20160301

বর্তমান রাজ্য সরকারের আর্থিক বিষয়ে ভিত্তিহীন বক্তব্য এবং প্রকৃত তথ্য

ড. অসীম দাশগুপ্ত

তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বর্তমান রাজ্য সরকার সম্প্রতি রাজ্যের কর রাজস্ব আদায়, পরিকল্পনা ব্যয়, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের উপর পুনরায় একাধিক ভিত্তিহীন বক্তব্য রেখেছে। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন বক্তব্য এবং প্রকৃত তথ্যাবলী একত্রিত করে এই প্রতিবেদনটি রাখছি।

১. কর রাজস্ব আদায়
ভিত্তিহীন বক্তব্য : বর্তমান রাজ্য সরকার সম্প্রতি (২০১৬) বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন উপলক্ষ্যে “A Tale of Four Years (চার বছরের কথা বা গল্প!) নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। এই বইতে লেখা হয়েছে যে, গত চার বছরে রাজ্য সরকারের নিজের কর রাজস্ব সংগ্রহ দ্বিগুণ (অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ১০০%) বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রায় একই সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে যে বিশাল আকারে কয়েকদিন ধরে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, তার প্রথম লাইনেই লেখা হয়েছে যে, গত চার বছরে রাজ্য সরকারের কর রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ বা শতকরা হিসেবে ২০০%! অর্থাৎ, একই সরকারের প্রায় এক সময়েই প্রকাশিত বইতে লেখা কর রাজস্ব বৃদ্ধির দাবির সঙ্গে বিজ্ঞাপনে দেওয়া দাবির মধ্যে চূড়ান্ত স্ববিরোধ। তাহলে প্রকৃত তথ্যটি কি?
প্রকৃত তথ্য : বিভিন্ন বছরের রাজ্য বাজেটের তথ্যাবলী থেকে দেখা যায় যে, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে ২০১০-১১ সালে, রাজ্য সরকারের নিজস্ব কর আদায় ছিল ২১,২২৮ কোটি টাকা, এবং সে বছরে কর রাজস্ব বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৭%। তারপরের বছরে, অর্থাৎ তৃণমূল সরকারের প্রথম বছরে (২০১১-১২) সেই কর রাজস্ব বৃদ্ধির হার কমে গিয়ে হয় ২০.৬%। তার পরের বছরে (২০১২-১৩) সহসাই এই রাজ্য সরকার রাষ্ট্রপতির অনুমোদন না নিয়েই বেআইনীভাবে পণ্যসামগ্রীর উপর একটি প্রবেশ কর লাগু করে দেয় প্রতিটি পৌরসভা এবং গ্রামপঞ্চায়েত স্তরেও। আমরা সতর্ক করে দিয়েছিলাম, যা অগ্রাহ্য করে এই সরকার প্রবেশ করটি আদায় করতে শুরু করে এবং এই বছরে কর রাজস্ব বৃদ্ধি হয় ২৮.১% হারে। কিন্তু তার পরের বছরেই এই প্রবেশ করের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট এইভাবে প্রবেশ কর চাপানোকে বেআইনী বলে তাকে খারিজ করে দেয়। ফলে, তার পরের বছরে (২০১৩-১৪) কর-রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং রাজস্ব বৃদ্ধির হার হয় মাত্র ৯.২শতাংশ। এবং এরপরে ২০১৪-১৫ সালেও রাজস্ব বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশের খুব বেশি উপরে উঠতে পারবে না বলে অনুমতি হয়েছে। এর পিছনে একটি বাড়তি কারণ হলো ‍‌শিল্পে নতুন বিনিয়োগ না হওয়া এবং শিল্প-উৎপাদনে শ্লথতা। ফলে (২০১৪-১৫) সালে রাজ্যের কর আদায় পরিমাণ হতে পারে আনুমানিক ৩৯,১০০কোটি টাকা। অর্থাৎ গত চার বছরে কর রাজস্বের বৃদ্ধি হবে ২১,২২৮ কোটি টাকা থেকে ৩৯,১০০ কোটি টাকা যা দ্বিগুণের কম, এবং শতাংশ হিসেবে ৮৬% যাও ১০০% এর কম, এবং অবশ্যই বিজ্ঞাপনে প্রচারিত ২০০% শতাংশের থেকে হাস্যকরভাবেই কম। এই শেষোক্ত ভুলটি প্রাথমিক গণিতের স্তরে এবং একই সঙ্গে এটি হলো প্রচার সর্বস্বতা এক নির্লজ্জ উদাহরণ। তবে যদি বর্তমান অর্থবর্ষকে (২০১৫-১৬) যুক্ত করে (যা এখনো শেষ হয়নি) পাঁচ বছরের কর রাজস্ব বৃদ্ধি অনুমান করা হয় (যা এই সরকার বইতে বা বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেনি), তাহলে কর রাজস্ব বৃদ্ধি দ্বিগুণ বা ১০০% হতে পারে। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাঁচ বছরের সময়কাল নিলে  বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কর রাজস্ব ২০০৫-০৬ সালে ১০,৩৮৮ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে (২০১০-১১) সালে হয়েছিল ২১,২২৩ কোটি টাকা যা দ্বিগুণের এবং ১০০ শতাংশের থেকে কিছুটা বেশিই। এবং তা সম্ভব হয়েছিল কোনো বেআইনী প্রবেশ কর না বসিয়েই।

