20200622

কর্মসংস্থানে দেশে শীর্ষে থাকা রাজ্যকে টেনে নামিয়েছেন মমতা




প্রসূন ভট্টাচার্য

পুরানো তথ্য, কিন্তু সেটাই নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাংলার বুকে কাজ না পেয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক যখন ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন কাজের খোঁজে এবং ভিনরাজ্যে গিয়ে লকডাউনের মতো বিপদে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তখন এক দশক আগের এনএসএসও’র তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার কর্মসংস্থানে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করেছিল। সিঙ্গুর সহ রাজ্যে শিল্পায়নে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগ যদি চালু থাকত তাহলে কি কাজের জন্য এমন স্রোতের মতো ভিনরাজ্যে যেতে হতো বাংলার যুবকদের? প্রশ্নটা নতুন করে উঠে আসছে এই চরম বেকারির বাজারে।

বামফ্রন্ট সরকারের শেষের ৬ বছরে রাজ্যে শিল্পায়নে, বিশেষত উৎপাদনমূলক শিল্পে রীতিমতো জোয়ার এসেছিল। রাজ্যের স্থিতিশীলতা, পরিকাঠামো বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষার প্রসার ও দক্ষ শ্রমিকের জোগান, গ্রামে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বামফ্রন্ট সরকার অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে উৎপাদনমূলক শিল্পে ব্যাপকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে সক্ষম হয়েছিল। এনএসএসও’র তথ্য অনুসারে ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সারা দেশে উৎপাদনমূলক শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৮ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। এর ৪০ শতাংশের বেশিই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদনমূলক শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৪ লক্ষ মানুষের।

উৎপাদনশিল্পে কর্মসংস্থানের পিছনে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের। কিন্তু সেগুলোর প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছিল রাজ্যে উৎপাদনভিত্তিক বড় শিল্প কারখানা গড়ে তোলায় বেসরকারি বিনিয়োগ টানায় সাফল্যের কারণে। বড় কারখানার উপস্থিতির জন্য রাজ্যে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি উৎপাদন করতে পেরেছে, বড়গুলির চাহিদা মেটাতে এবং বড়গুলির উৎপাদনের সাহায্যে নতুন উৎপাদনে। অর্থাৎ আপস্ট্রিম এবং ডাউনস্ট্রিমে। হলদিয়া পেট্রোকেম উপস্থিতিই এরাজ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পেরেছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে।

শিল্পবিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনায় সেই সময়ে সিঙ্গুরে অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তুলতে টাটা মোটরসের উদ্যোগ, শালবনী, পুরুলিয়া, খড়্গপুরে ইস্পাত শিল্প সহ বিভিন্ন শিল্পের উদ্যোগ চলছিল জোর কদমে। এর সঙ্গে পরিষেবা ক্ষেত্র এগচ্ছিল মূলত তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে কেন্দ্র করে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সালে বাংলা যখন কেবল উৎপাদন শিল্পেই ২৪ লক্ষ কর্মসংস্থানের সাফল্য দেখাতে পেরেছিল, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান তখন এক্ষেত্রে ছিল প্রথম। অনেকটা পিছনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল গুজরাট। সে রাজ্য ওই সময়কালে ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার কর্মসংস্থান করতে পেরেছিল উৎপাদনশিল্পে। এরপরে যারা ছিল সেই তামিলনাডু, পাঞ্জাব, কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্রে সংখ্যাটা ছিল ৪ থেকে ৬লক্ষের মধ্যে।

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্প মন্ত্রী নিরুপম সেন তখন প্রায়ই বলতেন, ‘টাটা মোটরসের গাড়িতে কে চড়বে সেটা আমাদের কাছে বড় কথা নয়, অটোমোবাইল শিল্পে এবং তার যন্ত্রাংশ সরবরাহের শিল্পগুলিতে এরাজ্যের হাজার হাজার বেকার ছেলেমেয়ে কাজ পাবেন এটাই আমাদের কাছে বড় কথা।’ সম্ভাবনাময় সেই বাংলায় তখন কাজের জন্য ভিনরাজ্য এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছিলেন। বিশেষত শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা রাজ্যেই ভালো (ডিসেন্ট) কাজের সন্ধান পাওয়ার আশা করছিলেন।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেল কীভাবে?

