20190407

‘‘বিজেপি-তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই’’: বিমান বসু


 ‘‘বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই। অনেকেই ভুলে যান, বিজেপি-কে এরাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে এই তৃণমূলই। তৃণমূল আরএসএস-র মতো শক্তিকেও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না। আরএসএস-র অনুষ্ঠানে তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী!’’ গণশক্তিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা বললেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুতৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে গোপন বোঝাপড়া, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যার পাশাপাশি এরাজ্যে বামফ্রন্টের প্রচারের অভিমুখ ও  গোটাদেশে বামপন্থীদের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অজয় দাশগুপ্ত।



প্রশ্ন: লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বামফ্রন্টকর্মীরা মূলত কী আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন?
বসু: এবারের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে সারাদেশে একটা মোড় ঘোরানোর মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেভাবে দেশের সংবিধানের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে, সংবিধানের বিশেষ বিশেষ ধারাকে তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা আমাদের মত বহু ভাষা, বহু জাতি-বর্ণ ও বহু ধর্মের দেশে বিপজ্জনক। এটা বলছে কেন্দ্রে যারা সরকারে আছে, সেই এনডিএ-র নেতৃত্বে থাকা বিজেপি। এই বিজেপি-র প্রাণভোমরা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। এর অসংখ্য শাখা সংগঠন আছে, যারা নানান কায়দায় মানুষের মধ্যে এই ধরণের প্রচার করছে। আরএসএস-র প্রধান লক্ষ্যবস্তু, দেশের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই পরিবর্তন করা, সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেশ চালাতে চায় তারা। এই নির্বাচনে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে সেই চেষ্টা যে আরএসএস করবে, তা নিজেদের মধ্যে প্রচার করছে। কিন্তু ভারতের এই সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামো সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত। দেশের সংবিধানের এই ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তা রক্ষা করার লক্ষ্যেই বামফ্রন্টকর্মীরা প্রচার করছেন। শুধু তাই নয়, বিজেপি-র আমলে দেশের সাধারণ মানুষের ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতির মেলবন্ধন সুরক্ষিত নয়। তাই, বিজেপি-কে পরাস্ত করতে হবে। কে কী খাবে, কে কী পরবে, এই ধরণের ফতোয়া ওরা জারি করতে চায়! মানুষের ওপর এই অগণতান্ত্রিক আক্রমণ নামিয়ে আনছেএই বিজেপি দেশের মানুষের বন্ধু নয়, দেশের মানুষের শত্রু। অবশ্যই একাংশের মানুষের তারা জিগরি দোস্ত; তারা কারা? যারা মাত্র ১শতাংশ, তাদের বন্ধু বিজেপি। ওপরতলার এই ১শতাংশের হাতে ২০১৪সালে দেশের মোট সম্পদের ৪৯শতাংশ ছিল, ২০১৮সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩শতাংশ। এদেরই বন্ধু বিজেপি সরকার। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের এই মহান দেশকে সুরক্ষিত  রাখতে এবং দেশের আপামর জনগণ, শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থে, দেশের ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে আমরা স্লোগান দিয়েছি: ‘বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও’।