২. পরিকল্পনা ব্যয়
বিভ্রান্তিকর বক্তব্য : বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের সময় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বইটিতে (পূর্বে উল্লিখিত) দ্বিতীয় পাতায় লেখা হয়েছে যে, গত চার বছরে  রাজ্য সরকারের পরিকল্পনায় ব্যয় বৃদ্ধি ‍‌পেয়েছে‍ তিনগুণের বেশি। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ২০০ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে, পুনরায় বিজ্ঞাপনের পাতায় লেখা হয়েছে যে, গত চার বছরে রাজ্যের পরিকল্পনায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৩০% শতাংশ।
প্রকৃত তথ্য : প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘‘তিনগুনের বেশি’’ মানে‍‌ তো শতকরা হিসেবে ২০০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ পুনরায় বইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের লেখার মধ্যে স্ববিরোধিতা এবং গানিতিক ভুল, যা পূর্বেও আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এখানে প্রকৃত তথ্যটি কি?
এরাজ্যে পরিকল্পনা ব্যয় সাধারণত প্রতি চার বছরে দ্বিগুণের কাছাকাছি বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে, ২০০৯-১০ সালে রাজ্যে যে পরিকল্পনা ব্যয় ছিল ১২,১২১ কোটি টাকা, তা পরের চার বছরে, ২০১৩-১৪ সালে, প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৪,১০৭ কোটি টাকায় (উৎস : রাজ্য বাজেট প্রকাশনা, ২০১৪-১৫, নং ৯, পৃঃ-১২ এবং আর্থিক  সমীক্ষা ২০১২-১৩, পৃঃ ১৩৪)। কিন্তু তার ঠিক পরের বছরেই, অর্থাৎ ২০১৪-১৫ সালে, রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয়কে অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি করে দেখানো হয়েছে ৪৪,০৭৪ কোটি টাকা। এটা কি করে সম্ভব হলো, বিশেষ করে যেখানে রাজ্য সরকারের নিজের  কর রাজস্ব আদায় এই বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৯% শতাংশ হারে (যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে।)? কি কৌশলে রাজ্যের এই সহসা পরিকল্পনা ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো সম্ভব হলো? আমরা  জানি যে, কেন্দ্রীয় সহায়তা ভিত্তিক  প্রকল্পগুলির   ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ব্যয়ের একটি অংশ দেয় রাজ্য সরকার, এবং বাকিটা প্রদান করে কেন্দ্রীয় সরকার। উদাহরণ হিসেবে, যদি মোট পরিকল্পনা ব্যয় ২৫% শতাংশ দেয় রাজ্য সরকার, তাহলে বাকি ৭৫% শতাংশ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এত দিন  নিয়ম  ছিল যে রাজ্য সরকারের অংশের অর্থ, এক্ষেত্রে ২৫%, রাজ্য বাজেটের পরিকল্পনা ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হতো, এবং বাকি ৭৫% যা কেন্দ্রের দেয়, তা অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হতো কেন্দ্রীয় বাজেটের পরিকল্পনা খাতে। এই নিয়ম তৃণমূল সরকারের প্রথম তিন বছরেও (২০১১-১২, ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ সালে) চালু ছিল। কিন্তু চতুর্থ বছর থেকে এই নিয়মটি বদলানো হয়েছে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দেয় েয ৭৫% অর্থ তাও রাজ্য বাজেটের পরিকল্পনা ব্যয় বরাদ্দ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো শুরু হয়েছে। এর ফলে, মোট পরিকল্পনা খাতে অর্থ, অর্থাৎ রাজ্যের পরিকল্পনা খাতে অর্থ + কেন্দ্রের দেয় পরিকল্পনা খাতে প্রাপ্ত অর্থ, আগে যা ছিল তাই থাকছে। কেবল  প্রচারের জন্য কৃত্রিমভাবে  দেখানো  হচ্ছে যে, রাজ্যের পরিকল্পনা ব্যয় এতো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ইত্যাদি। এই ধরনের কৃত্রিমভাবে ব্যয় বৃদ্ধি প্রচারের জন্য বিশেষভাবে দেখানে হচ্ছে মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু উন্নয়নের ক্ষেত্রে, এবং সাধারণ বিদ্যালয়ের দপ্তরের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে কৌশলগত পদ্ধতিটা স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা না  করে গোপন রাখা হয়েছেএবং এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। 

