20200721

মমতাই প্রমাণ করেছেন ‘২১শে জুলাই’ এক ধাপ্পার দিন!


চন্দন দাস


‘২১ শে জুলাই’-র মামলা এখনও চলছে। সরকার মামলা প্রত্যাহার করেনি। ‘২১শে জুলাই’ কমিশন গড়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে। সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ‘২১ শে জুলাই’-র হলফনামা পেশকারী মনীশ গুপ্তকে নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ পর্যন্ত বানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু ‘২১শে জুলাই’-র কমিশনের সুপারিশগুলির কিছুই করতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রথম ‘২১শে জুলাই’-এ কিছু ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। যেমন ‘দু’ বছরে দশ লক্ষ চাকরি দেবো।’ ন’ বছর কেটে গেছে। সেই প্রতিশ্রুতিও পালিত হয়নি। গত ন’ বছরে পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ প্রচুর কমেছে। ২০১১-র ‘২১ শে জুলাই’-এ একটি চমৎকার শপথ বাক্য নেতা, কর্মীদের পাঠ করিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বলেছিলেন, ‘‘..বিশৃঙ্খলা কিন্তু বরদাস্ত করা হবে না। বলুন, চুরি করবেন না। কেউ অন্যায় করলে আটকাবেন।’’ সেই ঘোষণা এখন একটি মস্করায় পরিণত হয়েছে। এখন মমতা ব্যানার্জি ভুল করেও এই কথা মুখে আনেন না। সেই ‘২১ শে জুলাই’ থেকে গত ন’ কতরকমভাবে চুরি করা যায় তা দেশকে হাতে কলমে শিখিয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল। সব চুরিই ‘বরদাস্ত’ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। চুরি করে শাস্তি পেয়েছে এমন তৃণমূলীর অস্তিত্ব নেই রাজ্যে! বরং উল্টোটাই শোনা গেছে গত কয়েক বছর।


২০১৯-র ‘২১ শে জুলাই’-র আগে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসীদের কাটমানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল। ক্ষুব্ধ, ঠকে যাওয়া মানুষ তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের বাড়ি ঘিরছিল কাটমানি ফেরতের দাবি নিয়ে। চারিদিকে হুলস্থুল। রাজ্যের ভাবমূর্তিতে দেশময় কালি ছিটছে তখন। তেমন সময়ে, ২০১৯-র ‘২১শে জুলাই’-র মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বলতে শোনা গেছিল ২০১১-র উলটো কথা। সেদিন তিনিই বলেছিলেন, ‘‘টাকা চেয়ে তৃণমূলের লোকজনের বাড়ি গেলে এবার আমরা স্ট্রং ব্যবস্থা নেবো।’’ অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ, প্রতারিত মানুষের বিরুদ্ধেই পুলিশী, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আরও কী বলেছিলেন গত বছর? কাটমানি নিয়ে ভাষণ দিতে দিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘...বলছে নাকি আমাদের লোকদের টাকা ফেরত দিতে। ওরা বলছে কাটমানি ফেরত দাও। কতগুলো কুঁচো চিংড়ি আর কতগুলো ল্যাটা মাছ, তাদের আবার বড় বড় কথা।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের চোর নেতা, কর্মীদের কাটমানি দিয়ে প্রতারিত মানুষকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন ‘কুঁচো চিংড়ি’ আর ‘ল্যাটা মাছ।’


এবার কাটমানির ইস্যুই আছে। তবে আরও বড় আকারে। গত এক বছরে কাটমানির সঙ্গে জুড়েছে করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের জন্য বরাদ্দ চাল লুট, আমফানে বিধ্বস্ত মানুষের ত্রিপল, চাল চুরি, আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ টাকা দেদার লুট, পান বরোজের ক্ষতির টাকা চুরি — এমন নানা তৃণমূল কংগ্রেসী তস্করবৃত্তি। এই চুরিগুলিকে ইতিমধ্যেই নবান্নে সরকারী চেয়ার থেকে মমতা ব্যানার্জি  ‘তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে রেখেছেন। এবার ‘২১ শে জুলাই’-র দলীয় মঞ্চ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এই জালিয়াতিগুলিকে কী বলেন, তা মঙ্গলবারই স্পষ্ট হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৮-তে দখলের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের ‘২১ শে জুলাই’-এ তৃণমূল কংগ্রেসের বার্তা ছিল,‘‘তৃণমূল দখল করবে দিল্লি, দিদি হবেন প্রধানমন্ত্রী।’’


গত বছর, অর্থাৎ ২০১৯-র ‘২১শে জুলাই’-এ মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন,‘‘২০২১’র ভোট দেরি আছে। পরের বার বলব।’’ অর্থাৎ মঙ্গলবার তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর আগামী বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বলার কথা। আশা করা যায় বলবেন। গতবছর তিনি দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,‘‘কানে কানে সবাইকে বলে দেবেন, তৃণমূল ভয় পায় না।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা প্রকাশ্যে, চুরির দায়ে কান মুলছেন, হাত জড়ো করে ক্ষমা ভিক্ষা করছেন, বাঁশবাগানে লুকিয়ে রাত কাটাচ্ছেন — এসব রাজ্য দেখেছে গত কয়েক মাসে। মানুষের বিক্ষোভের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে — কানে কানে নয়, সারা রাজ্য জোরে জোরে বলছে এই কথা। এবার মমতা ব্যানার্জি দলের নেতাদের ভোট লুটের যোগ্য করে তুলতে কী ভোকাল টনিক দেন — সেটাই প্রধান আকর্ষণ মঙ্গলবারের ভার্চুয়াল সভার।


