20200827

করোনার সংক্রমণ ও আর্থিক অধোগতি রোধ: বামপন্থী বিকল্প পথ

 

বামপন্থী বিকল্প পথ ব্যাখ্যা করছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি

ড. অসীম দাশগুপ্ত

করোনা অতিমারী এবং আর্থিক অধোগতি— এই দুই কঠিন সমস্যার মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একই সঙ্গে, আমরা লক্ষ্য করছি, করোনা রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সামগ্রিক নীতি কি হওয়া উচিত— স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদীতে— তার ওপর সংক্ষেপে এই আলোচনা। 

আর্থিক অধোগতি 

দেশের আর্থিক অধোগতি করোনার আক্রমণের আগেই শুরু হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল তথাকথিত আর্থিক উদারনীতি, যে নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির কারণেই, বারংবার দেশের অর্থনীতিকে ছেড়ে দিতে চেয়েছে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার ওপরে এবং খর্ব করতে চেয়েছে সরকারের সামাজিক কল্যাণকর ভূমিকা। এই নীতি অনুসরণ করেই, ভুল পথে গিয়ে, প্রস্তুতিহীন ভাবে বিমুদ্রাকরণ ঘোষণা করা হয়, এবং তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবা— সর্বক্ষেত্রেই।

কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতি অর্থবর্ষে তিন মাস ধরে ধরে যে তথ্যাবলী প্রকাশিত হয়, তার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে যে, গত অর্থবর্ষের (২০১৯-২০) প্রতি তিন মাসেই দেশের মোট উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে এবং সর্বশেষ ত্রৈমাসিকে এই বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে হয় ৫ শতাংশ, যা বিগত ছ’বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই অধোগতির অঙ্গ হিসাবে উৎপাদনের পরিমাণও হ্রাস পায়— শিল্পের ক্ষেত্রে, কৃষিতে এবং পরিষেবার (যথা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে ঋণ প্রদান ইত্যাদি) ক্ষেত্রেও। উৎপাদন ও পরিষেবার এই সামগ্রিক অধোগতির কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ, এবং ফলে হ্রাস পায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এই ক্রয়ক্ষমতার হ্রাসই আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত রিপোর্টে (২০১৯-২০)। এর মুখে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, পুনরায় তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, সাধারণ মানুষের এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উপেক্ষা করে নজর দেয় ধনী শিল্পপতিদের সুবিধা দিতে কর্পোরেট করের হার ইত্যাদি লাঘব করতে, যাতে শিল্পপতিরা উৎসাহিত হয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ, যেখানে মূল সমস্যা ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাজারে মোট চাহিদারই অভাব, সেই চাহিদার বৃদ্ধির পথে না গিয়ে, কেবল জোগান বৃদ্ধির পথে গিয়ে সমস্যা সমাধানের উলটো দিকেই যাওয়া হয়। ফলে, সামগ্রিক আর্থিক অধোগতি রোধ করাও সম্ভব হয় না। 

করোনা অতিমারীর আঘাত 

এই আর্থিক অধোগতির মধ্যেই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় গত অর্থবর্ষের শেষের দিকে। চীন দেশের উহান প্রদেশে এই রোগ শুরু হলেও (এবং চীন এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হলেও) ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সরকার বিষয়টিকে শুরু থেকেই গুরুত্ব না দেওয়ায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয় এবং করোনা অতিমারীর আকার ধারণ করে গোটা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে করোনা আক্রান্ত এখন ২.৩৩ কোটি অতিক্রম করেছে। আক্রান্তের নিরিখে শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা, তারপরে ব্রাজিল, এবং তৃতীয় স্থানে ভারত (৩০লক্ষ ছাড়িয়েছে)। কিন্তু এর মধ্যে উদ্বেগের বিষয় এই যে, সর্বাপেক্ষা বেশি হারে আক্রান্তদের সংখ্যা এখন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ভারতেই। 

এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দেশে এবং এরাজ্যে উপলব্ধি করা হয়েছে যে, যত দিন না পর্যন্ত করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন নিবারণমূলক পদক্ষেপের ওপরই জোর দিতে হবে— দূরত্ববিধি রক্ষা, মুখের বন্ধনী ব্যবহার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদির ওপর। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা আরও ব্যাপক ও দ্রুত করা এবং তার সঙ্গে নিভৃতবাস এবং হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থাকেও কার্যকরী ভাবে সমন্বিত করা। এই পদক্ষেপগুলির অঙ্গ হিসাবে জোর দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে কিছুদিন এবং কিছু এলাকা নির্দিষ্ট করে ‘লকডাউন’ প্রক্রিয়া লাগু করার ওপর। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই ‘লকডাউন’ এর দিন ইত্যাদির সিদ্ধান্ত একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে নেওয়া হয়নি এবং স্থানীয় চাপ ইত্যাদির সঙ্গে আপস করা হয়েছে, যার একটি উদাহরণ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত। 

কিন্তু, উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই ‘লকডাউন’গুলির কারণে প্রতিটি রাজ্যেই উৎপাদন এবং পরিষেবার ওপর বাড়তি আঘাত এসে পড়েছে, বিশেষ করে দেশের বিশাল অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলির ওপর যেখানে ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তাঁদের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনের জন্য নির্ভরশীল। এর ফলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবর্ষে (২০২০-২১) আমাদের দেশের মোট উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিবর্তে হতে পারে প্রায় ৪ শতাংশ সংকোচন (-৪%) এবং কাজ হারাতে পারেন প্রায় ১৪ কোটি মানুষ। এতে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পুনরায় দেশের সেই নিচের ৮০ শতাংশ মানুষজনই। 

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির প্রশ্ন 

এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, তাদের শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্থির করেছে যে, দরিদ্র মানুষদের সরাসরি সহায়তা করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মূলত উদ্যোগীদের ঋণ প্রদান এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের ওপরেই জোর দেওয়া। তার মাধ্যমেই উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটলে শ্রমজীবী মানুষজনও উপকৃত হবেন। লক্ষণীয় যে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি যে প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে আরও বিস্তারিত ভাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, ঘোষণা করেছেন তার প্রায় ৯০ শতাংশই হলো ঋণ যা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে প্রদান করা হবে শিল্পোদ্যোগীদের। এমন কি অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে ১ লক্ষ কোটি টাকা কৃষির ক্ষেত্রে বরাদ্দ করার কথা বলেছেন, তা ঐ ২০ লক্ষ কোটি টাকারই অংশ এবং যা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কৃষকদের প্রদান করা হবে বিপণন পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা উপেক্ষিত থাকছে, তা হলো, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষমতা, যার সমাধান না হলে শুধুমাত্র জোগান বৃদ্ধি করলে উৎপাদিত পণ্য তার বাজার পাবে না। 

এ ছাড়া, উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই আর্থিক অধোগতির সময়ই, সংসদে কোনও আলোচনা না করেই নির্বিচারে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার যার মধ্যে রয়েছে দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলিও। এ ছাড়া, আঘাত করা হয়েছে শ্রমিকদের কল্যাণের শ্রমআইনগুলিও। এই পদক্ষেপগুলির জন্য পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যাপক অংশের শ্রমজীবী মানুষ। 

বামপন্থী বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি 

এই ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধিকেই মূল লক্ষ্য হিসাবে স্থির রাখা হয়েছে বামপন্থী বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তাই কার্যকরী দিক হলো কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে নিচের ৮০ শতাংশ পরিবারের হাতে পরিবারপিছু মাসে ৭,৫০০ টাকা সরাসরি প্রদান করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া, বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া, এবং করোনা প্রতিরোধে নিবারণমূলক এবং নিরাময়মূলক পদক্ষেপগুলির জন্য অতিরিক্ত অর্থপ্রদান করা এবং সাংগঠনিক পদক্ষেপগুলিও গ্রহণ করা। 

এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে তাই স্বল্পমেয়াদি (আগামী ছ’মাসের জন্য) পদক্ষেপগুলি হলো— (১) দেশের নিচের ৮০ শতাংশ পরিবারের প্রত্যেকটি পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাসে ৭,৫০০ টাকা জমা দেওয়া। এর জন্য কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ করতে হবে ৯.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। তারপরে (২) নিচের এই ৮০ শতাংশ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে ভরতুকি দিয়ে বিনামূল্যে ৬ মাসের জন্য মাসে ১০ কেজি করে খাদ্যশস্য (চাল অথবা গম) রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া, যার জন্য প্রয়োজন হবে ৬ কোটি ২৪ লক্ষ টন খাদ্যশস্য (যার থেকে অনেক বেশি খাদ্যশস্য, প্রায় ৭ কোটি ৭০ লক্ষ টন, বর্তমানে মজুত আছে ভারতের খাদ্যনিগমের গুদামগুলিতে)। আর্থিক দিক থেকে এই পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজন হবে কেন্দ্রীয় বাজেটে অতিরিক্ত ১.১৭ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা। এ ছাড়া, (৩) করোনার ক্ষেত্রে নিবারণ ও নিরাময়মূলক পদক্ষেপগুলির জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বর্তমান বছরে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বরাদ্দকে (৬৭ হাজার কোটি টাকা) দ্বিগুণ করে উন্নীত করতে হবে ১.৩৪ লক্ষ কোটি টাকাতে। অর্থাৎ, এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের জন্য বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে অতিরিক্ত মোট ১১.১৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা হবে সমগ্র কেন্দ্রীয় বাজেটের মাত্র ৩.৮ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদিতে এই বাড়তি অর্থ জোগাড় করতে হবে ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমেই, এবং এর জন্য উদারনীতির চাপানো আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও বাজেট পরিচালনা আইনকে কিছুটা অতিক্রম করতেই হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, এই পদক্ষেপগুলির জন্য সাধারণ মানুষের আয়বৃদ্ধির ফলে যে অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি হবে, তা বর্তমানের এই চাহিদা-ঘাটতির সময়ে মঙ্গলজনক হয়ে উৎপাদনকে উৎসাহিত করে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যকেই রক্ষা করবে, এবং এর জন্য কোনও অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি হবে না। ফলে, উৎপাদনে অধোগতিকে রুখে দিয়ে অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত গতি সঞ্চারই হবে। 

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে ১ লক্ষ কোটি টাকা কৃষির ক্ষেত্রে বরাদ্দ করার কথা বলেছেনতা ঐ ২০ লক্ষ কোটি টাকারই অংশ এবং যা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কৃষকদের প্রদান করা হবে বিপণন পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা উপেক্ষিত থাকছেতা হলোসাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষমতাযার সমাধান না হলে শুধুমাত্র জোগান বৃদ্ধি করলে উৎপাদিত পণ্য তার বাজার পাবে না।

স্বল্পমেয়াদিতে যতদিন না পর্যন্ত করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং গণব্যবহার শুরু হচ্ছে, ততদিন মূল জোর থাকবে করোনার নিবারণমূলক চিকিৎসায়, এবং তার সঙ্গে নিরাময়মূলক চিকিৎসার সমন্বয়ের ওপর। এই নিবারণমূলক চিকিৎসার ক্ষেত্রে, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ‘লকডাউনের’ পরিবর্তে অনেক জরুরি হবে গ্রামে এবং শহরে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। এই কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে চিকিৎসকের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা যাদের অধিকাংশকেই এরাজ্যে নিয়োগ করা হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারেরই আমলে। এঁরাই মানুষের বাড়িতে গিয়ে বোঝাবেন কি কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তাঁদের স্বাস্থ্য নিরাপদ থাকবে তাঁদের নিজেদের হাতেই। এই ক্ষেত্রে বিশেষ সহযোগী ভূমিকা পালন করবে বাম ও প্রগতিশীল গণসংগঠনগুলি। এই বিষয়ে এরাজ্যে ইতিমধ্যেই এগিয়ে এসেছেন বিজ্ঞানমঞ্চ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি এবং ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলি। এরপর, এই নিবারণমূলক পদক্ষেপগুলির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হবে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে গ্রামাঞ্চলে ব্লক, মহকুমা এবং জেলাস্তরে হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা, রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থাকে আরও দ্রুত করা এবং রোগ নিরাময়ের দিকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। শহরাঞ্চলেও একই ধরনের কাজ করতে হবে প্রতি ওয়ার্ডকে ভিত্তি করে পৌর হাসপাতালগুলির পরিকাঠামোকে উন্নয়নের মাধ্যমে। করোনার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের এই পদক্ষেপগুলির জন্যই এই খাতে কেন্দ্রীয় বাজেটের অর্থ দ্বিগুণ করার কথা ইতিমধ্যেই উল্লিখিত হয়েছে। 

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ 

দীর্ঘমেয়াদি স্তরটি চিহ্নিত হবে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং তার গণব্যবহারের স্তর শুরু হওয়ার পর থেকেই। এই লক্ষ্যে এখনই প্রস্তুতির প্রয়োজন, যাতে কেন্দ্রীয় বাজেটে উপযুক্ত ভরতুকি প্রদানের জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ থাকে, এবং রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে সমন্বয় থাকে যাতে এই বিষয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে গণটিকার ব্যবস্থা সম্ভব হয়, এবং তার উপকার সমস্ত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। 

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও স্বল্পমেয়াদি স্তরের তিনটি পদক্ষেপকেই বেশ কিছুদিনই চালু রাখতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থে শুধু করোনার আক্রমণের পূর্ণাঙ্গ মোকাবিলা সম্ভব হবে তাই নয়, আর্থিক প্রগতির চাকাটিও নিয়মিত ঘুরতে শুরু করবে যাতে সাধারণ মানুষের আয় এবং কর্মসংস্থান ধারাবাহিক ভাবেই বৃদ্ধি পাবে। দেশের মোট উৎপাদন ও আয়বৃদ্ধি হতে থাকলে রাজস্ব আদায়ও বৃদ্ধি পায়, এবং এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির আয়ও বৃদ্ধি পাবে, যার থেকে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আরও বর্ধিত ব্যয়ও বহন করা সম্ভব হবে। 

সর্বশেষে মনে রাখা প্রয়োজন, আর্থিক প্রগতি এবং করোনাকে প্রতিরোধ করার এই প্রক্রিয়া থেকে সর্বাপেক্ষা উপকৃত হতে পারেন আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষজনই। তাই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলির ক্ষেত্রে, দাবি আদায় এবং পদক্ষেপগুলির কার্যকারিতা বজায় রাখার লক্ষ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত এবং ধারাবাহিক আন্দোলন— গ্রামে এবং শহরে। 

গণশক্তি, ২৭ আগস্ট, ২০২০

 


 

প্যান্ডেমিক-পিকে-আঁখি এবং প্রত্যাঘাত

সুদীপ্ত বসু

শুধু ধূপগুড়িতেই গঙ্গাধর রায় সহ মোট দশজন কৃষক এখনও পর্যন্ত আত্মঘাতী হয়েছেন। পাটের চাষ প্রায় বন্ধ বিস্তীর্ণ এলাকায়। ফসলের দাম নেই, মহাজনী ঋণে জর্জরিত গরিব, প্রান্তিক কৃষকরা। আবার এই ধূপগুড়িতেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রথম গোরক্ষার নামে গুজব ছড়িয়ে দুই কিশোরকে পিটিয়ে খুন করার প্রথম ঘটনা ডুডুয়ার তীরে বারহালিয়া গ্রামে। 

আজকের বাংলার রাজনীতির ‘সাজানো সমীকরণের’ আশ্চর্য ক্যানভাস হয়ে উঠতে পারে উত্তরবঙ্গের এই কৃষি জনপদ। 

গঙ্গাধর রায়ের মাত্র তিন বিঘা জমি ছিল, অন্যের জমিতে লিজেও চাষ করতেন। তিনটি মেয়ে। ব্যাঙ্ক ও মহাজনী ঋণের চাপে শেষপর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ, আত্মঘাতী হন। জমিও আপাতত বন্ধক রয়েছে মহাজনী কারবারিদের হাতে। ধূপগুড়ি থেকে গোটা উত্তরবঙ্গে আলু যায়, সেখানেই আলু চাষি আত্মঘাতী হচ্ছেন। শুধু এই এলাকা থেকেই তিন হাজারের বেশি কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়ে বাইরে কাজের খোঁজে। 

