20201119

বিজেপি-কে হারাতে গেলে তৃণমূলকে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করতে হবে: সীতারাম ইয়েচুরি

 


তৃণমূলের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, লড়াই না করলে লাভবান হবে বিজেপি-ই। পশ্চিমবঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির এটিই বাস্তবতা। বুধবার গণশক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবাশিস চক্রবর্তী। 

গণশক্তি: সদ্যসমাপ্ত বিহার নির্বাচনের শিক্ষা কী?

ইয়েচুরি: বিহার নির্বাচন থেকে অনেকগুলি কার্যকরী শিক্ষা আমরা নিতে পারি। প্রথম কথা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সম্ভাব্য বৃহত্তম ঐক্য গঠন করা গিয়েছিল। তা বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরজেডি-কংগ্রেস মহাগটবন্ধনের সঙ্গে বামপন্থীরা সামিল হয়েছিল। তিন বামপন্থীদলের এই যোগদান বিহারের নির্বাচনী প্রচারের চিরায়ত ধারাকে বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রশ্ন সামনে এসেছে। মানুষ সাড়া দিয়েছেন। বিশেষ করে বেরোজগারীর প্রশ্নে যুবকদের সাড়া পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, সারা দেশই জানে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থীরাই সবচেয়ে জোরদার কণ্ঠ। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে বামপন্থীদের বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। তার প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ভোট এক জায়গায় পড়েছে। আমরা প্রচারে বলেছিলাম বিজেপি-কে পরাস্ত করা বিহারের পক্ষে জরুরী, ভারতের পক্ষে জরুরী। বাস্তবে বিজেপি-জেডি(ইউ) জোট শেষ পর্যন্ত মাত্র ০.০৩ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। বিজেপি যে অপরাজেয় নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে।

গণশক্তি: পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যেই হবে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে কথাবার্তা শুরুও হয়ে গেছে। সিপিআই(এম)-র রাজনৈতিক রণকৌশল কী হবে?

ইয়েচুরি: সিপিআই(এম)-র পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক রণকৌশলগত লাইন নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বিজেপি-কে পরাস্ত করা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার থেকে তাদের অপসারণ করা। পশ্চিমবঙ্গেও প্রাথমিক লক্ষ্য বাংলা ও ভারতের স্বার্থে তাদের পরাস্ত করা। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এই লক্ষ্য পূরণ করা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেসকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, পরাস্ত করতে হবে। তৃণমূল বাংলায় বিজেপি-কে প্রবেশের রাস্তা করে দিয়েছে। তাদের ওপরে নির্ভর করেই বিজেপি বাংলায় পা রেখেছে। তৃণমূল বিজেপি-র সঙ্গে আঁতাত করেছিল, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এনডিএ সরকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে শূন্য।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে গভীর জনঅসন্তোষ রয়েছে। তৃণমূলের হিংসা ও শাসানির রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। কেউ যদি বলেন বিজেপি-কে পরাস্ত করতে তৃণমূল সহ সকলকে নিয়ে চলতে হবে তা হবে আত্মঘাতী। সেক্ষেত্রে সমস্ত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, শাসক দলের বিরোধী ভোট বিজেপি-র কাছে চলে যাবে। এই ধরনের কৌশল বিজেপি-র জয়কেই উলটে নিশ্চিত করবে। বাংলায় প্রয়োজন বিজেপি-বিরোধী, তৃণমূল-বিরোধী সমস্ত ভোটকে সর্বোচ্চ সম্ভব এক জায়গায় জড়ো করা। এই লক্ষ্য নিয়েই চলার কথা সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গণশক্তি: কোনো কোনো মহল থেকে কথা উঠছে ‘প্রধান শত্রু’ কারা। সিপিআই(এম) তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার করায় বিজেপি-র সুবিধা হচ্ছে। কীভাবে এই প্রশ্নকে আপনি দেখছেন?

ইয়েচুরি: প্রধান শত্রু বিজেপি। সারা ভারতেই এবং বাংলায় প্রধান শত্রু বিজেপি। রণকৌশলের মুখ্য প্রশ্ন হল এই শত্রুকে আমরা কীভাবে হারাতে পারি। আমি আগেই বলেছি, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, প্রচার না করলে শাসক-বিরোধী ভোটের একটাই রাস্তা খুলে যাবে। তা হলো ভোট চলে যাবে বিজেপি-র কাছে। যে লক্ষ্যের জন্য আমরা কাজ করব, সেই লক্ষ্যই পরাস্ত হবে। এমন কোনো কৌশল নিলে বিজেপি-ই লাভবান হবে।

বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই চায় দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি ভাষ্য তৈরি হোক। হয় বিজেপি, না হয় তৃণমূল। উভয় শক্তিই এই মেরুকরণকে মদত দিচ্ছে। যাতে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্য জায়গা না থাকে। এই দ্বিমেরুর আখ্যানে শেষ পর্যন্ত লাভ হবে বিজেপি-র। জনগণ কোনো বিকল্প না পেলে বিজেপি-র দিকে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নীতি জনস্বার্থবিরোধী। বিজেপি-র নীতি থেকে তা পৃথক নয়। উভয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই তৃতীয় এবং নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি হবে।

গণশক্তি: এমন কথাও কেউ কেউ বলছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেশি মনোযোগ দেয়।

