20171226

৬ই ডিসেম্বর — অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে

সূর্য মিশ্র

আজ থেকে ২৫ বছর আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল সঙ্ঘ পরিবারের করসেবকরা।  ওই দিনটি ভারতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক দিন। আজকের ভারতে সেই সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থী শক্তি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বিপদকে প্রতিহত করতে পারে গণসংগ্রাম ও গণপ্রতিরোধ। সেজন্য প্রস্তুত হতে হবে সংগঠনকে । সে কথাই লিখেছেন লেখক।

এবারের ৬ই ডিসেম্বর কালাদিবসের তাৎপর্য অন্যান্যবারের তুলনায় অ‍‌নেকখানি আলাদা। ২৫ বছর ও ভারতের সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকারের মৃত্যুবার্ষিকী ছাড়াও যেটা মনে রাখা দরকার যে নানাবিচারে এবছর, ৬ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তামাম দুনিয়ার পটভূমিটাই দ্রুত বদলাচ্ছে।

হোয়াইট হাউসে এর আগে ট্রাম্পের মতো একজন রাষ্ট্রপতি এই প্রথম। ঠিক যেমন ভারতে মোদীর মতো একজন প্রধানমন্ত্রী বা উত্তর প্রদেশে যোগীর মতো মুখ্যমন্ত্রী। এরা সবাই কার্যত ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্পের ঘোষণা আমেরিকা কেবল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন ব্রেক্সিটের মূল কথা হলো ব্রিটেন কেবল ব্রিটিশদের জন্য। মোদীর ভারত মানে হিন্দুস্থান কেবল হিন্দুদের জন্য। ইউরোপের সাংসদদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন নিজ নিজ দেশের উগ্রদক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। ‘মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় (১লা জুন, ২০১৭) রচনায় জন বেলামি ফস্টার যে নামে ডাকা হোক না কেন সাধারণভাবে এদের সকলের আর্থ-সামাজিক গণভিত্তি, রাজনীতি এবং বংশপঞ্জির অনুসন্ধান করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে উগ্র ফ্যাসিবাদী ইতালীয় দার্শনিক জুলিয়াস ই‍‌ভোলা (Julius Evola) (১৮৯৮-১৯৭৪) মুসোলিনিকে জাতি, জাতিবাদ ও তাঁর মতবাদের পক্ষে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। তিনি কেবল দর্শন নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি-আধাসামরিক দলীয় সংগঠন এমন কি সামরিক বিষয়েও মুসোলিনির পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করতে করতে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের সময় নাৎসিবাদকেই ইতালির তুলনায় উন্নততর ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির পতনের সময় তিনি বার্লিনে হিটলারের জেনারেল হেড কোয়ার্টারেই অবস্থান কর‍‌ছিলেন। যুদ্ধোত্তর পর্বে তিনিই ইউরোপ থেকে আমেরিকার সমস্ত নয়া ফ্যাসিবাদীদের ‘আধ্যাত্মিক জনক’ (স্পিরিচুয়াল ফাদার) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে‍‌ছিলেন। ইভোলার রচনাবলি ও জীবনীকারদের বিবরণ এই প্রবন্ধের আ‍‌লোচ্য বিষ‌য় নয়। এককথায় তিনি ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের কারণগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুলত্রুটিমুক্ত বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদের দিশারি বলে তাঁর অনুগামীদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন। অধুনা পরিত্যক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন তথা আমেরিকার ফ্যাসিবাদের নবতম সংস্করণ ‘অলট-রাইট’ অর্থাৎ বিকল্প দক্ষিণপন্থীদের ইভোলার উত্তরসূরি বলা যায়। এই ধারাবিবরণীর সঙ্গে মোদী বা মোহন ভাগবতের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এঁদের পূর্বসূরি মু‍‌ঞ্জে যখন মু‍সোলিনির ইতালিতে ফ্যাসিবাদের পাঠ নিতে গি‍‌য়েছিলেন তখন তাঁদের গুরুর গুরুদেব ইভোলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল কিনা সেটা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। ৬ই ডিসেম্বরের ২৫ বছরে যা প্রাসঙ্গিক তা হলো বিশ্বব্যাপী বর্তমান (২০০৮-১৭) দীর্ঘ সময় জুড়েমন্দার প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের অধুনা প্রজন্মের উত্থান যা প্রায় নয় দশক আগের মহামন্দা কবলিত ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের ঘটনা‍কে মনে করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন নয়া উদারবাদী অর্থনীতিজনিত সংকট, বৈষম্য ও বেকারির বিপুল বৃদ্ধি, ধান্দার ধনতন্ত্রর অবাধ লুটতরাজ ও ক্রমবর্ধমান জনরোষকে উগ্র দক্ষিণপন্থা বিভাজনের রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিপথে পরিচালিত করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে।

কর্ণাটকের উদুপিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আয়োজিত ধর্ম সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মোহন ভাগবতের ঘোষণা আসলে দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সংঘাতকে তীব্রতর করার মরিয়া আর্তনাদ। এবছর ৬ই ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে এটাই হলো নবতম সংযোজন। আসলে গুজরাট ও তার পরবর্তী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলিতে যে কোনও মূল্যে ওঁদের সোনার হরিণ চাই। অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতেই রামমন্দির চাই। যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল তার পুরোটাই চাই। সেখানে অন্য কোনও কাঠামো না-থাকা চাই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলেও কুছ পরোয়া নেই। রায়ের জন্য অপেক্ষা করা তো দূরের কথা শুনানি শুরু হওয়ার পূর্বেই চাপ সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণের সময়সূচি ঘোষিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত কবে কি হয়, হ‍‌বে তা নিয়ে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। ৫ বছরে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রত্যক্ষ মদতদাতাদের গুজরাট গণহত্যার নায়কদের কারুর কোনও সাজা হয়নি। গোরক্ষকবাহিনী, অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড, লাভ জিহাদের অভিযোগ তুলে স্বনিযুক্ত খাপ পঞ্চায়েতসহ সঙ্ঘ পরিবারের নানান নামে বিভিন্ন অবতারের নিজস্ব ঘাতকবাহিনী মৃত্যুদণ্ডের রায় দিচ্ছে ও তা কার্যকর করছে। গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ড যে নরেন্দ্র দাভোলকার বা গোবিন্দ পানসারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার পুনর্নির্মাণ মাত্র। কেবল সংখ্যালঘু নয় দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষ, নারী, শিশু এদের রামরাজত্বে কারুর রেহাই নেই। দেশের সংবিধান, আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা, সংসদ, সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি কোনও কিছু পরোয়া করার দরকার নেই। রাজ্যসভায় প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোটাই পাল‍‌টে ফেলার অভিযান শুরু হয়েছে। এসব নিছক একনায়কতন্ত্র নয়। কোনও সন্দেহ নেই যে এটা ধান্দার ধনতন্ত্রের বর্তমান পর্বে—লগ্নিপুঁজির সর্বাধিক প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বের পথে যাত্রার সূচনা মাত্র। এই একনায়কত্ব আমাদের ভূখণ্ডে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য মিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাপেক্ষা উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থানের পরিপূরক।

