20210716

শোকবিহ্বল পূর্ণিয়ায় অজিত সরকারের দেহ উপচে পড়েছিল হলুদ অমলতাসে

জয়দীপ সরকার

তখন সবে কাজ শুরু করেছি, রাত ১১টায়। অভীকদা ফোন করে বললো, ‘‘পূর্ণিয়া চলে যাও, অজিতদা খুন হয়ে গেছেন।’’ দিনটা ছিল ১৪ই জুন।

দার্জিলিং মেইলে সাধারণ টিকিট কেটে বহুকষ্টে বারসই, সেখান থেকে কাটিহার হয়ে পূর্ণিয়ার কয়েক কিলোমিটার আগে বাস থেমে গেল। চালক বললেন, ‘পূর্ণিয়াতে আগুন জ্বলছে, বাস যাবে না।’ বাসে দেখি তাত্ত্বিক শঙ্করদাও চলেছে ছবি তুলতে। জুটি পেলাম। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে শহরে ঢুকে দেখলাম মানুষের তেজ। একজন রিক্সাচালক কাঁদছিলেন, বললেন, ‘‘ভগবান খুন হয়ে গেলেন।’’ বোঝালাম, নিয়ে চলুন, ওনার দেহ যেখানে আছে সেখানে।

বিরাট শহর, কিন্তু সে সময় লাল ঝান্ডার দখলে। রিক্সাচালক নিজে বললেন, তিনি চামার সম্প্রদায়ের দলিত, সিপিএম নেতা অজিত সরকার সেখানকার বিধায়ক ছিলেন বহুবছর ধরে। ‘‘শহরে গুন্ডারা মাথা তুলতো না তাঁর ভয়ে, পাপ্পু যাদব জমির মালিকদের টাকা নিয়ে অজিত বাবাকে গুলি মারলো।’’

রাস্তা শুনশান। পুলিসের গাড়ি জ্বলছে একের পর এক। লাঠি নিয়ে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে নীরব স্রোত আসছে সব গলি থেকে। সবার হাতে লাঠি।উল্টে ফেলে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিরাট বিলাসবহুল কয়েকটা গাড়ি, রিক্সাচালক বললেন, ‘‘এগুলো পাপ্পুর গাড়ি।’’

লাল পতাকা নিয়ে মিছিল কান্না, এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে ভাবছিলাম, এটা পশ্চিমবাংলা না উত্তর বিহার!


শহীদ মিনার ময়দানের মতন একটা মাঠ, নিচে শোয়ানো অজিত সরকারের দেহ। একটা হলুদ অমলতাস গাছের নীচে সে দেহ উপচে পড়ছে ফুল, এই বর্ষা শুরুর বৃষ্টি ফোঁটায় ভারী হয়ে অজিতদার দেহটা ঢেকে দিচ্ছে হলুদ অমলতাস। পাটনা বিধায়ক নিবাসে গেলে এই মানুষটি ছাড়তে চাইতেন না, ‘‘ইয়ং ম্যান বসো। শ্যামনগর ভাটপাড়া এখনও টানে জানো, সুভাষদা ফোন করে খোঁজ খবর নেয়।’’ সেই বিরাট দাপুটে মানুষটা ফুলের ভারে চাপা পড়ে আছেন!

স্বতঃস্ফুর্ত বনধ। কতদিন চলবে কেউ জানে না। ক্ষিপ্ত দেহাতী মানুষরা পুলিস কর্তাদের ঘিরে বলছেন, ‘‘পুলিস চাইলে এখনই খুনীদের ধরতে পারে। হয় আপনারা ধরুন নয় আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। আমরা শয়তানের শেকড় ছিঁড়তে চাই।’’

সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোড়াই চরিত মানস’ বইতে চিনেছিলাম পূর্ণিয়াকে। বিহারের শস্য ভান্ডারে ফসল উৎপাদকের হাতে জমির অধিকার তুলে দেওয়া, গরিব কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় এ তল্লাটে আপামর মানুষের কাছে অজিত সরকার তখন আপনা নেতা। বেলার দিকে দিল্লি থেকে পৌছলেন সীতারাম ইয়েচুরি, তিনি তখন দল থেকে বিহারে সিপিআই(এম)-র দায়িত্বে। শোকসভা করে পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে শেষকৃত্যে গেলেন ইয়েচুরি সহ সকলে ।

আমরা খবর পাঠাতে গেলাম পূর্ণিয়া পোষ্ট অফিসে। পোষ্টমাষ্টার রাজস্থানী, ফ্যাক্স চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘এত দূর দেশ থেকে কাজ করতে এসে আত্মীয় পেয়েছিলাম, তিনিও খুন হলেন।’’ একটা সর্বাত্মক সহানুভূতি, ভাবাবেগের স্রোত। তিনিই একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করলেন। পরদিন পরিচিত এক বন্ধু ঘুরে দেখালেন তাৎমাটুলি, এ যেন এক অতি পরিচিত অথচ আশ্চর্য জগৎ। পাশেই লেখা লেনিননগর। বেতের দেওয়ালে আঁকা কমরেড চে। বস্তির মানুষরাই ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে সাজান তাঁদের বন্ধু চে’কে।

আমরা ফিরছিলাম, অজিত সরকারের পরিবারের সাথে মাধবীদির সাথে কথা বলে। সীতারাম ইয়েচুরি বাংলায় বললেন, ‘‘খেয়ে যাবে না তোমরা?’’ ক্ষিদেও ছিল চরম, সীতারাম ইয়েচুরির পাশে মাঠের মাঝে বসে খাওয়া। পাতায় ভাত, ডাল এবং কাঁচা মুলো। আমার বোধে ছিল না এটাই শুরু এবং শেষ হতে পারে। কিছুটা ভাত রাখা ছিল। সীতারাম বললেন, ‘‘এটাই কমরেডরা চাঁদা তুলে নিজেদের কষ্টের টাকা দিয়ে বানিয়ে আমাদের খাওয়াচ্ছেন, আর কোন কিছু নেই।’’ একজন এসে বালতি থেকে ডাল দিলেন, একজন সযত্নে মূলোর টুকরো। আমি হতবাক, লজ্জিত। সীতারাম চেটেপুটে সব খেয়ে পাতা ফেলতে চললেন। আমিও তাই করলাম।


এখন চে’র দিন আসলেই মনে পড়ে পূর্ণিয়ার বাহুবলী মানুষদের লড়াই, অজিত সরকারকে হারানোর শোক, রক্তভেজা রাস্তা, অমলতাস আর লাল পতাকায় মোড়া নেতার শবদেহ ছুঁয়ে দেহাতী মানুষদের বুকফাটা কান্না, রহস্যময় তাৎমাটুলির মাঝে লেনিননগরে চে’র জন্মদিন আর মাঠের মাঝে বাবু হয়ে সীতারাম ইয়েচুরি আর কৃষকদের সাথে খেতে বসার এক নতুন অভিজ্ঞতা।

ছবিটা সেসময় ছোট ক্যামেরায় তোলা। তখন ডিজিটাল জীবন আসেনি।

১৪জুন, ২০২১

 



বিঃ দ্রঃ হিন্দি চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা আমীর খান তাঁর ‘সত্যমেব জয়তে’ অনুষ্ঠানের একটি এপিসোডে কমরেড অজিত সরকারের ভূমিকা অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছিলেন। কমরেড অজিত সরকারের ছেলে অমিত সরকার সেই অনুষ্ঠানে তাঁর বাবার নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা তুলে ধরেন। মানুষের স্বার্থে কমরেড অজিত সরকারের কাজের কয়েকটি উদাহরণও তুলে ধরেছিলেন।

Courtesy: https://youtu.be/aY1M8v8KNFc



ঈশ্বর যেখানে আছেন

 


অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

God's own country অথবা ঈশ্বরের নিজের দেশ বলে বিজ্ঞাপনে দাবি করার অনেক আগে থেকেই আমার মনে হয়েছিল কেরালা ঈশ্বরের দেশ অর্থাৎ স্বর্গ।

অফিসের কাজে বেশ কয়েকবার কেরালা যেতে হয়েছে। যতবার গিয়েছি ততবার কেরালার প্রতি আমার প্রেম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

কেরালা এবং কেরালাবাসীর গুণের শেষ নেই, তবু ওই রাজ্য আমাকে প্রধানত মুগ্ধ করেছে তার বর্ষণসিক্ত রূপ দেখিয়ে।

ছোটবেলা থেকেই বর্ষার ভক্ত। জমা জলে ছলাৎ ছলাৎ করতে করতে বিধান সরণি দিয়ে স্কুলে যাওয়ার যে আনন্দ শৈশবে পেয়েছি সেটি আজও লালন করছি মনের মধ্যে এবং এই বার্ধক্যের দোরগোড়ায় এসেও জমা জলের রাস্তা পেরোতে আমি সমান আনন্দ পাব এ কথা হলফ করে বলতে পারি।

বর্ষা উপভোগ করতে ছুটে গিয়েছি ডুয়ার্সে। কোনও এক বর্ষার দ্বিপ্রহরে রানাঘাট থেকে ট্রেন ধরে যাত্রা করেছি  বনগাঁ, প্রত্যক্ষ করেছি বিভূতিভূষণের সবুজ আত্মাকে। ঘন ঘোর বর্ষায় স্টিমারে অতিক্রম করেছি পদ্মা নদী, তবু, হ্যাঁ তবু কেরালার বর্ষা আমাকে সবথেকে বেশি মোহিত করেছিল।

মনে পড়ে ১৯৮৯ সাল নাগাদ অফিসের কাজে উত্তর কেরালায়  গিয়েছিলাম। সেই প্রথম খুব কাছ থেকে কেরালার গ্রাম দেখা, কাইয়ুর শহীদদের গ্রাম, যে গ্রাম এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ইতিহাস হয়ে আছে।

অজস্র নারকেল গাছে আচ্ছাদিত। সবুজে সবুজ। কিন্তু এই সবুজের একটা বৈশিষ্ট্য দেখলাম। মনে হয় যেন প্রতিটি গাছের পাতা কেউ ধরে ধরে পরিষ্কার করেছে। এতোটুকু ধুলোর আস্তরণ নেই।

আর হবে নাই বা কেন? কেরালায় বর্ষা আসে দেশের মধ্যে সবার আগে, আর বিদায় নেয় সবার পরে। যাকে বলে ফি বছর ডবল মনসুন।

উঠেছিলাম শহরের কাছেই একটা অতীব সস্তার হোটেলে। কিন্তু যত সস্তাই হোক, ওখানকার হোটেলে রোজ বিছানার চাদর পাল্টে দেয়, ঘরে নিয়মিত ঝাঁট পড়ে, সস্তার হোটেল বলে বাথরুমের জল উপচে ঘর ভাসিয়ে দেয় না, ঘরের দেওয়াল স্যাঁতস্যাঁতে নয়।

হোটেলের এক তলায় একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। সাধারণ কাঠের চেয়ার টেবিল। কিন্তু একেবারে ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার। ভোর ছটাতেই রেস্টুরেন্টের ঝাঁপ খুলে যায়। কলকাতার মত রেস্টুরেন্টে ঢুকে বলতে হয় না, ওরে কে আছিস রে, টেবিলটা পরিষ্কার কর। তারপর কেউ হয়তো এসে একটা কালো ন্যাকড়া দিয়ে এমনভাবে মুছে দিয়ে গেল, তাতে পরিষ্কার হলো না আরো নোংরা হল বোঝা দায়।

আরব দুনিয়া থেকে রোজগার করে আনা বিপুল টাকার মালিক অথবা পথের ভিখারী (সংখ্যায় খুবই কম) কেরালায় সকলেরই জামাকাপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে আর্থিক সামর্থ্যের কোন সম্পর্ক নেই।

মনে আছে সেদিন সকাল ছটায় ঘুম ভেঙে গেল বিকট মেঘ ডাকার শব্দে।

তড়িঘড়ি উঠে দেখি তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এত বৃষ্টি যে চারদিক ঝাপসা হয়ে গেছে। থেকে থেকে দমকা হাওয়া দিচ্ছে।

এই জলের গন্ধ যেন অন্যরকম। আরব সাগরের জল বলেই কি?

সেই সঙ্গে হাওয়া বইছিল ভালো রকম। চারপাশের অজস্র নারকেল গাছ ভয়ানক রকম দুলছিল। কিন্তু না। একটা নারকেলও গাছ থেকে পড়ল  না। ভাবটা যেন, এরকম ঝড়-বৃষ্টি অনেক দেখা আছে।

এই রকম দেখতে দেখতে মনে হল একটু চা দরকার।

কিন্তু রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি লোকজন কর্মচারী কেউ নেই। একেবারে ফাঁকা। বৃষ্টির জন্য আটকা পড়েছে হয়তো।

রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দেখি একটি ছেলে কাজ করছে।

তাকে  হিন্দিতে বোঝালাম চা কফি কিছু হবে? সে একটা অনাবিল হাসি দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে স্টেইনলেস স্টিলের বাটিতে কফি এবং ঝাল ঝাল দেশি বিস্কুট দিয়ে গেল।

বৃষ্টি এলো আরো জাঁকিয়ে।

সেই মুহূর্তে নিজেকে পরম ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম যদি কোন কারণে মরে যেতাম তাহলে এই ধূমায়িত কফি সহযোগে এই কৈরল বর্ষার অনন্য অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়ে ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হতো।

সেদিন সকালবেলা খবরের কাগজ জুটলো না। একটা টেলিভিশন ছিল বটে, কিন্তু দেখলাম নিরাপত্তার কারণে প্লাগ খুলে রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি আর চালানোর কথা বললাম না।

মোটামুটি সকাল নটা সোয়া নটা নাগাদ সকালের খিদে পাব পাব করছে, এমন সময় সেই ছেলেটি প্লেটে করে মোট চারটি ইডলি এবং সম্বার ও চাটনি দিয়ে গেল। দেবার সময় বলে গেল, স্যার, অন্য কিছু নেই। সকালে শুধু এইগুলো বানাতে পেরেছি। এটাই খেয়ে নিন।

আমি কিন্তু বেজায় খুশি। ইডলি আমার খুব প্রিয়। কিন্তু চারটে খাওয়া আমার পক্ষে একটু বেশি। তবু প্লেটের দিকে তাকিয়ে একটা চোখের খিদে হল। ইডলির প্রথম টুকরোটা হাতে নিতেই দেখি অবিশ্বাস্য রকম তুলতুলে। এ কি সত্যিই ইডলি না আরব সাগরের অতলান্ত থেকে তুলে আনা সাদা স্পঞ্জ?

আমি অবলীলায়  চারটে ইডলি যাকে বলে সাঁটিয়ে দিলাম। সে যে স্বাদে গন্ধে কি অপূর্ব তার আর কি বলবো? আমার মনে হয় ওইটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইডলি এবং এখনও পর্যন্ত আমি এই সিদ্ধান্তে অটল আছি।

একটু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি থামল। আমিও নিজের ঘরে গিয়ে স্নান সারলাম।

লাঞ্চ করার জন্য একতলায় সেই রেস্টুরেন্টে গেলাম। গিয়ে দেখি আশ্চর্য ব্যাপার! কোন লোকজন নেই। এমনকি রিসেপশন কাউন্টারে কেউ নেই। রান্নাঘরে ওই ছেলেটির হদিস পেলাম না।

কি করবো বুঝতে পারছিনা, বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নিলেই হয় কিন্তু  হোটেল এরকম ফাঁকা কি করে হয়?