ইয়েচুরি: পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হবে না?  সরকার তৃণমূলের। জনগণের জীবনজীবিকা, তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার জন্য লড়াই চলছে। মানুষের বিক্ষোভকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করছে সিপিআই(এম) ও বামপন্থীরা। কিন্তু শুধু রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে, এটি বাজে কথা। কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করছে সিপিআই(এম)। লকডাউনের সময়ে লড়াই কার বিরুদ্ধে হয়েছে? ২৬নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে? রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারীকরণ, শ্রম আইনে শ্রমিক-বিরোধী সংশোধনী, নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই হচ্ছে। মোদী সরকারের গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ, সংবিধানকে ধ্বংস করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) একটানা লড়াই চালাচ্ছে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে না বলা একেবারেই অসত্য, বিভ্রান্তিকর কথা।

বিপদের কথা আগেই বলেছি। বিজেপি এবং তৃণমূলকে আমরা এক করে দেখছি না। দেশের কোনো রাজনৈতিক দলকেই বিজেপি-র সঙ্গে এক করে দেখা যায় না। বিজেপি সংবিধান ও সাধারণতন্ত্রের কাঠামোকেই ভেঙে দিতে উদ্যত। কিন্তু তৃণমূলের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের মোদী সরকার উভয়ের বিরুদ্ধেই সিপিআই(এম) লড়ছে।

গণশক্তি: পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে কীভাবে দেখছে সিপিআই(এম)? বিশেষ করে বাংলার পূর্ব ইতিহাস এবং জনবিন্যাসের প্রেক্ষিতে?

ইয়েচুরি: বাংলায় দেশভাগের সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, অত্যন্ত বিষাদময় ও নৃশংস ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে হয়েছে বাংলার মানুষকে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনেও গান্ধীজী কলকাতায় অনশন করছিলেন। নোয়াখালির বর্বর দাঙ্গার জন্য তিনি যেতে চেয়েছিলেন। যেতে দেওয়া হয়নি। তিনি লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ পতাকা তুলতে যাননি, কলকাতায় অনশন করছিলেন। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ক্ষত গভীর ভাবেই বাংলার মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্টরা ও বামপন্থীরা দীর্ঘ সময় তা সংযত করে রাখতে পেরেছে, এমনকি অনেকাংশে মুছেও দিতে পেরেছে। অর্ধশতক ধরে বাংলায় আন্দোলন-সংগ্রাম, জীবনজীবিকার লড়াই, প্রগতিশীল রাজনীতি, সাংস্কৃতিক প্রবাহ সেই ক্ষত মুছতে সাহায্য করেছে। সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পেয়েছেন। বাবরি মসজিদের সময়ে গোটা দেশে দাঙ্গা হলেও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বাংলায় আশ্রয় নিয়েছেন। গোটা দেশে যখন সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার অভাবে ভুগেছেন, তখন বাংলায় সংখ্যালঘুরা জীবনজীবিকা উন্নত করার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির জোর হিসাবে কাজ করেছে সাম্প্রদায়িক সংহতি। এই যে নিরাপত্তাবোধ তা কোনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে মদত দিয়ে পাওয়া যাবে না। বিজেপি চেষ্টা করছে অতীতে ফিরে গিয়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে জাগিয়ে তোলার। বাংলায় ওদের প্রচারের অন্যতম উপাদানই তাই। সিপিআই(এম) দৃঢ় ভাবে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়ে থাকবেও।

গণশক্তি: সিপিআই(এম) ও বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ায় যাচ্ছে। এ কি কেবল ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যে?

ইয়েচুরি: প্রথম কথা সিপিআই(এম) কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ায় যাচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। সিপিআই(এম)-র দেশব্যাপী অবস্থানই হল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো, সাধারণতন্ত্র রক্ষায় যে-সমস্ত শক্তি ইচ্ছুক, তাদের ঐক্য গড়ে তোলা। একেক রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তার চেহারা স্থির হবে। সিপিআই(এম) কারোর অধীনস্থ নয়, কারোকে আমাদের অধীনস্থ হতেও বলছি না। বিহারের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আরজেডি-কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের ঐক্য হয়েছে। তামিলনাডুতে আমরা ডিএমকে-র সঙ্গে ঐক্য গঠন করব। পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ঐক্য গঠনের আলোচনাই চলছে। বিজেপি-বিরোধী, তৃণমূল-বিরোধী শক্তিগুলির ঐক্য গঠনের প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। একে শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য বলে দেখা উচিত নয়। এই হল সিপিআই(এম)-র অবস্থান।

***********

গণশক্তি, ১৯ নভেম্বর, ২০২০

20201118

Soumitra Chatterjee on Jyoti Basu

 ‘‘A magnetic personality’’

(published in Frontline, Volume 27, Issue 3, January 30-February 12, 2010) 



জননেতা জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের পর তাঁকে নিয়ে ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকার একটি সংগ্রহে রাখার মতো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রতিটি লেখাই পাঠককূলের কাছে রসোত্তীর্ণ বিবেচিত হবে। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, এই সংখ্যাতেই জ্যোতি বসু সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি অনবদ্য স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হয়েছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি করেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সৃহৃদশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। স্মৃতিচারণাটির একটি আকর্ষণীয় অংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরলাম। পুরোটা পড়তেই সবাইকে অনুরোধ করবো। 

