20201108

সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিল নভেম্বর বিপ্লব

 


জ্যোতি
বসু

 

বছর সারা পৃথিবীতে মহান নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও মর্যাদার সঙ্গে আমরা মহান নভেম্বর বিপ্লবকে স্মরণ করবো।

অনেকেই এখন বলে থাকেন যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে যে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, সেই সোভিয়েতই তো এখন নেই! তবে নভেম্বর বিপ্লব দিবস উদ্যাপন, করার যৌক্তিকতা কোথায়? যারা এসব কথা বলেন, তারা আসলে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যে‍‌ দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি যে সাফল্য অর্জন করেছিল তাকেই খাটো করে দেখাতে চান। কার্ল মার্কস ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোঘোষণার মাধ্যমে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব রাষ্ট্র বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শকে প্রচার করেন। এই মতবাদের ভিত্তিতে পুথিবীর দেশে দেশে, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে সেখানকার শ্রমিকশ্রেণি প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে, যা প্যারি কমিউনহিসাবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। যদিও এই চেষ্টা সফল হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই বুর্জোয়াদের হিংস্র আক্রমণের ফলে প্যারি কমিউন’-এর পতন ঘটে। কিন্তু কমিউনার্ড-দের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা, সে সময় ইউরোপের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া জার্মান, হাঙ্গেরিসহ কয়েকটি দেশে শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।

১৯১৭ সালে জার শাসিত রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বেই প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়, যা নভেম্বর বিপ্লব হিসাবে পরিচিত। মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ মার্কসবাদের সফল সার্থক প্রয়োগ হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে। মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশ্তেহার রচনার সময় এবং পরে এই ধারণার কথা বলেছিলেন যে এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশেই আগে শ্রমিক বিপ্লব হবে। মার্কস-এঙ্গেলস যখন একথা বলেন, সে সময় পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। তখন এই ধারণাই সঠিক ছিলো। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পুঁজিবাদ, তার সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি গোটা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে লেনিন মার্কসবাদের সৃজনশীল বিকাশ সার্থক প্রয়োগ জারশাসিত রাশিয়ায় ঘটান। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে রাশিয়া অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের এই দুর্বলতম গ্রন্থিতেই শ্রমিকশ্রেণিকে আঘাত হানতে হবে। লেনিনের এই তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে বিপ্লবী আন্দোলনে নতুন পথনির্দেশ দিয়েছিল। এজন্য কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঘোষণা করেছিল, লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। এজন্য আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অনুসরণ করার কথা বলি।

শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখিয়ে দিয়েছিল যে সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদের থেকে অনেক উন্নত সমাজব্যবস্থা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলিও যে সমাধান করা সম্ভব, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গোটা পৃথিবীর সামনে তার উদাহরণ তুলে ধরে। পুঁজিবাদের চার শতাব্দীর ইতিহাসে যে প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব হয়নি, তা অল্প দিনের মধ্যেই করে দেখায় সমাজতান্ত্রিক শিশুরাষ্ট্র। রাশিয়া ছিল অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া। কিন্তু মাত্র ১৩ বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। যে সামাজিক সাম্য ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রশংসা বিশ্বের বহু মনীষী অকুণ্ঠভাবে করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের সময় রাশিয়ার চিঠি’-তে শুরুতেই লিখেছিলেন, ‘যা দেখছি, আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনও দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা জাগিয়ে তুলেছে।’’

বিশেষ করে জনশিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নভেম্বর বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই গোটা দেশজুড়ে শিক্ষা বিস্তারের বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শুধুমাত্র ইউরোপীয় অংশেই নয়, এশিয়ার অংশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পশ্চাৎপদ উপজাতিদেরও শিক্ষার অঙ্গনে টেনে আনা হয়েছিল। জাতিগঠনের প্রশ্নে শিক্ষার যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে তা সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও এই দিকটি নজর কেড়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যা নয়, তার সম্পূর্ণতায় তার প্রবণতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় নিকর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন কী বিপুল উদ্যম।’’

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নেও সোভিয়েত ইউনিয়নই পথিকৃৎ। নারী পুরুষের জন্য পূর্ণ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরির অল্প দিনের মধ্যেই গৃহীত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নই বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যেখানে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নারী-পুরুষকে সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হয়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বলে অভিহিত গ্রেট ব্রিটেন এই অধিকার দেয় ১৯২৮ সালে।

জন্মলগ্ন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, অন্তর্ঘাত প্রভৃতি প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ দেশ থেকে অল্প দিনের মধ্যেই অগ্রসর দেশে পরিণত হয়। দ্রুত এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের মতো বিধ্বংসী শক্তিকে আটকাতে সক্ষম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যা পুঁজিবাদী দেশগুলির পক্ষে সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানব সভ্যতাকে রক্ষা করেছিল। কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে কখনই ম্লান করা যাবে না।

৭৪ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপর্যয় ঘটলো কেন নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের পার্টি সম্পর্কে ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কেশীর্ষক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাতে প্রশ্নের কিছু উত্তর আছে। আমি সে কথায় ‍‌রে আসবো।

একথা সকলেরই জানা যে, লেনিন রাশিয়ার বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করলেন তা ছিল একটি পশ্চাৎপদ দেশ। ফলে তাঁকে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলতে হয়েছিল কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা, দিক-নির্দেশ তাঁর সামনে ছিল না। তিনিই নয়া অর্থনৈতিক নীতি (NEP) চালু করেছিলেন, যে রাষ্ট্র বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যদিও আধিপত্য ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের।