প্রশ্ন: এরাজ্যের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট তো একইসঙ্গে ‘তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও’ বলছে...
বসু: হ্যাঁ, এরাজ্যে আমরা একইসঙ্গে ‘তৃণমূল হটাও, রাজ্য বাঁচাও’ স্লোগান দিয়েছি। অনেকে এটা বলতে পারেন, এটা তো লোকসভা নির্বাচন। এই রাজ্যের শাসকদলকে কেন আমরা হটানোর কথা বলছি? তার কারণ হলো, বিজেপি-কে এরাজ্যে হাত ধরে ডেকে এনেছে এই তৃণমূলই, সেকথা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন। ১৯৯৮সালে তৃণমূল দল তৈরি হওয়ার পর অনেক অশুভ শক্তির সঙ্গেই এই দল সম্পর্ক তৈরি করেছিল, যারমধ্যে বিজেপি-ও ছিল। পরে বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার তৈরি হলে তার অংশীদার হয় তৃণমূল। তৃণমূল আরএসএস-র মতো শক্তিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে না। আরএসএস-র মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার এক অনুষ্ঠানে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী গিয়ে বলেছিলেন, না এলে জানতাম না, এরা কতো ভালো! তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী! নানাসময় বিজেপি-র গুণগানও করেছে তৃণমূল। স্বাভাবিকভাবে যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিরই এই ধারণা থাকা ভালো, বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো মৌলিক ফারাক নেই। আর ২০১১ সালে সরকারে আসার পর আমরা দেখছি, এই তৃণমূল সরকার নানাভাবে মানুষের টুঁটি চিপে ধরছে, অধিকার হরণ করছে। তৃণমূলের পক্ষ থেকে লাগাতার কমিউনিস্টদের ওপর, বামপন্থীদের ওপর, যারা এই সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, তাদেরকেই আক্রমণ করা হচ্ছে। এলাকার পর এলাকায় বামপন্থীরা বাড়িঘর ছাড়া হয়েছেন, লাগামহীন অত্যাচার, খুন চলছে। সাধারণ মানুষকে এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে হচ্ছে, জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে হচ্ছেবিশেষ করে, দ্বিতীয় তৃণমূল সরকার তৈরি হওয়ার পর আমরা দেখছি, লুঠতরাজের রাজত্ব খোলাখুলি শুরু হয়ে গেছে। বেপরোয়া তোলাবাজি চলছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে যারা জমি পেয়েছিলেন, তফসিলী জাতি, আদিবাসী বা ধর্মের বিচারে মুসলমান মানুষ, তাঁদের অনেকের জমি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা ফসলের ন্যয্য দাম পাচ্ছেন না। সারাদেশের মতো এরাজ্যেও কৃষিসঙ্কট শুরু হয়েছে, যা বামফ্রন্ট সরকারের সময় রোখা গিয়েছিল। তৃণমূল সরকার মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে আক্রমণ নামিয়ে আনছে, যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেইজন্য রাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে জোরদার করতেই তৃণমূলকে পরাস্ত করার বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রশ্ন: সম্প্রতি এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা ২৯দিন ধরে অনশন করলেন। শিক্ষাক্ষেত্রের অন্যান্যরাও আন্দোলনে নেমেছেন। কিন্তু তৃণমূল সরকার তো এরাজ্যে ব্যাপক উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছে....
বসু: হ্যাঁ, তৃণমূল সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের উদ্দাম প্রচার চলছেকিন্তু উন্নয়ন-এর কথা দিনরাত জপ করলেও মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত এই আমলে দিনদিন দুর্বল হচ্ছেসে এসএসকে বা এমএসকে, অথবা প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক হোক, অথবা মাদ্রাসায় প্রতিটি স্তরেই শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। নিয়োগ হচ্ছে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তো প্রতিবছর বাড়বে, কম কম হলেও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।  বামফ্রন্ট সরকারের সময় যেখানে একবার মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা একবছরে ৭লক্ষ থেকে লাফিয়ে ৯লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিল, যা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাথমিক ফল। একটা প্রজন্মের পর দ্বিতীয় প্রজন্ম শিক্ষার আঙিনায় এলে এটা হয়। এখন যেমন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। তাহলে মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কমবে কেন? কিন্তু এবারে কমেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও অনেক ঢক্কানিনাদ শোনা যায়। কিন্তু শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মতোই এখানেও শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। যে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নই করতে পারে না, সে আবার কী করে উন্নয়নের দাবি জানায়? 

