20180513

গর্বের পঞ্চায়েতঃ গড়েছে বামফ্রন্ট, ধ্বংস করছে তৃণমূল-২


ভূমিসংস্কারের উলটো পথে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গে যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচী দেশে-বিদেশে উচ্চপ্রশংসিত হলেও ক্ষমতায় এসেই উলটো পথে চলতে শুরু করে মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। ২০১১সালের ১৮ই অক্টোবর (মেমো নম্বর-আই আর সি/৬২৪/১১) একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে তৃণমূল সরকার বলে, ‘‘ভূমিহীনদের মধ্যে মূলত কৃষিজমি বন্টনের যে ধারায় আগের ভূমিসংস্কার চলেছে, তা থেকে সরে আসতে হবে এবার।’’ আরো আগ্রাসী ভাষায় রাজ্য সরকারের জমি নীতি সুপারিশকারী কমিটি বলেছে, ‘‘জমির অবৈধ দখলদারিকে কখনো ভূমিসংস্কার বলা যায় না। বরং এটিকে জমি-ডাকাতি বলা যায়। এই জমি-ডাকাতি বন্ধ করতে সরকার যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।’’
এর পরেই রাজ্যের গ্রামে গ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে পূর্বতন জমিদার, জোতদার এবং লুকোনো জমির মালিকরা। শুরু হয়ে যায় বর্গাদার, পাট্টাদার, এমনকি রায়তি জমির মালিক গরিব কৃষকদের উচ্ছেদের ঘৃণ্য অভিযান। তবে গরিব কৃষকের প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে লক্ষ্যনীয়ভাবে।

পঞ্চায়েত ঠুঁটো জগন্নাথপশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের গ্রামবাসীকে যুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক ও বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন কাঠামোর যে ব্যবস্থা সারা দেশকে পথ দেখিয়েছিলো, ক্ষমতায় এসেই তা ভাঙতে শুরু করেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ক্ষমতায় এসেই তিনি কলকাতার টাউন হলে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের বিডিও, ৬৫জন এসডিও-র সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। সভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘এবার থেকে প্রতিটি জেলায় তিনটি করে কমিটি হবে। ব্লক পর্যায়ে কমিটির মাথা হবেন বিডিও-রা। মহকুমা স্তরে মহকুমাশাসক বা এসডিও-রা। জেলা পর্যায়ে কমিটির কর্তা হবেন জেলাশাসকরা। প্রতিটি পর্যায়ের কমিটিতেই সদস্য হবেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের অফিসাররা। এই কমিটিগুলিই গ্রামোন্নয়নের কাজের তদারকি ও নজরদারি করবে।’
এর ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। উন্নয়নের কাজে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা রূপায়নের আসল ক্ষমতা চলে গেলো আমলাদের হাতে। জনগণের সঙ্গে যাদের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। ফলে ক্ষমতা হারালেন গ্রামের সাধারণ মানুষও। অথচ এতদিন গ্রাম সংসদের মাধ্যমে তাঁরা উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও রূপায়ণের কাজে রীতিমতো বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতেন।

কৃষক আত্মহত্যার যে ঘটনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত ছিলো না, বাংলায় তা এখন অহরহ ঘটছে। গত ছ’বছরে রাজ্যে দেড়শোর বেশি কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিয়ে সরকার কৃষকদের এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ায়নি। তারা বরং খেলা মেলা উৎসবে এবং ক্লাবগুলোকে টাকা বিলোনোয় বেশি উৎসাহ দেখিয়েছে। কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। ধান, আলু, পাট থেকে পান, সরষে, ডালশস্য— রাজ্যের প্রতিটি ফসলের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। সরকার এখন ফড়েদের থেকে ধান কিনছে, পঞ্চায়েত ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে ধান কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে অথচ ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা বিপদে পড়ছেন। সারের দোকানের ঋণ, প্রতিবেশীর কাছে ঋণ, মহাজনের ঋণ নিয়ে চাপের মুখে আত্মহত্যা করছেন অনেকেই। নাবার্ডের ফোকাস পেপার, ২০১৬-১৭তে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজীবী পরিবারগুলি প্রতি মাসে গড়ে ১৯০৮টাকার ঋণ জালে জড়াচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে কৃষিতে বিপর্যয়, কখনো বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি, কখনো অনাবৃষ্টিতে, কখনো পোকার আক্রমণে। কিন্তু বাংলার কৃষকদের সামনে এখন বীমার ক্ষতিপূরণের সুযোগ নেই। শস্যবিমার বিধি ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে কৃষকদের আরও বেশি করে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার।