কিন্তু ’২১ জুলাই’-র কমিশন, মামলার কী হলো? আর কিছু না পারুন, তার কোনও হিল্লে করবেন মমতা ব্যানার্জি — এটা আশা করাই যায়। তাও পারেননি স্বঘোষিত অগ্নিকন্যা১৯৯৩-র ২১শে জুলাই ধর্মতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, মনীশ গুপ্ত সেই ঘটনা সম্পর্কে হাইকোর্টে হলফনামা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামায় বলা হয়েছিল,‘ওই দিন (১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী (অ্যান্টিসোশ‌্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল।’ তারা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। ‘জনতা’ পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ। পরে রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। মনীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিল। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিসি (সদর), ৭জন ডিসি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিসকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিল। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর একে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। অর্থাৎ সেদিন ‘আন্দোলনকারীরা’ বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিল! তারা মহাকরণ দখল করতে ছুটছিল। গুলি ছুঁড়ছিল, বোমা মারছিল।

সেদিন সাংবাদিকও পিটিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির দলবল। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী ওই সাংবাদিক, সঈদ আহমেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিল। মারাত্মক আহত হন তিনি। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি অভিযোগ পুলিশ দায়ের করে। একটি পার্ক স্ট্রিট থানায়। আর একটি হেস্টিংস থানায়। অভিযোগের মধ্যে ছিল সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, অস্ত্র আইন লঙ্ঘন, খুনের চেষ্টা, পুলিশকে মারধর ইত্যাদি। সেদিন রেডরোডে, ছদ্মবেশে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকানোর চক্রান্ত হয়েছিল, তা জানা গেছে সোনালি গুহর লেখায়। সেই ‘দায়িত্ব’ সোনালি গুহদের নিজের বাড়িতে ডেকে দিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি। তিনি এখন মুখ্যমন্ত্রী। সেদিনের ঘটনা সংক্রান্ত দুটি মামলা আজও চলছে। সাতাশ বছর। অভিযুক্তদের আইনজীবী অলোক কুমার দাস সোমবার জানিবেছেন, ‘‘মামলাটি এখনও চলছে। তারিখ পে তারিখ চলছে। চিহ্নিত ১৫-১৬ জন এখনও হাজিরা দেন ডেট পড়লে। আমি আদালতের কাছে এবং রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি মামলটা খারিজ করতে।’’ এই আইনজীবী দু’বার তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আইনমন্ত্রীদের কাছে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া কিছুই জোটেনি।


‘২১ শে জুলাই’-র প্রয়োজন ফুরিয়েছে চম্পলা সর্দার, কিষেণজীর মত। ফলে সেদিনের স্বরাষ্ট্র সচিব মনীশ গুপ্তর মন্ত্রী, সাংসদ হওয়া হয়ে গেলেও মামলায় ‘তারিখ পে তারিখ’ থামছে না। মমতা ব্যানার্জির ঘোষণা ছিল ‘২১শে জুলাই’-এ ঘটনায় ‘দায়ী’ সিপিআই(এম) নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ কর্মীদের শাস্তি দেবেন। এখন সে কথা বলেননও না। সিপিআই(এম)-কে কিছু করতে হয়নি। মমতা ব্যানার্জিই প্রমাণ করে তুলেছেন — ‘২১শে জুলাই’ এক বিরাট ধাপ্পার দিন!


 ২০ জুলাই, ২০২০ 

20200720

সমমর্যাদা, স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলুক ভারত



পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকায় সম্পাদকীয়
---------------------------------------

      
নয়াদিল্লি, ২৭ জুন— সমমর্যাদা ও স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলার দৃঢ়তা থাকতে হবে ভারতের। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাস্তবতা বুঝতে হবে, দেশের মূল স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। মার্কিন রণনীতির অংশ হওয়া ভারতের স্বার্থরক্ষায় অনূকূল নয়। ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ সম্পর্কে এই অবস্থান জানিয়েছে সিপিআই(এম)। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে এই অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গালওয়ান নদীর উপত্যকায় সীমান্ত সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের প্রাণহানি স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর মনে ক্রোধের সঞ্চার করেছে। এই ঘটনা মর্মান্তিক, নিন্দাযোগ্য। বিশেষ করে ৬ জুন উভয় পক্ষের পদস্থ সামরিক অফিসারদের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা হ্রাস ও সেনা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হওয়ার পরেও এই ঘটনা ঘটেছে। ১৫ জুন রাতে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে কোন পরিস্থিতিতে শারীরিক সংঘাত ঘটল তার অনেক কিছুই আজও অজানা। সরকার সে বিষয়ে স্পষ্টতা দিতে কোনও উদ্যোগই নেয়নি।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলই বলেছে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেশ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে লাদাখের চলতি সমস্যা এবং আমাদের অবস্থান কী ছিল তা নিয়ে কোনও প্রশ্নই করা যাবে না। যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। তাহলেই সরকার এবং দেশ সামনের দিনে এগতে পারবে।

পিপলস ডেমোক্র্যাসি বলেছে, ১৭ জুন ভারত ও চীনের বিদেশ মন্ত্রীদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়। নিজেদের অবস্থানের কথা দু’দেশই বলে। কিন্তু তারপরেও তাঁরা এই মতৈক্যে পৌঁছায় যে, দায়িত্বশীলভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করা হবে, উভয় পক্ষই ৬ জুনের সেনা সরানোর সমঝোতাকে আন্তরিক ভাবে রূপায়ণ করবে। তাছাড়াও, ‘উভয় পক্ষই এমন কিছু করবে না যাতে উত্তেজনা বাড়ে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও প্রোটোকল মেনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।’ সর্বদলীয় বৈঠকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সিপিআই(এম) সমর্থন করেছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ ও সামরিক প্রত্যাঘাতের জিগিরমুখী আওয়াজকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যে রাজনৈতিক মনোভাবেরই হোন না কেন, কোনও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এই রকমের অবাস্তব ও অপরিণত অবস্থানের শরিক হতে পারেন না।

