20210213

তৃণমূল-বিজেপি’কে হারানোর বাস্তব পরিস্থিতি রয়েছে: সূর্য মিশ্র

 


--------------------------------------------------

পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এবারে রাজ্যে ত্রিমুখী লড়াই। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলকে পরাস্ত করার বাস্তবতা রয়েছে। বিকল্প নীতি রূপায়ণ করতে হবে। সেই বিকল্প বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দিতে পারবে। গণশক্তিকে সাক্ষাৎকারে বললেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য।

--------------------------------------------------

প্রশ্ন: রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘোষিত হতে চলেছে। তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস একসঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সীমিত করে দেখানো হচ্ছে মিডিয়াতে। আপনি কি মনে করেন, ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই দুই দলকে পরাস্ত করা যাবে? রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সুযোগ রয়েছে?

সূর্য মিশ্র: অবশ্যই রয়েছে। কারণ, পরিস্থিতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তা নিয়ত পরিবর্তনশীল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি’র মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। এই মেরুকরণের ফলে রাজ্যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জনসমর্থন ১৩ শতাংশের নিচে নেমে যায়। সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। এখন ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে বাধ্য। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরেই দেশে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শুরু হতে দেখা গিয়েছে। তারপরে যত রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে, বিজেপি হেরেছে অথবা অনেক কারসাজি করে কান ঘেঁষে জিতেছে। রাজস্থান, কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশ, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিততে পারেনি। কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশে জনতার রায়কে উলটে দিয়ে পরে সরকার দখল করেছে। বহু টাকা খরচ করে, গোদি মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রচার চালিয়েও বিহারে মাত্র ০.৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে সরকারে এসেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে মহামারী এবং তার আগে থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং বৈষম্য আরও বেড়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ আন্দোলনও তীব্র হয়েছে। সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় প্রতিবাদ দমনের চেষ্টা করছে। কিন্তু ধর্মঘট-হরতাল ও সর্বশেষ কেন্দ্রের কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লিকে ঘিরে কৃষকদের অবস্থান-বিক্ষোভ এবং দেশ জুড়ে কৃষকদের আন্দোলন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা স্বাধীনতার পর কখনো দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, এরাজ্যে তৃণমূলের সরকারের জনবিচ্ছিন্নতাও বাড়ছে, সরকারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভও বাড়ছে। ওরা প্রচুর টাকা খরচ করে যতই চেষ্টা করুক, সেটাকে চাপা দিতে পারছে না। ইলেকটোরাল বন্ডে বিজেপি’র পরে সবচেয়ে বেশি টাকা তো তৃণমূলই পেয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে ১৮টি আসনে জেতানোর পরে  ‘দিদিকে বলো’ বলে তৃণমূলের সুবিধা কিছু হয়নি, তাই ‘দুয়ারে দুয়ারে’ যেতে হয়েছে এবং ‘সমাধান’ তো দূরের কথা, তৃণমূল দলটার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এখন তো দল প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে। অন্যদিকে মহামারী ও লকডাউনের সঙ্কটের সময় থেকে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে বামপন্থীরা। ভিনরাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করা, তাঁদের ঘরে ফেরানো, কোভিড নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রচার, অসহায় মানুষদের কাছে সাবান, স্যানিটাইজার, খাদ্য, ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, কমিউনিটি কিচেন ও সবজি বাজার চালানো, হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া, রক্তদান করা— এসবই বামপন্থীরা করেছে। এমনকী পুলিশের বাধা সত্ত্বেও করেছে। কেন্দ্রের কাছে মানুষের দাবি তুলে ধরে রাস্তায় নামায় আমাদের কলকাতার বুকে দু’বার গ্রেপ্তার করেছে এই সরকারের পুলিশ। মানুষ দেখেছেন, যারা সরকারে আছে তারা দরকারে নেই। আর যারা সরকারে নেই, তারা দরকারে আছে। কাজেই আমাদেরই দায়িত্ব মানুষকে বিকল্প দেওয়া। তার জন্য বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সবাইকে একজোট করে ব্যাপক একটা বিকল্প তৈরির চেষ্টা চলছে। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে কথা চলছে, ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গেও কথা হবে। বাম সহযোগী যারা, তারাও আমাদের সঙ্গেই আছে। কাজেই লড়াই ত্রিমুখী হতে বাধ্য।

প্রশ্ন: আপনারা বিকল্প নীতির কথা বলছেন। সরকার গঠন করতে পারলে রাজ্যে কোন বিকল্প রূপায়ণ করবেন? কীসে দেওয়া হবে অগ্রাধিকার?

