20191219

আন্দোলনের বর্শাফলক থাকুক মানুষের শত্রু আরএসএস-বিজেপি’র দিকে



শমীক লাহিড়ী

ভারতবর্ষের নাগরিক কারা এবং কারা ভবিষ্যতে নাগরিক হতে পার‍‌বেন — এই নিয়ে কে‍‌ন্দ্রের বিজেপি সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে — ‍‌(১) জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নতুন করে তৈরি করা এবং (২) ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সং‍‌শোধন করা।

নতুন সংশোধিত আইন

১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন এখনও পর্যন্ত ৬ বার সংশোধিত হয়েছে — ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ এবং ২০১৯। ১৯৮৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পূর্বে যিনি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। এরপর যাদের জন্ম হয়েছে তাঁদের পিতা অথবা মাতা যেকোনও একজন সন্তানের জন্মের সময় ভারতের নাগরিক হলে, সন্তান এদেশের নাগরিকত্ব পাবে। ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুযায়ী যে সমস্ত শিশু ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তাঁদের পিতা এবং মাতা উভয়কেই ভারতবর্ষের নাগরিক হতে হবে, তবেই সেই শিশু ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য হবে।

বিদেশে জন্মগ্রহণকারী এবং বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের ক্ষেত্রে আইন পৃথক। সর্বশেষ সংশোধনী (CAA) বিদেশে বসবাসকারী অ-ভারতীয়দের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা ভারতবর্ষের নাগরিক নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব পেতে চান তাঁদের জন্য নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধনী। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও দেশের মানুষ এবং যে কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষ এই সর্বশেষ আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। কেবলমাত্র ৩টি প্রতিবেশী দেশ— পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে বসবাসকারী অ-মুসলমান মানুষেরা ভারতবর্ষের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। অর্থাৎ এই আইনটি এককথায় বিদেশিদের জন্য তৈরি, ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

সঙ্গতভাবেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে। প্রথমত, কেবলমাত্র ৩টি প্রতিবেশী দেশকে বেছে নেওয়া হলো কেন? নেপাল, মায়ানমার (পূর্বতন বার্মা), ভূটান, চীন, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশগুলিও ভারতবর্ষের প্রতিবেশী দেশ। এদের বাদ দেওয়া হলো কেন? এর কোনও সঙ্গত উত্তর প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেননি অথবা দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, আমাদের দে‍‌শের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকে ধর্ম-ভাষা-জাতি কখনই বিচার করা হয়নি। দেশ বিভক্ত হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেও আমাদের দেশ সেই রাস্তায় হাঁটেনি। আমাদের দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দেশে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পার্সি-নাস্তিক সহ সব ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংবিধানকে দু’হাত তুলে সমর্থন করেছিলেন এবং এই ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক দেশকেই তাঁদের মাতৃভূমি বা পিতৃভূমি রূপে গণ্য করে, এই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, এই দেশেই বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজ হঠাৎ ধর্ম বিচার করে নাগরিকত্বদানের প্রশ্নটিকে আরএসএস-বিজেপি সামনের সারিতে নিয়ে আসতে চাইছে কেন? এরা যুক্তি দিচ্ছেন আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত মানুষদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে, তাই এই নিপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এই আইন আনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দুটি প্রশ্ন সামনে উঠে আসছেপ্রথমত, সমস্ত প্রতিবেশী দেশগুলির উৎপীড়িত নাগরিকদের জন্য এই আইন না এনে কেবলমাত্র ৩টি দেশকে কেন বেছে নেওয়া হলো? দ্বিতীয়ত, ভাষাগত জাতিগত অথবা রাজনৈতিক নিপীড়িতদের বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎপীড়িতদের জন্য কেন এই আইন? তৃতীয়ত, এই উপমহাদেশের অন্যান্য ধর্মের মানুষকে এই সুযোগ দেওয়া হলেও মুসলমানদের বাদ দেওয়া হলো কেন?

পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ এই ৩টি দেশকে বেছে নেওয়া হয়েছে তার মূল কারণ এই দেশগুলিতে মুসলমান মানুষরা সংখ্যালঘু নন। শ্রীলঙ্কা-চীন-নেপাল-ভুটান-বার্মা এই সব প্রতিবেশী দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যালঘু। যদি এই দেশগুলির নাগরিকদেরও এই সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে এই সব দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতবর্ষের নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে— যেটা প্রবল মুসলমান বিদ্বেষী আরএসএস-বিজেপি চায় না। শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যা আমাদের কারুর অজানা নয়। যদি প্রতিবেশী দেশের উৎপীড়িতদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন প্রকৃত কারণ হতো তাহলে শ্রীলঙ্কার তামিল কিংবা মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে কখনই দৃষ্টি ফেরাতে পারত না আমাদের দেশের সরকার।

আসলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার দীর্ঘ লালিত আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যেই এই আইন সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গায়ের জোরে বিজেপি সরকার তৈরি করতে চেয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রাক্‌শর্ত রূপে প্রথমত, দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন দ্বিতীয়ত, বিভাজনকে তীব্র করার জন্য ঘৃণা তৈরি তৃতীয়ত, এই ঘৃণাকে স্থায়ী রূপ দিতে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী। যে কারণে সমস্ত যুক্তি-তর্ক এড়িয়ে গায়ের জোরে এবং অসত্যকেই ভিত্তি করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন সব প্রতিবেশী দেশ নয়, কেন জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে যে কোনও উৎপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয় — এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তর এরা দিচ্ছেন না। সিপিআই(এম) দেশ ভাগের পর থেকেই শরণার্থীদের পাশে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই বাংলায় কমিউনিস্টরা লাগাতার লড়াই করেছে। যাঁরা এদেশে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেবার দাবিও তুলেছে। কিন্তু ধর্মীয় বিচার না করেই এই নাগরিকত্ব দিতে হবে। অন্যথায় সংবিধানের মৌলিক ধারণাই বিপর্যস্ত হবে।

নতুন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি কেন?

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এই সরকারের নাগরিকপঞ্জি তৈরির ঘোষণার সাথে। আসামে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার ক্ষেত্রে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছেসেখানে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেবে আর তাদের জমি-বাড়ি-সম্পত্তি-চাকরি সব হিন্দুরা পাবে, এই প্রচার চালিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯ লক্ষের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়ায় সেখানকার মানুষদের সামনে বিজেপি’র স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেছে। মানুষ সেখানে বিজেপি’র বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ জানাচ্ছে।

১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি নাগরিকপঞ্জি কার্যত একটি ব্যর্থ কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কেবলমাত্র জনগণের দেয় করের অর্থ অপচয়ই নয়, প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষকে গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে। কোনও কোনও মানুষের ক্ষেত্রে নিজের পকেটের থেকে এই খরচের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকাও ছাড়িয়েছে। যে সব হতদরিদ্র মানুষ এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে নথিপত্র তৈরি করতে পারেননি, এদে‍‌শে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁরা অনুপ্রবেশকারী বিদেশি হিসাবেই চিহ্নিত হয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আসামের অভিজ্ঞতার নিরিখে সমগ্র দেশে এক গভীর অস্থিরতা তৈরি হয়েছে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করাকে কেন্দ্র করে। এটি কোনও সাধারণ আর পাঁচটি সমস্যার মতো নয়, এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, সম্পত্তি রক্ষা করার অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি। অর্থাৎ একজন মানুষ এবং তাঁর সমগ্র পরিবারের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত নতুন করে নাগরিকপঞ্জি তৈরির বিষয়টি।

মানুষের আসল সমস্যা লুকোতে চাইছে

আমাদের দে‍‌শের বেকার সমস্যা— কৃষি জীবনের সমস্যা— শিল্প কলকারখানার সমস্যা— দারিদ্র দূরীকরণের সমস্যা— অশিক্ষার সমস্যা-মহিলাদের উপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের সমস্যা- অর্থনীতির অধোগতির সমস্যা, এই সবের সাথে অথবা দে‍‌শের উন্নয়নের সাথে কোনও সম্পর্ক কি আছে নতুন নাগরিকত্ব আইন অথবা নাগরিকপঞ্জি নতুন করে তৈরি করার? তাহলে এই বিষয় দুটিকে টেনে এনে সমগ্র দেশজুড়ে আগুন লাগানোর অর্থ কি? উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সমগ্র ভারত উদ্বেলিত। রাস্তায় ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে। পুলিশের গুলি চলছে। মিলিটারি নামাতে হচ্ছে। বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য কোনও বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী, সভ্য সরকার নিজের দেশে আগুন জ্বালাতে  পারে— এটা বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষকে দেখেই সমগ্র পৃথিবী জানল। এই আগুন জ্বালানো বিজেপি’র জন্য এত জরুরি হয়ে পড়ল কেন?