আরও কেউ কেউ বলছেন চীনের সঙ্গে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সমস্ত চুক্তি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সীমান্ত প্রশ্নে একাধিক চুক্তি হয়েছে। ১৯৯৩সালে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চুক্তি হয়। এরপরে ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১৩, ২০১৫-তে আরও চুক্তি হয়েছে। কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় সরকারের আমলেই এই চুক্তিগুলি হয়েছে। এইসব চুক্তি এবং তার অধীনে মতপার্থক্য ও সংঘাত মোকাবিলার যে ব্যবস্থার কথা স্বীকৃত হয়েছিল তার ফলেই হিমালয়ের উচ্চতায় শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালে শেষ সশস্ত্র সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছিল। এই সমস্ত প্রয়াসকে একবারে নস্যাৎ করে দেওয়া ভুল হবে। বরং, দরকার হলো অতীতের এই চুক্তিগুলির ওপরে আরও শক্তপোক্ত চুক্তির দিকে যাওয়া।

এখন সামনে এগতে হলে আশু করণীয় কাজ উত্তেজনা প্রশমন। তা করতে গেলে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করতে হবে। কিন্তু তার জন্য স্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদী স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিভঙ্গি চাই।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, লাদাখের সমস্যাকে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন ‘সালামি স্লাইস’ বা অল্প অল্প কেটে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতিতে ভারতীয় ভূখণ্ড নিয়ে নিতে চাইছে চীন। কিন্তু কেবল কিছু এলাকা দখলের চেষ্টা হিসাবে এই ঘটনাকে দেখা ঠিক হবে না। সীমান্তে এই গোলমালের পিছনে গভীরতর কারণ রয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সাধারণ সংঘাতের বাইরেও ভূ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আরও মৌলিক ব্যাপার হলো, ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কিছু মাত্রায় অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে

পিপলস ডেমোক্র্যাসি বলেছে, চীনের তরফে মর্মান্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ভারত সরকারের অবস্থানও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দেওয়া এবং জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার প্রতিক্রিয়া পড়েছে দেশের বাইরেও। চীন তাদের অবস্থান থেকে এই ঘটনাকে দেখেছে। চীন দু’বার ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে চীনের দাবি রয়েছে এমন এলাকায় প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন হিসাবেই এই পদক্ষেপকে তারা দেখছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বেসরকারি বৈঠকে চীন এই প্রসঙ্গ তোলার পরেও ভারত সরকার এড়িয়ে গেছে।

এই পদক্ষেপ নিয়ে সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীদের রাজনৈতিক চমক দেখানোর চেষ্টাও প্রভাব ফেলেছে। ৬ আগস্ট জম্মু কাশ্মীর পুনর্গঠন নিয়ে সংসদে আলোচনার সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, ‘‘আমি নথিভুক্ত করে রাখতে চাই যখনই আমি সংসদে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য বলব তার মধ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং আকসাই চিন অন্তর্ভুক্ত।’’ গত সেপ্টেম্বরে বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ‘একদিন পাক অধিকৃত কাশ্মীর বাস্তবেই দখলে আসবে’ বলে মন্তব্য করেন।

সিপিআই(এম)’র মুখপত্র বলেছে, মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার প্রথম বছরে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই রণনীতির লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় আঁতাতকে গত সেপ্টেম্বরে মন্ত্রীপর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময়ে চার দেশের বিদেশ মন্ত্রীরা বৈঠকে বসেছিলেন।

চলতি মহামারীর সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য মার্কিন উদ্যোগের সঙ্গেই ভারত সুর মিলিয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মার্কিন অভিযোগের প্রতিধ্বনি করে দাবি করেছেন চীনের গবেষণাগারে করোনা ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে।
এসবই লাদাখে সমস্যাকে বাড়িয়েছে বলে মনে হয়। দৌলতবাগ ওল্ডি পর্যন্ত সড়ক ও তার উত্তরমুখী শাখা সড়ক নির্মাণ ভারত বৈধভাবেই করেছে সীমান্ত পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য। কিন্তু চীন এখন তা পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সরকারকে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন আমাদের প্রতিবেশিদের সঙ্গে সমস্যা বাড়ছে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে জটিল সীমান্ত সমস্যা তো রয়েইছে, নেপালও এখন কালাপানি এলাকা নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। আরেক বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশি বাংলাদেশ ক্রমাগত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বাগাড়ম্বর এবং সিএএ-এনআরসি পরিকল্পনায় এইসব ‘ঘুনপোকাকে’ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় অস্বস্তির বৃত্তে পড়ে গিয়েছে। এসবই চীনের নকশার ফলে হচ্ছে, একথা ধরে নেওয়া নিজেকেই মোহাবিষ্ট করার শামিল। বাস্তব হলো, বিজেপি-আরএসএস’র অতি জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।

সিপিআই (এম)’র মুখপত্রে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে চলতি সংঘাতের সমাধান ছাড়াও বকেয়া সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে ভারতকে। উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপেই তা সম্ভব। চীন সম্পর্কে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এমকে নারায়ণন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে সম্প্রতি সওয়াল করেছেন ভারতের স্বার্থ সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে হলে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে ভারতের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া উচিত। পশ্চিমী শক্তিগুলির অনুরাগী স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ ও দালালদের ক্রমবর্ধমান দাবির তুলনায় নারায়ণনের পরামর্শ অনেক বিবেচনাপ্রসূত। মোদী সরকার মার্কিনীদের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কও বাড়িয়ে চলেছে। সরকারের ভেবে দেখা উচিত চীনের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হবে কিনা।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সমমর্যাদা ও স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলার দৃঢ়তা থাকতে হবে ভারতের। আমাদের মূল স্বার্থ পরিত্যাগ করার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। দরকার এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করতে সক্ষম।

