20180107

ব্যাঙ্কে রাখা টাকা লোপাট করার কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত


দীপন মিত্র

কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে হাজার লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। তারমধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি দেউলিয়া হতে পারে। তার কোপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। তাদের ব্যাঙ্কে জমা সামান্য টাকা ফেরত নাও দিতে পারে ব্যাঙ্ক। সেই আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা নিয়েই এই লেখা।

এতদিন পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাস ছিল অন্তত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে তা কখনও মার যাবে না। নেহাত কোনও ব্যাঙ্ক যদি সত্যিই তেমন অক্ষম হয়ে পড়ে সরকার তাকে টাকা দিয়ে রক্ষা করবে। টাকা দিয়ে কোনোও বিত্তিয় সংস্থাকে  রক্ষা করাকে ইংরেজিতে বলে বেলআউট করা। এই তো সেদিন ২০০৮ সালে আমেরিকায় আন্তর্জাতিক মানের বিশাল বিশাল বেসরকারি ব্যাঙ্ক একের পর এক তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, অর্থাৎ দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তখন আমেরিকার সরকার তাদের লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার  জোগান দিয়ে বেলআউট করে। ইউরোপেও অনেক এমন ঘটনা সেসময় ঘটেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে একটি এমনই স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এখন ক্ষমতায় আসীন যারা তাদের এক একটি নীতির ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ নরনারীর রুজি রুটি হারালে, এমনকী শতখানেক মানুষ মৃত্যু বরণ করলেও (নোট-বাতিলের নীতি) এতটুকু লজ্জিত বোধও করে না। নির্বাচনী দরিয়া পার করতে পারলেই হয়ে গেল। তা এমত এক কেন্দ্রীয় সরকার সত্যিই এক এমন আইন আনতে চলেছেন যার অধীনে বেসরকারি ব্যাঙ্কের কথা বাদ দিই, এমনকী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রাখলেও আর তার কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে না। সংসদের এবারের শীতকালীন অধিবেশনে পেশ হবে তাই সর্বনাশা ফিনান্সিয়াল রিজলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স বিল ২০১৭। আপাতত সেটি যৌথ-সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে সলাপরামর্শের জন্য। অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই কমিটি তাদের মতামতসহ বিলটি জমা দিলেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক সেটি সংসদে আইন হিসাবে পাশ করানোর জন্য পেশ করবেন।

বেল-ইন
এই বিলের ৫২ নং ধারায় আছে একটি অভূতপূর্ব বিধান। এদেশে কেউ কখনও যার কথা শোনেনি। তার নাম হলো বেলইন। অর্থাৎ বাইরে থেকে টাকা দিয়ে ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করা চলবে না। ভিতর থেকে টাকা নিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হবে। অতঃপর এই ধারা অনুযায়ী কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যদি কোনও ব্যাঙ্কের ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা বিপন্ন হয়ে পড়ে, সেই ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের জন্য আমানতকারীদের টাকা ব্যবহার করা যাবে। আইনি ভাষায় বললে  ব্যাঙ্কে টাকা জমা করেছেন যাঁরা সেই আমানতকারীদের টাকা (মূল ও সুদসহ) ফেরানোর দায় ব্যাঙ্ক অস্বীকার করতে পারে। বেলইনের সোজা সাপটা মানে এই। সরকারি বা বেসরকারি যে কোনও ব্যাঙ্কে আমার আপনার কষ্টার্জিত টাকা, তা সেভিংসে হোক, কারেন্টে হোক অথবা ফিক্সড ডিপোজিট হোক তা পূর্ণত বা অংশত তারা নিয়ে নিতে পারে। হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও তারা করতে পারে ব্যাঙ্কের অবস্থা বিবেচনা সাপেক্ষে তারা হয়তো খানিকটা টাকা ফেরত দিলে, বাকিটা ব্যাঙ্কের শেয়ারে রূপান্তর করে আপনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এখন যদি ব্যাঙ্কটি দেহ রাখেন, আমার আপনার হাতে পড়ে থাকবে এক মুঠো ছাই। আর ব্যাঙ্কটি যদি নেহাত ধুঁকতে ধুঁকতে চলে, তবেও তার শেয়ারের দাম নামমাত্র হবে, সন্দেহ কী।

