20180513

গর্বের পঞ্চায়েতঃ গড়েছে বামফ্রন্ট, ধ্বংস করছে তৃণমূল-২


ভূমিসংস্কারের উলটো পথে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গে যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচী দেশে-বিদেশে উচ্চপ্রশংসিত হলেও ক্ষমতায় এসেই উলটো পথে চলতে শুরু করে মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। ২০১১সালের ১৮ই অক্টোবর (মেমো নম্বর-আই আর সি/৬২৪/১১) একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে তৃণমূল সরকার বলে, ‘‘ভূমিহীনদের মধ্যে মূলত কৃষিজমি বন্টনের যে ধারায় আগের ভূমিসংস্কার চলেছে, তা থেকে সরে আসতে হবে এবার।’’ আরো আগ্রাসী ভাষায় রাজ্য সরকারের জমি নীতি সুপারিশকারী কমিটি বলেছে, ‘‘জমির অবৈধ দখলদারিকে কখনো ভূমিসংস্কার বলা যায় না। বরং এটিকে জমি-ডাকাতি বলা যায়। এই জমি-ডাকাতি বন্ধ করতে সরকার যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।’’
এর পরেই রাজ্যের গ্রামে গ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে পূর্বতন জমিদার, জোতদার এবং লুকোনো জমির মালিকরা। শুরু হয়ে যায় বর্গাদার, পাট্টাদার, এমনকি রায়তি জমির মালিক গরিব কৃষকদের উচ্ছেদের ঘৃণ্য অভিযান। তবে গরিব কৃষকের প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে লক্ষ্যনীয়ভাবে।

পঞ্চায়েত ঠুঁটো জগন্নাথপশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের গ্রামবাসীকে যুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক ও বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন কাঠামোর যে ব্যবস্থা সারা দেশকে পথ দেখিয়েছিলো, ক্ষমতায় এসেই তা ভাঙতে শুরু করেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ক্ষমতায় এসেই তিনি কলকাতার টাউন হলে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের বিডিও, ৬৫জন এসডিও-র সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। সভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘এবার থেকে প্রতিটি জেলায় তিনটি করে কমিটি হবে। ব্লক পর্যায়ে কমিটির মাথা হবেন বিডিও-রা। মহকুমা স্তরে মহকুমাশাসক বা এসডিও-রা। জেলা পর্যায়ে কমিটির কর্তা হবেন জেলাশাসকরা। প্রতিটি পর্যায়ের কমিটিতেই সদস্য হবেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অফিসাররা। এই কমিটিগুলিই গ্রামোন্নয়নের কাজের তদারকি ও নজরদারি করবে।’
এর ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। উন্নয়নের কাজে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা রূপায়নের আসল ক্ষমতা চলে গেলো আমলাদের হাতে। জনগণের সঙ্গে যাদের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। ফলে ক্ষমতা হারালেন গ্রামের সাধারণ মানুষও। অথচ এতদিন গ্রাম সংসদের মাধ্যমে তাঁরা উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও রূপায়ণের কাজে রীতিমতো বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতেন।

কৃষক আত্মহত্যার যে ঘটনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত ছিলো না, বাংলায় তা এখন অহরহ ঘটছে। গত ছ’বছরে রাজ্যে দেড়শোর বেশি কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিয়ে সরকার কৃষকদের এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ায়নি। তারা বরং খেলা মেলা উৎসবে এবং ক্লাবগুলোকে টাকা বিলোনোয় বেশি উৎসাহ দেখিয়েছে। কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। ধান, আলু, পাট থেকে পান, সরষে, ডালশস্য— রাজ্যের প্রতিটি ফসলের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। সরকার এখন ফড়েদের থেকে ধান কিনছে, পঞ্চায়েত ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে ধান কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে অথচ ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা বিপদে পড়ছেন। সারের দোকানের ঋণ, প্রতিবেশীর কাছে ঋণ, মহাজনের ঋণ নিয়ে চাপের মুখে আত্মহত্যা করছেন অনেকেই। নাবার্ডের ফোকাস পেপার, ২০১৬-১৭তে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজীবী পরিবারগুলি প্রতি মাসে গড়ে ১৯০৮টাকার ঋণ জালে জড়াচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে কৃষিতে বিপর্যয়, কখনো বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি, কখনো অনাবৃষ্টিতে, কখনো পোকার আক্রমণে। কিন্তু বাংলার কৃষকদের সামনে এখন বীমার ক্ষতিপূরণের সুযোগ নেই। শস্যবিমার বিধি ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে কৃষকদের আরও বেশি করে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার।

