20200820

বিজেপি’র ফেসবুক ঘনিষ্ঠতায় যোগসূত্র রয়েছে তৃণমূলেরও

 


ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস’র আঁতাত ফাঁস করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। প্রতিবাদ সব মহল থেকে হলেও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব তৃণমূল সুপ্রিমো মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

তৃণমূলের এই হিরন্ময় নীরবতা রহস্যজনক। তবে রামমন্দির থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ—  দেশের যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূলের নীরবতা আসলে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, বারেবারে তা স্পষ্ট হয়েছে।

এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না!

এবার সেতু হয়ে উঠলেন সেই আঁখি দাসই।

নিজেদের নিয়ম, অবস্থানকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজেপি নেতাদের উগ্র ঘৃণার প্রচার ‘ব্যবসা ও শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্ক’র খাতিরে ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়ে চলেছে, অভিযোগের তীর আঁখি দাসের দিকে।

আঁখি দাস ভারতে ফেসবুকের অন্যতম কর্ত্রী, ফেসবুকের ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর। তাঁর দিদিও রশ্মি দাস আরএসএস’র ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে একটি এনজিও’র কর্ত্রী, যা দিল্লিতে আরএসএস’র একটি ভবন থেকেই চলে।

তবে এখানেই দাঁড়ি টানা যাচ্ছে না আঁখি দাসের পরিচয়-বৃত্তান্তের।

২০২০ সালে ফেসবুকের নাগপুর-করণের এই বিতর্কের অনেক, অনেক আগেই ২০১১ ও ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যে তৃণমূলের হয়ে নির্বাচনী প্রচার লড়াইয়ে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আঁখি দাস। ২০১৬’র নির্বাচনে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে প্রচারেও ‘মেঘের আড়াল’ থেকেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলেন আঁখি দাস। এমনকি এরাজ্যের একটি বিধানসভা নির্বাচনী কেন্দ্রে সশরীরে হাজির থেকে তৃণমূলের ‘ওয়ার রুম’র তদারকি করেছিলেন আঁখি দাস।

আঁখি দাসের শ্বশুরমশাই এরাজ্যের শাসক তৃণমূলের দু’বারের বিধায়ক, একবারের মন্ত্রী। ভারতে ফেসবুকের পলিসি সংক্রান্ত প্রধান, প্রবল ক্ষমতাধর আঁখি দাস রাজ্যের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ। শাসক তৃণমূলের অন্দরে অনেক বিষয়ে খবর রাখেন এমন মানুষজনও জানেন, আঁখি দাসের প্রভাব প্রথমবারের বিধায়ককে মন্ত্রী হতে সাহায্য করেছিল।

রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রের বিধায়ক। ২০১১ সালে এই কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে হারিয়ে তিনি জিতেছিলেন। এই প্রসঙ্গে সামনে আসতেই পারে কেন্দ্রীয় সরকারের এক উচ্চ পদস্থ আমলার কথা। তিনি সৌম্য চট্টোপাধ্যায়। আঁখি দাসের স্বামী। সৌম্য চট্টোপাধ্যায় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি পরে জেএনইউ। প্রেসিডেন্সিতে ১৯৮৬সালে ভর্তি হয়েছিলেন। শোনা যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের আরএসএস’র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি’র প্রথম ইউনিট তৈরি হয়েছিল তাঁরই হাত দিয়ে, যদিও এখন সেই সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। জেএনইউ’তে আঁখি দাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং বিদেশে যাত্রা। পরে বিবাহ। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লি থেকে এসে বেশ কিছুদিন বর্ধমানে নিজের বাড়িতেই ছিলেন সস্ত্রীক। বর্ধমান শহরের শাসক তৃণমূলের কর্মী, সংগঠকরাও জানেন, বাবার ভোটে পিছনে থেকে ওয়ার রুমের দায়িত্ব কীভাবে সামলেছিলেন এই কেন্দ্রীয় উচ্চ পদস্থ আমলা। মিডিয়া সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন আঁখি দাস।

তখন আঁখি দাস মাইক্রোসফট-এর ভারতের পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর, একেবারে শীর্ষস্তরের পদে ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ২০১১’র শেষদিকেই তিনি ফেসবুকে যোগ দেন। ২০১১ সালে অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রথমে ফেসবুক ইন্ডিয়া এবং পরে সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর হন। ২০১১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার সামলেছেন আঁখি দাস নিজেই। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও সৌম্য চট্টোপাধ্যায় এবং আঁখি দাস ওই কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারের সময় ছিলেন বর্ধমানেই। ২০১৬ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসক তৃণমূলের প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনায় সাহায্য পরামর্শও দিয়েছেন।

কমিউনিস্টবিরোধী ঘৃণার প্রচার ফেসবুকে অহরহ চলছে। মূলত বিজেপি’র আইটি সেলের কারিগর। এরাজ্যে পিছিয়ে নেই তৃণমূলের আইটি সেলও। রহস্য এটাই, সেই বিকৃত উগ্র ঘৃণার প্রচারও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘রিপোর্ট’ করার পরেও অবিকৃত থেকে যায়।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত ১৮ আগস্টের প্রতিবেদনে ফাঁস করেছে রহস্য উন্মোচনের সেই তথ্য। ভারতে ফেসবুকের পলিসি মেকাররা গুরুতরভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ফেসবুকের পোস্টে নজরদারির জন্য সংস্থার নির্দিষ্ট কাঠামো আছে, টিম আছে যারা নজরদারি রাখে। তেলেঙ্গনার বিজেপি নেতা টি রাজা সিং’র মুসলিম বিরোধী মন্তব্য এমনকি ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুলি করে মারার’ মতো মন্তব্য পোস্ট করেন। ভারতে নজরদারি রাখার জন্য ফেবসুকের সেই টিমের তরফে এবিষয়ে নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ জানানো হয় যথাযথ স্থানে। এই ঘৃণার মন্তব্য মুছে দেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ফেসবুক অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবেই বাতিল করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকি ফেসবুকের নিয়ম অনুযায়ী ওই ব্যক্তিকে ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ বলে চিহ্নিত করার কথাও বলা হয়। যদিও তা খারিজ করে দেওয়া হয়। বরং নজরদারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভারতে ফেসবুকের অন্যতম কর্ত্রী জানিয়ে দেন, বিজেপি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। পলিসি সংক্রান্ত প্রধান আঁখি দাস তাই পোস্ট মোছার অনুমোদন দেননি, ‘ব্যবসা ও শাসক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হবে’- এই অজুহাতে।

একাধিক বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও আঁখি দাসের ছবি দেখা গিয়েছে। এমনকি খোদ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে কোভিডের জন্য ‘মুসলিমদের বাড়তি দায়িত্ব পালন করা উচিত’র মতো সূক্ষ্ম বিষাক্ত প্রচারও শেয়ার করতে দেখা গেছে। এমনকি, তাঁর যমজ বোন, প্রাক্তন এবিভিপি নেত্রী রশ্মি দাসের লেখাও তিনি শেয়ার করেছেন নিজের ওয়ালে। নরেন্দ্র মোদী ডট ইন-এ তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আবার ২০১৬সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরে মমতা ব্যানার্জির গদগদ প্রশংসা করে লিখেছেন একটি সর্বভারতীয় নিউজ পোর্টালে। 

ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব বেআব্রু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদের সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির সম্ভবত হাত-পা বাঁধা।

আঁখি দাস শাসক তৃণমূলেরও ঘনিষ্ঠ, এবার সামনে এল সেই ছবিই। আঁখি দাসের ‘সাহায্য ও পরামর্শ’ ২০২১ সালের নির্বাচনেও মমতার গোপন তাস হতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

গোপনে বা প্রকাশ্যে তৃণমূল-বিজেপি’র রাজনৈতিক বোঝাপড়া এই বাংলার মানুষের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে ঘটনা পরম্পরায়। এবার ফেসবুকেও সেই বোঝাপড়া!

ভারতে ফেসবুক কর্ত্রীর বিজেপি ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি তৃণমূল সখ্যের ছবিও এবার সামনে এল। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপের রাজনৈতিক নিরপেক্ষ অবস্থানের ওপর সংশয়ের অন্ধকার আরও গাঢ় হলো।

 

গণশক্তি, ২০ আগস্ট, ২০২০

 

ফোটো ক্যাপশন: ২০১৪ সালের ৫মার্চ লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতা টাউনহলে ফেসবুকের একটি অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আঁখি দাস। ছবিটি আঁখি দাসের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া হয়েছে।