দারিদ্র্যের সেই উঠোনে বিহার থেকে আসা পিকে’র বাহিনী হাজির হয়েছিল। গঙ্গাধর রায়ের দাদা চিন্তামোহন রায়। গাদং এলাকায় সিপিআই(এম)’র সংগঠক। দু’বছর আগে বাবাকে হারানো তিন কন্যার অবাক চাহনি। চিন্তামোহন রায়ের পুত্র জয়ন্ত রায়। বাংলায় এমএ। ছয় বছর আগে প্রাথমিকে টেটে উত্তীর্ণ, আজও নিয়োগ হয়নি।

কর্পোরেট সংস্থা পিকে বাহিনীর মুখের ওপর জবাব শুনিয়েছিল জয়ন্ত,‘আমাদের পরিবারকে আগে জেনে আসুন, তারপর বাবাকে কিনতে আসবেন, আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু বিক্রি হই না’। 

প্রত্যাখ্যানের পর্ব পেরিয়ে এবার প্রত্যাঘাত। ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকরাই পালটা তাড়া করেছে। প্রত্যাঘাতেই লুকিয়ে আছে আগামীর অনেক সম্ভাবনার রসদ।

 

‘আমাদের মাথা বিক্রির জন্য নয়’ 

রাজনীতিতে সময় বরাবরই এক্স ফ্যাক্টর। 

কোভিড আবহ। চলতি মাসেই রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লক্ষে পৌঁছাতে চলেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র বেআব্রু হচ্ছে প্রতিদিন, লকডাউনের দিন ঘোষণা করতেও কার্যত নাজেহাল সরকার। রাজ্যের মত দেশেও বাড়ছে করোনা দাপট। দেড়শো দিন পেরিয়ে গেছে, দেশে ৫৮ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্য, প্রধানমন্ত্রী ময়ূরের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন! 

ঠিক সেই সময়তেই এরাজ্যে কেনাবেচা করতে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা শুরু করেছে মমতা ব্যানার্জির হয়ে ভাড়া খাটা প্রশান্ত কিশোরের বাহিনী। 

২০১৮’র পঞ্চায়েত ভোটের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। গায়ের জোরে, অস্ত্রের মুখে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় মাইলের পর মাইল বিরোধী শূন্য। বেলাগাম দুর্নীতির উৎসমুখ। আমফান পরবর্তী ঘটনাবলি স্পষ্ট করেছে বিনা ভোটে জেতার উগ্র বাসনা কেন। গরিব, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সামান্য ত্রিপল পেতেও টাকা দিতে হয়েছে। ক্ষোভের বৃত্ত বাড়ছে, জমি হারাচ্ছে তৃণমূল। বাজার করতে বেরোচ্ছে প্রশান্ত কিশোর অ্যান্ড কোম্পানি। 

খোদ হরিরামপুরের বিধায়কের বাড়ি পৌঁছেছে সেই ভাড়াটে বাহিনী। ঘৃণাভরে তা উড়িয়েছেন সিপিআই(এম) বিধায়ক রফিকুল ইসলাম। ঘরের দোর থেকেই বিদায় করেছেন পিকে বাহিনীকে। 

এবাংলার রাজনীতিতে এই সংস্কৃতির আমদানি হলো মমতা ব্যানার্জির হাত ধরেই। ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা মামলা রুজু করে দলবদলে চাপ দেওয়ার ঘটনা ২০১১ সাল থেকেই চলছিল। কিন্তু কোটি কোটি টাকায় ভাড়া করা একটা কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে বাংলার মানুষকে ‘কিনতে ’ চাওয়ার স্পর্ধা এর আগে কেউ দেখায়নি। ‘দিদিকে বলো’ থেকে ‘বাংলার গর্ব মমতা’- কর্পোরেট প্রচার মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই এবার বাঁকা আঙুলে ঘি তোলার চেষ্টা— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক নতুন উদ্বেগজনক ছবি।  

ধূপগুড়ির সিপিআই(এম)’র প্রাক্তন বিধায়ক লক্ষীকান্ত রায়ের উঠোনে দাঁড়িয়েও দরদাম করেছেন প্রশান্ত কিশোরের সংস্থার বিহারের বাসিন্দা। 

—শুনুন তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব নিয়েছেন আমাদের বস, এখন বেকায়দায়। চারিদিকে দুর্নীতি, আপনি তৃণমূলে যোগ দিন,আপনাদের মতো সৎ লোকেদের প্রয়োজন তৃণমূলে। টাকা পয়সার অভাব হবে না, জেলায় ভালো পদ পাওয়া যাবে।

ছাত্র আন্দোলন থেকে জমির আন্দোলনে পরশ মাখা প্রৌঢ়ের পালটা জবাব ছিল,‘ কমিউনিস্ট পার্টি করেছিল সারাজীবন, কোনোদিন শুনিনি ভোটের জন্য কোনও দলকে একটা কর্পোরেট কোম্পানিকে ভাড়া করতে হয়। এসব এরাজ্যের সংস্কৃতি নয়, আর এই যে বলছেন তৃণমূলে সব অসৎ লোক, এটা ভুল ধারণা। তৃণমূলের মাথাই অসৎ তাই কর্মীরাও সেই পথে’। 

কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের শ্লাঘা বোধ হবে এমন কথোপকথনে স্বাভাবিক। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন সিপিআই(এম)’কে কিনতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে হচ্ছে? আবার করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্যও দেশের সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, মানুষের দাবিতে প্রতিবাদ আন্দোলনে নামলে সিপিআই(এম)’কেই হুঁশিয়ারি দিতে হচ্ছে নবান্ন থেকে?

 

বাড়ির সামনে বসে মাছের জাল বুনছেন প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক লক্ষীকান্ত রায়


‘করোনার ব্যর্থতা শেষে এখন দুর্নীতি’ 

গত পাঁচ মাস রাজ্যজুড়ে কোভিড পরিস্থিতিতে একের পর এক মর্মান্তিক ছবি সামনে এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্য দপ্তর পাঁচ মাসে ঠিক কী কাজ করেছে তা নিয়ে রাজ্যবাসীর স্বাভাবিকভাবেই এখন কোনও আগ্রহ নেই। লকডাউন মানে যে রাস্তা লাল ইট দিয়ে সাদা গোল করা নয়, তা এতদিনে উনিও হয়তো টের পেয়েছেন। 

মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক তো ছাড়, খাস বিহারও এখন দৈনিক করোনা নমুনা পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গকে ছাড়িয়ে গেছে। রাজ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণের আবহে অ্যাগ্রেসিভ টেস্টিং’র জায়গায় দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ‘অ্যাগ্রেসিভ’ ভাবে কমে যাওয়া করোনা পর্বে রীতিমতো উদ্বেগজনক বলেই মনে করা হচ্ছে। কোভিড পজিটিভ হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার পেরোতে চলেছে। উত্তরবঙ্গের যে জেলায় করোনা মোকাবিলার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেই জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের স্রেফ সঙ্কীর্ণ স্বার্থে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ‘আলিপুরদুয়ার মডেল’ নয়, সরকার বরং নির্মল মাজি-শান্তনু সেন’দের প্রেসক্রিপশনেই আস্থা রাখছে। যার অনিবার্য পরিণাম, সংক্রমণের গতি বেপরোয়া, মৃত্যুর স্রোতকে আটকাতে না পারার ব্যর্থতা সামনে আসছে প্রতিদিন। 

সংক্রমণের এই পর্বে রাজনীতি করা যাবে না বলে দাবি করে প্রতিদিন স্রেফ দলীয় রাজনীতি করে যাচ্ছে সরকার। সংক্রমণের শঙ্কা উপেক্ষা করে দলীয় বাহিনী ত্রাণ, ক্ষতিপূরণে টাকা চুরি করে যাচ্ছে, প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা পথে নামলে ‘করোনায় রাজনীতি ’ না করার হুশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তথ্য বলছে লকডাউন শুরু প্রায় তিন সপ্তাহ আগেই তখই করোনা উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশনে থাকা মানুষের সংখ্যা ৩১, ১২৫১জন নজরদারিতে, ২৯জনের লালরসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর সেদিনই মুখ্যমন্ত্রী মালদহের সভায় দাঁড়িয়ে বলছে, করোনা করোনা নিয়ে মাথা ঘামানো হচ্ছে, ওসবে প্যানিক করবেন না’। উলটে আবার নেতাজী ইন্ডোরে সভা করে ক্লাবগুলিতে টাকা বিলি করা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের সরকার কেনাবেচায় ব্যস্ত ছিল অমিত শাহ, তাই জানুয়ারি স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলেও মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নষ্ট করা হয়েছিল। 

আর এখন আনলক পর্বে সামনে এসেছে মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিইি-ভেন্টিলেটর- কেনা নিয়েও সরকারের অন্দরেই এখন কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির খবর। কোভিড সরঞ্জাম নিয়েও দুর্নীতি! আমফানের ক্ষতিপূরণ নিয়েই দুর্নীতি! মুখ্যমন্ত্রীর সাফাইয়ের মর্মার্থ— পিএম কেয়ার ফান্ডে দুর্নীতি হতে পারলে এরাজ্যে সামান্য মাস্ক, ভেন্টিলেটর নিয়ে প্রশ্ন কেন? 

‘বাইনারি’ ঠিক হচ্ছে কীভাবে, কোন খাতে বারেবারে তা স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। 


‘শীতঘুম শেষে বোঝাপড়ার সমন’ 

এর মাঝেই নতুন মোড়। আনলক পর্বে এসে দীর্ঘ শীতঘুম কাটিয়ে ফের নারদ ঘুষকাণ্ডে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের সমন পাঠানো হচ্ছে, সম্পত্তির তথ্য চাওয়া হচ্ছে। এফআইআর রুজুর পরে চার বছর কেটে গেছে। তারপরেও এখনও সমনের পালা চলছে। কেউ কেউ খুশি, ‘এই তো এবার দুর্নীতিগ্রস্তরা ধরা পড়বে’। দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির আকাঙ্ক্ষা ভুল কিছু নয়, কিন্তু কেন্দ্রীয় সংস্থা দৃঢ়তার সঙ্গে তদন্ত করে হাত পেতে ঘুষ নেওয়া মন্ত্রী, সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সেই ধারণা চরম বিভ্রান্তিকর। 

কেন? ২০১৪ সালে সারদা-রোজভ্যালি সহ চিট ফান্ডকাণ্ডে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়। ছয় বছর পরেও চার্জশিট জমা দেওয়া হয়নি। এখন বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত চলছে। 

তবে এর মাঝেই এবার জবাব দিতে হবে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই। গত ছয় বছর ধরে চিট ফান্ডকাণ্ডে অভিযুক্তদের জেলে ঢোকানোর গল্প পশ্চিমবঙ্গে এসে বার পাঁচেক শুনিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। 

অথচ সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের (সিভিসি) রিপোর্ট বলছে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গোটা দেশে একাধিক দুর্নীতির মামলায়( ব্যাঙ্ক, এমনকি সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি) জনপ্রতিনিধি ও সরকারি আধিকারিক সহ ১১০ জনের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর সম্মতিটুকু পর্যন্ত আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় কর্মীবর্গ, জন-অভিযোগ মন্ত্রক। এই মন্ত্রক রয়েছে মোদীর হাতেই। 

২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র আবেদন বকেয়া রয়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসেই সিবিআই’র তরফে তৃণমূলের তিনজন সাংসদ ও একজন মন্ত্রীর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে মামলা ও আইনি প্রক্রিয়া শুরুর জন্য আবেদন জানানো হয়। সেই  আবেদন ১৫ মাস ধরে ফেলে রেখেছে মোদী সরকার। এমনকি মমতা ব্যানার্জির ছবি দুর্নীতিকাণ্ডের আইনি প্রক্রিয়ার আবেদনও ফেলে রাখা হয়েছে। 

বিশ্বাস করবেন এই নতুন ‘সমন পর্ব’? 


সোশ্যাল মিডিয়া শাসকেরই মিডিয়া’ 

‘নয়া ভারতে মোদীর প্রতারক ভাবমূর্তি’— এই শীর্ষক সিপিআই(এম)র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির ফেসবুক লাইভ। সেই ভার্চুয়াল বক্তৃতার শেয়ার করার মহারাষ্ট্রের সিপিআই(এম) নেত্রী শুভা সামিমের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তিনদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। এই বক্তৃতা নাকি ফেসবুকে সামাজিক মাপকাঠির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। 

যদিও তেলেঙ্গানার বিজেপি নেতা টি রাজা সিং’র ঘৃণ্য বিষাক্ত মন্তব্য— মুসলিমদের বিশ্বাসঘাতক, রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুলি করে মারা, দিল্লির দাঙ্গায় কপিল মিশ্রের উগ্র পোস্ট— সব কিছুই অনুমোদন দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ‘ব্যবসা ও শাসক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কে ক্ষতি হবে’ এই অজুহাতে! অভিযোগের তীর ফেসবুকের  ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাস আবার রাজ্যের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ। ২০১১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার সামলেছেন আঁখি দাস নিজেই। কথিত আছে, তাঁর প্রভাবেই রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রীসভায় স্থান পান। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও তাঁর স্বামী দিল্লির উচ্চ পদস্থ আমলা( আরএসএস’র কট্টর সমর্থক) সৌম্য চট্টোপাধ্যায় এবং আঁখি দাস ওই কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারের সময় ছিলেন বর্ধমানেই। এমনকি খোদ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে কোভিডের জন্য ‘মুসলিমদের বাড়তি দায়িত্ব পালন করা উচিত’র মতো সূক্ষ বিষাক্ত প্রচারও শেয়ার করতে দেখা গেছে। তাঁর দিদিও পরিচিত মুখ, বিজেপি’র। 

বিজেপি-আরএসএস’র সখ্যতা কখনও তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় আঁখি দাসের পথে বাধা হয়নি। 

২০১১ ভোটের সময় যেভাবে তৃণমূলের প্রচার ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছিল, যেভাবে প্রচারের সুর বেঁধে দেওয়া হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় তাতে দলেরই বিধায়ক, মন্ত্রীর এই পুত্রবধূর ‘ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ। 

সীতারাম ইয়েচুরির বক্তৃতার লিঙ্ক শেয়ার অপরাধ, অথচ কপিল মিশ্রদের বক্তৃতা ফেসবুকে ভাইরাল করতে সময় লাগে না। খোদ ফেসবুক প্রধান নিজেই লিখেছেন মমতার প্রচারের ৩৮ ভিডিও ভাইরালের রহস্য! 

আদৌ রহস্য থাকল কিছু ? সোশ্যাল মিডিয়া আসলেই ‘শাসকেরই মিডিয়া’!


‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে’ 

মহামারীকে ঢাল করে যেভাবে জনগণের রুটি-রুজির ওপরে আঘাত নামিয়ে আনা হচ্ছে, যেভাবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে এই অস্থির সময়তেই সপ্তাহ ব্যাপী সিপিআই(এম)’র প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। ১৬টি দাবি। স্পষ্ট বিকল্প— আয়কর দেয় না এমন পরিবারগুলিকে আগামী ছয় মাস নগদ ৭৫০০ টাকা করে দিতে হবে, বর্ধিত মজুরি সহ রেগায় ২০০দিনের কাজ। 

আবারো বলতে হচ্ছে ‘সময়’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুত্বের উগ্র মুখ মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল ফিরে এসেছেন কলকাতায়। নড়বড়ে অধিকারী পরিবার, নারদকাণ্ডের সমন পৌঁছেছে তাঁর ঠিকানাতেও। ‘পত্র-সংঘাতের’ মাঝেই রাজভবনে ‘আড্ডা’ দিয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীও।

বিচ্ছিন্ন সব ছবি? একেবারেই নয়। 

পরিকল্পিত মেরুকরণের রঙিন চিত্রনাট্য প্রস্তুত। শাসকের মরজি মতো মিডিয়ায় সাজানো হচ্ছে বাইনারি- ‘হয় তুমি তৃণমূল নয় তুমি বিজেপি’। 

আপনাকে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুই সরকার। 

উত্তর অভিন্ন— আমাদেরই সামনে আনতে হবে বিকল্প ভাষ্য। একইসঙ্গে প্রত্যাঘাত, দ্রুত এবং সরাসরি। মনে রাখতে হবে পিকে’র বাহিনী কাদা মাখা কৃষকদের তাড়া খেয়েই কিন্তু গ্রাম থেকে পালাতে বাধ্য হয়।

গণশক্তি, ২৫ আগস্ট, ২০২০

20200825

বাজার যখন সুবোধ রায়কে খুঁজে পেল

 


অশোক মিত্র

প্রচারবিমুখ মানুষটি পার্টি-অফিসের এক কোণে বসে নীরবে কাজ করে গিয়েছেন সারা জীবন। তাঁকেই নায়ক বানিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে সেই সুবোধ রায়কে খোঁজার চেষ্টা অনর্থক।

......................................................... 