এক ঢিল, তিন পাখি

আসলে ঘৃণা এবং বিভেদের রাজনীতি হলো আরএসএস-বিজেপি’র মূল মতাদর্শ। এই দুটি আইনের মাধ্যমে একইসাথে অনেকগুলি ঢিল মারতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী।

প্রথমত, দেশজুড়ে এই দাঙ্গার পরিস্থিতিতে ধামাচাপা পড়ে গেল পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা, সরকারি ব্যাঙ্কগুলো ধুঁকছে কারণ বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিরা টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়েছে অথবা ফেরত দিচ্ছে না, দেশের কয়লাখনি-তেলের কোম্পানি-রেল সব বেচে দেওয়া হচ্ছে, গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচাইতে বেশি বেকারত্ব, কৃষক আত্মহত্যা করছে ঋণের জালে জড়িয়ে গিয়ে, দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে।

দ্বিতীয়ত, এই আইনের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা যাবে, ঠিক যেমন নোট বন্দির সময় হয়েছিল। ১৩৩ কোটি মানুষকেই এখন নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কাগজপত্র তৈরি করে লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঠিকঠাক কাগজ তৈরি করতে না পারলে আপনি সহ আপনার বাপ-ঠাকুরদা এদেশে জন্মে থাকলেও, নাম কাটা পড়বে— সে আপনি হিন্দুই হোন অথবা মুসলমান-জৈন-শিখ,পার্সি-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-নাস্তিক যাই হোন না কেন। হিন্দু বলে কেউ ছাড় পাবেন না। তাঁদেরও যদি কাগজপত্র না থাকে, তাহলে স্থায়ী ঠিকানা হবে ডিটেনশন ক্যাম্প। এখন প্রশ্ন হলো যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে এমএ পাশ বলে দাবি করেন, অথচ সেই নথি হারিয়ে যাওয়ায় জমা দিতে পারেন না, সেই দেশে বন্যায় হাজার হাজার গ্রাম-শহর ভেসে যাওয়া অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িঘর সব নষ্ট হয়ে যাওয়া, দরিদ্রতম মানুষেরা কিভাবে তাঁদের নথিপত্র খুঁজে পাবেন অথবা নথিপত্র নতুন করে বানাবার জন্য অর্থই বা কোথা থেকে পাবেন? তাই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র জোগাড়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি করুক আর লাইনে দাঁড়াক, এক বুক আতঙ্ক নিয়ে, এটাই চাইছে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী।
তৃতীয়ত, এর মধ্যে দিয়ে তীব্র ঘৃণার রাজনীতি এবং হিন্দু মুসলমান বিভেদের পরিস্থিতিও তৈরি করা যাবে। সেই পরিস্থিতির দিকে দ্রুত এগচ্ছে দেশ। আতঙ্কগ্রস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ কেবল রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, তাই নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল  জুড়ে আগুন জ্বলছে কোথাও অসমীয়া এবং অ-অসমীয়া বিভেদকে কেন্দ্র করে, কোথাও উপজাতি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। এর ফলে বিভেদের রাজনীতি সামগ্রিকভাবে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি।

বিজেপি’র এই ঘৃণ্য বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক ভাবে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তোলাই দেশের মানুষের মূল কর্তব্য। কোথাও আগুন লাগিয়ে অথবা ভাঙচুর  চালিয়ে আন্দোলন পরিচালিত হলে তা বিজেপি’র উদ্দেশ্যকেই সফল করবে। ফলে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আন্দোলনের বর্শা ফলক আরএসএস-বিজেপি  বাহিনীর দিকেই থাকে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রতিবেশি দেশের উৎপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি করতে হবে নাগরিকত্ব আইন।

এনআরসি-এনপিআর-সিএএ

এনআরসি অর্থাৎ  নাগরিকপঞ্জি নতুন করে তৈরি করা এবং সিএএ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এই দুটি বিচ্ছিন্ন নয়। এজন্যই দেশজুড়ে এই প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ২০২৪ সালের  মধ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এরই প্রাথমিক ধাপ হিসাবে এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরি করার কাজ শুরু হবে ১ এপ্রিল, ২০২০। এর মধ্যে জনগণনার কোনও সম্পর্ক নেই। জনগণনা করা হয় ১৯৪৮ সালে তৈরি সেনসাস অ্যাক্ট অনুযায়ী। এই আইন অনুযায়ী ২৮ জুন, ২০১৯ ভারতবর্ষে রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেনসাস কমিশনার  গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে জানিয়ে দিয়েছেন, ২০২১ সালে দেশে জনগণনা হবে।

এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি তৈরি করার নির্দেশিকা জারি করেছেন Registrar General of Citizen Registration and Census Commissioner, India, এই নির্দেশিকা অনুযায়ী ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাজ হবে। এই নির্দেশিকা জারি হয়েছে ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারা অনুযায়ী। এই আইন অনুযায়ী একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নাগরিকদের দেওয়া হবে। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জনগণনা এবং জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরি এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।

মনে এক, মুখে আর এক

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বারে বারে হুঙ্কার ছাড়ছেন—এরাজ্যে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কোনওভাবেই তৈরি করতে দেওয়া হবে না। এই প্রশ্নে জনগণের দেয় করের টাকায় নিজের বিশাল ছবি সহ বিজ্ঞাপনও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দিয়ে চলেছেন। অথচ একইসাথে নবান্ন থেকে  নির্দেশিকা জারি করে এনপিআর বা জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি তৈরির কাজে নিজের সরকারের আধিকারিক এবং কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান করতে বলেছেন। একইসাথে শোনা যাচ্ছে রাজারহাট এবং বনগাঁতে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মতো ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির জন্য জমি চিহ্নিতকরণের কাজ প্রায় সেরে ফেলেছেন। এসবই রাজ্যের মানুষ দেখছেন। একদিকে দিল্লির সরকারের প্রবল সংখ্যালঘু বিদ্বেষ এবং অন্যদিকে হিজাব টানা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতারণা রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রবল আতঙ্ক তৈরি করেছে, যার প্রতিফলনে রাজ্য জ্বলছে।

ঐ‍‌ক্যের রক্ষক

রাজ্যে ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের সময় কোনও মৌলবাদী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর আসমুদ্র হিমাচলে আগুন লেগেছিল, কিন্তু জ্যোতি বসুর সরকার সেই আগুন এরাজ্যে ছড়াতে দেয়নি। জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাহস হয়নি বাংলা থেকে ২ কোটি বাঙালিকে তাড়ানোর হুমকি দেওয়ার। বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের সময়েও কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাহস হয়নি এই কথা বলার অথবা প্রবল বিভেদকামী আইন পাশ করার, কারণ সংসদে তখন বামপন্থীরা সংখ্যায় অনেক ছিল, আর তিনটি রাজ্যে বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বামপন্থীরা দুর্বল হলে দেশে ঘৃণার রাজনীতি আগুন জ্বালাতে পারে, দেশের সম্পদ বিক্রি করে দিতে পারে শাসকদল।

আন্দোলনের বর্শা ফলক

আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণ্য ও বিভেদকামী রাজনীতির  বিরুদ্ধে চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অথবা এনআরসি কেবলমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এই সমস্যা জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর। তাই কেবলমাত্র ধর্মের নাম করে কোনও আন্দোলন পরিচালিত হলে তা আরএসএস-বিজেপি’কে রুখতে পারবে না। বরং তাতে দাঙ্গার উত্তাপ ছড়াবে, আর এটাই চায় আরএসএস-বিজেপি। ধর্ম এবং রাজনীতিকে এক করতে চায় আরএসএস-বিজেপি। এটা দেশের ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক। এদের ফাঁদে পড়া হবে আত্মহত্যার শামিল। সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করে নয়, বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনের বর্শা ফলকের অভিমুখ থাকুক আরএসএস-বিজেপি’র ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতির প্রতি। দাবি উঠুক ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নয়, স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে দেশের ১৩৩ কোটি মানুষকে নাগরিকত্ব প্রমাণেই লাইনে দাঁড় করানো চলবে না। লড়াই হোক শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষকের ফসলের দাম, বেকারের কাজ, স্বল্পমূল্যে সবার শিক্ষার দাবিতে। লড়াই হোক ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি বিক্রি, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া কৃষকের আত্মহত্যা, ব্যাঙ্কে আমার/আপনার সঞ্চিত টাকা লুট, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। লড়াই হোক লুটে খাওয়াদের বিরুদ্ধে, খেটে খাওয়া মানুষের।

গণশক্তি, ১৭ডিসেম্বর, ২০১৯



20191213

বিজেপি বদলে দিতে চাইছে প্রকৃত ভারত


মহম্মদ সেলিম

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পেশ করেছে মোদী সরকার। বিলটি লোকসভায় পাশ হয়েছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে বদলে যাবে প্রকৃত ভারত— আমাদের দেশ। আসলে লোকসভায় বিজেপি সংখ্যার জোরে পাশ করিয়েছে।

এই বিলের মাধ্যমে নাগরিকত্বকে ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপি তাদের ২০১৪-র নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে বলেছিল শুধু হিন্দুদের কথা। পরে, কৌশলের অঙ্গ হিসাবে টোকেনের মত জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে। ভারত পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিল এক অনন্য উদাহরণ— ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। সেই ধারণাকেই  আঘাত করা হচ্ছে। আমরা কী করে অস্বীকার করব, শিখদের একাংশ দেশ ছাড়ছেন। খ্রিস্টানদের অনেকে চলে যাচ্ছেন গোলার্ধের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। হিন্দুদেরও অনেকে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। স্থানান্তর, দেশান্তরের প্রধান কারণ আর্থিক। কখনও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক কারণও থাকে।

সেখানে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রয়োজনীয়তা কী? দেশের ৯৯% যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের  কোনও সুরাহা নেই এই বিলে। তাঁরা কাজ চান, খাবার চান, আশ্রয় চান, পরিশুদ্ধ জল চান, যথাযথ মজুরি চান, ফসলের দাম চান, সামাজিক সুরক্ষা চান, নিয়মিত ভাতা চান, কাজের নিশ্চয়তা চান। তারজন্য আন্দোলন, তারজন্য লঙ মার্চ, ৮ জানুয়ারি হবে দেশজোড়া ধর্মঘট।