সূর্য মিশ্র: আমাদের বিকল্পের প্রধান কথাই হলো বেকারদের কর্মসংস্থান। এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। সরকার ও আধা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সমস্ত শূন্যপদ এক বছরের মধ্যে পূরণ করতে হবে। কর্মসংস্থানের মূল তিনটি ক্ষেত্র কৃষি, শিল্প ও পরিষেবায় কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। চাষের খরচ কমিয়ে, কৃষকের কাছে ফসলের দাম বাড়িয়ে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে শ্রমদিবস বাড়িয়ে ও শহরে তা  সম্প্রসারিত করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। সমবায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও করোনার সময়ে সংগঠিত কমিউনিটি কিচেন, সবজি বাজার ইত্যাদি স্থানীয় উদ্যোগগুলিকে প্রসারিত করতে হবে। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গ অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে প্রথম ছিল। সেগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে অগ্রাধিকার বজায় রেখে বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সরকার কৃষক-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া ও অধিকার রক্ষার পক্ষে থাকবে। শিক্ষার সর্বস্তরে গণতন্ত্রীকরণ, ভর্তি ও ফল প্রকাশে স্বচ্ছতা ও নিয়মিত পরীক্ষা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা করবে। ৬ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত সকলের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। সমস্ত স্তরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্য পরিষেবা, রোগ প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা, সমস্ত স্তরে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা বাড়ানো ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার প্রসার বর্ধিত কাজের চাহিদার অর্ধেক পূরণ করতে পারে।

তাছাড়া সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার কোনও কেন্দ্রীয় সাহায্য ছাড়াই প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবারকে দু’টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এই ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট স্তরের স্থায়ীকাজ ও আয়ের নিচে বসবাসকারী সবার জন্য গণবণ্টন ব্যবস্থাকে প্রসারিত করতে হবে। এক কথায়, সকলের জন্য খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। সবরকম সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সরকার সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করবে। নারী ও শিশু বিকাশ, আদিবাসী-তফসিলি-সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বহুমুখী উদ্যোগগুলি যথেষ্ট ছিল না। উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল, সুন্দরবনে ও সমস্ত রকম আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিচারে রাজ্যের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে।

আমরা যে বিকল্পের কথা বলছি, তা বর্তমান বাস্তবতার উপরে দাঁড়িয়ে একটা বিকল্প ভাষ্যের নির্মাণ। এই ভাষ্য তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যেকার কটূক্তি ও অশালীন ভাষার সম্পূর্ণ বিপরীত। তৃণমূল এবং বিজেপি কী সর্বনাশ করেছে, তা আমরা মানুষকে নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু আসল কথা হলো, আমরা বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন কী করেছি, কেরালায় কী হচ্ছে, আরও কী কী এখানে করা যায়— এই ইতিবাচক বিষয়গুলিই মানুষকে বলতে হবে, এগুলিই আমাদের বিকল্প। আমরা সরকারে থাকি বা না থাকি, এই বিকল্পের জন্যই লড়াই করি— এটাই আমাদের কাছে মুখ্য। এই বিকল্প নিয়ে আমরাই শেষ কথা বলার অধিকারী নই। মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে এবং প্রয়োগে তা পরীক্ষিত হবে।

প্রশ্ন: গত দশ বছরে রাজ্যের ঋণভার যেভাবে বেড়েছে এবং শিল্পায়ন না হওয়ার ফলে রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহের সুযোগ যেভাবে কমেছে, তাতে অনেকেই রাজ্যের অর্থনৈতিক হাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নতুন সরকার গঠন করলে এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন কীভাবে?