কী আর করা, এত এত বছর ধরে জড়ো হওয়া স্তূপ, স্মৃতিপটের কোনাঘুপচিতে হয়তো কয়েক হাজার কবিতার পঙক্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, হঠাৎ-হঠাৎ একটি-দু’টি আচমকা মাথা ঝাঁকুনি দেয়কবে কোথায় কোনও কলেজ ম্যাগাজিনে কী বা নগণ্যতর এক পুস্তিকায় এই কাব্যপ্রয়াস চোখে পড়েছিল, এখন আর কিছুতেই মনে আনতে পারি না: ‘অনেকটা সেই সিন্ধুবুকে গর্জনেরে ছাড়ি’। রেডিয়োতে নাটক শুনে বেজায় তারিফ তারই...’ কিংবা এরই কাছাকাছি জোড়া পঙক্তিযোজন। একটি সামাজিক মন্তব্যও যেন লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়েছিল: আসলে আমাদের অশ্রদ্ধা, অথচ নকল নিয়ে দুর্দান্ত মারামারি। কলেজ ম্যাগাজিনে পেশ করা সমাজদর্শনকে কী করে যেন সম্প্রতি একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্তিত হতে দেখলাম। 

চট্টগ্রাম বিদ্রোহের তরুণতম নায়ক সুবোধ রায়, বাড়ির সবাই ঝুঙ্কু বলে ডাকত। ১৯৩০ সাল, মাত্র চোদ্দো বছরের আদরের মাসতুতো ভাইটিকে কল্পনা দত্ত মাস্টারদার কাছে হাজির করিয়েছিলেন। কিশোরটি মুহূর্তের মধ্যে উৎসর্গীকৃত বিপ্লবী সেনানীতে রূপান্তরিত, অনেক শৌর্যের, অনেক মৃত্যুবরণের অধ্যায় পেরিয়ে বিপ্লবের প্রদীপ্ত শিখা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এল, সুবোধ রায় ধরা পড়লেন, আন্দামানের সেলুলার কারাকক্ষে দীর্ঘ এক দশকের নির্বাসন। কারাভ্যন্তরেই যৌবনের উন্মেষ, সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া। ছাব্বিশ বছর বয়সে মুক্তিলাভের পর মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে প্রবেশ। অনবচ্ছিন্ন সাড়ে ছয় দশক ধরে সুবোধ রায় পার্টির সব সময়ের সাধারণ কর্মী-ই থেকে গিয়েছিলেন। আদর্শনিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রিত জীবন, কোনও দিন স্বার্থচিন্তা করেননি, সংসারে গুছিয়ে বসার কথা ভাবেননি, সর্বক্ষণের দলীয় কর্মী, দলীয় দফতরই দশকের পর দশক জুড়ে তাঁর আশ্রম তথা জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বরাবরের মন্ত্র: সম্ভোগ নয় সংবরণ। কর্মী থেকে নেতৃত্বে পৌঁছবার বাসনাবিহীন। সাধ্যের প্রত্যন্তে গিয়ে দলীয় সংগঠনের কাজে কর্তব্য সম্পাদনে প্রতিনিয়ত তাঁর অধ্যবসায়। শেষ বছরগুলি পর্যন্ত নিজের জামাকাপড় নিজে কেচেছেন, রোদে মেলেছেন, ইস্ত্রি করেছেন। যে ঘরে থাকতেন, নিজেই ঝাড়তেন, পুঁছতেন, জীবন নির্বাহের অতি সামান্য যে ক’টি উপকরণ, আশ্চর্য নিপুণতায় গুছিয়ে রাখতেন। নিজের জন্য ন্যূনতম রান্না সাধারণত নিজেই করতেন, অন্যথা মাঝেমধ্যে দলীয় কমিউনে আহার্যের সামান্য চাহিদা মেটানো। কৃচ্ছ্রসাধনায় দৃঢপ্রতিজ্ঞ, অন্তরঙ্গতর অনুরাগীরা কখনও-সখনও একটু-আধটু উপহারসাগ্রী তাঁকে পৌঁছে দিতেন, বিব্রত সুবোধ রায় বিপন্নতার সঙ্গে তা গ্রহণ করতেন, দু’দিন বাদে অনুরাগীদের মধ্যেই ফের বিলিয়ে দিতেন। 

মানুষটি বরাবর আত্মপ্রচারের বাইরে থেকেছেন। যাঁদের পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে ডেকে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের রোমাঞ্চকর বিভিন্ন কাহিনি শোনাতে ভালবাসতেন। সর্বস্তরের সকলের সঙ্গে নয়, ঈষৎ নিচুতলার দলীয় কমরেডদের সঙ্গেই তাঁর নিবিড়তর সখ্য, যাঁরা দলের গাড়ি চালান, যাঁরা ঘরে ঘরে কাগজপত্র বা চা-মুড়ি পৌঁছে দেন, যাঁরা অপেক্ষাকৃত উঁচু মহলের নেতাদের নির্দেশাদি পালন করেন, ইত্যাকার কমরেডদের নানা সমস্যা মেটাতে সুবোধ রায় অহরহ ব্যস্ত। পাশাপাশি দলীয় দফতরে অনেক খুঁটিনাটি সাংগঠনিক দায়িত্বও তাঁকে সামলাতে হয়েছে। জেলা দফতরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, বিনিময়-প্রতি-বিনিময়, কিংবা কেন্দ্রীয় দফতর বা অন্যন্য রাজ্য দফতরের সঙ্গে চিঠিপত্রের মধ্যবর্তিতায় সেতুবন্ধনের কাজ। দীর্ঘ দশকগুলি জুড়ে পার্টি অনেক ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, বিভিন্ন ঋতুতে মতাদর্শের অনেক টানাপোড়েন, অঢেল তর্ক-বিতর্ক, পঁয়ষট্টি বছর ধরে সুবোধ রায় অনেক ইতিহাস তৈরি হতে দেখেছেন। অনেক নেতার উত্থান দেখেছেন, তাঁদের প্রস্থানও পর্যবেক্ষণ করেছেন। দলের ভাবাদর্শ ও কর্মসূচির অবৈকল্য রক্ষায় তাঁর ইস্পাতকঠিন মানসিক দার্ঢ্য। কিন্তু কর্মী থেকে নেতাতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবৃত্তি তাঁর কদাপি ছিল না। দলের শৃঙ্খলা থেকে কোনও দিন বিচ্যুত হননি, কিন্তু স্পষ্টবাদিতায় তাঁর জুড়ি নেই, ছোট-মাঝারি-বড় নেতাই হোন, কিবা নেতৃত্বে তখনও পৌঁছয়নি কিন্তু পৌঁছুতে আঁকুপাকু করছেন, কারও আদর্শগত বা আচরিক স্খলন তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে সরবে সমালোচনা করেছেন। তাঁকে তাঁকে তাই ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না অনেকেই। দলের মধ্যে ক, খ বা গ তরতর করে সোপান বেয়ে উন্নতি ও মর্যাদার বেলাভূমিতে পৌঁছে গেছেন। সুবোধ রায় একা পড়ে থেকেছেন। তাঁর হাঁটুর বয়সিরা দ্রুততার সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন, দলের মধ্যে কেষ্টবিষ্টু বলে বিবেচিত হয়েছেন, তাঁরা ফরমান জারি করেছেন, দলীয় অনুশাসন মেনে সুবোধ রায় সেই ফরমান মান্য করে নিজের কর্তব্য নিঃশব্দে পালন করে গেছেন। 

এমনি করেই একটা গোটা জীবন অতিবাহন। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বীর যোদ্ধা, পার্টির অন্যতম প্রাচীন সদস্যদের এক জন। বহু বছর ধরে দলীয় ইতিহাস ধাপে-ধাপে সুশৃঙ্খল লিপিবদ্ধ করেছেন, কয়েক খণ্ডে যা প্রকাশিত হয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তা হলেও দলের এক জন নিতান্ত সাধারণ কর্মী, নতুন প্রজন্মের দলীয় সদস্যরা তাঁর পরিচয় জানেন না, তাঁদের কাছে নিতান্ত হেজিপেঁজি কে এক জন বৃদ্ধ পার্টি দফতরে ঘাড় গুঁজে কর্মরত। তাঁর কোনও দাবিদাওয়া নেই, তাই তাঁর আলাদা আদর সম্ভাষণও নেই। 