উত্তর আছে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ৮০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা গুজরাটে তাড়ানোর পাশাপাশি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন তিনি বাংলার ধ্বংসকার্য শুরু করেছিলেন। ২০১১ সালে ক্ষমতায় বসার পরে সেই ধ্বংসকার্যের ফলাফল দেখতে পাচ্ছেন। উৎপাদনমূলক শিল্পকে অর্থনীতির শক্তিশালী বুনিয়াদ বলা হয় এই কারণে যে এটা উদ্বায়ী চরিত্রের নয়। যখন খুশি মুনাফার লোভে সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যেতে পারে না, সংগঠিত শ্রমিকরা প্রাপ্যের জন্য সংগঠিতভাবে লড়াই করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু তৃণমূলের সিঙ্গুর আন্দোলনের ফলে বাংলার সেই উৎপাদন শিল্পের সম্ভাবনা ধংস হয়েছে। সিঙ্গুরের কারখানা হয়নি, শালবনী বা পুরুলিয়ার ইস্পাত কারখানাও হয়নি, পেট্রোকেমিক্যালসের প্রসারও ঘটেনি।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিধানসভায় বাজেট পেশ করে অর্থ মন্ত্রী অমিত মিত্র জানিয়েছিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত চলতি আর্থিক বছরে আমরা ৯ লক্ষ ১১ হাজার জনের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছি।’’ এভাবেই প্রতিবছর মুখ্যমন্ত্রীও মুখে মুখে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান করছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই কাজ দেখা যাচ্ছে না। এবারের বাজেট অধিবেশনেই শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক জানিয়েছেন, ‘‘২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ৫ হাজার ৫৮২।’’ 

এটাই হলো রাজ্যের অবস্থা। এরজন্যই রাজ্য ছেড়ে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন শহরের শিক্ষিত যুবরা এবং গ্রামের কৃষিক্ষেত্রে উপার্জনে ব্যর্থ যুবরা। ভিনরাজ্যে কখনো সাম্প্রদায়িক সমস্যার মুখে পড়ছেন, এবার লকডাউনের বিপদে পড়েছেন। কিন্তু ফিরে এসেও উপায় কী? কাজ নেই মমতা ব্যানার্জির বাংলায়, তাই ফের ভিন রাজ্যে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।

গত দশকের যে সত্যকে বিরোধী নেত্রী হিসাবে চাপা দিয়েছিলেন, এই দশকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাকে চেপে রাখতে পারছেন না মমতা ব্যানার্জি।

গণশক্তি, ২০ জুন, ২০২০



বামফ্রন্টের সাফল্য এবং লড়াই শত্রুদের চিরন্তন আতঙ্কের ভূত



মৃদুল দে

বামপন্থীদের সরকার পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭৭ সালে। ২১জুন প্রতিষ্ঠা দিবস একটা স্মরণীয় দিন উদ্‌যাপনের আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। ৩৪বছর টানা অনন্য সরকার, তার জন্যও নয়। চারদিকে প্রতিক্রিয়ার বেষ্টনি ও ষড়যন্ত্র, সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা, কেন্দ্রের সরকারের পদে পদে বৈষম্য, পুলিশ আমলাসহ গোটা যন্ত্র যেভাবে জনবিরোধী কাজে অভ্যস্ত তাদের বাধা, নানা শক্তির নাশকতামূলক কাজ, মিডিয়ার শত্রুতা এবং আদালতের ভূমিকায় জনমুখিনতার অভাব, কংগ্রেসের ত্রিশ বছরের শাসনের ব্যর্থতা ও অপকর্মের বিশাল বোঝা ইত্যাদি উত্তরাধিকার সূত্রে বইতে হয়েছে নতুন সরকারকে; এর মধ্যেই খোদাই হয়েছে অবিস্মরণীয় সাফল্য  হাজার চেষ্টা করেও প্রতিক্রিয়া, তাদের মিডিয়া, বর্তমান হিংস্র স্বৈরাচারী শাসন ভাঙার হাস্যকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে সারা দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা চাপিয়ে কংগ্রেস একচ্ছত্র ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে চেয়েছিল। তার বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশব্যাপী অ-কংগ্রেসী শক্তিগুলির অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পটভূমিতে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার গঠিত হয় এবং এরপরেই রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচন; প‍‌শ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। এবং আধা-ফ‌্যাসিস্ত সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটায়। এটাও সামগ্রিক মূল্যায়ন নয়, এভাবে রাতারাতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত গুণগত এক পরিবর্তনেও এই সরকার তৈরি হয়নি। এটাও নয় যে, শুধু নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ সরকার কালচক্রে স্থাপিত হয়েছিল; আছে এক দীর্ঘ অক্ষয় ঐতিহ্য।