শিল্পপতিদের লুটপাট বলির পাঁঠা আমানতকারী
বিষয়টি তাহলে এরকম দাঁড়াল এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে দেশের স্বনামধন্যপ্রথম সারির শিল্পপতিরা স্বনামের মহিমায় বা রাজনীতির দাদাদের নাম-মহিমায় হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করে ফেলল। সরকার বাহাদুরের তাদের ধরা, টাকা উশুল করা তো দূরের কথা, তাদের নাম প্রকাশ করাতেও বড় লজ্জা, কে জানে কেঁচো খুড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরিয়ে পড়ে! অতএব চিন্তা কী? ধরো, এদেশের অগণ্য গরিব-গেরস্তদের। তাদের টাকাই তো ব্যাঙ্কগুলির কোটি কোটি টাকা মোট আমানতের সিংহ ভাগ। নাও ওদের তিল তিল করে সারাজীবনব্যাপী জমানো টাকাটা, হয়তো কন্যার বিয়ের জন্য অথবা ছেলের পড়াশুনার জন্য বা বিপদে আপদের রক্ষাকবচ হিসাবে রাখা একেবারে হাপিশ করে দাও। নাও নাও, অই যে অবসরগ্রহণ করে যারা পি এফ, গ্র্যাচুইটি বাবদ কয়েক লক্ষ টাকা পেয়ে ব্যাঙ্কে জমা রেখে তার সুদে দিন চালায়, হাতিয়ে নাও তাদেরও টাকা। দেখো না এই টাকা কেড়ে নিয়ে আরও কত ভারতীয় শিল্পপতির নাম ফোর্বসের ১০০ জন জগতজোড়া ধনীদের তালিকায় ঢোকানো যায়। একেবারে গুজরাত মডেলে চলছে এই সরকার - গরিবের ঘর ভেঙে ধনীদের চল্লিশতলা মহল উঠবে। একেই তো বলে উন্নয়ন!

ফিনান্সিয়াল রিজলিউশন করপোরেশন (এফ আর সি)
শুনতে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, সত্যিই ঠিক এমনই এক জন-বিরোধী আইন শীঘ্রই আনতে চলেছে ভ্রষ্টাচারবিরোধীএই সরকার। এই আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হবে উপরোক্ত এফ আর সি - যারবোর্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই হবে সরকার কর্তৃক মনোনীত। এদের শাসনের এক্তিয়ারে পড়বে তাবৎ সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক, নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থা, সমস্ত জীবন বিমা, সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি। এদের ক্ষমতা থাকবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাঙ্কগুলিকে (আর্থিক সংস্থা) একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা (মার্জার), মিলিয়ে দেওয়া (অ্যামালগ্যামেশন), দেউলিয়া ঘোষণা (ব্যাঙ্কক্রাপসি) করা অথবা বিলোপ সাধন (লিকুইডিকেশন) করা। এ সমস্ত অধিকার তারা পাবে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইন ১৯৩৫, ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক আইন ১৯৫৫, ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন আইন ১৯৪৯, ভারতীয় জীবনবিমা আইন ১৯৫৬ এবং আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনে সংশোধন এনে।

ঠুঁটো জগন্নাথ আর বি আই
১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর থেকে অর্ধশতাব্দী ধরে কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের আমানতকারীর কোনও দিনও একটি টাকাও মার যায়নিকিছু কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অবস্থা বিপন্ন হওয়ার লক্ষণ দেখা মাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করে সাধারণত, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে সেবিকে যুক্ত করে দিত। আমানতকারীদের সেভিংস বা ফিক্সড ডিপোজিট আগের মতই সুরক্ষিত থাকত।
আজ পর্যন্ত ব্যাঙ্কগুলির নিয়ন্ত্রক হলো ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাঙ্ককে রক্ষা করা বা তার বিলোপ সাধনের পুরো বিষয়টি (রিজলিউশন) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেখাশুনা করে এসেছে। মানতেই হবে তারা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। কিছু কিছু শহরাঞ্চলিক সমবায় ব্যাঙ্ককে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তুলে দিতে বাধ্য হয়, যেহেতু সেগুলির পরিচালনায় দুর্নীতির বহর এতটাই বেড়ে যায় যে তাদের সুস্থ করা সম্ভব ছিল না। তাদের চলতে দিলে আরও আরও বহু আমানতকারী সেই জালে জড়িয়ে পড়ে নিঃস্ব হতেন। এই সব ক্ষেত্রেও কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার সহযোগী সংস্থা ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি করপোরেশন (ডি আই সি জি সি)-এর মাধ্যমে প্রত্যেক আমানতকারীকে আমানত অনুয়ায়ী সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ফেরত দিয়েছেন। এই উপরোক্ত সংস্থাটি তৈরি হয় ১৯৬২ সালে। কেননা সেসময় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয়নি এবং শিল্পপতিদের মালিকানায় অসংখ্য ব্যাঙ্ক যখন তখন ফেল করতো। সমস্ত আমানত হারিয়ে গ্রাহকরা নিঃস্ব হয়ে পড়তেন। এই সংস্থাটি গড়ে তোলার পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি বিভাগ হিসাবে এই ডি আই সি জি সি-র মাধ্যমে তারা দেশের যে কোনও প্রান্তে কোনও ব্যাঙ্ক ফেল করলে আমানতের উপর বিমা হিসাবে সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন এবং এখনও দিয়ে থাকেন।

ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ইউনিয়নগুলির ভূমিকা
এই নতুন সর্বনাশা গরিববিরোধী, আমানতকারী-বিরোধী আইনটি লোকসভায় পেশ হওয়ার প্রাক্কালে অল ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি মাধ্যমে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে লেখা একটি চিঠি প্রকাশ করেন যাতে তাঁরা যুক্তিসংগতভাবে ব্যাঙ্ক আমানতের উপর এই বিমাকৃত পরিমাণ ১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ১০ লক্ষ করার আবেদন জানান। সংগঠন সম্পাদক সমীর ঘোষ আরেকটি প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই বিলের বিরোধিতা করেন এবং দাবি করেন এই বেলইন নির্দেশটিকে যেন বাতিল করা হয়। একই মর্মে ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বিশ্বাস একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ট্রেড ইউনিয়নগুলিও যেমন এ আই বি ই এ, আইবক যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে এই বিলের বিরোধিতায় নেমে পড়েছেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের এই সোচ্চার বিরোধিতার ফলে এই সংবাদ ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন জাতীয় ইংরেজি তথা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার দৈনিকে।
তা এই প্রস্তাবিত আইন যথারীতি এই ডি আই সি জি সি আইনটিকেই বাতিল করে আমানতের উপর বিমা করার কাজটি নিজেদের হাতে তুলে নেবে। অবশ্যই তারা আদৌ জানায়নি যে কোনও ব্যাঙ্ক ফেল করলে বিমা হিসাবে ন্যূনতম কত টাকা তারা দেবে, নাকি কিছুই দেবে না।

সতর্কীকরণ
সরকারের এই জনবিরোধী অবিবেচনামূলক পদক্ষেপ দেখে অনেক মানুষই ভাবতে পারেন তবে আর ব্যাঙ্কে টাকা রেখে কাজ নেই বরং মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখি। তাঁদের প্রতি বিনম্র নিবেদন যে সরকার ঠিক এইটেই চাইছে। ব্যাঙ্কে/পোস্ট অফিসে জমা টাকার উপর সুদের হার ক্রমশ কমিয়ে তারা চাইছে মানুষ মিউচুয়াল ফান্ডে, অর্থাৎ শেয়ার বাজারে যাক। শিল্পপতিদের স্বার্থবাহী এই সরকার জানে যে যতদিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বহাল থাকবে ততোদিন সুদ কমিয়েও খুব একটা সুবিধে তারা করতে পারবে না। শেয়ার বাজারে সাধারণ মানুষ যাবে না। তাহলে দেশের শেয়ার বাজার ফেঁপে ফুলে উঠবে না। শিল্পপতিদের হাতে টাকা আসবে না। মনে রাখতে হবে যে মিউচুয়াল ফান্ডগুলিও শেয়ার বাজারেই টাকা ঢালে। তারা সকলে অসৎ তাও নয়। কিন্তু তাদের কাছে জমা টাকা তারা খাটায় শেয়ার বাজারেই। যেহেতু শেয়ার বাজারে ফাটকাবাজদের রাজত্ব, এবং এই ফাটকাবাজরা মূলত বিদেশি বিশাল বিশাল আর্থিক সংস্থা, তাই তাদের বিপুল টাকা ঢালা ও টাকা তুলে নেওয়ার উপরই মূলত শেয়ার বাজারে শেয়ারের দামে ওঠা নামা হয়। এই পথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের বাড়তি প্রচুর টাকা আছে তারা এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু যাদের সঞ্চয়ের টাকাটা বেঁচে থাকার জন্যও যথেষ্ট নয়, এই ঝুঁকি তাদের নেওয়া বিপজ্জনক।

