20220205

উন্নয়নের নীতি কী হবে: প্রেক্ষিত আসানসোল

 অনুপ মিত্র

 

এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে এবারের পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের নীতির জন্য শিল্প সমৃদ্ধ পশ্চিম বর্ধমান জেলায় একটার পর একটা শিল্প ধ্বংস হয়েছে। কয়লা খনি থেকে শুরু করে চিত্তরঞ্জন রেল কারখানা, লৌহ ইস্পাত শিল্প, কেবলস কারখানা হয় বন্ধ না হয় রুগ্‌ণ করে বন্ধ করার প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার।

বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে কৃষির সাফল্যের উপর দাঁড়িয়ে শিল্পায়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। অসংখ্য নতুন ছোট-ব‍‌‍ড়ো-মাঝারি শিল্পের বিনিয়োগ হয়েছিল। পশ্চিম বর্ধমান জেলাতেও সেই সময় বহু নতুন শিল্প গড়ে উঠেছিল এবং নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাবও এসেছিল। বামফ্রন্টের সময়কালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল ইস্কোর আধুনিকীকরণ এবং ইস্কোকে ‘সেইল’-এর সাথে অন্তর্ভুক্ত ঘটা‍‌নো। একই সাথে কুলটি কারখানাকেও ‘সেইল’-এর সাথে যুক্ত করা হয় অথচ সেই সাফল্যকে বামফ্রন্ট পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নীতির কারণে টিকিয়ে রাখা গেল না।

 

উন্নয়ন: আজকের প্রেক্ষাপটে

 

উন্নয়নের রূপ ও স্বরূপ’ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্রয়াত নিরুপম সেন বলেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী উন্নয়‌ন হলো মানুষের পছন্দের সম্প্রসারণ। এই সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড়ো বাধা আমাদের আর্থিক ক্ষমতার অভাব, আমাদের দারিদ্র্য।

আমাদের মতো দে‍‌শে উন্নয়নের সুযোগকে আমরা যদি সকলের জন্য যথাসাধ্য সম্প্রসারিত করতে না পারি এবং তার অভিমুখকে আমরা যদি ঠিক করতে না পারি তাহলে উন্নয়নের প্রকৃত অর্থটি অবহেলিত হবে।’’

এই বক্তব্যই ছিল বামফ্রন্ট সরকারের নীতি।

 

আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে উন্নয়নের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা

 

আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে তৎকালীন সময়ে এক ব্যাপক উন্নয়নের কর্মকাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। পৌরসভা, কর্পোরেশন, পঞ্চায়েত প্রভৃতি স্বশাসিত সংস্থাগুলি যে উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল, বামফ্রন্ট সরকারের পরবর্তী সময়ে তাকে ধরে রাখল না বর্তমান সরকার।

আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়ন ঘটাতে সেই সময় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এডিডিএ)। ১৯৮০ সালে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন দুর্গাপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আসানসোল প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন এই দুই সংস্থার একত্রীকরণের মধ্য দিয়ে এডিডিএ গঠন করা হয়।

এডিডিএ’র লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকাঠামো গঠন ও তাকে কার্যকরী করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা রচনা করা, রাস্তা সহ পরিকাঠামোর বিস্তার, গ্রাম-শহর যোগাযোগকারী রাস্তা নির্মাণ, উপযুক্ত পরিকাঠামো সহ বিভিন্ন শিল্পতালুক তৈরি করা, তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন, কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসা ও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত জমি ও পরিকাঠামোর ব্যবস্থা, গরিব মানুষের জন্য আবাস যোজনা, সবুজায়ন, গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদি বহুবিধ কর্মসূচির রূপায়ণ। বামফ্রন্টের সময়কালে এডিডিএ উপরোক্ত কাজগুলি করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও এডিডিএ’র একটা বড় সাফল্য ছিল দামোদর, বরাকর ও অজয় নদের জলাধারগুলি ব্যবহার করে এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এডিডিএ’র উদ্যোগে আসানসোল-দুর্গাপুর, কাঁকসা অঞ্চলে শিল্পতালুক নির্মাণ হয়েছে। বহু শ্রমিক এইসব শিল্পগুলিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। আসানসোল ইন্ডোর স্টেডিয়াম ও স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে।