এই মুহূর্তে দেশের সামনে এই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। কিন্তু হতে দিচ্ছে না শাসকরা। যাদের প্রধান প্রতিভূ বিজেপি। মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রবল সঙ্কটের এই সময়েই নাগরিকতার মাপকাঠি ঠিক করার উদ্যোগ। এই ক্ষেত্রে শুধু ধর্মকেই ভিত্তি করা হচ্ছে না, ভাষা, জাতি এমনকি কোথাও কোথাও আঞ্চলিক সঙ্কীর্ণতাকেও ভিত্তি করে তোলা হচ্ছে। এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সেই সব বিচ্ছিন্নতা, বিভাজনকেই তীব্রতর করতে চাইছে। বিজেপি’র উদ্দেশ্যও তাই।

এর আগে বিজেপি প্রচার করত ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ লোকসভায় মমতা ব্যানার্জিও আরএসএস, বিজেপি’র এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টায় মদত দিয়েছিলেন। অনুপ্রবেশের সূত্র ধরে বিজেপি প্রচার করত, একদিন নাকি আলাদা ‘বাঙালিস্তান’ তৈরি হয়ে যাবে। এখন তারা এনআরসি এনেছে। এনআরসি আসলে ‘নিউ রিফিউজি ক্রাইসিস।’ তা কিন্তু শুধু ভারত ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থার উল্লেখ করে সংসদে যা বলেছেন, তাতে দু’ দেশের সম্পর্ক ক্ষুন্ন হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈদেশিক বিষয়ে, অন্য দেশের বিষয়ে সংসদে এই কথা বলার কথা নয়। যদি আদৌ তেমন বাস্তবতা থাকে, তাহলে রীতি মাফিক বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে কতবার এই নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন? কোনও উত্তর নেই।

এই বিলের নির্যাস হলো, বিজেপি-আরএসএস জনসংখ্যা আদান প্রদান করতে চাইছে। বার্তা দিতে চাইছে— প্রতিবেশী দেশগুলির হিন্দুরা আসুন। আধুনিক পৃথিবীতে এই ভাবে নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের আদান প্রদান আদৌ সম্ভব কিনা, তা এক বিরাট প্রশ্ন। তাছাড়াও এই বার্তা সেই সব দেশের এবং আমাদের দেশের স্থায়িত্ব, রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশকেও বিঘ্নিত করবে। উৎসাহিত হবে কারা? প্রতিবেশী দেশগুলির মৌলবাদী শক্তিগুলি উদ্দীপ্ত হবে। তাদের দেশের সংখ্যালঘু গরিব পরিবারগুলিকে ভয় দেখিয়ে বলার সুযোগ পাবে— ‘যাও, তোমাদের জন্য তো আলাদা দেশ হয়েছে।’ আসলে এই বিভাজনের বরাবর যে লক্ষ্য থাকে,  ধর্মীয়সহ নানা ধরনের মৌলবাদীদের সেই কায়েমী স্বার্থই জেগে উঠবে— সম্পত্তি দখল, জমি দখল। আমাদের দেশে তো বটেই আশেপাশের রাষ্ট্রগুলিতেও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে প্ররোচিত করে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এই নাগরিকত্ব বিল।

ভারত দীর্ঘ সময় শান্তি, জোট নিরপেক্ষতা এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই, বিশেষত নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগ শুরুর পর থেকে দেশ তার সেই পথ থেকে একটু একটু করে সরেছে।

এই বিলের পিছনে রয়েছে বিজেপি’র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সঙ্ঘ পরিবারের বহুদিন লালিত  হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি।

লোকসভায় বিল পেশের সময় অমিত শাহ দেশভাগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁর ইতিহাস জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমার কাজ নয়। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই দেশের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন তাঁরা। বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি দেশে সঙ্ঘের ভাবনার অন্যতম ধারক ছিলেন। তিনি দেশভাগের শুধু সমর্থকই ছিলেন না, দেশভাগ নিশ্চিত করতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। দেশে ‘হিন্দুত্বের’ ভাবনার উদ্গাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার দেশভাগের পক্ষে ছিলেন। সামগ্রিকভাবে আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মত সংগঠনগুলি মুসলিম লিগের মতই দেশভাগের পক্ষে কাজ করেছে, ব্রিটিশের মদতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় প্ররোচনা দিয়েছিল। দেশকে ভাগের চক্রান্তে এরাই তিন পান্ডা। লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক তাই বলেছেন, যা আরএসএস, তার স্বয়ংসেবকদের মাথায় ঢোকে।

কোন সময়ে দেশভাগের ব্লু প্রিন্ট? যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েছেন, দেশে বিপ্লবী শক্তি উদ্দীপিত হয়েছে। বড় বড় ধর্মঘট হচ্ছে চটকলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। নৌবিদ্রোহ কাঁপিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাসকে। শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে সেই বিদ্রোহ। তার পক্ষে জেগে উঠছে সমাজের অন্যান্য অংশ। একই সময়ে তেভাগার দাবিতে কৃষক সংগ্রাম দুর্বার।

দেশ বিভক্ত হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতেই হবে, তবু এই দেশ ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ মেনে নেয়নি। পাকিস্তান যারা চেয়েছিল, তাঁরা মেনেছিলেন। ভারতে তা একটি ঘৃণ্য ধারণা। ভারতের সংবিধানে এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক। বিজেপি সেই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-কে পুনরায় প্রয়োগ করতে চাইছে। তারা মানত জিন্না-মুসলিম লিগের সেই ধারণা। বিজেপি সেটাই নতুন করে চাপিয়ে দিতে চাইছে ভারতের উপর।

এটাই সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য। তারা  গণতন্ত্রকে মানে না। এরা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে  পরিণত করতে চাইছে এথনিক (জাতিগত) গণতন্ত্রে। তা আমাদের সংবিধানের মূল ভাবনার বিরোধী। পৃথিবীতে জাতিগত গণতন্ত্রের উদাহরণ ইজরায়েল। যা আসলে গণতন্ত্রই নয়। ইজরায়েলের জায়নবাদী রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। আরএসএস’র প্রধানরা বরাবর ইজরায়েলের এই ভাবনার প্রশংসা করেছে। কী সেই ভাবনা? একটি জাতিগোষ্ঠীর দেশ হবে। জায়নবাদী শাসকরা বলে ইজরায়েল সব ইহুদিদের দেশ। তেমনই এখানে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, যে কোনও হিন্দুর রাষ্ট্র ভারত। অর্থাৎ সংখ্যাগুরুর কর্তৃত্ব। কিন্তু ভারতে সেই মডেল চলতে পারে না। ভারত আর  ইজরায়েল এক নয়। ভারত নানা ধর্ম, জাতি, ভাষাভাষীর মানুষের মিলন ভূমি।

কিন্তু এখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে মহিমান্বিত করার অপপ্রয়াস চলছে। একই সঙ্গে এই ধারণা গড়ে তোলে একটি আশঙ্কা— ‘পবিত্রতা’ নষ্টের আশঙ্কা। যা অন্য ধর্ম, ভাষা, জাতির মানুষের প্রতি এক তীব্র ঘৃণার জন্ম দেয়। এই জেনোফোবিয়া গড়ে তোলারই চেষ্টা করেছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার। কোনও অপরাধ ঘটলেই বলার চেষ্টা হয়েছে নির্দিষ্ট কোনও অংশের মানুষ এটা করেছে। কখনও তাদের বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশি’। কখনও বলা হয়েছে রোহিঙ্গা। কখনও পুরোপুরি একটি ধর্মের মানুষকে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। একদিকে দেখানো হচ্ছে হিন্দুদের ‘রাইট টু রিটার্ন’। অন্যদিকে নির্দিষ্ট একাংশকে ভয় দেখানো— ‘চলে যাও। পাঠিয়ে দেবো বাংলাদেশে, পাকিস্তানে।’ অন্য ধর্ম, জাতি, ভাষার মানুষকে চিহ্নিত করা হয় ‘এজেন্ট অব বায়োলজিক্যাল ডাইল্যুশন’ হিসাবে। পবিত্রতা নষ্ট করে দিচ্ছে, এমন একটা আশঙ্কা বিজেপি ছড়িয়ে দিতে চাইছে  হিটলারের জার্মানি আর ইজরায়েলের জায়নবাদী কৌশলে। এর পথ ধরেই ‘লাভ জিহাদ’, ‘ঘর ওয়াপসি’,‘ইন্টার-কাস্ট ম্যারেজ’-র বিরোধিতা এসেছে।

ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দু আর্যদের আদিবাসী ধরে নিয়েই এই দেশকে ‘হিন্দুদের ভূমি’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। কিন্তু কে প্রকৃত আদিবাসী? এর জবাব কে দেবে? আর্যরা কারা? আর্যরা কী আদিবাসী? ইতিহাস বলছে আর্যরা বহিরাগত। আদিবাসীরাই এই দেশের আদি বাসিন্দা। তারা বহিরাগত নন। বিজেপি তা মানে না। ঐতিহাসিক, নৃতাত্বিক সেই সত্যের প্রতিষ্ঠা আটকানোর জন্যই এদের তারা বনবাসী বলে। আদিবাসী বলে না। এদের আদিবাসী বললে প্রমাণ হয়ে যায় যে, তথাকথিত ‘আর্যরা’ বাইরে থেকে এসেছে। এই হচ্ছে চালাকি। এনআরসি’তে তাই আদিবাসীরাও আশঙ্কিত। কারণ, তাদের আর নথি কোথায়?