ভোটের নামে প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে যে পঞ্চায়েত ভোট কার্যত উৎসবের পরিবেশে হতো, সেই ভোটই এখন রীতিমতো প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মমতা ব্যানার্জির শাসনে পরপর দু’টি পঞ্চায়েত নির্বাচনই বেপরোয়া সন্ত্রাস, বিরোধী প্রার্থী খুন, ভোট-লুট, আদালতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিশৃঙ্খলার জন্য ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।
তৃণমূল আমলে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩-র জুলাইয়ে। রাজ্যে মোট ৪৮,৮০০টি পঞ্চায়েত আসন। নির্বাচনের আগেই, আতঙ্ক সৃষ্টি করে ৫,৩৫৬টি আসন দখল করেছিলো তৃণমূলতারপরেও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতেও জিততে দেদার ছাপ্পা, ভোট লুঠ, বিরোধীদের মেরে বের করে দেওয়া, বেপরোয়া বুথ দখল চালায় শাসকদল। গণনার সময়েও চলে ব্যাপক জালিয়াতি ও বলপ্রয়োগ। তবুও বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিলো ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২% কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে (???) যথাসম্ভব সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে গিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ বাধার মুখে পড়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো। আদালতের লড়াইয়ে জিতলেও, ভোটের দিন কিন্তু শাসকের সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীর তান্ডব আটকাতে ব্যর্থ হন তিনি।

বেআইনী দখলদারি-র নির্লজ্জ অভিযানে নজির গড়লো তৃণমূল। তীব্র সন্ত্রাস আর আক্রমণ চালিয়েও ২০১৩সালে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূল জিততে পারেনি। একইভাবে বহু পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীদের জয় হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কি! নির্বাচনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় নতুন খেলা। দল ভাঙিয়ে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দখলদারি শুরু হয়। যেখানে বামপন্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করেছিলো, অঙ্ক কষে সেখানে খুনও করা হয়েছে। সভাপতি হিসাবে কাজ শুরুর আগেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে উত্তর ২৪পরগণার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গাজিকে। এরপর সেই সমিতি দখলও করে শাসকদলফরাক্কায় খুন হন পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য হাসমত শেখ। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলদিয়া পৌরসভায় সন্ত্রাস চালিয়ে, কাউন্সিলারদের অপহরণ করে ১৫মাসের মধ্যেই দখল করে নেয় তৃণমূল।
তৃণমূলের দখলের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদএই জেলায় ২৬টির মধ্যে একমাত্র সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতিতে জয়ী হয়েছিলো তৃণমূল। এখন তৃণমূলের দখলে ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতি! আর জেলা পরিষদ? মোট ৭০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল মাত্র ১টি আসনে। বাকি সবই ছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের হাতে। এখন নানা কৌশলে মোট ৪৩ জনকে ভাঙিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ চালাচ্ছে তৃণমূল! ভয় দেখিয়ে দল ভাঙিয়ে দখলদারির এই ফরমুলা সারা রাজ্যেই চালু করেছে মমতার দল।

মুখে গামছা-বাঁধা ‘উন্নয়ন’ দেখছে এখন গ্রামাঞ্চল! তৃণমূলের আমলে দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের (২০১৮) সন্ত্রাস অতীতের সব নজির ছাড়ালো। আগেরবার ভোট লুঠ, নির্বাচনের পর সন্ত্রাস চালিয়ে বোর্ড দখলে নজির গড়েছিলো তৃণমূল। এবার একেবারে মনোনয়ন পর্ব থেকেই গ্রামবাংলায় মুখে গামছা-বাঁধা সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। মনোনয়ন পেশের কেন্দ্রগুলি ঘিরে রেখেছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে তৈরি পুলিশ-তৃণমূলের যৌথ বাহিনী। প্রার্থীকে খুন, জখম, অপহরণ, সন্ত্রাস চালিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো— সবই হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অসহায় চোখের সামনে! বিরোধীদের আবেদনের ভিত্তিতে বারেবারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে হাইকোর্টকে। শাসকের সশস্ত্র গুন্ডাদের মার খেয়ে, রক্ত ঝরিয়ে তবু বিরোধী দলের কিছু প্রার্থী মনোনয়ন পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। অনুব্রত মন্ডল নামে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য দুষ্কৃতী-নেতার কথায়, ‘মমতা ব্যানার্জির উন্নয়ন আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সবই হচ্ছে সেই কারণে।’ গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিনের আলোয় গামছায় মুখ ঢাকা এমন ‘উন্নয়ন’ সারা দেশে সত্যিই বেনজির!

দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। সাধারণ মানুষকে হটিয়ে পঞ্চায়েতগুলি দখল করেছে অর্থলোলুপ কিছু তোলাবাজ। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, যে কোন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পেতে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতাশালী নেতাদের এখন ‘কমিশন’, ‘তোলা’ দিতে হয়। পঞ্চায়েতের কাজের আগেই ১০থেকে ১৫শতাংশ টাকা শাসকদলের নেতাদের পকেটে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকাদাররা।                      নীতি-আদর্শহীন তৃণমূল মূলত ধান্দা-নির্ভর একটি দল। তাই পঞ্চায়েতগুলিও এখন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর ক্ষেত্র। একশ’ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ইত্যাদি প্রকল্পে চলছে দেদার চুরি। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, আদিবাসী বা তফসিলী মানুষের হকের টাকা ‘পাইয়ে দেওয়ার’ নাম করে কাটমানি খাচ্ছে তৃণমূল নেতারা। মানুষের ভুরিভুরি অভিযোগ জমা পড়লেও কোন প্রতিকার করছে না তৃণমূল সরকার।

গণশক্তি, ১৩ই মে, ২০১৮ 

গর্বের পঞ্চায়েতঃ গড়েছে বামফ্রন্ট, ধ্বংস করছে তৃণমূল-১


১৯৭৮সালে ঐতিহাসিক নির্বাচন। আইন সংশোধন করে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই বছরেই প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন করে বামফ্রন্ট সরকার। কংগ্রেস আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছিলো। চলতি ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বামফ্রন্টের সৃষ্টি। আগে নামে পঞ্চায়েত থাকলেও গ্রামের উন্নয়নের পরিবর্তে তা ছিলো শোষণের হাতিয়ার। আগে সরকারি কর্মসূচীর সুযোগ সুবিধা গ্রামের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছতো না। এসব কর্মসূচীর সঙ্গে গ্রামের গরিব মানুষ জড়িতও থাকতেন না। ১৯৭৮সালে নবগঠিত পঞ্চায়েতের ৫৬হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্রামবাংলায় নতুন প্রাণের ছন্দ সৃষ্টি করেন। পঞ্চায়েত হয়ে ওঠে গ্রামের গরিবের বন্ধু। গরিব মানুষ পঞ্চায়েতের কাজকর্মে সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করেন। গ্রামের মানুষের যথাসম্ভব উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয় পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা। সারা দেশে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার মডেল হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত। পরে কেন্দ্রীয় আইনও এরাজ্যের অনুকরণেই তৈরি হয়।
নজিরবিহীন গণউদ্যোগ। ১৯৭৮সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই বিধ্বংসী বন্যায় বিপর্যস্ত হয় এরাজ্যের গ্রামাঞ্চল। কোনরকম অতীত অভিজ্ঞতা ছাড়াই সর্বস্তরের মানুষের বেনজির উদ্যোগ গড়ে এই সর্বনাশা বন্যার মোকাবিলা করে পঞ্চায়েত উদ্ধার, ত্রাণ ও পুননির্মাণের কাজে পঞ্চায়েতের সম্মিলিত অভিযান জনমানসে গভীর রেখাপাত করে
১৯৭৮-৭৯সালের ভয়াল বন্যা এবং ১৯৮১-৮২সালের প্রচন্ড খরায় কৃষি উৎপাদনে দারুণ বিঘ্ন ঘটে। ৫৫০কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। বাস্তু ও কৃষিজমির প্রচুর ক্ষতি হয়। বামফ্রন্ট সরকারের পরিচালনায় পঞ্চায়েত শুরু করে পুননির্মাণের অভিযান। ১৯৭৮থেকে প্রথম চার বছরে পঞ্চায়েত ‘কাজের বদলে খাদ্য’ কর্মসূচী অনুযায়ী ১৪লক্ষ শ্রমদিবস সৃষ্টি করে। কৃষি বিভাগের উন্নত জাতের বীজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ও নতুন ফসলের চাষে কৃষকদের সাহায্য করতে মিনিকিট বিতরণ প্রকল্প পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে রূপায়িত হয়। পঞ্চায়েতের সুপারিশে মাছচাষিদের ঋণ দেয় সরকার। পানীয় জল সরবরাহ, নার্সারি, হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি, বাস্তুহারাদের জন্য বসতবাড়ি, স্কুলবাড়ি, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকদের জন্য বাড়ি, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র ইত্যাদি প্রকল্প রূপায়িত হয়
অবাধ ও নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচনসারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য, যেখানে নির্দিষ্ট পাঁচ বছর অন্তর ত্রিস্তর পঞ্চায়েতেই নির্বাচন হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের সময়েভোট হয়েছে টানা সাতবার— ১৯৭৮সালে প্রথম, ১৯৮৩সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৮সালে তৃতীয়, ১৯৯৩সালে চতুর্থ, ১৯৯৮সালে পঞ্চম, ২০০৩সালে ষষ্ঠ এবং ২০০৮সালে সপ্তম বার।