বস্তি এলাকার বাসস্থান সমস্যার সমাধানের জন্য বাল্মীকী আম্বেদকর আবাস যোজনায় (ভিএএমবিএওয়াই) দুর্গাপুর আসানসোল রানিগঞ্জে গরিব মানুষের জন্য ঘরের সংস্থান করা হয়েছে।

এই সময়কালের মধ্যে রানিগঞ্জের মঙ্গলপুর শিল্পতালুকে জল সরবরাহের জন্য ৬ কোটি টাকার উপর ব্যয় করে ৫ এমজিডি ক্ষমতা সম্পন্ন জল প্রকল্প তৈরি হয়েছে।

শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে কারিগরি শিক্ষা, ম্যানেজমেন্ট ও অন্যান্য বিভাগের বহু শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল এবং পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

এই সময়কালের মধ্যে একটি বড় প্রকল্প ছিল জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউল মিশন (জেএনএনইউআরএম)। এডিডিএ এই প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব পেয়ে‌ছিল। এই প্রকল্পগুলির মধ্যে ছিল জল প্রকল্প, গৃহনির্মাণ ও পরিকাঠামো উন্নয়ন, কঠিন বর্জ্য নিষ্কাষণ প্রকল্প এবং সোয়েরেজ ব্যবস্থা। এডিডিএ এই প্রকল্পগুলির সফল রূপায়ণ করে। রানিগঞ্জে বৃহত্তর জলপ্রকল্প এডিডিএ’র একটি কর্মসূচি।

 

বামফ্রন্ট সরকারের নীতি: পরিকল্পিত উন্নয়ন

বামফ্রন্ট সরকারের নীতি ছিল উন্নয়নের কাজকে আরও সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে রূপায়ণ করা। গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ব্যাপক সাফল্যের মতন‍‌ই শহরাঞ্চলে পৌর প্রশাসনও ছিল সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং তা ছিল অপরিহার্য। পৌর ব্যবস্থা এবং পৌর প্রশাসনের ক্ষেত্রে ৭৪তম সংবিধান সং‍শোধনও একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে সমগ্র দেশই পৌরসভাগুলি নাগ‍‌রিকদের নিজস্ব এবং সার্থক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু এ‍‌ই আইনের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল আমাদের রাজ্যেই। ১৯৯২ সালে ৭৪তম সংবিধান সংশোধন হওয়ার পর পৌর পরিচালনায় আরও গতি আনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পৌর আইন ১৯৯৩ তৈরি হলো। পৌর প্রশাসনে নাগরিকদের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের রাজ্যে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিয়মিত পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে লাগল। গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। মৃতপ্রায় অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমস্ত অংশের মানুষের অংশগ্রহণ ঘটল। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী নাগরিকদের জীবনমানের উন্নতির ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের নীতি অনুযায়ী পৌরসভাগুলি কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে সক্ষম হলো। এছাড়াও আইন অনুযায়ী পৌরসভা কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। নাগরিকদের সুচিন্তিত মতামতের মধ্য দিয়ে ওয়ার্ড কমিটি পরিচালিত হতো এবং উন্নয়নের কাজ সংগঠিত হতো।

 

পরিকল্পিত উন্নয়নের যে বৈশিষ্ট্যগুলি অগ্রাধিকার পেল তার কয়েকটি উল্লেখ করা প্রয়োজন।

১) খসড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা: খসড়া, উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য পৌরসভা স্তরে একটি ডিডিপি পলিসি গ্রুপ গঠন করা হয়। এছাড়াও পৌরসভা তিনটি ডিটিজি-১ গ্রুপের দায়িত্ব পরিকাঠামো, জমির ব্যবহার ও পরিবেশ উন্নয়ন।

ডিটিজি-২ গ্রুপের দায়িত্ব সমাজ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরির কাজ।

ডিটিজি-৩ গ্রুপের দায়িত্ব পৌরসভার সাংগঠনিক পরিকাঠামো, উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরির কাজ।

২) অ্যাকাউন্টিং রিফর্মস: বামফ্রন্ট সরকার পৌরসভাগুলিতে আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে অ্যাক্রুয়েল বেসড ডাবল এন্ট্রি ব্যবস্থা চালু করার কথা বলে। এটি একটি সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা যার সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থাকে নানা ধরনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুসংহতভাবে দেখা যায়।