গণশক্তি, ২৮ জুন, ২০২০

আমতার ‘ডি ভ্যালেরা’ সমর মুখার্জি ছিলেন ‘গড’স্‌ ওন ম্যান’ : অজয় দাশগুপ্ত




জ্যোতি বসু প্রায়শই তাঁর সম্পর্কে বলতেন, উনি হচ্ছেন ‘গড’স্‌ ওন ম‌্যান’। ইংরাজী পরিভাষায় যার অর্থ হচ্ছে, সমস্ত দিক থেকে নিখুঁত একজন ব‌্যক্তি। পার্টি থেকে যখন সমর মুখার্জিকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি তা এতটাই নিখুঁত ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন যে তা সকলের কাছে শিক্ষণীয় ছিল। 

১৯৭১ সালে সমর মুখার্জি লোকসভায় পার্টির সহকারী দলনেতা থাকার সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন প্রকাশ কারাত। তিনিই সমর মুখার্জি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জ্যোতি বসুর এই মন্তব্যের কথা বলেছিলেন তাঁর শততম জন্মদিন উদযাপনের দিন। পরে তিনি তা পিপলস্‌ ডেমোক্রেসি পত্রিকায় লিখেছিলেন (Comrade Jyoti Basu used to say that Samarda is “God’s own man”.  This saying in English denotes a selfless person who has all the virtues of a good human being.)

আমতা পীতাম্বর হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সমর মুখার্জিকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল স্কুল থেকে। অপরাধ, গান্ধীজীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্র ধর্মঘট এবং গেটে পিকেটিং করা। তাঁর নেতৃত্বেই আমতার ছাত্ররা মদের দোকানে পিকেটিং করে, বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে আইন অমান্য করেছিল ব্রিটিশ পুলিস সমর মুখার্জি এবং তাঁর তুতো ভাই বারীন মুখার্জির বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তাঁদের এক বছর কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রেসিডেন্সি জেলে আটক করা হয়েছিল। এটাই ছিল সমর মুখার্জির প্রথম কারাবাস। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে সমর মুখার্জি এবং বারীন মুখার্জি আদালতে পালটা অভিযোগ করেন। ফলে ছয়দিন কারাবাসের পরই তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাবার ইচ্ছায় আবার স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করেনকিন্তু খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে বহিষ্কৃত ছাত্রকে কোনো স্কুলই ভর্তি করার সাহস পায়নি। এই সময়ে ১৯৩২ সালে হাওড়ার পানপুরে কৃষকদের এক সমাবেশে বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, সমর মুখার্জিকে বলেন, ‘তুমি তো আমতার ডি ভ্যালেরাতিনিই তখন লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে বউবাজার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে তাঁকে পাঠান। গিরীনবাবু সমর মুখার্জিকে তাঁর স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি করে নেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সমর মুখার্জি সিটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং ইউনিভার্সিটি লকলেজে ভর্তি হন।

১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার পর থেকে ৭৩ বছর ধরে পার্টি অফিস বা পার্টি কমিউনেই জীবন কাটিয়েছেন সমর মুখার্জি একজন কংগ্রেসকর্মী থেকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক, কমিউিনস্ট পার্টির সদস্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্পাদক, পার্টির রাজ্য কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিট ব্যুরো সদস্য, সিআইটিইউ-র সাধারণ সম্পাদক ইত্যাদি জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন সমর মুখার্জি। বিধায়ক, সাংসদ হয়েছেন, সংসদে দলের নেতাও ছিলেন দীর্ঘদিন। সাংসদ হিসেবে তাঁর মাসিক ভাতার অধিকাংশটাই পার্টি তহবিলে জমা দেওয়ার পরেও যা অবশিষ্ট থাকতো, সেই টাকাও প্রতিবছর কোনো এক সময়ে কখনো ৫০হাজার, কখনো ৬০হাজার টাকা পার্টি তহবিলে জমা দিয়ে দিতেন।  ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সেই টাকা তিনি কখনো ব্যয় করতেন না। রাজ্য দপ্তরেও এভাবে টাকা জমা দিতেন। এই অনুকরণীয় জীবনধারা ছিল শেষদিন পর্যন্ত 

আবার ওপার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের জন্য লড়াই করতে সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ (ইউসিআরসি) তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। উদ্বাস্তুদের ন‌্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে কখনো দিল্লি, কখনো কলকাতায় সরকারের কাছে গিয়ে হাজির হতেন তিনি। একজন পশ্চিমবঙ্গীয় হয়েও পুর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের স্বার্থে আজীবন তিনি যে লড়াই করেছেন, তা এককথায় অসাধারণ!

শেষদিকে, কলকাতায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিট ব্যুরোর বৈঠক হলে শীর্ষ নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন দিলখুসা স্ট্রিটের কমিউনে। ২০১০ সালের ৯জানুয়ারি ভিএস অচ্যুতানন্দন দেখা করতে গিয়েছিলেন কমিউনে। তারই একটি মুহূর্তের ছবি নিবন্ধে যুক্ত করা হয়েছে।

20200719

রাষ্ট্রনায়ক জ্যোতি বসু



রবীন দেব



জীবিত অবস্থাতেই জ্যোতি বসু ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন কিংবদন্তী (Living Legend) নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। শুধু বামপন্থী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনেই না, ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অর্ধশতবর্ষব্যাপী কাজ করার সুবাদে দেশের  ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো  ও যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের বিকাশে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তা জ্যোতি বসুকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছিল। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর আগেও বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এবং জীবনাবসানের পরেও দেশ-বিদেশের রাজনীতিক-বিশ্লেষকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে তাঁর এই ভূমিকার কথা। এই রকম একজন অসাধারণ কমিউনিস্ট নেতার জন্মশতবর্ষে তাঁর এই অবদানগুলি আলোচনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের শিক্ষিত করতে সাহায্য করবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একজন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েও সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তপ্ত প্রবাহে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন জ্যোতি বসু। বিলেতেই হাতেখড়ি কমিউনিজমের প্রথম পাঠের, সেখানেই সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হবেন। দেশে এসেই যোগ দিলেন পার্টির কাজে, শ্রমিকদের সংগঠিত করার যে কাজ তিনি শুরু করলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার থেকে কখনো বিযুক্ত হননি। জীবনের শেষ বছরগুলিতেও তিনি সি আই টি ইউ-র একজন নেতা হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠেছিল মতাদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, অসমসাহসী মনোভাব।