ভোটদানের সময় নির্বাচকমন্ডলীর ব্যাপকতম অংশগ্রহণ ঘটতো, গড়ে ৮৫-৯০শতাংশ ভোটদাতা ভোট দিতেন বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম এরাজ্যে ১৮বছরে ভোটাধিকার চালু করেছিলো পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের নির্বাচনে।
প্রতিবারই এই বিশাল নির্বাচনে ভোটদান, গণনা ও ফল ঘোষণার কাজ সারা রাজ্যে সম্পন্ন হয়েছে সুষ্ঠুভাবে। সবটাই মানুষের চোখের সামনে। এটাই ছিলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্যতম গ্যারান্টি।
মহিলা, তফসিলী ও আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণ ১৯৯৩সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে চালু হয়েছিলো। সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম। পরে সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী করে সারা দেশে এই আসন সংরক্ষণ চালু হয়।
দুর্বলতর মানুষকে উন্নয়নের মূলস্রোতে যুক্ত করতেই সব পঞ্চায়েতে তফসিলী জাতি, আদিবাসী, এবং মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের এই পদক্ষেপসংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত এলাকায় মোট জনসংখ্যার সঙ্গে তফসিলী জাতি ও আদিবাসীদের জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতেই আসন সংরক্ষণের সংখ্যা ঠিক হতে থাকে। এক-তৃতীয়াংশ আসন (তফসিলী জাতি ও আদিবাসী আসন-সহ) মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। পর্যায়ক্রমে তা আবর্তিত হয়। ১৯৯৮সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে প্রত্যেক পঞ্চায়েত স্তরে সভাপতি ও সহসভাপতির পদগুলিও তফসিলী জাতি, আদিবাসী, এবং মহিলাদের জন্য একইভাবে সংরক্ষিত।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে (২০০৮) তিনটি স্তরে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মোট ৫১,৪৯৯জন। এর মধ্যে মহিলারা নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯,৮১২টি আসনে। অর্থাৎ ৩৮.৪৭%আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন মহিলারা, যদিও সংরক্ষণ ছিলো ৩৩%। পাশাপাশি, জেলা পরিষদে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১.৩২%। তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন ৩৩.৫০%। পঞ্চায়েত সমিতিতে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২১.৯৩% এবং তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন ৩৪.৩৪%। গ্রাম পঞ্চায়েতে সংখ্যালঘু সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২৩.২৮% এবং তফসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন ৩৪.৭৮%। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত পৌরসভায় মহিলাদের জন্য ন্যূনতম ৫০শতাংশ আসন সংরক্ষণের আইনও তৈরি করেছিলো। 
গ্রামের মানুষের হাতেই ক্ষমতাযথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচী এবং বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে আসলে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রেরই বিকাশ ঘটিয়েছিলো বামফ্রন্ট। একাজে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ছিলো হাতিয়ার। ভূমিসংস্কার কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছিলো তিনটি পথে। বেনামী ও সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার, ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বন্টন এবং বর্গাদারদের অধিকারের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা।
সারা দেশে ভূমিসংস্কার থেকে উপকৃত পরিবারগুলির শতকরা ৫৩.২ভাগই পশ্চিমবঙ্গের। ৩১শে মার্চ, ২০০৬পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ২৯লক্ষ ৮২হাজার একর বেনামী ও সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার করা হয়েছে। জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে মোট ২৮লক্ষ ৪৯হাজার জনকে। এরাজ্যে যত পরিবারকে খাস জমি বন্টন করা হয়েছে তার ৫৬শতাংশই তফসিলী জাতি ও আদিবাসী পরিবার। ভূমি ও ভূমিসংস্কার দপ্তরের ২০০৮সালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বন্টিত জমির ৩৬.২৪শতাংশ পাট্টা পেয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। নজর করার মতো তথ্য, গোটা দেশে যত জমি এভাবে পুনর্বন্টিত হয়েছে, তার শতকরা ২২ভাগ পশ্চিমবঙ্গের। যদিও গোটা দেশের মোট কৃষিজমির শতকরা মাত্র ৩ভাগ রয়েছে এরাজ্যে।