‘‘স্নেহাংশু আচার্য ছিলেন জ্যোতি বাবুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। তাঁরা বিলেতে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন। এদিকে স্নেহাংশু আচার্য আবার সম্পর্কে আমার কাকা হন। উনি ছিলেন খুবই হাসিখুশি মানুষ। কলকাতায় একবার চলচ্চিত্র উৎসবের সময় ওনাকে দেখে আমি ছুটে গেলাম, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উনি আমাকে কলকাতা ক্লাবে ডিনারে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি কী করে যাই, জ্যোতিবাবু, উনি তখন মুখ্যমন্ত্রী, তখনও এসে পৌঁছাননি।


আমি কাকাকে সেকথা বোঝাবার চেষ্টা করছি, সেসময় জ্যোতিবাবু এসে পৌঁছলেন। কাকা সমস্ত রকম প্রোটোকল ভেঙে তাঁকে ডেকে বললেন, ‘‘এই যে জ্যোতি, একবার এদিকে এসো।’’ জ্যোতিবাবু কাকার উচ্ছ্বাস আর হাবভাব দেখে হেসে বললেন, ‘‘আচ্ছা, আসছি, আসছি!’’ ওঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। জ্যোতিবাবু যখন আমাদের কাছে এলেন, তখন কাকা আমাকে দেখিয়ে বললেন, দ্যাখো জ্যোতি, এর কোন কারণ নেই যে (তুমি এসেছো বলে) এই ছোকরাকে হাসিহাসি মুখ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি ওকে ডিনারে নিয়ে চললুম। তোমাকেও ইনভাইট করছি, কিন্তু আমি জানি, তুমি এখন যেতে পারবে না।’’ 

এটা শুনে জ্যোতিবাবু হাসতে শুরু করলেন এবং আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘‘যাও, যাও, এখানকার চেয়ে ওখানে খাবার অনেক বেশি ভালো।’’

 


“One of Jyoti Babus closest friends was Snehangshu Acharya. They studied together in England. Snehangshu Acharya was an uncle of mine. He was a very jolly man. During one of the film festivals in Calcutta, I ran into him and he immediately wanted to take me away to have dinner in Calcutta Club. But I could not leave, as Jyoti babu, who was by then the Chief Minister, had not yet arrived. 

As I was trying to explain this to my uncle, Jyoti Basu walked in. Breaking all protocol, my uncle called out to him, Hey, Jyoti come over here. Jyoti babu was smiling at his exuberance and gesturing, Yes, I'm coming, I'm coming. They were the best of friends. When he walked up to us, my uncle said, Jyoti, there is no point in this boy hanging around here with a fixed smile on his face. I'm taking him out for dinner. I would have invited you, too, but I know you cant leave now.

At which Jyoti Basu laughed and, turning to me said, Go on, the food is much better out there than here.” 

(As told to Suhrid Sankar Chattopadhyay)

 


Courtesy: 

https://frontline.thehindu.com/other/article30179261.ece

 

20201115

এখনও বিশ্বাসও করি, বামপন্থাই বিকল্প

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 


ছেলেবেলার বন্ধু বেণুর কথা খুব মনে পড়ে আজকাল। এই অস্থির সময়ে ওর মুখ বেশি ভাসে চোখে। কৃষ্ণনগরে এক পাড়ায় থাকতাম। আমার ফজলু কাকার ছেলে বেণু। বেণু রহমান। বেণু হিন্দুর থেকেও বেশি হিন্দু ছিল। ওঁর নিয়মকানুন মানার ঠেলায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। আবার আমায় বলত, পুলু, তুমি এ সব একটু মানো। আমি ধমক দিতাম ওকে। মনে পড়ে রূপচাঁদ জেঠুর (রূপচাঁদ তপাদার) কথা। দুর্গাপুজোয় বাড়ি গিয়ে কেন দেখা করলাম না, সে জন্য জেঠুর সে কী বকুনি! জেঠু ছিলেন খ্রিস্টান।

বাড়িতে বড়রা এলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাই রেওয়াজ ছিল। বাবার বন্ধুরা এলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিস্টানওসব কোনও বাছবিচার ছিল না। ছেলেবেলায় সাম্প্রদায়িকতা শব্দটা শুনিনি এমন নয়। তবে আর পাঁচটা শব্দের মতোই আমাদের কাছে সাধারণ এক শব্দ ছিল মাত্রকোনও বিশেষত্ব ছিল না। ফলে মাথায় গেঁথে যায়নি। বা গেঁথে যাওয়ার মতো পরিবেশও তৈরি করা হয়নি তখন। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় নদীয়া জেলার কোথাওই কোনও প্রভাব পড়েনি। কৃষ্ণনগরেও না। এখন সত্যিই খুব হতাশ লাগে। আমার চেনা দেশ এখন কোন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আদৌ সেই অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না জানি না। আমি চেনা ছন্দে আমার দেশকে আর দেখতে পাব কি না, তা-ও জানি না।

ছেচল্লিশে আমি অনেকটাই ছোট। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, সে সব বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি। কলেজে ঢুকে যাওয়ার পর আর হিন্দু-মুসলমান বলে আমাদের কাছে আলাদা কিছু ছিল না। একটা বিষয় আমায় বরাবরই খুব নাড়া দেয়, জিন্নার কল ফর পাকিস্তানমুসলমানদের অধিকাংশকে এতটা আকর্ষণ করতে পেরেছিল কেন? ভীষণভাবে মনে হয়, তখন বেশিরভাগ জমিদারই ছিলেন হিন্দু আর প্রজারা মূলত মুসলিম। ফলে নিপীড়িত হয়েছেন তাঁরাই। তখন ভেবেছিলেন, পৃথক রাষ্ট্র হলে এই সমস্যাগুলি মিটবে। পাকিস্তানে হিন্দু শাসন বা হিন্দু পীড়নের প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়েছে, এই ধারণা আদপে কত ভুল। তাই আরেকবার মুক্তির লড়াই করে ৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হয়েছিল।