পটভূমি
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিপ্লববাদী আন্দোলনের ধারা, পাশাপাশি বিরাট ভূমিকা পালন করে ব্রিটিশ শাসকদের অবর্ণনীয় নৃশংসতার শিকার হয়েছিল, ফাঁসি, জেল, আন্দামানে সেক্যুলার জেলে আটক, পরিবারের পর পরিবারকে কালকানুন দিয়ে হিংস্রতায় নিমজ্জিত করাবাংলায় এই ঐতিহ্য,অম্লান, সুমহান। এঁরা সকলেই পরে যুক্ত হন বামপন্থীদের সঙ্গে ১৯২০ সালে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। বাংলায় জাতীয় আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারার‍‌ই প্রাধান্য ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই উজ্জ্বল অবদানকে পরিকল্পিতভাবে আড়াল করার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসের খণ্ডিত চিত্রই প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই উগ্র জাতীয়তাবাদ, বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ইতিহাসচর্চায় তখন থেকেই বিরাজ করছে, যার প্রাবল্যে আজ গোটা দেশের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সঙ্ঘ পরিবার এক বিরাট ও ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট বিদ্বেষী প্রচার, কমিউনিস্ট ও বামপন্থার ওপর আক্রমণ, ১৯৪৬-তে গোটা বাংলাজুড়ে দাঙ্গার ভয়াবহতা, দেশভাগজনিত পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি শ্রেণি আন্দোলনের সামনে তৈরি করে বহু বাধা ও জটিলতা। কিন্তু এ‍ই কঠিন অবস্থায়ও পাঁচের দশকে নিরবচ্ছিন্ন ও একনিষ্ঠ আন্দোলন, উত্তাল গণআন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জনগণের সংযোগকে দৃঢ় করে তোলে। কংগ্রেসী শাসনের অত্যাচার, জেল, দমনপীড়ন ইত্যাদি কোনকিছুই জনগণ থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে ও বামপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। বরং দেউলিয়া কংগ্রেসের শাসনের বিচ্ছিন্নতাই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ছয়ের দশকের গোড়ায় চীন-ভারত বিরোধ, গণআন্দোলন ও দেশে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর বিদ্বেষ আক্রমণ চলে। বন্দিমুক্তি, খাদ্য আন্দোলন চললেও বিরাট গণআন্দোলন এই আক্রমণের মুখে অনেকটা গতি হারায়। এরই অনুবর্তিকায় ঘটে বামপন্থীদের ১৯৬৬ সালের উদ্দীপ্ত খাদ্য আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষের যৌথ আন্দোলন। দুদশকের কংগ্রেসের জনবিরোধী নীতি, অপশাসন, আর্থিক সঙ্কটও, মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণ বাড়িয়ে তোলে।