ভোটের নামে প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে যে পঞ্চায়েত ভোট কার্যত উৎসবের পরিবেশে হতো, সেই ভোটই এখন রীতিমতো প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মমতা ব্যানার্জির শাসনে পরপর দু’টি পঞ্চায়েত নির্বাচনই বেপরোয়া সন্ত্রাস, বিরোধী প্রার্থী খুন, ভোট-লুট, আদালতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিশৃঙ্খলার জন্য ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।
তৃণমূল আমলে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩-র জুলাইয়ে। রাজ্যে মোট ৪৮,৮০০টি পঞ্চায়েত আসন। নির্বাচনের আগেই, আতঙ্ক সৃষ্টি করে ৫,৩৫৬টি আসন দখল করেছিলো তৃণমূলতারপরেও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতেও জিততে দেদার ছাপ্পা, ভোট লুঠ, বিরোধীদের মেরে বের করে দেওয়া, বেপরোয়া বুথ দখল চালায় শাসকদল। গণনার সময়েও চলে ব্যাপক জালিয়াতি ও বলপ্রয়োগ। তবুও বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিলো ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২% কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে (???) যথাসম্ভব সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে গিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ বাধার মুখে পড়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো। আদালতের লড়াইয়ে জিতলেও, ভোটের দিন কিন্তু শাসকের সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীর তান্ডব আটকাতে ব্যর্থ হন তিনি।

বেআইনী দখলদারি-র নির্লজ্জ অভিযানে নজির গড়লো তৃণমূল। তীব্র সন্ত্রাস আর আক্রমণ চালিয়েও ২০১৩সালে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূল জিততে পারেনি। একইভাবে বহু পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীদের জয় হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কি! নির্বাচনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় নতুন খেলা। দল ভাঙিয়ে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দখলদারি শুরু হয়। যেখানে বামপন্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করেছিলো, অঙ্ক কষে সেখানে খুনও করা হয়েছে। সভাপতি হিসাবে কাজ শুরুর আগেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে উত্তর ২৪পরগণার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গাজিকে। এরপর সেই সমিতি দখলও করে শাসকদলফরাক্কায় খুন হন পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য হাসমত শেখ। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলদিয়া পৌরসভায় সন্ত্রাস চালিয়ে, কাউন্সিলারদের অপহরণ করে ১৫মাসের মধ্যেই দখল করে নেয় তৃণমূল।
তৃণমূলের দখলের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদএই জেলায় ২৬টির মধ্যে একমাত্র সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতিতে জয়ী হয়েছিলো তৃণমূল। এখন তৃণমূলের দখলে ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতি! আর জেলা পরিষদ? মোট ৭০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল মাত্র ১টি আসনে। বাকি সবই ছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের হাতে। এখন নানা কৌশলে মোট ৪৩ জনকে ভাঙিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ চালাচ্ছে তৃণমূল! ভয় দেখিয়ে দল ভাঙিয়ে দখলদারির এই ফরমুলা সারা রাজ্যেই চালু করেছে মমতার দল।

মুখে গামছা-বাঁধা ‘উন্নয়ন’ দেখছে এখন গ্রামাঞ্চল! তৃণমূলের আমলে দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের (২০১৮) সন্ত্রাস অতীতের সব নজির ছাড়ালো। আগেরবার ভোট লুঠ, নির্বাচনের পর সন্ত্রাস চালিয়ে বোর্ড দখলে নজির গড়েছিলো তৃণমূল। এবার একেবারে মনোনয়ন পর্ব থেকেই গ্রামবাংলায় মুখে গামছা-বাঁধা সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা রাস্তায় নেমে পড়েছে। মনোনয়ন পেশের কেন্দ্রগুলি ঘিরে রেখেছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে তৈরি পুলিশ-তৃণমূলের যৌথ বাহিনী। প্রার্থীকে খুন, জখম, অপহরণ, সন্ত্রাস চালিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো— সবই হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অসহায় চোখের সামনে! বিরোধীদের আবেদনের ভিত্তিতে বারেবারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে হাইকোর্টকে। শাসকের সশস্ত্র গুন্ডাদের মার খেয়ে, রক্ত ঝরিয়ে তবু বিরোধী দলের কিছু প্রার্থী মনোনয়ন পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। অনুব্রত মন্ডল নামে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য দুষ্কৃতী-নেতার কথায়, ‘মমতা ব্যানার্জির উন্নয়ন আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সবই হচ্ছে সেই কারণে।’ গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিনের আলোয় গামছায় মুখ ঢাকা এমন ‘উন্নয়ন’ সারা দেশে সত্যিই বেনজির!

দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। সাধারণ মানুষকে হটিয়ে পঞ্চায়েতগুলি দখল করেছে অর্থলোলুপ কিছু তোলাবাজ। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, যে কোন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পেতে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতাশালী নেতাদের এখন ‘কমিশন’, ‘তোলা’ দিতে হয়। পঞ্চায়েতের কাজের আগেই ১০থেকে ১৫শতাংশ টাকা শাসকদলের নেতাদের পকেটে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকাদাররা।                      নীতি-আদর্শহীন তৃণমূল মূলত ধান্দা-নির্ভর একটি দল। তাই পঞ্চায়েতগুলিও এখন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর ক্ষেত্র। একশ’ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ইত্যাদি প্রকল্পে চলছে দেদার চুরি। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, আদিবাসী বা তফসিলী মানুষের হকের টাকা ‘পাইয়ে দেওয়ার’ নাম করে কাটমানি খাচ্ছে তৃণমূল নেতারা। মানুষের ভুরিভুরি অভিযোগ জমা পড়লেও কোন প্রতিকার করছে না তৃণমূল সরকার।

গণশক্তি, ১৩ই মে, ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment