20160710

মৃল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে যোগ দিন: সি পি আই (এম)-র আহ্বান

মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারী বৃদ্ধির প্রশ্নে ১১-১৭ই জুলাই সি পি আই (এম)-র ডাকে সারা ভারতে প্রতিবাদ সপ্তাহ পালিত হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রতিবাদ সপ্তাহে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য পার্টির রাজ্য কমিটি সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছে।

মূল্যবৃদ্ধি
মোদী সরকারের একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ করা ও কমানো। কারণ ইউ পি এ সরকারের সময় প্রচণ্ড হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। ফলে বিজেপি-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেককে মোহান্বিত করেছিল। অথচ দু’বছরে জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করে মোদী সরকার প্রচণ্ড হারে দামবৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেছে। এবং এই দু’বছরে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দামবৃদ্ধির নজির সব অতীত রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়েছে। কালোবাজারী ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রেও মোদী সরকার দু’বছরে কালো নজির সৃষ্টি করেছে। প্রায় সমস্ত খাদ্যসামগ্রীর দাম এই সময়ে ক্রমাগত বেড়েছে। তার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। দু‘বছর আগের চেয়ে বর্তমানে অড়হড় ও কলাইয়ের ডালের দাম বেড়েছে ১৪০শতাংশ। গত তিনমাসে সারা ভারতে সবজির দাম বেড়েছে ১২০শতাংশের বেশি। দেশের কোন কোন অংশে সবজির দাম অপেক্ষাকৃত কম বাড়লেও কয়েকটি সবজির দাম ১২০শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আলুর দাম কিলো প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ২০টাকার বেশি। পিঁয়াজের দাম এখন কিছুটা কমলেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেজি প্রতি ৭০ থেকে ১০০টাকা দাম চড়েছিল। চিনির দাম বাড়তে বাড়তে এখন ৪০টাকা থেকে ৫০টাকার মধ্যে। চিনির দাম আরও বাড়বে। চাল ও গমের দাম ইতিমধ্যে বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারতে মাথাপিছু কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী ভোগের হার হ্রাস পেয়েছে।

যেমন ১৯৫১সালে দৈনিক মাথাপিছু ডাল গ্রহণের পরিমান ছিল ৬১গ্রাম, ২০১৩সালে ৪২গ্রাম, ২০১৬সালে ৪০গ্রামের নিচে। অথচ এই ডাল ভারতের জনগণের পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের বাস ভারতে। আর এই সময়ে ঘটছে প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধি।

নিম্নমানের পথ্য গ্রহণজনিত রোগে প্রতিদিন ভারতে তিন হাজার শিশুর মৃত্যু হয়, ৫৮শতাংশ শিশু খর্বকায়; গ্রামীণ ভারতের ৭০শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগে; প্রতিদিন ২০কোটি মানুষ ভারতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে। এই তথ্য বিভিন্ন সরকারী ও আন্তর্জাতিক সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে এসেছে।

একটা হিসেবে বলা হয়েছে বি পি এল-ভুক্ত পরিবারগুলির আয়ের ৭০শতাংশ এবং এ পি এল-ভুক্ত পরিবারগুলির আয়ের ৫০শতাংশ কেবল খাদ্যগ্রহণের জন্য ব্যয় হয়। এর ফলে খাদ্যদ্রব্যের সামান্য দামবৃদ্ধিও ভারতের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মোদী সরকারের আগ্রাসী নয়া-উদারবাদী নীতি এবং বাজারে নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলিকে দাম নির্ধারনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া। ইউ পি এ সরকারও এই নীতি নিয়ে চলেছিল।

মারাত্মক আমদানি-রপ্তানি নীতি
যখন প্রয়োজন তখন সরকার আমদানি না করে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ড হারে মুনাফার সুযোগ করে দেয়। যখন সরকার বুঝতে পারলো যে খরার জন্য ডালের উৎপাদন ২০১৪-১৫সালে কমে গেছে তখনই বাইরে থেকে ডাল আমদানি থেকে মজুত করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করার ফলে ডালের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মজুতদারদের মুনাফাও ততোধিক হারে বৃদ্ধি পায়। তা না করে এরকম অবস্থায় যখন ডাল আমদানি করলো তা এতটাই কম করা হল। যার জন্য সরকার অজুহাত দিল আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম বেশ চড়া। তাই সামান্য পরিমানেই ডালের আমদানি করলো। ২০১৫সালের শেষে কিলো প্রতি অড়হড় ডালের দাম ছিল ২০০টাকা অথচ কৃষকেরা কিলো প্রতি দাম পেয়েছিল মাত্র ৪০টাকা। এর দ্বারা বোঝা যায় মোদী সরকার মজুতদারদের ব্যপক মুনাফার স্বার্থে কাজ করছে।

মুনাফাখোরদের জন্য ব্যবস্থা
কৃষকদের সহায়তার নাম করে পাইকারি মাণ্ডি বা কৃষি দ্রব্যের বাজার কমিটির বিধি-নিষেধ তুলে দেয়। মজুত করার নিয়মও সরকার শিথিল করে দেয়। দাম প্রচণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ার পরে এই নিয়মগুলোকে কঠোর করে। উভয়ক্ষেত্রে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের রমরমা স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এর অর্থ কৃষকদের জন্য নামমাত্র দাম এবং ক্রেতাদের জন্য অসহনীয় চড়া দাম।

পেট্রোদ্রব্যের দরনীতি
মূল্যবৃদ্ধির আর একটি কারণ পেট্রোদ্রব্যের সরকারী দরনীতি। গত দু’বছরে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের আন্তর্জাতিক দাম কমেছে ৬২শতাংশ। ভারত তার পেট্রোপণ্যের তিন চতুর্থাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে। একটা হিসেবে বলা হয়েছে অপরিশোধিত তেলের ক্রমহ্রাসমান দামের ফলে ভারতে লাভ হয়েছে ২.১৪লক্ষ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে দাম কমেছে ভারতের বাজারে সেই পেট্রোপণ্যের দাম সরকার অনেক চড়া হারে ধার্য করেছে। এর ফলে সরকারের লাভ হয়েছে কিন্তু জিনিসপত্রের দাম প্রচণ্ড বেড়েছে। গত দু’বছরে মোদী সরকার পেট্রোপণ্যের ওপর অন্তঃশুল্ক বাড়িয়েছে পাঁচবার। তাছাড়া এই দু’বছরে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৩বার এবং পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়েছে ২০বার। একটা হিসেব থেকেই এই চিত্র পরিষ্কার হবে। প্রকৃত উৎপাদন খরচ ধরে বর্তমানে অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম দাঁড়ায় লিটার প্রতি ২৬টাকা। অথচ আমাদের এখানে সেই তেল আমদানি করে বিক্রি করা হয় লিটার প্রতি ৬৭টাকা দামে। সরকার এভাবে শুল্ক কর বসিয়ে ডিজেল ও পেট্রোপণ্যের দাম চড়া করে তুলেছে। যে কোন সাধারণ মানুষই বোঝেন পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়লে সব জিনিসেরই দাম বাড়ে। এই দামবৃদ্ধির জন্য সরাসরি এবং সম্পূর্ণরূপে মোদী সরকারই দায়ী। যখন খরা পরিস্থিতির জন্য জলের সঙ্কট তখন ডিজেলের দামবৃদ্ধি কৃষকদের এবং কৃষি উৎপাদনের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। কিন্তু মোদী সরকার তাও গ্রাহ্য করে নি।

আগাম বাণিজ্যের ফাটকাবাজি
অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির আর একটি কারণ হল অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যে পণ্য বিনিময়ের ফাটকাবাজিআগের তুলনায় বিশেষ করে কয়েকটি ক্ষেত্রে যেমন, গম, চিনি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর আন্তর্জাতিক দাম সাধারণভাবে কম। পরে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের স্বার্থও হ্রাস পায়। কিন্তু বহু কৃষি উৎপাদন দেশে প্রতিকূল আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দামবৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছিল। এর অর্থ ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ফাটকাবাজিদের বর্ধিত স্বার্থ। বর্তমানে গম, চিনি, ডাল এমনকি আলু ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসহ প্রায় সব কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যৎ বাণিজ্যকে সরকার অবাধ অনুমতি দিয়েছে। ভবিষ্যৎ বাণিজ্য নিষিদ্ধ করার জন্য সংসদের উপদেষ্টা কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ অগ্রাহ্য করে সরকার বৃহৎ ব্যবসায়ী ও ফাটকাবাজিদের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