কিছুক্ষণ পরে অবশ্য এক মহিলাকে ঘর মুছতে দেখলাম। কিন্তু আমার কথা  কিছুই বুঝতে পারলেন না।

একরকম বেরিয়ে যাব বলে মনস্থির করেছি এমন সময় দেখি রিসেপশনে বসে থাকা সেই ভদ্রলোক দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন। আমাকে দেখে বললেন, চলুন। আপনাকে নিতে এসেছি।

আমি বললাম, কোথায় যাব?

তিনি আমাকে বললেন, আপনি জানেন না? আজ আমাদের হোটেল মালিকের মেয়ের বিয়ে। সবাইকে ওখানে। আপনি দুপুরে ওখানেই খাবেন।

আমি তো শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। এরকমভাবে চিনি না জানি না, নেমন্তন্ন নেই, বিয়েতে যাওয়া যায় নাকি?

সম্ভবত তা আন্দাজ করে ভদ্রলোক বললেন, মালিক নিজেই আপনাকে আসতে বলেছেন বার বার করে। বৃষ্টি না হলে নিজে এসে বলে যেতেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে জোর করে নিয়ে যেতে। কোন অসুবিধা নেই চলুন। হোটেলে আরো যারা আছেন সবাই চলে গেছেন এতক্ষণ। 

অবশেষে তার সঙ্গে আমি রওনা দিলাম। যাবার পথে রাস্তার ধার থেকে কিছু জুঁই ফুলের মালা কিনে নিলাম কনেকে উপহার দেবার জন্য।

দুপুরবেলা বাড়ির বড় উঠোনের মাঝখানে শামিয়ানা খাটিয়ে বিবাহ এবং খাওয়া-দাওয়ার সুবন্দোবস্ত। লম্বা কাঠের টেবিলে বিশাল বিশাল কলাপাতায় লাল নীল সবুজ হলুদ কত রকম খাবার যে খেতে দিল তার ঠিক ঠিকানা নাই। যদিও সবই নিরামিষ কিন্তু অতীব সুস্বাদু। কত রকম মিষ্টি যে খাইয়েছিল তার হিসেব নেই। একমাত্র বাঙালি মিষ্টি বানাতে পারে এই ধারণা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

মাঝেমধ্যেই সেই মালিক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই গলবস্ত্র হয়ে হাসিমুখে  সবাইকে আপ্যায়ন করছিলেন, বলছিলেন মালায়ালি ভাষাতেই। তিনি কি বলতে পারেন তা একটা আন্দাজ করে নিলাম। অর্থাৎ দেখেশুনে নিজের মনে করে খাবেন, আমার এই সামান্য আয়োজন, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যে এই আহার এবং আপ্যায়নে যারপরনাই তৃপ্ত সে কথা ইংরেজি-হিন্দী মিশিয়ে বারেবারে বলাতে উনি খুবই আনন্দিত হলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম গোটা বিয়েবাড়িতে অনেকেই আমাকে দূর থেকে দেখছেন, আমি যে একজন অ-মালায়ালি সেটা ততক্ষণে বোধহয় গোটা বিয়েবাড়িতে চাউর হয়ে গেছে, এবং আমার উপস্থিতি তাঁরা বেশ উপভোগ করছেন বুঝতে পারলাম।

অতিথিকে যে দেবতা জ্ঞানে গণ্য করা হয় একথা ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ষোলআনার উপর আঠারো আনা সত্যি। এ আমার সীমিত জীবনের অভিজ্ঞতা।

তবে ভদ্রলোক আমাকে যা বলছিলেন তার মধ্যে একটা ইংরেজি শব্দ বারে বারে কানে আসছিল। শব্দটা হল blessings.

তার মানে কি উনি আমার কাছে ওর কন্যা ও জামাতার জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন?

মহা মুশকিল, আমি কি আশীর্বাদ করব?

আমার নিজেরই তখন বিয়ে হয়নি যে।

তখন দেখতে মোটেই বুড়ো ছিলাম না, তবে কি চালচলনের মধ্যে বুড়োটেপানা ছিল?

