20220905

‘‘জুতোটা ঠিক জায়গায় লেগেছে তো?’’


অজয় দাশগুপ্ত
 

সেদিন অফিসে ঢুকতেই অভীকদা বললো, ‘‘একবার ওবাড়িতে যাও। বিমানদা তোমাকে ডেকেছেন!’’

আমি ব্যাগটা রেখে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আলিমুদ্দিনে ছুটলাম।

বিমানদা আমাকে দেখেই বললেন, ‘‘শোনো, তোমাকে কাল একবার জ্যোতিবাবুর বাড়ি যেতে হবে। ৩১ তারিখের সমাবেশের জন্য ওনার একটা শুভেচ্ছা বার্তা আনতে হবে।’’

২০০৯ সালের ৩১আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে বামফ্রন্ট ধর্মতলায় বিশাল সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। তার দু’দিন আগের এই ঘটনা।

আমি বিমানদাকে বললাম, ‘‘জ্যোতিবাবুর একটা লেখা তো করে এনেছি। সেটা ৩১তারিখ গণশক্তিতে ছাপা হবে।’’

বিমানদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, জানি সেটা। এটা শুভেচ্ছা বার্তা, সমাবেশে পাঠ করা হবে। জ্যোতিবাবু তো তোমার কথা বললেন।’’

বলে বিমানদা হাসতে লাগলেন, ‘‘জ্যোতিবাবু বললেন, ‘তোমার ওই মোটা ছেলেটাকে পাঠিও, ও নিয়ে যাবে।’ উনি মোটা ছেলেটা বলতে কাকে বলেন, সেটা আমি জানি। যাইহোক, তুমি কখন যাবে, সেটা জয়ের সঙ্গে কথা বলে নিও।’’

**********************

অফিসে এসে জয়কৃষ্ণ ঘোষকে ফোন করলাম। পরদিন সকাল দশটায় ইন্দিরা ভবনে যেতে বললেন। নিয়মমতো দশটার আগেই পৌঁছে গেলাম। কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় উনি বাইরের ঘরে এলেন। এসেই বললেন, ‘‘বিমান এসেছিল। ও বললো, যা প্রস্তুতির খবর এসেছে, তাতে বিশাল সমাবেশ হবে। এত মানুষ আসবেন, আপনি একটা শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিলে ভালো হয়আমি বলছি, তুমি লিখে নাও।’’

উনি খুব সংক্ষেপে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিলেন। খুব তাড়াতাড়িই আমার কাজ শেষ হয়ে গেল। 

**********************

 

                                                  সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ

১৯৫৯ সালের ৩১আগস্টের ঘটনার পর ২১ সেপ্টেম্বর বিধানসভার অধিবেশন শুরু হলে খাদ্য আন্দোলনের ফলে পুলিশী আক্রমণে নিহত ৮০ জন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালনের দাবি জানানো হলে তা মানতে অস্বীকার করে শাসক কংগ্রেস ও পিএসপি-র সদস্যরা। তখন তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। এমনকি জুতো ছোড়াছুড়িও হয়েছিল বলে জানা যায়হইচই থামলে জ্যোতিবাবু খাদ্য আন্দোলনের প্রসঙ্গে মুলতবি প্রস্তাব এনে তৎকালীন রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বিধানসভায় ভাষণ দেন। পরে বিধান রায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলের সদস্যরা। ২৮ সেপ্টেম্বর অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরেও ভাষণ দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু।

সেদিনের গণশক্তিতে জ্যোতিবাবুর ২১ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতাটিই পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছিল। আমি ওঁর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই ওনাকে ওই বক্তৃতাটা ছাপানোর কথা বললাম।

জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘হ্যাঁ, জয় আমাকে বলেছে। তোমরা তো অনেক কিছু ছেপেছো।’’

তারপর উনি সেই অধিবেশনের ঘটনার কথা বলতে শুরু করলেন। একেবারে ফোটোগ্রাফিক মেমোরি!

‘‘ওইদিন তো খুব গোলমাল হয়েছিল হাউসে। চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছিলো। কংগ্রেসের এমএলএ’রা বললো, আমি নাকি জুতো ছুড়ে মেরেছি। আমি পা থেকে জুতো খুলে দেখিয়ে বললাম, আমার জুতো আমার পায়েই আছে। আমি জুতো ছুড়িনি। আসলে মণিকুন্তলা ছুড়েছিল।’’

তারপর একটু থেমে বললেন, ‘‘সাউথ ইন্ডিয়া থেকে আমাদের পার্টির কয়েকজন নেতা এখানে এসেছিলেন। তাঁরা সেদিন অধিবেশন দেখতে বিধানসভায় ভিজিটার্স গ্যালারিতে ছিলেন। তাঁরা পরে পার্টি অফিসে এসে বললেন, বিধানসভায় এসব আবার কী হচ্ছে?’’

জ্যোতিবাবু একটু পরিহাসের সুরেই বললেন, ‘‘আসলে এখানকার মানুষের তখন ক্ষোভ কতটা বেশি ছিল, সে সম্পর্কে ওঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। বিধানসভায় তখন একজন নির্দল এমএলএ ছিলেন, আন্দোলনে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন, নামটা এখন মনে পড়ছে না। উনি পরে আমাকে বলেছিলেন, বিধানসভাতেও বলেছেন একটা ঘটনার কথা। উনি বাজারে মাছ কিনতে গেছেন। মাছওলা ওনাকে প্রশ্ন করেছেন, জুতোটা ঠিক জায়গায় লেগেছে তো? সেই সময় মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।’’

 

*********************

 

                                        ২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় বামফ্রন্টের 
                                          সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

ইন্দিরা ভবনে থেকে ফিরে তড়িঘড়ি কম্পোজ করে পার্টি অফিসে দিয়ে এলাম। ঘন্টাখানেক বাদে আবার ওবাড়ি থেকে ফোন। ওপারে বিমানদা। বললেন, ‘‘শোনো, তুমি আরেকবার ইন্দিরা ভবনে যাও। কম্পোজ কপিটার নিচে জ্যোতিবাবুর সই করিয়ে আনতে হবে। প্রেসকে আমরা সেটার কপিই দেবো।’’ বিমানদা আরও বললেন, ‘‘আমি জ্যোতিবাবুকে বলে রেখেছি। তুমি গেলেই সই করে দেবেন।’’

কী আর করা! আবার বিকেলে ছুটলাম। আমাকে দেখেই জ্যোতিবাবুর সস্নেহ হাসি, ‘‘কি, তোমায় আবার আসতে হলো তো! বিমানের যতসব কান্ড!’’

জয়কৃষ্ণ ঘোষ আগে থেকেই একটা সিগনেচার স্ট্যান্ড আনিয়ে রেখেছিলেন। সাদা কাগজের প্যাডও ছিল।

জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘সই-টই করা এখন খুব ঝামেলার ব্যাপার!’’

জয়দা বললেন, ‘‘আপনি ওই সাদা কাগজে তিন-চারবার মকসো করে নিন। তারপর ওই বার্তাটায় সই করবেন।’’

জ্যোতিবাবু তাই করলেন। আমি গোটা তিনেক কপি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবগুলোতেই সই করিয়ে নিলাম।

জয়দা আমাকে বললেন, ‘‘আসলে এখন বছরে একবার সই করতে হয় ওনাকে। প্রাক্তন বিধায়ক হিসেবে যে পেনশন পান, সেটা পার্টির রাজ্য কমিটিকে চেক লিখে দিয়ে দেন। ওটাই বছরে একবার করতে হয়’’ 

 জ্যোতি বসুর স্বাক্ষরিত এই সেই বার্তা

********************

 

                                ২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় বামফ্রন্টের  সমাবেশ

২০০৯ সালের ৩১আগস্ট ধর্মতলায় সেবার যে সমাবেশ হয়েছিল, তা সঠিক অর্থেই ছিল ঐতিহাসিক। ‘‘অনুগত’’ সংবাদমাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা হলেও ধর্মতলায় অতবড় সমাবেশ এখনও পর্যন্ত কোন দলই ক্ষমতায় থাকতে বা না থাকতে করতে পারে নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রধান বক্তা ছিলেন। বামফ্রন্টের নেতারা বক্তব্য রেখেছিলেন।

সমাবেশের শুরুতেই জ্যোতিবাবুর শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করে বিমানদা কাগজটা সমবেত জনতাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘এটা জ্যোতিবাবুর শুভেচ্ছা বার্তা, এই যে দেখুন ওনার সই করা আছে।’’

লাখো লাখো জনতা মুখরিত সখ্যে সেই বার্তা গ্রহণ করলেন।

********************

সংযোজন: ১৯৫৯ সালের ২৮সেপ্টেম্বর বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা যাচ্ছে, পিএসপি বিধায়ক (১৯৫৭ সালে নির্বাচনে জেতার পর নিজেকে দলের থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে চলছিলেন) সুধীর চন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘....গুলি চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে বসে থাকা মোটেই সম্মানের কাজ নয়। এখানে জুতো ছোড়াছুড়ি নিন্দনীয়, নিশ্চয়ই এবিষয়ে কোন ভুল নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে খুব দুঃখিত হয়েছে তা নয়। এক ভদ্রলোক আমাকে সেদিন বললেন — আচ্ছা, কালীবাবুর মুখে কি জুতা গিয়ে পড়েছিলো? আমি বললাম, অত তো লক্ষ্য করিনি। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন — প্রফুল্লবাবু কি তখন ঘরে ছিলেন না? আমি বললাম — হ্যাঁ, ছিলেন। তখন তিনি বললেন — তার মুখে একটা পড়তে পারল না। এটা একজন সাধারণ মানুষেরই কথা, আমার বানান কথা নয়।’’

