অশোক ভট্টাচার্য
আর কয়েকদিনের
মধ্যে অবশেষে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন হতে চলেছে। অবশ্যই যদি রাজ্য
নির্বাচন কমিশন বা রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। করোনার অজুহাতে নির্বাচন
প্রথমে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক জনমত ও নাগরিক আন্দোলনের
চাপে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন ২২জানুয়ারি চারটি পৌর কর্পোরেশন
নির্বাচনের দিন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। পরে তা পিছিয়ে দিয়ে নির্বাচনের দিন
পুনঃনির্ধারণ করা হয় ১২ ফেব্রুয়ারি। যদিও করোনার প্রকোপ এখনও অব্যাহত রয়েছে।
ইতিমধ্যে
বামফ্রন্ট সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচারের কাজ অব্যাহত রেখেছে। বামফ্রন্ট
সমস্ত করোনা বিধি মান্য করেই প্রচারের কাজ চালিয়ে গেলেও, তৃণমূল
কংগ্রেস দল কিন্তু তা মেনে চলছে না। ইতোমধ্যে তাদের এক প্রধান নেতা করোনা বিধি না
মেনে প্রচারের কাজ চালানোর ফলে নিজে যেমন অসুস্থ হয়েছেন সেই সংক্রমণে সংক্রমিত
হয়েছেন তাদের দলের অনেক কর্মী ও নেতারাও। এই নিয়ে শহরের মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন
উঠছে।
যে চারটি
পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তার মধ্যে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের
নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০১৫সালে রাজ্যের সর্বশেষ পৌর কর্পোরেশনগুলির
নির্বাচনে একমাত্র শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনেই বামফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে
বিজয়ী হয়ে পৌরবোর্ড গঠন করেছিল। রাজ্যের বিভিন্ন পৌর কর্পোরেশন বা পৌরসভার
নির্বাচনগুলিকে শাসকদল পুলিস প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রহসনে পরিণত করেছিল। তা পারেনি
কেবলমাত্র শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনে। কারণ বামফ্রন্ট সেই সময় সব দল, তথা
দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ভোটদাতাদের কাছে নিজের ভোট নিজে দেওয়া, বাধা
এলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আবেদন জানিয়েছিল। মানুষ সেই আবেদনে
ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিলেন এবং নিজের ভোট নিজের পছন্দমতো প্রার্থীদের দিতে
পেরেছিলেন। ফলে বামফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল। কিছু সংবাদমাধ্যম একেই বলেছিল শিলিগুড়ি
লাইন। আর একটি বিষয় হলো নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বামফ্রন্টকে পৌরবোর্ড পরিচালনা করতে
হয়েছিল বহু বাধা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে। শাসকদল নানাভাবে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি
করেছিল দলত্যাগের। হুমকি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচিত পৌরবোর্ড ভেঙে দেবার ও জবরদখল
করার। ওই পৌরবোর্ড এতো বাধার মধ্যে উন্নয়ন ও উন্নত পরিষেবা প্রদানের কাজ করেছিল
সাফল্যের সাথে।
বামফ্রন্ট
পরিচালিত সেই পৌরবোর্ড একদিকে উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্যে যেমন লড়াই
করেছিল,
তেমনি লড়াই করে বহু দাবি আদায় করেছিল, আবার
নিজস্ব উদ্যোগে আয় বাড়িয়ে বহু উন্নয়নমূলক কাজও করেছিল। কাজ করেছিল মানুষকে সাথে
নিয়ে সৎ ও স্বচ্ছভাবে। বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল শহরের বুনিয়াদি পরিষেবা প্রদান ও
পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ। সেইসব কাজ শহরের মানুষের চোখের সামনে রয়েছে। এতো বাধার
মধ্যে বামফ্রন্ট শাসক দলের ও রাজ্য সরকারের চোখ রাঙানির কাছে মাথা নিচু করেনি।
করেনি আত্মসমর্পণও। শিলিগুড়ির মানুষ এরজন্য গর্ববোধ করে।
এই শহরের
