20180129

ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না



দীপঙ্কর সিংহ

শিয়রে শেষ পরিণতি মৃত্যু দেখে শয়তানের সাধু সাজার প্রয়াস সফল হয় না।
ধর্মের নামে বিভাজন আর আক্রমণের বিরুদ্ধে দিকে দিকে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। মুখোশ খুলে পড়ছে দেখে সংঘীরা নতুন নতুন কৌশল করার চেষ্টা করছে। গতকাল সি পি আই (এম)-র হুগলি জেলার ২৩তম সম্মেলন শেষ হলো। এর আগে গত ৭জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে উত্তরপাড়ায় এই সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশ্য সমাবেশের শুরুতে বিপুল মানুষের সামনে গণসংগীত পরিবেশন করছিলেন কমরেড হিরণ্ময় ঘোষাল ও সহশিল্পীবৃন্দ। তাঁদের পরিবেশিত গানেই কাঁপন ধরছিলো গেরুয়াবাহিনীর মাতব্বরদের। মঞ্চে পরিবেশিত হলো গুরুদাস পালের লেখা ও সুরে জনপ্রিয় গণসংগীত, ‘‘ভাইরে, মৃত্যুকালে পাপীতো কৃষ্ণ বলেনা।’’  তরজা গানের শ্লেষগুলো বিদ্ধ করছিলো ধর্মের কারবারি ও তাদের তাঁবেদারদের। গানের কথায় ভাসছিলো -
‘‘... যতই মাজো ঘষো তবু
ছুঁচোর গায়ের গন্ধ কভু
গোলাপ জলে ধুলেও যাবে না।
আর জার্মানীতে হিটলার ছিল
সে যে কত না তাবিজ বাঁধিল
কত আইন কানুন গুলি জেলখানা
আর কত না ঝটিকা বাহিনী
শেষপর্যন্ত কেউ টেঁকেনি
আমাদের কত্তারা কি খবর রাখেন না।...’’

গেরুয়াবাহিনী আর তাদের তাঁবেদারদের অন্তরের পূজনীয় হিটলারকে নিয়ে এমন কথা কি সহ্য হয়? তার উপরে আবার মুখড়ায় কৃষ্ণ নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করা? সংঘীরা তো ‘কৃষ্ণ’ নামটিকে তাদের এজমালি সম্পত্তি মনে করে। সুতরাং শুরু হয়ে গেল নতুন অপপ্রচার সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে। বাংলার বহু মানুষই এই গান শুনেছেন। তাই এই অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য হলো ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষ, যাঁরা বাংলা ভাষা জানেন না বা এই গান শোনেননি। প্রচার শুরু করা হলো সি পি আই (এম)-র সভার শুরুতে ‘কৃষ্ণভজন’ গাওয়া হয়েছে।

তরজা গানের মতো লোকগানে যে নানা প্রবাদ, পুরাকাহিনী নিয়ে উপমা দেওয়া হয়, শ্লেষ মিশ্রণ করা হয়, তা বাংলার মানুষ জানেন। তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু অন্যভাষী মানুষদের সে ধারণা না থাকারই কথা। পুরাকাহিনী বা তার চরিত্র নিয়ে উপমা দিয়ে গণসংগীত শুধু গুরুদাস পালই করেছেন তাই নয়। বাংলার বহু লোকগান গণসংগীত হিসাবে ব্যবহৃত হয় যাতে পুরাকাহিনীকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ গণসংগীত নির্মাণের সামনের সারির গীতিকাররাও নানা সময়েই পুরাকাহিনীর উপমা ব্যবহার করেছেন। প্রখ্যাত বামপন্থী উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর গানে-কবিতায়, বা পল রোবসনের গাওয়া লীড বেলির ‘‘উই আর ইন দ্য সেম বোট ব্রাদার’’-র মধ্যেও ‘আল্লা’, ‘গড’ শব্দগুলি ভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার হয়েছে। প্রয়াত গণসংগীত শিল্পী অজিত পান্ডের একটা গান মনে পড়ছে-
‘‘বলো কৃষ্ণে কি ওই কংস কারায় বেঁধে রাখা যায়?
আহা মাঠে মাঠে লক্ষ কৃষ্ণ অগ্নিবাঁশের বাঁশী বজায়। ...’’

পুরাকাহিনীকে উপমা দেওয়া আর ধর্মপ্রচার করা যে এক নয় সেটা ওই গেরুয়া বাহিনীর লোকেরা ভালোই জানেআবার, এটা যে নিছক গানের অর্থ বুঝতে না পেরে প্রচার নয়, সেটাও আমরা বুঝি। হিটলারের ঝটিকা বাহিনীর মতো সংঘীদের গোরক্ষা বাহিনীর আক্রমণ, দেশপ্রেমের নামে আক্রমণ, ইত্যাদি যতই মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করছে, ততই তারা নতুন কায়দা অবলম্বন করে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইছে। এর শেষতম প্রয়াস হচ্ছে বামপন্থী দল ও বাম সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকান্ডে ধর্মভিত্তিক আচরণের ছাপ্পা মেরে দিয়ে নিজেদের ধর্মীয় মেরুকরণের অপকর্মকে লঘু করা।  এই অপপ্রয়াসে এদের তাঁবেদাররা ও তাদের সাথে সোশ্যাল, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার একটা কায়েমী স্বার্থের লেজুড়বাহিনীও যুক্ত হয়েছে।


এই প্রয়াস সফল হবে না, সফল করতে দেওয়া যাবে না। সতর্ক থাকতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মীদের, বামমনস্ক মানুষদের। বুঝতে হবে ‘‘আমরা আমাদের গান গাই, ওরা চায় না’’