এসবের অর্থ এই নয় যে ভারতে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেছে। একটি ফ্যাসিবাদী দলও এককভাবে কেন্দ্রে যদি সরকার গঠন করে তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে তাদের পরিকল্পিত অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাবে যেমনটা এখন হচ্ছে। কিন্তু সেটাই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। ভারতে চিরায়ত অর্থে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব যদি তা কোনও সাম্রাজ্যবাদী দেশের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সামরিক জোটের শরিক না হয়। এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের চাইতে নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার উপাদানগুলির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের গুরুত্ব বেশি। যে সব দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, যেমন ইতালি ও জার্মানিতে, তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের রূপ এক ও অভিন্ন ছিল না। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিকাশের প্রথম লক্ষণগুলি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গতিরোধ করতে ব্যাপকতম প্রতিরোধের মঞ্চ গড়ে তোলা। কবে ফ্যাসিবাদ পূর্ণাঙ্গ রূপে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবে তার অপেক্ষায় দিবানিদ্রার বিলাসিতার অর্থ হলো ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করে দেওয়া। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদ এখনই দরজায় কড়া নাড়ছে। ভারতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান বা বাংলাদেশের চাইতে বেশি। সঙ্ঘ পরিবার ও কেন্দ্রীয় শাসকদলের কল্যাণে আমাদের দেশসহ প্রতিবেশী দুই দেশে আই এস আই এস এবং অন্যান্য মুসলিম সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলির ভিত্তি প্রসারিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, সংঘাত, দাঙ্গার প্রতিটি ঘটনা এদেশে হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারীদের শক্তি জোগাবে। বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি দুদিক থেকে আক্রান্ত হবে। জাতি, ধর্ম, ভাষার ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত জনগণের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে যে জোয়ার সৃষ্টির সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির আর্থিক নীতি ও দুর্নীতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি পর্দার আড়ালে চলে যাবে। সেগুলি দমনপীড়নের জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োজন হবে না। তখন নোট বাতিল, জি এস টি, খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যুগুলিকে চাপা দেওয়ার জন্যই ধান্দার ধনতন্ত্রের উপাসকদের রামমন্দির নির্মাণের এই বেপরোয়া তোড়জোড়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি ষোলকলা পূর্ণ করবে।

সারা দে‍‌শে এখন যা ঘটছে তার বাংলা সংস্করণের প্রকাশ ২০১১ সালে। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার বিল দিয়ে প্রস্তাবনা — যে জমিতে এখন যে কেউ সরষে ফুল দেখতে পারেন। শিল্পে খরা, কৃষকের আত্মহত্যা, বেকারদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি, টেট থেকে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি। সর্বোপরি স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসের রাজত্বে হামলা, মিথ্যা মামলা, ধর্ষণ, খুন, নির্বাচনে প্রহসন দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। এসবের মধ্যে সঙ্ঘের শাখা ও কর্মতৎপরতা নিরাপদ আশ্রয়ে বিস্তার লাভ করছিল। সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসবাদীরা খাগড়াগড়ে শাসকদলের অফিসের ওপরতলায় ঠাঁই পেল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদী দিল্লির লাড্ডু নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য। প্রতিদানে