অর্থমন্ত্রীর মিথ্যা আশ্বাস
মিডিয়ার উপর যতই তারা জোর খাটান, এই সর্বনাশা বিল সাংবাদিক থেকে নিয়ে সকলের মধ্যেই ভয় সঞ্চার করেছে। ফলে চারিদিকে হইচই পড়ে গেছে। বিপদ বুঝে অর্থমন্ত্রী মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদের আশ্বাস দিয়েছেন যে এই আইন নাকি আমানতকারীদের স্বার্থের কথা ভেবেই করা হয়েছে এবং আমানতকারীদের কোনও টাকা মার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একথা তিনি বলেননি যে বিলের ৫২ নং ধারায় বর্ণিত বেলইন খারিজ করা হলো বা বাদ দেওয়া হলো। ফলে তাঁর বক্তব্য তো ফলক হয়ে চিরবিরাজমান থাকবে না। কিন্তু বেলইন থেকে যাবে। আরও বহু সর্বনাশা বিধান থেকে যাবে। অতএব এ ধরনের আশ্বাসবাণী যে ভুয়ো, তা সকলেই বুঝতে পারছেন।

গড়ে উঠুক গণপ্রতিরোধ
এই সর্বনাশা বিলের আরও অনেক মারাত্মক দিক আছে যা নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয় এবং কাম্যও নয়। তবু এ কথা বলতেই হবে যে এই বিল আইনে পরিণত হলে অনেকগুলি জাতীয় আর্থিক সংস্থা, যেগুলি এই দেশকে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে নিয়ে গেছে, সংকটের সময় দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, সেগুলি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অধিকার খর্ব হওয়ার কিছুটা প্রসঙ্গ উপরে এসেছে। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায় ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক সম্পর্কে। ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক আইন ১৯৫৫-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী এক মাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বিশেষ নির্দেশ ভিন্ন এই ব্যাঙ্কটির বিলোপ সাধনের কোনও প্রচেষ্টাই গ্রাহ্য হবে না। অথচ নতুন এই প্রস্তাবিত সর্বনাশা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনে স্টেট ব্যাঙ্কেরও বিলোপসাধন তারা করতে পারবে। 
ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন আইন ১৯৪৯-এর প্রারম্ভিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে এই আইনের মোতাবেক ব্যাঙ্কের আমানতকারীর স্বার্থই সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান। কিন্তু প্রস্তাবিত সর্বনাশা আইন ব্যাঙ্কগুলিকে কোম্পানি আইনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যে আইন বলে শেয়ার-হোল্ডারদের স্বার্থ সর্বোপরি। এক কথায় এই সর্বনাশা আইন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা ব্যবস্থাকে ভিতর থেকে ফোঁপরা করে বেসরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছে। শেষ করার আগে জানাই যে সাইপ্রাস নামক একটি দেশে এই বেলইন প্রথম লাগু হয়। তার ফল হয় ভয়াবহ  আমানতকারীরা তাঁদের জমা টাকার ৬০ শতাংশ খুইয়ে ফেলেন।
আসুন আমরা ব্যাঙ্ককর্মচারীদের লড়াইয়ের সঙ্গে একহয়ে এই সর্বনাশা বিলের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলি। আর বিলম্ব করলে আমরা কিন্তু এই স্বৈরতন্ত্রী সরকারের ধ্বংসাত্মক চাপের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না। ইতিহাস এই শিক্ষাই দেয় যে কোনও স্বৈরতন্ত্রই গণপ্রতিরোধের জোয়ারের সামনে দাঁড়াতে পারে না। আসুন আমরা সেই পথেই হাঁটি।


গণশক্তি, ১৩ই ডিসেম্বর ২০১৭

এফ আর ডি আই বিল:রাজকোষ হতে চুরি...