যুক্তফ্রন্ট
১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরেক বড় গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। গোটা দেশে কংগ্রেসের বিকল্প কোনও দল, জোট বা শক্তি ছিল না। কংগ্রেসের বিকল্প নেই এই যে প্রচার গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, সেই মিথ্যা তখন ভেঙে পড়ে। সংবিধানের নির্দেশিকা ও মর্মবস্তুর সঙ্গে কংগ্রেস শাসন চিরকাল পরিহাস করে এসেছে। তাতে কংগ্রেস-বিরোধী মনোভাবের সুযোগ নিতে তৎপর হয় স্বতন্ত্র এবং আরএসএসএর রাজনৈতিক ও প্রতিনিধি জনসঙ্ঘ। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিও সক্রিয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং ৭টি রাজ্যের বিধানসভায় কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে অকংগ্রেসীরা নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ লড়াই না করেও পরাস্ত করে কংগ্রেসকে। জনসঙ্ঘকে বাদ দিয়ে বাম ও অ-বাম অকংগ্রেসী দলগুলিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। গোটা রাজ্য এই উচ্ছ্বাসে তখন ফেটে পড়ে। গণতান্ত্রিক অধিকার, গণআন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন ও সংগঠনের অধিকার, বিনাবিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি, উদ্বাস্তু, কৃষকদের জন্য জমি, প্রশাসনিক দুর্নীতিরোধ, খাদ্য সঙ্কটের মোকাবিলা ইত্যাদি ১৮ দফা কর্মসূচির বহুবিধ কাজে হাত দেয় নতুন সরকার। পদে পদে বাধা, সংবাদপত্রের কুৎসা, স্থিতিশীলতা ধ্বংস, আইন শৃঙ্খলার অবসান ইত্যাদি প্রচার, এর মধ্যেও গণআন্দোলন ও সরকারের দায়িত্ব পালন একসঙ্গে চলে। দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের চেয়ে পৃথক এক শাসনধারা তৈরিও শুরু হয়। সাত মাসের মধ্যে নির্দল ও অবামপন্থীদের ১৭ জন বিধায়ককে দিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করিয়ে রাজ্যপালকে ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটায় কেন্দ্র, কোনও রাজ্যেই অকংগ্রেসী সরকারকে টিকতে দেওয়া হয়নি। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে রাজজুড়ে জোরালো আন্দোলন চলে, ব্রিগেডে হয় বিরাট বিরাট সমাবেশ। ১৯৬৭-র  ৫নভেম্বরের সিপিআই(এম)র ব্রিগেড সমাবেশ এখনও বলা যায় অতুলনীয়। এই আন্দোলনের চাপেই ১৯৬৯ সালে আবার বিধানসভা নির্বাচন। এবার বাম, অ-বামরা যুক্তফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ। বিরাট জয় হয় যুক্তফ্রন্টের মোট ৪৯.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে।
সিপিআই(এম) উভয় সরকারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দল হওয়া সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর পদ বাংলা কংগ্রেসকে ছেড়ে দেয়, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরও ভাগ করা হয় শরিকদের মধ্যে। বেনামি জমি উদ্ধার, জমি বণ্টন, বর্গাদারদের অধিকার, শিল্প শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের নির্বাচন ও অধিকার, শিক্ষা স্বাস্থ্য, উদ্বাস্তু তফসিলি জাতি ও উপজাতি সমস্ত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য সীমিত ক্ষমতা ও সমস্যার মধ্যেও অর্জিত হয়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বাধা সত্ত্বেও বেনামি জমি উদ্ধারের আন্দোলন, জনগণের পক্ষে ৩৬ দফা কর্মসূচি রূপায়ণ সম্পূর্ণ এক পৃথক ও বিকল্প জনমুখী সরকার পরিচালনা যুক্তফ্রন্ট হাজির করে দেশের সামনে। এর আগে বামপন্থীদের নেতৃত্বে কেরালাও নজির তৈরি করে।

সন্ত্রাসরাজত্ব বাংলাতেই
বাংলায় যুক্তফ্রন্টে এই সাফল্য যেমন প্রতিক্রিয়ার শক্তির শ্রেণি আক্রোশ বাড়িয়ে তোলে, যুক্তফ্রন্টের মধ্যেও বিভেদের প্রতিফলন ঘটে। এসব কাজে লাগিয়ে এই সরকারের পতন ঘটানো হয়। কিন্তু সরকার বাঁচানোর জন্য কোনও আপসমূলক কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হয়নি, বাইরের সংগ্রামকে তীব্রতর করা হয়, সন্ত্রাসে সিপিআই(এম)‘র বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা ও হাজার হাজার কর্মীকে অকথ্য অত্যাচার সইতে হয়। ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, কিন্তু সিপিআই(এম) এবং সহযোগী কয়েকটি ছোট বামপন্থী দল মিলে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে সন্ত্রাস, মিডিয়ার কুৎসা, বহু কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রচার করতে না পারা, ষড়যন্ত্র, গরিবী হটাও, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে কংগ্রেস সরকারের সহায়তার জন্য কংগ্রেস-অনুকূল ইন্দিরা-হাওয়ানামক পরিস্থিতির মধ্যেও। সর্বত্রই জয় জয়কার কংগ্রেসে, একমাত্র হাওয়া ঘুরে যায়, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় পরাজয় কংগ্রেসের।
১৯৭২ সালের নির্বাচনের আবার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বামপন্থীরা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ঐক্যবদ্ধ হয়। আরও বড় শোচনীয় পরাজয় অবধারিত বুঝে গোটা নির্বাচনকে রিগিং ও জাল জুয়াচুরির মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার। পাঁচ বছর ধরে অকথ্য বর্বরতা চলে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীদের ওপর। ১১০০ সিপিআই (এম) নেতা ও কর্মী খুন হন, বিনা বিচারে ও সাজানো মামলায় হাজার হাজার গ্রেপ্তার, হাজার হাজার কর্মী এলাকা ছাড়া হয়। ভারতে জরুরি অবস্থার আগেই পশ্চিমবঙ্গ সেই বীভৎস অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু গণতন্ত্র ও জীবন  জীবিকার আন্দোলনকে তখনও স্তব্ধ করা যায়নি। ভারতের অন্য কোনও রাজনৈতিক দল এই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি এরকম ত‌্যাগস্বীকার করেনি
এই সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কাল যাঁরা অতিক্রম করেছেন, স্বাভাবিক কারণেই আজ তাঁদের সংখ্যা সীমিত। মিডিয়া এখন অনেক শক্তিশালী, নতুন নতুন প্রজন্মকে কুৎসায় ডুবিয়ে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে তারা বিস্মরণে পাঠিয়ে দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে এই লড়াই ও আত্মত্যাগই আজও ভবিষ্যতের অফুরন্ত প্রেরণা।