আজ আশ্চর্য হই, যে শত সহস্র উদ্বাস্তু পূর্ব বাংলা থেকে এসেছেন, তাঁদের তো মুসলমানদের উপর রাগ আছেই, কিন্তু এখন এপার বাংলার মানুষদের যেন মুসলিমদের উপর রাগ আরও বেশি। পুব বাংলা থেকে আসা মানুষদের রাগের মধ্যে অভিমানও যেমন আছে, ভালোবাসাও আছে। একসঙ্গে থাকতেন। ছেড়ে আসতে হয়েছে। সেই অনূভূতি আছে। আবার মুসলমানরা যেমন তাঁদের উপর হামলা চালিয়েছে, তেমনই রক্ষাও করেছেএমন ইতিহাসও আছে। ফলে ওপার বাংলা থেকে চলে আসা মানুষদের কাছে প্রতিক্রিয়াটি মিশ্র। কিন্তু এখনকার যে প্রজন্ম সে সব দিন দেখেনি, শুধু গল্পই শুনেছে, তাঁদের মধ্যে উগ্রতা যেন বেশি। কিংবা উগ্রতা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোয় কোনও ধর্মের ভেদাভেদ ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশী, যিনি যে ধর্মেরই হোক না কেন, আমাদের বাড়ির পুজোয় আসতেন। অংশ নিতেন। তবে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ত, মুসলিমরা যত হিন্দুদের বাড়ি যেতেন, হিন্দুরা তত যেতেন না মুসলমানদের বাড়ি। সে দিক থেকে আমি বলব, হিন্দুরা অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। এখন তারই উগ্র চেহারা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের বাড়িতে এমনিতেই ধর্মবিরোধী মনোভাব ছিল।

ভাবলে অবাক লাগে, যাঁর আমলে ২০০২ সালে গুজরাটে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হলো, সেই তিনিই আজ ভারতবর্ষের মসনদে। ভারতবর্ষের মানুষ এদের সহ্য করছেন। তাঁদেরই ভোট দিয়ে আবার জেতাচ্ছেন। তার একটা বড় কারণ আমার মনে হয়, মানুষ শক্তিশালী কোনও বিকল্প পাচ্ছেন না। বা বুঝে উঠতেই পারছেন না। মহামারীতে এত মানুষ আক্রান্ত, এত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এককথায় দুঃসহনীয়। তার মধ্যেও রামের নামে চলছে রাজনীতি। মজার বিষয় হলো, যে রামের নামে মন্দির তৈরি হলো, সেই রামকে কিন্তু আমরা সকলেই ছেলেবেলা থেকে চিনি, জানি। শত সহস্র বছর ধরে রাম একইরকম জনপ্রিয়। রাম আমাদের চোখের সামনেই থাকেন। ভালোবাসা, অনুপ্রেরণার জায়গা। একটা কথা বলতে পারি। যে রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসে যান, সেই রাম কি এই বিপুল বৈভবের মন্দিরে থাকতেন? পিতৃসত্য পালন, বনবাস সবই যদিও কল্পকথা। এগুলি আসলে আমাদের জীবনে মূল্যবোধ তৈরি করে। মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে থাকে। কিন্তু সেই মূল্যবোধগুলো আসলে কোথায়? আমাদের সংস্কৃতিকেই আমরা অবহেলা করছি। আঁকড়ে ধরিনি ঠিকমতো।

আমার বিশ্বাস, বিকল্প কেউ হতে পারলে তা বামপন্থীরাই হতে পারেন। কিন্তু সেই দৃঢ়তা কোথায়? মানুষের মনে ভরসা তৈরি করতে পারছেন কোথায়? এই সময়েই খুব হতাশ হয়ে পড়ি। এই দেশ, এই সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বুঝতেই পারছি না। বিশ্বজুড়েই দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটছে। সব দেশের কথা বিস্তারিত জানি না। কিন্তু প্রশাসন চোখ বুজে না থাকলে এই অনাচার হতে পারে না কোথাও। এর প্রতিকার কীভাবে, সেটাই আমার জিজ্ঞাসা।


ধর্মের প্রভাব সব দেশের সব অংশের মানুষের মধ্যেই কম-বেশি আছে। কিন্তু ভারত
, পাকিস্তান, সৌদি আরবে ধর্মের গোঁড়ামি অত্যন্ত বেশি। সৌদি আরবের একজন মানুষকে বোঝানো খুব কষ্টকর যে, মুসলমান হওয়াই জীবনের সব নয়। আবার ভারতেও হাতে গোনা কয়েক জনকেই ধর্মনিরপেক্ষতা বোঝানো যায়। অধিকাংশই বুঝতে চান না। রামকে নিয়ে এই জায়গাতেই রাজনীতি চলছে। রাম যেহেতু প্রত্যেকের কাছেই এক অনুভবের ও ভালোবাসার জায়গায় আছেন, তাই হিন্দুত্ববাদীরা রামকেই ধরেছে নিজেদের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডা পূরণের জন্য। ওঁরা জানেন, রামকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হলেও কেউ বাধা দেবেন না। কারণ অধিকাংশই মনে করেন, রাম তো আমাদের নিজের লোক। আমি তো রামেরই ভক্ত। অত্যন্ত ধুরন্ধর মতলববাজ রাজনীতিকরা এ সব করে চলেছেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যেভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে, তা অত্যন্ত সংগঠিতভাবে। তাদের বিরুদ্ধে দেশে কী হয়েছে? যে রাজনৈতিক দলগুলি এতে বাধা দিতে পারত, তারা কোথায় ছিল? আমি বারবার সেই প্রশ্ন তুলব। মুখে বললেই হবে না। তাদের পতাকার তলায় লোককে জমায়েত করতে পারছে?

