ড. অসীম দাশগুপ্ত
এই রাজ্য বাজেটের মাধ্যমে ধ্বংস
করা হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা ব্যয়ের সমগ্র খাতটিকেই। এর ফলে, এই অর্থবর্ষ
(২০১৮-১৯) থেকেই পরিকল্পনা বাবদ কি ব্যয় হবে তার জন্য কোনও আলাদা খাত থাকবে না।
অর্থাৎ, পরিকল্পনা ব্যয় এবং পরিকল্পনা-বহির্ভূত ব্যয়ের মধ্যে
কোনও তফাত করা হবে না। একটি সামগ্রিক খাতের মাধ্যমেই মিশিয়ে দেওয়াত হবে দুই ধরনের
ব্যয়কেই।
আমরা জানি, স্বাধীনতার আগেই,
১৯৩৮ সালে হরিপুরাতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে নেতাজী
সুভাষচন্দ্র বসু দেশের সামগ্রিক আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে, অগ্রাধিকারের বিষয়গুলি (স্বনির্ভরতা, বুনিয়াদি
শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ওপর জোর, ভূমিসংস্কার,
সেচের সম্প্রসারণ, সকলের জন্য শিক্ষা ও
জনস্বাস্থ্য এবং রাজ্যগুলির হাতে অধিক ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদির) মধ্যে সমন্বয়
সাধনের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কথা বলেছিলেন। তাই স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা
কমিশন গঠন করে, পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতের ব্যয়কে
চিহ্নিত করা হয়, এবং সঙ্গত কারণেই। পরিকল্পনা ব্যয় হলো কোনও
একটি বছরে নতুন প্রকল্পের জন্য ব্যয়। উদাহরণ হিসাবে, কোনও
একটি এলাকায় নতুন রাস্তা হবে, তার জন্য যে ব্যয় — কাঁচামাল ও উপকরণের জন্য এবং মজুরির জন্যেও যে ব্যয় — তা হবে পরিকল্পনা খাতে ব্যয়। অন্যদিকে, কোনও একটি
পুরানো এবং সমাপ্ত রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে প্রয়োজনীয় ব্যয়, তা হবে পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে ব্যয়। পরিকল্পনা ব্যয় একটি সরকারের নতুন
অগ্রাধিকারকে চিহ্নিত করে, আর পরিকল্পনা-বহির্ভূত ব্যয়
পুরানো প্রকল্পের প্রয়োজনীয় মেরামতির কথা বলে। তাই এই দুই খাতের ব্যয়কে আলাদা করেই
দেখানো উচিত, এবং এতদিন তাই হতো। এর মাধ্যমে সরকারের
পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যেত। পরিকল্পনা
ব্যয়ের খাতকে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে মিশিয়ে দেওয়া মানে হলো, পরিকল্পনার গুরুত্বকেই খর্ব করা, এবং তার মাধ্যমে
সরকারের কল্যাণকর ভূমিকাকেই আঘাত করা। এই আঘাত বর্তমানে বি জে পি-র নেতৃত্বে
কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে আরও তীব্র করা হয়েছে, এবং
নাটকীয়ভাবে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে
পরিকল্পনা কমিশনকেই তুলে দেওয়া হয়েছে, এবং ধাপে ধাপেই ধ্বংস
করা হয়েছে পরিকল্পনা ব্যয়বরাদ্দের বিষয়কেই। পরিতাপের বিষয়, মুখে
বি জে পি দলের বিরোধিতা করলেও ঠিক একইভাবে পরিকল্পনা ব্যয়বরাদ্দের ধ্বংস শুরু করল
এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের এই সরকার। এরপরে হরেক রকমের উৎসবের জন্য (মাটি উৎসব,
মিষ্টান্ন উৎসব, ইত্যাদি এবং ক্লাবগুলিকে
ব্যাপকভাবে পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে অর্থ বরাদ্দ করা, এবং
দুর্গমস্থানে পরিকল্পনা খাতে অর্থ বরাদ্দ করা একাকার হয়ে গেল।
২
রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়
বিভ্রান্তিকর তথ্য :
রাজ্যের তৃণমূল সরকারের তরফ
থেকেই মাঝে মাঝে দাবি করা হয় যে, এই রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির হার সমগ্র দেশের মোট
উৎপাদন বৃদ্ধির হারের থেকে অনেক বেশি।
প্রকৃত পরিস্থিতি : ভারত সরকারের
প্রকাশিত সর্বশেষ আর্থিক সমীক্ষার (২০১৭-১৮) তথ্যাবলী থেকে দেখা যাচ্ছে (পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা : এ২৯),
পশ্চিমবঙ্গ এখন একমাত্র রাজ্য যেখানকার সরকারের এই বিষয় পাঠানো তথ্য
কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থার (অধ্যাপক মহালনবীশের প্রতিষ্ঠিত) বিচারে
গ্রহণযোগ্যই হয়নি। এটা খুবই লজ্জার কথা, যা গোপন রেখে চলেছে
বর্তমানের তৃণমূলদলের এই রাজ্য সরকার, এবং বিভিন্ন শিল্প
সম্মেলনে নিজেদের বাড়তি অগ্রগতির কথা বলেই চলেছে। এছাড়া, বলা
প্রয়োজন বিধানসভাতেও বারংবার প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও এখনও জানানো হয়নি গত পাঁচ বছরে
এরাজ্যে বাস্তবায়িত শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণ এবং উৎপাদন শুরুর তথ্যাবলী।
৩
কর্মসংস্থানের তথ্যাবলী :
একই সঙ্গে লক্ষণীয় যে, এই সরকার
প্রতিবছরে এই রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি করে সংখ্যা উল্লেখ করে থাকে। যেমন,
এ বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উল্লিখিত সংখ্যা হলো ৮.৯২ লক্ষ। এর
সঙ্গে, এই সরকারের আমলে আগের বছরগুলিতে উল্লিখিত কর্মসংস্থানের
মোট সংখ্যা হলো প্রায় ৮১ লক্ষ। অর্থাৎ তৃণমূল সরকারের আমলে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯০
লক্ষ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রেও বিধানসভাতেই বারংবার
জিজ্ঞাসা করা হয়েছে; গ্রামাঞ্চলে কোন কোন গ্রাম পঞ্চায়েত
এলাকায় এবং শহরাঞ্চলে কোন কোন পৌরসভার কোন কোন ওয়ার্ডে এই কর্মসংস্থান কত সংখ্যায়
হয়েছে। লক্ষণীয় এই প্রসঙ্গে প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর এড়িয়ে গিয়ে কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা উল্লেখ করেই বাজেট বক্তব্য শেষ হয়েছে; ‘‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে।’’ এছাড়া উল্লেখ করা
প্রাসঙ্গিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে শুধু একটি সংখ্যা বললেই হবে না, কোন ক্ষেত্রে কি ধরনের শিল্পস্থাপন এবং পরিষেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে তা
সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে কিছুটা উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ থাকা
প্রয়োজন ছিল এই বাজেটে। কিন্তু তা একেবারেই দেখা গেল না। তাই সরকার এবিষয়ে কতটা
গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেছে তাও বোঝা গেল না।
৪
কর ছাড়ের প্রস্তাব :
নতুন করের ক্ষেত্রে, উল্লেখ করা
হয়েছে, এই সরকার কৃষকদের ক্ষেত্রে খাজনা মকুব করার পর এবং
কৃষিক্ষেত্রে জমি কেনাবেচার বিষয় মিউটেশন ফি মকুব করার সিদ্ধান্ত নিল। এখানে স্মরণ
করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, এই মিউটেশন ফি অনেক আগেই গ্রামাঞ্চলের জন্য মকুব করে রেখেছিল
বামফ্রন্ট সরকার এবং তা যুক্ত করে বর্তমান সরকার। এছাড়া, ১৯৭৮-৭৯
সাল থেকেই ছয় একর সাধারণ কৃষি জমি এবং সেচ সেবিত জমির ক্ষেত্রে ৪ একর পর্যন্ত
সমস্ত কৃষিজমির খাজনা মকুব হয়েই আছে (যা এ রাজ্যের মোট কৃষিজমির প্রায় ৯৫ শতাংশ)।
৫
রাজ্যের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে
উল্লেখ করা প্রয়োজন,
এ রাজ্য সরকার বারংবার (রাজ্যের মোট উৎপাদন বা রাজ্যের মোট আয়) বেশি
করে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে। তার একটি কারণ, চতুর্দশ অর্থ
কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যের মোট আয়ের তিন শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করা সম্ভব।
বেশি আয় উল্লেখ করে কিছুটা ঘুর পথেই রাজ্য সরকার বাড়তি ঋণ বারংবার গ্রহণ করেই
চলেছে। ফলে বামফ্রন্ট সরকারের সামগ্রিক সময়কালে (প্রায় ৩৪ বছর) যে পুঞ্জিভূত ঋণের
পরিমাণ হয়েছিল ১.৯২ লক্ষ কোটি টাকা, তা এই রাজ্য বাজেটের
হিসাব অনুযায়ী বর্তমান অর্থ বর্ষের শেষে অর্থাৎ ৮ বছরের মধ্যেই দ্বিগুণের বেশি
বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছবে ৩.৯৫ লক্ষ কোটি টাকাতে!
গণশক্তি, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