৩. রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি
বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য : রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পক্ষ থেকে আগাম অনুমান হিসেবে দাবি করা হয়েছে যে, ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির হার হবে ১০.৫%, যা হবে সমগ্র দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির হারের (৭.৫%) থেকে অনেক বে‍‌শি। রাজ্যের শিল্পের ক্ষেত্রে  উৎপাদন বৃদ্ধির হার হবে ৮.৪%, কৃষির ক্ষেত্রে ৬.৫% এবং‍‌ পরিষেবার ক্ষেত্রে ১২.১%, যা হবে সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে শিল্প (৫.৬%) কৃষি (১.১%) এবং পরিষেবার (১০.১%) বৃদ্ধির হারের থেকে অনেক বেশি, ইত্যাদি।
প্রকৃত তথ্য : রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করে শিল্প, কৃষি এবং পরিষেবার ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির উপর। শিল্পের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বাস্তবায়িত বিনিয়োগের উপর দাঁড়িয়ে।  এখানে লক্ষ্যনীয় যে, বর্তমান রাজ্যসরকারেরই প্রকাশিত প্রথম দুবছরের আর্থিক সমীক্ষার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৬.৬ সারনির তথ্যাবলী অনুযায়ী, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে, ২০১০ সালে যেখানে সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে ৩২২টি নতুন শিল্প সংস্থায় ১৫,০৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়ে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়েছিল, সেখানে তৃণমূল সরকার আসার পর ২০১২ সালে নতুন চালু হওয়া শিল্প সংস্থার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১২টিতে, এবং বাস্তবায়িত বিনিয়োগের পরিমাণও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়ায় ৩১২ কোটি টাকায়। কিন্তুবিষ্ময়করভাবে, এর ঠিক পরের বছর গুলিতে, অর্থাৎ ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ সালের আর্থিক সমীক্ষাগুলিতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত বইটিতেও (২০১৬) এই গুরুত্বপূর্ণ সারণিকটিকেই উধাও করে দেওয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে একটি নতুন সারণি এনে এই বছরগুলির জন্য নতুন শিল্পের সঙ্গে নির্ণীয়মান শিল্প একত্রিত করে দেখানো হয়েছে। বিধানসভায় বারংবার বলা সত্ত্বেও, এই বছরগুলিতে ঠিক কতগুলি নতুন সংস্থায় বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে তা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে এই সরকার। এছাড়া অসংগঠিত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রেও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ, এই উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে যে ঋণের প্রয়োজন হয়, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে তার পরিমাণও ২০১৩-১৪ সালে ২১,৮৪২ কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৪-১৫ সালে হয়েছে ১৫,০৪৭ কোটি টাকা। এই কারণগুলির জন্য সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে শিল্পের বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে ২০১৪-১৫ সালে ৮.৩ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির যে আগাম অনুমান বর্তমান রাজ্য সরকার করেছে তার ভিত্তি হয়েছে খুবই দুর্বল। একইভাবে দুর্বল হয়েছে রাজ্যের কৃষির ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির (৬.৫ শতাংশ) অনুমানটিও। এর একটি কারণ হলো, এ-রাজ্যে কৃষিতে মোট উৎপাদনের সূচক (ভিত্তি বর্ষ ১৯৮১-৮২=১০০) বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে, ২০০৯-১০ সালে ২৬৭.৩ থেকে বর্তমান সরকারের আমলে ২০১২-১৩ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২৫৮.৭। এবং লক্ষ্যণীয় েয এর পর থেকেই, তৃণমূল সরকার এ-রাজ্যে কৃষিতে উৎপাদন-পরিমাপের যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল, তাকেই নষ্ট করতে শুরু করে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রতি বছর অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে রাজ্যের কৃষিতে চাষ জমির এবং উৎপাদনের পরিমাপ করা হতো। কৃষি দপ্তর থেকে প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর প্রতিটি জেলাতে জমির তথ্য পরীক্ষা করতেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের অভিজ্ঞ আধিকারিকগণ এবং উৎপাদনের তথ্য পরীক্ষা করতেন ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান সংস্থার বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীরা। সমস্ত পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত রাখা হতো ভারতের প্রসিদ্ধ রাশি বিজ্ঞান সংস্থার (Indian statistical Institute) বিশেষজ্ঞদের। এরজন্য পশ্চিমবঙ্গের কৃষির ক্ষেত্রে প্রকাশিত তথ্যাবলী সমগ্র দেশেই গ্রহণযোগ্য এবং সমাদৃত হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খবর আসছে যে এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থেকে এখন ভূমি ও ভূমি সংস্থার দপ্তর, ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান সংস্থা এবং ভারতের রাশি বিজ্ঞান সংস্থার প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ইদানিং কালে কৃষির উৎপাদনের তথ্যাবলীর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে এবং দুর্বল হয়েছে ২০১৪-১৫ সালের কৃষি উৎপাদনের ৬.৫ শতাংশ উচ্চহারে বৃদ্ধির অনুমাণটিও।
রাজ্যে পরিষেবার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি নির্ভর করে, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং সরকারের ব্যবস্থাপনার বিকাশের উপরও। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে রাজ্যে সামগ্রিকভাবে ব্যাঙ্ক ঋণের (কৃষি অংগঠিত এবং অসংগঠিত বিকাশ ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্র একত্রিত করে) বৃদ্ধির হার জুন মাস পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী ২০১৪ সালে ১৬% শতাংশ থেকে উদ্বেগজনকভাবে  হ্রাস পেয়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ১.৫% শতাংশ। এছাড়া রাজ্য সরকারের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও কর্মী ও মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে বেতনজনিত ব্যয়ে ২০১৪-১৫ সালে ৩৩,৬২৫ কোটি টাকা থেকে ৩১,৫৪৭ কোটি টাকাতে হ্রাস পাওয়াতে।