মিশ্র: এটা বিকল্প রূপায়ণের জন্য সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়। জনগণের দুর্দশা কমানোর জন্য আমরা যে বিকল্পের কথা বলছি, তার জন্য অবশ্যই সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। জিএসটি থাকায় রাজ্যের সরকারের এখন সম্পদ সংগ্রহের সুযোগ কম, এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটা করা সম্ভব। কিন্তু রাজ্যের বেহাল অর্থনৈতিক দশা কাটানোর জন্য প্রথমেই বিজ্ঞাপনী প্রচার ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, যা বর্তমান সরকার করে চলেছে, তা বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির কারণে যে পরিমাণ অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে, তাও বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আমাদের স্থানীয় পরিষেবা ও উন্নয়নের জন্য স্থানীয় বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজ্য সরকার একটি নিগম গঠন করে জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সমবায় এবং পঞ্চায়েত ক্ষেত্রের ছোট উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে পারবে। এমন হলে স্থানীয় স্তরে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে। অতীতে আমরা ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে দেশের মধ্যে প্রথম ছিলাম এবং এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যা সঞ্চয় হতো, তা রাজ্যের ঘাড়ে ঋণ হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হতো। আমরা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সমবায় ব্যাঙ্ক ঋণের সঙ্গে যুক্ত করে মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলাম। এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির স্বনির্ভরতা চলে গিয়েছে। আমরা যদি রাজ্যের একটি ব্যাঙ্ক তৈরি করতে পারি, তাহলে রাজ্যের উন্নয়নে ব্যাঙ্কগুলির ঋণদানে যে অনীহা, ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও-তে রাজ্যের প্রতি যে বঞ্চনা, তার অনেকটা সুরাহা হতে পারে। এ ছাড়াও বিত্তশালীদের থেকে সম্পদ সংগ্রহের জন্য কিছু উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া প্রয়োগ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বামপন্থীরা বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে যে, রাজ্যে গত দশ বছরে সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুতর অবক্ষয় ঘটেছে। দুষ্কৃতী দাপটে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং নারীদের নিরাপত্তার অভাব তো আছেই। সেই সঙ্গে ধর্ম, জাত ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পরিচিতিবোধের কারণে সম্প্রীতি ও ঐক্যবোধ ধাক্কা খেয়েছে। এগুলিকে সামাল দিয়ে বাংলাকে তার মূল ঐতিহ্যের ধারায় আবার ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব হবে? 

মিশ্র: জ্যোতি বসুর সেই কথাটাই বারে বারে মনে পড়ে। উনি বলেছিলেন, ‘সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না’অর্থাৎ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই আসল কথা। সদিচ্ছা থাকলে এমনকী আইনেরও সবসময় প্রয়োজন হয় না। গত দশ বছরেও রাজ্যে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারের সদিচ্ছা নেই। রাজ্যের শাসক দল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ে এসেছে, বাড়তে দিয়েছে, মানুষের মধ্যে ধর্ম-জাতি-ভাষার ভিত্তিতে বহুমাত্রিক মেরুকরণ করেছে। এসবের ফলে বাংলার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির নিঃসন্দেহে ক্ষতি হয়েছে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম সেই জন্যই চালাতে হবে। সংস্কৃতি ও বৌদ্ধিক জগতের এব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বর্তমান সরকার শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের নিজস্ব স্বাধীন সত্ত্বাকে খর্ব করেছে, কিনে নেওয়ার মানসিকতায় দখলদারি করেছে। সংস্কৃতি জগতে সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে শিল্পীদের সরকার নির্ভর হয়ে থাকতে হবে না। এমনকী লোকশিল্পীরাও যেন স্বাধীন সত্ত্বা বজায় রেখে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রচার করতে পারেন এবং সেভাবেই জীবনযাপন করতে পারেন। তাঁকে সরকারি প্রচার তথা শাসক দলের প্রচারের জন্য জীবন ব্যয়িত করতে হবে না। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জন্য এরাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে দুষ্কৃতীযোগ ও দুষ্কৃতী নির্ভরতা নিঃসন্দেহে বড় কারণ। সেই কারণেই মহিলারা আক্রান্ত হলেও অপরাধীরা সাজা পায় না, শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ প্রশাসন তাদের ছোঁয় না। এই পরিস্থিতির বদল ঘটানোর জন্য আমরা পুলিশ প্রশাসন যাতে স্বাধীনভাবে আইন অনুসারে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করব। সদিচ্ছা থাকলে তা করা সম্ভব। বর্তমান সরকারের আমলে যে অফিসাররা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, তাঁরা অনেকেই বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন এবং বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে দিয়েছে। বামপন্থীদের কোনও লোক অন্যায় করলেও পার পায় না, এটা তখন অনেকবার দেখা গিয়েছে। দলদাসের পরিবর্তে প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ করাটাও বিকল্প।

প্রশ্ন: প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়েই তৃণমূল সরকার অনেকগুলি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে। সেই সব তদন্তে কিছুই যে প্রমাণিত হয়নি, তা আমরা জানি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়কালের দুর্নীতিগুলো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আপনাদের সরকার তৈরি হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে?

মিশ্র: তৃণমূল সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করতে বিরোধীদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে, জেলে পুরেছে, বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। বিজেপি সরকার সারা দেশে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতে যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, তার আগে থেকেই এরাজ্যের সরকারি ক্ষমতাকে যথাসম্ভব ব্যবহার করে তৃণমূল সরকার সেই কাজ করছে। সরকার পরিবর্তন হলে আমাদের প্রথমেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করতে হবে। ১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার আসার মতোই আমাদেরও মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেব, রাজনৈতিকভাবে বিরোধী বলে যাঁদের বন্দি করা হয়েছে, তাঁদের মুক্তি দেব। একদম পঞ্চায়েত ও পৌরসভা পর্যন্ত বিরোধীদের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি রুখতে হলে, সততা ফিরিয়ে আনতে হলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, প্রশাসনের সক্ষমতা ও সংবেদনশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা মনে করি, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, সংখ্যালঘু কমিশন, রাজ্যের নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি সব কমিশনগুলিকে তাদের স্বাধীনতা সহ সক্রিয় করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রশাসনিক শীর্ষস্তরে দুর্নীতি ঠেকাতে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন লোকায়ুক্ত তৈরি করা হয়েছিল, তারপরে তাকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। লোকায়ুক্তকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। তবে দুর্নীতি রুখতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের সক্রিয় নজরদারি। তার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে প্রকৃত অর্থে কার্যকরী করে জনগণের অংশগ্রহণকে বাস্তবায়িত করতে হবে। জনগণের চেয়ে ভালো নজরদারি কেউ করতে পারে না।

প্রশ্ন: আপনি যে বিকল্প রূপায়ণের কথা বলছেন এবং তার জন্য বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের শক্তিকে একত্রিত করছেন, নির্বাচনে তারা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে কী হবে? ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যদি বিধানসভায় ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি হয় তাহলে?

মিশ্র: আমাদের আশঙ্কা, তেমন পরিস্থিতি হলে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিজেপি এবং তৃণমূল প্রকাশ্যেই একজোট হয়ে বসবে। ওরা যতই পরস্পরের বিরুদ্ধে কটূক্তি করুক, পরস্পর বোঝাপড়া করেই চলে। প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি’র শাসন চেয়ে ডবল ইঞ্জিনের কথা বলে গিয়েছেন। আসলে ডবল ইঞ্জিন তো এখনই আছে, ওঁর লোকই তো রাজ্যে বসে থেকে সরকার চালাচ্ছে। যদি নির্বাচনের পরে বিকল্পকে ঠেকাতে ওরা প্রকাশ্যেই এক ইঞ্জিনে উঠে বসে, তবে সেটা রাজ্যের পক্ষে আরও বিপজ্জনক হবে। তাই তৃণমূল ও বিজেপি’কে এমন জায়গায় নামাতে হবে, যাতে কোনোভাবেই ওরা সরকার গঠন করতে না পারে। এই বাস্তবতা আছে এবং সেই জন্যই ব্যাপক মানুষের সমর্থনকে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে সমবেত করতে হবে।

=================

*তৃণমূল-বিজেপি’কে পরাস্ত করার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।

*তৃণমূল ও বিজেপি’কে এমন জায়গায় নামাতে হবে, যাতে কোনোভাবেই ওরা সরকার গঠন করতে না পারে।

*আমাদের বিকল্পের প্রধান কথাই হলো বেকারদের কর্মসংস্থান।

*অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে অগ্রাধিকার বজায় রেখে বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।

*সমস্ত স্তরে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা।

*গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।

*দলনিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করা।

=================

 

গণশক্তি, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 

 

 

শ্রেণি আক্রমণ মোকাবিলায় চাই শ্রেণি প্রত্যাঘাত

 

সীতারাম ইয়েচুরি

 

ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে শ্রেণি আগ্রাসন তীব্র করতে চাইছে বিজেপি। শোষিত শ্রেণিগুলি ও জনগণের বিভিন্ন অংশের পালটা শ্রেণি আক্রমণ দিয়েই তাকে চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলা করতে হবে।

=================

 কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কৃষক সংগঠনের নেতাদের ৩০ ডিসেম্বরের আলোচনাতেও অভূতপূর্ব কৃষক প্রতিবাদের মুখ্য বিষয়গুলির সমাধান হয়নি। কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে কেন্দ্রীয় সরকার সম্মত হয়নি। কিন্তু বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল পর্যালোচনা ও বায়ু দূষণ আইন থেকে কৃষকদের অব্যাহতি দেবার বিষয়ে আপাতত রাজি হয়েছে। ৪জানুয়ারি আরেক দফা আলোচনা হবে বলে ঠিক হয়েছে। 

কৃষি আইন প্রত্যাহারে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকারের টানা একগুঁয়েমির জন্য এই বিরাট শান্তিপূর্ণ কৃষক প্রতিবাদের অচলাবস্থা কাটছে না। 

সমস্ত দিক থেকেই দিল্লির সীমান্তে, দিল্লিমুখী জাতীয় সড়কে কৃষকদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাঁরা নজরকাড়া দৃঢ়তা, প্রত্যয় দেখিয়েছেন। দিল্লির সংলগ্ন রাজ্যগুলি ছাড়াও মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরাখণ্ডের মতো দূরের রাজ্যগুলি থেকেও কৃষকরা এসেছেন। দেশের অন্যান্য অংশে, প্রায় সব রাজ্যে, পাটনা থেকে রায়পুর, গুলবর্গা থেকে থাঞ্জাভুর কৃষকরা লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। 

এই কৃষক সংগ্রামের পাশে শ্রমিক শ্রেণি, ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় সংহতি জানিয়েছে। দেশের অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সমাজের অন্য অংশের মানুষ— মহিলা, ছাত্র, যুবকরা। 

এই প্রতিবাদ আন্দোলনের দাবিগুলি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিবোধ থাকলে যে কোনও সরকার তা গ্রহণ করে নেবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হচ্ছে এখন এই আইনগুলি প্রত্যাহার করে নিয়ে কৃষকদের, কৃষি সম্পর্কিত সমাজ, কর্পোরেট, সমস্ত অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করো, তার ভিত্তিতে নতুন আইন বানিয়ে সংসদে পদ্ধতি মেনে আলোচনা ও বিতর্ক করে তা চালু করো। এই পদক্ষেপ নিতেই প্রধানমন্ত্রী মোদী একগুঁয়ের মতো রাজি হচ্ছেন না। (বস্তুত এই রকম চাপ আসতে পেরে ভেবেই কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের শীতকালীন অধিবেশন বাতিল করে দিয়েছে, জবাব দেওয়ার ও দায়বদ্ধতার দায়িত্ব পরিহার করেই এই কাজ তারা করেছে।) 