স্কেচ সৌজন্য: ইন্দ্রজিৎ নারায়ণ

************

#MartyrsDay

#HistoricalFoodMovement

#LeftFront

#JyotiBasu

 

20220712

বুথ দখলেও ভরসা নেই, ভোটই আটকাতে চান মমতা

চন্দন দাস

রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাত্রা বদলে গেছে। গ্রামের সরকারগড়ার সংগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বোমায় ক্ষতবিক্ষত নলহাটির খেতমজুর হীরু লেট সেই যুদ্ধের নিশান।
রাজ্যের অষ্টম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু আগামী ১লা মে। একমাসও বাকি নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচন গ্রামের সরকারগড়ার নির্বাচন। নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই। ফলে গ্রামের উন্নয়ন সম্পর্কে কোনও রাজনৈতিক দল বা পার্টির কী নীতি তার সংগ্রামই পঞ্চায়েত নির্বাচন। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামের উন্নয়ন, শাসকদলের নেতা কর্মীদের দুর্নীতি, গ্রামের বিকাশে রাজ্য সরকার এবং সরকারে আসীন দলের ভূমিকাই এই নির্বাচনের প্রধান বিচারের বিষয়। আর সেক্ষেত্রে গ্রামের মানুষই প্রধানত সেই বিচারের দায়িত্বে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ গত সাত বছর এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আছে। দিন যত যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতির সংকট বাড়ছে, বিপদ ছড়াচ্ছে। এখন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা ঘনীভূত। এখন, এই পরিস্থিতিতে আমরা এক যুদ্ধে আছি। শুধু গ্রামের যুদ্ধ আর নেই তা। নিঃসন্দেহে গ্রামবাসীদের দিকেই অধীর অপেক্ষায় রয়েছে সময়। তবু, এই পরিস্থিতিতে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে রাজ্যের প্রায় দশ কোটি মানুষ পাশাপাশি এক যুদ্ধে আছি। যুদ্ধ সরকার গড়ার নয় এই সংগ্রাম আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের।
যুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে। দুটি পক্ষেরই কিছু মিত্র শক্তি থাকে। এই শেষ বসন্তে, এপার বাংলার প্রতি ইঞ্চি জমিতে যুযুধান দুই পক্ষ। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস। আর একদিকে মানুষ ছোট দোকানদার, কৃষক, চাকরিজীবী, খেতমজুর, দিনমজুর, অসংগঠিত শ্রমিকসহ আরও অনেকে। গরিব, মধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ী আর তৃণমূল কংগ্রেস মুখোমুখি।
তৃণমূল কংগ্রেসের মিত্র শক্তি আছে সংগোপনে, কৌশলে। নাম বি জে পি। বি জে পি-র পিছনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল। আর সম্মিলিত জনতার বন্ধু কারা? যাঁরা ২৮শে মার্চ কাজের দাবিতে মিছিল করেছেন, তাঁরা রাজ্যের জনতার মিত্র শক্তি। যাঁরা রামনবমীর আগে শোভাযাত্রা করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন — ‘ধর্ম যার যার/ দেশ সবার’ — তাঁরা মানুষের পক্ষে। তাঁরা বামপন্থী, তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁরাই দেশপ্রেমিক।
কী আশ্চর্য সমাপতন! গত ২৫শে মার্চ ছিল রামনবমী। যদিও ২৪শে মার্চ থেকে পরের প্রায় সাতদিন রামনবমী পালিত হয়েছে রাজ্যে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং সেই রামনবমীতে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম কোনও শাসকদল রামনবমী পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। রামনবমী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মের সঙ্গে প্রশাসনকে এইভাবে মিলিয়ে দেওয়ার কাজ দেখা গেল স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গে সেটিও তৃণমূল কংগ্রেসের দৌলতে। আলিপুরদুয়ারের মতো বেশ কিছু জায়গায় বি জে পি আর তৃণমূল কংগ্রেস মিলিতভাবে রামনবমীর ধর্মীয় শোভাযাত্রা করল। কাঁকিনাড়ায় শাসকদলের মিছিলেই খাপখোলা তরবারি দেখা গেল। রাজ্যে দাঙ্গা হলো বেশ কয়েকটি জায়গায়। অন্তত তিনজনের প্রাণ গেল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায়। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।
হিন্দুত্বের উগ্র বাসনা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেল। অস্ত্র নিয়ে উন্মত্ত প্রকাশ বৈধতা পেল। প্রশ্ন উঠল সেই একটি পক্ষ থেকে, যারা মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্য মিশ্র বললেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রী কী বাংলায় মোদীর গুজরাট মডেলের প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে চান?’’ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন। কেন? কারণ — ‘গুজরাট মডেলহালে পানি পাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে।
রাজ্যে যখন এমন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পরিবেশ, ঠিক তখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সূচি ঘোষিত হলো। অথচ আগের বার, ২০১৩-তে এই মুখ্যমন্ত্রীই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন জুলাইয়ে। নির্বাচনের সূচি নিয়ে মামলা পৌঁছেছিল সুপ্রিম কোর্টে। পঞ্চায়েতগুলি গঠিত হয়েছিল আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। এবার তার প্রায় বিপরীত। ধর্মীয় শোভাযাত্রার নামে আস্ফালনের পরেই, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীনই পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু। গ্রামে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব, চিহ্নকে ভোটের হিসাবে মান্যতা দেওয়া, বি জে পি-কে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মমতা ব্যানার্জির এত তৎপরতার কারণ কী? তাঁর নিজের লুটের শাসন আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখা নিশ্চয়ই একটি কারণ। আর একটি কারণ? নরেন্দ্র মোদীর শাসনে বিপর্যস্ত দেশের সামনে প্রকৃত বিকল্প হাজির করার লক্ষ্যে অটল বামপন্থীরা। সেই লড়াই নয়া মাত্রা পেতে চলেছে মুম্বাইয়ে কৃষকদের লঙ মার্চ তার একটি বহিঃপ্রকাশ। এমন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিক লড়াইয়ে থাকা বামপন্থীদের কৌশলে দুর্বল প্রতিপন্ন করা আসলে বি জে পি এবং মমতা ব্যানার্জির যৌথ কর্মসূচি।
দেশের আগামীকাল পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে। পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা দেশে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনকে আরও শক্তি জোগাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গের এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন জন্মভূমি রক্ষার সংগ্রামে সম্পৃক্ত।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। এমন সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই নির্বাচনে হাঙ্গামা, সশস্ত্র হামলা চলছে। যে কন্যাশ্রীবা যুবশ্রীজীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন, পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন, তিনি কী দেখেছেন? আমরা, যাঁরা মমতা ব্যানার্জির পাঁশকুড়া-লাইন দেখেছি, কিংবা যাঁরা অবরুদ্ধ-নন্দীগ্রামের কথা জানি, তাঁরা বাইকবাহিনীর হামলায় গ্রাম দখল দেখেছি। একটি সাধারণ, স্বাভাবিক অঞ্চল কিভাবে দখলিকৃত এলাকাহয়ে ওঠে, আমরা দেখেছি। আস্ত ব্লক এলাকার প্রতিটি পঞ্চায়েত শুধু বোমা, বুলেটের দাপটে মাসের পর মাস দাবিয়ে রাখা যায়? তালপাটি খাল কিংবা কংসাবতীর পাড় তা জানে। সবই পশ্চিমবঙ্গের জানা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যে।
কিন্তু ব্লক অফিস দখল? মহকুমাশাসকের দপ্তর অস্ত্রের দাপটে অবরোধ? এবার দেখা গেল। কৃতিত্ব’ — সেই তৃণমূল কংগ্রেসের। সদ্য বাবাকে হারানো পাঁশকুড়ার যুবক গেছেন ব্লক অফিসের দিকে। পৌঁছাতে পারেননি ব্লক অফিসের দরজায়। সেই যুবকের দরকার মৃত বাবার কিছু নথিতে সরকারি আধিকারিকের সই। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির দামালছেলেরা আঙুল উঁচিয়ে বলেছে,‘‘বাড়ি যা। এখন ঢোকা যাবে না এখানে। সব ৯ তারিখের পরে।’’ এমন আরও অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের। কেন ৯ তারিখসেদিন পর্যন্ত রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। আর ততদিন ব্লক অফিস পাহারা দেবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, কর্মীরা। তাদের জন্য ক্যাম্প হয়েছে ব্লক অফিসের রাস্তায়। সেই ক্যাম্পে ঢালাও খানা এবং পিনার ব্যবস্থা হয়েছে। আর হাতে হাতে ধরানো হয়েছে বোমা, মাস্কেট, পিস্তল।
গত সাত বছর রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই বছরগুলিতে তাঁর সরকার রাজ্যের জন্য কী কী উন্নতি ঘটিয়েছেন, তার একটি বিচার এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হওয়ার কথা। মমতা ব্যানার্জির দাবি তিনি ৮১লক্ষের উপর চাকরি দিয়েছেন। তাঁর আমলে গ্রামে অনেক রাস্তা হয়েছে। অনেক ভাতা চলছে। মানুষ নানা নামের প্রকল্পে ঘর পাচ্ছেন। এমন সময়ে মানুষ তাঁর এবং তাঁর সরকারের পাশে দাঁড়াবেন সেটিই স্বাভাবিক। যদি নিজের দাবির প্রতি তাঁর ভরসা থাকে, তাহলে তাঁর সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার জন্য বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু তা হলো না। তাঁর দলের সশস্ত্র কর্মীরা ব্লক অফিস অবরুদ্ধ করল রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জায়গায়। কারণ আশঙ্কা আছে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করবে। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নান্টু প্রধানের গ্রামবাসীদের রোষে মৃত্যুর ঘটনা কী নিশ্চিত অশনি সংকেত? বর্ধমানের কিছু গ্রামে চোরতৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের গ্রামবাসীদের সম্মিলিত তাড়া করা, আটকে রাখা, তোলাবাজির টাকা আদায় করার ঘটনা কী কোনও ইঙ্গিত? গ্রামে মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন কাজ না পেয়ে, প্রাপ্য টাকা না পেয়ে, ন্যায্য বাড়ি না পেয়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের তোলার টাকা দিতে দিতে, নান্টু প্রধানের মত লোকদের কাছে নিজের জমি হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া মানুষ ব্যালটে জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। তাই কোথাও মনোনয়নপত্র জমা পড়ুক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক চাননি মমতা ব্যানার্জি। বুথ দখল করে ভোটে জেতা অভ্যাস হয়ে গেছে তৃণমূল কংগ্রেসের। ফলে গ্রামবাসীদের কোনও অংশকেই তারা আর ভরসা করতে পারছে না। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতারই মুখোমুখি হতে চাইছেন না মমতা ব্যানার্জি। গত ২২শে মার্চ মেদিনীপুরে প্রশাসনিক সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেদিন তিনি বলেন যে, পঞ্চায়েত শাসকদলের হাতে না থাকলে কিভাবে কাজ হবে? তাই তাঁর আহ্বান ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতিয়ে কাজের সুযোগ দেবেন।
উন্নয়নের প্রতীকযিনি, তাঁর এই আহ্বানের মানে কী? সব পঞ্চায়েতে, সব আসনে জিততে হবে। ভোট লুট তো পরের কথা। ভোটই আটকাও — ‘উন্নয়নের জন্য।কার উন্নয়ন? গণতন্ত্র খুন করে উন্নয়নের লালন? হতে পারে না। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর কথায়,‘‘বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে অনেক সময় সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষকেই নির্বাচিত করতে চাই। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’’(১৯৭৮, ১৯শে এপ্রিল, কলকাতা)।
গ্রামের সরকার গড়ার সংগ্রামের গুরুত্ব এখানে। রাজ্যের উন্নয়ন সেই গণতন্ত্রের বিকাশের উপর নির্ভরশীল। তাই-ই রক্তাক্ত। নলহাটি লড়ছে। ভাঙড় লড়ছে। লড়ছে আরও অনেক জনপদ।
এ লড়াই শুধু নির্বাচন নয় গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধ! নলহাটিতে বোমায় ক্ষতবিক্ষত খেতমজুর হীরু লেটের শরীর সেই যুদ্ধের প্রতীক।