বি জে পি রাজ্যে আবার ২টি আসন পেল। মুখ্যমন্ত্রী আদাজল খেয়ে নামলেন বি জে পি-কে প্রধান বিরোধীদলের জায়গা করে দিতে। শুরু হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার গড়াপেটা ম্যাচ। ধুলাগড়ে শাসকদলের এক হিন্দু বিধায়ক অপরদিকে এক মুসলমান বিধায়ক টস করে মাঠ ভাগ করে নিলেন। শাসকদলের দুই বিধায়কের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে দুই বামপন্থী সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি ও মহম্মদ সেলিমের শান্তি মিছিল আটকানো হলো। এরকম অনেক ধুলাগড়, নোয়াপাড়া, বসিরহাট, চোপড়া, ধূপগুড়ির উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাই জ্যোতি বসু যাদের অসভ্য বর্বর বলেছিলেন, সেই বি জে পি মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় তাঁদের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ — আগেও ছিল, এখনো আছে। ট্রাম্প, মোদী বা ইনি যে অদৃশ্য সূত্রে সাতপাকে বাঁধা তার পোশাকি নাম ধান্দার ধনতন্ত্র বা ক্রনি ক্যাপিটালিজম। এঁদের সবার স্বামী-স্ত্রী, মেয়ে-জামাই, পুত্র-পুত্রবধূ, ভাই-ভাইপোরা সেই অর্থে একই পরিবারভুক্ত। কেউ বড় শরিক, কেউ মেজো আবার কেউ বা নিতান্তই ছোট শরিক মাত্র। তাই হাস্যকর হলেও এটাই সত্য যে ট্রাম্প যেমন ক্রনি ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে প্রকা‍‌শ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন বা মোদী যেমন কালো টাকা উদ্ধারের জন্য চোখ ছলছল করে ফেলেন ইনি তখন রাজ্যে বুথপিছু গড়ে ১০৫ জনের কাজ দিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করতে পারেন। প্রতি ঘণ্টায় ১৫৪জন কাজ পেয়েছেন! পাহা‍‌ড়, জঙ্গলমহল, সুন্দরবন, ডুয়ার্স — সবাই হাসছে তো হাসছেই। এমন কি যাদবপুর, বেহালার পৈশাচিক লালসার শিকার শিশুকন্যার পরিবার, স্বাস্থ্যভবনে বিক্ষোভরত কর্মচারীর মৃতদেহ, ডেঙ্গুতে মৃত বা আত্মঘাতী কৃষকের পরিবার, বন্ধ চা বাগান ও কলকারখানার শ্রমিক কাঁদলেও রাজ্যজুড়ে অট্টহাসির কলরোলের তা এত তুচ্ছাতিতুচ্ছ যে সব চাপা পড়ে যাচ্ছে। হাসাহাসির তালিকা এত দীর্ঘ যে তার স্থান সংকুলান করা এই পরিসরে অসম্ভব। গোয়েবলসীয় প্রচার এখন ‘উত্তর সত্য’ নাম ধারণ করেছে। সংকট জর্জরিত জনগণের সামনে ইন্দ্রজালের কায়দায় সবরকম প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যার মোহজাল নির্মাণের প্রতিযোগিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা।

কেবল এসবের সাতকাহন নিয়ে এবারের ৬ই ডিসেম্বর নয়। এবার ৬ই ডিসেম্বর এসবের বিকল্প নির্মাণের শপথ নেওয়ার দিন। উত্তর সত্যের বিপরীত নির্মাণ। সত্য হলো মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের চাইতে জনসমর্থনের ঢল বার্নি স্যান্ডারস-এর দিকে যিনি সমাজতান্ত্রিক বিকল্পের কথা বলেন। তিনি প্রার্থী হলে ট্রাম্প হয়তো পরাস্ত হতেন। ব্রিটেনে বিরাট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে থেরেসা মে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ডাক দিলেন। তাঁর শক্তি ক্ষয় হলো। শক্তি বাড়লো করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টির যিনি টনি ব্লেয়ারের নয়া উদারবাদী নীতির বিরোধী। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থীদের সমর্থনে লি পেঁ-কে আটকে দেওয়া গেছে। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দ্বন্দ্ব যা এতদিন স্তিমিত ছিল তাতে এখন চিড় ধরেছে। ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডরে বামপন্থীদের জয় জয়াকার। লড়াইয়ের সামনের সারিতে কিউবা। আছে বলিভিয়া, ব্রাজিল। স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাসে বামপন্থীরা এগচ্ছে। আমাদের দেশের রাজধানীতে পার্লামেন্ট স্ট্রিট কার্যত প্রথমে শ্রমিক ও পরে কৃষকরা, সবমিলে ৫দিন দখল নিয়েছিল। রাজ্যে নবান্ন অভিযান বি পি এম ও-র পদযাত্রা, সংগ্রামের নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। কলকাতা এখন প্রায়শ শ্রমিক, উদ্বাস্তু, আদিবাসী, সামাজিক ন্যায়মঞ্চ লোকশিল্পী, যুব, প্রতিবন্ধী কোনও না কোনও মিছিলে কল্লোলিত হচ্ছে। কিন্তু সামনে অগ্নিপরীক্ষা। ‘তৃণমূল হঠাও বাংলা বাঁচাও, বি জে পি হঠাও দেশ বাঁচাও’ এই আহবান এখন আরও প্রাসঙ্গিক। সংগ্রাম ও সংগঠন গণপ্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত কিনা তার পরীক্ষা দিতে হবে। এবারে ৬ই ডিসেম্বর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শপথ দিবস।

গণশক্তি, ৬ই  ডিসেম্বর ২০১৭

তুমুল তিমিরে লেখা হবে নতুন সংগ্রামের আলেখ্য


শ্যামল চক্রবর্তী

রাজ্যের অসংখ্য গ্রাম-শহর ছুঁয়ে শেষ হয়েছে বি পি এম ও-র পদযাত্রা। জনজীবনের ১৭ দফা দাবি নিয়ে এই পদযাত্রাকে কেমনভাবে গ্রহণ করলেন এরাজ্যের জনগণ? সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন লেখক।
অসংখ্য গ্রাম শহর নগর অতিক্রম করে ৩রা নভেম্বর পদযাত্রা প্রবেশ করল কলকাতা মহানগরীতে। বি পি এম ও-র ঘোষিত কর্মসূচি ছিল মানুষের কাছে যাও যে মানুষ টানে দাঁড় ধরে থাকে হাল মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে। যে মানুষ শুধু দুটি অন্নখুঁটি কোনও মতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের কাছে যেতে হবে। এসেছেন আদিবাসী যুবক ওরা শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে বংশ বংশ ধরে অরণ্যচারী, তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অরণ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে জমির পাট্টা। ওরা ছড়িয়ে আছে বীরভূমে, বাঁকুড়ায়, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামে এক কথায় জঙ্গলমহলে। ছদ্মবেশী তৃণমূল আর মাওবাদীদের অশুভ আঁতাতে জঙ্গলমহল ছিল রক্তাক্ত। ওরা মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে মানুষকে দাসত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। এখন মাওবাদীদের মুখোশের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। খোলাখুলি আত্মপ্রকাশ করেছে তৃণমূলী জল্লাদবাহিনী। সেই জঙ্গলমহলের অত্যাচারিত মানুষেরা এসেছেন। এসেছেন সারা শরীরে রক্তের দাগ নিয়ে। তাদের সারা প্রান্তরে এখন বিষাদের ছায়া। অসংখ্য মানুষের কান্নার ছায়ায় বাতাস ম্রিয়মান। লাল পতাকা আজ তাদের করতলে এক বিশ্বাসী হাতিয়ার। তাদের মহিমান্বিত কণ্ঠস্বরে জীবন জয়ের গান।
২০০৬ থেকে ২০১০ মাত্র এই চার বছরে একমাত্র ঝাড়গ্রাম মহকুমাতে খুন হয়ে গিয়েছিল ২৫৫জন সি পি আই (এম্) ও বামপন্থী কর্মীরা।
অভিজিৎ মাহাতো অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তাজা টগবগে এক তরুণ এস এফ আই কর্মী, বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ওর শরীর। ফুলবনী মাণ্ডি কালো পাথরে খোদাই করা এক ছিপছিপে তরুণী, স্পর্ধায় মাথা তুলবার ঝুঁকি নিয়েছিল দিনবদলের স্বপ্ন দুচোখে মেখে। এস এফ আই-র পতাকা হাতে উচ্চকিত স্লোগানে আদিবাসী মূলবাসীদের চেতনার কন্দরে পৌঁছে দিত আশার আলো, সংগ্রামের মহামন্ত্রধ্বনি। অন্ধকার গহ্বর থেকে হিংস্র পশুরা বেরিয়ে তার ওপর হামলা চালিয়েছিল। তারপর ২৬ বছর বয়সী অর্ধমৃত ফুলবনী মাণ্ডিকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল।
তাতেও তাদের রক্ত তৃষ্ণা মেটেনি। শালকু সোরেন এক আদিবাসী কৃষক, রুক্ষ মাটির বুকে সোনার ফসল ফলাতো, দুন্দুভি বাজিয়ে হায়দরী হাঁক দিয়ে সে জানাতো ইন কিলাবী আহ্বান। শালকু সোরেনের লাশ ফেলে দিল ওরা পাশবিক উল্লাসে। গোটা এলাকা ঘিরে রেখে দিল, আত্মীয়স্বজনকেও স্পর্শ করতে দিল না। চারদিন ধরে লাশ পচলো ফটোগ্রাফারদের সামনে। শোকার্ত শালকু সোরেনের স্ত্রীকে চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার অবকাশও দিল না ওরা। সদ্য বিধবা শালকুর স্ত্রীকে বন্দুকের ডগায় তৃণমূলের মিছিলে জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন ছত্রধর মাহাতোর ডেরায় তৃণমূল নেত্রীর নিত্য আসা যাওয়া।
এ রাজ্যে আছে সাতাত্তর হাজার বুথ। আমরা বুথএই শব্দটি ব্যবহার করছি এই কারণে যে গ্রাম বা শহরে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম এলাকা চিহ্নিত করা সম্ভব ঐ বুথশব্দটির মধ্য দিয়ে। এই মুহূর্তে সাতাত্তর হাজার বুথই হবে আমাদের পাখির চোখ। গ্রিক পুরাণের একটি চরিত্র অ্যান্টি‌য়ুস। তিনি ছিলেন অপরাজেয় বীর। পৃথিবী ছিলেন তার মা। তাই যতক্ষণ মাটিতে পা থাকত তাকে পরাজিত করার ক্ষমতা কারও থাকত না। হারকিউলিস তাকে মাটি থেকে তুলে নিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে অ্যান্টিয়ুস শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাকে হত্যা করতে হারকিউলিসের কোনও সমস্যা হয়নি। আমাদেরও শক্তির উৎস ঐ মাটি। যে মাটির সন্তান মানুষ। কোনও যাত্রাপালার মাটি মানুষ নয়। মানুষের সঙ্গে আছে জীবন্ত, চলমান সম্পর্ক। মাও-সে-তুঙ একটু অন্যভাবেই বলেছেন জলের মধ্যে মাছের মতো বিচরণ করতে হবে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলেই আমরা শক্তিহীন হয়ে পড়বো।
মানুষের জন্যই আমাদের বেঁচে থাকা। মানুষের জন্যই আমাদের সংগ্রাম। আর সেই সংগ্রামের অন্তস্তলে মানুষের আসনে আসীন শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর, আদিবাসী গরিব সংখ্যালঘু মানুষ। প্রধানত এই মানুষের জন্যই অন্ধকার দারিদ্রের হিমকুঞ্চিত যবনিকা ছিঁড়ে ভোরের আলোর মতো একফালি উজ্জ্বল রৌদ্র ছিঁড়ে আনার জন্য আমাদের সংগ্রাম।
গ্রামে কৃষক, খেতমজুর, আর অন্য রাজ্যে দৈনিক মানুষের কাজে যোগ দিতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবার। তাদের কাছেই আমরা গিয়েছি। লাল পতাকা হাতে নিয়ে মানুষগুলো ছুটে এসেছেন জল নিয়ে, বুনোফুলের পাপড়ি ছড়িয়েছেন আমাদের চলার পথে। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে তারা এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের পাশে। লাল পতাকা তাদের চেতনার কন্দরে নিয়ে এসেছে বিশ্বাসের বারুদ।
আমরা বলেছি চল্লিশ হাজার গ্রাম আছে আমাদের রাজ্যে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলিতে এখন নিঃসীম শূন্যতা, লাল পতাকার মিছিল বুকের মধ্যে এক প্রাণবন্ত যৌবন জন্ম দিয়েছে।
গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছে পদযাত্রীরা। দুহাত উঁচু করে ছুটে এসেছে আধা উলঙ্গ শিশু, নিরন্ন মা, বুভুক্ষু বাবা। তার মাঠভরা সোনালি ফসল, তবুও তার মুঠো ভরে যায় ঋণে। তাদের প্রত্যয় আমাদের মিলিত সংগ্রামে আমরাই ফলাতে পারি স্বস্তির সোনালি ফসল। লাঙলের ফালে ক্লান্ত বিশ্রাম মেখে তারা এসেছেন। তা‍‌দের রক্ত মাংস হাড়করোটির কষ্ট নিয়ে, রক্ত ধোয়া হৃদয় নিয়ে তারা কলকাতায় এসেছেন। শোষকেরা চায় আমাদের কৃষকরা শূন্য পাকস্থলী আর ক্ষয়াকাশ নিয়ে মাঠে ফিরে যাক।
বি পি এম ও-র দাবি ছিল কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম দিতে হবে। এটাই ন্যূনতম ক্রয় মূল্য হওয়াই উচিত। কিন্তু তা হয়নি। কে শুনবে কৃষকের যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠস্বর। মহাজনের ঋণ শোধ করতে পারছে না কৃষক। কৃষকের কষ্টে রক্তে ঘামে যে ফসল খেতে লালন করেছে সে ধান কৃষকের অঙ্গনে ওঠে না। শুধু ওঠে শস্যের ঋণ। তাই সারা দেশের ৩ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সারা দেশের তীব্র হাহাকারের মধ্যে দাঁড়িয়েও ৩৪ বছর ধরে আমাদের এই বাংলায় বাম সরকার ডানা মেলে কৃষকের শক্তি জুগিয়েছে সাহস সঞ্চার করেছে। একজনও কৃষক এ বাংলায় আত্মহত্যা করেনি। কিন্তু তৃণমূল সরকার আসার পরেই একশোরও বেশি কৃষক ফলিডল খেয়েছে, বিষ খেয়েছে, গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলে পড়েছে। বি পি এম ও এ রাজ্যে অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্য অংশের খেটেখাওয়া মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে রৌদ্রে পোড়া জোছনায় ভরা, প্লাবনে ভাসানো মাটি পায়ে পায়ে অতিক্রম করে আগামীদিনের যুদ্ধারম্ভের প্রস্তুতি ঘোষণা করেছে।
পুরুষের পাশাপাশি হেঁটেছেন মহিলারা। কারও মা, কারও স্ত্রী, কারও বোন নেমে এসেছেন সংগ্রামের প্রশস্ত রাজপথে। মানুষ নিদ্রাহীন তন্দ্রার মধ্যে ধর্ষিতার কাতর আর্তনাদ শুনতে পান প্রতিদিন। দিল্লির নির্ভয়া, উত্তর প্রদেশের আই এ এস পাঠরতা পুলিশ অফিসারের তরুণী কন্যা, দলিত কিশোরী কামদুনির ছাত্রী, পার্ক সার্কাসের সুজেটা, হাজরার মোড়ে ফুঁসে ওঠা বাঁকুড়ার ধর্ষিতা কিশোরী কন্যার মা, রায়গঞ্জে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া আদিবাসী কিশোরী সংখ্যা বেড়ে যায় ক্রমাগত। তিন বছরের কিশোরী কন্যা থেকে ৭৩ বছরের বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী রেহাই নেই কারও। এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? সকলেমি‍লে তৈরি করতে হবে প্রতিরোধের দেওয়াল। ভষ্ম, অপমান, শয্যা ছে‍‌ড়ে মাথা তুলতে হবে আমাদের। স্বাধীনতার ৭০ বছর পর যখন যৌবন উৎসবে মেতে ওঠার কথা তখন যৌবন পথের ধুলায় দলিত মথিত হয়।
বি পি এম ও স্লোগান তোলে সব হাতে কাজ চাই। খেতমজুরদের হাতে কাজ নেই, খুব‍‌ বেশি কাজ পেলে বছরে দুমাস থেকে পাঁচ মাস। বাকি মাসগুলো শুধু হাহাকার ভরা অনাহারী দিনমান। গ্রামীণ মজুরেরও কাজ নেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। যুবক-যুবতী মধ্যবয়সী এমনকি ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধরাও যে গ্রামেরই হোক বা শহরেরই হোক এখন তারা কাজ চায়। প্রতিদিন তারা স্বপ্ন দেখে আগামীকালের। প্রতিদিন আসবে কাজ, ব্যবহৃত হবে তার মস্তিষ্ক, আসবে উচ্ছ্বসিত দিন। দুহাতে অঞ্জলিভরে নেবে যা কিছু তার প্রাপ্য। তাই তারা হাতে তুলে নিয়েছে লাল পতাকা, তার হাতের পাঞ্জায় বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। জ্বলে ওঠে তাজা বারুদ বহ্নি।
১০দিন ধরে পদ যাত্রার পর উত্তর বাংলার বিভিন্ন গ্রাম শহর অতিক্রম করে পদযাত্রা প্রবেশ করেছিল ১লা নভেম্বর শিলিগুড়ি শহরে। সেদিন শিলিগুড়ির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছিল শুধু উদ্দাম কলরব। বিভেদের কুমন্ত্রণায় উত্তর বাংলার আকাশ এখন পীড়িত। পাহাড় জ্বলছে, জ্বলছে দাবানলের মতো। কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে রক্তের ছাপ, পাহাড়ি পথে রক্তের আলপনা। ‘‘গোর্খাল্যান্ড’’ এই শব্দটি জিইয়ে রেখেছে এই তৃণমূল সরকার। জাহান্নামের আগুনে বসে মোনালিসার হাসি হাসছেন মোদী-মমতা। জিয়ল মাছের মতো গোর্খাল্যান্ড শব্দটি জিইয়ে রাখা হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদা‍য়ের মধ্যে মেরুকরণ তো করছেই এবারে তার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বাঙালি ও নেপালির মধ্যে বিভাজন। উসকে দেওয়া হয়েছে গ্রেটার কোচবিহারের দাবি। সারা উত্তর বাংলাকে নিয়ে ছিনি‍মিনি খেলছে তৃণমূল-বি‍‌ জে পি। সাড়ে ৪ লক্ষ চা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট উত্তরবাংলার পাহাড়ি, সমতলবাসী, বনবাসী, আদিবাসী, চা শ্রমিক, কৃষক সকল অংশকে নিয়েই চলমান পদযাত্রা উত্তর বাংলার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু রচনা করেছে।
১লা নভেম্বর শুরু হয়েছিল মহানন্দার তীর থেকে গড়ানো দুপুরে। অফুরন্ত মানুষের সমাবেশে অফুরন্ত, প্রাণবন্ত মিছিল শেষ হলো শেষ বিকেলে দিগন্তে রক্ত গোলাপের ম‍‌তো উজ্জ্বল আলো লাল পতাকায় মেখে নিয়ে।
আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য ৭৭ হাজার বুথ এলাকা। আমরা ৭৭ হাজার বুথে পৌঁছাবই। আমরা জানি ১২দিন পদযাত্রায় ৭৭ হাজার বুথে পৌঁছানো যায় না। এ‍ই ১২দিন আমরা একটা পর্যায়ে অতিক্রম করলাম। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বুথ অতিক্রম করেছি। বাকি বুথগুলো লাল ঝান্ডার স্পর্শের জন্য অহল্যার মতো অপেক্ষা করছে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস জুড়ে আমাদের পদযাত্রা চলবে। যেখানে আমরা পৌঁছাতে পারিনি সেখানেও চলতে চলতে পৌঁছে যাব। আমাদের বিরাম নেই বিশ্রাম নেই। মানুষের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। যে মানুষ মাটির পিঁপড়ের মতো, সমুদ্রের মাছের মতোআকাশের পাখির মতো অগণন। যাঁরা ভীরু, যাঁরা বীর, যাঁরা নিরক্ষর, যাঁরা শিক্ষিত, যাঁরা ধ্বংস করে, যাঁরা সৃষ্টি করে, তাঁদেরই জন্য আমাদের সংগ্রাম। তাঁদের জীবনেই আমাদের জীবন মেলাতে হবে। মানুষ অন্তরময়। অন্তর মেশালে তবে তাঁর অন্তরের পরিচয় আমরা পাব। অন্তরঙ্গ হবার যোগ্যতা অর্জন করব।
আমরা দেখেছি গ্রাম এবং শহরের শ্রমিকরা এসেছেন। তাদের বুকে ছিল স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, তাঁরা জানিয়েছেন তাদের বুকের মধ্যে দামালদরিয়া নেচে উঠেছে। আমরা দেখেছি ওদের বুনো পায়ের বন্যতা জেগে উঠেছে মগজে, পেশিতে, দেহে। যখনই আক্রান্ত হয়েছে তখনই তাদের উষ্ণ রক্ত টগবগ করে ফুটেছে। কয়লা শ্রমিকরা এসেছেন হীরক সকালের স্বপ্ন নিয়ে, ইস্পাতের ফলার মতো ইস্পাত শ্রমিকরা এসেছেন, বিদ্যুৎ শ্রমিকরা জ্বেলেছেন চেতনার উদ্ভাসিত আলো। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলাদের মিছিলে দেখে রক্ত ঝরা মাটির ললাটজুড়ে বুক বেঁধেছে মানুষ।
আগামী দুমাস হবে আমাদের দাবি ছিনিয়ে আনার উৎসব। যে দাবি এখুনি আদায় করা সম্ভব সেই আশু দাবিগুলো নিয়ে তুমুল তিমিরে শুরু হবে নতুন সংগ্রামের আলেখ্য। আমার ১০০দিনের কাজ নেই, আমাকে কাজ দিতেই হবে। আমার পরিবারে ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই, কার্ড দিতেই হবে। আমি দিনমজুর আমাকে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ দিতেই হবে এ আমার অধিকার। দানিসনদ প্রচারের আন্দোলনের স্তর থেকে উন্নীত হয়ে এখন দাবি আদায়ের আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
এবারের আন্দোলন রাজ্যের আহ্বানে রাজ্য পর্যায়ে কোনও নির্দিষ্ট দিনে নয়। এবারের আন্দোলন জেলায় জেলায় অঞ্চলে অঞ্চলে। স্থানীয় নেতৃত্বকে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই আন্দোলনকে বাস্তব রূপ দিতে হবে। এবারের লড়াই কোনও নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের জন্য বি পি এম ও অন্তর্গত সব অংশকে সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বিগত ১২দিনে অজগরের রোষে গর্জে ওঠা পাঁজরের ভাঙা হাড়ে অনন্ত ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে অন্ধকারে প্রসারিত মানুষের সূর্যময় হাতের আশ্রয়ে, মজুরের শিরা উপশিরা ধমনীর রক্তে জীবনের ঘাম মিশিয়ে, ছাত্র যুবককেরা তাদের ভবিষ্যতকে নতজানু করে, বন্ধুর লাশ কাঁধে তুলে নিয়ে মাইলের পর মাইল, গ্রামের পর গ্রাম, শহর থেকে মহানগর পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছে। এখন আবার আমাদের বেগবান দর্শন, শ্রম, উৎসব নিয়ে আমরা চলতে থাকব। আমাদের স্নায়ুর তিমির জুড়ে স্বপ্নের স্বদেশ। আমাদের চার পাশে ফুটে আছে জীবনের অপরূপ উজ্জ্বল ফুল। আমাদের সামনে আছে ছিনিয়ে আনার জন্য দিগন্তের মতো প্রসন্ন ভবিষ্যৎ।
৩রা নভেম্বর কলকাতার মহামিছিল শেষ হয়নি। আঁধারের আল বেয়ে বেয়ে এ মিছিল চলতেই থাকবে। এ মিছিল লাঙ্গলের ফালে আগাছা উপড়ে ফেলবার এ মিছিল কাস্তের বুকে নতুন ফসল তোলবার।
এই মিছিল সব পাওয়ার সব হারার এই মিছিল। ক্লান্তি হীন, শ্রান্তি হীন এই মিছিল।

গণশক্তি, ৬ই নভেম্বর ২০১৭