৩) নাগরিক সনদ: ‘নাগরিক সনদ’ এ‍ই ধারণাটি প্রথম গড়ে ওঠে ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডে। এরপর বিভিন্ন নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলিতে এই নাগরিক সনদ চালু হয়।ভারতে ১৯৯৭ সালে নাগরিক সনদ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রথম চালু হয়। নাগরিক সনদের মূল নীতিগুলি হলো — পরিষেবার মান উন্নত করা ও তাকে নির্দিষ্ট করা। নাগরিকদের কাছে পছন্দ বা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা, আলাপ-আ‍‌লোচনার প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের মানুষ‍‌কে যুক্ত করা, নাগরিক ও পৌরসভার মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিবেশ তৈরি করা, পৌরসভার কাজে দায়বদ্ধতা আনা এবং সর্বোপরি নাগরিকরা যাতে পৌর পরিষেবা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পান তা সুনিশ্চিত করা। এক ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বামফ্রন্ট পরিচালিত পৌর বোর্ডগুলি এই কাজগুলি করতে পারায় বামফ্রন্ট সময়কালে পৌরসভাগুলি সত্যিকারের নাগরিকদের পৌরসভা হয়ে উঠেছিল।

 

এখন আর জনগণের অংশগ্রহণ নেই

২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পর তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত রাজ্য সরকার পৌর প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকারের উপর হস্তক্ষেপ হানল। বামফ্রন্ট পরিচালিত পৌর বোর্ডগুলিকে নানান উপায়ে দখল করা হতে লাগল। জোর করে আইনকে উপেক্ষা করে পৌর বোর্ডগুলি চালাতে লাগল। পৌরসভা পরিচালনায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হলো। শুরু হলো এক অরাজক অবস্থা। উন্নয়নের নামে লুটপাট চলতে লাগল।

পৌরসভাগুলির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরেও নতুন করে নির্বাচন করা হলো না। পৌর আইনকে উপেক্ষা ও জলাঞ্জলি দিয়ে শাসক দলের প্রতিনিধিদের দিয়েই অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, বোর্ড অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তৈরি করে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে পৌরসভা, কর্পোরেশনগুলি আজও পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করা হয়েছে। বামফ্রন্ট সময়কালে নাগরিকদের সমস্ত স্বাধীনতা, মতামতের অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

 

আসানসোলের ভোটে যে কথা সামনে আসছে

আসানসোল নগর নিগম পূর্বে এত বড় এবং এত ওয়ার্ড নিয়ে ছিল না। এখন ১০৬টি ওয়ার্ডে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৫ সালে পৌরভোটের আগে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া ও কুলটি পৌরসভাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তৎকালীন আসানসোল নগর নিগমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রানিগঞ্জ এবং জামুড়িয়া পৌরসভা দু’টি ছিল বামফ্রন্ট পরিচালিত। দু’টি পৌরসভাই এ‍‌ই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। রানিগঞ্জ পৌরসভায় বোর্ড অব কাউন্সিলারদের জরুরি সভা ডাকা হয়। সেই সময় রানিগঞ্জ পৌরসভাকে তুলে দেবার এবং আসানসোল নগর নিগমের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয় এবং একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তখনও বর্ধমান জেলা ভাগ হয়নি। তৎকালীন পৌরসভার পক্ষ থেকে রানিগঞ্জ পৌরসভা তুলে দেবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসানসোলে অতিরিক্ত জেলা শাসককে চিঠি পাঠানো হয়। যিনি মিউনিসিপ্যাল বিষয়টি দেখতেন। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত জেলা শাসক রানিগঞ্জ পৌরসভাকে চিঠি দিয়ে শুনানির জন্য উপস্থিত হতে চিঠি পাঠান। আমরা সেই শুনানিতে উপস্থিত থাকি এবং আমাদের বক্তব্য বলি ও রানিগঞ্জ পৌরসভা তুলে দেবার বিরোধিতা করি। পৌরসভা এবং বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে নাগরিকদের কনভেনশন, সভার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়। এমনকি রানিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স ও রানিগঞ্জ সিটিজেন্স কাউন্সিলও তখন রানিগঞ্জ পৌরসভা তুলে দেবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। কিন্তু কোনও কিছুকেই তোয়াক্কা না করে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, কুলটি পৌরসভাকে তুলে দিয়ে আসানসোল নগর নিগমের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটানো হয়। জামুড়িয়াতেও রানিগঞ্জের মতো অনুরূপ প্রতিবাদ সংগঠিত হয়।