গণশক্তি, ৭ই এপ্রিল, ২০১৮

মেরুদণ্ড: শমীক লাহিড়ী

 

 ৩০ মার্চ। সকাল ৮ টা নাগাদ বিষ্ণুপুর থানার কোম্পানির পুকুরে আমতলা-বারুইপুর রোডের খালের ধারে  পথচলতি গ্রামের মানুষ এক যুবকের মৃতদেহ দেখতে পান। যুবকের মাথাটা খালের জল-কাদার মধ্যে ডোবানো ছিল। তাই কার মৃতদেহ প্রথমে কেউই বুঝতে পারেন নি। পরে সবাই বোঝেন, এই দেহ স্থানীয় যুবক বিদ্যুৎ মন্ডলের। পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায়, আর যথারীতি সাজানো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়। 

তারপর থেকে ঘটনাস্থল, বিদ্যুৎ-এর বাড়ি বা গ্রামে কোথাও পুলিশ যায়নি। গ্রামের মানুষ বিদ্যুৎ-এর চটি ছাড়া আরও একজোড়া জুতো, একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ আর দুটো মোবাইল ফোন খুনের ঘটনাস্থল থেকে পেয়ে পুলিশে জমা দিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলে কাদায় ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। পুলিশ কিন্তু ভুলেও আর ঐ রাস্তায় যায়নি। পুলিশের কুকুরও যায় নি। 

কেন? এই প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক?

এই খুনের খবর ছবি ভিডিও সহ এগিয়ে-পিছিয়ে থাকা সহ, নানা নম্বর সম্বলিত সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাঠানো সত্ত্বেও তা বেমালুম চেপে দেওয়া হ'ল? কেন? 

এই প্রশ্ন তোলা কি অগণতান্ত্রিক?

বিদ্যুৎ-এর ভাই ও বিধবা মা পুলিশে অভিযোগ করতে যান। এই অভিযোগ নিতেও বিষ্ণুপুর থানার পুলিশ গড়িমসি করে, এমনকি উপস্থিত সিপিআই(এম) নেতাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও জেদ ধরে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পুলিশকে অভিযোগ নিতে বাধ্য করে, বিদ্যুৎ-এর ভাই সহ স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। 

পুলিশে অভিযোগ জানাতে চাওয়াটাও কি খুবই অন্যায় কাজ? 

৩০ মার্চ থেকে পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই একবারের জন্যও কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, কাউকে আটক করেনি, কোনও তৎপরতা দেখায়নি, খুনের ঘটনার তদন্ত করার প্রশ্নে। কেন করেনি? এই প্রশ্ন তোলা অপরাধ?

কেন খুন হ'লো বিদ্যুৎ? 

একটি নাবালিকা মেয়েকে জবরদস্তি বিয়ে করতে চায় একটি ছেলে, যে কিনা স্থানীয় তৃণমূলের এক জমি মাফিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায় বিদ্যুৎ। পুলিশের কাছে পরিবারটির সদস্যদের নিয়ে যায় বিদ্যুৎ, এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে। যেহেতু শাসকদলের জমি মাফিয়ার ঘনিষ্ঠ এই অন্যায় কাজে যুক্ত, তাই পুলিশ এই অভিযোগকে আমল দেয়নি স্বাভাবিকভাবেই।নাছোড়বান্দা বিদ্যুৎ জাতীয় মহিলা কমিশন সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠিপত্র লিখে, পুলিশকে বাধ্য করায় অভিযোগ নিতে এবং লোকদেখানো সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ছেলেটি ও তার পরিবারের কয়েকজনকে পুলিশ বাধ্য হ'য়ে গ্রেপ্তার করে।

বিদ্যুৎ কি অন্যায় করেছিল? বিদ্যুৎ ডিওয়াইএফআই ও সিপি আই(এম) কর্মী। তাই দলের শিক্ষায়- নীতিতে উদ্বুদ্ধ বিদ্যুৎ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অসহায় দরিদ্র নাবালিকার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এটা কি অপরাধযোগ্য কাজ? 

এইবার শাসকদলের মাফিয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ দীর্ঘ ৬ মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ি ও গ্রামছাড়া হতে বাধ্য হয়।

নাবালিকার বিয়ে আটকানোর জন্য বাড়িছাড়া, কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন- সংবাদমাধ্যম নীরব, নিশ্চুপ সব জানা সত্ত্বেও - এটা একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা? কোথায় যাচ্ছে বাংলা? প্রশ্নটা কি খুবই অশালীন? 

এরপর স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা সালিশি সভা ডেকে নিদান দেয়, ২লক্ষ টাকা জরিমানা দিলে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে বিদ্যুৎকে। এটা খাপ পঞ্চায়েত নয়? সারা বাংলাজুড়ে এই খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা তুলছে তৃণমূলীরা - এটা জানে না পুলিশ? থানায় এর প্রতিকার চাইতে গেলে পুলিশ কি বলে না, কিছুটা কম করে দিচ্ছি, টাকা দিয়ে মিটিয়ে নিন? এটা কে না জানে? কোনও সান্ধ্যকালীন আলোচনা এই নিয়ে হয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে? খুব অস্বস্তিকর, শালীনতার মাত্রা ছাড়ানো প্রশ্ন হয়ে গেল - তাই না!!

