20210719

বামফ্রন্ট সরকার ও জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি



রবীন দেব

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনার চৌত্রিশ বছরের (১৯৭৭-২০১১) অভিজ্ঞতা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নজিরবিহীন শুধু তার মেয়াদের দৈর্ঘ্যের কারণে নয়, তার বিকল্প নীতির রাজনৈতিক তাৎপর্যের সূত্রেও। বহু পদক্ষেপের ক্ষেত্রেই বামফ্রন্ট সরকার ছিল দেশের মধ্যে পথিকৃৎ। শুধু রাজ্যে নয়, সমগ্র দেশে।

বামফ্রন্ট সরকারকে অনেক সময়েই এমন পথে চলতে হয়েছে যে পথে আগে কারও পদচিহ্ন পড়েনি। পথও কুসুমাস্তীর্ণও ছিল না। বাধা এবং প্রতিকূলতা ছিল লাগাতার। ছিল আক্রমণ ষড়যন্ত্র অপপ্রচার। বামফ্রন্ট সরকারের চৌত্রিশ বছরে ২৮০৬ জন কমরেড এরাজ্যে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন শ্রেণিশত্রুদের হাতে। বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার পরও শহীদ হয়েছেন ২২৮জন।

বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হবার দশ বছর পরও সেই সরকারের অভিজ্ঞতাগুলির প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। শুধু সাফল্যের অভিজ্ঞতা নয়, তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার অভিজ্ঞতাও। সব মিলিয়ে বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাজ্যস্তরে বাম-নেতৃত্বাধীন সরকার পরিচালনার জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান ও সাফল্য সমগ্র দেশে আজও বিকল্প নীতি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের দিশারি।

শুধু বিধানসভা নির্বাচন নয়, পঞ্চায়েত, পৌরসভা, লোকসভার প্রতিটি নির্বাচনে বামফ্রন্ট রাজ্যবাসীর সমর্থন পেয়েছে চৌত্রিশ বছর ধরে। দিনের হিসাবে বারো হাজার তিনশো ছিয়াশি দিন। সেই সময়পর্বে কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আট হাজার পাঁচশো চল্লিশ দিন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিন হাজার আটশো ছেচল্লিশ দিন।

অনেক আত্মত্যাগের ফলশ্রুতি

বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে হঠাৎ করে গঠিত হয়নি। যুক্তফ্রন্ট সরকারগুলি (১৯৬৭ এবং ১৯৬৯) স্বল্পমেয়াদি হলেও বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ভিত্তি রচিত হয় তখনই। যুক্তফ্রন্ট সরকার পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার ও আধাফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করতে গিয়ে সত্তর দশকের সেই সময় সিপিআই(এম)’র ১১০০ নেতা,কর্মী, সংগঠক শহীদ হয়েছিলেন। হাজার হাজার কর্মীকে ঘড়ছাড়া হতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়েছে অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।

লক্ষণীয়, বামফ্রন্ট সর্বদা নতুন নতুন অংশের মধ্যে প্রসারিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ছিল ছ’পার্টির কোয়ালিশন। তারপর বামফ্রন্টের শরিকের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও বামফ্রন্ট আট দলের। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বানের সময় বামফ্রন্টের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস এবং আইএসএফ মিলে সংযুক্ত মোর্চা গঠিত হয়। ত্রিপুরা এবং কেরালাতেও সিপিআই(এম) নতুন নতুন শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১-র নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জিতলেও সেই জোট টেকেনি। উলটে কংগ্রেসের নির্বাচিত বিধায়কদের দল ভাঙিয়ে তৃণমূলে আনা হয়েছে। নেত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাই তৃণমূলে শেষ কথা। মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ-ও কার্যত ভাঙাঘর। বিজেপি এখন মোদী-সর্বস্ব। একটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কখনই নিরাপদ নয়।

বামফ্রন্ট সরকার: নতুন অভিমুখ

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রবেশ করে নতুন এক পর্বে এবং সেই সূত্রেই বদলে যেতে শুরু করে রাজ্য সরকারের অভিমুখ।

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া: বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছে, তাকে প্রসারিত করেছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়। কয়েকজন সাংবাদিকও তখন মুক্তি পান। মুক্তি পান নকশালপন্থী এবং কংগ্রেসের অনেকেও। নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে অন্য রাজ্যের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও তখন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বামফ্রন্ট সরকার বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সুরক্ষা দেয়। সরকারি কর্মচারীদের, এমনকি পুলিশ কর্মীদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয়। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ আন্দোলন বা ধর্মঘট ভাঙতে কখনও পুলিশ পাঠায়নি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। বামফ্রন্ট সরকারই দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন করে।

ভূমি সংস্কার ও গ্রামোন্নয়ন: কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান অতুলনীয়। বিশ্বব্যাঙ্ক পর্যন্ত ২০০৬ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এ ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর প্রশংসা করে। সারা দেশের জমির মাত্র ৩% পশ্চিমবঙ্গে। অথচ গোটা দেশে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যত জমি বণ্টিত হয়েছে তার ২২% পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছিল। ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪শতাংশ কৃষি জমির মালিক। জাতীয় স্তরে তা ৩৪ শতাংশের সামান্য বেশি। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছেন কৃষক পরিবারের মহিলারাও। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫লক্ষ ১৩হাজার নথিভুক্ত বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।

ভূমি সংস্কারের উপর ভিত্তি করেই কৃষিতে সাফল্য আসে। স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৬-৭৭সালে রাজ্যে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হত ৭৪লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১০-১১ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৭০লক্ষ মেট্রিক টন।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

প্রথম বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর কমরেড জ্যোতি বসু বলেছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার শুধুমাত্র মহাকরণ থেকে কাজ করবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা গড়ে তোলায় গোটা দেশকে পথ দেখিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৮ সালে রাজ্যে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামোন্নয়নের ভার তুলে দেওয়া হয় পঞ্চায়েতের হাতে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে আসে দুর্বলতর অংশের প্রতিনিধিরা। বামফ্রন্ট সরকার নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন করেছে। পর পর সাতবার।

বামফ্রন্ট সরকারই পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে— প্রথমে ৩৩ শতাংশ, তারপর ৫০ শতাংশ। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষণ করা হয়। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয় পৌরসভাগুলির ক্ষেত্রেও।

জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কাজের নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৭৮ সালের শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম বন্যার সময় ত্রাণ ও পুনর্গঠনের কাজে পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নতুন নজির সৃষ্টি করে। রাজ্যের মন্ত্রীরাও প্রত্যক্ষভাবে উদ্বার ও ত্রাণকার্যে নেমে পড়েন।

 



বামফ্রন্ট সরকারের দুই মুখ্যমন্ত্রী: জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

পৌরব্যবস্থায় রূপান্তর: বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই নগরায়নের চাহিদায় সাড়া দিয়ে পৌরব্যবস্থার অভূতপুর্ব প্রসার ঘটানো হয়। রাজ্যে পৌরসভার সংখ্যা বেড়ে ৯২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭। শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, আসানসোল পৌরনিগম হয় বামফ্রন্টের আমলেই। বামফ্রন্ট সরকারই পৌরসভাগুলিকে সত্যিকারের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করে। পৌর নির্বাচনে ১৮ বছর বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান করে দেশের মধ্যে প্রথম। পৌরসভাগুলির নির্বাচন হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে এবং নিয়মিত। অথচ গত দশ বছরে নির্দিষ্ট সময়ে পৌরসভা নির্বাচন করতে রাজ্য সরকার চরম ব্যর্থ। ২০১৮ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ ১৭টি পৌরসভাসহ মোট ১১২টি পৌরসভার ভোট কবে হবে কেউ জানে না।


দারিদ্র হ্রাস: পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ১৯৭৭-র আগে শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ এরাজ্যে দারিদ্রসীমার নিচে ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, ২০০৪-০৫ সালেই তা ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। ষষ্ঠ এবং সপ্তম বামফ্রন্টের সময়কালে রাজ্যে আর্থিক অগ্রগতির হার জাতীয় গড়ের উপরে থেকেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির ফলেই ২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার।

