20211205

রাত জাগা প্রত্যয়ের কাছে সেদিন হেরেছিল উন্মাদনা

 

সুদীপ্ত বসু

 

রাত জাগা সুরু সেই রবিবার থেকেই।

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ থেকে খিদিরপুর, এন্টালি, ট্যাংরা, তিলজলা, পার্কসার্কাস, বেনিয়াপুকুর, বেলগাছিয়া। কোথাও ত্রিপল খাটিয়ে কোথাও বা পার্টি অফিসেই ক্যাম্প করে রাতের শহরের গলি, বড় রাস্তা, মহল্লার দখল নিয়েছিল লাল ঝান্ডার কর্মী,সংগঠকরা।

সেদিন শুক্রবার (৪ঠা ডিসেম্বর)। করসেবকরা তখন অযোধ্যামুখী।

অন্যদিকে শহীদ মিনারে তখন বামফ্রন্টের জনসভা। জ্যোতি বসুর বার্তা, ‘আমরা কোন মধ্যযুগে আছি তা আত্মসমীক্ষা করা দরকার। রামের নামে মানুষ খুন চলতে পারে না। সাধু সন্তরা ধ্যান করুন, উপাসনা করুন, অসুবিধা নেই, কিন্তু দেশ চালাবেন এটা হতে পারে নাস্পষ্ট বার্তা। সেই জনসভা থেকে বামফ্রন্ট কর্মী ও রাজ্যের মানুষের কাছে আবেদন কোনভাবেই এবাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্য দুষ্কৃতীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তা যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে।

সেদিনই শহরের অন্যপ্রান্তে তখন চলছে কংগ্রেসের সভা। মমতা ব্যানার্জি তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। রাম মন্দির, বাবরি মসজিদ নিয়ে কোন শব্দ নেই সেই সভায়। বরং সি পি এম ক্যাডার নামিয়ে এসব উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, ওসব কিছু হবেনা এসব বলে ৬ই ডিসেম্বরের আগে সেই সভা থেকে সি পি আই(এম)র বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আন্দোলন গড়ার ডাক দেন মমতা ব্যানার্জি।

 

মন্বন্তর থেকে খাদ্য আন্দোলন, জমির আন্দোলনে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া শহর, এমনকি ১৯৮৪ সালে শিখ বিরোধী দাঙ্গাও  রুখে দেওয়া কলকাতা তখন এক অজানা শঙ্কা ঠেকানোর প্রস্তুতিতে।

    ৬ই ডিসেম্বর,দুপুর ১:৫৫মিনিট, সৌধের গম্বুজ ভেঙে ফেললো কয়েক হাজার করসেবক। তার মাত্র দুমাস পরে কলকাতায় এসে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং বলেছিলেন, ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া এটা সম্ভব ছিলো না।যদি আমরা ঠিকাদার নিয়োগ করতাম এই সৌধ ভাঙার জন্য তাহলেও কমপক্ষে দেড় মাস সময় লাগতো ভাঙতেবর্বরতার উচ্ছ্বাস!

      দুপুর থেকেই সেই ধ্বংসলীলার ছবি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশ জুড়ে। উত্তেজনা, আশঙ্কা বাড়তে থাকে প্রতি সেকেন্ডে। কালক্ষেপ করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। সন্ধ্যা থেকেই রাস্তায় নামেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। একের পর এক খবর আসতে শুরু করে। তাতে গুজবও ছিল। এন্টালিতে বোমা পড়েছে, গার্ডেনরিচে হামলা শুরু হয়েছে, খিদিরপুরে, ট্যাংরায় প্রকাশ্যে বাড়তে শুরু করেছে দুষ্কৃতীদের জমায়েত।

২৫ বছর আগের এক সকালে সতর্কবার্তা গিয়েছিল এই শহর থেকেই। না শোনার মাশুল আজও গুনছে বৃহত্ত গণতন্ত্র।

 


দিনরাতের প্রহরী, কঠোর সরকার...

 

   পরেরদিনই বন্‌ধ ডাকে রাজ্য বামফ্রন্ট।  ৮ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয়ভাবে দেশজুড়ে বন্‌ধ ডাকে বামপন্থী দলগুলি। তাতেও সমর্থন জানায় রাজ্য বামফ্রন্ট। টানা ৪৮ ঘণ্টা বন্‌ধ আসলে দুষ্কৃতী, দাঙ্গাবাজদের স্বাভাবিক গতিবিধি ঠেকাতেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তখন পুলিশের পাশাপা‍‌শি আধা সামরিকবাহিনী মোতায়েন করা হয় কলকাতার ৩৫টি থানা এলাকায়। হাওড়া, বর্ধমানেও বেশ কিছু জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়।

৬ই ডিসেম্বর রাতেই জ্যোতি বসুর আবেদন, ‘হাঙ্গামা বাধানোর চেষ্টা হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি। তবে শুধু প্রশাসন নয়, মানুষকেই ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সারা রাত ছিলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে।

এই ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলার মাটি।

ওদিকে তখন বন্দর এলাকার বটতলা, মুদিয়ালি, ফতেপুর, কাচ্চি সড়ক, ধানখেতি, কাশ্যপ পাড়ায় উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। ৬ই ডিসেম্বর রাতে হরিমোহন ঘোষ কলেজের সামনে পার্টি অফিসেই হল ক্যাম্প। সারা রাত জেগে সি পি আই (এ‌ম) কর্মীরা। তখন একটাই থানা মেটিয়াবুরুজ।

সেদিনের সেই টানা ছয়দিনের অভিজ্ঞতা এখনও উজ্জ্বল লড়তে থাকা প্রতিটি চেতনায়। নাহ! এর জন্য ব্রাহ্মণ সম্মেলন, ইমাম ভাতা বা পুজো কমিটিকে ভিক্ষার দান দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি

ততক্ষণে বেশ কিছু জায়গায় লুটপাট শুরু হয়ে গেছে, বাড়িঘর ভাঙচুরও হয়েছে। বন্দর এলাকায় বটতলা, মুদিয়ালি, ফতেপুর, কাচ্চি সড়ক, ধানখেতি, কাশ্যপ পাড়ায় উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। মুসলিম মহল্লা, হিন্দু এলাকায় পালা দিয়ে ছুটছেন সি পি আই (এম) কর্মীরা। দাঙ্গা বাধানো সহজ, কিন্তু উন্মত্ত জনতাকে শান্ত রেখে অশান্তি এড়ানো কঠিনতম কাজ। সেই কাজেই তখন হাত লাগিয়েছেন সি পি আই (এম) সহ বামপন্থীরা। জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।যদিও সেনাবাহিনী সামান্য দেরিতে আসা নিয়ে তখন ক্ষোভও তৈরি হয়।

৭ই ডিসেম্বর থেকে মিছিলও শুরু হয় বিভিন্ন এলাকায়, গলির ভিতরে। দুপুরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাকরণে জানান, হাওড়া, আসানসোল, বারাকপুর থেকে গন্ডগোলের খবর আসছে। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আরও সেনা মোতায়েন করছি, কেন্দ্রের সঙ্গে কথা হয়েছে। ততক্ষণে রাজাবাজার, গার্ডেনরিচ, বেনিয়াপুকুর, কড়েয়া, জোড়াসাঁকো থানা এলাকায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। কাশীপুর, চিৎপুর, একবালপুর, ওয়াটগঞ্জ, আমহার্স্ট স্ট্রিট, হেস্টিংস থানা এলাকাতেও চলছে টহল।

এসব নিছকই তথ্য নয়। একটা আস্ত ইতিহাস।

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে একটা রাজ্য সরকারের ইস্পাতদৃঢ়তার সেই ইতিহাস।

৭ই ডিসেম্বরের সফল, সর্বাত্মক বন্‌ধের পরে ১০ই ডিসেম্বর ছিল মহামিছিল। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। দাঙ্গার কবলে পড়া এন্টালি, তপসিয়ার পায়ে হেঁটে ঘুরছেন বিমান বসু।

আরও একটি তাৎপর্যের ঘটনা হল, সেই সময় লাগাতার কয়েকদিন কার্ফু থাকায়, বেশ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় গরিব বস্তিবাসী এলাকায় ঘরে মজুত খাবারে টান পড়ে। সি পি আই (এম) কর্মীরা একদিকে এলাকা পাহারা অন্যদিকে ক্যাম্প করে খিচুড়ি রান্না করে গরিব বস্তিবাসী, আক্রান্তদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন। ঘরে আটকে থাকা শিশু, বৃদ্ধদের জন্য ওষুধের ব্যবস্থাও করেছিলেন তাঁরা।

সম্প্রীতি রক্ষার সেই লড়াই তখন এক অন্য উচ্চতার স্তরে যা মানুষের হৃদয়ে আজও যত্ন করেই রাখা।

 


 

তবু জেগে আছে বুক বেঁধে...