অন্যদিকে রানিগঞ্জ জামুড়িয়ার স্বার্থে, রানিগঞ্জ জামুড়িয়াকে যুক্ত করে নতুন রানিগঞ্জ মহকুমার দাবিতে বামফ্রন্টের উদ্যোগে ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, রানিগঞ্জ শহরে একটি নাগরিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এবং রানিগঞ্জকে মহকুমা করার দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবারের নগর নিগম নির্বাচনে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে এই দাবি তোলা হয়েছে। এছাড়াও দাবি করা হয়েছে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, কুলটিকে পুরানো পৌরসভার মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আসন্ন নগর নিগম নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিম বর্ধমান জেলা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী ইশ্‌তেহার প্রকাশ করা হয়েছে তাতে উপরোক্ত দাবি সহ মোট একুশ দফা প্রস্তাব করা হয়েছে যা বামফ্রন্ট পৌর নিগমের নির্বাচনে নির্বাচিত হলে রূপায়ণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ বোর্ড গঠন করা এবং তাকে রক্ষা করা। শিল্পাঞ্চলকে বাঁচানোর জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা। শিল্পাঞ্চল ও কৃষি অঞ্চলকে মরুভূমির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া। ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে নাগরিকদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা। আসানসোল রেলপাড় অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য গাড়ুই নদীর সংস্কার করা। বার্নপুর এলাকায় হাইড্রেন সংস্কার করা। পৌর বোর্ডে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী অফিসারদের যে মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সেই মর্যাদা এবং সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া। বিরোধী কাউন্সিলরদের য‍‌থোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া। বোরো অফিসগুলিকে যথার্থই কার্যকরী করে তোলা। অর্থ মঞ্জুর করে উন্নয়নের কাজকে গতিশীল করা। অনলাইনের মাধ্যমে ট্যাক্স প্রদান। এসসি, এসটি, ওবিসি ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সুবিধে প্রদান। দালাল চক্রকে বন্ধ করা। বর্জ্য পদার্থ পরিকল্পিতভাবে উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করা। পানীয় জলের সঙ্কট মোচন করা। বস্তি এলাকায় মানুষের পয়ঃপ্রণালী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পাকাবাড়ি, পানীয় জল, পথবাতি, পাকা রাস্তার ব্যবস্থা করা। ক্রীড়া ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো। কুলটি, চিনাচুড়ি, রানিগঞ্জ, বার্নপুর, জামুড়িয়া, আসানসোল শহরের প্রধান সড়কগুলি সম্প্রসারণ ও সংস্কার করা। রানিগঞ্জের বাইপাস রাস্তা প্রকল্প কার্যকর করা। কুলটি, জামুড়িয়া এলাকায় দমকল কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের কাছে পাঠা‍নো। পূর্বের মাইনস বোর্ড অব হেলথ-এর কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা।

করোনা পরিস্থিতিতে কোভিড বিধি মেনে এবারের নগর নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে আসানসোল কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট লুট করা হয়েছিল। মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। জোর করে আসানসোল নগর নিগম নির্বাচনকে দখল করা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা মানুষের সামনে আছে। এবারের নির্বাচনে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ভোট লুট রুখে দিয়ে মানুষ যাতে নতুন বামপন্থী পৌর বোর্ড গঠন করতে পারে সর্বত্র তারই প্রস্তুতি চলছে।

 

(গণশক্তি, ২৯জানুয়ারি, ২০২২)

 

শিলিগুড়িও আধুনিক হয়েছে বামফ্রন্টের হাত ধরেই

 অশোক ভট্টাচার্য

 

আর কয়েকদিনের মধ্যে অবশেষে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন হতে চলেছে। অবশ্যই যদি রাজ্য নির্বাচন কমিশন বা রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। করোনার অজুহাতে নির্বাচন প্রথমে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক জনমত ও নাগরিক আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন ২২জানুয়ারি চারটি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। পরে তা পিছিয়ে দিয়ে নির্বাচনের দিন পুনঃনির্ধারণ করা হয় ১২ ফেব্রুয়ারি। যদিও করোনার প্রকোপ এখনও অব্যাহত রয়েছে।