কর্মসংস্থান
ভিত্তিহীন বক্তব্য : গত প্রায় চার বছরের সময়কালে এরাজ্যে ৬৭.৩৫ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকৃত অবস্থা : এই বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রতি বছরে এবং বর্তমান সরকারের প্রথম দুবছরেও (২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩) রাজ্য বাজেটের সঙ্গে রাজ্যের আর্থিক সমীক্ষার পাশাপাশি পরিসংখ্যান তথ্যাবলী বইয়ের আকারে পেশ করা হতো। এই পরিসংখ্যান তথ্যাবলীতে সারণি ৪.০, ৪.১ এবং ৪.২-তে রাজ্যে প্রতি বছরে রাজ্য সরকার, রাজ্য সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় সরকার, বেসরকারী  সংগটিত ক্ষেত্র এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে দোকান ও অন্যান্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের নির্দিষ্ট তথ্যগুলি প্রকাশ করা হতো। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম যে, বর্তমান সরকারের প্রথম দুবছরের পর থেকেই অর্থাৎ ২০১৩-১৪ সাল থেকে শুরু করে পরের বছরগুলিতে সেই পরিসংখ্যানের বইটিকেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং বইটিকে আর বিধানসভায় পেশ করাই হচ্ছে না। তার পরিবর্তে কর্মসংস্থানের বিষয়ে কাল্পনিক কিছু সংখ্যার কথা শোনানো হচ্ছে।

এই অবস্থাতে আমরা চেষ্টা করেছি কিছু প্রকৃত তথ্যের সন্ধান করতে। সাম্প্রতিককালে রাজ্য সরকারের নিজস্ব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের চিত্রটিকে অধোগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার একটি প্রমাণ হলো রাজ্য সরকা‍রি কর্মী, মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতনের খাতে ব্যয়ের সংকোচন, যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়া রাজ্যে সংগঠিত বেসরকারি শিল্পের ক্ষেত্রে  কর্মসংস্থানের চিত্রটিও নিম্নগামী২০০৮ সালে ৭.২৪ লক্ষ থেকে ২০১২ সালে ৭.২০ লক্ষ-তে। বর্তমান সরকারের সাম্প্রতিক শিল্প সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত বইয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (পৃষ্ঠা ২৮০) গত চার বছরে (২০১১-২০১৪) সমস্ত ধরনের স্বনিযুক্তি প্রকল্প থেকে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬,০৪৭ জনের, দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচী থেকে প্রায় ১৩,০০০ জনের এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আরো অতিরিক্ত ১,১৮০ জনের। এছাড়া কর্মসংস্থান ব্যাঙ্ক নামে অনেক প্রচার করে যে প্রকল্পটা ২০১২ সালে উদ্বোধন করা হয়, সেখানে ১৭,০১,৫৪৪ জন কর্মপ্রার্থী নাম নথিভুক্ত করার পর ২০১৪ সালের শেষ পর্যন্ত  কাজে নিযুক্ত হতে পেরেছেন মাত্র ৩০৯ জন। এর বাইরে, এরাজ্যে কুটির, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে গত বছরে জানুয়ারি মাসে জেলাগুলিতে যে ৩০ হাজার শিল্প স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে এখনো পর্যন্ত উৎপাদন শুরু হয়েছে ৩ হাজারেরও কম ক্ষেত্রে । অর্থাৎ গত প্রায় চার বছরের সময়কালে যে ৬৭.৩৫ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি করেছে বর্তমান রাজ্য সরকার, তার সমর্থনে এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি এই সরকার। তাই প্রশ্ন, বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে এই নিষ্ঠুর পরিহাস করা আর কতদিন সহ্য করবেন এরাজ্যের সাধারণ মানুষ