সংখ্যালঘু উন্নয়নে বামফ্রন্ট সরকার: সামগ্রিকভাবে শিক্ষা এবং মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অগ্রগতি বামফ্রন্টের আমলে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বিষয়ক দপ্তরের সূত্রপাত বামফ্রন্ট আমলে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার সমতুল্য করার কৃতিত্ব বামফ্রন্ট সরকারের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সেই উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। বামফ্রন্ট সরকারই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠন করে। মাদ্রাসাগুলিকে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করে। প্রতিষ্ঠা করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের প্রতিষ্ঠাও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। কর্মসূচি রূপায়ণে নিগম একদশকের উপর ধারাবাহিকভাবে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। তবে সরকারি ও অন্যান্য সরকারপোষিত কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে বামফ্রন্ট সরকারই দেশে প্রথম রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে ‘অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়’(ওবিসি)-এর তালিকায় বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা সম্প্রসারণে তা ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

শিক্ষা: শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অরাজকতার ও মাৎস্যন্যায়ের পর্বে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে শাসনভার গ্রহণ করে। স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা বামফ্রন্ট সরকারের বিরাট সাফল্য। উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছিল প্রাথমিক শিক্ষায়। রাজ্যে ছয় থেকে দশ বছর বয়সি শিশুদের ৯৯.৬ শতাংশকে স্কুলে আনা সম্ভব হয়। মিড ডে মিলের আওতায় আনা গিয়েছিল ৯৬% শিশুকে। স্কুলছুটের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমে আসছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল নজিরবিহীনভাবে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ২লক্ষেরও কম ছাত্র-ছাত্রী। ২০১১ সালে সাড়ে ১০ লক্ষের মতো। এদের মধ্যে ছাত্রীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চগবেষণার সুযোগ আজ যা দেখা যায় তার প্রায় পুরোটাই গড়ে ওঠে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম সরকারি কাজকর্মে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাঁওতালী ভাষার স্বীকৃতি দেয়।

সাক্ষরতা: ১৯৭১ সালে রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। সর্বভারতীয় হারের চেয়ে তা অনেক বেশি। সাক্ষরতার সাফল্যে ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর বিখ্যাত ‘নোমা পুরস্কার’ পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সাক্ষরতা আন্দোলন সেই সময় গণআন্দোলনের রূপ নেয়।

সংস্কৃতি: সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার স্বার্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও পরিকাঠামো তৈরি করতে এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য বিকশিত করতে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারই সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের উপর সরকারি খবরদারি বন্ধ করে। বন্ধ করে পুলিশ দিয়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট অনুমোদনের প্রথা।

স্বাস্থ্যক্ষেত্র: বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের সময় রাজ্যে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩২৬। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার। রাজ্যে ৭৩% মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসতেন। যখন গোটা দেশে এই হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করায় বামফ্রন্ট জোর দেয়।

প্রসঙ্গত, করোনা অতিমারীকালে দুর্ভোগে পড়া সাধারণ মানুষের সাহায্যে বাম ছাত্র-যুব শ্রমিক মহিলা সংগঠনগুলি অনবদ্য ভূমিকা নিয়েছে। এটাই বামপন্থীদের ভূমিকা। অতিমারী মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার মধ্যে রেড ভলান্টিয়াররাই রাজ্যকে গৌরবান্বিত করছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাফল্য: বামফ্রন্টের আমলে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে অভূতপূর্ব হারে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। প্রায় প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১১ সালের পর রাজ্যে একটিও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়নি।

উদ্বাস্তু কল্যাণ: কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য না পেয়ে সীমিত সাধ্যের মধ্যেই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে বামফ্রন্ট সরকার উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। উদ্বাস্তু কলোনিগুলির স্বীকৃতি এবং জমির নি:শর্ত পাট্টা প্রদানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা পেলে সমস্যার আরও অনেক সুরাহা করা যেত। বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের পর নতুন সরকার উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের পৃথক অস্তিত্বই তুলে দিয়েছে।

শিল্প-প্রসারে উদ্যোগ: কৃষির সাফল্যের উপর ভিতের উপর দাঁড়িয়েই রাজ্যের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত করতে শিল্পায়নের উপর নজর দেয় বামফ্রন্ট সরকার। কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক নীতির মুখে রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগেই কাজ শুরু করে।

