20160710

বেকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচীতে যোগ দিন: সি পি আই (এম)-র আহ্বান

মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারী বৃদ্ধির প্রশ্নে ১১-১৭ই জুলাই সি পি আই (এম)-র ডাকে সারা ভারতে প্রতিবাদ সপ্তাহ পালিত হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রতিবাদ সপ্তাহে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য পার্টির রাজ্য কমিটি সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছে।

বেকারী, কর্মহীনতা
ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে মোদীর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার। আর মোদী প্রতিশ্রুত ‘সুদিন’ বা ‘আচ্ছে দিন’-র দু’বছর পর এখন দেশে বেকার বাহিনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

কেন্দ্রের মোদী সরকারের নীতির সাফল্য এখানেই যে আজ দেশে কর্মহীন বেকারের সংখ্যা ২০ কোটি ছাপিয়ে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বেকারবাহিনীর সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে প্রতিদিন কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যাও। প্রতিবছর ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ নতুন করে বেকারের তালিকায় নাম তুলছেন। আর এই বর্ধিত কর্মহীন কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আজ প্রায় ৫০ কোটি ছুঁইছুঁই। লক্ষ্যনীয় আজ এটাই, এই কর্মহীন নতুন বেকারবাহিনী তরুণ এবং শিক্ষিত অংশ, যাঁদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে মোদী দু-হাতে অঢেল কাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন

কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কী? সকলেই জানেন হাওয়ায় চাকরি বা কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। তার জন্য দরকার শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি। উৎপাদনশীল শিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে সবচেয়ে বেশি বেকার কাজ পেতে পারে। তার ব্যাপক উন্নতি দরকার, কিন্তু হচ্ছে অধোগতি। প্রয়োজন কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ কিন্তু তারও বেহাল অবস্থা।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা মোদী সরকার বজায় রেখে চলেছে। চাকরির পদসৃষ্টির বদলে পদই লোপ করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের শূণ্যপদের সংখ্যা ৭,৪৭,১৭১। যা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত পদের সংখ্যার ১৮ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্যেও অনুরূপভাবে বহু পদ শূণ্য। মোদী ক্ষমতায় আসার সময় ভারতীয় রেলে শূণ্যপদ ছিল ২,২৫,৮৬৩। কার্যত সেই অবস্থাতেই এখন চলছে। তপসিলী জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নিয়োগের বকেয়া খুবই বেশি। একইসঙ্গে মোদী সরকার এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে বেসরকারী ক্ষেত্রে তারা সংরক্ষণের বিরোধী।

কেন বেকার সমস্যা বাড়ছে? কর্মসংস্থান সৃষ্টির নাম করে মোদী সরকার ভারতীয় বিদেশী কর্পোরেটগুলিকে ঢালাও সুবিধার পর সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। তাকানো যাক ব্যাঙ্কঋণ কেলেঙ্কারির দিকে। ২০১৫সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাঙ্কগুলিতে খারাপ ঋণ (অনুৎপাদক সম্পদের জন্য ঋণ)-র পরিমান ছিল ৩.৪লক্ষ কোটি টাকা। এই ঋণের বেশিরভাগটাই দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী কোম্পানিকে, উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল শিল্প স্থাপন বা পরিকাঠামো নির্মান। কিন্তু কিছুই হয় নি। অথচ জনগণের এই বিরাট পরিমান অর্থ হাওয়ায় উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগের সাথে যে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা তাও উড়ে গেল।

২০১৫-র ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি এই একবছরে শিল্পোৎপাদনের সূচক বেড়েছে মাত্র ২শতাংশ। এটা পূর্ববর্তী একবছরের তুলনাতেও (ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫) খারাপ। সেই সময় শিল্পোৎপাদনের সূচক ছিল ৪.৮শতাংশ। আগের বছর ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বৃদ্ধি হয়েছিল ৫.১শতাংশ। পরের একবছরে হয়েছে ০.৭ শতাংশ। এই তথ্য ২০১৬ সালের ১২ই এপ্রিল প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী রূপায়ন মন্ত্রক।

এবার আসা যাক দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রসঙ্গে। মোট জাতীয় উৎপাদনের অংশ হিসেবে সরকারী ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, বিনিয়োগ কমেছে এবং কমেছে আমদানি ও রপ্তানি। এর অর্থ হচ্ছে যে সরকারী ব্যয়ে মানুষের সহায়তা হয় এবং মানুষের ক্রময়ক্ষমতা বাড়ে সেই সরকারী ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। বিনিয়োগ হয়েছে খুব কম। আন্তর্জাতিক বানিজ্য হ্রাসমান।

২০১৬সালের মার্চ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় গত একবছরে অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ইস্পাত উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এখানেও একই কথা আসে। উৎপাদন যদি কমতে থাকে বা সামান্যই বৃদ্ধি পায় সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কোথায়? বস্তুত ২০১৫ সালের শেষ তিনমাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির বদলে এই সুযোগ কমেছে।