লক্ষ্য হলো আধিপত্য কায়েমের পরিকাঠামোগত বিন্যাস। অর্থাৎ এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য এবং বাকিদের দ্বিতীয় শ্রেণি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।

নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগের প্রথম পর্যায়ে তার ঘোর সমর্থক তাত্ত্বিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এটি পরিকাঠামোগত সমন্বয়ের ব্যবস্থা। বেসরকারিকরণ, বিলগ্নি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দুর্বল করার সেই তত্ত্বের প্রভাব আজ আমরা বুঝতে পারছি। ছাঁটাই, বেকারি, কৃষি সঙ্কট, অভাব, মন্দার এই প্রভাবের কথা বামপন্থীরা বলেছিল ৯০-র দশকেই। নয়া আর্থিক নীতি, উদারনীতির পথকে তখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রবলভাবে প্রলোভনের বিষয়বস্তু করে তুলে ধরেছিল। আজ তার প্রকৃত রূপ বেরিয়ে পড়েছে। কিছু লোক প্রচুর ধনী হয়েছে। কিন্তু সিংহভাগ মানুষের অবস্থা খারাপ হয়েছে। আরও খারাপ হচ্ছে।

এবার বিজেপি চাইছে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামোগত বদল আনতেএই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের লক্ষ্য হলো নাগরিকত্বে বিভাজন। গ্রেডেশন করা। একদল হবে প্রেফারেবল— তারাই প্রধান, গ্রহণযোগ্য। আর এক দল হবে ব্রাত্য। মানসিক গোলামি হবে তাদের বৈশিষ্ট্য। সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ধাপে ধাপে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হবে ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু, ব্রাত্যদের সম্পর্কে। খাওয়া, পোশাক সমস্ত প্রশ্নে তৈরি করা হবে ভীতি, তার থেকে বেশি ঘৃণা। এখনও তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখি— কোনও পাড়ায়, কোনও আবাসনে ঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে। এবার এটাই ছড়িয়ে দেওয়া হবে সারা দেশে। এটা শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে থেমে থাকবে না। এই ধরনের বিভাজন জাতি, সংস্কৃতি, ভাষার ভিত্তিতেও ছড়িয়ে পড়বে।

উত্তর-পূর্বে এর অন্যরকম প্রভাব পড়বে। এর প্রভাব পড়বে বাজারে।  বিল পেশ করতে গিয়ে অমিত শাহ বলেছেন  ইনার লাইন পারমিট ব্যবস্থা থাকবে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষ তার বিরোধিতা করেছেন। কারণ, এতে সেখানকার পর্যটন, ব্যবসা মার খাবে। যারা কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বললেন, ৩৭০ নং ধারা তুলে দিলে নাকি কাশ্মীরের উন্নতি হবে, বিনিয়োগ বাড়বে। জমি কিনতে পারবে। কাশ্মীরের উন্নতি হবে। তারাই উত্তর পূর্বাঞ্চলে বলছেন ইনার লাইন পারমিট চালু হবে! নাগরিকরা যেতে পারবে না। তাহলে এখানে  ‘ওয়ান নেশান-ওয়ান অ্যাক্ট’ কোথায় গেল? নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে শুধু ধর্ম, জাতি, ভাষাতেই বিভাজন ঘটানো হয়নি। দেশকে আঞ্চলিকতাতেও বিভক্ত করা হয়েছে। কে কোথায় কাঙ্ক্ষিত, কে কোথায় ব্রাত্য তার সীমানা তৈরি হচ্ছে। একাংশের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই জাতিগত বা ‘এথনিক ডেমোক্র্যাসি’ হলো নন সিভিক ফর্ম অব ডেমোক্র্যাটিক স্টেট। অর্থাৎ সামাজিক স্বাধীনতা থাকবে না। মানবাধিকার থাকবে না।

প্রথমে আতঙ্ক ছড়ানো হলো। প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতা ছড়ালো। যে যুদ্ধ সীমান্তে ছিল, তাকে নিয়ে এল দেশের মধ্যে। প্রতিটি গ্রাম-শহর এখন যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ সরকার গঠনের সময়ে এই বিজেপি কী বলেছিল? এরা বলেছিল, যুদ্ধ করেই পাকিস্তানকে শায়েস্তা করবে। এখন সেই যুদ্ধটা তারা নিয়ে আসছে দেশের মধ্যে। প্রতিদিন ঘৃণা, আশঙ্কা, বিভাজন নিয়ে একটি দেশের মানুষ এগবে কী করে?

আতঙ্ক, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অনেককে দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। সেই পরিবেশ ওরা ফিরিয়ে আনতে চাইছে। দেশভাগের সময়ে পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে যে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি ভারতে এসেছিলেন, তাদের সেই ক্ষতকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। অন্যদিকে নিউ রিফিউজি ক্রাইসিস তৈরি করতে চাইছে। নতুন আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চাইছে। বাস্তবে পারবে কিনা, ঠিক নেই। আপাতত তা ভার্চুয়াল করে তুলতে চাইছে। যা ডেকে আনবে এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা।

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই আমাদের দেশের গড়ে ওঠার ভিত্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামও বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের আদর্শকে তুলে ধরেছে। ভগৎ সিং, সূর্য সেন, আসফাকউল্লাহ, রামপ্রসাদ বিসমিল, ক্ষুদিরাম বসুদের লড়াই ছিল আপসহীন।

এরাজ্যে এক জটিল পরিস্থিতি। তৃণমূল আর বিজেপি’র নকল কুস্তি আর আসল দোস্তি।  তৃণমূল কংগ্রেস কী করেছে? তারা মুখে বিরোধিতার কথা বলেছে। এনআরসি, এনপিআর, সিএবি হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচির অংশ। তাদের বিভাজনের রাজনীতির মোকাবিলা করতে হলে দরকার আদর্শভিত্তিক লড়াই। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির কোনও আদর্শ নেই। তিনি শুধু আদর্শহীনতায় ভুগেছেন তাই নয়, সুবিধাবাদেও নিমজ্জিত হয়েছেন। মমতা ব্যানার্জি ধর্মীয় বিভাজনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে। এখনও তিনি জনগণনা এবং জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-কে গুলিয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যে ডিটেনশান ক্যাম্পের জন্য জমি চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মমতা ব্যানার্জির সরকার সেই জমি দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশের মত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার বিরোধিতায় নিজের দলের পুরো শক্তিকে হাজির করেননি তিনি। এই হলো বিজেপি, সঙ্ঘের সঙ্গে আপসকামিতার পরিণাম। মমতা ব্যানার্জি আসলে সঙ্ঘের রাজনীতির পরিপূরক হয়ে উঠেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি গত আট বছরে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করেছেন। মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকে ছোবল মারতে চেয়েছে তৃণমূলই।

দ্বিচারিতা, আপস করে বাংলাকে রক্ষা করা যাবে না। দেশ আরো বিপন্ন হবে। আপসহীন সংগ্রামই পথ। একমাত্র বামপন্থীরাই পারে বিভিন্ন মঞ্চ, সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজ্যকে, দেশকে রক্ষা করতে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়েই পড়া এখন একমাত্র পথ। 

গণশক্তি, ১২ডিসেম্বর, ২০১৯ 

অনৈক্যের বাতাবরণ তৈরিই আসল উদ্দেশ্য


দেবেশ দাস

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯ লোকসভায় পাশ হয়েছে। বিলের মূল কথা— ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবধি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত ৬টি ধর্মাবলম্বী (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান) মানুষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হবেন না। বাইরের দেশের কোনও নাগরিকের ভারতে ঢুকতে পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে। পাসপোর্ট-ভিসা যদি না থাকে বা থাকলেও তার সময়সীমা পেরিয়ে যায়, তবে সে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। বিলের মানে দাঁড়াচ্ছে ঐ ৬টি ধর্মের কেউ ঐ তিনটি দেশ থেকে এইভাবে ভারতে ঢুকলে তাকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ধরা হবে না। সে কিন্তু নাগরিক হচ্ছে না, তার ভোটাধিকার থাকছে না, এমনকি সে উদ্বাস্তুও হচ্ছে না, এখন সে শুধু বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নয়। বিলে আছে, এই সমস্ত লোকদের সরকার নাগরিকত্ব দিতে পারে। এদেশে মোট পাঁচ বছর বাস করলে সে ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে।

তার মানে কি ঐ ৩টি দেশের উপরে-উল্লেখিত ৬টি ধর্মের সমস্ত লোক এদেশে এলে এইভাবে পাবে? ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে যে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি হয়, তার রিপোর্ট ২০১৯-এর জানুয়ারিতে বেরিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রশ্নোত্তরের সময় স্বরাষ্ট্র দফতর বলেছে যে এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র দফতরের ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ও ১৮ জুলাই, ২০১৬ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কাজ হবে। এই বিজ্ঞপ্তিতে, কেউ যদি ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বা সেই ধরনের নিপীড়নের ভয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আসে তাদের কথা বলা হয়েছে।  লোকসভায় সদ্য পেশ হওয়া বিলের পরিপ্রেক্ষিতে কী বিধি তৈরি হয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে যদি শুধু ধর্মীয় নিপীড়নের কথাই বলা হতো, তাতেই তো যথেষ্ট ছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে তো মুসলমানদের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন হচ্ছে না, তারা এমনিতেই বাদ পড়ত। কিন্তু, অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো করে শুধু মুসলিম বাদ দিয়ে অন্য ধর্মগুলির নাম করা হয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য– লিখিত পড়িত ভাবে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করা ও তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার গড়ে তোলা। এক অনৈক্যের পরিবেশ গড়ে তোলাই উদ্দেশ্য।