জয়দেব দাশগুপ্ত

বাংলা ১৩০৬ সালে মানে আজ থেকে ১১৭ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিশোধনামে একটি কবিতা লেখেন। শিরোনামে পঙ্ক্তিটি দিয়ে কবিতার শুরু। কিন্তু পাঠক দেখুন, রাজকোষ থেকে অর্থ তছরূপ বা চুরির হদিশ বা কে চোর তা কবি লেখেননি। শুরু থেকে কবিতা অন্য প্রবাহে চলতে শুরু করল। এক অনবদ্য সৃষ্টি হয়ে রইলো কবিতাটি যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।
রাজকোষ বা Treasury থেকে চুরি কে করতে পারে তা যে কোনও নাগরিক বিলক্ষণ বুঝতে পা‍‌রেন। যার ক্ষমতা আছে, যে বা যারা জানে তাদের কোনও শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। আজকের সরকারের বদান্যতায় বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরকারি অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যবসাকে বাড়িয়ে, এক ব্যবসার জন্য অর্থ নিয়ে অন্য নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, বিশ্ব ধনকুবেরদের তালিকায় নাম তুলে দেশের গরিব মানুষদের কৃতার্থকরে দেশের মুখ উজ্জ্বলকরছে। কিন্তু টাকা যা ধার নিয়েছে তা ফেরত দিতে তাদের প্রচণ্ড অনীহা। এদের প্রত্যেকের নাম ব্যবসা সরকার জানে। কিন্তু প্রকাশ করলে এদের ভাবমূর্তিতে যে আঘাত লাগবে তাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার খুবই বিব্রত হবে। তাই সরকার অর্থমন্ত্রক খুবই ধৈর্যশীল। এবার তাদের কথায় আসা যাক। কারণ কোষাগারের পয়সা বা ব্যাঙ্কের টাকা তো সাধারণ মানুষের। তারা বিশ্বাস করে সরকারি ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছেন। সেই টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়েছে। টাকা ফেরত না এলে গরিবরা বিপদে পড়বে, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরিকাঠামোর উন্নয়ন থমকে যাবে, কৃষিঋণ কমবে, অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া বন্ধ হবে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকরা ছোট/মাঝারি ব্যবসায় ঋণ পাবেন না, যা সারা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আমাদের দেশ নানা সংকটে জর্জরিত কিন্তু এই অভাবনীয় সংকট, বড় বড় কোম্পানিগুলো ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে টাকা ফেরত দেবে না আমরা মানবো কেন?
১৯৯৮ সাল জ্যোতি বসু
দশকে তিনটি ব্যাঙ্ক দুর্বলবলে ঘোষণা হয়। কারণ ছিল একই। কলকাতায় সদর দপ্তর এমন দুটি ব্যাঙ্ককে CII (Confederation of Indian Industry) চরম সংকটে পড়েছে বলে গ্রাহকদের পরামর্শ দেয় ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা রাখা নিরাপদ নয়। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিবৃতি দিয়ে বলেন CII- ভূমিকা চরম নিন্দনীয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কে টাকা রাখা নিরাপদ, সুতরাং কোনও ভয় নেই। একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র একটি ব্যাঙ্কের সদর দপ্তরের ছবি ছাপিয়ে গ্রাহকদের টাকা তুলে নিতে প্ররোচনা দেয়। তবুও কোনও মানুষ টাকা তুলে নেননি। প্রয়াত জ্যোতি বসুর এই অবদান চিরকাল মনে রাখবো।

ব্যাঙ্কগুলি রুগ্নয়, শক্তিশালী
২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আমানত ৮১ লক্ষ কোটি টাকা, ঋণদান ৫৬ লক্ষ কোটি টাকা, বিনিয়োগ প্রায় ২৬ লক্ষ কোটি টাকা। আমানত সংগ্রহ প্রমাণ করে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারি ব্যাঙ্ককে শুধু ভরসাই করে না, আস্থাও অটুট। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগী, ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক, গরিব, মধ্যবিত্ত, অসংগঠিত শ্রমিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রেখে নিশ্চিন্ত। কোনও বিদেশি ব্যাঙ্ক গত ২৬ বছরে সরকারি ব্যাঙ্কের উপর মানুষের বিপুল আস্থায় চিড় ধরাতে পারেনি। সরকারি ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ক সরকারি, বিদেশি নানা বিধান, বিধিনিষেধের মধ্যেও বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়েছে।
আসলে ব্যাঙ্কের রুগ্ণতা জন্য দায়ী দেশের বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি যারা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। এর পরিমাণ সরকারি হিসাবেই লক্ষ কোটি আমাদের হিসাবে ১৭-১৮ লক্ষ কোটি টাকা। পুরানো দিনে রেল বাসে বিজ্ঞাপন দেখা যেত সরকারি সম্পত্তি-আপনার সম্পত্তি। কথাটি বাস্তবে প্রয়োগ করেছে দেশের কয়েক‍‌টি পরিবার। তারা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়েছে, ব্যবসা করেছে, ব্যবসা বাড়িয়েছে, একটি ব্যবসার জন্য টাকা নিয়ে অন্য ব্যবসায় খাটিয়েছে, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নাম তুলেছে কিন্তু সরকারি ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। সরকার নির্বিকার। নানা আইন, আইনের সংশোধন, নতুন আইন প্রনয়ণ কিন্তু এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি সাড়ম্বরে ব্যবসা করে চলেছে। ব্যাঙ্ক রুগ্দেশের সাধারণ মানুষ দারিদ্রে পীড়িত কিন্তু এরা বিপুলাকার। এখনই এদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা দরকার। তাহলেই রুগ্ এই বিশেষণ থাকবে না।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা ব্যস্ত অন্য কাজে। কোনও মানুষ কি খাবে, কি পরবে, কেমনভাবে ধর্ম পালন করা উচিত, সংবিধান কেন ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি থাকবে এসব অতি প্রয়োজনীয় বিষয়নিয়ে গভীর চিন্তা কাজে নিমগ্ন। সুতরাং সময় কোথায়? তবুও যেটুকু সময় বার করা গেছে গত সাড়ে তিন বছরে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে জিনিসের দাম বাড়ছে, সরকারি সম্পত্তি বেচা হচ্ছে, গোরক্ষকরা সমাজরক্ষকের ভূমিকায় এবং পরিশেষে এফ আর ডি আই ব্যাঙ্কের সমস্ত গ্রাহকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

