20191219

আন্দোলনের বর্শাফলক থাকুক মানুষের শত্রু আরএসএস-বিজেপি’র দিকে



শমীক লাহিড়ী

ভারতবর্ষের নাগরিক কারা এবং কারা ভবিষ্যতে নাগরিক হতে পার‍‌বেন — এই নিয়ে কে‍‌ন্দ্রের বিজেপি সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে — ‍‌(১) জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নতুন করে তৈরি করা এবং (২) ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সং‍‌শোধন করা।

নতুন সংশোধিত আইন

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন এখনও পর্যন্ত ৬ বার সংশোধিত হয়েছে — ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ এবং ২০১৯। ১৯৮৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পূর্বে যিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। এরপর যাদের জন্ম হয়েছে তাঁদের পিতা অথবা মাতা যেকোনও একজন সন্তানের জন্মের সময় ভারতের নাগরিক হলে, সন্তান এদেশের নাগরিকত্ব পাবে। ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুযায়ী যে সমস্ত শিশু ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তাঁদের পিতা এবং মাতা উভয়কেই ভারতবর্ষের নাগরিক হতে হবে, তবেই সেই শিশু ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবে।

বিদেশে জন্মগ্রহণকারী এবং বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের ক্ষেত্রে আইন পৃথক। সর্বশেষ সংশোধনী (CAA) বিদেশে বসবাসকারী অ-ভারতীয়দের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা ভারতবর্ষের নাগরিক নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব পেতে চান তাঁদের জন্য নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধনী। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও দেশের মানুষ এবং যে কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষ এই সর্বশেষ আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। কেবলমাত্র ৩টি প্রতিবেশী দেশ— পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে বসবাসকারী অ-মুসলমান মানুষেরা ভারতবর্ষের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। অর্থাৎ এই আইনটি এককথায় বিদেশিদের জন্য তৈরি, ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

সঙ্গতভাবেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে। প্রথমত, কেবলমাত্র ৩টি প্রতিবেশী দেশকে বেছে নেওয়া হলো কেন? নেপাল, মায়ানমার (পূর্বতন বার্মা), ভূটান, চীন, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশগুলিও ভারতবর্ষের প্রতিবেশী দেশ। এদের বাদ দেওয়া হলো কেন? এর কোনও সঙ্গত উত্তর প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেননি অথবা দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, আমাদের দে‍‌শের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকে ধর্ম-ভাষা-জাতি কখনই বিচার করা হয়নি। দেশ বিভক্ত হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেও আমাদের দেশ সেই রাস্তায় হাঁটেনি। আমাদের দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দেশে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পার্সি-নাস্তিক সহ সব ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংবিধানকে দু’হাত তুলে সমর্থন করেছিলেন এবং এই ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দেশকেই তাঁদের মাতৃভূমি বা পিতৃভূমি রূপে গণ্য করে, এই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, এই দেশেই বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজ হঠাৎ ধর্ম বিচার করে নাগরিকত্বদানের প্রশ্নটিকে আরএসএস-বিজেপি সামনের সারিতে নিয়ে আসতে চাইছে কেন? এরা যুক্তি দিচ্ছেন আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত মানুষদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে, তাই এই নিপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এই আইন আনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দুটি প্রশ্ন সামনে উঠে আসছেপ্রথমত, সমস্ত প্রতিবেশী দেশগুলির উৎপীড়িত নাগরিকদের জন্য এই আইন না এনে কেবলমাত্র ৩টি দেশকে কেন বেছে নেওয়া হলো? দ্বিতীয়ত, ভাষাগত জাতিগত অথবা রাজনৈতিক নিপীড়িতদের বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎপীড়িতদের জন্য কেন এই আইন? তৃতীয়ত, এই উপমহাদেশের অন্যান্য ধর্মের মানুষকে এই সুযোগ দেওয়া হলেও মুসলমানদের বাদ দেওয়া হলো কেন?

পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ এই ৩টি দেশকে বেছে নেওয়া হয়েছে তার মূল কারণ এই দেশগুলিতে মুসলমান মানুষরা সংখ্যালঘু নন। শ্রীলঙ্কা-চীন-নেপাল-ভুটান-বার্মা এই সব প্রতিবেশী দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যালঘু। যদি এই দেশগুলির নাগরিকদেরও এই সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে এই সব দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতবর্ষের নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে— যেটা প্রবল মুসলমান বিদ্বেষী আরএসএস-বিজেপি চায় না। শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যা আমাদের কারুর অজানা নয়। যদি প্রতিবেশী দেশের উৎপীড়িতদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন প্রকৃত কারণ হতো তাহলে শ্রীলঙ্কার তামিল কিংবা মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে কখনই দৃষ্টি ফেরাতে পারত না আমাদের দেশের সরকার।

আসলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার দীর্ঘ লালিত আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যেই এই আইন সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গায়ের জোরে বিজেপি সরকার তৈরি করতে চেয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রাক্‌শর্ত রূপে প্রথমত, দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন দ্বিতীয়ত, বিভাজনকে তীব্র করার জন্য ঘৃণা তৈরি তৃতীয়ত, এই ঘৃণাকে স্থায়ী রূপ দিতে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী। যে কারণে সমস্ত যুক্তি-তর্ক এড়িয়ে গায়ের জোরে এবং অসত্যকেই ভিত্তি করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন সব প্রতিবেশী দেশ নয়, কেন জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে যে কোনও উৎপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয় — এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর এরা দিচ্ছেন না। সিপিআই(এম) দেশ ভাগের পর থেকেই শরণার্থীদের পাশে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই বাংলায় কমিউনিস্টরা লাগাতার লড়াই করেছে। যাঁরা এদেশে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেবার দাবিও তুলেছে। কিন্তু ধর্মীয় বিচার না করেই এই নাগরিকত্ব দিতে হবে। অন্যথায় সংবিধানের মৌলিক ধারণাই বিপর্যস্ত হবে।

নতুন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি কেন?

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এই সরকারের নাগরিকপঞ্জি তৈরির ঘোষণার সাথে। আসামে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার ক্ষেত্রে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছেসেখানে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেবে আর তাদের জমি-বাড়ি-সম্পত্তি-চাকরি সব হিন্দুরা পাবে, এই প্রচার চালিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯ লক্ষের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ায় সেখানকার মানুষদের সামনে বিজেপি’র স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেছে। মানুষ সেখানে বিজেপি’র বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ জানাচ্ছে।

১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি নাগরিকপঞ্জি কার্যত একটি ব্যর্থ কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কেবলমাত্র জনগণের দেয় করের অর্থ অপচয়ই নয়, প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষকে গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে। কোনও কোনও মানুষের ক্ষেত্রে নিজের পকেটের থেকে এই খরচের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকাও ছাড়িয়েছে। যে সব হতদরিদ্র মানুষ এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে নথিপত্র তৈরি করতে পারেননি, এদে‍‌শে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁরা অনুপ্রবেশকারী বিদেশি হিসাবেই চিহ্নিত হয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আসামের অভিজ্ঞতার নিরিখে সমগ্র দেশে এক গভীর অস্থিরতা তৈরি হয়েছে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করাকে কেন্দ্র করে। এটি কোনও সাধারণ আর পাঁচটি সমস্যার মতো নয়, এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, সম্পত্তি রক্ষা করার অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি। অর্থাৎ একজন মানুষ এবং তাঁর সমগ্র পরিবারের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নতুন করে নাগরিকপঞ্জি তৈরির বিষয়টি।

মানুষের আসল সমস্যা লুকোতে চাইছে

আমাদের দে‍‌শের বেকার সমস্যা— কৃষি জীবনের সমস্যা— শিল্প কলকারখানার সমস্যা— দারিদ্র দূরীকরণের সমস্যা— অশিক্ষার সমস্যা-মহিলাদের উপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের সমস্যা- অর্থনীতির অধোগতির সমস্যা, এই সবের সাথে অথবা দে‍‌শের উন্নয়নের সাথে কোনও সম্পর্ক কি আছে নতুন নাগরিকত্ব আইন অথবা নাগরিকপঞ্জি নতুন করে তৈরি করার? তাহলে এই বিষয় দুটিকে টেনে এনে সমগ্র দেশজুড়ে আগুন লাগানোর অর্থ কি? উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সমগ্র ভারত উদ্বেলিত। রাস্তায় ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে। পুলিশের গুলি চলছে। মিলিটারি নামাতে হচ্ছে। বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য কোনও বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী, সভ্য সরকার নিজের দেশে আগুন জ্বালাতে  পারে— এটা বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষকে দেখেই সমগ্র পৃথিবী জানল। এই আগুন জ্বালানো বিজেপি’র জন্য এত জরুরি হয়ে পড়ল কেন?