ভারতবর্ষের প্রকৃত চেহারা তো স্কুলের পাঠ্যবই থেকে পেয়েছি আমরাহিটলারের সময়ের জার্মানির সঙ্গে অনেকেই আজকের ভারতের তুলনা টানেন। কিন্তু আমি কিছুতেই সেই তুলনা করতে পারি না। অন্তত শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি, আর আমাদের দেশ একেবারেই বেনিয়াদের। তার মধ্যে কোনও তুলনা হয় না কি? তাদের বিশ্বজয়ের দরকার ছিল, তা না হলে মাল বেচতে পারবে না। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ এতই অমানবিক ছিল যে, পৃথিবীর মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমাদের দেশে এখন গোসেবক-গোরক্ষক এই সব নাম দিয়ে কাণ্ডকারখানা চলছে। গোমূত্র পান করলে করোনা সেরে যাবে, থালা বাজালে, বাতি জ্বালালে করোনা চলে যাবে, এগুলো ঘৃণ্য অ্যাজেন্ডা ছাড়া আর কিছু না। এই ভারতের আছে কি থালা বাজানো ছাড়া? তার আবার জার্মানির সঙ্গে তুলনা! অন্যের পিছন ধরে চলে। আর কাগজে লেখা হয়, ভারত একটা বিশাল ব্যাপার। বিশাল শক্তিশালী দেশ। কীসের জোরে এই কথাগুলি বলা হয়? নিজের তো কোনও জোরই নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এখন চীনবিরোধী কাজ চলছে। যা বলা হচ্ছে, প্রতিটি কথা চ্যালেঞ্জ করা যায়। চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে? আমেরিকা বা অন্য দেশ পাশে এসে না দাঁড়ালে ক্ষমতা আছে যুদ্ধ করার? চীনের দ্রব্য বর্জন তো আমাদের দেশের অর্থনীতিতে আরও প্রভাব ফেলছে। চীনের জিনিস কেনা বন্ধ হলে তো আমেরিকার জিনিস কেনাও বন্ধ করা উচিত। আমি বলব, চীন অতি নরমভাবেই দেখছে গোটা বিষয়টি।

৬০ বছর ধরে কংগ্রেস দেশ চালিয়েছে। কংগ্রেসের অনেক নেতাই দক্ষিণপন্থী মনোভাবাপন্ন। প্রকাশ্যে নয় ঠিকই, গোপনে। ইতিহাস খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। আমার মতে, বামপন্থীদের মূল্যায়নেও অনেক ঘাটতি থেকে গিয়েছে। গান্ধীজীর সঙ্গে আমাদের মতের অমিল ছিল বা আছেও। কিন্তু তাঁর রাজনীতির মধ্যে যে সততা ছিল, তা অস্বীকার করার নয়। আজকের রাজনীতিকদের কজনের আছে সেই সততা? এখন তা নতুন করে ভাবাচ্ছে। বামপন্থীরা তখন বলতে পারতেন তো, গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ আছে। এইটুকু বলার জায়গা থাকবে না? গান্ধীজী কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোনও আপস করেননি। ঘোর হিন্দু হয়েও তিনি মুসলিম-বিরোধী কাজকর্ম করেছেন, এ কথা কেউ বলতে পারবে না। ভারতবর্ষকে তিনি চিনতেন তাঁর মতো করেই। জওহরলাল নেহরুর কথাও বলতে হবে এ প্রসঙ্গে। অন্য অনেক বিষয়ে বিরক্তি থাকলেও এ কথা বলতেই হবে, নেহরুও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোনও আপস করেননি। আমি অন্তত সুভাষচন্দ্র বসুর থেকে বড় ধর্মনিরপেক্ষ কাউকে মনে করি না। ওঁর আইএনএ-র গঠন, কাজকর্ম দেখলে বোঝা যায়। আবার সুভাষ বসুর কাছেও ভারতের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কিন্তু গান্ধীই।