কিছু তথ্য এবং বাস্তবতা
২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, ৫৬‍‌টি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, ৩১‍‌টি রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক, ৩৭০‍‌টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক, ১৬০৬টি শহরাঞ্চলীয় সমবায় ব্যাঙ্ক এবং ৯৩,০০০টি প্রাথমিক কৃষি ঋণদান সমিতি নিয়ে ব্যবস্থা। শক্তিশালী এই ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের স্বার্থে ধারাবাহিক কাজ করে চলেছে। অন্যদিকে ৫৫৯টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের দায়িত্ব ১৯৬৯ সালের পর থেকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি গ্রহণ করেছে আমানতকারীদের স্বার্থে। ১৯৬৯ সালে আমানত ঋণ নিয়ে ব্যাঙ্কগুলির মোট ব্যবসা ছিল ৯০০০ কোটি টাকা। যা আজকে ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা।
এবার আসা যাক ঋণ খেলাপিদের কাছে ব্যাঙ্কের পাওনা ২০০৪ সালে ৪৮০০০ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ,৯৪,০০০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ,১১,০০০ কোটি টাকা, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বর ,০০,০০০ কোটি টাকা।
মাত্র ৫০০টি অ্যাকাউন্টে ,০০,০০০ কোটি টাকা সরকারি হিসাবেই ব্যাঙ্কগুলি পাবে। অর্থমন্ত্রকের হিসাবে মাত্র ১২‍‌টি চিহ্নিত কোম্পানি থেকে ব্যাঙ্কগুলির পাওনা ,৬০,০০০ কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ের দায়িত্ব কার? ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলির যার এই ঋণ মঞ্জুর করেছে, সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যাদের তত্ত্বাবধানে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি চলে।
২০১৫ সালে ব্যাঙ্কগুলি মোট লাভ করেছে ,৩৮,৭০০ কোটি টাকা, নিট লাভ ৩৭,০০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ব্যাঙ্কগুলির মোট লাভ ,৩৭,৩০০ কোটি টাকা, নিট লোকসান ১৮,৬৭০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাঙ্কগুলির মোট লাভ ,৫৯,০০০ কোটি টাকা, নিট লোকসান ১১,০০০ কোটি টাকা।
তাহলে প্রশ্ন আসবে মোট লাভ হলে নিট লোকসান কেন হয়। ঋণ খেলাপিদের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে Balance Sheet- Provision (অর্থাৎ ঋণ খেলাপিদের জন্য বন্দোবস্ত বা অর্থের সংস্থান) করতে হয়। যার জন্য উপরোক্ত তিনটি বছরে ব্যাঙ্কগুলিকে সংস্থান করতে হয়েছে ২০১৫ সালে ,০০,৯০০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ,৫৫,৯৭০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ,৭০,০০০ কোটি টাকা। দায় কার?
যে ঋণ আর ব্যাঙ্কে ফিরবে না বা বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলিকে ফেরত দিতে হবে না তা Balance Sheet থেকে মুছে ফেলা হয়েছে write off এর মাধ্যমে। কত টাকা একবার দেখুন : ২০০৫-২০১৪ মোট ,৪৬,৯০০ কোটি টাকা, ২০১৫ ৪৯,০০০ কোটি টাকা, ২০১৬ ৫৭,৪০০ কোটি টাকা, ২০১৭ ৮১,৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন বছরে প্রায় ,৮৮,০০০ কোটি টাকা। সাধারণ আমানতকারীদের টাকার এমন কর্পোরেট হরির লুটআমরা দেখছি। অথচ সরকার, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিনমাধ্যম দিক‍‌টি সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে না। এবার এর সমস্ত দায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ আমানতকারীদের সঞ্চয়ের উপর।