নাগরিক সংশোধনী বিলে ধর্মীয় নিপীড়নের কথা না বলেই মুসলিমদের বাদ রাখা হয়েছে। সংবিধান সম্মত এই কাজ? সংবিধানের ১৪নং ধারা বলছে আইনগত সমতা বা আইনগত সুরক্ষা থেকে কোনও ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যায় না। সেক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে কোনও একটা বিশেষ সুবিধা কোনও একটা ধর্মাবলম্বী মানুষদের বাদ দিয়ে ঘোষণা করলে তা সংবিধানের ১৪নং ধারাকে অমান্য করা হয়। স্বরাষ্ট্র দফতরের বিজ্ঞপ্তি ও এই নাগরিক সংশোধনী বিল সেটাই করছে। বিজেপি ভারতের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ তকমা মুছে ফেলতে চায়।  

এই বিল অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরে যারা বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে তাড়া খেযে এসেছেন তারা সবাই কি এবার ভারতের নাগরিক হয়ে যাবেন? হবেন না। ঐ জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির সভাতে প্রশ্নোত্তরের সময় ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বলেছিল– কয়েক দশক আগে যারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে এদেশে এসেছিল বলে দাবি করছেন ও ভারতের নাগরিকত্ব চাইছেন, তাদের বেশিরভাগই দেশভাগ হওয়ার পরপর যখন ব্যাপক হারে দেশান্তর হচ্ছিল তখন এসেছে, এদের দাবি আজ মানা সম্ভব নয়। ইনটেলিজেন্স ব্যুরো আরো জানিয়েছে, যে এতদিন পর্যন্ত যতো হিন্দু ঐ তিনটি দেশ থেকে এসেছে, নাগরিকত্ব বিল অনুযায়ী, তার মধ্যে মাত্র ২৫৪৪৭ জন হিন্দু নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী (এদের অনেকে পাঞ্জাবের), এদের আবার পাসপোর্ট-ভিসা আছে, ভিসার মেয়াদটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাহলে কয়েক লক্ষ বাঙালি হিন্দু যে আসামে এনআরসি’তে বাদ পড়ল, তাঁদের ভাগ্যে আর শিকে ছিড়ছে না। তবে, এবারের বিল পেশের সময়ে বলা হয়েছে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যাবে। নথিভুক্তি বা দেশীয়করণের মাধ্যমে সেই আবেদন বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন, সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু সম্প্রতি কেউ যদি ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য ওদেশ থেকে এসে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে কি হবে? জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্টে স্বরাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, সম্প্রতি যারা এসেছে, তাদের কাগজপত্র দেখা যেতে পারে, সেই কাগজপত্র দিয়ে যদি প্রমাণ হয় যে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তবে তার দাবি বিবেচনায় আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মীয় নিপীড়ন যদি কারোর উপর হয়ে থাকে বা তার ভয়ে যদি কেউ এদেশে এসে থাকে সে কিভাবে এটা প্রমাণ করবে যে, এটা তার উপরে হয়েছে? সে কি তাহলে পুলিশে ডায়েরি করে প্রমাণ নিয়ে আসবে? তাড়া খেযে যে আসছে, কী করে সে প্রমাণপত্রগুলি গুছিয়ে নিয়ে আসবে? জানবেই বা কী করে যে কী কী প্রমাণ নিয়ে যাওয়া দরকার। এদেশে এসেই বা জানবে কি করে যে কোথায় তাকে রিপোর্ট করতে হবে?

কোনও দেশে যদি কারো উপর ধর্মীয় নিপীড়ন হয়, নিপীড়িত মানুষজনের প্রতি সহানুভুতি, তাদের পাশে থাকা ভালো কাজ। কিন্তু, শুধু ধর্মীয় নিপীড়ন কেন? যে কোনও নিপীড়নের বিরুদ্ধেই তো থাকতে হবে। আমরা ছিলামও। পূর্ব-পাকিস্তানের উপর যখন পশ্চিম পাকিস্তান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ভারত যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে, দেশের মানুষ তা সমর্থন করেছিল। লাখো লাখো উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। এই নিপীড়ন তো ধর্মীয় নিপীড়ন ছিল না। আজ বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে মুসলিম মৌলবাদী বা দাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা বলে যদি কোনও মুসলিম নিপীড়নের মুখে পড়ে, সে মুসলিম বলে কোনো হিন্দু তাকে সমর্থন করবে না? কোনো কোনো মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে খুন করা হয়েছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলার জন্য। বাংলাভাষা বাঁচাতে যদি কোনো মুসলমানের উপর নিপীড়ন হয়, বাংলাভাষী হিন্দুরা মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? বহু মুসলিম তো পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষা বাঁচাতে শহীদ হয়েছে। 

আর শুধু ঐ ৩টি দেশই বা কেন? শ্রীলঙ্কা থেকে যে ১ লক্ষ শরণার্থী এসেছে তাদের কি হবে? বার্মা যে হাজার হাজার বাংলাভাষীকে তাড়ানো হলো তার কিছু হবে কি? প্রতিবেশী সব দেশের কথা ভাবা হোক। প্রতিবেশী সব দেশেই কারো উপর নিপীড়ন হলে আমরা তার পাশে দাঁড়ানোই তো ভালো। ১৯৪৮ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলির সভায় মানবাধিকার সম্বন্ধে একটি সার্বজনীন ঘোষণায় বলা হয়েছে কোনো নিপীড়নের থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেকেরই অন্য দেশে আশ্রয় চাওয়া ও পাওয়ার অধিকার আছে। প্রতিবেশী সমস্ত দেশগুলির থেকে এই  আবেদন আসলে তা গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। শুধু মুসলিমদের বাদ দিয়ে একটা আইন চালু করে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ভারতের যে সম্মান ছিল তার মুখ পোড়ানো কেন? মানুষে মানুষে গোলমাল লাগানোই আসল উদ্দেশ্য।

গণশক্তি, ১১ডিসেম্বর, ২০১৯



20190407

‘‘বিজেপি-তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই’’: বিমান বসু


 ‘‘বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই। অনেকেই ভুলে যান, বিজেপি-কে এরাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে এই তৃণমূলই। তৃণমূল আরএসএস-র মতো শক্তিকেও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না। আরএসএস-র অনুষ্ঠানে তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী!’’ গণশক্তিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা বললেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুতৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে গোপন বোঝাপড়া, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যার পাশাপাশি এরাজ্যে বামফ্রন্টের প্রচারের অভিমুখ ও  গোটাদেশে বামপন্থীদের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অজয় দাশগুপ্ত।



প্রশ্ন: লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বামফ্রন্টকর্মীরা মূলত কী আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন?
বসু: এবারের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে সারাদেশে একটা মোড় ঘোরানোর মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেভাবে দেশের সংবিধানের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে, সংবিধানের বিশেষ বিশেষ ধারাকে তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা আমাদের মত বহু ভাষা, বহু জাতি-বর্ণ ও বহু ধর্মের দেশে বিপজ্জনক। এটা বলছে কেন্দ্রে যারা সরকারে আছে, সেই এনডিএ-র নেতৃত্বে থাকা বিজেপি। এই বিজেপি-র প্রাণভোমরা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। এর অসংখ্য শাখা সংগঠন আছে, যারা নানান কায়দায় মানুষের মধ্যে এই ধরণের প্রচার করছে। আরএসএস-র প্রধান লক্ষ্যবস্তু, দেশের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই পরিবর্তন করা, সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেশ চালাতে চায় তারা। এই নির্বাচনে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে সেই চেষ্টা যে আরএসএস করবে, তা নিজেদের মধ্যে প্রচার করছে। কিন্তু ভারতের এই সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামো সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত। দেশের সংবিধানের এই ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তা রক্ষা করার লক্ষ্যেই বামফ্রন্টকর্মীরা প্রচার করছেন। শুধু তাই নয়, বিজেপি-র আমলে দেশের সাধারণ মানুষের ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতির মেলবন্ধন সুরক্ষিত নয়। তাই, বিজেপি-কে পরাস্ত করতে হবে। কে কী খাবে, কে কী পরবে, এই ধরণের ফতোয়া ওরা জারি করতে চায়! মানুষের ওপর এই অগণতান্ত্রিক আক্রমণ নামিয়ে আনছেএই বিজেপি দেশের মানুষের বন্ধু নয়, দেশের মানুষের শত্রু। অবশ্যই একাংশের মানুষের তারা জিগরি দোস্ত; তারা কারা? যারা মাত্র ১শতাংশ, তাদের বন্ধু বিজেপি। ওপরতলার এই ১শতাংশের হাতে ২০১৪সালে দেশের মোট সম্পদের ৪৯শতাংশ ছিল, ২০১৮সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩শতাংশ। এদেরই বন্ধু বিজেপি সরকার। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের এই মহান দেশকে সুরক্ষিত  রাখতে এবং দেশের আপামর জনগণ, শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থে, দেশের ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে আমরা স্লোগান দিয়েছি: ‘বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও’।