 

উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া। অনায়াসে দাঙ্গার আগুনে ছারখার হতে পারতোসে সময় বেলগাছিয়া মুসলিম বস্তি, কুন্ডু লেন, রেলওয়ে কলোনী মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের বাস ছিল। তার মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু দাঙ্গার আগুন স্পর্শ করতে পারেনি এই জনপদ। মন্দির, মসজিদের দেওয়ালে একটা আঁচড় পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। পার্টি, গনসংগঠন, শান্তি কমিটি, বস্তি ফেডারেশন তখন অক্লান্ত উদ্যমে ময়দানে, প্রায় এক সপ্তাহ ঘুম নেই যেন কারও। উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা ছিল বেলগাছিয়া আমন কমিটির। কারফিউ জারি হওয়ার ফলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে সি পি আই (এম) কর্মীরা তখন চাল, ডাল, মুড়ি কিনে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন।

এমনকি এই সু‍‌যোগে যাতে জিনিসপত্রের দাম যাতে বাড়তে না পারে তার জন্যও নেমেছিলেন সি পি আই (এম) কর্মীরা। জিনিস মজুত করে দাম বাড়ানোর ফাটকাকারবারীদের কৌশল ব্যর্থ করেছিল সেই লাল ঝান্ডাই। শুধু তাই নয় প্রবীনদের স্মৃতির পাতায় এখনও যেন রোদের উঁকিঝুঁকি। শুধু পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি নয় বেলগাছিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজ যাতে নির্বিঘ্নে কোয়ার্টারে ঝিলে স্নান করতে পারেন সে দিকেও নজর রাখতে হয়েছে।

দাঙ্গার আগুন এখানে নিভেছিল ঐতিহ্যের পরশে।

ট্যাংরার মতো উত্তেজনা প্রবণ এলাকায় এক অনন্য দৃশ্য হিন্দুস্থান গ্যাস মোড়, প্রভুরাম, সরকার লেন, পেমেন্টাল গার্ডেন লেনে রাস্তার মোড়ে দুধারে দাঁড়িয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন।পতাকা ছাড়াই। কোন পক্ষ থেকে যেন কেউ উত্তেজনা ছড়াতে না পারে। মুসমিল সম্প্রদায়ের মানুষ রক্ষা করেছেন হিন্দু গৃহবধূকে, মুসলিম শিশুর দুধ যোগাড় করেছে হিন্দু পরিবার, মন্দির মসজিদে উড়েছে শান্তি শ্বেতপতাকা।

এই দৃশ্যেরও সাক্ষী ছিল কলকাতা!!

১৫ই ডিসেম্বর কলকাতা ও হাওড়ার সিংহভাগ এলাকা থেকে উঠলো কারফিউ। মাত্র এক সপ্তাহে প্রায় তিন হাজারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী জ্যো‍‌তি বসুর কঠোরতম বার্তা, ‘‘পুলিশকে বলেছি হাঙ্গামাকারীরা কোন দল দেখার দরকার নেই। দলমতনির্বিশেষে সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এব্যাপারে আমরা সবাই সাহায্য করবো। কংগ্রেসকেও বলছি আপনারাও সাহায্য করুন। কারণ যারা হাঙ্গামা করছে তাদের রাজ‍‌নৈতিক পরিচ‌য়ের কোনো দরকার নেই, ওরা অপরাধী।’’

এই দৃঢ়তা দেখানোর জন্য কলজে দরকার। কোনো দুর্নীতিতে ফেঁসে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখাভিনয় করতে হয়নি বামপন্থীদের।

গণশক্তির পাতায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপ্লব দাশ্গুপ্তের উত্তর সম্পাদকীয়, ‘১৯৮৪ সালের শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রতিরোধের ক্লাইম্যাক্স হল সেই সত্তর হাজার মানুষের দীর্ঘ মহামিছিল যার পর সাম্প্রদায়িক শক্তি আর ফনা তুলতে পারেনি। আগামী ১৫ই ডিসেম্বরের মহামিছিল হোক আরও বড় আসুক হিন্দু, মুসলিম, শিখ সব অন্য সব মানুষ। মিছিলের জনতরঙ্গে, অসংখ্য মানুষের নিঃশব্দ ঘৃণার বীজ অগ্নি নিঃশ্বাসে পুড়ে যাক ওই অভিশপ্ত, ভয়ঙ্কর দাঙ্গার স্বপ্ন।

১৫ই ডিসেম্বর গোটা দেশ দেখেছিল এক ঐতিহাসিক মহামিছিল।

তৎকালীন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান শৈলেন দাশগুপ্তের আহ্বান, ‘অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি আমরা, আমাদের উত্তীর্ণ হতেই হবে।

ইতিহাস সাক্ষী সেই পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।

সময়ের ব্যবধানে আবার আমরা, আমাদের রাজ্য দেশ পরীক্ষার মুখে। উত্তীর্ণ হতেই হবে।

 


সেদিন কেন ব্যবস্থা নিলেন না সৌধ রক্ষার...

লিবেরহান কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন ‘...বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দুদিন আগে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলাম, চারদিক দিয়ে উদ্বেগজনক সব খবর আসছে। করসেবকরা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়ে। তবে উনি আমায় বলেন, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক আছে, সেখানে পরিস্থিতি আলোচনা করে তবে কেন্দ্রের তরফে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলো। মসজিদের কাঠামো মাটিতে মিশে গেলো, মানুষ দেখল তা। জানা গেছে বেশ কয়েকজন বি জে পি শীর্ষনেতা ঘটনাস্থলে ছিলেন। এখন তাঁদের কয়েকজন বি জে পি সরকারের মন্ত্রিসভাতেও রয়েছেন। এরপরে যখন হরকিষেন সিং সুরজিৎ আর আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম তখন জিজ্ঞাসা করি, কেন মসজিদ রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নিলেন না। উনি শুধু বললেন, আমি কী করে একজন মুখ্যমন্ত্রীকে (উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং) অবিশ্বাস করবো। উনি আমায় কথা দিয়েছেন সেরকম কিছু হবে না।

হয়েছিল ঠিক উল্টো।

 

দ্য মোস্ট সিভিলাইজড মেট্রোপলিস...