নাবালিকাকে বেআইনিভাবে বিয়ে করা আটকানোর জন্য বাড়িছাড়া, তারপর আবার ২লক্ষ টাকা জরিমানা - এই হ'লো তৃণমূলের খাপ পঞ্চায়েতের নিদান। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন সংবাদমাধ্যম সব জেনেও নীরব। এটাই বর্তমানে গণতন্ত্রের 'বাংলা মডেল'।

বিষ্ণুপুর থানার আন্ধারমানিক, জুলপিয়া সহ ৪/৫ টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা সম্পূর্ণভাবে তৃণমূলী জমি মাফিয়াদের দখলে। কেউ বিরোধিতা করতে পারে না। মেরে, ঘর জ্বালিয়ে জমি কেড়ে নিয়ে সব সিপিআই(এম) কর্মীদের  গ্রামছাড়া করেছে এই জমি মাফিয়ারা পুলিশের  প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২০১১ সালের পর থেকেই। এমনকি যে তৃণমূল কর্মী বা সমর্থকরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদেরও একইভাবে অত্যাচারিত হ'তে হয়েছে। এখানে সব তৃণমূলী জমি মাফিয়াদের হাতে পিস্তল। সমগ্র দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার পুলিশের কাছে মোট যা আগ্নেয়াস্ত্র আছে তার কয়েকগুণ বেশী আগ্নেয়াস্ত্র আছে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ভাইপো নিয়ন্ত্রিত তৃণমূলী মাফিয়াদের হাতে। পুলিশ মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম - কে জানে না একথা? কিন্তু প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাতে মাফিয়া- পুলিশ- তৃণমূল, আর তাদের ধামাধারীদের আঁতাতকে নাকি খুব অসম্মান করা হয়!!

বিদ্যুৎ সাহস করে বাড়ি ফিরেছিল বিধবা মা'র কাছে থাকবে বলে। কপর্দকহীন বিদ্যুৎ জরিমানা না দিয়ে গ্রামে ঢোকার অপরাধে খুন হ'লো। 

বিদ্যুৎ-এর খুনের প্রতিবাদে গত ৫ এপ্রিল প্রায় হাজারখানেক গ্রামবাসীকে নিয়ে থানা ঘেরাও করে সিপিআই(এম)। সেইদিন পুলিশের কর্তারা ১ মাস সময় চেয়েছিলেন, খুনের কিনারা করার জন্য।

১মাস অপেক্ষা করার পর ৭মে প্রতিবাদ সভা হয় বিদ্যুৎ-এর গ্রামের অদূরেই কয়ালের মোড়ে। 

খুব অন্যায় হয়েছে এই সভা করা? যেখানে ২০১১-এর পর সিপিআই(এম) কেন, কোনও বিরোধী দলকে গায়ের জোরে কোনও কর্মসূচী করতে দেওয়া হয়নি, সেখানে জমি মাফিয়াদের মুক্তাঞ্চলে ৩ হাজার গ্রামবাসী নিয়ে সভা করার সাহস হয় কিভাবে সিপিআই(এম)-এর!? ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক কাজ তাই না!

এই সভার আগের রাতে ২জন পুলিশ শহীদ কমরেড  বিদ্যুৎ-এর মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তিনি কাকে সন্দেহ করছেন। অমলাদেবী বলেন, আপনারা পুলিশ এতদিন বাদে এসেছেন? আপনারা কি তদন্ত করছেন যে, এখনও আমার ছেলের খুনের কিনারা হ'লো না? 

আসলে পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল, যদি কোনো তৃণমূল নেতা বা তাদের ঘনিষ্ঠ কারোর নাম অমলাদেবী বলেন, সাথে সাথে সেই নাম স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তাহলে টাকার টোপ বা ভয় দেখিয়ে অথবা অত্যাচার চালিয়ে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত করা হবে বিদ্যুৎ-এর  বেঁচে থাকা ভাই, বিধবা মা' অথবা সাক্ষ্যদানে আগ্রহী গ্রামবাসীদের। 

এসব বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যদি না টিঁকিটা কালিঘাটে বাঁধা থাকে।

পুলিশের কুকুরও গন্ধ শুঁকে খুনীদের শনাক্ত করে দিতে পারে দ্রুত, আর ৩৭ দিনের মাথায়ও পুলিশ বিদ্যুৎ খুনের কিনারা করতে পারে না? তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে পুলিশ রাখার অর্থ কি? এর বদলে কুকুর রাখলেও তো কিছু কাজ হ'তে পারতো, আর মানুষের ট্যাক্সের টাকাও কম খরচ হ'তো - এই সভায় এই প্রশ্ন তোলা খুবই অশ্লীল? 

বিদ্যুৎ খুনের খবর দেখানো হয় না, অথচ কালো টাকা সাদা করার জন্য তৈরি করা ফুটবল ক্লাবের খবর ঘটা করে দেখানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর লুচির তাপমাত্রা কত ছিল, সেটাও খবর হয়। 

পুলিশের কুকুর খুনের কিনারা করতে পারে, কিন্তু পুলিশ করে না বা করতে পারে না - এই প্রশ্ন তুলে কি ভয়ানক অশালীনতার পরিচয় দিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব!! তাহলে কী বলা উচিত ছিল? 

আনিস খান খুনের কিনারা ১৫ দিনে হবে - মূখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ঘটা করে ঘন্টাখানেক, ৯,১৮,২৪ সর্বত্র প্রচার করা হ'লো। কিন্তু আজ ৭৮ দিনের মাথাতেও কিছুই হ'লো না। মীনাক্ষী সহ ১৬ জন আধমাস জেল খেটে আসলেন, বাম ছাত্র-যুব- মহিলারা কয়েকবার গ্রেপ্তার হ'লো, আর খুনীরা দিব্যি ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরছে।  এর প্রতিবাদে সান্ধ্যকালীন কোনও আলোচনার আসর বসে না কেন সংবাদমাধ্যমে? কি উচ্চ মানের শালীনতাবোধ এটা - তাই না!!

খুনীর গ্রেপ্তার চেয়ে বামকর্মীরা জেলে যায়, আর খুনীদের আড়াল করা সরকার ফূর্তিতে কেন থাকে? তাহলে পুলিশ-পুলিশ মন্ত্রী এদের কাজ কি? নীরব সংবাদমাধ্যমই বা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ কেন? খুব অশালীন প্রশ্ন হ'য়ে গেল, তাই না!?

কোথায় পুলিশকে খুনের কাজে লাগানো হচ্ছে বা খুনীদের আড়াল করতে কাজে লাগানো হচ্ছে - সংবাদমাধ্যম জানে না? 

একবারও তো বলা হচ্ছে না আনিস হত্যার ৭৮ দিন পরে বা বিদ্যুৎ হত্যার ৩৮ দিন পরেও কেন খুনের কিনারা হয় না?

এটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়, যদি না বিজ্ঞাপন বা খামের লেনদেন থাকে। 

আর কালিঘাটে দাসখত দেওয়া থাকলে পুলিশ না পুলিশের কুকুর, কার মান- সম্মান বেশি সেই নিয়ে অযথা বিতর্ক তুলে, খুনীদের আড়াল করার চেষ্টা করাটা বাধ্যতামূলক হয় - এটাও বুঝতে কারোরই বিশেষ অসুবিধা হয় না।

তবে খুনীদের আড়াল করতে গিয়ে অযথা যারা কু-তর্ক জুড়লেন তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ ক্ষেতমজুর বিদ্যুৎ মন্ডলের হত্যার খবর চেপে রেখেছিল যেসব সংবাদমাধ্যম এতদিন, আজ অযথা কু-তর্ক তুলে তাঁরা অন্তত এই নৃশংস খুনের ঘটনাকে প্রকাশ্যে এনে ফেললেন নিজেদের অজান্তেই। আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাদের।

বিদ্যুৎ মন্ডলদের লড়াই খবর হয় না, কারণ ওরা ১০ আঙুল  ভরা হীরেখচিত আংটি ডুবিয়ে ফুলকো লুচি খাবার ক্ষমতা ধরে না। বিদ্যুৎদের বাড়ির উঠোনে রোলস রয়েস- মার্সিডিস-পোর্শে গাড়ি থরে থরে সাজানো থাকে না। ওরা কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত না দিয়েও নানা মন্ত্রী/আমলার সাথে প্রাতরাশ বা নৈশভোজ  করার সুযোগ পায় না। সর্বোপরি খবর ছাপা বা চাপার জন্য কর্পোরেট মিডিয়াকে বিজ্ঞাপন বা খাম দেওয়ার ক্ষমতা ধরে না।

তবে এই পৃথিবীতে সবাই শুধু পকেট বা পাকস্থলীর জন্যই বাঁচে না, মেরুদণ্ডটার গুরুত্ব বিদ্যুৎ -দের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তাইতো এক বিদ্যুৎ শহীদ হ'লে হাজার বিদ্যুৎ-এর ঝলক আকাশের অন্ধকারকে ফালাফালা করে দেয়।

…..............

