20200721

মমতাই প্রমাণ করেছেন ‘২১শে জুলাই’ এক ধাপ্পার দিন!


চন্দন দাস


‘২১ শে জুলাই’-র মামলা এখনও চলছে। সরকার মামলা প্রত্যাহার করেনি। ‘২১শে জুলাই’ কমিশন গড়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে। সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ‘২১ শে জুলাই’-র হলফনামা পেশকারী মনীশ গুপ্তকে নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ পর্যন্ত বানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু ‘২১শে জুলাই’-র কমিশনের সুপারিশগুলির কিছুই করতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রথম ‘২১শে জুলাই’-এ কিছু ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। যেমন ‘দু’ বছরে দশ লক্ষ চাকরি দেবো।’ ন’ বছর কেটে গেছে। সেই প্রতিশ্রুতিও পালিত হয়নি। গত ন’ বছরে পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ প্রচুর কমেছে। ২০১১-র ‘২১ শে জুলাই’-এ একটি চমৎকার শপথ বাক্য নেতা, কর্মীদের পাঠ করিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বলেছিলেন, ‘‘..বিশৃঙ্খলা কিন্তু বরদাস্ত করা হবে না। বলুন, চুরি করবেন না। কেউ অন্যায় করলে আটকাবেন।’’ সেই ঘোষণা এখন একটি মস্করায় পরিণত হয়েছে। এখন মমতা ব্যানার্জি ভুল করেও এই কথা মুখে আনেন না। সেই ‘২১ শে জুলাই’ থেকে গত ন’ কতরকমভাবে চুরি করা যায় তা দেশকে হাতে কলমে শিখিয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল। সব চুরিই ‘বরদাস্ত’ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। চুরি করে শাস্তি পেয়েছে এমন তৃণমূলীর অস্তিত্ব নেই রাজ্যে! বরং উল্টোটাই শোনা গেছে গত কয়েক বছর।


২০১৯-র ‘২১ শে জুলাই’-র আগে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসীদের কাটমানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল। ক্ষুব্ধ, ঠকে যাওয়া মানুষ তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের বাড়ি ঘিরছিল কাটমানি ফেরতের দাবি নিয়ে। চারিদিকে হুলস্থুল। রাজ্যের ভাবমূর্তিতে দেশময় কালি ছিটছে তখন। তেমন সময়ে, ২০১৯-র ‘২১শে জুলাই’-র মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বলতে শোনা গেছিল ২০১১-র উলটো কথা। সেদিন তিনিই বলেছিলেন, ‘‘টাকা চেয়ে তৃণমূলের লোকজনের বাড়ি গেলে এবার আমরা স্ট্রং ব্যবস্থা নেবো।’’ অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ, প্রতারিত মানুষের বিরুদ্ধেই পুলিশী, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আরও কী বলেছিলেন গত বছর? কাটমানি নিয়ে ভাষণ দিতে দিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘...বলছে নাকি আমাদের লোকদের টাকা ফেরত দিতে। ওরা বলছে কাটমানি ফেরত দাও। কতগুলো কুঁচো চিংড়ি আর কতগুলো ল্যাটা মাছ, তাদের আবার বড় বড় কথা।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের চোর নেতা, কর্মীদের কাটমানি দিয়ে প্রতারিত মানুষকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন ‘কুঁচো চিংড়ি’ আর ‘ল্যাটা মাছ।’


এবার কাটমানির ইস্যুই আছে। তবে আরও বড় আকারে। গত এক বছরে কাটমানির সঙ্গে জুড়েছে করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের জন্য বরাদ্দ চাল লুট, আমফানে বিধ্বস্ত মানুষের ত্রিপল, চাল চুরি, আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ টাকা দেদার লুট, পান বরোজের ক্ষতির টাকা চুরি — এমন নানা তৃণমূল কংগ্রেসী তস্করবৃত্তি। এই চুরিগুলিকে ইতিমধ্যেই নবান্নে সরকারী চেয়ার থেকে মমতা ব্যানার্জি  ‘তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে রেখেছেন। এবার ‘২১ শে জুলাই’-র দলীয় মঞ্চ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এই জালিয়াতিগুলিকে কী বলেন, তা মঙ্গলবারই স্পষ্ট হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৮-তে দখলের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের ‘২১ শে জুলাই’-এ তৃণমূল কংগ্রেসের বার্তা ছিল,‘‘তৃণমূল দখল করবে দিল্লি, দিদি হবেন প্রধানমন্ত্রী।’’