বেসরকারি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পেই দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সল্টলেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও কাজের সুযোগ বেড়েছিল নানা স্তরে।

ক্ষুদ্র শিল্পে সংখ্যার বিচারে ও কর্মসংস্থানের বিচারে বামফ্রন্টের সময়েই পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরার শিরোপা পায়। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের। উপকৃত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।

কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি ঘোষণার পর সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বিচার করে বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৪ সালে রাজ্য সরকারের ‘শিল্পায়ন সংক্রান্ত নীতি বিবৃতি’ ঘোষণা করে। রাজ্য সরকারের লাগাতার উদ্যোগের ফলেই ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের মানদণ্ডে আমাদের রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। ২০১০ সালে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫হাজার ৫২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা।

আন্তরিকতার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দাঁড়িয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পাশে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫লক্ষে। সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৫০লক্ষের উপর; যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা। মহিলাদের মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে দেশে বামফ্রন্ট সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

সেই সঙ্গে ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ নাগরিক কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘উদীয়মান স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্প’,‘বাংলা কর্মসংস্থান প্রকল্প’-র মতন উদ্যোগগুলি।

নয়া উদারবাদ যখন কর্মসংস্থানহীন/কর্মসংকোচনকারী তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-র মডেল চাপিয়ে দিচ্ছে তখন বামফ্রন্ট সরকারের ‘বিকল্প’ নীতির বৈশিষ্ট্য ছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং আয় বাড়ানোর প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানো। প্রতিটি প্রকল্প রূপায়ণে কর্মদিবস সৃষ্টির প্রশ্নটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক সুরক্ষা: সমাজের দুর্বলতর অংশের স্বার্থরক্ষায় বামফ্রন্ট সরকার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করেছে অনেক আগে থেকে। বামফ্রন্ট সরকারের আগে এরকম প্রকল্প বিশেষ ছিল না। বার্ধক্য ভাতা (শুরু ১৯৭৯ সালে), প্রতিবন্ধী ভাতা (শুরু ১৯৮০সাল), আদিবাসী বার্ধক্যভাতা (একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হতো), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা শুরু করা হয় রাজ্য সরকারের নিজের উদ্যোগে। এই সব প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে টাকার পরিমাণও এবং উপভোক্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ভূমিহীন কৃষক, রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক, অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের পথিকৃৎ বামফ্রন্ট সরকারই। বামফ্রন্ট সরকার ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ২টাকা কেজি দরে চাল দিত। শুধু বিপিএল নয়, এপিএল-এর দরিদ্র মানুষেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তখন রাজ্য ছিল দ্বিতীয় স্থানে। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও গরিব মানুষকে বসবাসের জমি দিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যেমন, উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত জমি প্রদান; ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন করা, কুড়ি বছরের বেশি সময়ের উপর সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের মাত্র ১ টাকায় ৯৯ বছরের লিজ প্রদান ইত্যাদি।

বামফ্রন্ট সরকারের সামাজিক সুরক্ষামূলক উদ্যোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দু:স্থ মেদাবী ছাত্র-ছাত্রী, বিশেষত অনগ্রসর সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু জন্য উদারভাবে বিভিন্ন বৃত্তি, স্কলারশিপ ও আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা।

বামফ্রন্ট সরকারই ‘ল্যাম্পস’-র কর্মচারীদের রাজ্য বেতন কমিশনের আওতায় এনেছিল। মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা এবং আদিবাসী মহিলা স্বশক্তিকরণ যোজনা প্রকল্প রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দেশের মধ্যে প্রথম।

তবে শুধুমাত্র সহায়তা প্রকল্প মারফত কোনও সমাজ সুস্থায়ী উন্নয়নের পথে এগতে পারে না। তাই স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্য শিল্প প্রসারে জোর দেওয়া হয়। সরকারি দপ্তরগুলিতে এবং স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে শূণ্যপদ পূরণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন বামফ্রন্ট সরকারের তৈরি।

বামফ্রন্ট সরকার শুধু রাজ্য সরকারি কর্মচারী নয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন, পেনশন, পারিবারিক পেনশন, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। এসবে বামফ্রন্ট সরকার কখনই কাটছাঁট করেনি।