অসত্য প্রচার 

প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে এই বিরাট ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলছে শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খলভাবে। তাকে বদনাম করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার বিষাক্ত অসত্য প্রচারে নেমেছে। প্রথমে তারা প্রতিবাদীদের খালিস্তানি, পাকিস্তানি, চীনের দালাল, শহুরে নকশাল, টুকরো টুকরে গ্যাঙ এইসব বলে চিহ্নিত করেছে। তারপর কুৎসা ছড়ানো হলো বিরোধী দলগুলি কৃষকদের বিপথে পরিচালিত করছে। বাস্তব সত্য হলো এই আন্দোলন পরিচালনা করছে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা, যা দেশব্যাপী ৫০০-র বেশি সংগঠনকে নিয়ে তৈরি, কোনও রাজনৈতিক দলেরই যোগাযোগ নেই। 

প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে এই জাতীয় প্রচারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করছেন বিরোধী দলগুলি নিজেদের নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে কৃষি সংস্কারের কথা বলে এখন বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করছেহ্যাঁ, সিপিআই(এম) সব সময়ে কৃষিতে সংস্কার দাবি করেছে। অন্য অনেক দলও করেছে। কিন্তু কী ধরনের সংস্কার? সিপিআই(এম) ভারতের খাদ্য নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করার জন্য, সমস্ত মানুষের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট শস্য উৎপাদনের লক্ষ্যে, কৃষকদের ফসলের লাভজনক মূল্য, ক্রেতাদের ন্যায়সঙ্গত দামে শস্য পাবার জন্য শক্তিশালী গণবণ্টন ব্যবস্থা চায়। চায় কৃষিক্ষেত্রের আরও উন্নতি। সেই লক্ষ্যে সিপিআই(এম) সংস্কার চায়। 

প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংস্কার যা এই কৃষি আইনগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে তা উলটো। ভারতের কৃষিকে, তার বাজার ও উৎপাদিত ফসলকে বহুজাতিক কৃষি বাণিজ্যের রাঘববোয়াল, দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবার জন্য এই সংস্কার। তা ভারতের খাদ্য নিরাপত্তার গুরুতর বিপর্যয় ডেকে আনবে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিপুল মজুতদারির অনুমোদন দেওয়ায় কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরি করে চড়া হারে মূল্য বৃদ্ধি ঘটানো হবে। গণবণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, সাধ্যের মধ্যে দামে খাদশস্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই আইনগুলিতে ভারতের কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হবে, জনগণের দুর্দশা আরও বাড়বে। এই কারণে অনেক বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দল এই বিলগুলির বিরোধিতা করেছিল, কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করছে, তাদের দাবি মেনে নিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। সরকারের কাছে দাবি, এমন সংস্কার করুন যা ভারতের জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের কাজে লাগে, দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের অতি মুনাফার লক্ষ্যে সংস্কারের পথে হাঁটবেন না। 

স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট কি রূপায়িত হচ্ছে? 

প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন তাঁর সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট রূপায়ণ করছে। সত্য হলো স্বামীনাথন কমিশন সি২+৫০ শতাংশ হারে এমএসপি নির্ধারণ করতে বলেছে। সরকার বড়জোর এ২+৫০ শতাংশ হারে এমএসপি নির্ধারণ করছে। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য তাৎপর্যপূর্ণ। এ২ প্রকৃত মিটিয়ে দেওয়া খরচ (অ্যাকচুয়াল পেইড আপ কস্ট)। সি২-র মধ্যে রয়েছে নিজের জমির খাজনার মূল্য, নিজস্ব মূলধনী সম্পদের ওপরে সুদ। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এমএসপি আদৌ দেওয়া হচ্ছে না, কমিশনের অন্য সুপারিশ তো উপেক্ষা করাই হচ্ছে। 