৮ মে, ২০২২

লেখক সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পার্টির দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সম্পাদক

ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার লড়াই: সীতারাম ইয়েচুরি

 

------------------------------------------

৮ জুলাই জ্যোতি বসু স্মারক বক্তৃতায় ‘স্বাধীনতা: ৭৫’ শিরোনামে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির ভাষণের সম্পাদিত বয়ান।

------------------------------------------

আমার রাজনৈতিক জীবনে প্রায় তিন দশক জ্যোতি বসুর সঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ পেয়েছি তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে ফেরার পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে জ্যোতি বসু বাকিদের মতো ওকালতি পেশায় যুক্ত হবেন। কিন্তু তার বদলে তিনি আন্দোলনের ময়দানে পা রাখলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন যে দেশে ফেরার পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যুক্ত হবেন এবং সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সময় চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে যে স্বাধীন ভারতের চরিত্র কেমন হবে। এই নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত শুরু হয়েছিল। 

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল কংগ্রেসের। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে ভারতের বৈচিত্রকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ভারত বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কংগ্রেসের এই ধারণাকে সমর্থন করলেও দাবি তোলা হয় যে সাধারণ মানুষ যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবে তাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রূপ দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে, তবেই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা টিকে থাকবে। এভাবেই ভারত ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে চলবে। ভারতে বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে সেই সময় কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ভারত যদি সমাজতন্ত্রের দিকে, অর্থনৈতিক সমতার দিকে এগিয়ে না যায় তবে দেশের মানুষের মধ্যে ক্রমশ তৈরি হওয়া অসন্তোষ একটা সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করবে।

 


আর এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী মত হিসাবে উঠে আসে তৃতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তাতে বলা হয় যে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ব্যাখ্যা করতে হবে। একটি পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে ভারতে যেহেতু মুসলিমদের একটি বড়সড় জনসংখ্যা থাকে তাই একটি মুসলিম রাষ্ট্র দরকার আছে। অপর দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় যে ভারত নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবে। কে মুসলমান আর কে হিন্দু সেই নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব ছিল। যেমন কেরালার মোপলা মুসলিম আর আসামের সিলেটি মুসলিমের মধ্যে মিলের চেয়ে ফারাকই বেশি আছে। ভারতের হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র আরও বেশি। এইসময়ে হিন্দুত্বের ধারণা নিয়ে আসেন সাভারকার। ইংল্যান্ডে থাকাকালীনই সাভারকার হিন্দুত্ববাদ শীর্ষক একটি লেখায় উল্লেখ করেন যে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক নেই। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে হিন্দুত্ববাদ হলো একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। এর মাধ্যমে বলা হয় যে ভারত যাদের মাতৃভূমি পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি তারাই একমাত্র এখানে থাকতে পারবে। সাভারকার উল্লেখ করেন যে মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা মদিনা এবং খ্রিস্টানদের পুণ্যভূমি জেরুসালেম। আরএসএস তৈরি হওয়ার দুবছর আগেই এই ধারণা ধীরে ধীরে প্রচার হতে থাকে। হিন্দু রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্র এই দুই রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে মুসলিম লিগের সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্নাহও একই কথা বলেন। সেই সময়ে সাভারকার জানান যে তাঁর সঙ্গে জিন্নার কোনও মতবিরোধ নেই। এই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই স্বাধীন ভারত দুই ভাগে ভাগ হয়। সেই একই কথা এখন শোনা যাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আরএসএস নেতাদের মুখে। তাঁদের কথায়, পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতে বসবাস করছে হিন্দুরা। আর ১২০০ বছর ধরে তারা পরাধীন। কারণ সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। তারপর ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর সেই সময়ের লড়াইকে হিন্দু বনাম খ্রিস্টানের বলে উল্লেখ করতে চাইছে আরএসএস। আর এই সবের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাসে পরিবর্তন করা হচ্ছে। ভারতের ইতিহাসকে তারা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে, আর ভারতীয় দর্শনকে বদলে হিন্দু দর্শনের পাঠ দিতে চাইছে। এসবের কারণেই স্বাধীনতা পূর্ব ভারতের তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব। 

জ্যোতি বসুর দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা  ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। সেই সময় থেকেই কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ভারতকে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি করতে চাইলেও পুঁজিবাদের ওপর কংগ্রেস নির্ভরশীল ছিল, কমিউনিস্টরা তার বিরোধিতা করে। ১৯৪০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর্বে এবং স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে বিদেশ থেকে জ্যোতি বসু যখন দেশে ফেরেন তখন তাঁর এবং কয়েকজন কমিউনিস্ট সদস্যের ওপরে ওপর মুখ্য দায়িত্ব পরে তৎকালীন ভারতে কৃষকদের দুর্দশার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার। যেমন বাংলায় তেভাগা আন্দোলন, কেরালায় পুন্নাপ্রা ভায়লার, মহারাষ্ট্রে ওরলি আদিবাসীদের জমির লড়াই, আসামের সুরমা উপত্যকায়, তেলেঙ্গানায় তখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে কৃষি আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলিকে থেকে বলা যেতে পারে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অন্যদিকে কংগ্রেস জমিদার, জোতদারদের সাথে বোঝাপড়া করে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আনার চেষ্টা করেছে। এই বোঝাপড়া স্বাধীনতার পরেও টিকে থাকে এবং তার পরিণাম এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরোপুরি শেষ হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সামন্তবাদের সাথে আপস করে পুঁজিবাদ নিজেদের জমি তৈরি করতে চেয়েছে, ফলে সামন্তবাদের উচ্ছেদ হয়নি। জ্যোতি বসু বার বার বলতেন যে, এরফলে সামন্তবাদী ধারণার আধিপত্য সমাজে বজায় থাকে। যেমন ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা এবং জাতব্যবস্থা এই দুই ধারণা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সে পিতৃতন্ত্রের প্রশ্নে হোক বা আদিবাসী দলিতদের ওপর অত্যাচারের প্রশ্নে হোক, কমিউনিস্টদের এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। প্রসঙ্গত, এই সব ধারণা আরএসএস’এর মনুবাদী মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়, বিজেপি আরএসএস হিন্দুত্বের স্লোগানকে সামনে রেখে এইসব সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা ভাবনাকে এখন প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। 

বিজেপি জানে যে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির কথা তারা বলছে তা কোনোভাবে সম্ভব নয় বর্তমান ভারতীয় সংবিধান থাকলে। হিন্দু রাষ্ট্র করতে তাদের সংবিধান বদলাতে হবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে আমরা এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যখন কেন্দ্রে এমন এক সরকার ক্ষমতায় রয়েছে যারা ভারতের সংবিধানকে বদলাতে চাইছে। তাকে মান্যতা দিতে চাইছে না শুধুমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করবে বলে। সংবিধানের চার ভিত্তি আর্থিক সার্বভৌমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র। এই চার স্তম্ভই আজ আক্রমণের সামনে। তিস্তা শীতলবাদের ঘটনা চোখে  আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বর্তমান ভারতের গণতন্ত্রের পরিস্থিতি। বর্তমান সরকার বলতে চাইছে যে সত্যি কথা কেউ বলতে পারবে না। সত্যি প্রকাশের জন্য সাংবাদিক জুবেইরকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ২০১৪ সালের পর একের পর এক নতুন আইন তৈরি করে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সরকার কেড়ে নিয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে সরকার বলছে ভিন্নধর্মে বিবাহের আগের পুলিশ ভেরিফিকেশন করাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। যে সব আইন বিজেপি সরকার তৈরি করছে তার মধ্যে দিয়ে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যেখানে হিন্দু এবং মুসলমানরা একে অপরের সাথে খোলাখুলি মেলামেশা করতে পারবে না। সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন, আদিবাসী দলিতদের ওপর ক্রমশ আক্রমণ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। কর্পোরেট এবং সরকারের সখ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দুই বছরে আদানির সম্পদ ব্যাপক বেড়েছে। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে রয়েছি যেখানে সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। অন্যদিকে খাদ্যের দিক থেকে হোক স্বাস্থ্যের দিক থেকে হোক বা অন্য যে কোনও বিষয়ে বিভিন্ন সূচকে ভারতের স্থান ক্রমশ নিম্নমুখী।

 


স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে এসে ভারত আবার সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে তারা স্বাধীনতার আগে ছিল। সেই সময় যে যে বিষয়ের বিরুদ্ধে ভারতকে লড়াই করতে হয়েছে আজও সেই একই বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু সময় বদলানোর সাথে সাথে লড়াইয়ের চরিত্র ধরন বদলে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে ভারতে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা এখন আবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে স্বাধীনতার রাতে মহাত্মা গান্ধী কোথায় ছিলেন। তিনি কলকাতায় ছিলেন, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, তারপর গিয়েছিলেন নোয়াখালিতে। আরএসএসের মতাদর্শের কারণে মহাত্মা গান্ধীকে খুন হতে হয়েছে। 