মানুষের অর্থ সঞ্চয় দেশের অগ্রগতি
আপনি যদি ৫০০০ টাকা নিজের কাছে রাখেন বা ঘরে রাখেন তবে তা নিরাপদ কিন্তু যদি ব্যাঙ্কে রাখেন তবে তা নিরাপদ থাকবে না কোন আইন? যে কোনও নোটের উপর ( টাকা বাদে) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের আশ্বাস থাকে। যা সরকার কর্তৃক গ্যারান্টি। আপনি ৫০০০ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে কিছু সুদ পাবেন (যদিও সুদের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে) কিন্তু আপনার মতো কোটি কোটি গ্রাহক ব্যাঙ্কে টাকা রাখছে বলেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে। দেশের পরিকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্প ব্যবস্থার অগ্রগতি, গরিব মানুষের ঋণ প্রদান, বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের যেটুকু বন্দোবস্ত তা করা সম্ভব হয়েছে। কিছু বিশাল ধনকুবের ব্যাঙ্কের টাকা চুরি করলে তার খেসারত সাধারণ গ্রাহকদের দিতে হবে কেন? যে ধরনের আর্থিক ব্যবস্থা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তার নির্মম রূপ এই বিলের মধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সরকারি ব্যবস্থা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওরা গ্রাহকদের বাজারি জুয়ার অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছে। আমরা সবাই একত্রিত হলে এই ভয়ংকর আইনকে রুখে দিতে পারবো।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এক ডেপুটি গভর্নর
যাদের হাতে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ভার সেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সাহেবের নিদান এত সরকারি ব্যাঙ্কের দরকার কি? যেন ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমলেই বড় বড় ঋণ খেলাপিরা লাইন দিয়ে এসে বকেয়া টাকা ফেরত দিয়ে যাবে। তার ডেপুটি আরও সরেস, তার নিদান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির পুনরায় বেসরকারিকরণ প্রয়োজন। অর্থাৎ চাকা ঘোরাতে হবে : বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ১৯৬৯ এবং ১৯৮০ সালে সরকারি ব্যাঙ্ক আবার ফিরে যাও ১৯৬৮ সালে। আসলে যবে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার কেন ব্যবসা করবে? ব্যবসা করবে ব্যবসায়ীরা তবে থেকেই এই বিপদ। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করলে দেশের মানুষের লাভ হবে? দেশের সরকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে সে জায়গায় লটেরাদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়।