শ্রম ব্যুরোর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি শ্রম-নিবিড় শিল্পের কয়েকটির অবস্থা খুব খারাপ। প্রতি তিনমাস অন্তর ৮টি শিল্পে এই সমীক্ষা করা হয়। এটা দেখার জন্য যে কত কর্মসংস্থান হয়েছে বা লোপ পেয়েছে। এই ৮টি শিল্প হল বস্ত্র, চর্ম, ধাতু, অটোমোবাইল, অলঙ্কার, পরিবহন, তথ্য প্রযুক্তি-বিপিও এবং হস্তচালিত ও বিদ্যুৎ চালিত তাঁত। ২০১৬সালের মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৫) এটা পরিষ্কার যে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার ১৫মাস পরে (অর্থাৎ ২০১৪-র জুলাই থেকে ২০১৫-র অক্টোবর) ৪.৩ লক্ষ চাকরি যুক্ত হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে এটাই সর্বনিম্ন। যে চাকরি যুক্ত হয়েছে তার সিংহভাগটাই তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবা এবং বিপিও ক্ষেত্রে। পাশাপাশি হস্তচালিত ও বিদ্যুৎচালিত তাঁতশিল্প, পরিবহন, অলঙ্কার ও চর্মশিল্পে চাকরি হ্রাস পেয়েছে।

সবচেয়ে দুরবস্থা কৃষির। কৃষিতে ভারতীয় জনগণের দুই তৃতীয়াংশ যুক্ত। এই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি নামমাত্র —১.১শতাংশ। এই কৃষি সঙ্কট আরও বেড়েছে খরা পরিস্থিতির জন্য। তাতে গ্রামীণ দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। কয়েক কোটি খেতমজুর ও কৃষক পরিবার অসহনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আইনী পথে এই দুস্থ দরিদ্র পরিবারগুলি যে সাহায্য পেতে পারে সেটা একমাত্র মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের মাধ্যমে (রেগা)। গ্রামীণ ধনিদের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আইনী ব্যবস্থাকে হেয় করছে মোদী সরকার। এই প্রকল্পে সময়মতো অর্থবরাদ্দ তাঁরা করছে না। এরফলে ন্যূনতম একশো দিনের কাজ দেওয়ার পরিবর্তে গড়ে বছরে কাজ হচ্ছে ৪৮দিন। অথচ মোদী সরকার খরাপ্রবণ এলাকায় একশো দিনের বদলে ১৫০দিন কাজ দেবে বলে ঘোষণা করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী ১কোটি ২০লক্ষ আবেদনকারীকে (১৪শতাংশ) কোন কাজ দেওয়া যায় নি। এটাই আসল গুজরাট মডেল। কারণ রেগা রূপায়নের ব্যর্থতায় গুজরাটের নাম আগে। রেগার সাফল্যের শীর্ষে রয়েছে ত্রিপুরা। যেখানে ২০১৫-১৬সালে গড়ে কাজ দেওয়া হয়েছে ৯৫দিন। দেশের সর্বত্র রেগার এই ত্রিপুরা মডেলই অনুসরণ করা উচিত।

চাকরি দিতে না পারা বা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য দায়ী মোদী সরকারের আগ্রাসী নয়া-উদারবাদী নীতি। বামপন্থীরা যে বিকল্প নীতির দাবি করে আসছে তা হল চাকরি ও কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় বহুল পরিমানের বৃদ্ধি করা। এটাই একমাত্র অর্থনীতিকে তেজী করতে পারে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারে। তা না করে মোদী সরকার সম্পূর্ণই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বেসরকারী বিনিয়োগের দিকে।

পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় ভয়াবহ। নতুন শিল্প হয় নি, অথচ সরকার শিল্পে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের হাস্যকর তথ্য হাজির করছে। শূণ্যপদে নিয়োগ এরাজ্যে কার্যত বন্ধ। নামমাত্র মজুরিতে সরকারী ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকার অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করছে। কৃষির ক্ষেত্রেও সঙ্কট সরকারী নীতির জন্য বাড়ছে। কৃষকেরা ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছেই না। এর কারণেই বাড়ছে গ্রামীণ বেকারী। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ব্যবসা-বানিজ্যের অধোগতি। আর্থিক কারণে এবং তৃণমূলের অপশাসনে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানের ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। নিয়োগনীতির ক্ষেত্রে সীমাহীন কেলেঙ্কারি রাজ্যের তরুণ এবং বেকাররা হাড়ে হাড়ে পাঁচ বছর ধরে বুঝতে পারছেন। বেকারীত্বে সমস্যার গভীরতা বোঝা যায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘তেলেভাজা শিল্প!’ প্রসারের ডাকের মাধ্যমে। বেকারদের চাকরি এবং কর্মসংস্থানে পশ্চিমবঙ্গকে ভাসিয়ে দেওয়ার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রহসনে পরিণত।

বেকারত্বের সমস্যার বিরুদ্ধে এবং মোদী সরকার ও তৃণমূল সরকারের বেকারবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী।

আমাদের দাবি
সরকারী পদে নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। সমস্ত শূণ্যপদ পূরণ করতে হবে। তপসিলী জাতি, আদিবাসীদের পদগুলো সমস্ত বকেয়া পূরণ করতে হবে। বেসরকারী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ চালু করতে হবে।

শহর এলাকায় রেগা’র ধাঁচে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তাকরণের জন্য আইন প্রনয়ন করতে হবে।
রেগা’য় সরকারী বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং এই আইনের যথার্থ রূপায়ন সুনিশ্চিত করতে হবে।

রাজ্যে নতুন শিল্প চাই। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সমস্ত শূণ্যপদে নিয়োগ করতে হবে। সরকারী পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকারী কাজে নিয়োগে শাসকদলের দলবাজী, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

No comments:

Post a Comment