20210809

স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা

 

মৌলানা হসরৎ মোহানী ও বিআর আম্বেদকর


অঞ্জন বেরা

 

মহাকাব্যিক বহুমাত্রিকতায় আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির সংগ্রাম এক অর্থে মানবিক উত্তরণেরও গর্বিত আখ্যান। এই উত্তরণে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। অনপনেয় তার প্রভাব

 

মহান অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭) অন্যান্য উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলির মতো ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও শুধুমাত্র অক্টোবর বিপ্লবের প্রতিবর্তক্রিয়ায় এদেশে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়নি। হয়েছিল, কারণ দেশের অভ্যন্তরে জমি ছিল প্রস্তুত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও তখন নতুন পর্বে পা দিয়েছে। এই নতুন পর্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই ছিল ব্যাপকতর মানুষের-শ্রমিক কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা-অংশগ্রহণ। অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী বিশ্বে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির রূপান্তর-পর্বে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তখন ঐতিহাসিকভাবেই অচল। লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালে গঠিত তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিকতবাদ অবসানের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয় প্রত্যাশিতভাবেই। ঐতিহাসিকভাবেই ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এক যুগসন্ধিক্ষণে।

 

কমিউনিস্টরাই জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে প্রথম সোচ্চার হয় ১৯২১ সালে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬-তম অধিবেশন উপলক্ষে প্রচারিত হয়  মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত ইশতেহার। শুধু ইশতেহার প্রচার নয়, এলাহাবাদে অধিবেশনে মৌলানা হসরত মোহানী এবং স্বামী কুমারানন্দ উত্থাপন করেন পূর্ণ স্বাধীনতার  প্রস্তাবসে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি, কারণ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘স্বরাজ’ অর্জন তখনও জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনেও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। জাতীয় কংগ্রেসকে ‘ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি’ হিসেবে উল্লেখ করে কমিন্টার্ণের বার্তা ঘোষণা করে: ‘‘সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া ভারতীয় জনগণের স্বাভাবিক বিকাশ অর্জন অসম্ভব।’’

 


১৯২১ সালের ইশতেহার থেকে ১৯৪৬সালের নির্বাচনী ইশতেহার, কিংবা গণপরিষদে কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাব-পরাধীন ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক বাঁকের মুখে কমিউনিস্ট পার্টি উত্থাপিত বিকল্প প্রস্তাব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আধুনিক ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে।  মুক্তিকামী রাজনীতির মূল অভিমুখ থেকে কমিউনিস্টরা কখনও সরে যায়নি।

 

জাতীয় কংগ্রেস সর্বপ্রথম পূর্ণ  স্বাধীনতার (‘পূর্ণ স্বরাজ’) প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে। গ্রহণ করে পূর্ণ স্বাধীনতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচী। স্বাধীনতার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মাত্রার স্বীকৃতির সূত্রে এই কর্মসূচী অনন্য। ঔপনিবেশিক মুক্তি সংগ্রামে নতুন অধ্যায়ের সূচনাবাহী

 

কমিউনিস্ট পার্টি জন্মসূত্রেই স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিবেদিত বীর সন্তানদের পার্টি।  এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘বার্লিন কমিটি’-তে সংগঠিত দেশান্তরী বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীরা। দেশান্তরী ভারতীয় মুজাহিররাগদর  বিপ্লবীরা। সেইসঙ্গে, দেশের মধ্যে সক্রিয় বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী (ব্রিটিশ সরকারের দলিলে যাঁরা ‘সন্ত্রাসবাদী’ চিহ্নিত), কংগ্রেসের রাডিক্যাল কর্মীদের একাংশ এবং খিলাফত ও আকালি আন্দোলনের আপোসহীন বিপ্লবীরা।

 

তেলেঙ্গানা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে নারীসেনানীরা

রবীন্দ্রনাথ যাঁদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন ‘বন্দীর শৃঙ্খলচ্ছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয়’ সেই তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের বড় অংশই তিরিশের দশকে বন্দী থাকালেই কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করেন এবং জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত বিপ্লবীরাও ছিলেন। ছিলেন ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বিদ্রোহে মাস্টার দা সূর্য সেনের সহযোদ্ধারা।

 

ঔপনিবেশিক জমানায় নির্যাতন ভোগের সম্ভবত কঠিনতম অভিজ্ঞতা কমিউনিস্টদেরই। প্রথম ছিল  পেশোয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা। ১৯২২ থেকে ১৯২৭সাল। কানপুর ‘কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ মামলা ১৯২৪-২৫ সালদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি জাতীয়স্তরে সংহত হবার চেষ্টা করতেই নেমে আসে মীরাট ‘ষড়যন্ত্র’ মামলার (১৯২৯-৩৩) খাঁড়া। গোটা দেশ থেকে একযোগে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার। ধৃতদের মধ্যে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির ফিলিপ স্প্র্যাট, বিএফ ব্র্যাডলে এবং এইচএল হাচিনসন’ও ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শুধু ভারতীয় কমিউনিস্টরা নন, ব্রিটিশ কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগও কম নয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতা শুধু মুখের কথা ছিল না। মীরাট মামলা না মিটতেই দেশজুড়ে সরকারী নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। ১৯৩৪ সালের ২৮জুলাই থেকে ১৯৪২সালের ২৩ জুলাইঔপনিবেশিক জমানার অন্তহীন নির্যাতনও কমিউনিস্ট পার্টিকে কিন্তু  জনবিচ্ছিন্ন  করতে পারেনি।

 

আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু ও 
ঝাঁসি রানী ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল

স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার ভিত্তি ছিল তার বৈপ্লবিক মতাদর্শ। শ্রেণী রাজনীতির মতাদর্শ। স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির  অন্যতম মৌলিক অবদান। এই মতাদর্শই স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিক কৃষক শ্রমজীবী জনতার নির্ধারক ভূমিকার ওপর আলোকপাতে সক্ষম করেছে কমিউনিস্ট পার্টিকে।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনে ও জাতীয় জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে কমিউনিস্ট পার্টির আপোসহীন ভূমিকা অনস্বীকার্য। এলাহাবাদ কংগ্রেস অধিবেশনে (১৯২১) প্রচারিত   কমিউনিস্টদের প্রথম ইশতেহারেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অপরিহার্যতা সোচ্চারে ঘোষিত হয়। ১৯২০-র দশক, ১৯৩০-র দশক, বিশেষত ১৯৪০-র দশকের মধ্যভাগ থেকে দেশভাগ পর্ব- মতাদর্শগত মৌলিকতাই কমিউনিস্ট পার্টিকে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সবচেয়ে নীতিনিষ্ঠ এবং অবিচল রেখেছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই কমিউনিস্টরা যে সংঘ পরিবারের ঘোষিত শত্রু সেটা বিনা কারণে নয়।

 

জাতপাতের বিভাজন ও  বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা কমিউনিস্ট পার্টির মৌলিক অবস্থান। প্রতিষ্ঠা পর্ব থেকে। বহু-জাতি সমন্বিত এই দেশে জাতিসত্বার গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার প্রতি সংবেদনশীলতা যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্বেই অন্তর্ভূক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়, তাতে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ভোলার নয়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের গণতান্ত্রিক দাবি কমিউনিস্ট পার্টির  অন্যতম মৌলিক দাবি।

 

তাছাড়া, ঔপনিবেশিক জমানার মদতপুষ্ট দেশীয় রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির সামন্ততন্ত্র-পিষ্ট জনতাকে উপমহাদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপ্তি মূলস্রোতে গ্রথিত করতে কমিউনিস্টদের অবদান স্মরণীয়। এপ্রসঙ্গে  সম্ভবত  সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল নিজাম-শাসিত তেলেঙ্গানায়। জমিদারপ্রথা রদ, ভূমিসংস্কারের দাবিতে কৃষক সমাজকে সংগঠিত করায় কমিউনিস্টদের গৌরবজনক ভূমিকাও অবিস্মরণীয়। তেভাগা শুধু ফসলের ভাগের প্রশ্ন ছিল না, ছিল নতুন জীবনবোধেরও। ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পিছনে উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের সাক্ষরতা অভিযানের অবদান কিংবা দুর্ভিক্ষপীড়িত বা দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় কমিউনিস্ট কর্মীদের দরদী ভূমিকা কি ভোলা সম্ভব?

 

স্বাধীনতা সংগ্রামে আমআদমির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রসারিত করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান শ্রেণী ও গণসংগঠনগুলিকে পুষ্ট করা। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (প্রতিষ্ঠা ১৯২০), সারা ভারত কৃষক সভা, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের (তিনটি সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠা ১৯৩৬ সালে) প্রাণশক্তি ছিল কমিউনিস্টরাই১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আত্মপ্রকাশ জাতির সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম মাইলফলক। এদেশে কমিউনিস্টরাই সংগঠিত করেছে লড়াকু মহিলাদের।

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে গ্রথিত করার উদ্যোগেও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সামনের সারিতে। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবিসিনিয়া ও স্পেনে ফ্যাসিস্ট হামলার বিরোধিতায়, জাপ-আক্রান্ত চীনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপনে, সোভিয়েত সংহতি আন্দোলন গড়ে তোলায়, ইন্দোচীনের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জ্ঞাপনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত।

 

ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারবাদে মাথা বিকিয়ে দেওয়া শাসক শ্রেণীগুলি দেশ চালানোর ভার তুলে দিয়েছে ‘হিন্দুরাষ্ট্রবাদী’দের হাতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা এবং ঔপনিবেশিক শাসকের সঙ্গে অশুভ আঁতাতই যাদের জন্মদাগ। কর্পোরেট স্বার্থ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির ‘নিষ্ঠুর একতা’য় আক্রান্ত  আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্বিক অভিজ্ঞানকমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপন যেন নতুন প্রেক্ষিতে অর্থবহ হয়ে উঠেছে।

 

 

1 comment:

  1. CasinoBetting: Review | Bonus Codes | Free Spins | Bonuses
    CasinoBetting Review: Read our 알바로 모라타 casino betting review. Check out all the bonuses 바카라 신규가입쿠폰 and 토토 라이브 스코어 promotions, game 복불복 룰렛 providers, payment methods and m w88 the welcome bonus.

    ReplyDelete