এই জমি উদ্ধার এবং বন্টনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকানার চরিত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বদল এসেছিলো। গোটা দেশের গড় হিসেবে যখন শতকরা ১৫জনের হাতে ৬০শতাংশ কৃষিজমি অর্থাৎ ধনী কৃষকদেরই একচেটিয়া আধিপত্য, তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের হাতে রয়েছে ৮৪শতাংশ জমির মালিকানা।  গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মহিলাদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে যৌথ পাট্টাও বন্টন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যে যৌথ পাট্টার অধিকারী ৬,০৩,৯৮৭টি পরিবার। অর্থাৎপরিবারের জমিতে মহিলা-পুরুষের সমান অধিকার।  পাশাপাশি, ২০১১সালের সেপ্টেম্বরের হিসেব, রাজ্যের ১লক্ষ ৬২হাজারেরও বেশি মহিলা একাই জমির মালিক। রাজ্যে বন্টিত জমির প্রায় ৩০শতাংশে মহিলাদের অধিকার রয়েছে।
বর্গাদারদের অধিকারও সুনিশ্চিত করেছিলো বামফ্রন্ট। ১৯৭৮সালে অপারেশন বর্গা চালু হয়। ১৫লক্ষেরও বেশি বর্গাদারের মেয়াদী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়গোটা দেশে আর কোথাও একাজ হয়নি। বর্গা নথিভুক্তদের মধ্যে শতকরা ৪১.৯২ভাগ তফসিলী জাতি ও আদিবাসী পরিবার।
ভূমিসম্পর্কের পরিবর্তন এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। ভূমিসংস্কার একদিকে কৃষক-সহ গ্রামীণ গরিবের আর্থিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে।
ফলনে রেকর্ড গড়ে গ্রামবাংলা। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সফল রূপায়ণ এবং যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কারণে উদ্দীপ্ত কৃষকরা এরাজ্যের কৃষি উৎপাদনে নজির গড়েন। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য থেকে বাড়তি রাজ্যে পরিণত হয় পশ্চিমবঙ্গ। গড় শস্যনিবিড়তার সূচকের নিরিখে পাঞ্জাবের ঠিক পরেই দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১০সালে পশ্চিমবঙ্গে শস্যচাষের নিবিড়তা ছিলো ১৯২শতাংশ।
ভূমিসংস্কার এরাজ্যে একদিকে উৎপাদন বাড়িয়েছে, আবার গ্রামীণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিবের হাতে জমি যাওয়ায় তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। তাঁদের সম্মিলিত চাহিদার ফলাফল হিসেবে এরাজ্যে গ্রামাঞ্চলে বিপুল বাজার তৈরি হয়।
পঞ্চায়েতের ক্ষমতা বাড়াতে আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই। গ্রামীণ উন্নয়নের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা হয়। দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী, পরিবেশ, উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ের কাজ পঞ্চায়েতগুলিই করতে থাকে। ক্ষুদ্র সেচ, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা, পানীয় জল সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য ও রোগ নিবারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা পরিপূরকের। গণবন্টন ব্যবস্থা, দুর্বলতর অংশের মানুষের মধ্যে জমি বন্টনের মতো ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের সুপারিশকে সামনে রেখে কাজ করে সরকারি দপ্তরগুলি।
বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের সমস্ত নথিভুক্ত ভোটারকে নিয়ে গ্রামসংসদ গঠন করা হয়। গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচীতে সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গ্রামসংসদ স্তরে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে ব্লক সংসদজেলা সংসদ গঠন করা হয়। জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে স্থায়ী সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে উপসমিতিগুলিকে আরো বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিটি স্তরের সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি ও সাব কমিটিতে বিরোধী দলের নেতা বা নেত্রী পদাধিকার বলে সদস্য হন। পঞ্চায়েতের কাজে আরো গতি আনার জন্য সরকারের দেয় অর্থ সরাসরি পঞ্চায়েতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হতে থাকে। সমস্ত স্তরেই সরকারি নিয়মমতো হিসেবপত্র পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়।
সম্পদ সংগ্রহের অধিকার। বামফ্রন্টের সময়েই এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ করার অধিকার দেওয়া হয় পঞ্চায়েতগুলিকে। পঞ্চায়েতের সংগৃহীত সম্পদ নিজস্ব এলাকার উন্নয়নেই খরচ হয়। যেসব কাজ সরকারি প্রকল্পে করা সম্ভব নয়, অথচ স্থানীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা এই টাকায় করা হতে থাকে। এর ফলে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হয়। গ্রামবাংলার জীবনে নতুন ছন্দ আনে পঞ্চায়েত।