গত বছর, অর্থাৎ ২০১৯-র ‘২১শে জুলাই’-এ মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘২০২১’র ভোট দেরি আছে। পরের বার বলব।’’ অর্থাৎ মঙ্গলবার তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর আগামী বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বলার কথা। আশা করা যায় বলবেন। গতবছর তিনি দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,‘‘কানে কানে সবাইকে বলে দেবেন, তৃণমূল ভয় পায় না।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা প্রকাশ্যে, চুরির দায়ে কান মুলছেন, হাত জড়ো করে ক্ষমা ভিক্ষা করছেন, বাঁশবাগানে লুকিয়ে রাত কাটাচ্ছেন — এসব রাজ্য দেখেছে গত কয়েক মাসে। মানুষের বিক্ষোভের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে — কানে কানে নয়, সারা রাজ্য জোরে জোরে বলছে এই কথা। এবার মমতা ব্যানার্জি দলের নেতাদের ভোট লুটের যোগ্য করে তুলতে কী ভোকাল টনিক দেন — সেটাই প্রধান আকর্ষণ মঙ্গলবারের ভার্চুয়াল সভার।


কিন্তু ’২১ জুলাই’-র কমিশন, মামলার কী হলো? আর কিছু না পারুন, তার কোনও হিল্লে করবেন মমতা ব্যানার্জি — এটা আশা করাই যায়। তাও পারেননি স্বঘোষিত অগ্নিকন্যা১৯৯৩-র ২১শে জুলাই ধর্মতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, মনীশ গুপ্ত সেই ঘটনা সম্পর্কে হাইকোর্টে হলফনামা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামায় বলা হয়েছিল,‘ওই দিন (১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী (অ্যান্টিসোশ‌্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল।’ তারা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। ‘জনতা’ পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ। পরে রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। মনীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিল। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিসি (সদর), ৭জন ডিসি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিসকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিল। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর একে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। অর্থাৎ সেদিন ‘আন্দোলনকারীরা’ বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিল! তারা মহাকরণ দখল করতে ছুটছিল। গুলি ছুঁড়ছিল, বোমা মারছিল।

সেদিন সাংবাদিকও পিটিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির দলবল। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী ওই সাংবাদিক, সঈদ আহমেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিল। মারাত্মক আহত হন তিনি। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি অভিযোগ পুলিশ দায়ের করে। একটি পার্ক স্ট্রিট থানায়। আর একটি হেস্টিংস থানায়। অভিযোগের মধ্যে ছিল সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, অস্ত্র আইন লঙ্ঘন, খুনের চেষ্টা, পুলিশকে মারধর ইত্যাদি। সেদিন রেডরোডে, ছদ্মবেশে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকানোর চক্রান্ত হয়েছিল, তা জানা গেছে সোনালি গুহর লেখায়। সেই ‘দায়িত্ব’ সোনালি গুহদের নিজের বাড়িতে ডেকে দিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি। তিনি এখন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিনের ঘটনা সংক্রান্ত দুটি মামলা আজও চলছে। সাতাশ বছর। অভিযুক্তদের আইনজীবী অলোক কুমার দাস সোমবার জানিবেছেন, ‘‘মামলাটি এখনও চলছে। তারিখ পে তারিখ চলছে। চিহ্নিত ১৫-১৬ জন এখনও হাজিরা দেন ডেট পড়লে। আমি আদালতের কাছে এবং রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি মামলটা খারিজ করতে।’’ এই আইনজীবী দু’বার তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আইনমন্ত্রীদের কাছে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া কিছুই জোটেনি।


‘২১ শে জুলাই’-র প্রয়োজন ফুরিয়েছে চম্পলা সর্দার, কিষেণজীর মত। ফলে সেদিনের স্বরাষ্ট্র সচিব মনীশ গুপ্তর মন্ত্রী, সাংসদ হওয়া হয়ে গেলেও মামলায় ‘তারিখ পে তারিখ’ থামছে না। মমতা ব্যানার্জির ঘোষণা ছিল ‘২১শে জুলাই’-এ ঘটনায় ‘দায়ী’ সিপিআই(এম) নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ কর্মীদের শাস্তি দেবেন। এখন সে কথা বলেননও না। সিপিআই(এম)-কে কিছু করতে হয়নি। মমতা ব্যানার্জিই প্রমাণ করে তুলেছেন — ‘২১শে জুলাই’ এক বিরাট ধাপ্পার দিন!


 ২০ জুলাই, ২০২০