ইতিমধ্যে বামফ্রন্ট সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচারের কাজ অব্যাহত রেখেছে। বামফ্রন্ট সমস্ত করোনা বিধি মান্য করেই প্রচারের কাজ চালিয়ে গেলেও, তৃণমূল কংগ্রেস দল কিন্তু তা মেনে চলছে না। ইতোমধ্যে তাদের এক প্রধান নেতা করোনা বিধি না মেনে প্রচারের কাজ চালানোর ফলে নিজে যেমন অসুস্থ হয়েছেন সেই সংক্রমণে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের দলের অনেক কর্মী ও নেতারাও। এই নিয়ে শহরের মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঠছে।

যে চারটি পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তার মধ্যে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০১৫সালে রাজ্যের সর্বশেষ পৌর কর্পোরেশনগুলির নির্বাচনে একমাত্র শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনেই বামফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে পৌরবোর্ড গঠন করেছিল। রাজ্যের বিভিন্ন পৌর কর্পোরেশন বা পৌরসভার নির্বাচনগুলিকে শাসকদল পুলিস প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রহসনে পরিণত করেছিল। তা পারেনি কেবলমাত্র শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনে। কারণ বামফ্রন্ট সেই সময় সব দল, তথা দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ভোটদাতাদের কাছে নিজের ভোট নিজে দেওয়া, বাধা এলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আবেদন জানিয়েছিল। মানুষ সেই আবেদনে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিলেন এবং নিজের ভোট নিজের পছন্দমতো প্রার্থীদের দিতে পেরেছিলেন। ফলে বামফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল। কিছু সংবাদমাধ্যম একেই বলেছিল শিলিগুড়ি লাইন। আর একটি বিষয় হলো নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বামফ্রন্টকে পৌরবোর্ড পরিচালনা করতে হয়েছিল বহু বাধা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে। শাসকদল নানাভাবে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছিল দলত্যাগের। হুমকি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচিত পৌরবোর্ড ভেঙে দেবার ও জবরদখল করার। ওই পৌরবোর্ড এতো বাধার মধ্যে উন্নয়ন ও উন্নত পরিষেবা প্রদানের কাজ করেছিল সাফল্যের সাথে।

বামফ্রন্ট পরিচালিত সেই পৌরবোর্ড একদিকে উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্যে যেমন লড়াই করেছিল, তেমনি লড়াই করে বহু দাবি আদায় করেছিল, আবার নিজস্ব উদ্যোগে আয় বাড়িয়ে বহু উন্নয়নমূলক কাজও করেছিল। কাজ করেছিল মানুষকে সাথে নিয়ে সৎ ও স্বচ্ছভাবে। বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল শহরের বুনিয়াদি পরিষেবা প্রদান ও পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ। সেইসব কাজ শহরের মানুষের চোখের সামনে রয়েছে। এতো বাধার মধ্যে বামফ্রন্ট শাসক দলের ও রাজ্য সরকারের চোখ রাঙানির কাছে মাথা নিচু করেনি। করেনি আত্মসমর্পণও। শিলিগুড়ির মানুষ এরজন্য গর্ববোধ করে।