প্রশ্ন: এরাজ্যের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট তো একইসঙ্গে ‘তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও’ বলছে...
বসু: হ্যাঁ, এরাজ্যে আমরা একইসঙ্গে ‘তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও’ স্লোগান দিয়েছি। অনেকে এটা বলতে পারেন, এটা তো লোকসভা নির্বাচন। এই রাজ্যের শাসকদলকে কেন আমরা হটানোর কথা বলছি? তার কারণ হলো, বিজেপি-কে এরাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে এই তৃণমূলই, সেকথা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন। ১৯৯৮সালে তৃণমূল দল তৈরি হওয়ার পর অনেক অশুভ শক্তির সঙ্গেই এই দল সম্পর্ক তৈরি করেছিল, যারমধ্যে বিজেপি-ও ছিল। পরে বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার তৈরি হলে তার অংশীদার হয় তৃণমূল। তৃণমূল আরএসএস-র মতো শক্তিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না। আরএসএস-র মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার এক অনুষ্ঠানে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী গিয়ে বলেছিলেন, না এলে জানতাম না, এরা কতো ভালো! তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী! নানাসময় বিজেপি-র গুণগানও করেছে তৃণমূল। স্বাভাবিকভাবে যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিরই এই ধারণা থাকা ভালো, বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই। আর ২০১১ সালে সরকারে আসার পর আমরা দেখছি, এই তৃণমূল সরকার নানাভাবে মানুষের টুঁটি চিপে ধরছে, অধিকার হরণ করছে। তৃণমূলের পক্ষ থেকে লাগাতার কমিউনিস্টদের ওপর, বামপন্থীদের ওপর, যারা এই সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, তাদেরকেই আক্রমণ করা হচ্ছে। এলাকার পর এলাকায় বামপন্থীরা বাড়িঘর ছাড়া হয়েছেন, লাগামহীন অত্যাচার, খুন চলছে। সাধারণ মানুষকে এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে হচ্ছে, জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে হচ্ছেবিশেষ করে, দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার তৈরি হওয়ার পর আমরা দেখছি, লুঠতরাজের রাজত্ব খোলাখুলি শুরু হয়ে গেছে। বেপরোয়া তোলাবাজি চলছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে যারা জমি পেয়েছিলেন, তফসিলী জাতি, আদিবাসী বা ধর্মের বিচারে মুসলমান মানুষ, তাঁদের অনেকের জমি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা ফসলের ন্যয্য দাম পাচ্ছেন না। সারাদেশের মতো এরাজ্যেও কৃষিসঙ্কট শুরু হয়েছে, যা বামফ্রন্ট সরকারের সময় রোখা গিয়েছিল। তৃণমূল সরকার মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে আক্রমণ নামিয়ে আনছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেইজন্য রাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে জোরদার করতেই তৃণমূলকে পরাস্ত করার বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রশ্ন: সম্প্রতি এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা ২৯দিন ধরে অনশন করলেন। শিক্ষাক্ষেত্রের অন্যান্যরাও আন্দোলনে নেমেছেন। কিন্তু তৃণমূল সরকার তো এরাজ্যে ব্যাপক উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছে....
বসু: হ্যাঁ, তৃণমূল সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের উদ্দাম প্রচার চলছেকিন্তু উন্নয়ন-এর কথা দিনরাত জপ করলেও মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত এই আমলে দিনদিন দুর্বল হচ্ছেসে এসএসকে বা এমএসকে, অথবা প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক হোক, অথবা মাদ্রাসায় প্রতিটি স্তরেই শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। নিয়োগ হচ্ছে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তো প্রতিবছর বাড়বে, কম কম হলেও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।  বামফ্রন্ট সরকারের সময় যেখানে একবার মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা একবছরে ৭লক্ষ থেকে লাফিয়ে ৯লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিল, যা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাথমিক ফল। একটা প্রজন্মের পর দ্বিতীয় প্রজন্ম শিক্ষার আঙিনায় এলে এটা হয়। এখন যেমন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। তাহলে মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কমবে কেন? কিন্তু এবারে কমেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও অনেক ঢক্কানিনাদ শোনা যায়। কিন্তু শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মতোই এখানেও শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। যে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নই করতে পারে না, সে আবার কী করে উন্নয়নের দাবি জানায়? 

প্রশ্ন: বিজেপি সভাপতি ও শীর্ষ নেতারা এসে এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন প্রশ্ন, অনুপ্রবেশ, এনআরসি প্রভৃতি প্রসঙ্গ প্রচার করছে। প্রধানমন্ত্রীও এতদিন বিকাশের কথা বলে এখন একইভাবে এইসব সাম্প্রদায়িক প্রচারে নেমেছেন। তৃণমূলও পালটা প্রচার করছে। একদিকে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং অন্যদিকে গোপন বোঝাপড়া, এই দ্বিমুখী বিপদকে বামপন্থীরা কিভাবে মোকাবিলা করবে?
বসু: এরা শলাপরামর্শ করেই পরস্পরের বিরুদ্ধে নাম করে তোপ দাগেবিজেপি সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী এরাজ্যে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তৃণমূলনেত্রীকে ‘দিদি’ ডেকে তোপ দাগেন, আবার তৃণমূলনেত্রী তাঁদের নানা নামে ডেকে পালটা বলছেন। মনে হবে ওদের মধ্যে ভীষণ বিরোধ আছে! আসলে এটাই ওদের বোঝাপড়া তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে বোঝাপড়া থাকার কারণেই গত ৫বছরে সারদা-রোজভ্যালিসহ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি! নারদা ঘুষকান্ডের ভিডিও ফুটেজ ফরেনসিক টেস্টে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সংসদের এথিক্স কমিটির একটি বৈঠকও তিন বছরে ডাকেনি এনডিএ সরকার! কেন? অন্যদিকে, সুক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ উভয় দলের পক্ষ থেকেই চলছে। রামনবমীকে কেন্দ্র করে হঠাৎ দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো! গতবছর রামনবমীর দিন যেভাবে দাঙ্গা হলো অতীতে পশ্চিমবাংলায় কখনো তা হয়নি। আবার আসানসোলের ইমামের যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে। তাঁর পুত্র খুন হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে ‘আমন’ বা শান্তি বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। রামনবমীকে কেন্দ্র করে যে হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি হলো, এরজন্য দায়ী তৃণমূল কংগ্রেস। একইসঙ্গে বিজেপি-ও, যাকে হাতে ধরে নিয়ে এসেছে তৃণমূল। বিজেপি এরাজ্যে তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের মাধ্যমে এই ধরণের কার্যকলাপ করার সুযোগ পেয়েছে। আরএসএস-র শাখা তৃণমূলের আমলে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিমবাংলায়। সারাদেশে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছে, তা এখানেও সুকৌশলে করছে। অন্যদিকে, তৃণমূলও ভিন্ন কায়দায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করছে। উভয় দলের পক্ষ থেকে মানুষকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে। এই দুটি দক্ষিণপন্থী দলই বামপন্থীদের শত্রু। কারণ, এতদিন ধরে বামপন্থীরা যে সমস্ত ইস্যুতে আন্দোলন করেছে, যেমন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম, বেকার যুবকদের চাকরি, শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতিসহ বিভিন্ন জনসাধারণের রুটিরুজির সমস্যা, তা এদের দুই দলের বিরুদ্ধেই। নির্বাচনের মুখে এসে সেসব মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে আমাদের মানুষের মধ্যে ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করতে হবে।  নানারকম প্ররোচনা সত্ত্বেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেষ্টায় অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোখা গেছে, যা পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য।    

প্রশ্ন: এরাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী ভোট এক জায়গায় করার উদ্যোগ আপনারা নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। বামফ্রন্ট দুটো আসনে প্রার্থী দেয়নি। সেই দুটো আসনে বামফ্রন্টকর্মীরা কী প্রচার করবেন? 
বসু: এরাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট এক জায়গায় করার লক্ষ্যে আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে চেয়েছিলাম। সেই উদ্যোগ শেষপর্যন্ত সেভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু দুটো আসন, মালদহ দক্ষিণ এবং বহরমপুরে বামফ্রন্ট কোনো প্রার্থী দেয়নি। এতেই বোঝা যাবে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী। তৃণমূল ও বিজেপিকে পরাস্ত করার লক্ষ্যেই এই দুই কেন্দ্রে কাজ করছেন বামফ্রন্টকর্মীরা। যেহেতু এই দুই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট প্রার্থী নেই, বিজেপি ও তৃণমূলকে হারাতে সক্ষম এবং এরাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে এমন প্রার্থীর পক্ষেই তাঁরা প্রচার করছেন। কেন্দ্রে একটি বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনে সহায়ক শক্তিকে এই দুই এলাকায় জয়ী করার লক্ষ্যে ভোট দেবেন বামফ্রন্টকর্মীরা।

প্রশ্ন: ২০১১সালের পর থেকে এরাজ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের ভয়াবহ সন্ত্রাস দেখা গেছে। লোকসভা নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হবে বলে মনে করছেন?
বসু: একথা ঠিক যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় বহু জায়গায় মনোনয়নপত্রই জমা দিতে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে বীরভূমের উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যেখানে জেলা পরিষদের আসনেও বিরোধী দলের কাউকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। তবে লোকসভা নির্বাচনে হুবহু তার পুনরাবৃত্তি হবে বলে আমি মনে করি না। যদি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে এলাকায় এলাকায় রুটমার্চ করানো হয় এবং পোলিং স্টেশনের বাইরে মোতায়েন করা যায়, তবে ভোটারদের মধ্যে ভোটদানের পক্ষে আস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, ভোট যারা লুট করে, তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজ্য প্রশাসন, সেইসব ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আটকানো যায়, তবে মানুষ ভোট দিতে পারবেনআর জনগণের পক্ষ থেকেও নিজের ভোট নিজে দেবো এই জেদ ধরেই চলা উচিত। এক্ষেত্রে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম জারি রাখতে জানকবুল লড়াই করা একান্ত জরুরী।     