আমরা কখনই ভাবতে পারিনি যে, একটা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পর তার আবার পতন হতে পারে এবং আবার সে দেশে পুঁজিবাদ ফিরে আসতে পারে। আমরা কেন, পৃথিবীর অনেক বড় কমিউনিস্ট পার্টিই তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু লেনিন বারে বারে আত্মসন্তুষ্টি পরিহার করার কথা বলেছিলেন। বিশেষ করে চারপাশে সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছিলেন। তিনি আমেরিকান পেশাদারি দক্ষতা থেকেও শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

রাশিয়ায় পরবর্তীকালে যে মতাদর্শগত চর্চার অভাব ঘটেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সে দেশে গিয়েও আমার নিজের বিষয়ে মনে হয়েছিল। প্রথম যাই ১৯৫৭ সালে। তারপর আরো কয়েকবার গিয়েছি। সাল মনে নেই, একবার সে দেশে গিয়ে ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণসাগর)- উপর দিয়ে একটা জাহাজে করে যাচ্ছিলাম। সেই জাহাজটি এক সময়ে হিটলারের জাহাজ ছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বাহিনী তা কবজা করে। প্রায় ২২০০ যাত্রী সেই জাহাজে ছিল। প্রায় সকলেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। জাহাজের মধ্যে খেলছে, সাঁতার কাটছে। কিন্তু দেখলাম কেউই খবরের কাগজ পড়ছে না। অথচ কাগজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপা হয়েছে। ওদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়েছে এবং রয়েছে এক রুশ মহাকাশচারীর প্রত্যাবর্তনের খবর। কিন্তু তাতেও ওদের কাগজ পড়ার আগ্রহ নেই। আমি এক দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ওদের খবরের কাগজ পড়ার আগ্রহ নেই কেন?’’ জবাবে সে বললো, ‘‘ওরা ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। তাই ওদের আগ্রহ নেই। ফিরে এসে কাগজ দেখবে। তাতে শুধু দেখবে ওদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা কিছু বাড়লো কি না।’’ তখন এই বিষয়টা নজরে এসেছিল। সবটা বুঝিনি আজ বুঝি প্রবণতাটা তখন থেকেই তৈরি হয়েছিল।

অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্ব‍‌শেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় বিজয়ওয়াদায়। সেই কংগ্রেসেই বোঝা গিয়েছিল পার্টি ভাঙতে চলেছে। তখন তো ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে স্তালিনবিরোধী প্রচার পুরোদমে চলছে। এই অবস্থায় আমাদের পার্টি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে একটি প্রতিনিধিদলকে মস্কো পাঠায়। দলে আমিও ছিলাম। এছাড়াও ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত গোবিন্দন নায়ার। সোভিয়েত পার্টির তরফে আলোচনার মধ্যে ছিলেন সুসলভ এবং পনোমারিয়েভ। আমার একটি প্রশ্নে পনোমারিয়েভ চটে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আপনারা স্তালিনের আমলে লেখা বলশেভিক পার্টির ইতিহাসবইটি বাতিল করে দিলেন কেন? তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক তো বই পৃথিবীর সর্বত্র প্রচার করেছিল।’’ জবাবে পনোমারিয়েভ রেগে গিয়ে বললেন, ‘‘ বইতে মার্কসবাদী দর্শন বিষয়ে স্তালিনের একটি লেখা ছিল। স্তালিন দর্শনের ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন। Negation of the negation বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যায় ত্রুটি ছিল। আমরা তা সং‍‌শোধন করে নতুন বই লিখেছি। এখন তার তর্জমার কাজ চলছে।’’ আমি সুসলভকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আপনারা স্তালিনের এত সমালোচনা করছেন কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এই সমালোচনা করেননি কেন?’’ এই প্রশ্নের জবাবে সুসলভ কিন্তু রেগে গেলেন না। তিনি হেসে বললেন, ‘‘এটা বুঝবেন, স্তালিন তো শুধু সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন না বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ছিলেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা সহজ ছিল না।’’ সেই সময় আলবানিয়ায় সরকার উৎখাতের বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মদত জোগাচ্ছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘আপনারা এটা কেন করছেন? সে দেশে কোন্সরকার থাকবে তা সে দেশের মানুষই ঠিক করবেন।’’ জবাবে সুসলভ বললেন, ‘‘ওরা আমাদের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক প্রচার করছে। তাই আমরা একাজ করছি।’’ স্বভাবতই সুসলভের এই জবাব শুনে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। পরে ফিরে এসে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটা রিপোর্ট দিয়েছিলাম।

আগেই বলেছি যে, সোভিয়েতে বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে আমাদের পার্টি ১৯৯২ সালে মাদ্রাজ (চেন্নাই) পার্টি কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই প্রস্তাবে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়। তারমধ্যে একটি হলো, সে দেশে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বদলে পার্টির এবং বেশিরভাগ সময়ে পার্টি নেতৃত্বের একনায়কত্বে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে পার্টি রাষ্ট্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে গিয়ে উন্নতমানের ভোগ্যপণ্য তৈরির কাজ অবহেলিত থেকেছে। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারেনি। এছাড়া মতাদর্শগত চেতনা প্রসারের ঢিলেমি দেখা দিয়েছিল।

আমি এই লেখায় সেই বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার কথা হলো, এই যাবতীয় অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। একই ভুল আমরা যাতে না করি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সব থেকে বড় কথা, কমিউনিস্টদের অনেক দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়েই এগোতে হবে। কিন্তু এই সঙ্কল্প রাখতে হবে পৃথিবীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকীতে সেই লক্ষ্যে কাজ করার শপথ আমাদের নিতে হবে।

 (২০০৭ সালের নভেম্বর মহান নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকী উপলক্ষে গণশক্তিতে জ্যোতি বসুর এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।)