জীবনের জন্য আকুতি কী তীব্র হতে পারে, কী হৃদয়স্পর্শী হতে পারে তাঁর এক ছবিতেই তা দেখেছিল গোটা দেশ।বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের দুই সন্তান, স্ত্রীর প্রানভিক্ষার আর্তি,চোখে মুখে আতঙ্ক- ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছিল সেই একটি ছবি-ই। কুতুবুদ্দিন আনসারি। আশ্রয় পেয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গেই, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে এসেছিলেন এই শহরেই।২০১২ সালে গুজরাট নির্বাচনে প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। হাত ধরে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘আপনারা আক্রান্তকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ যেন এমনই থাকে, তা যেন গুজরাট না হয়

১৯৯৯ সাল।মুম্বাইতে বি জে পি-আর এস এস বাহিনীর মুখে আক্রান্ত বলিউডের কিংবদন্তী দিলীপ কুমার। এদেশের বুকে কমিউনিস্ট বিরোধী বলেই পরিচিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা পর্যন্ত ১৩ই জুলাই সম্পাদকীয় লিখল: ‘Dilip says he may be forced to abandon Mumbai and live else-where. If he wants to live in the most civilised metropolis in the country he come to Calcutta..’ অর্থাৎ স্টেটসম্যানের মত কাগজও লিখতে বাধ্য হয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির আস্ফালন থেকে যদি রক্ষা পেতে হয় তবে পশ্চিমবঙ্গই আদর্শ আশ্রয়স্থল। তখন রাজ্য বামফ্রন্ট সরকার।

এই ঐতিহ্য-ই আমাদের গর্ব।আমাদের শ্লাঘা বোধ। তা রক্ষা করাই সময়ের ডাক।

 

আজকের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা...

সেই ঐতিহ্যের মাটিতেই গো-রক্ষার নামে ধূপগুড়িতে ১৯ বছর বয়সী দুই কিশোরকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাটের মত এরাজ্যেও গো-রক্ষার ব্যানারে মানুষ খুন। ধূপগুড়ির ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সহ মোট ছয় জন। এই ঘটনায় মোট ৬জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এস এসর চারজন, তৃণমূলের ২জন। ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার এক মডেল হয়ে উঠছে বাংলা।

ইতিহাসের পাতায় লেপ্টে থাকা সাম্প্রদায়িক অশান্তি ঠেকানোর বামপন্থীদের এই ভূমিকার পাশেই আজকের বসিরহাট থেকে ধূলাগড় হয়ে ক্যানিং। রাজ্যে তৃণমূল সরকার। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কৌশলী রাজনীতি নিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতাকে রোখা যায় না তা স্পষ্ট হচ্ছে বারেবারে।

খাস কলকাতা বন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনজনকেই। তিনজনেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী,  একজন আবার  হরিমোহন ঘোষ কলেজের তৃণমূলী ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। তিনজনে বিরুদ্ধেই ছিল মারাত্মক অভিযোগ- পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আই এস আই-র এজেন্ট হিসাবে কাজ করার।

আবার, গত দুবছরে শারদোৎসবের পরে বিসর্জন ও মহরমের ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকানিতে রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় রীতিমত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, কোথাও কোথাও তা সংঘর্ষের চেহারা নেয়। যেমন নৈহাটির হাজিনগর। ২০১৫ সালে এই ঘটনাতেও পুলিশ বাধ্য হয় এক কাউন্সিলর তৃণমূলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করতে। যদিও রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোনে দুর্বল মামলা রুজু করে তাদেরও ছেড়েও দেওয়া হয়।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল যখন বি জে পি-কে রাজনৈতিকভাবে অচ্ছুৎবলেছিলো, তখন কংগ্রেসের ভিতরে থেকেও মমতা ব্যানার্জি বি জে পি-কে অচ্ছুৎ বলতে চাননি। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরির পরেই হাত মিলিয়েছিলেন বি জে পি-র সঙ্গে।২০০৩ সা‌লে ১৫ই সেপ্টেম্বর নয়া‌দি‌ল্লি‌তে আর এস এস-এর মুখপত্র পাঞ্চজন্য’-কমিউনিস্ট টেররিজমনামে সংকলন প্রকাশ অনুষ্ঠা‌নে মমতা ব্যানার্জিট সগর্ব ঘোষনা , ‘‘ক‌মিউনিস্ট‌দের বিরু‌দ্ধে আপনা‌দের লড়াই‌য়ে আমরা আ‌ছি। য‌দি আপনারা আমায় ১শতাংশ সাহায্য ক‌রেন, আমরা ক‌মিউনি স্ট‌দের সরা‌তে পার‌বো..আপনারাই হলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।‌বি‌ জে পি-র তৎকা‌লীন রাজ্যসভা সাংসদ বলবীর পুঞ্জ প্রত্যুত্তরে ব‌লেছিলেন,‘‘আমা‌দের প্রিয় মমতাদি‌দি সাক্ষাৎ দুর্গা

২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে এসেছে। এর মাঝে শাসকদল হিসাবেই  ৬ই ডিসেম্বর গান্ধীমূর্তির সামনে সভা করেন মমতা ব্যানার্জি। ৬ই ডিসেম্বরের সভা অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংস, আর এস এস এবং বি জে পি-র ভূমিকা অনুচ্চারিত রেখে দেওয়া- সম্ভবত এদেশের বুকে মমতা ব্যানার্জিই তা করে দেখাতে পেরেছেন। বাজপেয়ী অসাম্প্রদায়িক লোক/আদবানী কট্টর লোকআদবানী ভালো লোক/মোদী খারাপ লোকমোদী ভালো লোক/অমিত শাখারাপ লোকখবরের কাগজের পাতায় মমতা ব্যানার্জির বি জে পিবিরোধী অবস্থানের চেহারা এটাই।

শাসকদলের সন্ত্রাস, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত বিরোধী দল মূলত সি পি আই (এম)। সি পি আই(এম)-কে এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে, একইসঙ্গে এরাজ্যে আর এস এস-র এলাকা বাড়ছে। সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা গত পাঁচ বছরে এরাজ্যে বেড়েছে ১৫৭শতাংশ! নাগপুর থেকেও এসেছে অভিনন্দন বার্তা, পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই সম্ভাবনাময়হয়ে উঠছে! বীরভূম থেকে পূর্ব মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার থেকে নদীয়া, হুগলী- সি পি আই (এম) বিরোধী সন্ত্রাসের জমি-ই মোহন ভগবতদের আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিচ্ছে।

তৃণমূলেরই প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর লেখা অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স-এ মমতা ব্যানার্জি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুখোশ বেআব্রু হয়েছে। গুজরাট দাঙ্গা আমার সামনে এক ব্যক্তিগত সঙ্কট তৈরি করে দেয়...কিন্তু আমার দলে আমি ছিলাম একা। এই প্রশ্নে মমতার দুমুখো আচরণে আমি হতাশ ছিলাম..ওকে সবাই ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলিম দরদী বলেই জানত। কিন্তু গুজরাট সঙ্কটের তাৎপর্য ও কেন বুঝতে পারছিল না বা বুঝতে চাইছিলো না, তা আমার কাছে ছিল রহস্য

সেই রহস্য আজ বেআব্রু হয়েছে।

                          ****************************

 

বারেবারে জ্যোতি বসু বলেছেন, তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ এরাজ্যে বি জে পিকে নিয়ে আসা

নাগপুরে আর এস এসর প্রধান দপ্তর কেশবভবন থেকে যেমন দেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া যাবেনা তেমনি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে এরাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইকেও চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে না।

 

 

 

 

20211011

তথ্য সমাজের নিঃসঙ্গতা

 প্রসূন ভট্টাচার্য

সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল দেখে বুঝতে পারছেন যে কাল মানে সোমবার ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে? আচ্ছা, এটা না হয় বামপন্থীদের বিষয় বলে অচ্ছ্যুৎ। কিন্তু শুক্রবার যে জলবায়ু ধর্মঘট ছিল সেই খবরটা ঠিকঠাক পেয়েছিলেন? অতিবৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ১৫ লক্ষ মানুষ আর বিস্তৃত জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, উত্তরবঙ্গের শিশুরা সংক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে, কিংবা কেবল করোনার দ্বিতীয় ঢেউতেই ভারতের আরও ১কোটি লোক কর্মহীন হয়ে গেছে, স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে, দেশের ৯৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে, আর ১১টি কর্পোরেট কোম্পানির আয় যা বেড়েছে তা দিয়ে গোটা দেশের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। এসব খবরের প্রায় কোনোটাই আমরা মিডিয়াতে পাইনি। অথচ খবর এখন আমাদের কাছে অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। আমরা এখন নাকি ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’ বা তথ্য সমাজে বসবাস করছি।

একটা সময় ছিল যখন খবর সংগ্রহ করে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা ছিল রীতিমতো কঠিন কাজ। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়' উপন্যাসে চারুলতার স্বামী ভূপতিকে মনে আছে? অনেক কষ্ট করে একটি খবরের কাগজ ছাপতে হতো তাঁকে। সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের ঠিকঠাক খবর তো বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎদের কাছেও পৌঁছয়নি। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলার মানুষ চার্চিলের নীতিতে যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন হঠাৎ স্টেটসম্যান পত্রিকা ব্রিটিস সরকারের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে সেই খবর ছেপে দিয়েছিল। লন্ডনে যখন সেই খবর পৌঁছলো তখন সমালোচনার মুখে পড়ে ব্রিটিস সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল, নইলে পোকামাকড়ের মতো মানুষের মৃত্যু সংবাদও চাপা পড়ে ছিল। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব কিংবা ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের খবরও এদেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছিল ধীরে ধীরে, বিক্ষিপ্তভাবে, ধোঁয়াশা মেখে। কিন্তু সেসব দিন তো ইতিহাস। রেডিও, স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং সর্বশেষে ইন্টারনেট মাধ্যম এসে যাওয়ার পরে দুনিয়া তো হাতের মুঠোর মধ্যে। এখন আফগানিস্তানে তালিবানরা কাকে কীভাবে মারছে সারা দুনিয়ার মানুষ ঘরে বসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে যাচ্ছি। নেটওয়ার্কড দুনিয়ায় আমেরিকায় বসা আত্মীয়ের সঙ্গে আমরা অনলাইনে ভিডিও চ্যাট করে নিতে পারছি। টিভিতে ২৪ ঘন্টা যুদ্ধ কিংবা খেলার লাইভ কভারেজ দেখতে পাচ্ছি, ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়াকে রোমাঞ্চকর সিনেমার মতো দেখছি, বাড়িতে বসে জোমাটোয় অর্ডার দিয়ে আধ ঘন্টায় খাবার আনিয়ে নিচ্ছি, প্রয়োজনে মোবাইল ফোনে অ্যাপক্যাব ডেকে নিচ্ছি, ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে অনলাইনে ক্লাস করে নিচ্ছে, বাবা মা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে নিতে পারছে, আরও কত কি!

এই প্রবনতাটা বুঝে নিয়েই ১৯৭৩সালে সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল বলেছিলেন, আমরা এখন তথ্য সমাজে প্রবেশ করেছি। কৃষিভিত্তিক সমাজ, শিল্পসমাজ পেরিয়ে এই সমাজে এখন তথ্যের অবাধ বিচরণই অর্থনৈতিক কারবারের মুখ্যভিত্তি। তথ্যই শক্তি। তথ্যই আনবে মুক্তি। সেই তথ্যের সুষম বন্টনের সুযোগ খুলে গেছে। ইন্টারনেট আসার পরে সবাই বলতে লাগলেন, এটাই সত্যি। অন্যদিকে সাত ও আটের দশকেই রাষ্ট্রসংঘের ইউনেস্কোর মঞ্চ থেকে আরেকদল সতর্ক করছিলেন, দুনিয়ায় তথ্যের প্রবাহে ভারসাম্যের গুরুতর অভাব ও বৈষম্য রয়েছে এবং সেই কারণে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ভারতসহ এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এই অভিযোগই করছিল উন্নত ধনী দেশগুলির বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের কথা চাপা পড়ে গেলো বিশ্বায়নের ধাক্কায়।

এখন আর তথ্যের আকাল নেই, তথ্যের সমুদ্রে আমরা ভাসমান। তথ্য আদান প্রদান এতই নাকি সহজ ও সস্তা যে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমুদ্রে ভাসমান নৌকার সেই মাঝির মতো যার কাছে এক ফোঁটা পানীয় জলও নেই। চারিদিকের অফুরান নোনা জলরাশি তাঁর তৃষ্ণা মেটানোর উপযোগী নয়। আমরাও তেমনি বিপুল তথ্যরাজির মধ্যে বসে আছি, চাই না চাই প্রতি মুহূর্তে আমাদের কাছে তথ্য এসে ভীড় করছে, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন মেটাতে সেটা সাহায্য করছে না। বরং অপ্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সদাব্যস্ত থাকতে থাকতে জীবনের প্রয়োজনটাকেই মাঝেমাঝে ভুলে যাচ্ছি, অবহেলা করে ফেলছি। যখন আমাদের রোজগার বাড়ানোর উপায় দরকার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুবন্দোবস্ত করা দরকার, অসুস্থ বাবা মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার, তখন আমরা ফিল্ম স্টার সাংসদ নুসরৎ জাহানের সন্তানের পিতার নাম জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। পুজোয় কোন তারকা কোন পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন করবে তা নিয়ে ফের চর্চা শুরু হয়ে গেছে। একটা অতিবর্ষণে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের জলমগ্ন জেলাগুলিতে ১৩জন শুধু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলো। কেন পরিকাঠামোর এই হাল, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কী করা জরুরী, তা নিয়ে ভাবার মতো তথ্য পাচ্ছি কোথায়? মোদীর জন্মদিনের তথ্য পাচ্ছি, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলানোয় কিংবা স্কুল কলেজ খোলার প্রচেষ্টায় উপেক্ষা সংক্রান্ত তথ্য কোথায়? দুয়ারে সরকারের বিজ্ঞাপন তো প্রচুর দেখলাম, কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড নিয়ে বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা মিলছে কিনা সেই তথ্য কোথায়?

তথ্য প্রয়োজন মেটাবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে তথ্যের পূর্ণাঙ্গতার ওপরে, ঝিলিক মেরে উবে যাওয়া তথ্যে কাজের কাজ হয় না। ব্রেকিং নিউজ একটা আসে, চাপা পড়ে যায় আরেকটা ব্রেকিং নিউজের তলায়। তথ্য বিশ্লেষণ করে তার মূল্যায়ন করার বন্দোবস্ত না থাকলে এমন তথ্য দিয়ে লাভ নেই। যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমরা রয়েছি এবং যারা সেই ব্যবস্থা চালাচ্ছেন, সেসবের মূল্যায়নই যদি না করতে পারলাম তাহলে আমি সিদ্ধান্ত নেবো কীভাবে! কেবল জয়ধ্বনি দেওয়ানোর জন্য আমাকে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না তো? অবাধ তথ্যের স্রোত যে মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিল, সেটাই আসলে বাঁধনের মতো চেপে বসছে না তো? তাহলে তো প্রতিবাদ হওয়ার কথা। তেমন প্রতিবাদ হচ্ছে কই! তথ্যের এমন শক্তিশালী নেটওয়ার্কে আমরা আছি যে চরম নিঃসঙ্গতায় ডুবে প্রতিদিন হতাশাগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার খবর পাচ্ছি, মানুষের হাতে হাত রাখার মতো মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না। কাছাকাছি আসার ছলে দূরত্বকে এতটাই বাড়িয়ে ফেলছি যে প্রতিবাদে সংগঠিত হওয়ার সুযোগগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজের রূপান্তর শুধু প্রযুক্তির পরিবর্তন নয়, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনও। ক্ষমতা ও সম্পদের মালিকানা সংক্রান্ত পরিবর্তন, সামন্ত সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে পরিবর্তন। তথ্য সমাজ কিন্তু এখনও এই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বরং পুঁজিবাদী সমাজ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে তথ্যের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই তথ্যের হিমালয় পর্বত হাজির, তাতে বিশল্যকরণী খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তথ্যকে ব্যবহার করছি না, তথ্যই (আসলে তথ্য সরবরাহকারীরা) আমাকে ব্যবহার করছেবাজারে গিয়ে আমি কী কিনবো, কী গান শুনবো, কাকে ভোট দেবো, সবকিছু অলক্ষ্যে কেউ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নতুন ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছি, যেখানে কোনো শিকল লাগে না।

তবুও, মানুষ তো শেষপর্যন্ত মানুষ, প্রশ্ন তোলার স্বভাব কি সে এত সহজে ছেড়ে দেবে? শিকল ভাঙার গান লুকিয়ে আছে মানুষের এই প্রশ্ন তোলা স্বভাবের মধ্যেই। যে যন্ত্র, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা তথ্য পাচ্ছি তার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তুলে তাকে যতো চিনবো, জানবো, ততই সচেতন হয়ে যাবো দাসত্ব সম্পর্কে। আর সচেতনতা ভেঙে ফেলতে পারে এই নতুন দাসত্বকে।

 গণশক্তি, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

 

20210809

স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা

 

মৌলানা হসরৎ মোহানী ও বিআর আম্বেদকর


অঞ্জন বেরা

 

মহাকাব্যিক বহুমাত্রিকতায় আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির সংগ্রাম এক অর্থে মানবিক উত্তরণেরও গর্বিত আখ্যান। এই উত্তরণে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। অনপনেয় তার প্রভাব

 

মহান অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭) অন্যান্য উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলির মতো ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও শুধুমাত্র অক্টোবর বিপ্লবের প্রতিবর্তক্রিয়ায় এদেশে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়নি। হয়েছিল, কারণ দেশের অভ্যন্তরে জমি ছিল প্রস্তুত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও তখন নতুন পর্বে পা দিয়েছে। এই নতুন পর্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই ছিল ব্যাপকতর মানুষের-শ্রমিক কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা-অংশগ্রহণ। অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী বিশ্বে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির রূপান্তর-পর্বে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তখন ঐতিহাসিকভাবেই অচল। লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালে গঠিত তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিকতবাদ অবসানের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয় প্রত্যাশিতভাবেই। ঐতিহাসিকভাবেই ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এক যুগসন্ধিক্ষণে।

 

কমিউনিস্টরাই জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে প্রথম সোচ্চার হয় ১৯২১ সালে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬-তম অধিবেশন উপলক্ষে প্রচারিত হয়  মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত ইশতেহার। শুধু ইশতেহার প্রচার নয়, এলাহাবাদে অধিবেশনে মৌলানা হসরত মোহানী এবং স্বামী কুমারানন্দ উত্থাপন করেন পূর্ণ স্বাধীনতার  প্রস্তাবসে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি, কারণ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘স্বরাজ’ অর্জন তখনও জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনেও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। জাতীয় কংগ্রেসকে ‘ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি’ হিসেবে উল্লেখ করে কমিন্টার্ণের বার্তা ঘোষণা করে: ‘‘সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া ভারতীয় জনগণের স্বাভাবিক বিকাশ অর্জন অসম্ভব।’’

 


১৯২১ সালের ইশতেহার থেকে ১৯৪৬সালের নির্বাচনী ইশতেহার, কিংবা গণপরিষদে কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাব-পরাধীন ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক বাঁকের মুখে কমিউনিস্ট পার্টি উত্থাপিত বিকল্প প্রস্তাব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আধুনিক ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে।  মুক্তিকামী রাজনীতির মূল অভিমুখ থেকে কমিউনিস্টরা কখনও সরে যায়নি।

 

জাতীয় কংগ্রেস সর্বপ্রথম পূর্ণ  স্বাধীনতার (‘পূর্ণ স্বরাজ’) প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে। গ্রহণ করে পূর্ণ স্বাধীনতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচী। স্বাধীনতার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মাত্রার স্বীকৃতির সূত্রে এই কর্মসূচী অনন্য। ঔপনিবেশিক মুক্তি সংগ্রামে নতুন অধ্যায়ের সূচনাবাহী

 

কমিউনিস্ট পার্টি জন্মসূত্রেই স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিবেদিত বীর সন্তানদের পার্টি।  এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘বার্লিন কমিটি’-তে সংগঠিত দেশান্তরী বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীরা। দেশান্তরী ভারতীয় মুজাহিররাগদর  বিপ্লবীরা। সেইসঙ্গে, দেশের মধ্যে সক্রিয় বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী (ব্রিটিশ সরকারের দলিলে যাঁরা ‘সন্ত্রাসবাদী’ চিহ্নিত), কংগ্রেসের রাডিক্যাল কর্মীদের একাংশ এবং খিলাফত ও আকালি আন্দোলনের আপোসহীন বিপ্লবীরা।

 

তেলেঙ্গানা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে নারীসেনানীরা

রবীন্দ্রনাথ যাঁদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন ‘বন্দীর শৃঙ্খলচ্ছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয়’ সেই তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের বড় অংশই তিরিশের দশকে বন্দী থাকালেই কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করেন এবং জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত বিপ্লবীরাও ছিলেন। ছিলেন ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বিদ্রোহে মাস্টার দা সূর্য সেনের সহযোদ্ধারা।

 

ঔপনিবেশিক জমানায় নির্যাতন ভোগের সম্ভবত কঠিনতম অভিজ্ঞতা কমিউনিস্টদেরই। প্রথম ছিল  পেশোয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা। ১৯২২ থেকে ১৯২৭সাল। কানপুর ‘কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ মামলা ১৯২৪-২৫ সালদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি জাতীয়স্তরে সংহত হবার চেষ্টা করতেই নেমে আসে মীরাট ‘ষড়যন্ত্র’ মামলার (১৯২৯-৩৩) খাঁড়া। গোটা দেশ থেকে একযোগে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার। ধৃতদের মধ্যে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির ফিলিপ স্প্র্যাট, বিএফ ব্র্যাডলে এবং এইচএল হাচিনসন’ও ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শুধু ভারতীয় কমিউনিস্টরা নন, ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগও কম নয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতা শুধু মুখের কথা ছিল না। মীরাট মামলা না মিটতেই দেশজুড়ে সরকারী নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। ১৯৩৪ সালের ২৮জুলাই থেকে ১৯৪২সালের ২৩ জুলাইঔপনিবেশিক জমানার অন্তহীন নির্যাতনও কমিউনিস্ট পার্টিকে কিন্তু  জনবিচ্ছিন্ন  করতে পারেনি।

 

আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু ও 
ঝাঁসি রানী ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল

স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার ভিত্তি ছিল তার বৈপ্লবিক মতাদর্শ। শ্রেণী রাজনীতির মতাদর্শ। স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির  অন্যতম মৌলিক অবদান। এই মতাদর্শই স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবী জনতার নির্ধারক ভূমিকার ওপর আলোকপাতে সক্ষম করেছে কমিউনিস্ট পার্টিকে।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনে ও জাতীয় জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে কমিউনিস্ট পার্টির আপোসহীন ভূমিকা অনস্বীকার্য। এলাহাবাদ কংগ্রেস অধিবেশনে (১৯২১) প্রচারিত   কমিউনিস্টদের প্রথম ইশতেহারেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অপরিহার্যতা সোচ্চারে ঘোষিত হয়। ১৯২০-র দশক, ১৯৩০-র দশক, বিশেষত ১৯৪০-র দশকের মধ্যভাগ থেকে দেশভাগ পর্ব- মতাদর্শগত মৌলিকতাই কমিউনিস্ট পার্টিকে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সবচেয়ে নীতিনিষ্ঠ এবং অবিচল রেখেছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই কমিউনিস্টরা যে সংঘ পরিবারের ঘোষিত শত্রু সেটা বিনা কারণে নয়।

 

জাতপাতের বিভাজন ও  বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা কমিউনিস্ট পার্টির মৌলিক অবস্থান। প্রতিষ্ঠা পর্ব থেকে। বহু-জাতি সমন্বিত এই দেশে জাতিসত্বার গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার প্রতি সংবেদনশীলতা যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্বেই অন্তর্ভূক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়, তাতে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ভোলার নয়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের গণতান্ত্রিক দাবি কমিউনিস্ট পার্টির  অন্যতম মৌলিক দাবি।

 

তাছাড়া, ঔপনিবেশিক জমানার মদতপুষ্ট দেশীয় রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির সামন্ততন্ত্র-পিষ্ট জনতাকে উপমহাদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপ্তি মূলস্রোতে গ্রথিত করতে কমিউনিস্টদের অবদান স্মরণীয়। এপ্রসঙ্গে  সম্ভবত  সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল নিজাম-শাসিত তেলেঙ্গানায়। জমিদারপ্রথা রদ, ভূমিসংস্কারের দাবিতে কৃষক সমাজকে সংগঠিত করায় কমিউনিস্টদের গৌরবজনক ভূমিকাও অবিস্মরণীয়। তেভাগা শুধু ফসলের ভাগের প্রশ্ন ছিল না, ছিল নতুন জীবনবোধেরও। ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পিছনে উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের সাক্ষরতা অভিযানের অবদান কিংবা দুর্ভিক্ষপীড়িত বা দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় কমিউনিস্ট কর্মীদের দরদী ভূমিকা কি ভোলা সম্ভব?

 

স্বাধীনতা সংগ্রামে আমআদমির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রসারিত করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান শ্রেণী ও গণসংগঠনগুলিকে পুষ্ট করা। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (প্রতিষ্ঠা ১৯২০), সারা ভারত কৃষক সভা, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের (তিনটি সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠা ১৯৩৬ সালে) প্রাণশক্তি ছিল কমিউনিস্টরাই১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আত্মপ্রকাশ জাতির সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম মাইলফলক। এদেশে কমিউনিস্টরাই সংগঠিত করেছে লড়াকু মহিলাদের।

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে গ্রথিত করার উদ্যোগেও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সামনের সারিতে। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবিসিনিয়া ও স্পেনে ফ্যাসিস্ট হামলার বিরোধিতায়, জাপ-আক্রান্ত চীনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপনে, সোভিয়েত সংহতি আন্দোলন গড়ে তোলায়, ইন্দোচীনের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জ্ঞাপনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত।

 

ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারবাদে মাথা বিকিয়ে দেওয়া শাসক শ্রেণীগুলি দেশ চালানোর ভার তুলে দিয়েছে ‘হিন্দুরাষ্ট্রবাদী’দের হাতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা এবং ঔপনিবেশিক শাসকের সঙ্গে অশুভ আঁতাতই যাদের জন্মদাগ। কর্পোরেট স্বার্থ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির ‘নিষ্ঠুর একতা’য় আক্রান্ত  আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্বিক অভিজ্ঞানকমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপন যেন নতুন প্রেক্ষিতে অর্থবহ হয়ে উঠেছে।

 

 

20210719

বামফ্রন্ট সরকার ও জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি



রবীন দেব

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনার চৌত্রিশ বছরের (১৯৭৭-২০১১) অভিজ্ঞতা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নজিরবিহীন শুধু তার মেয়াদের দৈর্ঘ্যের কারণে নয়, তার বিকল্প নীতির রাজনৈতিক তাৎপর্যের সূত্রেও। বহু পদক্ষেপের ক্ষেত্রেই বামফ্রন্ট সরকার ছিল দেশের মধ্যে পথিকৃৎ। শুধু রাজ্যে নয়, সমগ্র দেশে।

বামফ্রন্ট সরকারকে অনেক সময়েই এমন পথে চলতে হয়েছে যে পথে আগে কারও পদচিহ্ন পড়েনি। পথও কুসুমাস্তীর্ণও ছিল না। বাধা এবং প্রতিকূলতা ছিল লাগাতার। ছিল আক্রমণ ষড়যন্ত্র অপপ্রচার। বামফ্রন্ট সরকারের চৌত্রিশ বছরে ২৮০৬ জন কমরেড এরাজ্যে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন শ্রেণিশত্রুদের হাতে। বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার পরও শহীদ হয়েছেন ২২৮জন।

বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার দশ বছর পরও সেই সরকারের অভিজ্ঞতাগুলির প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। শুধু সাফল্যের অভিজ্ঞতা নয়, তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার অভিজ্ঞতাও। সব মিলিয়ে বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাজ্যস্তরে বাম-নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনার জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান ও সাফল্য সমগ্র দেশে আজও বিকল্প নীতি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের দিশারি।

শুধু বিধানসভা নির্বাচন নয়, পঞ্চায়েত, পৌরসভা, লোকসভার প্রতিটি নির্বাচনে বামফ্রন্ট রাজ্যবাসীর সমর্থন পেয়েছে চৌত্রিশ বছর ধরে। দিনের হিসাবে বারো হাজার তিনশো ছিয়াশি দিন। সেই সময়পর্বে কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আট হাজার পাঁচশো চল্লিশ দিন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিন হাজার আটশো ছেচল্লিশ দিন।

অনেক আত্মত্যাগের ফলশ্রুতি

বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে হঠাৎ করে গঠিত হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকারগুলি (১৯৬৭ এবং ১৯৬৯) স্বল্পমেয়াদি হলেও বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ভিত্তি রচিত হয় তখনই। যুক্তফ্রন্ট সরকার পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার ও আধাফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করতে গিয়ে সত্তর দশকের সেই সময় সিপিআই(এম)’র ১১০০ নেতা,কর্মী, সংগঠক শহীদ হয়েছিলেন। হাজার হাজার কর্মীকে ঘড়ছাড়া হতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়েছে অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।

লক্ষণীয়, বামফ্রন্ট সর্বদা নতুন নতুন অংশের মধ্যে প্রসারিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ছিল ছ’পার্টির কোয়ালিশন। তারপর বামফ্রন্টের শরিকের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও বামফ্রন্ট আট দলের। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বানের সময় বামফ্রন্টের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস এবং আইএসএফ মিলে সংযুক্ত মোর্চা গঠিত হয়। ত্রিপুরা এবং কেরালাতেও সিপিআই(এম) নতুন নতুন শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১-র নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জিতলেও সেই জোট টেকেনি। উলটে কংগ্রেসের নির্বাচিত বিধায়কদের দল ভাঙিয়ে তৃণমূলে আনা হয়েছে। নেত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাই তৃণমূলে শেষ কথা। মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ-ও কার্যত ভাঙাঘর। বিজেপি এখন মোদী-সর্বস্ব। একটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কখনই নিরাপদ নয়।

বামফ্রন্ট সরকার: নতুন অভিমুখ

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রবেশ করে নতুন এক পর্বে এবং সেই সূত্রেই বদলে যেতে শুরু করে রাজ্য সরকারের অভিমুখ।

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া: বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছে, তাকে প্রসারিত করেছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়। কয়েকজন সাংবাদিকও তখন মুক্তি পান। মুক্তি পান নকশালপন্থী এবং কংগ্রেসের অনেকেও। নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে অন্য রাজ্যের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও তখন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বামফ্রন্ট সরকার বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সুরক্ষা দেয়। সরকারি কর্মচারীদের, এমনকি পুলিশ কর্মীদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয়। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ আন্দোলন বা ধর্মঘট ভাঙতে কখনও পুলিশ পাঠায়নি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন করে।

ভূমি সংস্কার ও গ্রামোন্নয়ন: কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান অতুলনীয়। বিশ্বব্যাঙ্ক পর্যন্ত ২০০৬ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এ ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর প্রশংসা করে। সারা দেশের জমির মাত্র ৩% পশ্চিমবঙ্গে। অথচ গোটা দেশে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যত জমি বণ্টিত হয়েছে তার ২২% পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছিল। ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪শতাংশ কৃষি জমির মালিক। জাতীয় স্তরে তা ৩৪ শতাংশের সামান্য বেশি। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছেন কৃষক পরিবারের মহিলারাও। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫লক্ষ ১৩হাজার নথিভুক্ত বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।

ভূমি সংস্কারের উপর ভিত্তি করেই কৃষিতে সাফল্য আসে। স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৬-৭৭সালে রাজ্যে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হত ৭৪লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১০-১১ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৭০লক্ষ মেট্রিক টন।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

প্রথম বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর কমরেড জ্যোতি বসু বলেছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র মহাকরণ থেকে কাজ করবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা গড়ে তোলায় গোটা দেশকে পথ দেখিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৮ সালে রাজ্যে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামোন্নয়নের ভার তুলে দেওয়া হয় পঞ্চায়েতের হাতে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে আসে দুর্বলতর অংশের প্রতিনিধিরা। বামফ্রন্ট সরকার নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন করেছে। পর পর সাতবার।

বামফ্রন্ট সরকারই পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে— প্রথমে ৩৩ শতাংশ, তারপর ৫০ শতাংশ। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষণ করা হয়। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয় পৌরসভাগুলির ক্ষেত্রেও।

জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কাজের নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৭৮ সালের শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম বন্যার সময় ত্রাণ ও পুনর্গঠনের কাজে পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নতুন নজির সৃষ্টি করে। রাজ্যের মন্ত্রীরাও প্রত্যক্ষভাবে উদ্বার ও ত্রাণকার্যে নেমে পড়েন।

 



বামফ্রন্ট সরকারের দুই মুখ্যমন্ত্রী: জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

পৌরব্যবস্থায় রূপান্তর: বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই নগরায়নের চাহিদায় সাড়া দিয়ে পৌরব্যবস্থার অভূতপুর্ব প্রসার ঘটানো হয়। রাজ্যে পৌরসভার সংখ্যা বেড়ে ৯২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭। শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, আসানসোল পৌরনিগম হয় বামফ্রন্টের আমলেই। বামফ্রন্ট সরকারই পৌরসভাগুলিকে সত্যিকারের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করে। পৌর নির্বাচনে ১৮ বছর বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান করে দেশের মধ্যে প্রথম। পৌরসভাগুলির নির্বাচন হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে এবং নিয়মিত। অথচ গত দশ বছরে নির্দিষ্ট সময়ে পৌরসভা নির্বাচন করতে রাজ্য সরকার চরম ব্যর্থ। ২০১৮ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ ১৭টি পৌরসভাসহ মোট ১১২টি পৌরসভার ভোট কবে হবে কেউ জানে না।


দারিদ্র হ্রাস: পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ১৯৭৭-র আগে শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ এরাজ্যে দারিদ্রসীমার নিচে ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, ২০০৪-০৫ সালেই তা ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। ষষ্ঠ এবং সপ্তম বামফ্রন্টের সময়কালে রাজ্যে আর্থিক অগ্রগতির হার জাতীয় গড়ের উপরে থেকেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির ফলেই ২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার।

সংখ্যালঘু উন্নয়নে বামফ্রন্ট সরকার: সামগ্রিকভাবে শিক্ষা এবং মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অগ্রগতি বামফ্রন্টের আমলে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বিষয়ক দপ্তরের সূত্রপাত বামফ্রন্ট আমলে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার সমতুল্য করার কৃতিত্ব বামফ্রন্ট সরকারের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সেই উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। বামফ্রন্ট সরকারই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠন করে। মাদ্রাসাগুলিকে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করে। প্রতিষ্ঠা করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের প্রতিষ্ঠাও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। কর্মসূচি রূপায়ণে নিগম একদশকের উপর ধারাবাহিকভাবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। তবে সরকারি ও অন্যান্য সরকারপোষিত কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে বামফ্রন্ট সরকারই দেশে প্রথম রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে ‘অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়’(ওবিসি)-এর তালিকায় বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা সম্প্রসারণে তা ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

শিক্ষা: শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অরাজকতার ও মাৎস্যন্যায়ের পর্বে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে শাসনভার গ্রহণ করে। স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা বামফ্রন্ট সরকারের বিরাট সাফল্য। উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছিল প্রাথমিক শিক্ষায়। রাজ্যে ছয় থেকে দশ বছর বয়সি শিশুদের ৯৯.৬ শতাংশকে স্কুলে আনা সম্ভব হয়। মিড ডে মিলের আওতায় আনা গিয়েছিল ৯৬% শিশুকে। স্কুলছুটের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমে আসছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল নজিরবিহীনভাবে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ২লক্ষেরও কম ছাত্র-ছাত্রী। ২০১১ সালে সাড়ে ১০ লক্ষের মতো। এদের মধ্যে ছাত্রীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চগবেষণার সুযোগ আজ যা দেখা যায় তার প্রায় পুরোটাই গড়ে ওঠে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম সরকারি কাজকর্মে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাঁওতালী ভাষার স্বীকৃতি দেয়।

সাক্ষরতা: ১৯৭১ সালে রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। সর্বভারতীয় হারের চেয়ে তা অনেক বেশি। সাক্ষরতার সাফল্যে ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর বিখ্যাত ‘নোমা পুরস্কার’ পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সাক্ষরতা আন্দোলন সেই সময় গণআন্দোলনের রূপ নেয়।

সংস্কৃতি: সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার স্বার্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও পরিকাঠামো তৈরি করতে এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য বিকশিত করতে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারই সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের উপর সরকারি খবরদারি বন্ধ করে। বন্ধ করে পুলিশ দিয়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট অনুমোদনের প্রথা।

স্বাস্থ্যক্ষেত্র: বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের সময় রাজ্যে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩২৬। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার। রাজ্যে ৭৩% মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসতেন। যখন গোটা দেশে এই হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করায় বামফ্রন্ট জোর দেয়।

প্রসঙ্গত, করোনা অতিমারীকালে দুর্ভোগে পড়া সাধারণ মানুষের সাহায্যে বাম ছাত্র-যুব শ্রমিক মহিলা সংগঠনগুলি অনবদ্য ভূমিকা নিয়েছে। এটাই বামপন্থীদের ভূমিকা। অতিমারী মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার মধ্যে রেড ভলান্টিয়াররাই রাজ্যকে গৌরবান্বিত করছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্য: বামফ্রন্টের আমলে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে অভূতপূর্ব হারে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১১ সালের পর রাজ্যে একটিও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়নি।

উদ্বাস্তু কল্যাণ: কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য না পেয়ে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে বামফ্রন্ট সরকার উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। উদ্বাস্তু কলোনিগুলির স্বীকৃতি এবং জমির নি:শর্ত পাট্টা প্রদানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা পেলে সমস্যার আরও অনেক সুরাহা করা যেত। বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের পর নতুন সরকার উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের পৃথক অস্তিত্বই তুলে দিয়েছে।

শিল্প-প্রসারে উদ্যোগ: কৃষির সাফল্যের উপর ভিতের উপর দাঁড়িয়েই রাজ্যের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করতে শিল্পায়নের উপর নজর দেয় বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক নীতির মুখে রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগেই কাজ শুরু করে।

বেসরকারি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পেই দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সল্টলেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও কাজের সুযোগ বেড়েছিল নানা স্তরে।

ক্ষুদ্র শিল্পে সংখ্যার বিচারে ও কর্মসংস্থানের বিচারে বামফ্রন্টের সময়েই পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরার শিরোপা পায়। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের। উপকৃত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।

কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি ঘোষণার পর সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বিচার করে বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৪ সালে রাজ্য সরকারের ‘শিল্পায়ন সংক্রান্ত নীতি বিবৃতি’ ঘোষণা করে। রাজ্য সরকারের লাগাতার উদ্যোগের ফলেই ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের মানদণ্ডে আমাদের রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। ২০১০ সালে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫হাজার ৫২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা।

আন্তরিকতার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দাঁড়িয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পাশে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫লক্ষে। সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৫০লক্ষের উপর; যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা। মহিলাদের মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে দেশে বামফ্রন্ট সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

সেই সঙ্গে ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ নাগরিক কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘উদীয়মান স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘বাংলা কর্মসংস্থান প্রকল্প’-র মতন উদ্যোগগুলি।

নয়া উদারবাদ যখন কর্মসংস্থানহীন/কর্মসংকোচনকারী তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-র মডেল চাপিয়ে দিচ্ছে তখন বামফ্রন্ট সরকারের ‘বিকল্প’ নীতির বৈশিষ্ট্য ছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং আয় বাড়ানোর প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানো। প্রতিটি প্রকল্প রূপায়ণে কর্মদিবস সৃষ্টির প্রশ্নটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক সুরক্ষা: সমাজের দুর্বলতর অংশের স্বার্থরক্ষায় বামফ্রন্ট সরকার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করেছে অনেক আগে থেকে। বামফ্রন্ট সরকারের আগে এরকম প্রকল্প বিশেষ ছিল না। বার্ধক্য ভাতা (শুরু ১৯৭৯ সালে), প্রতিবন্ধী ভাতা (শুরু ১৯৮০সাল), আদিবাসী বার্ধক্যভাতা (একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হতো), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা শুরু করা হয় রাজ্য সরকারের নিজের উদ্যোগে। এই সব প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে টাকার পরিমাণও এবং উপভোক্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ভূমিহীন কৃষক, রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক, অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের পথিকৃৎ বামফ্রন্ট সরকারই। বামফ্রন্ট সরকার ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ২টাকা কেজি দরে চাল দিত। শুধু বিপিএল নয়, এপিএল-এর দরিদ্র মানুষেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তখন রাজ্য ছিল দ্বিতীয় স্থানে। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও গরিব মানুষকে বসবাসের জমি দিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যেমন, উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত জমি প্রদান; ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন করা, কুড়ি বছরের বেশি সময়ের উপর সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের মাত্র ১ টাকায় ৯৯ বছরের লিজ প্রদান ইত্যাদি।

বামফ্রন্ট সরকারের সামাজিক সুরক্ষামূলক উদ্যোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দু:স্থ মেদাবী ছাত্র-ছাত্রী, বিশেষত অনগ্রসর সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু জন্য উদারভাবে বিভিন্ন বৃত্তি, স্কলারশিপ ও আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা।

বামফ্রন্ট সরকারই ‘ল্যাম্পস’-র কর্মচারীদের রাজ্য বেতন কমিশনের আওতায় এনেছিল। মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা এবং আদিবাসী মহিলা স্বশক্তিকরণ যোজনা প্রকল্প রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দেশের মধ্যে প্রথম।

তবে শুধুমাত্র সহায়তা প্রকল্প মারফত কোনও সমাজ সুস্থায়ী উন্নয়নের পথে এগতে পারে না। তাই স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্য শিল্প প্রসারে জোর দেওয়া হয়। সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে শূণ্যপদ পূরণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন বামফ্রন্ট সরকারের তৈরি।

বামফ্রন্ট সরকার শুধু রাজ্য সরকারি কর্মচারী নয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন, পেনশন, পারিবারিক পেনশন, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। এসবে বামফ্রন্ট সরকার কখনই কাটছাঁট করেনি।

সম্প্রীতি ও ঐক্য: ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত ঐক্যরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা গোটা দেশের পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা বাড়িয়েছিল। সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সংখ্যাগুরুবাদী সংকীর্ণতা রাজ্যে মাথাচাড়া দিতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক শক্তি সব সময়ই বামফ্রন্ট-বিরোধী ষড়যন্ত্রে সক্রিয়ভাবে শামিল থেকেছে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং বিজেপি’র সঙ্গে তার সার্বিক জোট রাজ্য রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির নতুন সমাবেশ ঘটাতে সাহায্য করে।

দুর্নীতির পরিবেশে ব্যতিক্রমী: বিশেষত নয়া উদারবাদী পর্বে সরকারি দুর্নীতি যখন কি কেন্দ্রে, কি রাজ্যে রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, তখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল স্পষ্টতই ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। অবান্তর বা অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মানুষকে ভাগাভাগি করে, জনগণকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচনে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেনি বামফ্রন্ট।

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নে

বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের প্রশ্নে ধারাবাহিকভাবে উদ্যোগ নেয়। দেশের বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলিকে এই প্রশ্নে সমবেত করে। সেই সব উদ্যোগের পরিণতিতেই কেন্দ্রীয় সরকার সারকারিয়া কমিশন গঠন করে। 

রাজনৈতিক পালা বদলের পর

আমরা শুধু সাফল্য নয়,বামফ্রন্ট সরকারের দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলি থেকেও শিক্ষা নেবার কথা বলি। অগ্রগতির সেটাও অপরিহার্য শর্ত।

একই সঙ্গে বিগত দশ বছর ধরে এটাও অভিজ্ঞতা যে, বামফ্রন্ট সরকারের অনুপস্থিতি আগ্রাসী নয়া উদারবাদী জমানার মুখে রাজ্যবাসীর সমস্যা-সঙ্কট বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চরম আক্রমণ নেমে এসেছে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীদের উপর। খুন জখম মিথ্যা মামলা চলছেই। আর বামপন্থীরা আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বর্ধিত মাত্রায় আক্রমণ নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের উপর। সবচেয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ। শ্রমজীবী মানুষ। সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশ। ধান্দার ধনতন্ত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। একই সঙ্গে চলছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভয়ঙ্কর আক্রমণ জনজীবনের ওপর।

সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ছে রাজ্য। রাজ্য সরকারের বাজার থেকে ধারের পরিমাণে দেশে রেকর্ড করেছে। কর্মহীনতা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র কিছু সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উপভোক্তা তৈরি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিকাশের সম্ভাবনাগুলিকে বিপর্যস্ত করছে। রাজ্য স্থায়ী সম্পদ তৈরি হচ্ছে না। পরিকাঠামো নির্মাণে রাজ্য পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

দুর্নীতি এখন লাগামছাড়া। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের গণতান্ত্রিক কাঠামো বিপর্যস্ত। সহায়তা প্রকল্পগুলিকে জিম্মা রেখে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হরণ করা হচ্ছে। রাজ্য পরিণত হচ্ছে জাতপাত সংকীর্ণ পরিচিতি সত্তা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভয়ারণ্যে।

বল্গাহীন স্বৈরাচার যেন বিকল্পহীন-- দেখাতে চায় ক্ষমতালিপ্সু শাসক। ‘জয় বাংলা’ আর ‘সোনার বাংলা’-র মিডিয়াপুষ্ট দ্বৈরথ সেই লক্ষ্যেই। সেকারণেই গুরুত্ব বাড়ছে বিকল্পের লড়াইয়ের। অর্জিত অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কার জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতির গুরুত্ব এখানেই। এরাজ্যে এবং সমগ্র দেশে।

গণশক্তি, ২০ জুন, ২০২১