বামফ্রন্টের সরকার : নবদিগন্ত
এই সংগ্রামের তরঙ্গ শীর্ষেই গঠিত হয়েছে বামফ্রন্ট এবং ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সরকার গঠন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা  সত্ত্বেও  সব শরিকদের সরকারে মর্যাদার আসন দেয় সিপিআই(এম)। ক্ষমতা নয়, জনস্বার্থ রক্ষাই যে প্রধান এ নীতিই উজ্জ্বলতর হয়। কেন্দ্রে তখন জনতা সরকার যার মধ্যে আরএসএসএর জনসঙ্ঘও মিশে যায়। পরাস্ত কংগ্রেসী স্বৈরতন্ত্র। এরকম অনুকূল অবস্থায় কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে জনতা পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের প্রস্তাব দেওয়া সত্ত্বেও তারা রাজি না হওয়ায় বামফ্রন্ট এককভাবে লড়াই করে, বিরাট জয় অর্জন করে। বাইরের শত্রুতা ছাড়াও দুই যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতার  কারণেও যে বাধা ছিল, সেই বাধা ১৯৭৭-এ ছিল না। কিন্তু দেশের  মূল সংবাদপত্র নতুন মাত্রায় বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কুৎসা অভিযান চালায়। প্রথম দিনেই জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন, সরকার জনগণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাতেই চলবে, রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলবে না। ৩৪ বছর এই নীতিই অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। দেশে অন্য কোনও নজির নেই। বিরোধীদের মর্যাদা, সমালোচনার অধিকার, বাক্‌ স্বাধীনতা, আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকার, রাজবন্দিদের মুক্তি, বরখাস্ত সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের পুনর্বহাল, আইন সংশোধন করে পূর্ণমাত্রায় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার পৌরসভা, পঞ্চা‍‌য়েতের  মাধ্যমে কাজ, সর্বত্র আমলাতান্ত্রিকতার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচিত সংস্থার  মাধ্যমে সরকার পরিচালনা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম  এবং সারা দেশের ও গণতন্ত্র সম্প্রসারণের দিশারিএক বছরের মধ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, ১৯৭৮  সালে, সম্পূর্ণ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ ও অবাধ। নির্বাচিত  হয় গরিব অংশের মানুষই দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের আবর্ত  থেকে মুক্ত করা হয় শিক্ষাকে। কংগ্রেসী আমলে সন্ত্রাসে হত্যা করা হয় ৪০ জনের বেশি শিক্ষককে। বহু  শিক্ষক, কর্মচারী, শ্রমিক এলাকাচ্যুত হয়, কাজে যোগদান করতে পারেননি এমন সকলেরই পুনর্বহাল হয়। প্রাথমিক শিক্ষার আওতা থেকে কোনও শিশু বাদ না যায়,  অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সে কাজে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অবৈতনিক শিক্ষাসহ শিক্ষা সংস্কার সর্বত্র শুরু হয়। বেআইনি  নাম উদ্ধার করে গরিব অংশের কৃষক, খেতমজুর, বর্গাদারদের মধ্যে বিলির কাজ ও কৃষকদের  সহায়তা  পায় অগ্রাধিকারআলাপ আ‍‌লোচনায় অনেক বন্ধ ও রুগ্‌ণ কারখানা এবং প্রতিষ্ঠান খোলা  সম্ভব হয়। গ্রামে চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা, বিভিন্ন ভাষার  বিকাশ, পার্বত্য উন্নয়ন এমন কোনও ক্ষেত্র বাকি নেই  যেখানে জনমুখী বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বিকেন্দ্রীকরণের  নীতি ও রূপায়ণ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত কেন্দ্র ও তা গ্রহণ করে সংবিধান সংশোধন করে।  রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা মাঠে মারা যায় যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল শাসনে বা  অন্যত্র বিজেপি শাসনে বটেই। কিন্তু বাধা, অসুবিধা, প্রতিবন্ধকতা, জনবিরোধী প্রশাসনিক কাঠামো ও সীমিত ক্ষমতার মধ্যে কাজ বার বার বামফ্রন্ট জনগণকে সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করেছে,  যাতে তাঁদের প্রত্যাশা এর বাইরে আকাশচুম্বী কিছু না হয়।  বলা হয় ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামো যুক্তরাষ্ট্রীয়, কিন্তু সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কেন্দ্রীভূত। হাজার সদিচ্ছা থাকলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাধা ও সীমাবদ্ধতা কোনও রাজ্য সরকারকে মৌলিক সমস্যা বিষয়েও গুণগত পরিবর্তন করতে দেয় না। রাজ্যগুলিকে রাজস্ব, আর্থিক, আইনগত ও বহু বিষয়ে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়। এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মোদী সরকার হিন্দুত্বের রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে গোটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই ভাঙনের মুখে এখন নিয়ে এসেছে, সরকারের নামে কার্যত দলীয় কর্তৃত্বের আওতায় নির্বাচন কমিশন থেকে সমস্ত স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে নিয়ে আসছে, আদালতের ওপরও খবরদারি চলছে। অন্য কোনও সরকার, বিরোধী নির্বাচিত সদস্যদের টিকতেই দেবে না ওরা। রাজ্যের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা এবং রাজ্যগুলির প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে রাজ্যগুলি এবং গোটা দেশকে উন্নতির পথে শক্তিশালী করতে বামফ্রন্ট সরকার দেশজুড়ে এক আন্দোলন তৈরি করেছিল। ভূমিসংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ, গণতন্ত্র প্রসার, জনগণের অধিকার রক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি অজস্র ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার বিরাট সাফল্যই কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের এই দেশব্যাপী আন্দোলনে জ্যোতি বসু নেতৃত্ব দিয়েছেন