অসম্ভব পরিশ্রম করে ব্রিটিশ আমলে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার দুরূহ কাজে সাফল্য তাঁকে অল্পদিনের মধ্যেই নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। জ্যোতি বসু হয়ে উঠেছিলেন রেল শ্রমিকদের জনপ্রিয় নেতা। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন আসন্ন হলে কমিউনিস্ট পার্টি রেল শ্রমিক কেন্দ্রে সেই সময় নামজাদা কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে তাঁকে পার্টির প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে জ্যোতি বসু এই কেন্দ্রে জয়ী হন। সংসদীয় রাজনীতিতে সেই থেকে শুরু - মাঝখানে বাহাত্তরের জালিয়াতি নির্বাচনের পাঁচ বছর বাদ দিলে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা ৫০ বছর ধরে মানুষের রায়ে নির্বাচিত হওয়ার অনন্য নজির তিনি গড়েছেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন থেকে ২০০০সালের ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত লাগাতার ৮৫৪০দিন ধরে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার বিরলতম নজিরও তিনি গোটা দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে, ক্ষমতায় যেনতেন প্রকারেণ টিঁকে থাকার জন্য ভারতের রাজনীতিতে যখন আত্মসর্বস্বতার নিকৃষ্ট উদাহরণ আকছার মিলছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিয়ে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে আত্মত্যাগের নজিরবিহীন উপমা তুলে ধরেছেন জ্যোতি বসু।

ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে শ্রমজীবী মানুষের কন্ঠস্বর তুলে ধরার অনন্য পথিকৃৎ ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় এবং পরে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টির অপর দুই বিধায়ক কমরেড রতনলাল ব্রাহ্মণ ও কমরেড রূপনারায়ণ রায় (স্বাধীনতার পরে পূর্ব পাকিস্তানে)-এর সাথে কমরেড জ্যোতি বসু শ্রমিক-কৃষকসহ সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কথা মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাইরে মাঠে-ময়দানে জমি-ফসলের আন্দোলন এবং কলে-কারখানায় রুটি-রুজির আন্দোলনের সার্থক প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন আইনসভার অভ্যন্তরেস্বাধীনতার পর প্রথমে প্রফুল্ল ঘোষ এবং পরে বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভার বিরোধী দলের নেতা হিসাবে জ্যোতি বসু বিধানসভার বিভিন্ন বিতর্কে যে তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার যুক্তিসহ বক্তব্য পেশ করেছেন, বাইরের আন্দোলনেও তা সাহায্য করেছে কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তিকে প্রসারিত করতে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে দীর্ঘসময় থাকার কারণে জ্যোতি বসুকে কখনো বিরোধী দলের বিধায়ক, কখনো বিরোধী দলের নেতা, কখনো উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা শুধু তত্ত্বগতভাবেই নয়, বাস্তবেও তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরেছেন। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায়, সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করায় তিনি যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সেই সময়ের বিধানসভার অধিবেশনের কার্যবিবরণী দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন।

স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, তা রাজ্যে রাজ্যে এবং পরবর্তীতে গোটা দেশের ক্ষেত্রে খর্ব করতে কোয়ালিশন পলিটিকস্‌বা জোট রাজনীতির কৌশল প্রয়োগ করার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার পিছনে ছিল এই রাজনীতিই--ছিল কমিউনিস্টদের কৌশল। ১৯৬৭ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের ৮টি রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকার কায়েম হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালাতে কংগ্রেসবিরোধী দলগুলির মধ্যে সি পি ‌আই (এম)-ই প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। কেরালাতে সি পি আই (এম) নেতা কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ-ই মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সি পি ‌আই (এম) ৪৩টি আসন পেলেও যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে ৩২টি আসন পাওয়া বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখার্জিকেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৬৯ সালেও। সেবার সি পি ‌আই (এম) পেয়েছিল ৮০টি আসন। তা সত্ত্বেও জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে যুক্তফ্রন্টের কৌশল ও তার প্রয়োগ এবং সমস্ত সহযোগী দলকে একসাথে নিয়ে চলার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পরে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিকল্পের উদাহরণ তুলে ধরে অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলিকে একই মঞ্চে সমবেত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। সে আলোচনায় পরে আসছি।

১৯৬৭সালে প্রফুল্ল ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটেছিল। নেমে এসেছিল চরম আক্রমণ। রাজপথে এই আক্রমণের সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দান করেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৬৭ সালের ২রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিনে অজয় মুখার্জিকে সামনে রেখে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটাবার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিলে মিছিলে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনরোল তৈরি হয়। পিছু হটে ষড়যন্ত্রকারীরা, অক্টোবরে প্রফুল্ল ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে, পি. ডি. এফ-এর একটি সরকার গঠিত হয়। কিন্তু বিধানসভার তদানীন্তন স্পীকার বিজয় ব্যানার্জির ঐতিহাসিক রুলিং-এ সরকারের পতন ঘটে। জারি হয় রাষ্ট্রপতির শাসন।

প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন থেকে ১৯৬৯সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার কায়েম (যে নির্বাচন রাষ্ট্রপতি শাসনেই হয়েছিল) ১০৫ থেকে কংগ্রেসের আসন নেমে গিয়েছিল ৫৫-তেএই পর্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে রাজ্যের বুকে। ভাঙা-গড়া হয়েছে শরিকদলগুলিতে। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের সময়েও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, ১৯৬৯ সালের ৩১শে জুলাই বিধানসভা ভবনে উপমুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিসমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরে একদল উন্মত্ত পুলিসের হামলা। কিন্তু জ্যোতিবাবুর অসমসাহসী ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের সামনে সেই পুলিসের দল পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পরেও বাংলা কংগ্রেস ছাড়া বাকিদের নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ার সুযোগ থাকলেও কেন্দ্রের নির্দেশে জ্যোতি বসুকে সরকার গড়ার জন্য ডাকা হয়নি। ডাকেননি তৎকালীন রাজ্যপাল। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তখন যে বামদলগুলি অন্ধভাবে সি পি আই (এম) বিরোধিতায় নেমেছিল, তাদের জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সরকার গড়ায় সমর্থন জানাতে আকুল আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সাড়া দেয়নি কিছু বামদল।

