20211011

তথ্য সমাজের নিঃসঙ্গতা

 প্রসূন ভট্টাচার্য

সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল দেখে বুঝতে পারছেন যে কাল মানে সোমবার ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে? আচ্ছা, এটা না হয় বামপন্থীদের বিষয় বলে অচ্ছ্যুৎ। কিন্তু শুক্রবার যে জলবায়ু ধর্মঘট ছিল সেই খবরটা ঠিকঠাক পেয়েছিলেন? অতিবৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ১৫ লক্ষ মানুষ আর বিস্তৃত জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, উত্তরবঙ্গের শিশুরা সংক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে, কিংবা কেবল করোনার দ্বিতীয় ঢেউতেই ভারতের আরও ১কোটি লোক কর্মহীন হয়ে গেছে, স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে, দেশের ৯৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে, আর ১১টি কর্পোরেট কোম্পানির আয় যা বেড়েছে তা দিয়ে গোটা দেশের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। এসব খবরের প্রায় কোনোটাই আমরা মিডিয়াতে পাইনি। অথচ খবর এখন আমাদের কাছে অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। আমরা এখন নাকি ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’ বা তথ্য সমাজে বসবাস করছি।

একটা সময় ছিল যখন খবর সংগ্রহ করে সংবাদপত্রে প্রকাশ করা ছিল রীতিমতো কঠিন কাজ। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়' উপন্যাসে চারুলতার স্বামী ভূপতিকে মনে আছে? অনেক কষ্ট করে একটি খবরের কাগজ ছাপতে হতো তাঁকে। সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের ঠিকঠাক খবর তো বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎদের কাছেও পৌঁছয়নি। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলার মানুষ চার্চিলের নীতিতে যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন হঠাৎ স্টেটসম্যান পত্রিকা ব্রিটিস সরকারের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে সেই খবর ছেপে দিয়েছিল। লন্ডনে যখন সেই খবর পৌঁছলো তখন সমালোচনার মুখে পড়ে ব্রিটিস সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল, নইলে পোকামাকড়ের মতো মানুষের মৃত্যু সংবাদও চাপা পড়ে ছিল। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব কিংবা ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের খবরও এদেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছিল ধীরে ধীরে, বিক্ষিপ্তভাবে, ধোঁয়াশা মেখে। কিন্তু সেসব দিন তো ইতিহাস। রেডিও, স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং সর্বশেষে ইন্টারনেট মাধ্যম এসে যাওয়ার পরে দুনিয়া তো হাতের মুঠোর মধ্যে। এখন আফগানিস্তানে তালিবানরা কাকে কীভাবে মারছে সারা দুনিয়ার মানুষ ঘরে বসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে যাচ্ছি। নেটওয়ার্কড দুনিয়ায় আমেরিকায় বসা আত্মীয়ের সঙ্গে আমরা অনলাইনে ভিডিও চ্যাট করে নিতে পারছি। টিভিতে ২৪ ঘন্টা যুদ্ধ কিংবা খেলার লাইভ কভারেজ দেখতে পাচ্ছি, ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়াকে রোমাঞ্চকর সিনেমার মতো দেখছি, বাড়িতে বসে জোমাটোয় অর্ডার দিয়ে আধ ঘন্টায় খাবার আনিয়ে নিচ্ছি, প্রয়োজনে মোবাইল ফোনে অ্যাপক্যাব ডেকে নিচ্ছি, ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে অনলাইনে ক্লাস করে নিচ্ছে, বাবা মা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে নিতে পারছে, আরও কত কি!

এই প্রবনতাটা বুঝে নিয়েই ১৯৭৩সালে সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল বলেছিলেন, আমরা এখন তথ্য সমাজে প্রবেশ করেছি। কৃষিভিত্তিক সমাজ, শিল্পসমাজ পেরিয়ে এই সমাজে এখন তথ্যের অবাধ বিচরণই অর্থনৈতিক কারবারের মুখ্যভিত্তি। তথ্যই শক্তি। তথ্যই আনবে মুক্তি। সেই তথ্যের সুষম বন্টনের সুযোগ খুলে গেছে। ইন্টারনেট আসার পরে সবাই বলতে লাগলেন, এটাই সত্যি। অন্যদিকে সাত ও আটের দশকেই রাষ্ট্রসংঘের ইউনেস্কোর মঞ্চ থেকে আরেকদল সতর্ক করছিলেন, দুনিয়ায় তথ্যের প্রবাহে ভারসাম্যের গুরুতর অভাব ও বৈষম্য রয়েছে এবং সেই কারণে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ভারতসহ এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এই অভিযোগই করছিল উন্নত ধনী দেশগুলির বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের কথা চাপা পড়ে গেলো বিশ্বায়নের ধাক্কায়।

