আমার মনে পড়ছে। যদিও আমি আপনার থেকে বয়সে একটু বড় এবং এখন প্রায় শয্যাগত হয়ে আছি,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের পার্টি ভারতের
বিভিন্ন অংশে আরও সাফল্য অর্জন করার জন্য এগিয়ে যাবে। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য
দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়ই অবশ্যম্ভাবী এবং যে কোন প্রকারের শোষণমুক্ত
শ্রেণীহীন সমাজ অবশ্যই তৈরি হবে।
পরিশেষে, দেশের নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক
বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে আপনি যে ভূমিকা পালন করেছেন,
সেকথা আমি স্মরণ করতে চাই। সাধারণ ন্যূনতম
কর্মসূচির ভিত্তিতে এবং দেশের জনগণের স্বার্থে আমরা বর্তমান কংগ্রেস সরকারকে বাইরে
থেকে সমর্থন দিয়েছি।
জ্যোতি বসু
কলকাতা,
২১মে, ২০০৮
ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক (আইএনএন)
২২ মে, ২০০৮ গণশক্তিতে প্রকাশিত এই খবরের লিঙ্ক:
http://archive.ganashakti.co.in/shownews.php?w=665&h=576&year=2008&month=5&date=22&page=7&dpn=165809