প্রশ্ন: কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বিকল্প সরকার গড়ে তোলার যে স্লোগান বামপন্থীরা দিয়েছে, তা কতটা সফল হবে বলে মনে করেন?
বসু: এবারের লোকসভা নির্বাচনে আমরা স্লোগান দিয়েছি, বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করো, লোকসভায় সিপিআই(এম) ও বামপন্থীদের শক্তি বাড়াও এবং কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিকল্প সরকার তৈরি করো। সারাদেশে এখন যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে এবং আমাদের রাজ্যে, তাতে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিজেপি-বিরোধী একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার তৈরির বাস্তবতা রয়েছে। বিজেপি সারাদেশে ধিক্কৃত হয়েছে, সারাদেশে বিজেপি-র আসন কিভাবে কমবে, তা ওরা উপলব্ধি করতে পারছে না। নির্বাচনের পরে এনডিএ-বিরোধী একটি সরকার তৈরির বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি হলে তা নিশ্চয়ই গতিবেগ পাবে  এবং বিকল্প একটি সরকার তৈরি হবে, সেই আশা রাখছি।     



20190401

নির্বাচনের পরে রাজ্য-রাজনীতিতে সৃষ্টি হবে নতুন পরিস্থিতি: সূর্য মিশ্র


সারা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের মানুষও সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি। এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে কোন আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন বামপন্থীরা? কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের মধ্যে মেরুকরণের চেষ্টা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক প্রচার, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা, এসবের মোকাবিলা করে বামপন্থীরা কী তাদের বিকল্পের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে পারবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে? গণশক্তিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিতভাবে মতামত জানিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। নির্বাচনের পরে এরাজ্যের রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য: 
-----------------------


প্রশ্ন: এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বামপন্থীরা কী আবেদন জানাবে? এই নির্বাচনে এরাজ্যের মানুষ কেন বামপন্থীদের সমর্থন করবেন?

মিশ্র: এই নির্বাচনে দেশের ও রাজ্যের মানুষের সামনের প্রধান বিষয়গুলির থেকে মানুষের নজর সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা। ৪৫ বছরের মধ্যে এমন খারাপ অবস্থা হয়নি। কাজ ছিলো  যাদের তাদেরও কাজ চলে যাচ্ছে। মোদী বলেছিলেন, প্রতি বছরে দুকোটি বেকারকে কাজ দেবেন। এখানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বেকারী শতকরা চল্লিশ ভাগ বেকারী কমে গেছে রাজ্যে। যে যা খুশি বলছেন। কিন্তু জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য যা সরকার চেপে রাখার চেষ্টা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ৫বছরে ৫কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ১কোটি ৮০লক্ষ মানুষ শিল্প ও পরিষেবার থেকে কাজ হারিয়েছেন মূলত নোটবন্দী ও জিএসটি’র কারণে এবং ধারাবাহিক শিল্পমন্দার কারণে। তার সঙ্গে প্রায় ৩কোটি ২০লক্ষ মানুষ যারা কৃষিকাজে স্থায়ীভাবে না হলেও যুক্ত ছিলেন তাঁরা কাজ হারিয়েছেন। শিল্প কৃষি দুটোতেই নজিরবিহীন সঙ্কট। ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হচ্ছে, লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কারখানার বেসরকারীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবার শিক্ষায় ইন্টার্ন নিয়োগের কথা বলেছেন যেগুলো আদৌ স্থায়ী কর্মসংস্থান নয়। কেন্দ্রীয় সরকারও রেল এবং অনেক ক্ষেত্রে এই কাজই করছে। কৃষিতে স্বাধীনতার পরে এমন সঙ্কট আসেনি। ফসলের দাম না পাওয়ায় চাষের খরচও উঠছে না, কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ফসলের দাম দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুন করবেন। আর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের আয় তিনগুন হয়ে গেছে। দুটোই হাস্যকর দাবি। কৃষকরা দুরবস্থার মধ্যে আছেন। ফসলবীমার নামে ৫টা কর্পোরেট সংস্থা ৭হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। অন্যদিকে এরাজ্যে অকাল বৃষ্টিতে আলুর ক্ষতি হয়েছে, আলু নিয়ে কৃষকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। কেজি প্রতি ৭টাকার কম দাম হলে কৃষকদের লাভ হয় না, অথচ আলুচাষীরা ২-৩টাকা দাম পাচ্ছেন। সরকার সমস্যাটা স্বীকারই করতে চাইছে না। তেলেঙ্গানা সরকার রায়তবন্ধু নামে, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকসম্মান নামে আর এরাজ্যের সরকার কৃষকবন্ধু নামে প্রকল্প যা করেছে তাতে ফসলের দাম, বীমা, ঋণ এসবের সমাধান না করে কৃষকদের হাতে থোক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এতে সমস্যা মিটবে না। তাছাড়াও সরকারের জনবিরোধী নীতির জন্য মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। শিক্ষা স্বাস্থ্যে সরকারের বেসরকারীকরণের জন্য মানুষের খরচ বাড়ছে, বোঝা বাড়ছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ফোন পেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদেশের মোটরসাইকেলের ওপর শুল্ক তুলে নিচ্ছেন। আর আমেরিকা এখানকার ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক চাপাচ্ছে। দেশের শিল্প পরিষেবা রক্ষায় সরকারের নজর নেই। এই সব জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীরা।

এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই জায়গাতেই দুর্নীতি। ওখানে রাফালে দুর্নীতি, এখানে সারদা নারদ দুর্নীতি। ওখানে ওরা থাকলে যে এখানে এরা নিরাপদ তা এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পাঁচ বছর হয়ে গেলো কেন্দ্রীয় সরকারের সিবিআই, ইডি কেউ সারদার নারদার আসামীদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করেনি, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমরা স্পষ্টভাবে মানুষের কাছে বলছি, এই সব বিষয়ে বামপন্থীদের বিকল্প রয়েছে। আমরা যে দাবি নিয়ে ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘট করেছি, ব্রিগেডে সমাবেশ করেছি, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং দিল্লির বুকে শ্রমিক, কৃষক, আশা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন করেছি, ইশতেহার প্রকাশ করে উল্লেখ করেছি, সেইসবই আমাদের বিকল্প। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। আদিবাসীদের এবং তফসিলি জাতির মানুষের উন্নয়ন কর্মসূচী কেন্দ্রীয় সরকার ছাঁটাই করছে, নারী ও শিশুকল্যাণে বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে, দলিত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, আর এরাজ্যে মহিলাদের নিরপত্তার হাল তো সবাই জানেন। সংখ্যালঘু দলিতদের ওপরে আক্রমণের ঘটনা বারবার দেখা যাচ্ছে সারা দেশে। আমাদের বার্তা হলো এই যে এসবের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা বিকল্পের দাবিতে যে লড়াই আন্দোলন করছে তার কন্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দিতে হবে। সেটা যে করা যায় ২০০৪ সাল তার একটা দৃষ্টান্ত। সেই সময়ে সংসদে বামপন্থীরা যখন শক্তিশালী ছিলো তখন কাজের অধিকার, আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার, বীমা ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ রোধ, খাদ্য ও শিক্ষার অধিকারের নিশ্চয়তা এসব করা গেছিলো। এখনকার পরিস্থিতি ২০০৪ সালের থেকেও কঠিন, আক্রমণ আরও তীব্র, কিন্তু এখনও বামপন্থাই বিকল্প। আমরা মানুষের কাছে বামপন্থীদের বিকল্পের লড়াইয়ের কন্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই আবেদন করবো।

প্রশ্ন: জনজীবনের সমস্যার সমাধানের জন্য যে বিষয়গুলিকে আপনারা বামপন্থীদের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরছেন, সেই বিকল্পের জন্য বামপন্থীরা এরাজ্যে আন্দোলন সংগ্রাম কতটা করতে পেরেছে? তার কোনো প্রভাব নির্বাচনে পড়বে কি?

মিশ্র: এরাজ্যে এবং সারা দেশে এই সময়কালে যদি কেউ লড়াইয়ের ময়দানে থেকে থাকে তাহলে তা বামপন্থীরাই। আমরা নিরন্তর আন্দোলনেই আছি। গত আগস্ট মাসে সারা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের জেলাগুলিতেও আইন অমান্য আন্দোলন হয়েছে। শত শত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, বামপন্থী কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। জনজীবনের দাবি নিয়ে বামপন্থী গণসংগঠনগুলি, তাদের সংগঠন বেঙ্গল প্ল্যাটফর্ম অব মাস অর্গানাইজেশন একাধিক পদযাত্রা করেছে। তারপরে ৪৮ ঘন্টার সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যের সরকারগুলি যা করেনি এরাজ্যের তৃণমূল সরকার সেই আক্রমণ করেছে ধর্মঘট ভাঙতে। আইনী এবং বেআইনী পদক্ষেপ নিয়ে ধর্মঘট ভাঙতে চেষ্টা করেছে, আক্রমণের রেকর্ড তৈরি করেছে। কিন্তু মানুষের বার্তা স্পষ্ট ছিলো, ঐতিহাসিক ধর্মঘট হয়েছে। তারপরে সেই বার্তা নিয়ে ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছে বামফ্রন্টের। ব্রিগেডের সমাবেশ প্রমাণ করেছে, বামপন্থীরাই শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করছে। নির্বাচনে নিশ্চয়ই এর প্রতিফলন ঘটবে।

প্রশ্ন: এটা কেন্দ্রের সরকার গঠনের নির্বাচন। কিন্তু এরাজ্যের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য্য কী? বিশেষ করে বামপন্থীরা যখন কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদলেরই বিরোধিতার কথা বলছে, তখন এই নির্বাচন কি রাজ্য রাজনীতিতে নতুন কোনো পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে?