জ্যোতি বসু এবং হরকিষেণ সিং সুরজিৎ উভয়েই প্রতি পদক্ষেপে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতেন। এই প্রশ্নে তাঁরা কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী দলগুলি ছাড়াও অন্যান্য দলগুলির কাছেও সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এই দুই নেতা দেশভাগের ক্ষত নিজেদের চোখে দেখেছেন, মরমে মরমে উপলবদ্ধি করেছেন। একজন বাংলায়, একজন পাঞ্জাবে। ভারত ভাগে আসল বিভাজিত হয়েছিল বাংলা এবং পাঞ্জাব। সেই বিভাজনের অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়, সাম্প্রদায়িকতার আগুন কীভাবে সবথেকে প্রগতিশীল বিচারধারাকে আক্রমণ করেছে। পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অগ্রসর, একইভাবে লাহোর শহর ছিল গোটা পাঞ্জাবের স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল। ভগৎ সিং লাহোরে কাজ করেছিলেন। সুরজিৎ নিজে লাহোর থেকে অমৃতসর অবধি সাইকেল চালিয়ে আসতেন বিপ্লবের কাজে। স্যার সিকান্দার হায়াত খান অবিভক্ত পাঞ্জাবের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কন্যা তাহিরা কমিউনিস্ট পার্টির পাঞ্জাব প্রদেশ কমিটির সদস্য ছিলেন। লাহোরে তাঁদের বাড়িতেই সাধারণত ক্যাবিনেট বৈঠক হতো, আবার কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠকও সেখানেই হতো। এমনও দিন গেছে, বাড়ির একতলায় পাঞ্জাব সরকারের ক্যাবিনেট বৈঠক চলছে, এবং দোতলায় কমিউনিস্ট পার্টির পিসি বৈঠক হচ্ছে। তো এমনই এক বৈঠক চলাকালীন খবর এল, পাঞ্জাব সরকারের ক্যাবিনেট বৈঠকে ঠিক হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। এমন সময় তাহিরা বলেন, আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনারা আমাদের বাড়িতেই থেকে যান। কারোর কল্পনাতেও আসা সম্ভব নয়, যে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেই কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠক চলছে! দেশভাগের পরে লাহোরের সেই ঐতিহ্য একেবারেই হারিয়ে গেল। ঢাকা শহরে আবার নতুন করে প্রগতিশীল আন্দোলন দানা বাঁধছে এবং বামপন্থীরা সেখানে ভূমিকা রাখছেন। 

সুরজিৎ, জ্যোতি বসুরা বারবার বলতেন, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতে চান, তাঁদের সবাইকে একজোট করতে হবে। যারা এমারজেন্সির বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক ছিলেন, তাঁদের সবাইকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলাম। আমরা এমন সরকারকে সমর্থন করেছিলাম, যে সরকারের বিদেশমন্ত্রীর নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর নাম লালকৃষ্ণ আদবানি। যদি প্রশ্ন করেন কেন এই সরকারকে সমর্থন করেছিলাম, তার উত্তর হলো— যে কোনও উপায়ে জরুরি অবস্থাকে রুখতেই হতো। সেই সময়কার সব কালাআইনকেও সংবিধান থেকে বাতিল করতে হতো। তাই এই সরকারকে আমরা সমর্থন করি। জ্যোতি বসু ১৯৬৭ সালে অজয় মুখার্জিকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাতে রাজি হয়েছিলেন, নিজে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, যদিও সেই সময় আমাদের বৃহত্তম সংখ্যক বিধায়ক ছিলেন। আমরা নিজেরা মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি জানাতে পারতাম। কিন্তু ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯- দুইবারই, বেশি বিধায়ক নিয়েও আমরা অজয় মুখার্জিকে মুখ্যমন্ত্রী হতে সাহায্য করি। কেন? কারণ তখন আমাদের মূল কাজ ছিল যে ভাবে সম্ভব কংগ্রেসকে হারানো এবং ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা। 

মূল বিষয় হলো, প্রতি যুগেই এমন একটা সময় আসে, যখন আমাদের শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে আশু লক্ষ্য চিহ্নিত করতে হয়। সেই মুহূর্তের পরিস্থিতির নিরিখে আমাদের চিহ্নিত করতে হয় শত্রুকে। কোন শক্তির কিংবা ব্যক্তির বিরোধিতা করতে পারলে গণআন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা সেই মুহূর্ত ঠিক করে দেয়। 

১৯৯৬ সালে নরসিমা রাওয়ের সরকারের ঠিক পরেই বাজপেয়ীর সরকার ক্ষমতায় এল। আমরা বললাম এদের ঠেকাতে হবে। সেই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা বললেন, আমি সরকার গড়তে সর্ববৃহৎ দলকে ডাকবো। সেটা ছিল বিজেপি। বিজেপি ১৩দিন সরকার চালিয়েছিল। সেই সময় আমি এবং আমার সহকর্মীরা জ্যোতি বসু এবং সুরজিতের কাজ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে আমরা সেই সময় খুবই শঙ্কিত ছিলাম। বিজেপি একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে তাদের উৎখাত করা কঠিন হয়ে পড়বে। জ্যোতি বসু এবং সুরজিৎ আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, তোমরা চিন্তা কোরো না, আমরা এদের ঠিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ছাড়ব। ১৩দিন পরে সংসদে আস্থা ভোট হলো, এবং ভোটে হেরে বাজপেয়ী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। তারপর প্রথম ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো। 

মূল বিষয় বা প্রশ্ন হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের কী প্রয়োজন সেই নিরিখেই আমাদের পথ তৈরি হবে। ১৯৭৭ সালে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে এমারজেন্সি এবং ইন্দিরা গান্ধীকে পরাস্ত করতে হবে। তাই আমরা এমারজেন্সির বিরোধিতা করতে প্রস্তুত সব শক্তির সঙ্গে একজোট হই। একইভাবে আমাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে, আমাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। তাই বিজেপি’কে পরাস্ত করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক সমস্ত শক্তিকে একজোট করার দিকে আমরা এগোচ্ছি। জ্যোতি বসুই খুব সম্ভবত আমাদের দেশের জোট রাজনীতির স্থপতি ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বাংলার প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে শুরু। তারপরে বাংলায় এবং দেশে যতগুলি যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়েছে, প্রত্যেকটিতে জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিল। 

২০০৪ সালে এনডিএ সরকারকে হারানোর জন্য বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সুরজিৎ। সেই সময়ের মূল প্রশ্ন ছিল, কিভাবে বিজেপি-কে পরস্ত করতে পারার মতো সংখ্যা একত্রিত করা যায়। বিরোধীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল— নিজের নিজের রাজ্যে যাও। বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে যতটা সম্ভব একত্রিত করো। এই ফর্মুলাতে রাজ্যস্তরে নিশ্চিত করতে হবে যে যাতে প্রতিটি রাজ্য থেকে অধিক সংখ্যক বিজেপি বিরোধী সাংসদ জিতে আসতে পারেন। তারপর আমরা দিল্লিতে বসে ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করব। বাস্তবেও ঠিক এটাই হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের যুক্তফ্রন্টও কিন্তু নির্বাচনের পরেই গঠিত হয়েছিল। একই কায়দায় ২০০৪ সালের প্রথম ইউপিএ সরকার নির্বাচনের পরে গঠিত হয়। এই অভিজ্ঞতাগুলি থেকেই স্পষ্ট, ভারতে নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী বিজেপি বিরোধী কোনও মোর্চা গঠন সম্ভব নয়। কিছু মানুষ এখন থেকেই মোদীর এবং বিজেপি’র বিকল্প জোট ইত্যাদি গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হলো এই ধরনের বিকল্প রাজ্যস্তরে গড়ে তুলতে হবে। যেমন তামিলনাড়ুতে হয়েছে। প্রথমে রাজ্যস্তরে করে তারপরে সেটাকে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনতে হবে। 

এই মুহুর্তের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি? আমরা পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাম্প্রদায়িকতাকে হারাতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সর্বোচ্চ ঐক্য গঠন করতে হবে। আমাদের প্রাথমিক কাজ হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, তাকে দুর্বল করতে হবে এবং তাকে হারাতে হবে। সেই কাজ করতে গেলে সবার আগে আমাদের পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের পার্টির সংগঠন এবং জনভিত্তি মজবুত করতে হবে। দ্বিতীয়ত বামপন্থী ঐক্য মজবুত করতে হবে। তৃতীয়ত সেই জোরের উপর দাঁড়িয়ে বাম-গণতান্ত্রিক জোট গঠন করতে হবে। এই জোট কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সামাজিক ও ন্যায়ের দাবিতে আন্দোলনরত সংস্থা এবং শক্তিগুলিকেও এরমধ্যে শামিল করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে এক জায়গায় জড়ো করতে গেলে ন্যূনতম একটা বোঝাপড়ায় আমাদের পৌঁছাতেই হবে। 

বর্তমানে আমাদের দরজায় রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন কড়া নাড়ছে। এমন একজন প্রার্থী খুঁজে বের করতে হবে যাকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি সমর্থন জানাতে প্রস্তুত হবে। এই প্রার্থীকে সামনে রেখে আমরা বিজেপি’র প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং আদর্শগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারব। এটাই মূল ইস্যু। একাধিকবার আমাদের মধ্যে প্রার্থীর নাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যাকে অধিকাংশ দল সমর্থন জানাতে রাজি হবে। বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিজেপি’র বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছুঁড়ে দেওয়া। এই প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমাদের পূরণ করতেই হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারিনা অমুকে হলুদ জামা পরেছে বা তমুকে লাল জামা পরেছে বলে আমি তাঁকে সমর্থন করব না। কিংবা সেই ব্যক্তি আগে অমুক অমুক কাজ করেছে তাই তাঁকে সমর্থন করা যাবে না। জ্যোতি বসুদের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে অজয় মুখার্জি বাংলায় কি কি করেছিলেন, কিংবা জনতা পার্টির নেতা হওয়ার আগে জগজীবন রামের ভূমিকা কী ছিল, রাজীব গান্ধীর অর্থমন্ত্রী হিসাবে ভিপি সিংয়ের ভূমিকা কী ছিল, এইসব প্রশ্ন আমরা তুলিনি, আমরা তাঁদের প্রত্যেককে সমর্থন জানিয়েছি কোনও না কোনও সময়ে। আমরা রাষ্ট্রপতি পদে ভিভি গিরিকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু আমরা তাঁকে শর্ত দিয়েছিলাম। আপনি ব্যাঙ্ক, কয়লার রাষ্ট্রীয়করণ করুন, তাহলেই একমাত্র আপনাকে সমর্থন করব। এবং তাঁকে দিয়ে আমরা এগুলি করিয়ে নিয়েওছিলাম। 