মানুষ জানে শিলিগুড়ির উন্নয়ন ও বামফ্রন্ট সমার্থক। মানুষ দেখেছে ও তারা জানে
শিলিগুড়িকে রাজ্য তথা দেশ ও বিদেশের কাছে তুলে ধরেছে বামফ্রন্টই। একটি ছোট্ট
জনপদকে একটি মেট্রো শহরের দিকে নিয়ে গেছে বামফ্রন্টই। বামফ্রন্টই শিলিগুড়িকে
পৌরসভা থেকে পৌর কর্পোরেশনে উন্নীত করেছে। মানুষ বিগত ৪০ বছরের মধ্যে একবারই মাত্র
তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোটের পৌরবোর্ডকে নির্বাচিত হতে দেখেছে। মানুষের
অভিজ্ঞতা বলে তারা জোটবদ্ধভাবে সেই পৌরবোর্ডকে পরিচালনা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ
হয়েছিল। এমনকি নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে সেই পৌরবোর্ডকে তারা চার বছরের বেশি সময়
অব্যাহত রাখতে বা পরিচালনা করতে হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অন্যদিকে শহরের মানুষ দেখেছে
এই শহরের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে বিগত বামফ্রন্টের পৌরবোর্ড, বামফ্রন্ট
পরিচালনাধীন শিলিগুড়ি—জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সেই সময়ের রাজ্য সরকারের
বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগে। এই শহরের ঘরে ঘরে পানীয় জল সরবরাহ, প্রতিটি
গৃহ থেকে জঞ্জাল সংগ্রহ করা, ওয়ার্ড ভিত্তিক জঞ্জাল সংগ্রহ ও
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে ওয়ার্ড বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি, ওয়ার্ড
কমিটি গঠন এসব বামফ্রন্ট পৌর বোর্ডেরই সুফল। শহরে যতো বড় বড় রাস্তা বা রাস্তা
প্রশস্তকরণ,
ডিভাইডার নির্মাণ, ফুটপাত, রাস্তার ধারে গাছ লাগানো, পাকা
নালা নির্মাণ,
জল নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন, শহরের মধ্যে যানজট জটিলতা হ্রাস
করতে বামফ্রন্টই নির্মাণ করেছিল তিনটি উন্নতমানের বাইপাস, চারটি
মহানন্দা সেতু,
প্রায় ১৫টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি, পঞ্চনই, মহিষমারি
নদীর ওপর। এই শহরের দুটি ফ্লাইওভারও নির্মিত হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে।
তিনটি আন্ডারপাস, রাস্তার ধারে এলইডি আলো। বস্তি উন্নয়ন, পাড়ার
রাস্তার উন্নয়ন,
বস্তির সার্বিক উন্নয়ন তাদের জমির পাট্টা, লিজ প্রদান, দলিল
দেওয়া সবই হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়ই।
শহরের
মধ্যে যানজট হ্রাস করতে শহরের বাইরে পরিবহণ নগর, তিনটি
উপনগর, বিঞ্জান
নগরী, ট্রাক
টার্মিনাল,
উন্নতমানের দুটি বাস টার্মিনাল, শ্মশানঘাটে বৈদ্যুতিক চুল্লি স্থাপন, কারবালা
উন্নয়ন এসবও হয়েছে বামফ্রন্ট জমানায়। বামফ্রন্ট শিক্ষা, সংষ্কৃতি, খেলাধুলার
উন্নয়নে রেখে গেছে বিরাট অবদান। এই শহরে কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন, ইন্ডোর
স্টেডিয়াম,
দীনবন্ধু মঞ্চ, সুইমিং পুল, ক্রীড়াদীপ্তি সবই বামফ্রন্টের
অবদান। এই শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া ও সাংষ্কৃতিক
অনুষ্ঠান। বামফ্রন্টের সময়েই হয়েছে দুটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সরকারি
বিজ্ঞান ও পলিটেকনিক কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং
কলেজ। বামফ্রন্টের সময়ে পাঁচটি নতুন সংগঠিত বাজার নির্মাণ, তিনটি
বাজার নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ, ডি আই ফান্ডকে পৌরসভার হাতে আনা
ইত্যাদি কাজও হয়েছে। মহানন্দা নদী সংস্কার প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছিল
বামফ্রন্টের সময়ে। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস দলের সরকার আসবার পর তাদের পরিচালিত
এসজেডিএ’র চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছিল ২০০ কোটি টাকার লুট ও
দুর্নীতির সাথে। আজ সেই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বামফ্রন্ট পরিচালিত এসজেডিএ