নব্বই বছর বয়স অতিক্রান্ত, অবশেষে সুবোধ রায় জড়ার শিকার হলেন। রোগগ্রস্ত অবস্থায় কলকাতাস্থ একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হল। তাঁর জন্য পাঁচতারা হাসপাতালের ব্যবস্থা করার প্রশ্ন ওঠে না, নিজেও সেটা অবশ্যই ঘোর অপছন্দ করতেন। হাসপাতালের একটি নিরাবরণ ঘরে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি নির্জীব পড়ে রইলেন, তিনি তো কোনও নামী-দামি নেতা নন, তেমন কেউ দেখতেও আসেন না। দু’এক জন কাছের মানুষ যাঁরা আসেন, সামান্য চেতনা থাকলে তাঁদের চিনতে পারেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারেন না। এক সায়াহ্নে সুবোধ রায়ের জীবনদীপ নির্বাপন, গুটিকয়েক সংবাদপত্রে দায়সারা খবর ছাপা হল। অধিকাংশ পত্রিকার বিচারে তাঁর প্রয়াণ উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচিত হল না। 

সুবোধ রায়ের মৃত্যুর পর ছ’বছর কেটে গেছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত, অপ্রয়োজনীয় কাহিনি। বিশ্বায়িত ভারতবর্ষ জোর কদমে এগিয়ে চলেছে, পুরনো দিনের পাঁচালিতে কারও উৎসাহ নেই। সময়ও নেই। সুবোধ রায় স্বভাবতই নিশ্চিন্ত বিস্মৃতির অতলে অবস্থান করছিলেন। 

এমন সময় কী অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র শিল্পের এক বিত্তবান প্রযোজকের যেন কী খেয়াল চাপল, এক পরিচালকের সনির্বন্ধ অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি চিটাগাং বিদ্রোহ নিয়ে একটি রংচঙে রোমান্টিক ছবি তৈরি করেছেন। ছবিটির প্রধান চরিত্র তরুণ বিপ্লবী সুবোধ রায়। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে নিশ্চয়ই কয়েক শো কোটি টাকা ব্যয়িত হয়েছে। মাল্টিপ্লেক্সে-মাল্টিপ্লেক্সে মহার্ঘ টিকিট কেটে ছবিটি ব্যবস্থা হয়েছে। যেহেতু ‘চিটাগাং’ চলচ্চিত্রটির প্রযুক্তিগত চতুরালি তথা অভিনয় উৎকর্ষ নিয়ে খবরের কাগজে ভাল ভাল কথা ছাপা হয়েছে, ব্যস্ত তরুণ-তরুণীকুল সময় করে ছবিটি দেখে আসছেন। যে তারকা সুবোধ রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তাঁর উপর পর্যাপ্ত প্রশংসা বর্ষিত হচ্ছেআর কিছু না হোক, একটু মুখ বদলানো তো হচ্ছে। বলিউডি নর্তন-কুন্দনে ক্ষণিক যতি দিয়ে দেশপ্রেম বোধের সঙ্গে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার উত্তেজনা।

 বেদব্রত পাইন পরিচালিত ‘চিটাগং’ ছবিতে সুবোধ রায়ের ভূমিকায় দিলজাদ হিওয়ালে।

মাল্টিপ্লেক্সের মধ্যবর্তিতায় তাঁর প্রয়াণের ছ’বছর বাদে সুবোধ রায় অতএব পুনরুজ্জীবিত হলেন। যত দিন জীবিত ছিলেন অখ্যাত হয়েই ছিলেন। খ্যাতিবিহীনতাই তাঁর পছন্দ ছিল। কিন্তু লালটলিখন এড়াবার উপায় নেই, যেহেতু কেউ কিশোরকালে বিপ্লবের পবিত্র আবেগে ভেসে গিয়ে অবিমৃশ্যকারী সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন তাঁকে চলচ্চিত্র শিল্পের বধ্যভূমিতে পৌঁছতেই হবে, মৃত্যুতেও নিস্তার নেই। তথ্য-প্রযুক্তি অধ্যুষিত পৃথিবীতে সনাতন ধ্যানধারণা অবশ্য বর্জনীয়, ব্যক্তিগত রুচি-অভিরুচিও গ্রাহ্য নয়। সুবোধ রায় এখন থেকে চলচ্চিত্রশিল্পের এক নন্দিত চরিত্র, আদি সুবোধ রায়ের সঙ্গে এই বিকিকিনি-কেন্দ্রিক সুবোধ রায়ের কতটা মিল, সে প্রশ্ন অবান্তর। মুম্বই চলচ্চিত্রশিল্প যা রচনা করেছে, তা-ই সত্য। বিশ্বায়নের এটাই জাদু। কলেজ-ম্যাগাজিনে পড়াপদ্যপংক্তিদ্বয় যা বলতে চেয়েছিল, আসলকে টেক্কা মেরে নকল এগিয়ে যাবে। আসলকে আর নকল থেকে আলাদা করে চেনা যায় না, চেনার চেষ্টাও বিধেয় নয়।

আদি অগ্রাহ্য-অগ্রহণীয়, কৃত্রিমই শ্রেয় ও বরণযোগ্য, এই প্রত্যয়ের পক্ষে আঁটোসাটো যুক্তিমালা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। পৃথিবীর পরিভাষা পাল্টে গেছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ অন্য রকম। চট্টগ্রাম বিপ্লব-কাহিনি যদি হালের ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় করতে হয়, পরিবেশনের প্রকরণে যথাযথ নতুন বিন্যাস প্রয়োজন। সংযম, আত্মত্যাগ, পরচিকীর্যা ইত্যাদি ভারী ভারী শব্দ এখন অচল, গম্ভীর-গম্ভীর দেশপ্রেম-উদ্দীপক বক্তৃতার বন্যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অসহ্য,একটু রঙ-বেরঙে ভূষিত না-করলে ছবিটি বাজারে মার খাবে, ছবিটি মার খেলে বর্তমান প্রজন্মকে ইতিহাস-সচেতন হওয়ার প্রয়াসও মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রাচীনপন্থীদের মেনে নিতে হবে এটা বিজ্ঞাপনের যুগ। বিজ্ঞাপনের সুবোধ রায় আদি ও অকৃত্রিম সুবোধ রায়ের কাছ থেকে শুধু নামটুকর জন্য ঋণী, সেই নামটিকে বিখ্যাত করতে গেলে বাজারের পছন্দ-অপছন্দদের কথাও মাথায় রাখতে হবে, মানতে হবে ক্রেতাদের কাছে যা গ্রহণীয়, তাই-ই গ্রাহ্য, অন্য সব কিছু বাতিল। 

পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া সুবোধ রায় তো আর আপত্তি জানাতে পারছেন না, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ন্যূনতম এনতার মানবাধিকার খারিজ হয়ে যায়, মানহানির ঝামেলা পোয়াতে হয় না কোনও পক্ষকেই। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে বলে নাকিকান্নাও সমান অর্থহীন, অতীতকে মাঝে মধ্যে নতুন করে বিশ্লেষণের প্রয়াস জ্ঞানচর্চার অন্যতম অঙ্গ নয় কি? সুবোধ রায়কে তাঁর জীবদ্দশায় চিনতে-জানতেন-ভালবাসতেন-গভীর শ্রদ্ধা করতেন এমন মুষ্টিমেয় যে ক’জন এখন আছেন, তাঁদের তাই মেনে নিতে হয় যখন যেমন তখন তেমন। একটি গুজব যা বলে আসছে শুনে অন্তত তাই মনে হয়। তরুণতর, তরুণতম প্রজন্মকে নাকি উৎসাহ দান করা, মাল্টিপ্লেক্স মাল্টিপ্লেক্সে ভিড় জমাও, মহার্ঘ মূল্যের টিকিট কেটে দেখে এসো, নিজেরা দেখ, বন্ধুবান্ধবদের দেখতে প্ররোচিত করো, জীবিত অবস্থায় পার্টি দফতরের এক নিভৃত কোণে তিনি যখন নীরবে নির্দেশিত করণীয় সংকল্প করে যেতেন, কারও ঠাহর হয়নি তিনি কত বড় কাজের মানুষ ছিলেন, চলচ্চিত্রটির কল্যাণে এখন তা প্রতীয়মান হচ্ছে। এই নবলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে, জনে-জনে কচিকাঁচাদের ধরে নিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। চলচ্চিত্রের দীপ্তিতে প্রজ্জলিত এই চরিত্রটি আমাদের দলভুক্ত সৈনিক ছিলেন। আমরা ফ্যালনা নই। 