সম্প্রীতি ও ঐক্য: ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত ঐক্যরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা গোটা দেশের পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা বাড়িয়েছিল। সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সংখ্যাগুরুবাদী সংকীর্ণতা রাজ্যে মাথাচাড়া দিতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক শক্তি সব সময়ই বামফ্রন্ট-বিরোধী ষড়যন্ত্রে সক্রিয়ভাবে শামিল থেকেছে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং বিজেপি’র সঙ্গে তার সার্বিক জোট রাজ্য রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির নতুন সমাবেশ ঘটাতে সাহায্য করে।

দুর্নীতির পরিবেশে ব্যতিক্রমী: বিশেষত নয়া উদারবাদী পর্বে সরকারি দুর্নীতি যখন কি কেন্দ্রে, কি রাজ্যে রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, তখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল স্পষ্টতই ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। অবান্তর বা অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মানুষকে ভাগাভাগি করে, জনগণকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচনে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেনি বামফ্রন্ট।

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নে

বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের প্রশ্নে ধারাবাহিকভাবে উদ্যোগ নেয়। দেশের বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলিকে এই প্রশ্নে সমবেত করে। সেই সব উদ্যোগের পরিণতিতেই কেন্দ্রীয় সরকার সারকারিয়া কমিশন গঠন করে। 

রাজনৈতিক পালা বদলের পর

আমরা শুধু সাফল্য নয়,বামফ্রন্ট সরকারের দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলি থেকেও শিক্ষা নেবার কথা বলি। অগ্রগতির সেটাও অপরিহার্য শর্ত।

একই সঙ্গে বিগত দশ বছর ধরে এটাও অভিজ্ঞতা যে, বামফ্রন্ট সরকারের অনুপস্থিতি আগ্রাসী নয়া উদারবাদী জমানার মুখে রাজ্যবাসীর সমস্যা-সঙ্কট বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চরম আক্রমণ নেমে এসেছে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থীদের উপর। খুন জখম মিথ্যা মামলা চলছেই। আর বামপন্থীরা আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বর্ধিত মাত্রায় আক্রমণ নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের উপর। সবচেয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ। শ্রমজীবী মানুষ। সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশ। ধান্দার ধনতন্ত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। একই সঙ্গে চলছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভয়ঙ্কর আক্রমণ জনজীবনের ওপর।

সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ছে রাজ্য। রাজ্য সরকারের বাজার থেকে ধারের পরিমাণে দেশে রেকর্ড করেছে। কর্মহীনতা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র কিছু সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উপভোক্তা তৈরি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিকাশের সম্ভাবনাগুলিকে বিপর্যস্ত করছে। রাজ্য স্থায়ী সম্পদ তৈরি হচ্ছে না। পরিকাঠামো নির্মাণে রাজ্য পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

দুর্নীতি এখন লাগামছাড়া। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের গণতান্ত্রিক কাঠামো বিপর্যস্ত। সহায়তা প্রকল্পগুলিকে জিম্মা রেখে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হরণ করা হচ্ছে। রাজ্য পরিণত হচ্ছে জাতপাত সংকীর্ণ পরিচিতি সত্তা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভয়ারণ্যে।

বল্গাহীন স্বৈরাচার যেন বিকল্পহীন-- দেখাতে চায় ক্ষমতালিপ্সু শাসক। ‘জয় বাংলা’ আর ‘সোনার বাংলা’-র মিডিয়াপুষ্ট দ্বৈরথ সেই লক্ষ্যেই। সেকারণেই গুরুত্ব বাড়ছে বিকল্পের লড়াইয়ের। অর্জিত অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কার জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতির গুরুত্ব এখানেই। এরাজ্যে এবং সমগ্র দেশে।