প্রশ্ন: বিজেপি সভাপতি ও শীর্ষ নেতারা এসে এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন প্রশ্ন, অনুপ্রবেশ, এনআরসি প্রভৃতি প্রসঙ্গ প্রচার করছে। প্রধানমন্ত্রীও এতদিন বিকাশের কথা বলে এখন একইভাবে এইসব সাম্প্রদায়িক প্রচারে নেমেছেন। তৃণমূলও পালটা প্রচার করছে। একদিকে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং অন্যদিকে গোপন বোঝাপড়া, এই দ্বিমুখী বিপদকে বামপন্থীরা কিভাবে মোকাবিলা করবে?
বসু: এরা শলাপরামর্শ করেই পরস্পরের বিরুদ্ধে নাম করে তোপ দাগেবিজেপি সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী এরাজ্যে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তৃণমূলনেত্রীকে ‘দিদি’ ডেকে তোপ দাগেন, আবার তৃণমূলনেত্রী তাঁদের নানা নামে ডেকে পালটা বলছেন। মনে হবে ওদের মধ্যে ভীষণ বিরোধ আছে! আসলে এটাই ওদের বোঝাপড়া তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে বোঝাপড়া থাকার কারণেই গত ৫বছরে সারদা-রোজভ্যালিসহ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি! নারদা ঘুষকান্ডের ভিডিও ফুটেজ ফরেনসিক টেস্টে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সংসদের এথিক্স কমিটির একটি বৈঠকও তিন বছরে ডাকেনি এনডিএ সরকার! কেন? অন্যদিকে, সুক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ উভয় দলের পক্ষ থেকেই চলছে। রামনবমীকে কেন্দ্র করে হঠাৎ দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো! গতবছর রামনবমীর দিন যেভাবে দাঙ্গা হলো অতীতে পশ্চিমবাংলায় কখনো তা হয়নি। আবার আসানসোলের ইমামের যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে। তাঁর পুত্র খুন হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে ‘আমন’ বা শান্তি বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। রামনবমীকে কেন্দ্র করে যে হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি হলো, এরজন্য দায়ী তৃণমূল কংগ্রেস। একইসঙ্গে বিজেপি-ও, যাকে হাতে ধরে নিয়ে এসেছে তৃণমূল। বিজেপি এরাজ্যে তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের মাধ্যমে এই ধরণের কার্যকলাপ করার সুযোগ পেয়েছে। আরএসএস-র শাখা তৃণমূলের আমলে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিমবাংলায়। সারাদেশে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছে, তা এখানেও সুকৌশলে করছে। অন্যদিকে, তৃণমূলও ভিন্ন কায়দায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করছে। উভয় দলের পক্ষ থেকে মানুষকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে। এই দুটি দক্ষিণপন্থী দলই বামপন্থীদের শত্রু। কারণ, এতদিন ধরে বামপন্থীরা যে সমস্ত ইস্যুতে আন্দোলন করেছে, যেমন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম, বেকার যুবকদের চাকরি, শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতিসহ বিভিন্ন জনসাধারণের রুটিরুজির সমস্যা, তা এদের দুই দলের বিরুদ্ধেই। নির্বাচনের মুখে এসে সেসব মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে আমাদের মানুষের মধ্যে ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করতে হবে।  নানারকম প্ররোচনা সত্ত্বেও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেষ্টায় অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোখা গেছে, যা পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য।    

প্রশ্ন: এরাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী ভোট এক জায়গায় করার উদ্যোগ আপনারা নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। বামফ্রন্ট দুটো আসনে প্রার্থী দেয়নি। সেই দুটো আসনে বামফ্রন্টকর্মীরা কী প্রচার করবেন? 
বসু: এরাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট এক জায়গায় করার লক্ষ্যে আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে চেয়েছিলাম। সেই উদ্যোগ শেষপর্যন্ত সেভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু দুটো আসন, মালদহ দক্ষিণ এবং বহরমপুরে বামফ্রন্ট কোনো প্রার্থী দেয়নি। এতেই বোঝা যাবে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী। তৃণমূল ও বিজেপিকে পরাস্ত করার লক্ষ্যেই এই দুই কেন্দ্রে কাজ করছেন বামফ্রন্টকর্মীরা। যেহেতু এই দুই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট প্রার্থী নেই, বিজেপি ও তৃণমূলকে হারাতে সক্ষম এবং এরাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে এমন প্রার্থীর পক্ষেই তাঁরা প্রচার করছেন। কেন্দ্রে একটি বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনে সহায়ক শক্তিকে এই দুই এলাকায় জয়ী করার লক্ষ্যে ভোট দেবেন বামফ্রন্টকর্মীরা।

প্রশ্ন: ২০১১সালের পর থেকে এরাজ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের ভয়াবহ সন্ত্রাস দেখা গেছে। লোকসভা নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হবে বলে মনে করছেন?
বসু: একথা ঠিক যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় বহু জায়গায় মনোনয়নপত্রই জমা দিতে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে বীরভূমের উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যেখানে জেলা পরিষদের আসনেও বিরোধী দলের কাউকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। তবে লোকসভা নির্বাচনে হুবহু তার পুনরাবৃত্তি হবে বলে আমি মনে করি না। যদি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে এলাকায় এলাকায় রুটমার্চ করানো হয় এবং পোলিং স্টেশনের বাইরে মোতায়েন করা যায়, তবে ভোটারদের মধ্যে ভোটদানের পক্ষে আস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, ভোট যারা লুট করে, তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজ্য প্রশাসন, সেইসব ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আটকানো যায়, তবে মানুষ ভোট দিতে পারবেনআর জনগণের পক্ষ থেকেও নিজের ভোট নিজে দেবো এই জেদ ধরেই চলা উচিত। এক্ষেত্রে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম জারি রাখতে জানকবুল লড়াই করা একান্ত জরুরী।     

প্রশ্ন: কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বিকল্প সরকার গড়ে তোলার যে স্লোগান বামপন্থীরা দিয়েছে, তা কতটা সফল হবে বলে মনে করেন?
বসু: এবারের লোকসভা নির্বাচনে আমরা স্লোগান দিয়েছি, বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করো, লোকসভায় সিপিআই(এম) ও বামপন্থীদের শক্তি বাড়াও এবং কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিকল্প সরকার তৈরি করো। সারাদেশে এখন যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে এবং আমাদের রাজ্যে, তাতে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিজেপি-বিরোধী একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার তৈরির বাস্তবতা রয়েছে। বিজেপি সারাদেশে ধিক্কৃত হয়েছে, সারাদেশে বিজেপি-র আসন কিভাবে কমবে, তা ওরা উপলব্ধি করতে পারছে না। নির্বাচনের পরে এনডিএ-বিরোধী একটি সরকার তৈরির বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি হলে তা নিশ্চয়ই গতিবেগ পাবে  এবং বিকল্প একটি সরকার তৈরি হবে, সেই আশা রাখছি।     



20190401

নির্বাচনের পরে রাজ্য-রাজনীতিতে সৃষ্টি হবে নতুন পরিস্থিতি: সূর্য মিশ্র


সারা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের মানুষও সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি। এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে কোন আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন বামপন্থীরা? কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের মধ্যে মেরুকরণের চেষ্টা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক প্রচার, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা, এসবের মোকাবিলা করে বামপন্থীরা কী তাদের বিকল্পের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে পারবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে? গণশক্তিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিতভাবে মতামত জানিয়েছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। নির্বাচনের পরে এরাজ্যের রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য: 
-----------------------


প্রশ্ন: এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে বামপন্থীরা কী আবেদন জানাবে? এই নির্বাচনে এরাজ্যের মানুষ কেন বামপন্থীদের সমর্থন করবেন?

মিশ্র: এই নির্বাচনে দেশের ও রাজ্যের মানুষের সামনের প্রধান বিষয়গুলির থেকে মানুষের নজর সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা। ৪৫ বছরের মধ্যে এমন খারাপ অবস্থা হয়নি। কাজ ছিলো  যাদের তাদেরও কাজ চলে যাচ্ছে। মোদী বলেছিলেন, প্রতি বছরে দুকোটি বেকারকে কাজ দেবেন। এখানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বেকারী শতকরা চল্লিশ ভাগ বেকারী কমে গেছে রাজ্যে। যে যা খুশি বলছেন। কিন্তু জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য যা সরকার চেপে রাখার চেষ্টা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ৫বছরে ৫কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ১কোটি ৮০লক্ষ মানুষ শিল্প ও পরিষেবার থেকে কাজ হারিয়েছেন মূলত নোটবন্দী ও জিএসটি’র কারণে এবং ধারাবাহিক শিল্পমন্দার কারণে। তার সঙ্গে প্রায় ৩কোটি ২০লক্ষ মানুষ যারা কৃষিকাজে স্থায়ীভাবে না হলেও যুক্ত ছিলেন তাঁরা কাজ হারিয়েছেন। শিল্প কৃষি দুটোতেই নজিরবিহীন সঙ্কট। ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হচ্ছে, লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কারখানার বেসরকারীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবার শিক্ষায় ইন্টার্ন নিয়োগের কথা বলেছেন যেগুলো আদৌ স্থায়ী কর্মসংস্থান নয়। কেন্দ্রীয় সরকারও রেল এবং অনেক ক্ষেত্রে এই কাজই করছে। কৃষিতে স্বাধীনতার পরে এমন সঙ্কট আসেনি। ফসলের দাম না পাওয়ায় চাষের খরচও উঠছে না, কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ফসলের দাম দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুন করবেন। আর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের আয় তিনগুন হয়ে গেছে। দুটোই হাস্যকর দাবি। কৃষকরা দুরবস্থার মধ্যে আছেন। ফসলবীমার নামে ৫টা কর্পোরেট সংস্থা ৭হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। অন্যদিকে এরাজ্যে অকাল বৃষ্টিতে আলুর ক্ষতি হয়েছে, আলু নিয়ে কৃষকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। কেজি প্রতি ৭টাকার কম দাম হলে কৃষকদের লাভ হয় না, অথচ আলুচাষীরা ২-৩টাকা দাম পাচ্ছেন। সরকার সমস্যাটা স্বীকারই করতে চাইছে না। তেলেঙ্গানা সরকার রায়তবন্ধু নামে, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকসম্মান নামে আর এরাজ্যের সরকার কৃষকবন্ধু নামে প্রকল্প যা করেছে তাতে ফসলের দাম, বীমা, ঋণ এসবের সমাধান না করে কৃষকদের হাতে থোক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এতে সমস্যা মিটবে না। তাছাড়াও সরকারের জনবিরোধী নীতির জন্য মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। শিক্ষা স্বাস্থ্যে সরকারের বেসরকারীকরণের জন্য মানুষের খরচ বাড়ছে, বোঝা বাড়ছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ফোন পেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদেশের মোটরসাইকেলের ওপর শুল্ক তুলে নিচ্ছেন। আর আমেরিকা এখানকার ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক চাপাচ্ছে। দেশের শিল্প পরিষেবা রক্ষায় সরকারের নজর নেই। এই সব জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীরা।

এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই জায়গাতেই দুর্নীতি। ওখানে রাফালে দুর্নীতি, এখানে সারদা নারদ দুর্নীতি। ওখানে ওরা থাকলে যে এখানে এরা নিরাপদ তা এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পাঁচ বছর হয়ে গেলো কেন্দ্রীয় সরকারের সিবিআই, ইডি কেউ সারদার নারদার আসামীদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করেনি, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমরা স্পষ্টভাবে মানুষের কাছে বলছি, এই সব বিষয়ে বামপন্থীদের বিকল্প রয়েছে। আমরা যে দাবি নিয়ে ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘট করেছি, ব্রিগেডে সমাবেশ করেছি, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং দিল্লির বুকে শ্রমিক, কৃষক, আশা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন করেছি, ইশতেহার প্রকাশ করে উল্লেখ করেছি, সেইসবই আমাদের বিকল্প। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। আদিবাসীদের এবং তফসিলি জাতির মানুষের উন্নয়ন কর্মসূচী কেন্দ্রীয় সরকার ছাঁটাই করছে, নারী ও শিশুকল্যাণে বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে, দলিত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, আর এরাজ্যে মহিলাদের নিরপত্তার হাল তো সবাই জানেন। সংখ্যালঘু দলিতদের ওপরে আক্রমণের ঘটনা বারবার দেখা যাচ্ছে সারা দেশে। আমাদের বার্তা হলো এই যে এসবের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা বিকল্পের দাবিতে যে লড়াই আন্দোলন করছে তার কন্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দিতে হবে। সেটা যে করা যায় ২০০৪ সাল তার একটা দৃষ্টান্ত। সেই সময়ে সংসদে বামপন্থীরা যখন শক্তিশালী ছিলো তখন কাজের অধিকার, আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার, বীমা ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ রোধ, খাদ্য ও শিক্ষার অধিকারের নিশ্চয়তা এসব করা গেছিলো। এখনকার পরিস্থিতি ২০০৪ সালের থেকেও কঠিন, আক্রমণ আরও তীব্র, কিন্তু এখনও বামপন্থাই বিকল্প। আমরা মানুষের কাছে বামপন্থীদের বিকল্পের লড়াইয়ের কন্ঠস্বর সংসদে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই আবেদন করবো।