এরই মাঝে উগ্রপন্থী রাজনীতির সুত্রপাত হয় এই রাজ্যে। উগ্রপন্থীদের ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে সঠিক মার্কসবাদী পথ গ্রহণে প্রয়াত কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত ও কমরেড জ্যোতি বসু পালন করেছেন দৃঢ় ভূমিকা।

দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর রাজ্যজুড়ে প্রচার আন্দোলনের ঝড় ওঠে। নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। খুন, সন্ত্রাস, বিনা বিচারে আটক, মিথ্যা মামলায় জড়ানো সহ স্বৈরাচারী কাজ চলে ব্যাপকভাবে। তারই মধ্যে পাটনায় ১৯৭০ সালে ৩১শে মার্চ জ্যোতি বসুকে লক্ষ্য করে আনন্দমার্গীরা গুলি চালায়। জীবনবীমা কর্মী কমরেড আলি ইমাম নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে জ্যোতি বসুর প্রাণ রক্ষা করেন। পাটনায় জ্যোতি বসুর উপর এই আক্রমণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রাজ্যজুড়ে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পালিত হয় ধর্মঘট। আমার এখনো মনে পড়ে সেই দিনটির কথা আগরপাড়ায় দেবেন সেন রোডে দাদার বাড়িতে সংবাদপত্র পড়ছিলাম। সংবাদ জানার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। ছাত্রকর্মী হিসাবে স্কুল ছাত্রদের নিয়ে সংগঠিত হয় বিশাল মিছিল। সামিল হন অগণিত মানুষ। পরের দিন শহীদ মিনারে বিশাল সমাবেশে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্ত হয় তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার।

ছাত্র-যুব আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে জ্যোতি বসুকে ১৯৬৫ সাল থেকে প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ে নানা সময়ে যেভাবে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি, তা এই প্রবন্ধে সবটা বিবৃত করা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে ২০শে ফেব্রুয়ারি হেমন্ত বসুকে হত্যা করে জ্যোতি বসুকে সেই বছরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেয়নি দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়ার শক্তি। সেবারও জ্যোতি বসু বরাহনগরে জয়ী হয়েছিলেন মহাজোট প্রার্থী অজয় মুখার্জিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেই। সি পি ‌আই (এম) নেতৃত্বাধীন ৬দলের জোট ১২৩টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও জ্যোতি বসুকে সরকার গড়তে ডাকেননি রাজ্যপাল। অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হয় এবং ৭১দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটে।

১৯৭২-এ সংসদীয় গণতন্ত্রকে কোতল করার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর লেখা ‘Subversion of Parliamentary Democracy’ নামে একটি পুস্তিকা দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ই জুন BBC থেকে এই মর্মে প্রচারিত হয় জ্যোতি বসুর বেতার ভাষণ।

১৯৭২থেকে ৭৭আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, জরুরী অবস্থার দিনগুলিতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে। বারুইপুরে কমরেড জ্যোতির্ময় বসুর সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিল জ্যোতি বসুর গাড়ী১৯৭৩ সালের ২৮শে মার্চ সিদো কানহু ডহরে বেকারী বিরোধী অবস্থানে অংশ নেন জ্যোতি বসু। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের ৩রা জুন শহীদ মিনারে সমাবেশ, ২৭শে জুলাই বাংলা বন্‌ধ, ১৫ই নভেম্বর আইন অমান্য, ১৭ই নভেম্বর বাংলা বন্‌ধ, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট, ৭ই মে বাংলা বন্‌ধ, রেলকর্মীদের ধর্মঘট, ১৯৭৫-এর ২০শে জুন বাংলা বন্‌ধ এবং ২৫শে জুন জরুরী অবস্থা জারির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সব সময়ই জ্যোতি বসু সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরই মধ্যে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী জোটে প্রফুল্লচন্দ্র সেনসহ অনেককে সামিল করা হয়েছে। ১৯৭৫-এর ২রা এপ্রিল সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ন কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সভা করতে এসেছিলেন, কিন্তু তখনকার কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখার্জিরা সেই সভা করতে দেননি। ভন্ডুল করে দেওয়া হয়। তখন তিনি এসেছিলেন কংগ্রেস (ও)-র ডাকে। পরে ১৯৭৫ সালের ৫ই জুন বামপন্থীদের ডাকে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে থেকে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী মহামিছিল সংগঠিত হয়েছিল, যেখানে জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে সংক্ষিপ্ত সভার সভাপতি ছিলেন ড. অশোক মিত্র। তিনিই মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯৭২ থেকে ৭৭, এই সময়ে বামপন্থীদের মধ্যে জোটে কয়েকবার ভাঙ্গাগড়া হয়েছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই বামফ্রন্ট তৈরি হয়েছে। প্রথমে ৬দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন সরকার গঠন করে। ১৯৮০ সালে সি পি আই যুক্ত হলো। পরে ৮দল এবং সর্বশেষে দশটি দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন জ্যোতি বসু। এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে এস পি, ডি এস পি প্রভৃতি দলগুলি। আজকের বামফ্রন্ট গড়ার প্রক্রিয়াতেও অনেক জটিলতার অবসান ঘটিয়েছেন জ্যোতি বসু। এইভাবে অজস্র ষড়যন্ত্র কুৎসা, অপবাদ, হুমকি, কারাবাস, মিথ্যা মামলা, সব কিছুকে ভেদ করেই জ্যোতি বসু ৮৫৪০দিন মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। ষড়যন্ত্র কুৎসা অপপ্রচারের জালকে যেমন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছেন, তেমনি উদ্দীপ্ত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ছাত্র-যুব-মহিলা আন্দোলনকে। পুষ্ট করেছেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে, আমাদের দেশের ও আমাদের রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বাস্তবানুগ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। প্রায় ২৪বছরের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে গণসংগঠনগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে কাজ করার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করছেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৮সালের বন্যা, বন্যা পরবর্তীতে উদ্ধার, ত্রাণ, পুণর্বাসন, পুনর্গঠনের কাজে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তি ও উগ্র বামপন্থীদের কাছ থেকে ছাত্র-যুবসহ শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে সঠিক দিশাদানে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেছে জ্যোতি বসুর বক্তব্য, কর্মকাণ্ড, পরামর্শ প্রভৃতি।