গণশক্তি, ২০ জুন, ২০২১


নারদাকান্ডে সিবিআই-র শীতঘুম ভাঙা: অজয় দাশগুপ্ত

১৮মে, ২০২১

নারদাকান্ডে পাঁচ বছর শীতঘুমে থাকার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত সিবিআই দপ্তর আচমকা জেগে উঠেছে! ভোটে হারার প্রতিক্রিয়া কিনা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনা হলো, ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ নারদ ‘এক্স ফাইলস’-এর ভিডিও ফুটেজে সৌগত রায়, সুব্রত মুখার্জি, ববি হাকিম, শুভেন্দু অধিকারীসহ তৃণমূলের ১৬ জন সাংসদ ও বিধায়ককে প্রকাশ্যে ঘুষ নিতে দেখা যায়। ভিডিও ফুটেজের সত্যতা ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও একজনের বিরুদ্ধেও দলীয় স্তরে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নিযদিও ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারে মমতা ব্যানার্জি নিজেই কবুল করেছিলেন, ‘‘আগে জানলে টিকিট দিতাম না।’’ কিন্তু নির্বাচনের পর তাদেরকেই আবার মন্ত্রী করেছেন এবং পরের নির্বাচনেও টিকিট দিয়েছেন। তুলনাহীন দ্বিচারিতায় উনি সবকিছুতেই ছাপিয়ে গেছেন, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।

এদিকে, তৃণমূল সাংসদ-বিধায়কদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য লোকসভায় গঠিত এথিক্স কমিটির কাছে নারদা স্টিং অপারেশনের টেপ জমা পড়ার ৫বছর বাদেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, একটি বৈঠকও ডাকা হয়নি। শুধু তাই নয়, রাজ্যসভায় এথিক্স কমিটি গঠনের বিরোধিতা করেছে স্বয়ং মোদী সরকার। এই ঘটনার পিছনে কোন বোঝাপড়ার অঙ্ক কাজ করছিল সেই রহস্য এখনও অন্ধকারে।

২০১৮সালের ১২সেপ্টেম্বর সংসদের নীতিবিষয়ক (এথিক্স) কমিটি পুনর্গঠিত করেন লোকসভার তৎকালীন অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন এবং নারদ ঘুষকান্ডের তদন্তে গত তিন বছরে একটিও মিটিং না ডেকে শীতঘুমে থাকা এই কমিটির চেয়ারম্যান আবার হন বিজেপি-র প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি। সেবছরই ১আগস্ট দিল্লিতে সংসদ ভবনে তাঁর কক্ষে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে মমতা ব্যানার্জির প্রণাম করার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ তাঁরা ‘সৌজন্যমূলক’ আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন, বলেও আমরা সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছিলাম! বাবরি মসজিদ ভাঙার নায়ক লালকৃষ্ণ আদবানিকেই মমতা ব্যানার্জি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, এটাও মিডিয়ার অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যেতে চান! তার পিছনে কোন অঙ্ক কাজ করছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

লোকসভা নির্বাচনের পর আদবানিহীন সংসদে নতুন করে এথিক্স কমিটি গঠিত হলেও তার বৈঠক কেন ডাকা হলো না, তার উত্তর মোদী-শাহ সরকারকে দিতে হবে। বৈঠক ডাকলেই সাংসদদের সদস্যপদ যে বাতিল করতে হবে, তার উদাহরণ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত লোকসভা দেখিয়ে দিয়েছে। সদ্য বিজেপি'তে যোগ দেওয়া, অথবা যোগ দিতে অপেক্ষমান সাংসদদের বাঁচাতে গিয়ে যে একাজ করা হচ্ছে না, এই প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৬এপ্রিল সিবিআই লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে সাংসদদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল। মোদী সরকারই তা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।

এদিকে, আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মমতা ব্যানার্জি দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তার অব্যবহিত পরেই সিবিআই সারদা, রোজভ্যালি এবং নারদা মামলার তদন্তকারী সমস্ত কর্মকর্তাদের বদলি করে, যারা তখনই কেস গুটিয়ে এনেছিলেন

নাটক এখনও শেষ হয়নি। নতুন অঙ্ক শুরু হয়েছে। দেখতে থাকুন।

সূত্র: 

১। আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮এপ্রিল, ২০১৬;   ‘‘আগে জানলে টিকিট দিতাম না:

২। The Hindu, Kolkata, 16th January, 2020;  CBI transfers officers probing Saradha, Rose Valley and Narada scams


(এই চমকপ্রদ ছবিটি সমকালীন চিত্র সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম সেরা অমিত ধরের তোলা। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।)