ঐতিহাসিক অবদান
কেরালা ও ত্রিপুরায় বামপন্থীরা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয়, এমন কোনও কাজ করতে দেয়নি। সাড়ে তিন দশক অবাধ, সুষ্ঠু ও সময়মতো নির্বাচন হয় সব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায়। কিছু বিচ্ছিন্ন দুর্বলতা গোটা সাফল্য ম্লান করতে পারে না। এই দুর্বলতা বামফ্রন্ট লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি। জনগণকে নিয়ে জারি রেখেছে। সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দমনে কোনও ফাঁক থাকতে দেয়নি, দুর্নীতি দমনেও মন্ত্রীসভার নজির আজও দেশে সকলের মুখে মুখে। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তোলার আগেই মাথা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তফসিলি, আদিবাসী, মহিলা নির্যাতন হলে অপরাধীরা যে-ই হোক, কেউই পার পায়নি। ১৯৮০ সালে জনতা সরকারের অবসান, তারপর ৪০ বছরে দেশেও কেন্দ্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
বামফ্রন্টের তিন দশকের সরকার পরিচালনার সময় নয়া-উদারীকরণের সর্বনাশা নীতি চালু করেছিল কংগ্রেস ৯০-র দশকে। হীনবল সঙ্ঘ পরিবার একই সময় প্রচণ্ড হিংসাত্মক দৌরাত্ম্য নিয়ে সাম্প্রদায়িক অভিযান তুঙ্গে তুলেছে। একই সময়ে বিশ্বব্যাপী গণআন্দোলনের বিপর্যয় ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে ভারসাম্যের পরিবর্তনে, বিভেদকামী-বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি এ সময়েই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। তার মধ্যেই বিরাট উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে যে রাজস্ব ও আর্থিক সামর্থ্য প্রয়োজন, কেন্দ্রের নীতির কারণে তাতেও ঘাটতি। তবুও জনগণের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে একবিন্দু বামফ্রন্ট সরকার সরেনি। গোটা দেশের প্রতিক্রিয়ার শক্তি বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশি শত্রুরও ইন্ধন পেয়েছে বহু ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেই। বামফ্রন্টকে এতবছর কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু গোটা দেশের প্রতিক্রিয়া, আধুনিক মিডিয়া, সমস্ত রঙের সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের শক্তি, চরম উগ্র-সন্ত্রাসবাদী বামপন্থী নামধারী শক্তি, বিপুল অর্থ সবাই তৃণমূলকে সামনে রেখে জোট বাঁধে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে, ৩৪ বছরের সাফল্যের অবসানে।

ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাসের রাজ
কায়েম হয় একচ্ছত্র ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রায় ৯ বছর, দিল্লিতে একই ফ্যাসিস্তসুলভ বর্বর সাম্প্রদায়িক রাজত্ব। দেশজুড়ে চলছে অভূতপূর্ব বিভীষিকা। বিপন্ন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জীবনজীবিকাপ্রতি পদক্ষেপে প্রতি মুহূর্তে তার ভয়ার্ত অভিজ্ঞতা বামফ্রন্ট, বৃহত্তর বামশক্তি প্রচণ্ড সন্ত্রাসের মধ্যেও, রিগিং-ভোটলুট সত্ত্বেও লড়াই থেকে একচুলও সরেনি। নতুন নতুন সাহসী লড়াই ও আত্মত্যাগের নজির সৃষ্টি হয়েছে। দুনিয়াজোড়া আর্থিক মন্দা ও সঙ্কটে পুঁজিবাদ কম্পমান, চরম দক্ষিণপন্থী সামাল দিতে বাড়বাড়ন্ত, মোদী সরকারেরও রেহাই নেই, যতই মিডিয়ায় খই ফোটাক। ঐতিহাসিক বামফ্রন্ট এবং চরম স্বৈরাচারী দেউলিয়া তৃণমূল শাসনের আকাশ-পাতাল বৈপরীত্য আজ দ্রুত মানুষের কাছে উন্মোচিত হচ্ছে। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি আবার ঐতিহাসিক নিয়মেই একত্রিত হচ্ছে, কংগ্রেসও মারাত্মকভাবে আজ আক্রান্ত। কংগ্রেসও গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এগিয়ে আসছে। তৃণমূল-বিজেপি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধসেই লুকানো রহস্য আজ খসে পড়ছে। বর্বরতার পূজারী এ দুয়ের বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যের সবাইএই শিক্ষার উৎস যুক্তফ্রন্ট থেকে বামফ্রন্টবামফ্রন্টের সময় থেকে নতুন পরিস্থিতিতেও সার্বিক ঐক্যের বার্তা।

গণশক্তি, ২১জুন, ২০২০

20200620

বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার



প্রকাশ কারাত

কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন যখন বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল, তখন কেউই ভাবতে পারেননি যে, ঐ সরকার ইতিহাস রচনা করবে। সে সময় যদি তখন কেউ ভবিষ্যৎবাণী করতেন যে বামফ্রন্ট আগামী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করবে তা হলে কেউ তা বিশ্বাস করতো না। বামফ্রন্ট সরকার সেটাই করে দেখিয়েছে। তারা পশ্চিমবঙ্গে একাদিক্রমে ৩৪ বছর সরকার পরিচালনা করেছে। প্রশংসনীয় ও অনন্য রেকর্ড, সন্দেহ নেই। বামপন্থীদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, অনেক অত্যাচার সহ্য করার মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পুলিস ও প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে রিগিং করে জয়লাভ করে। সেবার নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করেছিল। ঐ সময়কালে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলির ১৪০০ জন সদস্য ও সমর্থককে খুন করা হয়। গোটা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার। সে সময় গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে অবদমিত করে রাখা হয়েছিল।

জমির জন্য কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন এবং মেহনতী মানুষের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের জোয়ারের ফলে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি তৎকালীন সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি সরকারের প্রচণ্ড দমনপীড়নের শিকার হয়েছিল। সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়। এর কারণ হলো জনগণ ঘৃণিত কংগ্রেস সরকার‍‌কে দূরে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং সর্বান্তকরণে ভোট দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের কর্মসূচী ও নীতিগুলির সমর্থনে।

এই বিপুল জনসমর্থনের ফলেই বামফ্রন্ট একাদিক্রমে ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার সাতবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। প্রতি বারেই তারা বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছে। জনগণের সমর্থনের এটি এক উল্লেখযোগ্য নজির। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রূপায়িত ভূমিসংস্কারের ফলে লক্ষ লক্ষ কৃষক ও বর্গাদার উপকৃত হয়েছেননির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, যা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের গরিব মানুষ এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছেন। শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতী জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করা গিয়েছিল।