এই রাজ্যে শিল্পস্থাপনে নতুন জোয়ার সৃষ্টিতে বহু বিতর্কের মধ্যেও সঠিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৮সালে হেমবতী নন্দন বহুগুণা সম্মতি দিলেও ১৯৮৪ সালের ৬ই জুলাই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার পেট্রোরসায়ন দপ্তরের মন্ত্রী পি শিবশংকর এই রাজ্যে পেট্রোকেমিক্যাল হবে নাএই ঘোষণা করলেন। পরবর্তীতে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জ্যোতি বসুর সরকার-তা নিয়েও বহু বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করেছি যুব তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মাদনা। ১৯৮৫ সালের ১৪-১৯শে সেপ্টেম্বর সল্টলেক থেকে হলদিয়া পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, ১৯শে সেপ্টেম্বর হলদিয়ায় পদযাত্রীদের উদ্দেশ্যে জ্যোতি বসুর দৃপ্ত ঘোষণা হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ হবেই১৯৮৯সালের ১৫ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জ্যোতি বসুকে সঙ্গে নিয়ে হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যালস্‌ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। যদিও পরে শোনা যায়-৩দিন পর নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে যোজনা পর্ষদের অনুমোদন না নিয়েই নির্বাচনী চমক সৃষ্টিতে তিনি এই কাজ করেছিলেন। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস্‌, বক্রেশ্বরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি দাবিতে ছাত্র-যুবদের উত্তাল আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন জ্যোতি বসু। ২০০০সালের ২রা এপ্রিল হলদিয়া পেট্রোকেমিক‌্যালস্‌ জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত করেছিলেন জ্যোতি বসু।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্যে সীমিত আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিকল্প কী কর্মসূচী নেওয়া সম্ভব হতে পারে তা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে হাতেকলমে সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছিল। দেশে জোট রাজনীতির যুগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর ধরে চলা ৯ দলের একটি দৃঢ় জোট হিসাবে বামফ্রন্ট সরকার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরেছিল। কারণ জোট সরকার মানেই যখন অস্থিতিশীল, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বলে প্রমাণ হচ্ছিলো, তখন এরাজ্যে এই জোট স্থিতিশীল, শান্তির পরিবেশ এবং জনমুখী উন্নয়নের নজির তৈরি করে গোটা দেশের সামনে একটি উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম তুলে ধরেছিল। একথা আজ সকলেরই জানা যে এরাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে অনুকরণ করেই গোটা দেশে তা রূপায়ণের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে। ভূমি সংস্কার, কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে। পাশাপাশি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, শান্তি-সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় ক্ষেত্রেও দেশের সামনে জ্যোতি বসুর পশ্চিমবাংলা উদাহরণ তৈরি করেছিল। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূলস্তরে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের সামনে মডেল হিসাবে স্বীকৃত।

শুধু জোট রাজনীতির প্রশ্নই নয়, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও সামনে তুলে এনেছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারই। রাজ্যগুলির হাতে আরো বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দাবিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের ইস্যুকে সামনে রেখে গোটা দেশে অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলি এবং বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসবিরোধী দলের দ্বারা পরিচালিত সরকারগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। শ্রীনগর, কলকাতা ও বিজয়ওয়াড়ায় বিরোধী দলগুলির কনক্লেভের নেতৃত্ব দেন তিনিই। কংগ্রেসের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙার লক্ষ্যে কোয়ালিশন রাজনীতির সূচনা এভাবেই তাঁর নেতৃত্বে ভারতে শুরু হয়েছিল। একটি রাজ্যের সফল ও জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনো প্রাদেশিকতার গন্ডির মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ না থাকায় জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা ও নেতৃত্বের আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের অখন্ডতা, সংসদীয় গণতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাঁর ঋজু ও দৃঢ় অবস্থান সমগ্র ভারতেই দল-মত-নির্বিশেষে উচ্চপ্রশংসিত হতো। ১৯৮৭ সালের ২৫শে এপ্রিল দিল্লির অন্ধ্র হলে বিরোধী দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে জ্যোতি বসু যে অসাধারণ বক্তব্য রেখেছিলেন, তার পরদিন তাঁর কট্টর সমালোচক আনন্দবাজার পত্রিকাও লিখতে বাধ্য হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রনায়কের মত বক্তব্য করেছেন জ্যোতি বসু।১৯৮৯ সালে ভি পি সিং-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকার গড়ারও অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। এই সময়েই ভারতে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেলসন ম‌্যান্ডেলা। ১৯৯০ সালের ১৮ই অক্টোবর ইডেন উদ‌্যানে বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং-এর উপস্থিতিতে জ্যোতি বসু সংবর্ধনা জানান ম‌্যান্ডেলাকে। এই সমাবেশ শেষেই ভি পি সিং এবং জ্যোতি বসু দিল্লিতে গিয়ে যৌথভাবে রথযাত্রার নামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি বন্ধ করতে আবেদন জানিয়েছিলেন বি জে পি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিকে। এই বছরেই ১৯শে মে কমরেড হো চি মিন-এর জন্মশতবর্ষে ভিয়েতনাম সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন জ্যোতি বসু। সঙ্গে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