এখন আর তথ্যের আকাল নেই, তথ্যের সমুদ্রে আমরা ভাসমান। তথ্য আদান প্রদান এতই নাকি সহজ ও সস্তা যে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমুদ্রে ভাসমান নৌকার সেই মাঝির মতো যার কাছে এক ফোঁটা পানীয় জলও নেই। চারিদিকের অফুরান নোনা জলরাশি তাঁর তৃষ্ণা মেটানোর উপযোগী নয়। আমরাও তেমনি বিপুল তথ্যরাজির মধ্যে বসে আছি, চাই না চাই প্রতি মুহূর্তে আমাদের কাছে তথ্য এসে ভীড় করছে, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন মেটাতে সেটা সাহায্য করছে না। বরং অপ্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সদাব্যস্ত থাকতে থাকতে জীবনের প্রয়োজনটাকেই মাঝেমাঝে ভুলে যাচ্ছি, অবহেলা করে ফেলছি। যখন আমাদের রোজগার বাড়ানোর উপায় দরকার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুবন্দোবস্ত করা দরকার, অসুস্থ বাবা মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার, তখন আমরা ফিল্ম স্টার সাংসদ নুসরৎ জাহানের সন্তানের পিতার নাম জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। পুজোয় কোন তারকা কোন পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন করবে তা নিয়ে ফের চর্চা শুরু হয়ে গেছে। একটা অতিবর্ষণে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের জলমগ্ন জেলাগুলিতে ১৩জন শুধু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলো। কেন পরিকাঠামোর এই হাল, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কী করা জরুরী, তা নিয়ে ভাবার মতো তথ্য পাচ্ছি কোথায়? মোদীর জন্মদিনের তথ্য পাচ্ছি, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলানোয় কিংবা স্কুল কলেজ খোলার প্রচেষ্টায় উপেক্ষা সংক্রান্ত তথ্য কোথায়? দুয়ারে সরকারের বিজ্ঞাপন তো প্রচুর দেখলাম, কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড নিয়ে বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা মিলছে কিনা সেই তথ্য কোথায়?

তথ্য প্রয়োজন মেটাবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে তথ্যের পূর্ণাঙ্গতার ওপরে, ঝিলিক মেরে উবে যাওয়া তথ্যে কাজের কাজ হয় না। ব্রেকিং নিউজ একটা আসে, চাপা পড়ে যায় আরেকটা ব্রেকিং নিউজের তলায়। তথ্য বিশ্লেষণ করে তার মূল্যায়ন করার বন্দোবস্ত না থাকলে এমন তথ্য দিয়ে লাভ নেই। যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমরা রয়েছি এবং যারা সেই ব্যবস্থা চালাচ্ছেন, সেসবের মূল্যায়নই যদি না করতে পারলাম তাহলে আমি সিদ্ধান্ত নেবো কীভাবে! কেবল জয়ধ্বনি দেওয়ানোর জন্য আমাকে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না তো? অবাধ তথ্যের স্রোত যে মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিল, সেটাই আসলে বাঁধনের মতো চেপে বসছে না তো? তাহলে তো প্রতিবাদ হওয়ার কথা। তেমন প্রতিবাদ হচ্ছে কই! তথ্যের এমন শক্তিশালী নেটওয়ার্কে আমরা আছি যে চরম নিঃসঙ্গতায় ডুবে প্রতিদিন হতাশাগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার খবর পাচ্ছি, মানুষের হাতে হাত রাখার মতো মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না। কাছাকাছি আসার ছলে দূরত্বকে এতটাই বাড়িয়ে ফেলছি যে প্রতিবাদে সংগঠিত হওয়ার সুযোগগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজের রূপান্তর শুধু প্রযুক্তির পরিবর্তন নয়, সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনও। ক্ষমতা ও সম্পদের মালিকানা সংক্রান্ত পরিবর্তন, সামন্ত সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে পরিবর্তন। তথ্য সমাজ কিন্তু এখনও এই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বরং পুঁজিবাদী সমাজ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে তথ্যের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই তথ্যের হিমালয় পর্বত হাজির, তাতে বিশল্যকরণী খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তথ্যকে ব্যবহার করছি না, তথ্যই (আসলে তথ্য সরবরাহকারীরা) আমাকে ব্যবহার করছেবাজারে গিয়ে আমি কী কিনবো, কী গান শুনবো, কাকে ভোট দেবো, সবকিছু অলক্ষ্যে কেউ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নতুন ধরনের ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছি, যেখানে কোনো শিকল লাগে না।

তবুও, মানুষ তো শেষপর্যন্ত মানুষ, প্রশ্ন তোলার স্বভাব কি সে এত সহজে ছেড়ে দেবে? শিকল ভাঙার গান লুকিয়ে আছে মানুষের এই প্রশ্ন তোলা স্বভাবের মধ্যেই। যে যন্ত্র, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা তথ্য পাচ্ছি তার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তুলে তাকে যতো চিনবো, জানবো, ততই সচেতন হয়ে যাবো দাসত্ব সম্পর্কে। আর সচেতনতা ভেঙে ফেলতে পারে এই নতুন দাসত্বকে।

 গণশক্তি, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১