এই শহরের মানুষ জানে শিলিগুড়ির উন্নয়ন ও বামফ্রন্ট সমার্থক। মানুষ দেখেছে ও তারা জানে শিলিগুড়িকে রাজ্য তথা দেশ ও বিদেশের কাছে তুলে ধরেছে বামফ্রন্টই। একটি ছোট্ট জনপদকে একটি মেট্রো শহরের দিকে নিয়ে গেছে বামফ্রন্টই। বামফ্রন্টই শিলিগুড়িকে পৌরসভা থেকে পৌর কর্পোরেশনে উন্নীত করেছে। মানুষ বিগত ৪০ বছরের মধ্যে একবারই মাত্র তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোটের পৌরবোর্ডকে নির্বাচিত হতে দেখেছে। মানুষের অভিজ্ঞতা বলে তারা জোটবদ্ধভাবে সেই পৌরবোর্ডকে পরিচালনা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে সেই পৌরবোর্ডকে তারা চার বছরের বেশি সময় অব্যাহত রাখতে বা পরিচালনা করতে হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অন্যদিকে শহরের মানুষ দেখেছে এই শহরের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে বিগত বামফ্রন্টের পৌরবোর্ড, বামফ্রন্ট পরিচালনাধীন শিলিগুড়ি—জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সেই সময়ের রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগে। এই শহরের ঘরে ঘরে পানীয় জল সরবরাহ, প্রতিটি গৃহ থেকে জঞ্জাল সংগ্রহ করা, ওয়ার্ড ভিত্তিক জঞ্জাল সংগ্রহ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে ওয়ার্ড বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি গঠন এসব বামফ্রন্ট পৌর বোর্ডেরই সুফল। শহরে যতো বড় বড় রাস্তা বা রাস্তা প্রশস্তকরণ, ডিভাইডার নির্মাণ, ফুটপাত, রাস্তার ধারে গাছ লাগানো, পাকা নালা নির্মাণ, জল নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন, শহরের মধ্যে যানজট জটিলতা হ্রাস করতে বামফ্রন্টই নির্মাণ করেছিল তিনটি উন্নতমানের বাইপাস, চারটি মহানন্দা সেতু, প্রায় ১৫টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি, পঞ্চনই, মহিষমারি নদীর ওপর। এই শহরের দুটি ফ্লাইওভারও নির্মিত হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে। তিনটি আন্ডারপাস, রাস্তার ধারে এলইডি আলো। বস্তি উন্নয়ন, পাড়ার রাস্তার উন্নয়ন, বস্তির সার্বিক উন্নয়ন তাদের জমির পাট্টা, লিজ প্রদান, দলিল দেওয়া সবই হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়ই।

শহরের মধ্যে যানজট হ্রাস করতে শহরের বাইরে পরিবহণ নগর, তিনটি উপনগর, বিঞ্জান নগরী, ট্রাক টার্মিনাল, উন্নতমানের দুটি বাস টার্মিনাল, শ্মশানঘাটে বৈদ্যুতিক চুল্লি স্থাপন, কারবালা উন্নয়ন এসবও হয়েছে বামফ্রন্ট জমানায়। বামফ্রন্ট শিক্ষা, সংষ্কৃতি, খেলাধুলার উন্নয়নে রেখে গেছে বিরাট অবদান। এই শহরে কাঞ্চনজঙ্ঘা  ক্রীড়াঙ্গন, ইন্ডোর স্টেডিয়াম, দীনবন্ধু মঞ্চ, সুইমিং পুল, ক্রীড়াদীপ্তি সবই বামফ্রন্টের অবদান। এই শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। বামফ্রন্টের সময়েই হয়েছে দুটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান ও পলিটেকনিক কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ। বামফ্রন্টের সময়ে পাঁচটি নতুন সংগঠিত বাজার নির্মাণ, তিনটি বাজার নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ, ডি আই ফান্ডকে পৌরসভার হাতে আনা ইত্যাদি কাজও হয়েছে। মহানন্দা নদী সংস্কার প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছিল বামফ্রন্টের সময়ে। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস দলের সরকার আসবার পর তাদের পরিচালিত এসজেডিএ’র চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছিল ২০০ কোটি টাকার লুট ও দুর্নীতির সাথে। আজ সেই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বামফ্রন্ট পরিচালিত এসজেডিএ বোর্ডের কাজের সাফল্যই টি পার্ক, ফুড পার্ক, আনারস পার্ক, ড্রাই পোর্ট ইত্যাদি কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প সমূহ। বামফ্রন্টই উদ্যোগ নিয়েছিল উত্তরায়নে ২৫একর জমির ওপর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণে বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোন নির্মাণের। বর্তমান রাজ্য সরকারের একজন মন্ত্রীর উদ্যোগে সেই প্রকল্পের উদ্যোগে বাতিল ও বানচাল করে দেওয়া হয়। কোয়ানটাম তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্রটিও বামফ্রন্টের উদ্যোগের সুফল। বর্তমান রাজ্য সরকারের সময়ে তাও মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে।

শিলিগুড়ি শহরের সমস্ত স্বীকৃত ও অস্বীকৃত বস্তিগুলির যতো উন্নয়ন হয়েছে তা হয়েছে বামফ্রন্টের সময়তেই। কম করেও প্রায় ১০হাজার উদ্বাস্তু ও সরকারি উদ্যোগে বা পৌরসভার উদ্যোগে জমির দলিল, পাট্টা বা লিজ দলিত পেয়েছে বামফ্রন্টের উদ্যোগেই।