মিশ্র: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ২মাসের মধ্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার হঠে যাবে, মোদী আর গদিতে থাকবেন না। কেন্দ্রে একটা বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার তৈরি হবে এবং বামপন্থীদের শক্তি সংসদে বাড়বে। এরমধ্য দিয়ে সারা দেশে মানুষের দাবির লড়াই আরও প্রসারিত হবে। এরাজ্যেও নির্বাচনের পরে তার প্রভাব পড়বে, তৃণমূল কংগ্রেস আরও দু’বছর সরকার চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ তৃণমূল দলটাই ভেঙে যাচ্ছে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দল ভেঙে বিজেপি’তে যোগ দিচ্ছে। আরও অনেকে ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ রাখছে চলে যাবে বলে। কারণ যারা লুটপাটের মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন তাঁরা আধিপত্য রাখার জন্য আনুগত্য বদলাতে চাইবে। এই অবস্থায় বর্ধিত শক্তি নিয়ে বামপন্থীদের লড়াই হবে বিজেপি যাতে মাথা তুলতে না পারে এরাজ্যে, তার জন্য নতুন পর্বের সংগ্রামের সূচনা হবে।

প্রশ্ন: কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং এরাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার করছে। এই মেরুকরণের মোকাবিলা করে কীভাবে বামফ্রন্ট নির্বাচনে লড়াই করবে?

মিশ্র: বিজেপি বলছে গণতন্ত্র আক্রান্ত। ঠিকই তো। কিন্তু গণতন্ত্র তো ২০১১ সাল থেকেই আক্রান্ত। আমরা তখন থেকেই বলছি, বিজেপি তখন কী করছিলো? বিজেপি সরকারের তো পাঁচবছর হয়ে গেলো, অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট আদেশ থাকা সত্ত্বেও চিটফান্ডে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? কেন প্রতারকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে প্রতারিতদের টাকা ফেরৎ দেওয়া হলো না? নারদ টেপ তো ফরেনসিকে প্রমাণিত, ওটা জাল নয়। সংসদে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আদবানি। কেন একদিনও সেই কমিটি বসতে পারলো না এটা নিয়ে? এটা বোঝাপড়া নয় তো বোঝাপড়া কাকে বলে! আর গণতন্ত্র নিয়ে বিজেপি কী বলবে, এখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা ৩৪শতাংশ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় দেখেছি, ত্রিপুরায় বিজেপি সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে প্রায় ৯৯শতাংশ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় করে। রামনবমীতেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে দুটো দলকেই দেখো গেছে। নীতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, যে কোনো প্রশ্নে তৃণমূল এবং বিজেপি একে অপরের পরিপূরক, কোনো ফারাক নেই। এই যে সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো’র স্ত্রীকে নিয়ে বিমানবন্দরের ঘটনাটা ঘটলো। উনি নাকি ২কেজি সোনা নিয়ে এসেছিলেন। তা কাস্টমস সেটা আটক করলো না কেন? কাস্টমস্‌ কারা চালায়? নতুন ফেডারেল কাঠামোয় ওটাও রাজ্যের হাতে চলে এসেছে নাকি! কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই? কাজেই বিজেপি’র প্রতিবাদ করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। ত্রিপুরার মতো গোটা তৃণমূল দলটা যদি এখানেও বিজেপি’তে চলে যায় অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তৃণমূলকে ভোট দেওয়া আর বিজেপি’কে ভোট দেওয়া একই ব্যপার। তাই আমরা নির্বাচনে দুটো দলের বিরোধী ভোটকে ঐক্যবদ্ধ করার আহবান জানিয়েছি।

প্রশ্ন: যেভাবে যুদ্ধোন্মাদনা এবং জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ জাগানো হচ্ছে তাতে জনসাধারণের রুটিরুজির সমস্যা কি নির্বাচনের মুখে এসে চাপা পড়ে যাচ্ছে? কাশ্মীরেরর ঘটনা, জওয়ানদের মৃত্যু এবং সীমান্তে সেনা কার্যকলাপ কি এরাজ্যেও ভোটদানের সময় জনসাধারণকে চালিত করবে?

মিশ্র: ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ রাজ্যে, বিশেষত রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো বিজেপি’র শক্ত ঘাঁটিতে তাদের পরাজয়ের পরেই আমরা সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে বলেছিলাম বিজেপি অপরাজেয় নয় প্রমাণিত হলো। কিন্তু তখনই সতর্ক করেছিলাম এরা আরও তুরুপের তাস বের করবে। বাস্তবে তাই করেছে। রামমন্দির ইস্যুকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়ার কথা বলে মেরুকরণের চেষ্টা করেছে। আর সেই সঙ্গে কাশ্মীর ও পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করে সারা দেশে তার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করেছে। আমরা এই বিষয়গুলি নিয়ে ডিসেম্বর মাসেই সতর্ক করেছিলাম। কাশ্মীরে বিজেপি পিডিপি’র সঙ্গে সরকারে ছিলো, সেই সরকারকে ভেঙে দিলো। ওখানকার মানুষের আস্থা নষ্ট করছে, তাঁদের অধিকার খর্ব করছে। পুলওয়ামায় ঘটনার জন্য দায়ী তো সরকারের গাফিলতি। বিজেপি সরকারের আমলে দেশে নিরাপত্তা রক্ষীরা বেশি সংখ্যায় প্রাণ দিয়েছে, আর সীমান্ত পার থেকে অনুপ্রবেশও বেশি সংখ্যায় হয়েছে। এই সরকার দেশের নিরাপত্তা, সংবিধান, ঐক্য সবকিছু রক্ষাতেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এখন সেগুলো থেকে নজর ঘোরাতে বায়ুসেনার কর্মী অভিনন্দনের ছবি দেখিয়ে ভোট চাইতে হচ্ছে! এতই দেউলিয়া অবস্থা বিজেপি’র। কিন্তু ওরা মানুষের প্রকৃত বিষয়গুলি থেকে নজর ঘোরাতে চাইলেও আমরা বামপন্থীরা প্রকৃত বিষয়গুলি নিয়েই প্রতিদিনের লড়াইতে আছি। এই যে ধর্মতলায় এসএসসি উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা অনশনে বসে মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘অনশন’এর রেকর্ড ভেঙে দিলেন সেটা কী এইসব মেরুকরণ করে নজর ঘুরিয়ে আটকাতে পারলো? আলুচাষীদের বিক্ষোভকে আটকাতে পারলো? পারবে না। তবে আমরা মনে করি, স্বাধীনতার পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে দুবার এরকম চ্যালেঞ্জ এসেছিলো। ১৯৭৭ সালে এবং ২০০৪ সালে। দুবারই দেশের নির্বাচকমন্ডলী প্রমাণ করেছেন যে সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ মোকাবিলায় তাঁরা সক্ষম। 

প্রশ্ন: আমাদের শেষ প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচন সহ বিভিন্ন নির্বাচনে শাসকদলের সন্ত্রাস দেখা গেছে। মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এবার অবাধে ভোট দিতে পারবেন কিনা। লোকসভা নির্বাচনে কি এর জন্য আপনারা নির্বাচন কমিশনের ওপরেই ভরসা করছেন?

মিশ্র: আমরা বারবার বলছি, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা, নিরপেক্ষতা, কার্যকারিতা এসব নিয়ে কোনো অতিরিক্ত মোহ রাখবেন না। তার মানে এই নয় যে কমিশনে অভিযোগ জানাবেন না। অভিযোগ জানাতে হবে, লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। সুযোগের ব্যবহার করতে হবে। অভিযোগ করে কিছু তো আদায় করা সম্ভব হয়। যেমন গতবার তো পরিচিতি পত্র ছাড়াই বুথ শ্লিপ দিয়ে ভোট দিয়েছিলো। এবার কমিশন আমাদের দাবি মেনেছে। কাজেই মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে, অধিকার রক্ষার লড়াইতে মানুষকে সংগঠিত করাটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, যে এটা পঞ্চায়েত নির্বাচন নয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় যে সব নির্বাচন এই সময়ে হয়েছে সব অবাধ হয়েছে এমন মোহ আমি রাখতে বলছি না। কিন্তু আমি বলছি, বাস্তবতা হলো, তৃণমূল ভয় পেতে শুরু করেছে। পঞ্চায়েতে ৩৪শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেও এমন শতাধিক পঞ্চায়েত আছে যেখানে তৃণমূল জিতেও কর্মকর্তা নির্বাচিত করতে পারছে না। তৃণমূলের হাতে তৃণমূলই আক্রান্ত। তৃণমূলের নেতাদেরই নিরাপত্তা নেই। এমনকি বিধায়কদেরও নেই। কেউ ছাড় পাচ্ছে না, নিজেদেরই হাতে আক্রান্ত হচ্ছে, বোমা ফাটছে, খুন হচ্ছে। তৃণমূলের এত দ্রুত ক্ষয় ২০১১ সালের পরে কখনো দেখা যায়নি। এই অবস্থায় প্রত্যেক বুথে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষ লাল পতাকা তুলে ধরবেন, বামপন্থী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাবেন। মানুষ যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে ওরা পালাবে। এটাই বাস্তবতা। কাজেই আমি বলিষ্ঠ আশাবাদে বিশ্বাসী। মানুষ শপথবদ্ধ হচ্ছেন, মরিয়া হয়ে তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এটাই সুষ্ঠু ভোটের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি হতে পারে। 

গণশক্তি, ১লা এপ্রিল, ২০১৯