জ্যোতিবাবু এবং সেই সময়ের নেতা যাঁদের আমরা পার্টির নবরত্ন বলে থাকি তাঁদের থেকে আমাদের শিখতে হবে, কীভাবে আশু লক্ষ্য পূরণ করে আমাদের আদর্শ এবং রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যই নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল গ্রহণ করতে হবে। একটি শক্তি কিংবা ব্যক্তিকে সমর্থন জানানোর মাপকাঠি কেবলমাত্র এটাই। একজন ব্যক্তি অতীতে কী করেছেন, বা ভবিষ্যতে কী করতে পারেন, সেই ভাবনা থেকে বর্তমানের রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ইতিহাস তাই-ই বলছে। এই সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করার ফলেই আমরা এমারজেন্সিকে পরাস্ত করতে পেরেছি। আমারা মোরারজী দেশাই সরকারকে সমর্থন না করলে এমারজেন্সি সরানো যেত না। আর এমারজেন্সি না সরলে পশ্চিমবাংলায় ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হত কিনা তা বলা সম্ভব নয়। জ্যোতিবাবুর ২৩বছরের রেকর্ড মুখ্যমন্ত্রিত্ব, হয়ত এর কোনওটাই হতো না। আমরা কাকে সমর্থন করছি সেটা বিষয় নয়, কেন সমর্থন করছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য কী?  উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন আসছে। আমরা এমন একজন প্রার্থীর খোঁজ করছি, যাঁকে সামনে রেখে বৃহত্তম বিরোধী ঐক্য গঠন সম্ভব। 

ইংল্যান্ড থেকে ফেরত আসার পরে জ্যোতি বসু ব্যারিস্টারির লোভনীয় পেশার হাতছানি উপেক্ষা করে রাজনীতিতে এলেন। শেষজীবনে তিনি একবার বলেছিলেন, সীতারাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করব। আর আজকে আমি আমার মরণোত্তর দেহদান করলাম, আমি জানতাম না যে মৃত্যুর পরেও আমি জনগণের সেবায় কিছু করতে পারি। এই ধরনের মূল্যবোধ এবং চিন্তাধারা বিরল। তাঁর এই চিন্তাধারার জন্য আমরা তাঁকে সেলাম জানাই। এবং শুধুমাত্র সেলাম জানানোই নয়, আমরা প্রতি মুহূর্তে তাঁর থেকে শিক্ষা নিই, নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করি। 

আমরা বর্তমানে একটি যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এর আগের যুগসন্ধিক্ষণে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল। এই সন্ধিক্ষণে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের কাঠামো রক্ষার লড়াইতে জিততে হবে। সেই ভিতের উপরে দাঁড়িয়েই আমাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। 

...........................................

গণশক্তি, উত্তর সম্পাদকীয়, ১০জুলাই, ২০২২

...........................................

20220711

ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো ...মমতা ব্যানার্জির ঘৃণ্য রাজনীতির পথেই চলছে মোদী সরকার

কাজ শুরু বামফ্রন্টের সময়েই, মমতার বাধাতেই প্রকল্পে কালক্ষেপ

-------------------

নিজের ওষুধই এখন তেতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে!

২০০৯সালের ২২ফেব্রুয়ারি ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রয়েছেন প্রণব মুখার্জিসুভাষ চক্রবর্তীমহম্মদ সেলিম সহ আরও অনেকে। (ফাইল চিত্র)

উন্নয়ন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির ঘৃণ্য রাজনীতির পথেই চলছে কেন্দ্রের মোদী সরকার।সোমবার কলকাতায় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অবহেলা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে দিয়ে সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত পরিষেবার উদ্বোধন করার ঘোষণা করেছে রেল মন্ত্রক। রবিবার অবশ্য শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণের কথাও জানানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষুব্ধ তৃণমূল সংকীর্ণ রাজনীতির অভিযোগ তুলে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোকে মমতা ব্যানার্জির পরিকল্পিত প্রকল্প বলে বর্ণনা শুরু করেছে।

কিন্তু তেরো বছর আগের তথ্য বলছে, বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই হাওড়া থেকে সল্টলেক ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এই প্রকল্পকে ঠেকাতে মমতা ব্যানার্জি সবরকম চেষ্টা করেছিলেন, কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রের সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, রাজ্যে বসে নৈরাজ্য তৈরি করে প্রকল্পের রূপায়ণে বাধা দিয়েছেন এবং সর্বোপরি কেন্দ্রের রেলমন্ত্রীর পদে বসে এবং তারপরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে তাঁর একের পর এক পদক্ষেপে প্রকল্প রূপায়ণে বিলম্ব ঘটিয়েছেন।

সোমবার সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রোরেলের যে প্রকল্পের উদ্বোধন হবে তাকে ‘মমতা ব্যানার্জির প্রকল্প’ বলে দাবি করে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জিই রেলমন্ত্রী থাকাকালীন প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর প্রকল্পে তাঁকেই বাদ দিয়ে উদ্বোধন? বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবে না।’

বিজেপি’র মতোই ইতিহাসকে নিজের মতো করে লিখছে তৃণমূল। শিলান্যাসের পরদিন, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে লেখা আছে যে ২২ ফেব্রুয়ারি সল্টলেক স্টেডিয়ামে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও। সেই সময় রেলমন্ত্রকের হাতে ছিল না প্রকল্পটি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ প্রকল্প ছিল এটা। সংবাদপত্রের পুরানো পাতা থেকেই দেখা যাচ্ছে, সেদিন প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, আমাদের মতো গরিব দেশে উন্নয়নে অনেক বাধা। টাকার অভাব, প্রযুক্তিও সবসময় থাকে না। কিন্তু তার সঙ্গে যদি আত্মকৃত বাধা এসে জোটে তাহলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু থাকে না। উন্নয়নকে সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখতে না পারলে এগোনোর পথে অনাবশ্যক কাঁটা ছড়ানো হয়। তাতে নিজেদেরই পা ক্ষতবিক্ষত হয়।’

প্রণব মুখার্জির এই মন্তব্যের কারণ ছিল মেট্রো প্রকল্পে মমতা ব্যানার্জির বাধা। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী ইউপিএ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে শিলান্যাস অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন, ‘ঋণভারে জর্জরিত রাজ্যকে কেন্দ্র কেন এত টাকা দিচ্ছে? রাজ্য সরকারকে মদত দেওয়া বন্ধ করুন। লোকসভার ভোট চলে এসেছে, এখনও সিপিএম’কে তোয়াজ করছেন কেন?’

সেদিন দুপুরে সল্টলেকে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যাওয়ার পথে কালো পতাকা দেখানোর চেষ্টা করেছিল তৃণমূল কর্মীরা। আর শিলান্যাস অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিকালে পার্থ চ্যাটার্জিকে সাংবাদিক বৈঠকে বসান মমতা ব্যানার্জি। দলনেত্রীর নির্দেশে সেদিন প্রণব মুখার্জিকে ‘সিপিএম’র পদলেহনকারী বাংলার এক নায়ক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি। তারপরে বলেছিলেন, ‘সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় যাকে দেখা যায়নি, বাংলার মানুষের পাশে যিনি দাঁড়াননি, তাঁকে এখন কথা বলতে শোনা যাচ্ছে।’

উদ্বোধনের আগের দিনরবিবারশিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনের ছবি।


সেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নাকি এখন মমতা ব্যানার্জির প্রকল্প! ২০০৯ সালে শিলান্যাস অনুষ্ঠানের ছবি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও প্রণব মুখার্জির নাম লেখা ফলকের ছবি এখন সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিলান্যাস মঞ্চ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, হাওড়া ময়দান থেকে গঙ্গার তলা দিয়ে (ভারতে নদীর তলা দিয়ে প্রথম ট্রেনলাইন) শিয়ালদহ হয়ে বিধাননগরের সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত এই মেট্রো প্রকল্পের কাজ ২০১৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

হয়নি কেন? ২০২২ সালের জুলাই মাসে এসে প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন করতে হচ্ছে কেন স্মৃতি ইরানিকে? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কৃতিত্বকে মমতা ব্যানার্জির ঝুলিতে ঠেলে দেওয়ার মিথ্যা রাজনৈতিক প্রচারের থেকেও ঘৃণ্য সেই কাহিনি।