বামফ্রন্টের নেতৃত্বে বিগত পৌরবোর্ডের সময়ে সমস্ত ওয়ার্ডে অজস্র রাস্তাগুলিকে ম্যাস্টিকে উন্নীত করা হয়েছে। রাস্তার ধারে উন্নত পাকা নালা নির্মাণ করা হয়েছে। সমস্ত রাস্তায় এলইডি আলো লাগানো হয়েছে। নতুন অফিস ভবন ও স্বাস্থ্যভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। শ্মশানঘাটে নতুন দুটি বৈদ্যুতিক চুল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নাট্য মঞ্চ, চারটি নতুন পার্ক, নদীর ঘাট উন্নয়ন, নদী তীরের সৌন্দর্যায়ন, বিসর্জনঘাটের উন্নয়ন ইত্যাদির পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বামফ্রন্টই নিয়েছে।

পৌর প্রশাসনে স্বচ্ছতা, সততা, দ্রুততা, দায়বদ্ধতা, বিকেন্দ্রীকরণ বামফ্রন্টেরই সাফল্য। পৌরসভা বামফ্রন্ট পরিচালনা করেছে সবসময়ই গণতান্ত্রিকভাবে। বিরোধীদেরও দেওয়া হয়েছে সমান অধিকার ও মর্যাদা। কোনোরকম রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হয়নি। শিলিগুড়িকে একটি পরিকল্পিত শহর হিসাবে গড়ে তুলতে প্রস্তুত করা হয়েছিল ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। জমির সদ্‌ব্যবহার মানচিত্র, জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনা, পরিবেশে দূষণ হ্রাসের পরিকল্পনা ইত্যাদি। যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রশংসিত হয়েছিল। শিলিগুড়ির উন্নয়নে বামফ্রন্টের সাফল্যের ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না।

তাই এই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিটি মানুষের মুখে একটিই কথা, শিলিগুড়ির যাবতীয় উন্নয়ন হয়েছে বামফ্রন্ট পৌরবোর্ডের সময়েই। একমাত্র বামফ্রন্টের হাতেই শিলিগুড়ি শহর থাকতে পারে সুরক্ষিত। শিলিগুড়ি শহরের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান ধরে রাখতে পারে বামফ্রন্টই। এই কারণেই এই শহরের মানুষ পুনরায় বামফ্রন্টের পৌরবোর্ডকেই দেখতে চায়। তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি—কে ভোট দেওয়া মানে শিলিগুড়ি শহরকে আরও দশ বছর পিছিয়ে দেওয়া। অনুন্নয়ন, অনিশ্চয়তা, নৈরাজ্যকে ডেকে আনা। মানুষ তা চায় না। এই শহরের মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে দেখেছে ২০০৯ সালে। বিগত ৮মাস প্রশাসক মণ্ডলীর চেয়ারম্যান ও বোর্ডে তৃণমূলীদের মানুষ দেখেছে। সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি মানুষ চায় না। এই শহর উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এই শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। সাম্প্রতিক তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসনে তাদের দলবাজি, দাম্ভিকতা, কাটমানি মানুষ দেখেছে। এই কারনে তারা শিলিগুড়ির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই তৃণমূল কংগ্রস ও বিজেপি—কে চায় না। তারা তাদের সুরক্ষা নিরাপত্তা, সম্মান, আত্মমর্যাদা, শান্তি সম্প্রীতির জন্যেই চায় বামফ্রন্টকে পৌরবোর্ডে ফিরিয়ে আনতে। এই চর্চা আজ শহরের সর্বত্রই দলমত নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে চর্চিত হচ্ছে।

শিলিগুড়ির মানুষ আর একবার বামফ্রন্টের পক্ষে ইতিবাচক রায় দিয়ে ২০১৫সালের পুনরাবৃত্তির দিকে তাকিয়ে আছে। শিলিগুড়ি চায় আরও উন্নততর শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি চায় আরও বসবাস উপযোগী শহর। যেখানে গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে থাকবে ভারসাম্য। পরিবেশের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখেই হবে উন্নয়ন। গরিবদের বসবাসের ক্ষেত্রে থাকবে নিশ্চয়তা। পৌরসভা হবে গরিব মধ্যবিত্ত অভিমুখী। বস্তি রেখেই হবে বস্তির উন্নয়ন। এইরকম এক পৌরসভা দিতে পারে একমাত্র বামফ্রন্টই। 

 

গণশক্তি, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২