এফ আর ডি আই বিল ২০১৭
এই বিলে হঠাৎ আসেনি। ১৯৯১ এর পর থেকে (সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিপর্যয়ের পর) একের পর এক কমিটি গঠন করে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের নিরলস প্রয়াস সফল হয়নি। বরং ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। সম্প্রতি পি জে নায়েক কমিটির সুপারিশ, বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকারের জ্ঞান সঙ্গম-এবং জ্ঞান সঙ্গম-’, ‘ইন্দ্রধনুষপ্রকল্প, ‘বিচার মন্থননানা গালভরা নামের আড়ালে লক্ষ্য ছিল একটাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ। যেন ব্যাঙ্কের শীর্ষপদ চেয়ারম্যানের নাম বদল করে ম্যানেজিং ডিরেক্টর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার করলেই ব্যাঙ্কগুলি ঘুরে দাঁড়াবে। যত কমিটির যত সুপারিশ জমা পড়েছে ততই সরকারি ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলি চুরি করেছে। অনুৎপাদক সম্পদ পোশাকি নাম NPA (Non Performing Assets) বেড়েছে। সরকারি ব্যাঙ্কের শেয়ার বাজারে বেচা হয়েছে সরকারি ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলিতে শেয়ার বাজারের দালালেরা স্বমহিমায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাঙ্কগুলি বড় বড় শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলিকে লাগামহীন ঋণ দিয়েছে কমে গেছে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রের ঋণ, চাষি সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পেয়ে মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে আর অন্যদিকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সাত-আটটা ব্যাগ নিয়ে এক শিল্পপতি বেসরকারি বিমানে চে‍‌পে সাগর পাড়ি দিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। কি অদ্ভুত বৈপরিত্য!
সাধারণ মানুষ নোট বাতিলের সময়ে নিজের টাকা ফেরৎ নিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ১০০ জন মানুষ মারা গেলেন ১০ জন ব্যাঙ্ক কর্মচারী কাজের চাপে মারা গেলেন কিন্তু সরকার নির্বিকার। কালো টাকা উদ্ধার, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অর্থ যাওয়া বন্ধ করা, জাল নোট উদ্ধার করার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরিণতি যত নোট বাতিল হয়েছিল তার ৯৯ শতাংশই আবার ফিরে এসেছে এখনও ১৪ মাস ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক টাকা গুনে চলেছে নতুন ছাপানো নোট দুমাসের মধ্যে জাল হয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা তাদের কার্যকলাপ নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে যে কালো টাকা ছিল তা ব্যাঙ্কের কাউন্টারে জমা পড়ে সাদা হয়েছে। উপরন্তু নতুন নোট ছাপাতে ৭০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয়েছে।
এখন আবার নতুন বিল এফ আর ডি আই ফিনানসিয়াল রেজোলিউশন এন্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স বিল-২০১৭। বছর জুন মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই বিল অনুমোদন করে সংসদে পেশ করে। এই বিলের বিরুদ্ধে বছর জুলাই মাসে আমরা বিবৃতি দিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। সবার প্রতিবাদের ফলে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সংসদের যুক্ত কমিটির কাছে বিলটি পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
এই বিলের ১৪৭ পাতা জুড়ে নানা বিধান দেওয়া হয়েছে যেন ব্যাঙ্কের রুগ্ণতা জন্য দায়ী সাধারণ গ্রাহক আমানতকারী। সবচেয়ে বিপদজনক দিক হলো এই বিল আইনে পরিণত হলে একটি রেজো‍‌লিউশন কর্পোরেশন গঠিত হবে যার হাতে থাকবে দানবীয় ক্ষমতা।
() যে কোনও ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্ককে সংযুক্তিকরণ, দেউলিয়া ঘোষণা বা চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারবে।
() সেই সংস্থায় গ্রাহকের সঞ্চিত অর্থ ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত, মেয়াদি আমানতের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বা সেই সংস্থার শেয়ার ইক্যুইটি সঞ্চিত অর্থের বদলে নিতে বাধ্য করা।
() এই কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত কোনও সরকারি প্রশাসনিক সংস্থা বিরোধিতা করতে পারবে না বা আদালতে বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
() কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল অতি সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত একটি ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় কর্তা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সারা জীবন সুদ পাওয়ার ইচ্ছা ছাড়তে হবে। সুদের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে তবুও কেন মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখছেন। তারা শেয়ার বাজারে বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে টাকা জমা রাখুক বা সোনা কিনুক।
সত্য কথাটি হলো সরকার আর কোষাগার থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা দিতে চাইছে না। সরকার অতি সম্প্রতি ১১টি সরকারি ব্যাঙ্ককে শর্তাধীনে টাকা দিয়েছে। এবার গ্রাহকের সঞ্চিত অর্থের ওপর নজর পড়েছে সরকারের ওখান থেকেই টাকার জোগান দিয়ে রুগ্ব্যাঙ্কগুলিকে টাকার বন্দোবস্ত করা যার পোশাকি নাম বেল-ইন।
যে কয়েকটি পরিবার সরকারি ব্যাঙ্কগুলি থেকে সরকারি হিসাবেই লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করল তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে গেলে সরকারের পতন হবে, তাই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত এই বিধান।

মুক্ত করো ভয়...
সারা ভারতের ১০ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারী এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। চলছে সই সংগ্রহ স্পিকারের কাছে জমা পড়বে কোটি কোটি গ্রাহকের আবেদন। ২৪শে জানুয়ায়রি ২০১৮ সারা ভারতে আমাদের ফেডারেশনের ডাকে ধরনা-অবস্থান হবে, রাস্তায় বসে ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা সই সংগ্রহ প্রচার করবেন।
গত ২৬ বছরে ৫৬টি ধর্মঘটের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা সরকারের বিভিন্ন অপপ্রয়াস জনবিরোধী সিদ্ধান্তের মোকাবিলা করেছেন। তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সরকারি ব্যাঙ্ক  দেশের আপামর জনতার। এই ব্যবস্থা থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা সরকারের নেই। লড়াই হবে রাজপথে, রাস্তায়, গ্রামে, শহরতলিতে। টাকা রাখবো ব্যাঙ্কেই। টাকা যারা চুরি করেছে তাদের কঠোরতম শাস্তি চাই। সরকারি ব্যাঙ্কের আমানত জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হোক, গরিব মানুষকে কম সুদে ঋণ দেওয়া হোক, যথার্থ পরীক্ষা করে বড় বড় ঋণগুলি দেওয়া হোক।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র আমাদের এই ক্ষেত্র থেকে আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না।  
 
(লেখক ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, পশ্চিমবঙ্গ-র সাধারণ সম্পাদক)

গণশক্তি, ১লা জানুয়ারি, ২০১৮