গান-বাজনার জগতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কদর কমে যাওয়াকে আমি দুর্ঘটনা বলে মনে করি। যাঁরা চর্চা করতেন, তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে হয় তো হিন্দু বা মুসলিম। কিন্তু আসলে তাঁরা শিল্পী। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এক মারাঠি ব্রাহ্মণ, নাম ভাস্কর বুয়া। তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখতে গেলেন আগ্রায়। সেখানে তো সব তাবড় তাবড় ওস্তাদরা থাকেন। তেমনই এক ওস্তাদজীর কাছে নাড়া বাঁধলেন। তো সেই ওস্তাদজী ভাস্কর বুয়াকে দিয়ে এক বছর ধরে শুধু গাড়ুতে জলই ভরাতেন। কতটা দিললাগিয়েছ, তার পরীক্ষা। কতটা ধৈর্য, কতটা সহ্যশক্তি, সে সবও পরীক্ষা করতেন। আগে দীক্ষা, তারপর শিক্ষা, তারপর পরীক্ষা। এক বছর ওভাবে ছিলেন বুয়া। একবারও ওস্তাদজী বলেননি, অমুক দিন থেকে শেখাব কিছু। একদিন বুয়া ঘর ঝাঁট দিচ্ছেন, হঠাৎ ওস্তাদজী বললেন, আমার খুব মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। মাংস নিয়ে আয় তো। মারাঠি ব্রাহ্মণ হয়ে মাংস কিনতে যেতে হবেভেবে তো কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন ভাস্কর বুয়া। কেউ দেখলে আর রক্ষে নেই। ওস্তাদজী বললেন, তুই এটুকু করতে পারবি না। তাহলে বাড়ি চলে যা। তোর আর তালিম নিয়ে কাজ নেই। উপায় না দেখে ভাস্কর বুয়া গেলেন মাংস কিনতে। ওস্তাদজীর পায়ের সামনে রাখতেই তিনি বললেন, রান্না করতে হবে। কড়াইয়ে মাংস চাপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাস্কর বুয়ার তখন এমনই অবস্থা যে, প্রায় উনুনের উপরই পড়ে যাবেন। শেষে ওস্তাদজী বললেন, কাল থেকে তোকে তালিম দেব।

আর আজ এই যে গোরু খাওয়া নিয়ে যা চলছে, কী প্রচণ্ড রাগ হয় বলে বোঝাতে পারব না। এত সস্তায় এই হাই প্রোটিন কোথায় পাওয়া যাবে? গোটা বিশ্ব গোরু খায়। সবচেয়ে বড় কথা, কে কী খাবে না খাবেতুমি (পড়ুন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা) বলে দেওয়ার কে? গোমাংস ভক্ষণে কোনও হিন্দুর আপত্তি থাকতেই পারে। কিন্তু সেই আপত্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? কে কী খাবে, তা-ও তুমি বলে দেবে! এ কোথায় নামছি আমরা! গো-মাংসের ছুতো করে মুসলমান মারা হচ্ছে। এই ছবি আগে ছিল না ভারতবর্ষের। আমাদের দেশ কী, দেশের ভিত্তি কী, সেই চেহারা তো পাঠ্যবই থেকেই জেনেছি।

মোদী যখন রামমন্দিরের ভিতপুজো করলেন, সে দিন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা নিয়ে খুব চর্চা শুরু হয়েছে, ‘দীনদানআমি সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বচ্ছন্দ নই। লোকমুখে শোনা। পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ সব সময়েই ভীষণ প্রাসঙ্গিক। এ কথা অস্বীকার করার নয়। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি জমিদার পরিবারের সন্তান না হতেন, জমিদারি সামলাতে রবীন্দ্রনাথকে যদি গাঁয়ে-গঞ্জে যেতে না হতো, তাহলে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই হতেন না। যুগ-যুগ ধরে ওঁর প্রাসঙ্গিকতা বিরাজ করত না। বাংলাদেশের মানুষকে এভাবে ভালোইবাসতে পারতেন না, যদি না তিনি জমিদারি সামলাতে যেতেন। শিলাইদহে গিয়ে ওঁর চোখ খুলে যায়। শহরের ছেলে হয়ে থাকলে চিনতেন কী করে দেশকে! দেশের জল-মাটি অনুভব করতেন কী করে! ভাবলেন, এই আমার দেশ। এখানে এত সমস্যা মানুষের! ব্রাহ্মবাড়ির ছেলে হওয়ায় ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি কখনওই ছিল না রবীন্দ্রনাথের। হিন্দুদের সঙ্গে বরং অনেক অমিলই ছিল। সেই সঙ্গে অবশ্যই ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব বড় কথা। মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করতে ইতালি চলে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু রোমা রোলাঁদের বকাবকিতে নিজের ভুলও বুঝেছিলেন। বিদ্যাসাগরের কথা বলব। তিনি নিজে সংস্কৃতের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়েও বেদ-বেদান্তের থেকে ইংরেজি সাহিত্য, বেকন পড়ানোর উপরই জোর দিয়েছেন।

শেষে বলব, গোঁড়ামি তৈরি করতেই চালাকি করে ধর্ম আর রাজনীতি মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কে রামকে ভালোবাসল, কে রহিমকেতা কোনও ব্যাপারই হতে পারে না। তাই বারবার মনে হয়, এসবের বিকল্প হতে পারে একমাত্র বামপন্থাই।

 

গণশক্তি শারদ ২০২০

 

 

 

 

20201108

সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিল নভেম্বর বিপ্লব

 


জ্যোতি
বসু

 

বছর সারা পৃথিবীতে মহান নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও মর্যাদার সঙ্গে আমরা মহান নভেম্বর বিপ্লবকে স্মরণ করবো।

