জয়দীপ সরকার
তখন সবে কাজ শুরু করেছি, রাত ১১টায়। অভীকদা ফোন করে বললো, ‘‘পূর্ণিয়া চলে যাও, অজিতদা খুন হয়ে গেছেন।’’ দিনটা ছিল ১৪ই জুন।
দার্জিলিং
মেইলে সাধারণ টিকিট কেটে বহুকষ্টে বারসই, সেখান থেকে কাটিহার
হয়ে পূর্ণিয়ার কয়েক কিলোমিটার আগে বাস থেমে গেল। চালক বললেন, ‘পূর্ণিয়াতে আগুন জ্বলছে, বাস যাবে না।’ বাসে দেখি
তাত্ত্বিক শঙ্করদাও চলেছে ছবি তুলতে। জুটি পেলাম। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে শহরে ঢুকে
দেখলাম মানুষের তেজ। একজন রিক্সাচালক কাঁদছিলেন, বললেন,
‘‘ভগবান খুন হয়ে গেলেন।’’ বোঝালাম, নিয়ে চলুন,
ওনার দেহ যেখানে আছে সেখানে।
বিরাট শহর, কিন্তু সে সময় লাল ঝান্ডার দখলে। রিক্সাচালক নিজে বললেন, তিনি চামার সম্প্রদায়ের দলিত, সিপিএম নেতা অজিত
সরকার সেখানকার বিধায়ক ছিলেন বহুবছর ধরে। ‘‘শহরে গুন্ডারা মাথা তুলতো না তাঁর ভয়ে,
পাপ্পু যাদব জমির মালিকদের টাকা নিয়ে অজিত বাবাকে গুলি মারলো।’’
রাস্তা
শুনশান। পুলিসের গাড়ি জ্বলছে একের পর এক। লাঠি নিয়ে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে নীরব
স্রোত আসছে সব গলি থেকে। সবার হাতে লাঠি।উল্টে ফেলে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিরাট
বিলাসবহুল কয়েকটা গাড়ি, রিক্সাচালক বললেন, ‘‘এগুলো
পাপ্পুর গাড়ি।’’
লাল পতাকা
নিয়ে মিছিল কান্না, এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে ভাবছিলাম,
এটা পশ্চিমবাংলা না উত্তর বিহার!
শহীদ মিনার
ময়দানের মতন একটা মাঠ, নিচে শোয়ানো অজিত সরকারের দেহ। একটা হলুদ
অমলতাস গাছের নীচে সে দেহ উপচে পড়ছে ফুল, এই বর্ষা শুরুর
বৃষ্টি ফোঁটায় ভারী হয়ে অজিতদার দেহটা ঢেকে দিচ্ছে হলুদ অমলতাস। পাটনা বিধায়ক
নিবাসে গেলে এই মানুষটি ছাড়তে চাইতেন না, ‘‘ইয়ং ম্যান বসো।
শ্যামনগর ভাটপাড়া এখনও টানে জানো, সুভাষদা ফোন করে খোঁজ খবর
নেয়।’’ সেই বিরাট দাপুটে মানুষটা ফুলের ভারে চাপা পড়ে আছেন!
স্বতঃস্ফুর্ত
বনধ। কতদিন চলবে কেউ জানে না। ক্ষিপ্ত দেহাতী মানুষরা পুলিস কর্তাদের ঘিরে বলছেন, ‘‘পুলিস চাইলে এখনই খুনীদের ধরতে পারে। হয় আপনারা ধরুন নয় আমাদের হাতে
ছেড়ে দিন। আমরা শয়তানের শেকড় ছিঁড়তে চাই।’’
সতীনাথ
ভাদুড়ীর ‘ঢোড়াই চরিত মানস’ বইতে চিনেছিলাম পূর্ণিয়াকে। বিহারের শস্য ভান্ডারে
ফসল উৎপাদকের হাতে জমির অধিকার তুলে দেওয়া, গরিব কৃষকের অধিকার
প্রতিষ্ঠা করায় এ তল্লাটে আপামর মানুষের কাছে অজিত সরকার তখন আপনা নেতা। বেলার
দিকে দিল্লি থেকে পৌছলেন সীতারাম ইয়েচুরি, তিনি তখন দল থেকে
বিহারে সিপিআই(এম)-র দায়িত্বে। শোকসভা করে পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে শেষকৃত্যে গেলেন
ইয়েচুরি সহ সকলে ।
আমরা খবর পাঠাতে গেলাম পূর্ণিয়া পোষ্ট অফিসে। পোষ্টমাষ্টার রাজস্থানী, ফ্যাক্স চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘এত দূর দেশ থেকে কাজ করতে এসে আত্মীয় পেয়েছিলাম, তিনিও খুন হলেন।’’ একটা সর্বাত্মক সহানুভূতি, ভাবাবেগের স্রোত। তিনিই একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করলেন। পরদিন পরিচিত এক বন্ধু ঘুরে দেখালেন তাৎমাটুলি, এ যেন এক অতি পরিচিত অথচ আশ্চর্য জগৎ। পাশেই লেখা লেনিননগর। বেতের দেওয়ালে আঁকা কমরেড চে। বস্তির মানুষরাই ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে সাজান তাঁদের বন্ধু চে’কে।
আমরা
ফিরছিলাম, অজিত সরকারের পরিবারের সাথে মাধবীদির সাথে কথা বলে। সীতারাম
ইয়েচুরি বাংলায় বললেন, ‘‘খেয়ে যাবে না তোমরা?’’ ক্ষিদেও ছিল চরম, সীতারাম ইয়েচুরির পাশে মাঠের
মাঝে বসে খাওয়া। পাতায় ভাত, ডাল এবং কাঁচা মুলো। আমার বোধে
ছিল না এটাই শুরু এবং শেষ হতে পারে। কিছুটা ভাত রাখা ছিল। সীতারাম বললেন, ‘‘এটাই কমরেডরা চাঁদা তুলে নিজেদের কষ্টের টাকা দিয়ে বানিয়ে আমাদের
খাওয়াচ্ছেন, আর কোন কিছু নেই।’’ একজন এসে বালতি থেকে ডাল
দিলেন, একজন সযত্নে মূলোর টুকরো। আমি হতবাক, লজ্জিত। সীতারাম চেটেপুটে সব খেয়ে পাতা ফেলতে চললেন। আমিও তাই করলাম।
এখন চে’র
দিন আসলেই মনে পড়ে পূর্ণিয়ার বাহুবলী মানুষদের লড়াই, অজিত সরকারকে হারানোর শোক, রক্তভেজা রাস্তা, অমলতাস আর লাল পতাকায় মোড়া নেতার শবদেহ ছুঁয়ে দেহাতী মানুষদের বুকফাটা
কান্না, রহস্যময় তাৎমাটুলির মাঝে লেনিননগরে চে’র জন্মদিন আর
মাঠের মাঝে বাবু হয়ে সীতারাম ইয়েচুরি আর কৃষকদের সাথে খেতে বসার এক নতুন অভিজ্ঞতা।
ছবিটা
সেসময় ছোট ক্যামেরায় তোলা। তখন ডিজিটাল জীবন আসেনি।
১৪জুন,
২০২১
No comments:
Post a Comment