প্রয়াণেও নিশ্চিন্তি নেই, সুবোধ রায় ব্যবহৃত হয়েই যাচ্ছেন। কী আর করা, বাজারের প্রয়োজন, বাজারই নাকি শেষ কথা বলে। 

সৌজন্য:

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪১৯ বুধবার ২১ নভেম্বর ২০১২

http://archives.anandabazar.com/archive/1121121/21edit3.html

20200821

১৬’র ভোটে আঁখি-সৌজন্যে মমতার ৩৮ভিডিও ভাইরাল

 


‘আকর্ষণীয় কথা, সুন্দর সুর দিয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া গান, সঙ্গে ছোট ছোট ভিডিও-এই প্যাকেজ খুব সহজেই ভাইরাল হতে পারে। তা ব্যবহার করেই মমতা ব্যানার্জির পাঁচ বছরের সরকারের রিপোর্ট কার্ড মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। মানবিক আবেদনের স্টোরি। এরকম ছোট ছোট ভিডিও ফেসবুক জুড়ে দারুণ ছড়িয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেস এমন ৩৮টি ভিডিও ছেড়েছিল ফেসবুকে, যা ভাইরাল হয়েছিল।’

এটা তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণের রিপোর্ট নয়। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর কয়েকঘন্টার মধ্যেই এই প্রতিবেদন লিখেছিলেন আঁখি দাস। ১৯ মে একটি সর্বভারতীয় নিউজ পোর্টালে তা প্রকাশিত হয়।

ফেসবুকের মত শক্তিশালী, গোটা বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যমের ভারতের অন্যতম শীর্ষ কর্ত্রী একটি রাজনৈতিক দলের ভোটে জেতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখছেন তা! এখানেই থামেননি, এমনকি যেভাবে নির্বাচনী নির্ঘন্ট প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছিল, সর্বোপরি তৃণমূলের ‘মুখ’ আছে, তাদের যোগ্য ‘নেতা’ আছে তাও বেমালুম লিখেছিলেন এই ফেসবুক কর্ত্রী। তবে শাসক তৃণমূলের একটি মহলের দাবি, যে ৩৮টা ভিডিও ভাইরাল করা হয়েছিল, যেভাবে প্রচারের সুর বেঁধে দেওয়া হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষত ফেসবুকে, তাতে দলেরই বিধায়ক মন্ত্রীর এই পুত্রবধূর ‘ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ।

ফেসবুকের ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাস। ২০১৩ সাল থেকেই ফেসবুকে বিজেপি-আরএসএসের ঘৃণ্য প্রচারকে ‘অনুমোদন’ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধেই। সেই তিনিই একটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে শাসক দলের হয়ে প্রতিবেদন লিখছেন, এমনকি কীভাবে ফেসবুকে দ্রুত ভাইরাল হয়েছে তৃণমূলের প্রচার ভিডিও, তারও বর্ণনা দিচ্ছেন।


বিজেপি সখ্যতার অভিযোগ, তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ একজনের বিরুদ্ধেই! একই সঙ্গে বিজেপি’র ঘৃণ্য বিষাক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সামাজিক মাধ্যমে একাধিক পোস্ট কে ‘মুছে দেওয়া’, আরএসএসের হিংস্রতার ছবিকে ‘মুছে’ দেওয়া এমনকি নির্দিষ্ট পোস্টের ‘রিচ’ পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে দেওয়া, সব আসলেই একই খাতে বইছে। বিজেপি’র সঙ্গে সখ্যতা তৃণমূলের পক্ষে প্রচারে কোন ‘বাধা’ হয়নি!

আঁখি দাসের বিজেপি যোগের পাশাপাশি তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার চিত্র গণশক্তি সামনে এনেছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে সব মহলে। যদিও তৃণমূলের তরফে সরকারিভাবে এদিন রাত পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা হয়নি।

সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র এই প্রসঙ্গেই এদিন ট্যুইটে বলেন ‘‘সংঘ পরিবারের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক, সংঘ ‘দেশপ্রেমিক’ ও তিনি ‘মা দূর্গা’ এই যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে আসে। সংঘ পরিবার বিজেপি ও তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রন করে। মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি’র মধ্যে তরজা ভাই-বোনের ঝগড়া। সংঘ নিয়ে তিনি নিশ্চুপ। কারণ একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র কর্তা আরএসএস’’

আঁখি দাস মাইক্রোসফ্টেরও ভারতের পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর, একেবারে শীর্ষস্তরের পদে ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। সেই সময়তেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার, মূলস্রোতের মিডিয়ায় প্রচারের ভাষ্য, রুপরেখাকে চোহারা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আরো একজন। তাঁর নাম সাবির ভাটিয়া। হটমেল’র অন্যতম সহ প্রতিষ্ঠাতা। সাবির ভাটিয়া কর্ণধার থাকাকালীনই ১৯৯৮ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে মাইক্রোসফ্ট ‘হটমেল’ কিনে নেয়। যদিও পরবর্তীকালে মাইক্রোসফ্ট থেকে বেরিয়ে ই-কমার্স ফার্ম তৈরি করেন এই উদ্যোগপতি।

কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারে বৃহৎ সংস্থা, বহুজাতিক কর্পোরেশন যে স্বেচ্ছাশ্রম দেয় তা বারেবারেই এদেশে একাধিক ঘটনাপরম্পরায় সামনে এসেছে।

একজন শিক্ষাবিদের পাশাপাশি আঁখি দাসের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হস্তক্ষেপে একেবারে শেষমুহুর্তে ২০১১ সালে রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই পান। প্রথমবার জিতেই মন্ত্রীও হন। তাতেও ফেসবুকের এই প্রবল ক্ষমতাশীল কর্ত্রীর যথেষ্ট ভূমিকা আছে বলেই জানা গেছে খোদ তৃণমূল সূত্রে। রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের পূত্রবধূ হলেন আঁখি দাস। এদিন যদিও বারেবারে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। রবিরঞ্জন দাসের পুত্র কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ আমলা, বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কে ডেপুটেশনে আছেন। আরএসএস যোগাযোগ স্পষ্ট। আঁখি দাসের দিদি রশ্মি দাস প্রকাশ্যেই নিজের আরএসএস ঘনিষ্ঠতার দাবি করেন। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ফেসবুকের মত সামাজিক মাধ্যমের অন্যতম শীর্ষ কর্ত্রী সেই রাজনৈতিক অবস্থানকে ব্যবহার করছেন ফেসবুক পরিচালনায়,  তা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে ফেসবুকের অভ্যন্তরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ‘ব্যবসার ক্ষতির’ অজুহাতে ফেসবুক ইন্ডিয়ার বিজেপি’ সখ্যতা নিয়ে। শুধু তাই , বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফেসবুকের কর্মীরা সংস্থার অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট ফোরামেই চিঠি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আদৌ সংস্থার নিজস্ব নজরদারির প্রক্রিয়া কী মেনে চলছে? এমনকি মুসলিম বিরোধী ঘৃণা প্রচারকে যেভাবে সঙ্গত দেওয়া হচ্ছে তাতেও ক্ষোভ, যন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন খোদ ফেসবুকের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা।

ফেসবুকে বিজেপি, আরএসএসের উগ্র, বিষাক্ত প্রচারকে বাড়তি ‘সুরক্ষা’ দেওয়া ব্যবসার স্বার্থে- তা মূলত ২০১৩ সাল থেকেই বেশিরকম ভাবে সামনে আসতে শুরু করে। ভারতে ফেসবুকের পলিসি সংক্রান্ত প্রধানের দায়িত্বে আঁখি দাস যোগ দেন ২০১১ সালের অক্টোবরে। ২০১৪ সাল থেকে ফেসবুকের মত সর্ববৃহৎ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মাধ্যম স্পষ্টতই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ শুরু করে। 

গণশক্তি, ২১ আগস্ট, ২০২০

 

20200820

বিজেপি’র ফেসবুক ঘনিষ্ঠতায় যোগসূত্র রয়েছে তৃণমূলেরও

 


ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস’র আঁতাত ফাঁস করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। প্রতিবাদ সব মহল থেকে হলেও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব তৃণমূল সুপ্রিমো মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

তৃণমূলের এই হিরন্ময় নীরবতা রহস্যজনক। তবে রামমন্দির থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ—  দেশের যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূলের নীরবতা আসলে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, বারেবারে তা স্পষ্ট হয়েছে।

এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না!

