20200622

কর্মসংস্থানে দেশে শীর্ষে থাকা রাজ্যকে টেনে নামিয়েছেন মমতা




প্রসূন ভট্টাচার্য

পুরানো তথ্য, কিন্তু সেটাই নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাংলার বুকে কাজ না পেয়ে লক্ষ লক্ষ যুবক যখন ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন কাজের খোঁজে এবং ভিনরাজ্যে গিয়ে লকডাউনের মতো বিপদে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তখন এক দশক আগের এনএসএসও’র তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার কর্মসংস্থানে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করেছিল। সিঙ্গুর সহ রাজ্যে শিল্পায়নে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগ যদি চালু থাকত তাহলে কি কাজের জন্য এমন স্রোতের মতো ভিনরাজ্যে যেতে হতো বাংলার যুবকদের? প্রশ্নটা নতুন করে উঠে আসছে এই চরম বেকারির বাজারে।

বামফ্রন্ট সরকারের শেষের ৬ বছরে রাজ্যে শিল্পায়নে, বিশেষত উৎপাদনমূলক শিল্পে রীতিমতো জোয়ার এসেছিল। রাজ্যের স্থিতিশীলতা, পরিকাঠামো বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষার প্রসার ও দক্ষ শ্রমিকের জোগান, গ্রামে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বামফ্রন্ট সরকার অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে উৎপাদনমূলক শিল্পে ব্যাপকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে সক্ষম হয়েছিল। এনএসএসও’র তথ্য অনুসারে ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সারা দেশে উৎপাদনমূলক শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৮ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। এর ৪০ শতাংশের বেশিই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদনমূলক শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৪ লক্ষ মানুষের।

উৎপাদনশিল্পে কর্মসংস্থানের পিছনে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের। কিন্তু সেগুলোর প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছিল রাজ্যে উৎপাদনভিত্তিক বড় শিল্প কারখানা গড়ে তোলায় বেসরকারি বিনিয়োগ টানায় সাফল্যের কারণে। বড় কারখানার উপস্থিতির জন্য রাজ্যে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি উৎপাদন করতে পেরেছে, বড়গুলির চাহিদা মেটাতে এবং বড়গুলির উৎপাদনের সাহায্যে নতুন উৎপাদনে। অর্থাৎ আপস্ট্রিম এবং ডাউনস্ট্রিমে। হলদিয়া পেট্রোকেম উপস্থিতিই এরাজ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পেরেছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে।

শিল্পবিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনায় সেই সময়ে সিঙ্গুরে অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তুলতে টাটা মোটরসের উদ্যোগ, শালবনী, পুরুলিয়া, খড়্গপুরে ইস্পাত শিল্প সহ বিভিন্ন শিল্পের উদ্যোগ চলছিল জোর কদমে। এর সঙ্গে পরিষেবা ক্ষেত্র এগচ্ছিল মূলত তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে কেন্দ্র করে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সালে বাংলা যখন কেবল উৎপাদন শিল্পেই ২৪ লক্ষ কর্মসংস্থানের সাফল্য দেখাতে পেরেছিল, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান তখন এক্ষেত্রে ছিল প্রথম। অনেকটা পিছনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল গুজরাট। সে রাজ্য ওই সময়কালে ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার কর্মসংস্থান করতে পেরেছিল উৎপাদনশিল্পে। এরপরে যারা ছিল সেই তামিলনাডু, পাঞ্জাব, কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্রে সংখ্যাটা ছিল ৪ থেকে ৬লক্ষের মধ্যে।

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্প মন্ত্রী নিরুপম সেন তখন প্রায়ই বলতেন, ‘টাটা মোটরসের গাড়িতে কে চড়বে সেটা আমাদের কাছে বড় কথা নয়, অটোমোবাইল শিল্পে এবং তার যন্ত্রাংশ সরবরাহের শিল্পগুলিতে এরাজ্যের হাজার হাজার বেকার ছেলেমেয়ে কাজ পাবেন এটাই আমাদের কাছে বড় কথা।’ সম্ভাবনাময় সেই বাংলায় তখন কাজের জন্য ভিনরাজ্য এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছিলেন। বিশেষত শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা রাজ্যেই ভালো (ডিসেন্ট) কাজের সন্ধান পাওয়ার আশা করছিলেন।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেল কীভাবে?

উত্তর আছে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ৮০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা গুজরাটে তাড়ানোর পাশাপাশি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন তিনি বাংলার ধ্বংসকার্য শুরু করেছিলেন। ২০১১ সালে ক্ষমতায় বসার পরে সেই ধ্বংসকার্যের ফলাফল দেখতে পাচ্ছেন। উৎপাদনমূলক শিল্পকে অর্থনীতির শক্তিশালী বুনিয়াদ বলা হয় এই কারণে যে এটা উদ্বায়ী চরিত্রের নয়। যখন খুশি মুনাফার লোভে সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যেতে পারে না, সংগঠিত শ্রমিকরা প্রাপ্যের জন্য সংগঠিতভাবে লড়াই করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু তৃণমূলের সিঙ্গুর আন্দোলনের ফলে বাংলার সেই উৎপাদন শিল্পের সম্ভাবনা ধংস হয়েছে। সিঙ্গুরের কারখানা হয়নি, শালবনী বা পুরুলিয়ার ইস্পাত কারখানাও হয়নি, পেট্রোকেমিক্যালসের প্রসারও ঘটেনি।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিধানসভায় বাজেট পেশ করে অর্থ মন্ত্রী অমিত মিত্র জানিয়েছিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত চলতি আর্থিক বছরে আমরা ৯ লক্ষ ১১ হাজার জনের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছি।’’ এভাবেই প্রতিবছর মুখ্যমন্ত্রীও মুখে মুখে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান করছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই কাজ দেখা যাচ্ছে না। এবারের বাজেট অধিবেশনেই শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক জানিয়েছেন, ‘‘২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ৫ হাজার ৫৮২।’’ 

এটাই হলো রাজ্যের অবস্থা। এরজন্যই রাজ্য ছেড়ে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন শহরের শিক্ষিত যুবরা এবং গ্রামের কৃষিক্ষেত্রে উপার্জনে ব্যর্থ যুবরা। ভিনরাজ্যে কখনো সাম্প্রদায়িক সমস্যার মুখে পড়ছেন, এবার লকডাউনের বিপদে পড়েছেন। কিন্তু ফিরে এসেও উপায় কী? কাজ নেই মমতা ব্যানার্জির বাংলায়, তাই ফের ভিন রাজ্যে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।

গত দশকের যে সত্যকে বিরোধী নেত্রী হিসাবে চাপা দিয়েছিলেন, এই দশকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাকে চেপে রাখতে পারছেন না মমতা ব্যানার্জি।

গণশক্তি, ২০ জুন, ২০২০



No comments:

Post a Comment