সিপিআই(এম)’র ২০১৯-র নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে ‘কৃষি সংস্কার’ সংক্রান্ত পরিচ্ছেদে প্রথমেই বলা রয়েছে সমস্ত কৃষককে এমএসপি-তে ফসল বিক্রির আইনি অধিকার দিতে হবে। ২০১৭ থেকে সিপিআই(এম) সাংসদরা বারবার এই দাবি সংসদে উত্থাপন করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এমন আইন আনেনি। বলা হয়েছিল, এমএসপি’র অধীনে সমস্ত কৃষিপণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সমস্ত কৃষককে তার পরিধিতে আনতে হবে। বর্তমানে মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক এর আওতায় পড়েন। তাছাড়াও কার্যকরী সংগ্রহের প্রক্রিয়া ছাড়া এমএসপি অর্থহীন। সরকারি বা বেসরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থা দেশজুড়ে সর্বজনীন করতে হবে। 

বিরোধী দলের রাজ্য সরকারগুলিকে আক্রমণ 

প্রধানমন্ত্রী মোদী সম্পূর্ণ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিরোধীদের রাজ্য সরকারগুলিকে বিশেষ করে কেরালার এলডিএফ সরকারকে আক্রমণ করে বলেছেন তারা কৃষকদের স্বার্থ দেখছে না অথচ কেন্দ্রীয় আইনের বিরোধিতা করছে। কেরালা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাভাষণকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছে সারা ভারত কৃষকসভা। কেরালায় ধান, তরিতরকারি, ডাল, কলা ইত্যাদিতে হেক্টরপ্রতি ভালোই ভরতুকি দেওয়া হয়। কেরালার কর্ষিত জমির ৮২শতাংশে অর্থকরী ফসল উৎপাদন হয় যার দাম পণ্য বোর্ড নিশ্চিত করে দেয়, রাজ্য সরকারের অধীনে নিলামের ব্যবস্থা রয়েছে। 

নজর ঘোরাতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ 

বিপুল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে বিজেপি তাদের রাজ্য সরকারগুলির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করতে উঠেপড়ে লেগেছে। উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে জারি করা হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’ আইন, ‘গোরক্ষা আইন’ জারি করা হয়েছে। এইসবকে ব্যবহার করা হচ্ছে হেনস্তা, হয়রানি, ও সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ তৈরির জন্য। মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনী, ইন্দোর, অন্যান্য জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে। এর বিপর্যয়কর অস্থিরতার প্রভাব পড়বে দেশে। 

নয়া উদারনীতির আগ্রাসী অভিযান 

বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে। নয়া উদারনীতির পথে সংস্কার যে এই সঙ্কটের কোনোই সমাধান করতে পারে না, সম্পূর্ণ দেউলিয়া তা উন্মোচিত হয়েছে। ধনতন্ত্রে লুটেরা প্রবৃত্তির মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য তাই কাড়াকাড়ি তীব্রতর হয়েছে। বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে বৃহত্তর সুযোগ করে দিতে নয়া উদারনীতির সংস্কার আগ্রাসী ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য দরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন নতুন এলাকা ও নতুন বাজার দখল করা। এই লক্ষ্যেই দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কৃষিকে তুলে দেবার চেষ্টায় নতুন আইনগুলি আনা হয়েছে।

ভারতের শাসক শ্রেণিগুলির শক্তিবৃদ্ধির মুখ্য এজেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকার, তাদের শ্রেণি স্বার্থ রক্ষায় সংস্কার রূপায়ণের কাজ করছে তারা। 

শ্রেণি প্রভাব 

বিশ্ব সঙ্কট ছাড়াও ভারতের অর্থনীতি নোটবাতিল ও পণ্য পরিষেবা কর রূপায়ণের পদ্ধতিতে ভারতের অর্থনীতি দুর্বিপাকে পড়েছে। গত কয়েক বছরে লাগাতার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার অধোগতিতে পড়েছে। অর্থনীতিতে মন্দা, কোভিড মহামারীর প্রভাব, অপরিকল্পিত হঠাৎ লকডাউনের প্রেক্ষিতে ভারতের শাসক শ্রেণিগুলি নিজেদের মুনাফা বজায় রাখতে, সর্বোচ্চ করতে আরও রাস্তা খুঁজছে। 

বৃহৎ বুর্জোয়ার নেতৃত্বে বুর্জোয়া-ভূস্বামী শাসক শ্রেণিগুলি নয়া উদারনীতির পথে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের প্রয়াস চালিয়ে গেছে। জাতীয় সম্পদের লুট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিপুল আকারে বেসরকারিকরণ, খনির মত জনগণের সম্পত্তি এবং জনপরিষেবা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবেই শ্রমিকদের অধিকার রদ করা হচ্ছে। 

কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভারতের শাসক শ্রেণিগুলির নেতৃত্বের মুনাফা সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে কৃষিতে কর্পোরেট দখলদারির ঘটনাকে স্পষ্ট ভাবে সামনে এনে দিয়েছে। 

এক নতুন শ্রেণি দ্বন্দ্ব সামনে আসছে। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় বৃহৎ বুর্জোয়া বনাম ধনী কৃষক ও জোতদার-সহ সমগ্র কৃষকের দ্বন্দ্ব। 

দ্বিতীয়ত, শাসক শ্রেণির শরিকদের মধ্যে সংঘাতও দেখা যাচ্ছে। একদিকে বৃহৎ বুর্জোয়া, অন্যদিকে অ-বৃহৎ বুর্জোয়া, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যে দ্বন্দ্ব। 

তৃতীয়ত, বিজেপি দেশে পূর্ণ রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করছে, তার বদলে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। রাজ্য সরকার পরিচালনা করে এমন কিছু আঞ্চলিক দল সংসদে বিজেপি-কে সমর্থন করত, কিছু দোদুল্যমান ছিল এবং মূলত বিজেপি-কে সমর্থনের উদ্দেশ্যে সংসদে নিরপেক্ষ থাকত। তারাও বিশেষ করে এই কৃষক সংগ্রামের সময়ে বিজেপি’র এই আধিপত্যকামী অভিযানের ফলে বিরোধিতায় বাধ্য হচ্ছে। 

শাসক শ্রেণিগুলির শরিকদের মধ্যে এই ধরনের সংঘাত কিছু সম্ভাবনা তৈরি করে যা শোষিত শ্রেণিগুলিকে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি, গরিব কৃষক, খেতমজুরদের বুর্জোয়া-ভূস্বামী শ্রেণি কাঠামোর বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র করার লক্ষ্যে এই সম্ভাবনাকে ব্যবহার করতে হবে। 

শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৃষক ও খেতমজুরদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি পেতে থাকায়। অনেক আগেই এই কাজ শুরু হয়েছিল, ২০১৮ থেকে এইসব অংশের যৌথ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ২৬ নভেম্বর সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, তা কৃষক সংগঠনগুলির ২৬-২৭ নভেম্বর দিল্লি চলো অভিযানের সঙ্গে মিশে গেছে। আগামী দিনগুলিতে সংগ্রামের এই ক্রমবর্ধমান ঐক্য নিশ্চয়ই আরও মজবুত হবে। 

একই সঙ্গে শাসক শ্রেণিগুলি শ্রেণি আক্রমণ তীব্রতর করছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্রতর করছে, ভারতীয় সংবিধানকে খর্ব করছে। এর ফলে বর্তমান বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম বৃদ্ধি পাওয়ার জমি তৈরি হচ্ছে। আগামী দিনগুলিতে একদিকে যৌথ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অন্যদিকে মহিলা, ছাত্র, যুব, দলিত, আদিবাসীদের মতো জনগণের বিভিন্ন অংশের নিজস্ব দাবিদাওয়ার আন্দোলন তীব্রতর হতে বাধ্য। এই আন্দোলনগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে শ্রেণি আগ্রাসন তীব্র করতে চাইছে বিজেপি। শোষিত শ্রেণিগুলি ও জনগণের বিভিন্ন অংশের পালটা শ্রেণি আক্রমণ দিয়েই তাকে চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলা করতে হবে।

=================

গণশক্তি, ১জানুয়ারি, ২০২১