20180701

আক্রমণ বহুমুখী গণপ্রতিরোধই একমাত্র বিকল্প


সূর্য মিশ্র

আজকের দিনে বামপন্থীদের রাজনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বুঝতে হলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আগে ভালো করে বুঝে নিতে হবে। একটা অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি।  একথা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতেই সত্য নয়, সারা দেশে এবং সারা দুনিয়ার পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের দেশের শুধু বামপন্থীদের কাছেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সমস্ত শক্তির কাছেই এত বড় চ্যালেঞ্জ আগে কখনো আসেনি। সারা দুনিয়াতেও যারা বামপন্থার জন্য লড়ছেন, গণতন্ত্র প্রসারের জন্য লড়ছেন তাঁরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখেননি। পরিস্থিতির এই জটিলতা এবং তা কতো কঠিন তা গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতেই হবে। তা না হলে আমরা কীসের বিরুদ্ধে লড়ছি, বেড়ালের সঙ্গে নাকি হায়নার সঙ্গে লড়ছি তা না বুঝে লড়াইয়ের জন্য নিজেদের ঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারবো না। বাস্তবকে ঠিকমতো বুঝে না নিলে প্রত্যাশার সঙ্গে মিলবে না, হতাশা গ্রাস করবে।
*********
অতীতে আমরা বহু আক্রমণ সন্ত্রাস দেখেছি, এরাজ্যেও দেখেছি, সারা দেশেও দেখেছি। জরুরি অবস্থা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস দেখেছি এবং আরও অনেক অত্যাচার দেখেছি। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা সেসবের থেকেও অনেক বড় আক্রমণ। অনেক ব্যাপকতর এবং তীব্র। সাতের দশকে সন্ত্রাস রাজ্যের সব জেলায় ছিল না, কয়েকটি জেলায় সীমিত ছিল। এখন তা সারা রাজ্যে ব্যাপ্ত। রাজ্যের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত, নাগরিক অধিকার আক্রান্ত। পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা সারা রাজ্যেই সন্ত্রাস দেখেছি। ব্যাপকতম এলাকাজুড়ে নজিরবিহীন সন্ত্রাস চলেছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় ব্লক অফিস, মহকুমাশাসকের অফিস এমনকি জেলাশাসকের অফিসগুলিও শাসকদলের সমাজবিরোধীরা পুলিশ প্রশাসনের প্রশ্রয়ে দখল নিয়েছে। মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, তারপরে প্রত্যাহারের জন্য কেবল প্রার্থী নয় শিশু মহিলা সহ তাঁদের পরিবার পরিজনদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, ভোটের দিনে ভোট লুট করতে এবং সবশেষে ভোট গণনার দিনে গণনাকেন্দ্রেও ছাপ্পা ও আক্রমণ হয়েছে। যত ভোট পড়েছে তার চেয়ে বেশি ভোট গণনা হয়েছে, জয়ী প্রার্থীকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার পরেও ফের গণনার নামে শাসকদলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এমন আক্রমণ সন্ত্রাসের কোনও নজির আমাদের রাজ্যে তো বটেই সারা দেশের কোথাও নেই।
*********
ব্যাপক এবং তীব্র হলেও সন্ত্রাসই কিন্তু বর্তমান সময়ের একমাত্র বিষয় নয়। এমনকি মুখ্য বিষয়ও নয়। দৈহিক আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেয়ে মনোজগতে আক্রমণ মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। মিথ্যার মোহজালে যুক্তিবাদ বাঁধা পড়লে যুক্তিহীন মেরুকরণ ও বিভাজনের রাজনীতির উত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। বোধবুদ্ধিহীন উন্মাদনায় মেহনতি মানুষের ঐক্যকে ভেঙে ভ্রাতৃঘাতী বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করতে পারলে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসের প্রয়োজন হয় না। সাতের দশক এবং অতীতের থেকে বর্তমান পরিস্থিতি আলাদা হওয়ার অন্যতম কারণ এখন বহুমাত্রিক মেরুকরণের রাজনীতি চলছে। সারা দেশের সঙ্গে আমাদের রাজ্যেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা হচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার করে। ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও সম্পর্ক নেই, পৃথিবীর কোনও ধর্মে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কথা বলা নেই। তবুও ধর্মকে বাহন করেই সাম্প্রদায়িকতা আক্রমণ হানে। সম্প্রতি কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছে কেন্দ্রের বি জে পি সরকার। কাশ্মীরের মানুষের বিরুদ্ধে তারা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে যে কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা হবে। কেন্দ্রে বি জে পি সরকার আসার পরে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের চার বছরের সময়কালে এরাজ্যে আর এস এস-এর শাখার সংখ্যা ১১গুণ বেড়েছে। এছাড়াও তাদের অজস্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নামে বেনামে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। খোলা চোখে এদের দেখা না গেলেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজ তারা করে চলেছে। আর তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় নেমেছে। কে বেশি রামভক্ত তা দেখাতে রামনবমীর প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে বেশি হনুমানভক্ত তার প্রতিযোগিতায় হনুমানজয়ন্তী পালন হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।


শুধু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ নয়, এখন বহুমাত্রিক মেরুকরণ করা হচ্ছে মানুষের নানা সত্তাকে ঘিরে। ভাষা নিয়ে কীভাবে মেরুকরণ ঘটানো যায় তা আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই দেখিয়েছেন পাহাড়ে। সেখানে তিনিই প্রথম আগুন জ্বালান বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করে চাপিয়ে দিয়ে। একইভাবে উত্তরবঙ্গে কামতাপুরী এবং রাজবংশী ভাষার স্বীকৃতির নামে উসকানি চলছে। একটাই ভাষা কিংবা উপভাষা কিন্তু সেটাকে দুটি নামে দাবি করা হচ্ছে, আর মুখ্যমন্ত্রী তাতেই প্ররোচনা দিয়ে দুটি নামেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন। আদিবাসীদের মধ্যে আর এস এস খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এমনকি আদিবাসীদের ভিতরের গোষ্ঠীগুলির ফারাক তুলে এনে তারা ভেদাভেদ চাগিয়ে তুলছে। সব অংশের আদিবাসীরাই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছে, কিন্তু আর এস এস সাঁওতালদের সঙ্গে মুণ্ডাদের প্রভেদ করছে। হুল তথা সাঁওতাল বিদ্রোহের সঙ্গে উলগুলান তথা মুণ্ডা বিদ্রোহের ফারাক নিয়ে রাজনীতি করছে। এক অংশের বিরুদ্ধে আরেক অংশকে লাগানোর এই কৌশল তারা উত্তর প্রদেশে দলিত এবং ও বি সি-দের নিয়েও করেছে। এরাজ্যের আসানসোলে হিন্দিভাষীদের ও বাংলাভাষীদের মধ্যে বিরোধ বাধানো হচ্ছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটানো হচ্ছে। ‘এখন তৃণমূলকে হটানোর মুরোদ বামপন্থীদের নেই, অতএব বি জে পি-কে লাগবে।’ এই প্রচারের মাধ্যমে বলা হচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যারা লড়তে চাও মতাদর্শ ছেড়ে সবাই একজোট হয়ে যাও। এর বিপরীতে তৃণমূলই বাংলায় বি জে পি-কে ঠেকাতে পারবে এইরূপ আরেকটি মিথ্যার মোহজাল নির্মাণ করা সহজ।
এই সমস্ত ঘটনা ঘটছে এমন একটা সময়ে যখন সারা বিশ্ব ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পায়নি। দশবছর ধরে চলতে থাকা এই মন্দার সঙ্গে প্রায় নব্বই বছর আগের মহামন্দার তুলনা করা চলে যার প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। এখনও মন্দার কারণে ক্রেতা নেই, শিল্পোৎপাদন প্রায় স্তব্ধ। সারা দুনিয়ায় অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা, বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন, ইংল্যান্ড ব্রেক্সিটের পথে চলে যাচ্ছে। জি সেভেনের বৈঠকে বাজার দখলে রাখতে কর বসানো নিয়ে বিরোধ চরমে উঠেছে। ৮০বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের ইতিহাসকে এই পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমরা এখনই একথা বলতে পারি না যে আবার একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে যে বোঝাপড়াটা ছিল সেটা আর আগের মতো নেই, তাতে গুরুতর ফাটল দেখা দিয়েছে।
আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদীর আমলে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে। কাজ নেই, শিল্পে, কৃষিতে সংকট চলছে, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে, রেগায় কাজ কমছে, শ্রমিকের মজুরি কমছে, কাজের কোনও নিরাপত্তা নেই। মোদী সরকার আসার আগে দেশের ১শতাংশ ধনীদের হাতে দেশের ৪৯শতাংশ সম্পদ ছিল। এখন তা ৭৩শতাংশ হয়ে গেছে। সম্পদের দ্রুত কেন্দ্রীভবন ঘটছে। নীরব মোদী, বিজয় মালিয়ারা ব্যাঙ্কের ১১হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। অমিত শাহের ছেলের সম্পত্তি ১৬হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরাজ্যে ভাইপোর সম্পত্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে চোখ ধাঁধিয়ে। সারদা নারদ কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোল নেই। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। গণবিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলেই নানা ধরনের মেরুকরণের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ করার দরকার হয়ে পড়েছে শাসকদের। এভাবেই উগ্র দক্ষিণপন্থা সহ নানা ধরনের ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটে।
মানুষের জীবনের দুর্দশা এবং তাঁদের ক্ষোভই এই সময়ের সত্য, কিন্তু সেই সত্যকে চাপা দিতে মিথ্যার প্রচার চলছে। মনোজগতের ওপরে আক্রমণের এই প্রক্রিয়ার জন্য এটাকে পোস্ট ট্রুথ বা ‘উত্তর-সত্য’ বলা হচ্ছে। মিথ্যাকে বার বার বলো, বেশি বেশি করে বলো, বড় বড় মিথ্যা বলো, তাহলে মানুষ সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করবে এবং যে বলছে সে নিজেও একসময়ে সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করা শুরু করবে। গোয়েবলসের এই তত্ত্বকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী অনুসরণ করে চলেছেন। মিথ্যার নির্মাণ করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে। তারা ক্রমাগত বি জে পি এবং তৃণমূলের মধ্যে লড়াইকে দেখিয়ে চলেছে, আর প্রচার করছে বামপন্থীরা মুছে গেছে। তৃণমূল এবং বি জে পি-র মধ্যে মেরুকরণের মিথ্যা নির্মাণের জন্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বামপন্থী পরিচয় দিয়ে সঙ্ঘীরাই বলছে ‘আমি আর এস এস তথা কেন্দ্রের সরকারের ঐ বি জে পি নই, আমি বামপন্থীই আছি। কিন্তু এখন বি জে পি-র পথে হেঁটে তৃণমূলকে হটাতে হবে, তারপরে আবার আমরা বামপন্থী হয়ে বি জে পি-কে হটাবো।’ বলা বাহুল্য এটা আরেকটা বৃহদাকার মিথ্যা। উলটোদিকে আরেকপক্ষ একইসময়ে বি জে পি-র হাত থেকে বাঁচানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যদের তৃণমূলের পাশে জড়ো করছে। এভাবে মিথ্যায় অন্ধ করে দিয়ে উন্মত্ত দাঙ্গায় শামিল করা যায়, কিন্তু রাজনৈতিক লড়াই করা যায় না। শুধু বাহুবলে তৃণমূলকে হারানো যাবে না, বি জে পি-কেও হটানো যাবে না। তার জন্য চাই যুক্তি-মতাদর্শ, মনোবল এবং জনবল। সেগুলি বর্জন করে আমরা বামপন্থীরা কোনও মিথ্যার উন্মত্ততার স্রোতে ভেসে যেতে পারি না।
**********

কিন্তু এতকিছুর পরেও এখনও পর্যন্ত আমরা এরাজ্যের মানুষকে কেন এই সত্য বোঝাতে পারছি না? মানুষকে সঙ্গে না নিয়ে আমরা কোনও পরিবর্তনই করতে পারবো না, তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে। জনগণের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে তাঁদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে মুক্তো তুলে আনার মতো করে তাঁদের মনের কথা তুলে আনতে হবে। এইখানেই জনগণের মধ্যে পার্টির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। পার্টির রাজনৈতিক স্লোগান যতক্ষণ না জনগণ গ্রহণ করছে ততক্ষণ পার্টি জনগণকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারে না। আমরা গত চার বছর ধরে ‘তৃণমূল হটাও-বাংলা বাঁচাও, বি জে পি হটাও- দেশ বাঁচাও’ এই স্লোগান দিয়ে চলেছি। কিন্তু জনগণ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় শেখে। আমরা যদি বারবার সত্য কথাটা বলে যাই তাহলে একদিন জনগণ সত্যটাই বুঝবে এবং তাঁরাই বলবেন যে বামপন্থীরাই তো বরাবর সত্যিটা বলে এসেছেন। আমরা মার্কসবাদীরা প্রকৃত সত্যের ওপরে নির্ভর করেই চলি, মার্কসের ভাষায় ‘ভ্রান্ত চেতনা’র ওপরে নির্ভর করে নয়। মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ তা সত্য। কিন্তু মানুষ অনেক সময়েই প্রকৃত সত্যকে সাময়িকভাবে বুঝতে পারেন না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্য বড় নাকি চাঁদ বড় তা বোঝা যায় না। আপাতভাবে ছোট ছোট তারাদের দেখে বোঝাও যায় না সেগুলি গ্রহগুলির থেকে তো বটেই এমনকি সূর্যের থেকেও বহুগুণ বড়। পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে সেই সত্য বলার জন্য গ্যালিলিও থেকে ব্রুনো কতজনকে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো তা সবাই জানি। কাজেই সত্য বলার জন্য বিশেষ জ্ঞান ও দৃষ্টি লাগে এবং সত্য বলার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আমাদের পার্টিকেও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অর্জনের জন্য মতাদর্শকে আয়ত্ত করে তার সঠিক অনুশীলন করতে হবে। শাসকের মোহজালে মানুষ আবিষ্ট হয়ে থাকলে সঠিক পথ খুঁজে পাবে না, কেবল উদভ্রান্তের মতো এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়িয়ে হোঁচট খাবে। তাই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে, যা যা রাজনৈতিক অস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করতে হয় তাই করতে হবে। পরিস্থিতি কঠিন বলে হতাশার কোনও জায়গা নেই, বরং এই কঠিন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকেই আজকের দিনের প্রয়োজনীয় শিক্ষাকে শিখে নিতে হবে। লড়াই যদি কঠিন না হয় তাহলে সেই লড়াই করায় কৃতিত্ব কীসের!
শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বে হবে না, সাংগঠনিক নেতৃত্বও চাই। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বকে সমান তালে এগতে হবে। শুধু তত্ত্বজ্ঞানে চলবে না, তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে হবে লড়াইয়ের ময়দানে। কার্ল মার্কস তো শুধু দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার কথা বলেননি, তিনি দুনিয়াকে বদলানোর কথা বলেছিলেন। তাই মানুষের আদায়যোগ্য দাবিকে তুলে ধরে লড়াই করতে হবে, রেশন কার্ড, একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরিসহ আদায়যোগ্য সব দাবিকে আদায় করে ছাড়তে হবে। তার জন্য পার্টির শাখাগুলিকে সক্রিয় করতে হবে। সংগ্রাম ছাড়া সংগঠন থাকে না, সংগ্রামের পথেই সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। কেন এখনও সব জায়গায় বুথ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে পারবো না? শাখার দুর্বলতার দায় কেবল শাখায় চাপিয়ে দিলে চলবে না, শাখাকে সক্রিয় করার দায়িত্ব উপরের কমিটিকে নিতে হবে। আমাদের পুরানো নেতারা বলতেন, গোরুর গাড়ির চাকা কাদায় আটকে গেলে গোরুকে শুধু খোঁচা মারলে হয় না। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে কাঁধ লাগিয়ে চাকাকে ঠেলে দিতে হয়। এই কাজ উপরের কমিটির নেতাদের করতে হবে। এরজন্যই তো আমরা সংগঠনকে পুনর্গঠিত করে এরিয়া কমিটি গঠন করেছি। কমিটিগুলিতে বয়সের গড় কমানো হয়েছে। পুনর্গঠনের কাজ অত্যন্ত দ্রুততায় করতে আমরা কিছুটা এগিয়েছি। বাকি কাজও দ্রুত করতে হবে, নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই।
*********

কঠিন পরিস্থিতির উল্লেখ দিয়ে এই নিবন্ধের শুরু। শেষ হবে এই পরিস্থিতির মধ্যেই থাকা চমৎকার উপাদানগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতি কবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটতে ঘটতে মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে, গণবিক্ষোভের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং তা দমন করতে শাসকের আক্রমণ তীব্র হওয়ায় প্রতিরোধও তীব্র হচ্ছে। আমরা যদি বিপ্লবী হই তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে সুযোগগুলিকে দেখতে পাবো না? সন্ত্রাস আক্রমণের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও রুপালি রেখা হলো জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের ঘটনাগুলি। ঘন কালো মেঘের গর্জনের পিছনে সেই রুপালি রেখাকে অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে আটশোর বেশি এলাকায় আমাদের কমরেডরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধে ছিলেন, রক্ত ঝরেছে, আমাদের অন্তত দশজন কমরেডের প্রাণ গিয়েছে তবু কেউ লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাননি। গত সাত বছরে এমনটা এই প্রথম। শহীদের তালিকায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে গরিব আদিবাসী, তফসিলি জাতির মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের নামই বেশি। গরিব বলেই এই মানুষজন লড়াইয়ের সামনের সারিতে রয়েছেন। মিথ্যার নির্মাণ সত্ত্বেও মিথ্যার মোহজাল ভেঙে মানুষের প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে। লড়াইয়ের ময়দানে থাকা এই মানুষদের আমাদের পার্টিতে নিয়ে আসতে হবে। আর যারা পার্টিতে থেকেও লড়াইয়ের ময়দানে নেই, তাঁরা পার্টিতে কেন আছেন সেই প্রশ্ন করতে হবে। আমরা কমিউনিস্টরাই নিজেদের বুকচিরে আত্মপর্যালোচনা করে এগতে পারি। জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সম্ভাবনাময় নতুন দিগন্তের সন্ধানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন এই চার অস্ত্রে নিজেদের সাজিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে। হতাশার কোনও জায়গা নেই কমিউনিস্টদের কাছে। আক্রমণ বহুমুখী, তাই গণপ্রতিরোধই একমাত্র বিকল্প।
***********
গণশক্তি, ১লা জুলাই, ২০১৮