প্রশ্ন: জনজীবনের সমস্যার সমাধানের জন্য যে বিষয়গুলিকে আপনারা বামপন্থীদের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরছেন, সেই বিকল্পের জন্য বামপন্থীরা এরাজ্যে আন্দোলন সংগ্রাম কতটা করতে পেরেছে? তার কোনো প্রভাব নির্বাচনে পড়বে কি?

মিশ্র: এরাজ্যে এবং সারা দেশে এই সময়কালে যদি কেউ লড়াইয়ের ময়দানে থেকে থাকে তাহলে তা বামপন্থীরাই। আমরা নিরন্তর আন্দোলনেই আছি। গত আগস্ট মাসে সারা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের জেলাগুলিতেও আইন অমান্য আন্দোলন হয়েছে। শত শত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, বামপন্থী কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। জনজীবনের দাবি নিয়ে বামপন্থী গণসংগঠনগুলি, তাদের সংগঠন বেঙ্গল প্ল্যাটফর্ম অব মাস অর্গানাইজেশন একাধিক পদযাত্রা করেছে। তারপরে ৪৮ ঘন্টার সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যের সরকারগুলি যা করেনি এরাজ্যের তৃণমূল সরকার সেই আক্রমণ করেছে ধর্মঘট ভাঙতে। আইনী এবং বেআইনী পদক্ষেপ নিয়ে ধর্মঘট ভাঙতে চেষ্টা করেছে, আক্রমণের রেকর্ড তৈরি করেছে। কিন্তু মানুষের বার্তা স্পষ্ট ছিলো, ঐতিহাসিক ধর্মঘট হয়েছে। তারপরে সেই বার্তা নিয়ে ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছে বামফ্রন্টের। ব্রিগেডের সমাবেশ প্রমাণ করেছে, বামপন্থীরাই শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করছে। নির্বাচনে নিশ্চয়ই এর প্রতিফলন ঘটবে।

প্রশ্ন: এটা কেন্দ্রের সরকার গঠনের নির্বাচন। কিন্তু এরাজ্যের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য্য কী? বিশেষ করে বামপন্থীরা যখন কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদলেরই বিরোধিতার কথা বলছে, তখন এই নির্বাচন কি রাজ্য রাজনীতিতে নতুন কোনো পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে?

মিশ্র: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ২মাসের মধ্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার হঠে যাবে, মোদী আর গদিতে থাকবেন না। কেন্দ্রে একটা বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার তৈরি হবে এবং বামপন্থীদের শক্তি সংসদে বাড়বে। এরমধ্য দিয়ে সারা দেশে মানুষের দাবির লড়াই আরও প্রসারিত হবে। এরাজ্যেও নির্বাচনের পরে তার প্রভাব পড়বে, তৃণমূল কংগ্রেস আরও দু’বছর সরকার চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ তৃণমূল দলটাই ভেঙে যাচ্ছে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দল ভেঙে বিজেপি’তে যোগ দিচ্ছে। আরও অনেকে ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ রাখছে চলে যাবে বলে। কারণ যারা লুটপাটের মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন তাঁরা আধিপত্য রাখার জন্য আনুগত্য বদলাতে চাইবে। এই অবস্থায় বর্ধিত শক্তি নিয়ে বামপন্থীদের লড়াই হবে বিজেপি যাতে মাথা তুলতে না পারে এরাজ্যে, তার জন্য নতুন পর্বের সংগ্রামের সূচনা হবে।

প্রশ্ন: কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং এরাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার করছে। এই মেরুকরণের মোকাবিলা করে কীভাবে বামফ্রন্ট নির্বাচনে লড়াই করবে?

মিশ্র: বিজেপি বলছে গণতন্ত্র আক্রান্ত। ঠিকই তো। কিন্তু গণতন্ত্র তো ২০১১ সাল থেকেই আক্রান্ত। আমরা তখন থেকেই বলছি, বিজেপি তখন কী করছিলো? বিজেপি সরকারের তো পাঁচবছর হয়ে গেলো, অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট আদেশ থাকা সত্ত্বেও চিটফান্ডে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? কেন প্রতারকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে প্রতারিতদের টাকা ফেরৎ দেওয়া হলো না? নারদ টেপ তো ফরেনসিকে প্রমাণিত, ওটা জাল নয়। সংসদে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আদবানি। কেন একদিনও সেই কমিটি বসতে পারলো না এটা নিয়ে? এটা বোঝাপড়া নয় তো বোঝাপড়া কাকে বলে! আর গণতন্ত্র নিয়ে বিজেপি কী বলবে, এখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা ৩৪শতাংশ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় দেখেছি, ত্রিপুরায় বিজেপি সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে প্রায় ৯৯শতাংশ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় করে। রামনবমীতেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে দুটো দলকেই দেখো গেছে। নীতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, যে কোনো প্রশ্নে তৃণমূল এবং বিজেপি একে অপরের পরিপূরক, কোনো ফারাক নেই। এই যে সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো’র স্ত্রীকে নিয়ে বিমানবন্দরের ঘটনাটা ঘটলো। উনি নাকি ২কেজি সোনা নিয়ে এসেছিলেন। তা কাস্টমস সেটা আটক করলো না কেন? কাস্টমস্‌ কারা চালায়? নতুন ফেডারেল কাঠামোয় ওটাও রাজ্যের হাতে চলে এসেছে নাকি! কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই? কাজেই বিজেপি’র প্রতিবাদ করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। ত্রিপুরার মতো গোটা তৃণমূল দলটা যদি এখানেও বিজেপি’তে চলে যায় অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তৃণমূলকে ভোট দেওয়া আর বিজেপি’কে ভোট দেওয়া একই ব্যপার। তাই আমরা নির্বাচনে দুটো দলের বিরোধী ভোটকে ঐক্যবদ্ধ করার আহবান জানিয়েছি।

প্রশ্ন: যেভাবে যুদ্ধোন্মাদনা এবং জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ জাগানো হচ্ছে তাতে জনসাধারণের রুটিরুজির সমস্যা কি নির্বাচনের মুখে এসে চাপা পড়ে যাচ্ছে? কাশ্মীরেরর ঘটনা, জওয়ানদের মৃত্যু এবং সীমান্তে সেনা কার্যকলাপ কি এরাজ্যেও ভোটদানের সময় জনসাধারণকে চালিত করবে?