গণবন্টন ব্যবস্থা আরও দুর্বল
অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দাম যখন একটানা বেড়ে চলেছে তখন প্রয়োজন হচ্ছে গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যামে নিয়ন্ত্রিত দামে পণ্যবিক্রি সুনিশ্চিত করা। এতে বাজারেও দাম কমতো। এই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধি আটকানোর কাজ না করে মোদী সরকার খাদ্য নিরাপত্তা আইনকে বরবাদ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই খাদ্য নিরাপত্তা আইন খুবই অপর্যাপ্ত। তা সত্ত্বেও এই খাদ্য নিরাপত্তা আইনে গ্রামীণ এলাকার ৭৫শতাংশ মানুষের সুবিধা পাওয়ার কথা। যেমন কিলোপ্রতি ২টাকা করে গম এবং কিলোপ্রতি তিন টাকা করে চাল। কিন্তু আইনের এই বিধানও কার্যকর করা হচ্ছে না। উপভোক্তা পরিবারগুলির চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি ও গুরুতর রূপে ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে কোটি কোটি পরিবার সস্তা দামে রেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া মাথাপিছু যে ৫কেজি খাদ্যশস্য দেওয়া হচ্ছে তাতে এক বিরাট সংখ্যক বি পি এল-ভুক্ত পরিবার উল্লেখযোগ্য কোনও স্বস্তি পাচ্ছে না। আগে প্রত্যেক বি পি এল পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও কমপক্ষে ৩৫কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার উপযুক্ত ছিল। মাথাপিছু কোটা বরাদ্দের অর্থ ৭সদস্যের কম পরিবারের রেশন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যশস্যের দামবৃদ্ধির সমস্যা মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করার প্রশ্নে মোদী সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দামবৃদ্ধি রোধ করা যায় একমাত্র যদি সবজি, ডাল, তৈলবীজ, আখ ইত্যাদির উৎপাদন নতুন বীজ, নতুন প্রযুক্তি সস্তা দরে উপকরণ, জল ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবস্থা করা যায়। এবং গণবন্টন ব্যবস্থার জন্য বিরাটভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে উৎপাদকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বৃহৎ ধনী, ব্যবসায়ী, মজুতদার ও ফাটকাবাজদের স্বার্থরক্ষায় নিমজ্জিত মোদী সরকার সে পথে হাঁটতে নারাজ। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগামীদিনগুলি আরও বেশি উদ্বেগজনক।

বিকল্প নীতি কেরালায়
খোলাবাজারে যেখানে কলাই ডালের দাম কিলো প্রতি ৮১টাকা, সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত দোকান থেকে মাত্র ৬৬.১৩টাকায় সেই ডাল বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান গণবন্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে প্রাথমিকভাবে দেড়শো কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সস্তায় উন্নতমানের ওষুধ বিক্রির জন্য কেরালায় বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

দাবিসমূহ
(১)   পেট্রোল, ডিজেলের ওপর সরকারী অন্তঃশুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে এবং দাম কমাতে হবে পেট্রোল ডিজেলের।
(২)   গণবন্টন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত দরে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে।
(৩)  সকলের জন্য গণবন্টন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। উপভোক্তার ত্রুটিপূর্ণ তালিকা সংশোধন করতে হবে। পরিবারপিছু কমপক্ষে ৩৫কিলো খাদ্যশস্য দিতে হবে।
(৪)   মিড-ডে-মিল প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং আই সি ডি এস-র মাধ্যমে শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে।

(৫)   ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারী হাসপাতাল এবং ঔষধালয় থেকে সস্তায় উৎকৃষ্ট মানের ওষুধ দেওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে আগাম-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করতে হবে।

বেকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে যোগ দিন: সি পি আই (এম)-র আহ্বান

মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারী বৃদ্ধির প্রশ্নে ১১-১৭ই জুলাই সি পি আই (এম)-র ডাকে সারা ভারতে প্রতিবাদ সপ্তাহ পালিত হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রতিবাদ সপ্তাহে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য পার্টির রাজ্য কমিটি সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছে।

বেকারী, কর্মহীনতা
ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে মোদীর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার। আর মোদী প্রতিশ্রুত ‘সুদিন’ বা ‘আচ্ছে দিন’-র দু’বছর পর এখন দেশে বেকার বাহিনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

কেন্দ্রের মোদী সরকারের নীতির সাফল্য এখানেই যে আজ দেশে কর্মহীন বেকারের সংখ্যা ২০ কোটি ছাপিয়ে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বেকারবাহিনীর সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যাও। প্রতিবছর ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ নতুন করে বেকারের তালিকায় নাম তুলছেন। আর এই বর্ধিত কর্মহীন কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আজ প্রায় ৫০ কোটি ছুঁইছুঁই। লক্ষ্যনীয় আজ এটাই, এই কর্মহীন নতুন বেকারবাহিনী তরুণ এবং শিক্ষিত অংশ, যাঁদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে মোদী দু-হাতে অঢেল কাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন

কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কী? সকলেই জানেন হাওয়ায় চাকরি বা কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। তার জন্য দরকার শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি। উৎপাদনশীল শিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে সবচেয়ে বেশি বেকার কাজ পেতে পারে। তার ব্যাপক উন্নতি দরকার, কিন্তু হচ্ছে অধোগতি। প্রয়োজন কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ কিন্তু তারও বেহাল অবস্থা।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা মোদী সরকার বজায় রেখে চলেছে। চাকরির পদসৃষ্টির বদলে পদই লোপ করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের শূণ্যপদের সংখ্যা ৭,৪৭,১৭১। যা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত পদের সংখ্যার ১৮ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্যেও অনুরূপভাবে বহু পদ শূণ্য। মোদী ক্ষমতায় আসার সময় ভারতীয় রেলে শূণ্যপদ ছিল ২,২৫,৮৬৩। কার্যত সেই অবস্থাতেই এখন চলছে। তপসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নিয়োগের বকেয়া খুবই বেশি। একইসঙ্গে মোদী সরকার এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে বেসরকারী ক্ষেত্রে তারা সংরক্ষণের বিরোধী।

কেন বেকার সমস্যা বাড়ছে? কর্মসংস্থান সৃষ্টির নাম করে মোদী সরকার ভারতীয় বিদেশী কর্পোরেটগুলিকে ঢালাও সুবিধার পর সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। তাকানো যাক ব্যাঙ্কঋণ কেলেঙ্কারির দিকে। ২০১৫সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাঙ্কগুলিতে খারাপ ঋণ (অনুৎপাদক সম্পদের জন্য ঋণ)-র পরিমান ছিল ৩.৪লক্ষ কোটি টাকা। এই ঋণের বেশিরভাগটাই দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানিকে, উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল শিল্প স্থাপন বা পরিকাঠামো নির্মান। কিন্তু কিছুই হয় নি। অথচ জনগণের এই বিরাট পরিমান অর্থ হাওয়ায় উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগের সাথে যে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা তাও উড়ে গেল।

২০১৫-র ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি এই একবছরে শিল্পোৎপাদনের সূচক বেড়েছে মাত্র ২শতাংশ। এটা পূর্ববর্তী একবছরের তুলনাতেও (ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫) খারাপ। সেই সময় শিল্পোৎপাদনের সূচক ছিল ৪.৮শতাংশ। আগের বছর ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বৃদ্ধি হয়েছিল ৫.১শতাংশ। পরের একবছরে হয়েছে ০.৭ শতাংশ। এই তথ্য ২০১৬ সালের ১২ই এপ্রিল প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী রূপায়ন মন্ত্রক।

এবার আসা যাক দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রসঙ্গে। মোট জাতীয় উৎপাদনের অংশ হিসেবে সরকারী ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, বিনিয়োগ কমেছে এবং কমেছে আমদানি ও রপ্তানি। এর অর্থ হচ্ছে যে সরকারী ব্যয়ে মানুষের সহায়তা হয় এবং মানুষের ক্রময়ক্ষমতা বাড়ে সেই সরকারী ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। বিনিয়োগ হয়েছে খুব কম। আন্তর্জাতিক বানিজ্য হ্রাসমান।

২০১৬সালের মার্চ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় গত একবছরে অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ইস্পাত উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এখানেও একই কথা আসে। উৎপাদন যদি কমতে থাকে বা সামান্যই বৃদ্ধি পায় সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কোথায়? বস্তুত ২০১৫ সালের শেষ তিনমাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির বদলে এই সুযোগ কমেছে।

শ্রম ব্যুরোর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি শ্রম-নিবিড় শিল্পের কয়েকটির অবস্থা খুব খারাপ। প্রতি তিনমাস অন্তর ৮টি শিল্পে এই সমীক্ষা করা হয়। এটা দেখার জন্য যে কত কর্মসংস্থান হয়েছে বা লোপ পেয়েছে। এই ৮টি শিল্প হল বস্ত্র, চর্ম, ধাতু, অটোমোবাইল, অলঙ্কার, পরিবহন, তথ্য প্রযুক্তি-বিপিও এবং হস্তচালিত ও বিদ্যুৎ চালিত তাঁত। ২০১৬সালের মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৫) এটা পরিষ্কার যে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার ১৫মাস পরে (অর্থাৎ ২০১৪-র জুলাই থেকে ২০১৫-র অক্টোবর) ৪.৩ লক্ষ চাকরি যুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে এটাই সর্বনিম্ন। যে চাকরি যুক্ত হয়েছে তার সিংহভাগটাই তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবা এবং বিপিও ক্ষেত্রে। পাশাপাশি হস্তচালিত ও বিদ্যুৎচালিত তাঁতশিল্প, পরিবহন, অলঙ্কার ও চর্মশিল্পে চাকরি হ্রাস পেয়েছে।