যাইহোক এই প্রসঙ্গ আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। এরপরে বহুবার কেরালা গিয়েছি এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছি।

তারপর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম বুড়ো বয়সে কেরালার গ্রামে গিয়ে থাকব। যদি টাকাপয়সা রোজগার করতে পারি তবে একটা জমি কিনে বাড়ি করব অথবা ছোটখাটো ঘর কিনে নেব। আমার এই বাসনার কথা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে বলেওছিলাম।

আজ যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ দিন ঘরবন্দি তখন এক বন্ধুবর মুচকি হেসে জানতে চাইলেন, তাহলে তুই কেরালায় বাড়ি করছিস কবে? সব প্লান ঠিকমতো এগোচ্ছে তো!

আমি তার প্রশ্নে রীতিমতো থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, এই মুহূর্তে তো কেরালা যাওয়ার কথা ভাবতে পারছি না। যেভাবে করোনার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে ওই রাজ্যে, এখন যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ভবিষ্যতেও স্থায়ীভাবে থাকবো কিনা ভাবতে হবে। তাছাড়া আরবসাগর যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে এবং বারে বারে কেরালার উপর হামলা চালাচ্ছে, সমুদ্রের ধারে পাকাপাকি বাস করাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে না।

বন্ধুটি বলল, তাহলে কোথায় গিয়ে থাকবি? গোটা দেশেই তো করোনা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কেউ বাদ নেই। এমনকি আন্দামানে ছড়িয়ে পড়েছে পর্যন্ত।

তারপর একটু থেমে কি ভেবে সে বলল, তুই ভুটানে যেতে পারিস। ওখানে নাকি করোনা দুর্দান্তভাবে সামাল দিয়েছে।

আমি বললাম, ভুটানে জমির কাঠা কত করে? 

হঠাৎ গিন্নির চিৎকারে সম্বিত ফিরল: এমনিতেই তোমার শরীর ভালো নেই কার সঙ্গে ফোনে এতক্ষণ  বকবক করছ? কখন থেকে খেতে ডাকছি। এখন সোয়া দুটো বাজে। 

অগত্যা তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। দেখলাম ডাইনিং স্পেসের জানলা বন্ধ। বললাম, একটু খুলে দাও।

গিন্নি বললেন, বাইরে ভালো রকম বৃষ্টি হচ্ছে। 

আমি বললাম তাই নাকি? আমি কিছুমাত্র টের পাইনি!! ঘরের দরজা বন্ধ করেছিলাম বলেই হয়তো বুঝতে পারিনি। তা হোক তবু একটু খুলে দাও, একটু ঠান্ডা হাওয়া আসুক, বৃষ্টিটা দেখি। 

টেবিলে প্লেট পড়ল। জিজ্ঞাসা করলুম, আজ কি রান্না হয়েছে গো?

কেন তোমার অর্ডার মাফিক হয়েছে। তিনি জবাব দিলেন।

আমি বললুম, আহা, আমার তো মনে নেই কি রাঁধতে বলেছিলাম।

তিনি বললেন, কেন, মটর ডাল। ব্যসন দিয়ে কুমড়ো ফুল ভাজা। ঘি দিয়ে মোচার ঘন্ট। বাটা মাছের ঝাল আর আমেরচাটনি।

আমার মনটা যে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সেটা তিনি ভালই বুঝতে পারলেন।

বাইরের দিকে তাকালাম। সবকিছু ঝাপসা। প্রবল বৃষ্টিতে বাড়ির জানালার লাগোয়া আমগাছটা দোল খাচ্ছে। কিন্তু একটা আমও পড়ছে না। ভাবটা অমন বৃষ্টি আমরা অনেক দেখেছি।

ভাতের উপর ডাল ঢেলে একটু মেখে নিয়ে কুমড়ো ফুলের বড়াতে কামড় দিলাম।

এক আশ্চর্য অনুভূতি হল। মনে হল এখানেও ঈশ্বর থাকেন! এটাও একটা স্বর্গ!!



 ###############################