অজয় দাশগুপ্ত
আচমকাই সুযোগ হয়ে গিয়েছিল অশোক
মিত্রের সান্নিধ্যে আসার। রাজনৈতিক জীবনের গোড়া থেকেই যাঁর বক্তৃতা ও লেখার
গুণমুগ্ধ ভক্ত, তাঁর কাছে নিয়মিত যেতে হবে শুনেই
রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। পয়লা মে সকালে মৃদুলদা(দে) যখন ফোনে জানালেন ওঁর মৃত্যুসংবাদ, তখন
একরাশ কথা ভিড় করে এলো। শুন্যতা তো বটেই!
১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি থেকে আমার
ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ‘গণশক্তি’-র রবিবারের উত্তর-সম্পাদকীয় লেখা ওঁর বাড়ি থেকে
আনার। টানা প্রায় দু’বছর আলিপুর পার্ক রোডে সোনালী অ্যাপার্টমেন্টে প্রতি সপ্তাহে
দু’বার করে যেতে হতো। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা! প্রথমে টেলিফোন করে ওঁর সময় নিতে হতো, তারপর
যথার্থই যথাসময়ে (এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও
না) পৌঁছে যেতে হতো। প্রথমে উনি টানা বলে যেতেন, যার
দ্রুত নোট নিতে হতো। পরের দিন সেটা কম্পোজ করে নিয়ে গেলে তার ওপর উনি কাটাছেড়া
করতেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘আমি প্রথমবার
ভাবনাটা বলি, পরেরবার লিখি।’
গণশক্তির বানান নিয়ে ওঁর প্রশ্ন
ছিল। একদিন উনি ডিকটেশন দেওয়ার সময় কোনো লেখায় ‘ইতিমধ্যে’ শব্দটি বলেছিলেন। আমাদের
তখন সংসদ বাংলা অভিধান অনুসরণ করা হতো, সোমেনদা(পাল) আমাকে
একদিন ওই অভিধান দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ইতিমধ্যে’
অশুদ্ধ প্রয়োগ, ওটা ‘ইতোমধ্যে’ হবে। আমিও তাই সেই
অনুসারে ‘ইতোমধ্যে’-ই লিখেছিলাম। উনি লেখাটার কম্পোজ প্রুফ দেখার সময় আমাকে বললেন, ‘তোমরা
ইতিমধ্যে-কে ইতোমধ্যে লেখো কেন?’ আমি ‘সংসদ
বাংলা অভিধান’-এর কথা বলতে উনি বললেন, ‘তোমাদের প্রুফ
কি বাংলা ভাষার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকরা দেখেন? রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ‘ইতিমধ্যে’ ব্যবহার করেছেন, সেটাও তাঁরা
মানবেন না?’ ওঁর নোট নিতে গিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি
তো বটেই, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ
নিয়েও অনেককিছু শিখতে পেরেছিলাম বলে ধন্য হয়েছি। একই শব্দ একই লেখায় দু’রকম প্রয়োগ
করা নিয়ে আমি প্রশ্ন করতে ওঁর সহাস্য মন্তব্য, ‘আমি
দুটোই লিখি, একটা লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে
আরেকটা লিখি।’
ওঁর বিশাল লাইব্রেরি কাম ড্রয়িং
রুমে বসে জ্ঞানভান্ডারের বহরে নিজেকে কার্যত হারিয়ে ফেলতাম। মাঝেমাঝে টুকরো-টাক্রা
কথাবার্তা হতো। আমার বাড়ি গড়িয়াতে জেনে বলেছিলেন, ‘ওখানে
উজ্জ্বল (চ্যাটার্জি) আছে, খুবই উদ্যমী
ছেলে।’
‘আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট’
বলে যিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তিনি কিন্তু
ব্যক্তিগত আচারে অত্যন্ত সুভদ্র ছিলেন, তার যথেষ্ট
প্রমাণ পেয়েছি অনেকের কাছেই। প্রত্যেক অতিথিকে উনি লিফটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে
দিতেন, নগণ্য হলেও আমার ক্ষেত্রে কোনোদিন তার
অন্যথা হয়নি। আপাতকঠিন, দৃঢ়
ব্যক্তিত্বের পিছনে যে একজন স্নেহশীল পিতার মনন লুকিয়ে আছে, সেটা
একটা ঘটনায় টের পেয়েছিলাম। গণশক্তি থেকে ২৩০নং বাসে চেপে শেষ স্টপেজ চিড়িয়াখানায়
নেমে হেঁটেই চলে যেতাম আলিপুর পার্ক রোডে। ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবে, তাই
তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে একদিন রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। রাস্তা খোঁড়া হচ্ছিল, চারদিকে
ইটের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে ছিল। ব্যস্, হাত-পা ছড়ে
গেলো, রক্ত বের হচ্ছিলো। দেরি হয়ে যাবে ভেবে
আমি কোনমতে ধুলে ঝেড়ে দৌড় লাগালাম। বেল টিপতে দু’মিনিট দেরি হয়ে গেছিল, দুরুদুরু
বুকে অপেক্ষা করছিলাম। ‘আজ একটু দেরি হয়ে গেলো’ বলতে বলতেই উনি আমার হাত লক্ষ্য
করে বললেন, ‘কী হয়েছে, ছড়ে
গেছে মনে হচ্ছে!’ আমি বললাম, ‘ও কিছু না, পড়ে
গিয়ে একটু লেগেছে।’ উনি আমাকে ঘরে বসিয়ে সোজা ভেতরে চলে গেলেন। তারপর একটা
ক্রিম(সম্ভবত ‘ভোলিনি’ জাতীয় কিছু একটা হবে) নিয়ে এসে নিজে লাগিয়ে দিতে লাগলেন, হাতে-পায়ে।
আমি তো সঙ্কোচে ‘না, না’ করতে লাগলাম। কিন্তু কার্যত ধমকে
আমাকে বললেন, ‘তুমি চুপ করে বসো, নিজে
নিজে মলম লাগানো যায় না।’ তারপর আমি সেদিন লিখতে পারবো কিনা, অন্যদিন
আসবো কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, ‘কিছুই তো হয়নি, আমি
পারবো, আপনি বলুন।’ সেদিন লেখা শেষ করে ফেরার
সময় উনি মলমের টিউবটা আমাকে দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যাও।
পরে আরেকবার লাগিয়ে নেবে।’ ওঁর এই স্নেহশীল ভূমিকা দেখে আমি রীতিমত অভিভূত হয়েছিলাম
সেদিন।
ওই সময়েই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
রোডে ‘গণশক্তি’-র নতুন ভবনের উদ্বোধন হয়। তারিখটা ১৯৯৭সালের ২রা জানুয়ারি। আমি তখন
নিয়মিত ওঁর বাড়িতে যাচ্ছি। পরে আমাকে কথায় কথায় কয়েকবার বলেছিলেন, ‘তোমাদের
নতুন দপ্তরে আমার যাওয়া হয়নি।’ আমি বলেছিলাম, ‘চলুন
না একদিন।’ কিছুদিন বাদে উনি আমাকে একদিন বললেন, ‘তোমাদের
দপ্তরের কাছেই যাচ্ছি, এনআরএস আকাদেমি হলে একটা কর্মসূচী আছে।’
আমি ওঁকে সেদিন এনআরএস আকাদেমি হল থেকে নিয়ে এসেছিলাম গণশক্তি দপ্তরে। প্রয়াত
কমরেড দীপেন ঘোষ তখন আমাদের সম্পাদক। উনি আমাদের দপ্তরের সম্পাদকীয় বিভাগ দেখে
বললেন, ‘আমি নিউইয়র্ক টাইমস্-এর দপ্তরেও গেছি, ম্যানহাটনে।
ওখানেও তোমাদের মতই ব্যবস্থা, সবাই সবাইকে
দেখতে পায়। কোনো ঘেরাটোপ নেই।’
ওঁর রবিবারের উত্তর-সম্পাদকীয়
পড়ার জন্য বহু মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকতেন। গণশক্তি-র রবিবারের প্রচারসংখ্যা বৃদ্ধির
পিছনে সেটাও একটা কারণ ছিল বলে মনে হয়। পরে ওঁর রবিবারের সেই লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
পরে অন্য কর্মসূচীতে যখনই দেখা হয়েছে, ডেকে কথা
বলেছেন। আমায় বলতেন, ‘তোমরা সাংবাদিকরা সঙ্গে একটা ক্যামেরা
নিয়ে ঘোরোনা কেন? কোনো ঘটনা ঘটলে তুমি নিজেই তার ছবি তুলে
নিতে পারবে, চিত্রসাংবাদিকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে
না।’
অনেকেই মার্কসবাদ ও
রবীন্দ্রনাথকে দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয় হিসেবে দেখতে বা দেখাতে চান। অশোক মিত্র’র
বিভিন্ন লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির কথা বারেবারে উঠে এসেছে।
তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ‘আপিলা চাপিলা’-য় একেবারে শেষে তিনি লিখেছেন: ‘‘এই অকিঞ্চিৎকর
জীবনে দুটি আলাদা চরিতার্থবোধ: এক রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমার জন্ম; দুই, আমার
চেতনাজুড়ে মার্কসীয় প্রজ্ঞার প্লাবিত বিভাস।’’ যারা এই পরস্পরবিরোধিতাকে উপজীব্য
করে থাকেন, অশোক মিত্র যেন তাদের উদ্দেশ্যেই নিজের
এবিষয়ে উপলব্ধির কথা লিখেছেন: ‘‘...নিজেকে মার্কসবাদী বলে গর্বিত প্রচার করি, মার্কসীয়
বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজের জিজ্ঞাসা-বিবর্তন বিশ্লেষণে নিমগ্ন হই, মার্কসীয়
ধারণার প্রেক্ষিতে অর্থশাস্ত্রের গহনে শ্রেণীদ্বন্দ্বের অন্বেষণ করি। অথচ সেই
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার অভিভূত গরিমাবোধ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জন্মগ্রহণ
করেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি, তাঁর কবিতায়
গানে প্রতিনিয়ত অবগাহিত হয়ে অধরার সন্ধান পাই, আমার
চেতনা জুড়ে, মার্কসের পাশাপাশি সব সময়ই
রবীন্দ্রনাথের আনন্দনিষ্যন্দিত উপস্থিতি।....আমরা হাসি, কাঁদি, গল্পগুজব
করি, কেচ্ছা ছড়াই, গানে গুনগুনিয়ে
উঠি, কলহে প্রবৃত্ত হই, সব-কিছুরই
প্রকাশের পথ বাতলে দেয় রবীন্দ্রনাথ দ্বারা নির্মিত-চর্চিত, রূপমন্ডিত
বাংলা ভাষা। ভাষার দার্ঢ্য এবং সেই সঙ্গে বিস্তার না থাকলে চিন্তা এলিয়ে পড়ে, যুক্তির
সারণি বেপথুমান হয়, ভাবনাকে সংহত রূপ দিতে আমরা অসমর্থ হই।
রবীন্দ্রনাথ-দত্ত ভাষার ভেলায় ভেসেই আমরা প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞানের স্তরের পর স্তর
অতিক্রম করতে সমর্থ হই। হাটে-মাঠে-ঘাটে যখন মার্কসবাদী হিসেবে নিজের বিশ্বাসের কথা
অন্যদের শোনাতে যাই, তখনো তো আমার প্রধান অবলম্বন আমার
মাতৃভাষা, যা রবীন্দ্রনাথের ভাষা, রবীন্দ্রনাথ
যা ভূষণে-রতনে আমাদের জন্য রচনা করে দিয়েছেন, অথচ
ভূষণরত্নের ভারে প্রসাদগুণ বিমূঢ় হয়নি।...’’
কয়েক বছর আগে ‘আমার মৃত্যুর পর’
নিবন্ধেও তিনি লিখে গেছেন: "...যে-বয়সে পৌঁছেছি, মৃত্যুচিন্তা
এড়ানো অসম্ভব, এবং সেজন্যই ইচ্ছাপত্র গোছের কিছু
বাসনার কথা ব্যক্ত করছি। ধরে নিচ্ছি আমার মৃত্যুকালে তখনো কয়েকজন বন্ধু অবশিষ্ট
থাকবেন। উদ্ধত সাহসের সঙ্গে আরো ধরে নিচ্ছি, তাঁরা
হয়তো আমার জন্য একটি ক্ষুদ্রায়তন স্মরণসভার আয়োজন করবেন। সেই সভায়, আমার
বিনীত অনুরোধ, স্মৃতিচারণ ধাঁচের বক্তৃতাদি একেবারে
বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু গান, একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই
কিছু গান যেন গাওয়া হয়।..." (নিবন্ধ সংকলন: ‘‘সমাজ, স্মৃতি, সাহিত্য’’)।
*************
‘একুশ শতক’, জুন
২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত