20200620

বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার



প্রকাশ কারাত

কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের ২১শে জুন যখন বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল, তখন কেউই ভাবতে পারেননি যে, ঐ সরকার ইতিহাস রচনা করবে। সে সময় যদি তখন কেউ ভবিষ্যৎবাণী করতেন যে বামফ্রন্ট আগামী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করবে তা হলে কেউ তা বিশ্বাস করতো না। বামফ্রন্ট সরকার সেটাই করে দেখিয়েছে। তারা পশ্চিমবঙ্গে একাদিক্রমে ৩৪ বছর সরকার পরিচালনা করেছে। প্রশংসনীয় ও অনন্য রেকর্ড, সন্দেহ নেই। বামপন্থীদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, অনেক অত্যাচার সহ্য করার মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পুলিস ও প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে রিগিং করে জয়লাভ করে। সেবার নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করেছিল। ঐ সময়কালে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলির ১৪০০ জন সদস্য ও সমর্থককে খুন করা হয়। গোটা দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার। সে সময় গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে অবদমিত করে রাখা হয়েছিল।

জমির জন্য কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন এবং মেহনতী মানুষের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের জোয়ারের ফলে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি তৎকালীন সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি সরকারের প্রচণ্ড দমনপীড়নের শিকার হয়েছিল। সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়। এর কারণ হলো জনগণ ঘৃণিত কংগ্রেস সরকার‍‌কে দূরে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং সর্বান্তকরণে ভোট দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের কর্মসূচী ও নীতিগুলির সমর্থনে।

এই বিপুল জনসমর্থনের ফলেই বামফ্রন্ট একাদিক্রমে ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার সাতবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। প্রতি বারেই তারা বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছে। জনগণের সমর্থনের এটি এক উল্লেখযোগ্য নজির। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রূপায়িত ভূমিসংস্কারের ফলে লক্ষ লক্ষ কৃষক ও বর্গাদার উপকৃত হয়েছেননির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, যা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের গরিব মানুষ এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছেন। শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতী জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করা গিয়েছিল।

এসবের ফলে মেহনতী মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয় নতুন মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার এবং স্বাধীন ভারতে পুঁজিবাদী উন্নয়নের অসম প্রকৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব ভারত অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার শিকার হয়। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরতার বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সরকার গোড়া থেকেই লড়াই শুরু করে। ধর্মনিরপেক্ষতার নির্যাস ও মর্মবস্তু কি হতে পারে তা বামফ্রন্ট সরকার হাতে কলমে করে দেখিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দুর্গ হয়ে দাঁড়ায়। বৃহৎ বুর্জোয়া এবং সামন্তপ্রভুদের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থার আওতায় একটি রাজ্য সরকার চালাতে হয় গুরুতর ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে। রাজ্য সরকারের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ধরনের সাফল্যের নজির গড়েছে।

তাছাড়া বামফ্রন্ট সরকারকে সবসময় অভ্যন্তরীণ ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সা‍‌লে পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ থেকে বোঝা যায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য কতদূর পর্যন্ত চক্রান্ত এঁটেছিল। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বামফ্রন্ট সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারগুলির বৈরিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার যে টিকে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিল তার জন্য মূল ভূমিকা ছিল পশ্চিমবঙ্গে জনগণের অবিচলিত সমর্থন এবং দেশের বাকি অংশে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ও বৃদ্ধি। যে গণতান্ত্রিক চেতনা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে অগণতান্ত্রিক পথে উৎখাত করার কোনো চক্রান্ত বরদাস্ত করতো না।

২০১১ সালের মে মাসের নির্বাচনে পরাজয়ের পর গত ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যগুলিকে নস্যাৎ করার জন্য একটি সমন্বিত অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের কৃতিত্ব নির্বাচনী পরাজয়কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হচ্ছে এইভাবে যেন জনগণ বামফ্রন্ট সরকারের সমস্ত কৃতিত্বকে খারিজ করে দিয়েছেন। এসব হলো বামপন্থীদের যারা বিরোধী তাদের উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণ। তাছাড়া মতাদর্শগত আক্রমণও চালানো হচ্ছে। বামফ্রন্টের শাসনকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো বামফ্রন্ট আমলে জনগণ যেসব অধিকার ও সুফল অর্জন করেছেন সেগুলিকে উলটে দেওয়া। অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুরানো আধিপত্যশীল শ্রেণীগুলি আবার নতুন করে জোর খাটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলি অনুসরণ করছে। পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তার আড়ালে এমনসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে যা মানুষের জীবন-জীবিকার উপরে আঘাত হানবে এবং তাদের অধিকারগুলিকে দুর্বল করে তুলবে।

সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের উপর যে মারাত্মক ধরনের আক্রমণ চালানো হচ্ছে তা থেকে বোঝা যায় আগামীদিনে কী ঘটতে চলেছে। তৃণমূল কংগ্রেস - কংগ্রেস যে শ্রেণী শক্তিগুলির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের খুন করছে, তাদের আক্রমণে অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন, নিয়মিত হুমকি দেওয়া হচ্ছেওরা সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের সাংগঠনিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে দিতে চাইছেকারণ তারা জানে এই সাংগঠনিক কাঠামোর উপরে ভরসা করে পশ্চিমবঙ্গের মেহনতী মানুষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং তাদের অধিকারকে সগর্বে তুলে ধরেন।

মেহনতী মানুষ অর্থাৎ কৃষক, বর্গাদার খেতমজুর, শ্রমিকশ্রেণী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে সুফল অর্জন করেছেন তা রক্ষা করতে হবে। শাসক শ্রেণীগুলির পক্ষে ভূমিসংস্কার এবং অন্যান্য সুফলগুলিকে আবার আগের পশ্চাদপদ জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না। কেরালার পুরানো অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। নিজেদের অধিকার ও জীবন-জীবিকা রক্ষা করা, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি রক্ষা করা এবং জনবিরোধী নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী ও মেহনতী জনগণের অন্যান্য অংশগুলির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ইতিহাসে গড়ে উঠবে এক নতুন অধ্যায়।

শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত করা, শ্রেণীসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সবসময়ই ভরসা দেওয়ার শক্তিশালী কাঠামো হিসাবে কাজ করবে। যারা বামফ্রন্টকে মুছে দিয়ে শোকগাথা লিখে ফেলেছেন ইতিহাস তাঁদের একদিন ভ্রান্তদর্শী বলে প্রমাণ করবে।

গণশক্তি, ২১শে জুন, ২০১১