এসবের ফলে মেহনতী মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয় নতুন মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার এবং স্বাধীন ভারতে পুঁজিবাদী উন্নয়নের অসম প্রকৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব ভারত অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার শিকার হয়। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরতার বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সরকার গোড়া থেকেই লড়াই শুরু করে। ধর্মনিরপেক্ষতার নির্যাস ও মর্মবস্তু কি হতে পারে তা বামফ্রন্ট সরকার হাতে কলমে করে দেখিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দুর্গ হয়ে দাঁড়ায়। বৃহৎ বুর্জোয়া এবং সামন্তপ্রভুদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থার আওতায় একটি রাজ্য সরকার চালাতে হয় গুরুতর ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে। রাজ্য সরকারের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ধরনের সাফল্যের নজির গড়েছে।

তাছাড়া বামফ্রন্ট সরকারকে সবসময় অভ্যন্তরীণ ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সা‍‌লে পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ থেকে বোঝা যায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য কতদূর পর্যন্ত চক্রান্ত এঁটেছিল। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বামফ্রন্ট সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারগুলির বৈরিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার যে টিকে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিল তার জন্য মূল ভূমিকা ছিল পশ্চিমবঙ্গে জনগণের অবিচলিত সমর্থন এবং দেশের বাকি অংশে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ও বৃদ্ধি। যে গণতান্ত্রিক চেতনা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে অগণতান্ত্রিক পথে উৎখাত করার কোনো চক্রান্ত বরদাস্ত করতো না।

২০১১ সালের মে মাসের নির্বাচনে পরাজয়ের পর গত ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যগুলিকে নস্যাৎ করার জন্য একটি সমন্বিত অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের কৃতিত্ব নির্বাচনী পরাজয়কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হচ্ছে এইভাবে যেন জনগণ বামফ্রন্ট সরকারের সমস্ত কৃতিত্বকে খারিজ করে দিয়েছেন। এসব হলো বামপন্থীদের যারা বিরোধী তাদের উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণ। তাছাড়া মতাদর্শগত আক্রমণও চালানো হচ্ছে। বামফ্রন্টের শাসনকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো বামফ্রন্ট আমলে জনগণ যেসব অধিকার ও সুফল অর্জন করেছেন সেগুলিকে উলটে দেওয়া। অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুরানো আধিপত্যশীল শ্রেণীগুলি আবার নতুন করে জোর খাটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলি অনুসরণ করছে। পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তার আড়ালে এমনসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে যা মানুষের জীবন-জীবিকার উপরে আঘাত হানবে এবং তাদের অধিকারগুলিকে দুর্বল করে তুলবে।

সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের উপর যে মারাত্মক ধরনের আক্রমণ চালানো হচ্ছে তা থেকে বোঝা যায় আগামীদিনে কী ঘটতে চলেছে। তৃণমূল কংগ্রেস - কংগ্রেস যে শ্রেণী শক্তিগুলির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের খুন করছে, তাদের আক্রমণে অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন, নিয়মিত হুমকি দেওয়া হচ্ছেওরা সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের সাংগঠনিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে দিতে চাইছেকারণ তারা জানে এই সাংগঠনিক কাঠামোর উপরে ভরসা করে পশ্চিমবঙ্গের মেহনতী মানুষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং তাদের অধিকারকে সগর্বে তুলে ধরেন।

মেহনতী মানুষ অর্থাৎ কৃষক, বর্গাদার খেতমজুর, শ্রমিকশ্রেণী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে সুফল অর্জন করেছেন তা রক্ষা করতে হবে। শাসক শ্রেণীগুলির পক্ষে ভূমিসংস্কার এবং অন্যান্য সুফলগুলিকে আবার আগের পশ্চাদপদ জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। কেরালার পুরানো অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। নিজেদের অধিকার ও জীবন-জীবিকা রক্ষা করা, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি রক্ষা করা এবং জনবিরোধী নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী ও মেহনতী জনগণের অন্যান্য অংশগুলির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ইতিহাসে গড়ে উঠবে এক নতুন অধ্যায়।

শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত করা, শ্রেণীসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সবসময়ই ভরসা দেওয়ার শক্তিশালী কাঠামো হিসাবে কাজ করবে। যারা বামফ্রন্টকে মুছে দিয়ে শোকগাথা লিখে ফেলেছেন ইতিহাস তাঁদের একদিন ভ্রান্তদর্শী বলে প্রমাণ করবে।

গণশক্তি, ২১শে জুন, ২০১১