সবচেয়ে দুরবস্থা কৃষির। কৃষিতে ভারতীয় জনগণের দুই তৃতীয়াংশ যুক্ত। এই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি নামমাত্র —১.১শতাংশ। এই কৃষি সঙ্কট আরও বেড়েছে খরা পরিস্থিতির জন্য। তাতে গ্রামীণ দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। কয়েক কোটি খেতমজুর ও কৃষক পরিবার অসহনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আইনী পথে এই দুস্থ দরিদ্র পরিবারগুলি যে সাহায্য পেতে পারে সেটা একমাত্র মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের মাধ্যমে (রেগা)। গ্রামীণ ধনিদের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আইনী ব্যবস্থাকে হেয় করছে মোদী সরকার। এই প্রকল্পে সময়মতো অর্থবরাদ্দ তাঁরা করছে না। এরফলে ন্যূনতম একশো দিনের কাজ দেওয়ার পরিবর্তে গড়ে বছরে কাজ হচ্ছে ৪৮দিন। অথচ মোদী সরকার খরাপ্রবণ এলাকায় একশো দিনের বদলে ১৫০দিন কাজ দেবে বলে ঘোষণা করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী ১কোটি ২০লক্ষ আবেদনকারীকে (১৪শতাংশ) কোন কাজ দেওয়া যায় নি। এটাই আসল গুজরাট মডেল। কারণ রেগা রূপায়নের ব্যর্থতায় গুজরাটের নাম আগে। রেগার সাফল্যের শীর্ষে রয়েছে ত্রিপুরা। যেখানে ২০১৫-১৬সালে গড়ে কাজ দেওয়া হয়েছে ৯৫দিন। দেশের সর্বত্র রেগার এই ত্রিপুরা মডেলই অনুসরণ করা উচিত।

চাকরি দিতে না পারা বা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য দায়ী মোদী সরকারের আগ্রাসী নয়া-উদারবাদী নীতি। বামপন্থীরা যে বিকল্প নীতির দাবি করে আসছে তা হল চাকরি ও কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় বহুল পরিমানের বৃদ্ধি করা। এটাই একমাত্র অর্থনীতিকে তেজী করতে পারে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারে। তা না করে মোদী সরকার সম্পূর্ণই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বেসরকারী বিনিয়োগের দিকে।

পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় ভয়াবহ। নতুন শিল্প হয় নি, অথচ সরকার শিল্পে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের হাস্যকর তথ্য হাজির করছে। শূণ্যপদে নিয়োগ এরাজ্যে কার্যত বন্ধ। নামমাত্র মজুরিতে সরকারী ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকার অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করছে। কৃষির ক্ষেত্রেও সঙ্কট সরকারী নীতির জন্য বাড়ছে। কৃষকেরা ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছেই না। এর কারণেই বাড়ছে গ্রামীণ বেকারী। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ব্যবসা-বানিজ্যের অধোগতি। আর্থিক কারণে এবং তৃণমূলের অপশাসনে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানের ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। নিয়োগনীতির ক্ষেত্রে সীমাহীন কেলেঙ্কারি রাজ্যের তরুণ এবং বেকাররা হাড়ে হাড়ে পাঁচ বছর ধরে বুঝতে পারছেন। বেকারীত্বে সমস্যার গভীরতা বোঝা যায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘তেলেভাজা শিল্প!’ প্রসারের ডাকের মাধ্যমে। বেকারদের চাকরি এবং কর্মসংস্থানে পশ্চিমবঙ্গকে ভাসিয়ে দেওয়ার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রহসনে পরিণত।

বেকারত্বের সমস্যার বিরুদ্ধে এবং মোদী সরকার ও তৃণমূল সরকারের বেকারবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী।

আমাদের দাবি
সরকারী পদে নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। সমস্ত শূণ্যপদ পূরণ করতে হবে। তপসিলী জাতি, আদিবাসীদের পদগুলো সমস্ত বকেয়া পূরণ করতে হবে। বেসরকারী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করতে হবে।

শহর এলাকায় রেগা’র ধাঁচে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তাকরণের জন্য আইন প্রনয়ন করতে হবে।
রেগা’য় সরকারী বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং এই আইনের যথার্থ রূপায়ন সুনিশ্চিত করতে হবে।

রাজ্যে নতুন শিল্প চাই। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সমস্ত শূণ্যপদে নিয়োগ করতে হবে। সরকারী পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকারী কাজে নিয়োগে শাসকদলের দলবাজী, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।