অনেকেই এখন বলে থাকেন যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে যে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, সেই সোভিয়েতই তো এখন নেই! তবে নভেম্বর বিপ্লব দিবস উদ্যাপন, করার যৌক্তিকতা কোথায়? যারা এসব কথা বলেন, তারা আসলে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যে‍‌ দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি যে সাফল্য অর্জন করেছিল তাকেই খাটো করে দেখাতে চান। কার্ল মার্কস ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোঘোষণার মাধ্যমে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব রাষ্ট্র বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শকে প্রচার করেন। এই মতবাদের ভিত্তিতে পুথিবীর দেশে দেশে, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে সেখানকার শ্রমিকশ্রেণি প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে, যা প্যারি কমিউনহিসাবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। যদিও এই চেষ্টা সফল হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই বুর্জোয়াদের হিংস্র আক্রমণের ফলে প্যারি কমিউন’-এর পতন ঘটে। কিন্তু কমিউনার্ড-দের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা, সে সময় ইউরোপের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া জার্মান, হাঙ্গেরিসহ কয়েকটি দেশে শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।

১৯১৭ সালে জার শাসিত রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বেই প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়, যা নভেম্বর বিপ্লব হিসাবে পরিচিত। মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ মার্কসবাদের সফল সার্থক প্রয়োগ হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে। মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশ্তেহার রচনার সময় এবং পরে এই ধারণার কথা বলেছিলেন যে এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশেই আগে শ্রমিক বিপ্লব হবে। মার্কস-এঙ্গেলস যখন একথা বলেন, সে সময় পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। তখন এই ধারণাই সঠিক ছিলো। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পুঁজিবাদ, তার সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি গোটা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে লেনিন মার্কসবাদের সৃজনশীল বিকাশ সার্থক প্রয়োগ জারশাসিত রাশিয়ায় ঘটান। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে রাশিয়া অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের এই দুর্বলতম গ্রন্থিতেই শ্রমিকশ্রেণিকে আঘাত হানতে হবে। লেনিনের এই তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে বিপ্লবী আন্দোলনে নতুন পথনির্দেশ দিয়েছিল। এজন্য কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঘোষণা করেছিল, লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। এজন্য আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অনুসরণ করার কথা বলি।

শ্রমিকশ্রেণির প্রথম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখিয়ে দিয়েছিল যে সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদের থেকে অনেক উন্নত সমাজব্যবস্থা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলিও যে সমাধান করা সম্ভব, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গোটা পৃথিবীর সামনে তার উদাহরণ তুলে ধরে। পুঁজিবাদের চার শতাব্দীর ইতিহাসে যে প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব হয়নি, তা অল্প দিনের মধ্যেই করে দেখায় সমাজতান্ত্রিক শিশুরাষ্ট্র। রাশিয়া ছিল অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া। কিন্তু মাত্র ১৩ বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। যে সামাজিক সাম্য ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রশংসা বিশ্বের বহু মনীষী অকুণ্ঠভাবে করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের সময় রাশিয়ার চিঠি’-তে শুরুতেই লিখেছিলেন, ‘যা দেখছি, আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনও দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা জাগিয়ে তুলেছে।’’

বিশেষ করে জনশিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নভেম্বর বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই গোটা দেশজুড়ে শিক্ষা বিস্তারের বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শুধুমাত্র ইউরোপীয় অংশেই নয়, এশিয়ার অংশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পশ্চাৎপদ উপজাতিদেরও শিক্ষার অঙ্গনে টেনে আনা হয়েছিল। জাতিগঠনের প্রশ্নে শিক্ষার যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে তা সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও এই দিকটি নজর কেড়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যা নয়, তার সম্পূর্ণতায় তার প্রবণতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় নিকর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন কী বিপুল উদ্যম।’’

মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নেও সোভিয়েত ইউনিয়নই পথিকৃৎ। নারী পুরুষের জন্য পূর্ণ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরির অল্প দিনের মধ্যেই গৃহীত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নই বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যেখানে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নারী-পুরুষকে সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হয়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বলে অভিহিত গ্রেট ব্রিটেন এই অধিকার দেয় ১৯২৮ সালে।

জন্মলগ্ন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, অন্তর্ঘাত প্রভৃতি প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ দেশ থেকে অল্প দিনের মধ্যেই অগ্রসর দেশে পরিণত হয়। দ্রুত এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের মতো বিধ্বংসী শক্তিকে আটকাতে সক্ষম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যা পুঁজিবাদী দেশগুলির পক্ষে সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানব সভ্যতাকে রক্ষা করেছিল। কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে কখনই ম্লান করা যাবে না।

৭৪ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপর্যয় ঘটলো কেন নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের পার্টি সম্পর্কে ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কেশীর্ষক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাতে প্রশ্নের কিছু উত্তর আছে। আমি সে কথায় ‍‌রে আসবো।

একথা সকলেরই জানা যে, লেনিন রাশিয়ার বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করলেন তা ছিল একটি পশ্চাৎপদ দেশ। ফলে তাঁকে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলতে হয়েছিল কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা, দিক-নির্দেশ তাঁর সামনে ছিল না। তিনিই নয়া অর্থনৈতিক নীতি (NEP) চালু করেছিলেন, যে রাষ্ট্র বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যদিও আধিপত্য ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের।

আমরা কখনই ভাবতে পারিনি যে, একটা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পর তার আবার পতন হতে পারে এবং আবার সে দেশে পুঁজিবাদ ফিরে আসতে পারে। আমরা কেন, পৃথিবীর অনেক বড় কমিউনিস্ট পার্টিই তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু লেনিন বারে বারে আত্মসন্তুষ্টি পরিহার করার কথা বলেছিলেন। বিশেষ করে চারপাশে সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছিলেন। তিনি আমেরিকান পেশাদারি দক্ষতা থেকেও শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