এক ঢিল, তিন পাখি

আসলে ঘৃণা এবং বিভেদের রাজনীতি হলো আরএসএস-বিজেপি’র মূল মতাদর্শ। এই দুটি আইনের মাধ্যমে একইসাথে অনেকগুলি ঢিল মারতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী।

প্রথমত, দেশজুড়ে এই দাঙ্গার পরিস্থিতিতে ধামাচাপা পড়ে গেল পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা, সরকারি ব্যাঙ্কগুলো ধুঁকছে কারণ বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়েছে অথবা ফেরত দিচ্ছে না, দেশের কয়লাখনি-তেলের কোম্পানি-রেল সব বেচে দেওয়া হচ্ছে, গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচাইতে বেশি বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যা করছে ঋণের জালে জড়িয়ে গিয়ে, দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে।

দ্বিতীয়ত, এই আইনের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা যাবে, ঠিক যেমন নোট বন্দির সময় হয়েছিল। ১৩৩ কোটি মানুষকেই এখন নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কাগজপত্র তৈরি করে লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঠিকঠাক কাগজ তৈরি করতে না পারলে আপনি সহ আপনার বাপ-ঠাকুরদা এদেশে জন্মে থাকলেও, নাম কাটা পড়বে— সে আপনি হিন্দুই হোন অথবা মুসলমান-জৈন-শিখ,পার্সি-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-নাস্তিক যাই হোন না কেন। হিন্দু বলে কেউ ছাড় পাবেন না। তাঁদেরও যদি কাগজপত্র না থাকে, তাহলে স্থায়ী ঠিকানা হবে ডিটেনশন ক্যাম্প। এখন প্রশ্ন হলো যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে এমএ পাশ বলে দাবি করেন, অথচ সেই নথি হারিয়ে যাওয়ায় জমা দিতে পারেন না, সেই দেশে বন্যায় হাজার হাজার গ্রাম-শহর ভেসে যাওয়া অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িঘর সব নষ্ট হয়ে যাওয়া, দরিদ্রতম মানুষেরা কিভাবে তাঁদের নথিপত্র খুঁজে পাবেন অথবা নথিপত্র নতুন করে বানাবার জন্য অর্থই বা কোথা থেকে পাবেন? তাই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র জোগাড়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি করুক আর লাইনে দাঁড়াক, এক বুক আতঙ্ক নিয়ে, এটাই চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী।
তৃতীয়ত, এর মধ্যে দিয়ে তীব্র ঘৃণার রাজনীতি এবং হিন্দু মুসলমান বিভেদের পরিস্থিতিও তৈরি করা যাবে। সেই পরিস্থিতির দিকে দ্রুত এগচ্ছে দেশ। আতঙ্কগ্রস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ কেবল রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, তাই নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল  জুড়ে আগুন জ্বলছে কোথাও অসমীয়া এবং অ-অসমীয়া বিভেদকে কেন্দ্র করে, কোথাও উপজাতি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। এর ফলে বিভেদের রাজনীতি সামগ্রিকভাবে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি।

বিজেপি’র এই ঘৃণ্য বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক ভাবে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তোলাই দেশের মানুষের মূল কর্তব্য। কোথাও আগুন লাগিয়ে অথবা ভাঙচুর  চালিয়ে আন্দোলন পরিচালিত হলে তা বিজেপি’র উদ্দেশ্যকেই সফল করবে। ফলে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আন্দোলনের বর্শা ফলক আরএসএস-বিজেপি  বাহিনীর দিকেই থাকে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রতিবেশি দেশের উৎপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি করতে হবে নাগরিকত্ব আইন।

এনআরসি-এনপিআর-সিএএ

এনআরসি অর্থাৎ  নাগরিকপঞ্জি নতুন করে তৈরি করা এবং সিএএ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এই দুটি বিচ্ছিন্ন নয়। এজন্যই দেশজুড়ে এই প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ২০২৪ সালের  মধ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এরই প্রাথমিক ধাপ হিসাবে এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরি করার কাজ শুরু হবে ১ এপ্রিল, ২০২০। এর মধ্যে জনগণনার কোনও সম্পর্ক নেই। জনগণনা করা হয় ১৯৪৮ সালে তৈরি সেনসাস অ্যাক্ট অনুযায়ী। এই আইন অনুযায়ী ২৮ জুন, ২০১৯ ভারতবর্ষে রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেনসাস কমিশনার  গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে জানিয়ে দিয়েছেন, ২০২১ সালে দেশে জনগণনা হবে।

এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি তৈরি করার নির্দেশিকা জারি করেছেন Registrar General of Citizen Registration and Census Commissioner, India, এই নির্দেশিকা অনুযায়ী ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাজ হবে। এই নির্দেশিকা জারি হয়েছে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারা অনুযায়ী। এই আইন অনুযায়ী একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নাগরিকদের দেওয়া হবে। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জনগণনা এবং জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরি এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।

মনে এক, মুখে আর এক

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বারে বারে হুঙ্কার ছাড়ছেন—এরাজ্যে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কোনওভাবেই তৈরি করতে দেওয়া হবে না। এই প্রশ্নে জনগণের দেয় করের টাকায় নিজের বিশাল ছবি সহ বিজ্ঞাপনও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দিয়ে চলেছেন। অথচ একইসাথে নবান্ন থেকে  নির্দেশিকা জারি করে এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরির কাজে নিজের সরকারের আধিকারিক এবং কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করতে বলেছেন। একইসাথে শোনা যাচ্ছে রাজারহাট এবং বনগাঁতে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মতো ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির জন্য জমি চিহ্নিতকরণের কাজ প্রায় সেরে ফেলেছেন। এসবই রাজ্যের মানুষ দেখছেন। একদিকে দিল্লির সরকারের প্রবল সংখ্যালঘু বিদ্বেষ এবং অন্যদিকে হিজাব টানা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতারণা রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রবল আতঙ্ক তৈরি করেছে, যার প্রতিফলনে রাজ্য জ্বলছে।

ঐ‍‌ক্যের রক্ষক

রাজ্যে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের সময় কোনও মৌলবাদী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর আসমুদ্র হিমাচলে আগুন লেগেছিল, কিন্তু জ্যোতি বসুর সরকার সেই আগুন এরাজ্যে ছড়াতে দেয়নি। জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাহস হয়নি বাংলা থেকে ২ কোটি বাঙালিকে তাড়ানোর হুমকি দেওয়ার। বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের সময়েও কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাহস হয়নি এই কথা বলার অথবা প্রবল বিভেদকামী আইন পাশ করার, কারণ সংসদে তখন বামপন্থীরা সংখ্যায় অনেক ছিল, আর তিনটি রাজ্যে বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বামপন্থীরা দুর্বল হলে দেশে ঘৃণার রাজনীতি আগুন জ্বালাতে পারে, দেশের সম্পদ বিক্রি করে দিতে পারে শাসকদল।

আন্দোলনের বর্শা ফলক

আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণ্য ও বিভেদকামী রাজনীতির  বিরুদ্ধে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অথবা এনআরসি কেবলমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এই সমস্যা জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর। তাই কেবলমাত্র ধর্মের নাম করে কোনও আন্দোলন পরিচালিত হলে তা আরএসএস-বিজেপি’কে রুখতে পারবে না। বরং তাতে দাঙ্গার উত্তাপ ছড়াবে, আর এটাই চায় আরএসএস-বিজেপি। ধর্ম এবং রাজনীতিকে এক করতে চায় আরএসএস-বিজেপি। এটা দেশের ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক। এদের ফাঁদে পড়া হবে আত্মহত্যার শামিল। সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করে নয়, বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনের বর্শা ফলকের অভিমুখ থাকুক আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতির প্রতি। দাবি উঠুক ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নয়, স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে দেশের ১৩৩ কোটি মানুষকে নাগরিকত্ব প্রমাণেই লাইনে দাঁড় করানো চলবে না। লড়াই হোক শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষকের ফসলের দাম, বেকারের কাজ, স্বল্পমূল্যে সবার শিক্ষার দাবিতে। লড়াই হোক ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি বিক্রি, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া কৃষকের আত্মহত্যা, ব্যাঙ্কে আমার/আপনার সঞ্চিত টাকা লুট, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। লড়াই হোক লুটে খাওয়াদের বিরুদ্ধে, খেটে খাওয়া মানুষের।

গণশক্তি, ১৭ডিসেম্বর, ২০১৯