জনস্বাস্থ্য ও শিশুশিক্ষা কর্মসূচী রূপায়ণেও পঞ্চায়েতগুলি গ্রামীণ জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো। রাজ্যের সমস্ত গ্রামীণ পরিবার, ছাত্র-শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্যবিধিসম্পন্ন আধুনিক শৌচাগারের সুবিধা দিতে সব জেলাতেই সার্বিক স্বাস্থ্যবিধান প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পের সাফল্যের কারণে বহু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নির্মল গ্রাম পুরস্কার’ পায়। শিশুশিক্ষা কর্মসূচী পঞ্চায়েতগুলিতে চালু হয় ১৯৯৭-৯৮সাল থেকেবিভিন্ন গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ৯থেকে ১৩বছরের বালক-বালিকা, যারা নানা কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা কারণে যেতে পারে না, তাদের জন্য খোলা হয় শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। খোলা হয় মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র।
খেতমজুরদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যনিধি প্রকল্প চালু হয়েছিলো ১৯৯৮সালে। পশ্চিমবঙ্গের ১৮থেকে ৫০বছর বয়সী খেতমজুররা মাসে ১০টাকা করে জমা দিয়ে এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করাতে পারতেন। প্রত্যেক নথিভুক্ত কৃষিশ্রমিকের জমা টাকার সমপরিমাণ টাকা রাজ্য সরকার দিতো। মোট জমার ওপর সুদ সংশ্লিষ্ট খেতমজুরের পাশবইতে নথিভুক্ত থাকতো। এই প্রকল্পের কাজও দেখাশোনা করতো পঞ্চায়েত১৯৮০-৮১সালে সারা ভারতে সর্বপ্রথম এরাজ্যে কৃষকদের বার্ধক্যভাতা চালু হয়। পেনশনভোগীর মৃত্যুর পরে তাঁর বিধবা পত্নীও পেনশন পেতে থাকেন।
দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণে জোর দিয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৯৩সালে অনুষ্ঠিত রাজ্যের চতুর্থ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সদস্য, পদাধিকারী ও কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়কল্যানীতে অবস্থিত রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন সংস্থায় এঁদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পরে প্রতিটি জেলায় তৈরি করা হয় প্রশিক্ষক দল।
আত্মমর্যাদা ও অধিকার চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত।  শুধু গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয়, গ্রামের মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও অধিকার চেতনার বিকাশ ঘটানোর কাজেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে পঞ্চায়েতআগে জনগণ সরকারের কাছে করুণাপ্রার্থী হিসেবে করুণাভিক্ষা করতেন। তাঁরা ক্রমশ বুঝেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস তাঁরাই। আত্মমর্যাদায় বলীয়ান গ্রামবাসীরা ক্রমশ বুঝেছেন, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার।
প্রশংসা সকলের মুখে। ১৯৯৩সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত সম্পর্কে জনগণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা করেছিলো দিল্লির ইনস্টিটিউট অব সোসাল সায়েন্স। ১৯৯৬সালে প্রকাশিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত ইলেকশনস-১৯৯৩-এ স্টাডি ইন পার্টিসিপেশন’ শিরোনামের রিপোর্টে তারা জানিয়েছিলো, ‘‘...বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বেশির ভাগ মানুষই বলেন, পঞ্চায়েত ভূমিহীনদের জমি দিয়েছে, গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে, বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষিত করেছে, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি করেছে, রাস্তাঘাট নলকূপ ইত্যাদি গ্রামীণ পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে, সর্বোপরি জনগণকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে।’’
২০০৭সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের ৬১তম রাউন্ডের রিপোর্ট জানিয়েছে, ১৯৭৩-৭৪সালে সারা দেশে গ্রামবাসীদের ৫৬.৪শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। পশ্চিমবঙ্গে তখন এই হার ছিলো ৭৩.২শতাংশ।
কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টই জানিয়েছে, ১৯৭৩সাল থেকে ২০০৫-এর মার্চের মধ্যে সারা দেশে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমার বিচারে প্রথম দু’টি রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াইয়েরই ফল এই সাফল্য।

গণশক্তি, ১৩ই মে, ২০১৮