মিশ্র: ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ রাজ্যে, বিশেষত রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো বিজেপি’র শক্ত ঘাঁটিতে তাদের পরাজয়ের পরেই আমরা সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে বলেছিলাম বিজেপি অপরাজেয় নয় প্রমাণিত হলো। কিন্তু তখনই সতর্ক করেছিলাম এরা আরও তুরুপের তাস বের করবে। বাস্তবে তাই করেছে। রামমন্দির ইস্যুকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়ার কথা বলে মেরুকরণের চেষ্টা করেছে। আর সেই সঙ্গে কাশ্মীর ও পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করে সারা দেশে তার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করেছে। আমরা এই বিষয়গুলি নিয়ে ডিসেম্বর মাসেই সতর্ক করেছিলাম। কাশ্মীরে বিজেপি পিডিপি’র সঙ্গে সরকারে ছিলো, সেই সরকারকে ভেঙে দিলো। ওখানকার মানুষের আস্থা নষ্ট করছে, তাঁদের অধিকার খর্ব করছে। পুলওয়ামায় ঘটনার জন্য দায়ী তো সরকারের গাফিলতি। বিজেপি সরকারের আমলে দেশে নিরাপত্তা রক্ষীরা বেশি সংখ্যায় প্রাণ দিয়েছে, আর সীমান্ত পার থেকে অনুপ্রবেশও বেশি সংখ্যায় হয়েছে। এই সরকার দেশের নিরাপত্তা, সংবিধান, ঐক্য সবকিছু রক্ষাতেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এখন সেগুলো থেকে নজর ঘোরাতে বায়ুসেনার কর্মী অভিনন্দনের ছবি দেখিয়ে ভোট চাইতে হচ্ছে! এতই দেউলিয়া অবস্থা বিজেপি’র। কিন্তু ওরা মানুষের প্রকৃত বিষয়গুলি থেকে নজর ঘোরাতে চাইলেও আমরা বামপন্থীরা প্রকৃত বিষয়গুলি নিয়েই প্রতিদিনের লড়াইতে আছি। এই যে ধর্মতলায় এসএসসি উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা অনশনে বসে মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘অনশন’এর রেকর্ড ভেঙে দিলেন সেটা কী এইসব মেরুকরণ করে নজর ঘুরিয়ে আটকাতে পারলো? আলুচাষীদের বিক্ষোভকে আটকাতে পারলো? পারবে না। তবে আমরা মনে করি, স্বাধীনতার পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে দুবার এরকম চ্যালেঞ্জ এসেছিলো। ১৯৭৭ সালে এবং ২০০৪ সালে। দুবারই দেশের নির্বাচকমন্ডলী প্রমাণ করেছেন যে সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ মোকাবিলায় তাঁরা সক্ষম। 

প্রশ্ন: আমাদের শেষ প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচন সহ বিভিন্ন নির্বাচনে শাসকদলের সন্ত্রাস দেখা গেছে। মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এবার অবাধে ভোট দিতে পারবেন কিনা। লোকসভা নির্বাচনে কি এর জন্য আপনারা নির্বাচন কমিশনের ওপরেই ভরসা করছেন?

মিশ্র: আমরা বারবার বলছি, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা, নিরপেক্ষতা, কার্যকারিতা এসব নিয়ে কোনো অতিরিক্ত মোহ রাখবেন না। তার মানে এই নয় যে কমিশনে অভিযোগ জানাবেন না। অভিযোগ জানাতে হবে, লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। সুযোগের ব্যবহার করতে হবে। অভিযোগ করে কিছু তো আদায় করা সম্ভব হয়। যেমন গতবার তো পরিচিতি পত্র ছাড়াই বুথ শ্লিপ দিয়ে ভোট দিয়েছিলো। এবার কমিশন আমাদের দাবি মেনেছে। কাজেই মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে, অধিকার রক্ষার লড়াইতে মানুষকে সংগঠিত করাটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, যে এটা পঞ্চায়েত নির্বাচন নয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় যে সব নির্বাচন এই সময়ে হয়েছে সব অবাধ হয়েছে এমন মোহ আমি রাখতে বলছি না। কিন্তু আমি বলছি, বাস্তবতা হলো, তৃণমূল ভয় পেতে শুরু করেছে। পঞ্চায়েতে ৩৪শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেও এমন শতাধিক পঞ্চায়েত আছে যেখানে তৃণমূল জিতেও কর্মকর্তা নির্বাচিত করতে পারছে না। তৃণমূলের হাতে তৃণমূলই আক্রান্ত। তৃণমূলের নেতাদেরই নিরাপত্তা নেই। এমনকি বিধায়কদেরও নেই। কেউ ছাড় পাচ্ছে না, নিজেদেরই হাতে আক্রান্ত হচ্ছে, বোমা ফাটছে, খুন হচ্ছে। তৃণমূলের এত দ্রুত ক্ষয় ২০১১ সালের পরে কখনো দেখা যায়নি। এই অবস্থায় প্রত্যেক বুথে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষ লাল পতাকা তুলে ধরবেন, বামপন্থী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাবেন। মানুষ যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে ওরা পালাবে। এটাই বাস্তবতা। কাজেই আমি বলিষ্ঠ আশাবাদে বিশ্বাসী। মানুষ শপথবদ্ধ হচ্ছেন, মরিয়া হয়ে তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এটাই সুষ্ঠু ভোটের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি হতে পারে। 

গণশক্তি, ১লা এপ্রিল, ২০১৯