জাতীয় রাজনীতিতে অকংগ্রেসী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর নেতৃত্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে রাজী হয়েছিল। এইচ ডি দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে সংযুক্ত মোর্চার সরকার গঠিত হলে গঙ্গার জলবন্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি করার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ-এর মধ্যে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

২০০০ সালের ৬ই নভেম্বর জ্যোতি বসু শারীরিক কারণে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। অবসর নিলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আমাদের রাজ্য এবং গোটা দেশের গণ-আন্দোলনে অন্যতম পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘কমিউনিস্টদের কাছে কোনো অবসর নেই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত‌্যাগ করা পর্যন্ত তাদের মানুষের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে।

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউ পি এ সরকার গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি এবং সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক হরকিষাণ সিং সুরজিৎ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেকথা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ইউ পি এ চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী বারেবারে স্বীকার করেছেন।  

২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারি জ্যোতি বসু শেষ নিঃশ্বাস ত‌্যাগ করেন। ২০১০র ১৯শে জানুয়ারি এক কমিউনিস্ট নেতার মরদেহ রাষ্ট্রীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রী, বিদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রনেতাদের ও তাঁদের প্রতিনিধিদের উপস্থি‍‌তিতে এক জনজোয়ারে শেষ বিদায় জানানো হয় কমরেড জ্যোতি বসুকে। সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় রেড রোড হয়ে উঠেছিল প্রকৃতই রেড রোড। জীবনাবসানের সময় সরকারী পদাধিকারী না হয়েও তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান দিয়ে গান-স্যালুটে শেষ বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এরপরেও কী তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক বলা যাবে না?

জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের পর তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা ও শোক জানাতে গিয়ে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতারা রাষ্ট্রনায়কহিসাবে তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন। দিল্লিতে বিদেশী অতিথি আসায় কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কলকাতায় আসতে পারেননি। কিন্তু প্রয়াত জ্যোতি বসুর শেষযাত্রার আগেরদিন দিল্লিতে সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় দপ্তরে গিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শোকপুস্তিকায় লিখে এসেছিলেন : ‘‘দেশ তার এক মহান সন্তানকে হারালো, যিনি ছিলেন এক মহান রাষ্ট্রনেতা ও মহান দেশপ্রেমিক। আমি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের এবং তাঁর অগণিত গুণগ্রাহীদের, কমরেডদের ও অনুগামীদের আমার গভীর শোকজ্ঞাপন করছি।’’ কলকাতায় এসেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া, ইন্দ্রকুমার গুজরাল, প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানিসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। ইউ পি এ-র চেয়ারপারসন ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও এসেছিলেন প্রয়াত জ্যোতি বসুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। বিশেষ বিমানে কলকাতায় পৌঁছে সোজা বিধানসভা ভবনে গিয়ে সেখানে শায়িত প্রবীণ জননেতার মরদেহে মালা দিয়ে শোকপুস্তিকায় তিনি লেখেন : ‘‘কংগ্রেস দল ও আমার নিজের পক্ষ থেকে কমরেড বসুর প্রতি আমি গভীর শোক জানাই। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী, দৃঢ়চেতা, দূরদৃষ্টি ও বাস্তববোধসম্পন্ন নেতা। তিনি দেশ, নিজের দল ও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর অভাব আমরা সকলেই অনুভব করবো।’’

শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ বিমানে কলকাতায় এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জ্যোতি বসুকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম অগ্রণী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বহিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর মৃত্যু শুধু ভারতের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিরাট ক্ষতি। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক।গভীর কৃতজ্ঞতায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা স্মরণ করেছিলেন, ‘১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়বসুর বিপুল সমর্থনেরকথা। সেইসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা ও উদ্যোগ শক্তিশালী করেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে।  প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে বিশেষ বিমানে একই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদও। ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ সেদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের ইতিহাসেও নজিরবিহীন ঘটনা।

কমরেড জ্যোতি বসু মানে জীবন্ত ইতিহাস। কমরেড জ্যোতি বসু মানে শুধু ভারতের নয়, এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা।এভাবেই প্রয়াত কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন শোক প্রকাশ করেছিলেন নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল। মাধব কুমার নেপাল বলেছিলেন, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাত দশকের ওপর রাজনৈতিক জীবন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আর আমাদের নেপালী জনগণের কাছে কমরেড জ্যোতি বসু প্রিয়তম, মহান বন্ধু।কলকাতায় চীনের কনসাল জেনারেল মাও সিওয়েই এক শোকবার্তায় বলেন, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ও চীনের মহান বন্ধু জ্যোতি বসুর জীবনাবসানে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।

কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে মানুষই ছিল শেষ কথা, জনগণই ছিল তাঁর শক্তির উৎস। তাঁর সত্তর বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম-আন্দোলন-ধর্মঘটে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কেবল যখন বিরোধীপক্ষের বিধায়ক বা বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তখনই নয়, যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী কিংবা বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও। মানুষের প্রতি অপরিসীম আস্থা ও ভালোবাসা থেকেই তিনি পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা। তাঁর এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যই তাঁর শেষযাত্রায় যেমন টেনে এনেছিল দেশ-বিদেশের নেতা-নেত্রীকে, তেমনি অগণিত সাধারণ মানুষকে। জ্যোতি বসুর জন্মশতবর্ষে তাঁর জীবনের এই উজ্জ্বল দিকগুলিকে বুকে আঁকড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলাই আমাদের দায়িত্ব। আগামীদিনে এটাই হোক আমাদের শপথ। 
*********