রাশিয়ায় পরবর্তীকালে যে মতাদর্শগত চর্চার অভাব ঘটেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সে দেশে গিয়েও আমার নিজের বিষয়ে মনে হয়েছিল। প্রথম যাই ১৯৫৭ সালে। তারপর আরো কয়েকবার গিয়েছি। সাল মনে নেই, একবার সে দেশে গিয়ে ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণসাগর)- উপর দিয়ে একটা জাহাজে করে যাচ্ছিলাম। সেই জাহাজটি এক সময়ে হিটলারের জাহাজ ছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বাহিনী তা কবজা করে। প্রায় ২২০০ যাত্রী সেই জাহাজে ছিল। প্রায় সকলেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। জাহাজের মধ্যে খেলছে, সাঁতার কাটছে। কিন্তু দেখলাম কেউই খবরের কাগজ পড়ছে না। অথচ কাগজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপা হয়েছে। ওদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়েছে এবং রয়েছে এক রুশ মহাকাশচারীর প্রত্যাবর্তনের খবর। কিন্তু তাতেও ওদের কাগজ পড়ার আগ্রহ নেই। আমি এক দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ওদের খবরের কাগজ পড়ার আগ্রহ নেই কেন?’’ জবাবে সে বললো, ‘‘ওরা ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। তাই ওদের আগ্রহ নেই। ফিরে এসে কাগজ দেখবে। তাতে শুধু দেখবে ওদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা কিছু বাড়লো কি না।’’ তখন এই বিষয়টা নজরে এসেছিল। সবটা বুঝিনি আজ বুঝি প্রবণতাটা তখন থেকেই তৈরি হয়েছিল।

অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্ব‍‌শেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় বিজয়ওয়াদায়। সেই কংগ্রেসেই বোঝা গিয়েছিল পার্টি ভাঙতে চলেছে। তখন তো ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে স্তালিনবিরোধী প্রচার পুরোদমে চলছে। এই অবস্থায় আমাদের পার্টি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে একটি প্রতিনিধিদলকে মস্কো পাঠায়। দলে আমিও ছিলাম। এছাড়াও ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত গোবিন্দন নায়ার। সোভিয়েত পার্টির তরফে আলোচনার মধ্যে ছিলেন সুসলভ এবং পনোমারিয়েভ। আমার একটি প্রশ্নে পনোমারিয়েভ চটে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আপনারা স্তালিনের আমলে লেখা বলশেভিক পার্টির ইতিহাসবইটি বাতিল করে দিলেন কেন? তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক তো বই পৃথিবীর সর্বত্র প্রচার করেছিল।’’ জবাবে পনোমারিয়েভ রেগে গিয়ে বললেন, ‘‘ বইতে মার্কসবাদী দর্শন বিষয়ে স্তালিনের একটি লেখা ছিল। স্তালিন দর্শনের ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন। Negation of the negation বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যায় ত্রুটি ছিল। আমরা তা সং‍‌শোধন করে নতুন বই লিখেছি। এখন তার তর্জমার কাজ চলছে।’’ আমি সুসলভকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘আপনারা স্তালিনের এত সমালোচনা করছেন কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এই সমালোচনা করেননি কেন?’’ এই প্রশ্নের জবাবে সুসলভ কিন্তু রেগে গেলেন না। তিনি হেসে বললেন, ‘‘এটা বুঝবেন, স্তালিন তো শুধু সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন না বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ছিলেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা সহজ ছিল না।’’ সেই সময় আলবানিয়ায় সরকার উৎখাতের বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মদত জোগাচ্ছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘আপনারা এটা কেন করছেন? সে দেশে কোন্সরকার থাকবে তা সে দেশের মানুষই ঠিক করবেন।’’ জবাবে সুসলভ বললেন, ‘‘ওরা আমাদের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক প্রচার করছে। তাই আমরা একাজ করছি।’’ স্বভাবতই সুসলভের এই জবাব শুনে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। পরে ফিরে এসে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে একটা রিপোর্ট দিয়েছিলাম।

আগেই বলেছি যে, সোভিয়েতে বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে আমাদের পার্টি ১৯৯২ সালে মাদ্রাজ (চেন্নাই) পার্টি কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই প্রস্তাবে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়। তারমধ্যে একটি হলো, সে দেশে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বদলে পার্টির এবং বেশিরভাগ সময়ে পার্টি নেতৃত্বের একনায়কত্বে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে পার্টি রাষ্ট্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে গিয়ে উন্নতমানের ভোগ্যপণ্য তৈরির কাজ অবহেলিত থেকেছে। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারেনি। এছাড়া মতাদর্শগত চেতনা প্রসারের ঢিলেমি দেখা দিয়েছিল।

আমি এই লেখায় সেই বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার কথা হলো, এই যাবতীয় অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। একই ভুল আমরা যাতে না করি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সব থেকে বড় কথা, কমিউনিস্টদের অনেক দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়েই এগোতে হবে। কিন্তু এই সঙ্কল্প রাখতে হবে পৃথিবীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকীতে সেই লক্ষ্যে কাজ করার শপথ আমাদের নিতে হবে।

 (২০০৭ সালের নভেম্বর মহান নভেম্বর বিপ্লবের ৯০তম বার্ষিকী উপলক্ষে গণশক্তিতে জ্যোতি বসুর এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।)