এবার সেতু হয়ে উঠলেন সেই আঁখি দাসই।

নিজেদের নিয়ম, অবস্থানকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজেপি নেতাদের উগ্র ঘৃণার প্রচার ‘ব্যবসা ও শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্ক’র খাতিরে ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়ে চলেছে, অভিযোগের তীর আঁখি দাসের দিকে।

আঁখি দাস ভারতে ফেসবুকের অন্যতম কর্ত্রী, ফেসবুকের ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর। তাঁর দিদিও রশ্মি দাস আরএসএস’র ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে একটি এনজিও’র কর্ত্রী, যা দিল্লিতে আরএসএস’র একটি ভবন থেকেই চলে।

তবে এখানেই দাঁড়ি টানা যাচ্ছে না আঁখি দাসের পরিচয়-বৃত্তান্তের।

২০২০ সালে ফেসবুকের নাগপুর-করণের এই বিতর্কের অনেক, অনেক আগেই ২০১১ ও ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচনে এরাজ্যে তৃণমূলের হয়ে নির্বাচনী প্রচার লড়াইয়ে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আঁখি দাস। ২০১৬’র নির্বাচনে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে প্রচারেও ‘মেঘের আড়াল’ থেকেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলেন আঁখি দাস। এমনকি এরাজ্যের একটি বিধানসভা নির্বাচনী কেন্দ্রে সশরীরে হাজির থেকে তৃণমূলের ‘ওয়ার রুম’র তদারকি করেছিলেন আঁখি দাস।

আঁখি দাসের শ্বশুরমশাই এরাজ্যের শাসক তৃণমূলের দু’বারের বিধায়ক, একবারের মন্ত্রী। ভারতে ফেসবুকের পলিসি সংক্রান্ত প্রধান, প্রবল ক্ষমতাধর আঁখি দাস রাজ্যের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ। শাসক তৃণমূলের অন্দরে অনেক বিষয়ে খবর রাখেন এমন মানুষজনও জানেন, আঁখি দাসের প্রভাব প্রথমবারের বিধায়ককে মন্ত্রী হতে সাহায্য করেছিল।

রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রের বিধায়ক। ২০১১ সালে এই কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে হারিয়ে তিনি জিতেছিলেন। এই প্রসঙ্গে সামনে আসতেই পারে কেন্দ্রীয় সরকারের এক উচ্চ পদস্থ আমলার কথা। তিনি সৌম্য চট্টোপাধ্যায়। আঁখি দাসের স্বামী। সৌম্য চট্টোপাধ্যায় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি পরে জেএনইউ। প্রেসিডেন্সিতে ১৯৮৬সালে ভর্তি হয়েছিলেন। শোনা যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের আরএসএস’র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি’র প্রথম ইউনিট তৈরি হয়েছিল তাঁরই হাত দিয়ে, যদিও এখন সেই সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। জেএনইউ’তে আঁখি দাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং বিদেশে যাত্রা। পরে বিবাহ। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লি থেকে এসে বেশ কিছুদিন বর্ধমানে নিজের বাড়িতেই ছিলেন সস্ত্রীক। বর্ধমান শহরের শাসক তৃণমূলের কর্মী, সংগঠকরাও জানেন, বাবার ভোটে পিছনে থেকে ওয়ার রুমের দায়িত্ব কীভাবে সামলেছিলেন এই কেন্দ্রীয় উচ্চ পদস্থ আমলা। মিডিয়া সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন আঁখি দাস।

তখন আঁখি দাস মাইক্রোসফট-এর ভারতের পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর, একেবারে শীর্ষস্তরের পদে ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ২০১১’র শেষদিকেই তিনি ফেসবুকে যোগ দেন। ২০১১ সালে অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রথমে ফেসবুক ইন্ডিয়া এবং পরে সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর হন। ২০১১ সালের নির্বাচনে দক্ষিণ বর্ধমান কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার সামলেছেন আঁখি দাস নিজেই। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও সৌম্য চট্টোপাধ্যায় এবং আঁখি দাস ওই কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারের সময় ছিলেন বর্ধমানেই। ২০১৬ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় শাসক তৃণমূলের প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনায় সাহায্য পরামর্শও দিয়েছেন।

কমিউনিস্টবিরোধী ঘৃণার প্রচার ফেসবুকে অহরহ চলছে। মূলত বিজেপি’র আইটি সেলের কারিগর। এরাজ্যে পিছিয়ে নেই তৃণমূলের আইটি সেলও। রহস্য এটাই, সেই বিকৃত উগ্র ঘৃণার প্রচারও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘রিপোর্ট’ করার পরেও অবিকৃত থেকে যায়।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত ১৮ আগস্টের প্রতিবেদনে ফাঁস করেছে রহস্য উন্মোচনের সেই তথ্য। ভারতে ফেসবুকের পলিসি মেকাররা গুরুতরভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ফেসবুকের পোস্টে নজরদারির জন্য সংস্থার নির্দিষ্ট কাঠামো আছে, টিম আছে যারা নজরদারি রাখে। তেলেঙ্গনার বিজেপি নেতা টি রাজা সিং’র মুসলিম বিরোধী মন্তব্য এমনকি ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুলি করে মারার’ মতো মন্তব্য পোস্ট করেন। ভারতে নজরদারি রাখার জন্য ফেবসুকের সেই টিমের তরফে এবিষয়ে নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ জানানো হয় যথাযথ স্থানে। এই ঘৃণার মন্তব্য মুছে দেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ফেসবুক অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবেই বাতিল করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকি ফেসবুকের নিয়ম অনুযায়ী ওই ব্যক্তিকে ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ বলে চিহ্নিত করার কথাও বলা হয়। যদিও তা খারিজ করে দেওয়া হয়। বরং নজরদারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভারতে ফেসবুকের অন্যতম কর্ত্রী জানিয়ে দেন, বিজেপি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। পলিসি সংক্রান্ত প্রধান আঁখি দাস তাই পোস্ট মোছার অনুমোদন দেননি, ‘ব্যবসা ও শাসক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হবে’- এই অজুহাতে।

একাধিক বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও আঁখি দাসের ছবি দেখা গিয়েছে। এমনকি খোদ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে কোভিডের জন্য ‘মুসলিমদের বাড়তি দায়িত্ব পালন করা উচিত’র মতো সূক্ষ্ম বিষাক্ত প্রচারও শেয়ার করতে দেখা গেছে। এমনকি, তাঁর যমজ বোন, প্রাক্তন এবিভিপি নেত্রী রশ্মি দাসের লেখাও তিনি শেয়ার করেছেন নিজের ওয়ালে। নরেন্দ্র মোদী ডট ইন-এ তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আবার ২০১৬সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরে মমতা ব্যানার্জির গদগদ প্রশংসা করে লিখেছেন একটি সর্বভারতীয় নিউজ পোর্টালে। 

ভারতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব বেআব্রু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদের সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির সম্ভবত হাত-পা বাঁধা।

আঁখি দাস শাসক তৃণমূলেরও ঘনিষ্ঠ, এবার সামনে এল সেই ছবিই। আঁখি দাসের ‘সাহায্য ও পরামর্শ’ ২০২১ সালের নির্বাচনেও মমতার গোপন তাস হতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

গোপনে বা প্রকাশ্যে তৃণমূল-বিজেপি’র রাজনৈতিক বোঝাপড়া এই বাংলার মানুষের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে ঘটনা পরম্পরায়। এবার ফেসবুকেও সেই বোঝাপড়া!

ভারতে ফেসবুক কর্ত্রীর বিজেপি ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি তৃণমূল সখ্যের ছবিও এবার সামনে এল। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপের রাজনৈতিক নিরপেক্ষ অবস্থানের ওপর সংশয়ের অন্ধকার আরও গাঢ় হলো।

 

গণশক্তি, ২০ আগস্ট, ২০২০

 

ফোটো ক্যাপশন: ২০১৪ সালের ৫মার্চ লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতা টাউনহলে ফেসবুকের একটি অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আঁখি দাস। ছবিটি আঁখি দাসের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া হয়েছে।