শিলান্যাসের কিছুদিন পরেই কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারপরেই রেলমন্ত্রককে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও শিয়ালদহে মেট্রো স্টেশনের পরিকল্পনাকে বানচাল করতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। অথচ হাওড়া ও শিয়ালদহ রেল স্টেশনের সঙ্গে যাত্রাপথে সংযোগ না হলে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের মূল সুবিধাই নিতে পারবেন না যাত্রীরা। তাই বামফ্রন্ট সরকার সেদিন কেবলমাত্র প্রকল্পটির রূপায়ণের স্বার্থে এই কদর্য রাজনীতিকে মর্যাদার লড়াইতে নিয়ে যায়নি। বরং উন্নয়নের স্বার্থে গোটা প্রকল্পটি রেলমন্ত্রকের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়ে যায়। ‘কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগেই হোক, অথবা রেলের মাধ্যমেই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প চালু হলেই নাগরিকদের লাভ।’ ২০১১ সালের গোড়ায় বামফ্রন্ট সরকারের পরিবহণ সচিব সুমন্ত্র চৌধুরি সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী প্রকল্পটি হস্তান্তরিত হয় রেলমন্ত্রকের হাতে। তারপর? কলকাতার কিছু ব্যবসায়ী, জমি মাফিয়াদের স্বার্থে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুটটাই পালটে ফেলে মমতা ব্যানার্জির সরকার। ইঞ্জিনিয়ার ও ভূবিজ্ঞানীদের যাবতীয় সমীক্ষার থেকে বেশি গুরুত্ব পায় তৃণমূল নেতাদের মরজি। ফলাফল? প্রকল্প ব্যয় হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে, দশ বছর সময় নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। বরং মধ্য কলকাতায় বাড়িতে বাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে মেট্রোর নতুন রুটের বন্দোবস্ত করতে গিয়ে।

স্থায়ী প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক যোগ্যতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাজনীতি করেছেন মমতা ব্যানার্জি। এখন বিজেপি’কে সেই অপকর্মের জন্য দোষারোপ করছেন তিনি। ইউপিএ সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে বামপন্থীরা সমর্থন তুলে নেওয়ার পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন প্রকল্প শিলান্যাসে। লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগেও তাঁরা পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করার বদলে উন্নয়নকে গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। আর এখন স্মৃতি ইরানিরা সেই আচরণই মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে করছেন যা তৃণমূল করেছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে আমন্ত্রণ জানালেও সোমবার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর অনুষ্ঠানে তাঁরা মমতা ব্যানার্জিকে আগে থেকে আমন্ত্রণ জানাননি।

২০০৯ সালেরই আগস্ট মাসের কথা কি মমতা ব্যানার্জির মনে পড়ছে? তখন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে সদ্য রেলমন্ত্রী পদে বসেই মমতা ব্যানার্জি টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া সম্প্রসারিত মেট্রো রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। সেদিন তিনি রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে পাশে বসিয়েছিলেন, কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া মেট্রো সম্প্রসারণ আদৌ রেলমন্ত্রকের একার প্রকল্পই ছিল না, ঐ সম্প্রসারণের কাজে ৩৩ শতাংশ ব্যয়বহন করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার।

ক্ষমতায় বসে কেউ ব্যস্ত ইতিহাস থেকে নেহরুদের নাম মুছতে, কেউ ব্যস্ত বামপন্থীদের নাম মুছতে। এরা কি আদৌ অক্ষয় হয়ে থাকবে ভবিষ্যতে?

.........................

গণশক্তি, ১১ জুলাই, ২০২২

.......................... 

20220416

লুম্পেন-রাজ দিয়ে বিজেপি-বিরোধিতা? নাগপুর হাসছে!

এই শ্মশানেই দাহ করা হয়েছে হাঁসখালির নির্যাতিতাকে


দেবাশিস চক্রবর্তী

প্রমাণ? আরো প্রমাণ?

বগটুইয়ে তৃণমূল নেতা ভাদু শেখকে খুন করেছে তৃণমূল। তারপর পেট্রোলের জার নিয়ে গ্রামে ঢুকেছে দুই তৃণমূল কর্মী, একজন ধরাও পড়েছে সিবিআই-র হাতে। দশজনকে কুপিয়ে, জ্বালিয়ে মেরেছে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জানিয়েছেন, দাপুটে তৃণমূল নেতা পুলিশকে আসতে না বলায় পুলিশ আসেনি। আমরা সকলেই যা জানতাম, মুখ্যমন্ত্রী তা অফিসিয়ালি জানিয়েছেন। তৃণমূল নেতারা আসতে না বললে রাজীব কুমাররা আসেন না, তাঁদের নিম্নতম অধস্তনরাও নড়েন না।

মার্চ-এপ্রিলে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সবক’টিতেই দোষী তৃণমূল নেতা, নেতার পুত্র, নেতার ভাগ্নে, দলের কর্মী। হাঁসখালির সঙ্গে কী পার্থক্য হাথরসের? একই ভাবে দলবদ্ধ ধর্ষণ, দেহ নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, পরিবারকে এমন ভয় দেখানো যাতে কন্যার মৃত্যুতেও মুখ খুলতে পারেন না পিতা-মাতা। হাথরসের মেয়েটি দিল্লির হাসপাতালে এসেছিল, হাঁসখালি সেটিও পারেনি। ঘরেই মরে গেছে, স্রেফ যন্ত্রণায় নীল হয়ে মরে গেছে।

সিবিআই অফিসারদের ঘিরে গ্রামের মানুষ বলছেন, তৃণমূলের এই নেতা, তার পুত্র ও শাগরেদরা হেরোইনের নেশা করত, ‘মেশিন’ নিয়ে ঘুরত, এমনকি খুনও করেছে আগে।

ধার শোধ করতে না পারায় বোলপুরে সুদখোর তৃণমূল নেতা পরিচিতের মেয়েকে ধর্ষণ করে ‘ক্ষতিপূরণ’ নিয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী অফিসিয়ালি জানিয়েছেন, এইসব ধর্ষণের ঘটনাকে তিনি তেমন গুরুতর কিছু বলে মনেই করেন না। অ্যাফেয়ার, অন্তঃসত্ত্বার মত বাড়তি কালি লেপে দিয়েছেন নির্যাতিতাদের শরীরে। অনায়াসে, কোনো অস্বস্তি ছাড়াই। ক্ষতবিক্ষত শরীর ঘিরে জন্তুদের উল্লাসে হাততালি দিয়েছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।

প্রমাণ? আরো প্রমাণ?

হাঁসখালির ধর্ষিতার গ্রামে এমনই আতঙ্ক যে ধর্মীয় রীতি মেনে মেয়ের শেষ কাজটুকুও করতে পারছিলেন না মা-বাবা। কোনো পুরোহিত আসবেন না, ক্ষৌরকার আসবেন না, জিনিসপত্র কেনা যাবে না। শাসকের চাপা ফতোয়া। বামপন্থীরা না থাকলে এইটুকুও হত না।

তৃণমূল যে লুম্পেনদের দলে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে বাংলার সমাজকে লুম্পেন-সমাজে পরিণত করছে, তার আরো প্রমাণ?

হাইকোর্টে কোন বিচারপতি কোন মামলা শুনবেন তা ঠিক করে দেবে তৃণমূল। এক বিচারপতির রায় দুর্নীতির ঢাকনা খুলছিল বলে তাঁর এজলাশের সামনে হাঙ্গামা হলো। মামলায় বাধা দেওয়া হলো। বিচারপতিরাও এখন আর হাইকোর্টের ভেতরে নিরাপদ নন।

লক্ষ্য করার আরো যে কিছু আছে!

দেশের যে দশ রাজ্যে রামনবমীর নামে দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে, সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, এই বাংলাতেও। ইসলামোফোবিয়ায় ক্রমে আক্রান্ত হচ্ছে সমাজের একটি অংশ। ঠিক তখনই বাবুল সুপ্রিয়কে জোর করেই প্রার্থী হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছেন মমতা। এমন এক কেন্দ্রে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংখ্যালঘু-নিবিড়। বাবুল সুপ্রিয়ের মত ইসলামোফোবিক একজনকে মমতা ব্যানার্জি প্রার্থী করেছেন কোন্‌ বার্তা দিতে?

প্রমাণ? আরো প্রমাণ?

২৫ বছর, ঠিক ২৫ বছর। এই ২৫ বছরে একদিনও, একবারের জন্যও আরএসএস সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি মমতা। বিজেপি-র সঙ্গী হয়েছেন, তিনবার একসঙ্গে ভোটে লড়েছেন, বিজেপি জোটের মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী হয়েছেন—এইসব কথা সকলেরই জানা। প্রতিদিনের রাজনীতিতে বিজেপি-র সঙ্গে ঠোক্কর লাগতে পারে। কিন্তু সঙ্ঘ? সদামুখর মমতা ব্যানার্জি এই একটি প্রশ্নে রা কাড়েন না।

কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত স্পষ্ট হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি চুপ। সংবিধানের কাঠামো ভেতর থেকে দুর্বল করা হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জি চুপ। প্রতিষ্ঠানগুলি আক্রান্ত, এরাজ্যেও সেই একই কায়দা। জেএনইউ-তে যেমন, তেমন আলিয়াতেও।

লুম্পেন-রাজ দিয়ে বিজেপি-বিরোধিতা? নাগপুর হাসছে, মোদী হাসছেন, বাংলা এভাবে অধঃপতিত হতে থাকলে এদেশে ফ্যাসিবাদের রাস্তা পরিস্কার হয়ে যাবে।

আর পিছোনোর কোনো জায়গা নেই।

 

১৫এপ্রিল, ২০২২