বোর্ডের কাজের সাফল্যই টি পার্ক, ফুড পার্ক, আনারস
পার্ক, ড্রাই
পোর্ট ইত্যাদি কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প সমূহ। বামফ্রন্টই উদ্যোগ নিয়েছিল উত্তরায়নে
২৫একর জমির ওপর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণে বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোন
নির্মাণের। বর্তমান রাজ্য সরকারের একজন মন্ত্রীর উদ্যোগে সেই প্রকল্পের উদ্যোগে
বাতিল ও বানচাল করে দেওয়া হয়। কোয়ানটাম তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্রটিও বামফ্রন্টের
উদ্যোগের সুফল। বর্তমান রাজ্য সরকারের সময়ে তাও মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে।
শিলিগুড়ি
শহরের সমস্ত স্বীকৃত ও অস্বীকৃত বস্তিগুলির যতো উন্নয়ন হয়েছে তা হয়েছে বামফ্রন্টের
সময়তেই। কম করেও প্রায় ১০হাজার উদ্বাস্তু ও সরকারি উদ্যোগে বা পৌরসভার উদ্যোগে
জমির দলিল,
পাট্টা বা লিজ দলিত পেয়েছে বামফ্রন্টের উদ্যোগেই।
বামফ্রন্টের
নেতৃত্বে বিগত পৌরবোর্ডের সময়ে সমস্ত ওয়ার্ডে অজস্র রাস্তাগুলিকে ম্যাস্টিকে
উন্নীত করা হয়েছে। রাস্তার ধারে উন্নত পাকা নালা নির্মাণ করা হয়েছে। সমস্ত রাস্তায়
এলইডি আলো লাগানো হয়েছে। নতুন অফিস ভবন ও স্বাস্থ্যভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া
হয়েছে। ১১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। শ্মশানঘাটে নতুন দুটি বৈদ্যুতিক
চুল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নাট্য মঞ্চ, চারটি
নতুন পার্ক,
নদীর ঘাট উন্নয়ন, নদী তীরের সৌন্দর্যায়ন, বিসর্জনঘাটের
উন্নয়ন ইত্যাদির পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বামফ্রন্টই নিয়েছে।
পৌর
প্রশাসনে স্বচ্ছতা, সততা, দ্রুততা, দায়বদ্ধতা, বিকেন্দ্রীকরণ
বামফ্রন্টেরই সাফল্য। পৌরসভা বামফ্রন্ট পরিচালনা করেছে সবসময়ই গণতান্ত্রিকভাবে।
বিরোধীদেরও দেওয়া হয়েছে সমান অধিকার ও মর্যাদা। কোনোরকম রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক
আচরণ করা হয়নি। শিলিগুড়িকে একটি পরিকল্পিত শহর হিসাবে গড়ে তুলতে প্রস্তুত করা
হয়েছিল ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। জমির সদ্ব্যবহার মানচিত্র, জলবায়ুর
পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনা, পরিবেশে দূষণ হ্রাসের পরিকল্পনা
ইত্যাদি। যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রশংসিত হয়েছিল। শিলিগুড়ির উন্নয়নে
বামফ্রন্টের সাফল্যের ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না।
তাই এই
নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিটি মানুষের মুখে একটিই কথা, শিলিগুড়ির
যাবতীয় উন্নয়ন হয়েছে বামফ্রন্ট পৌরবোর্ডের সময়েই। একমাত্র বামফ্রন্টের হাতেই
শিলিগুড়ি শহর থাকতে পারে সুরক্ষিত। শিলিগুড়ি শহরের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান ধরে
রাখতে পারে বামফ্রন্টই। এই কারণেই এই শহরের মানুষ পুনরায় বামফ্রন্টের পৌরবোর্ডকেই
দেখতে চায়। তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি—কে ভোট দেওয়া মানে শিলিগুড়ি শহরকে আরও দশ বছর
পিছিয়ে দেওয়া। অনুন্নয়ন, অনিশ্চয়তা, নৈরাজ্যকে
ডেকে আনা। মানুষ তা চায় না। এই শহরের মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে দেখেছে ২০০৯ সালে।
বিগত ৮মাস প্রশাসক মণ্ডলীর চেয়ারম্যান ও বোর্ডে তৃণমূলীদের মানুষ দেখেছে। সেই
অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি মানুষ চায় না। এই শহর উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের
একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এই শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী।
সাম্প্রতিক তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসনে তাদের দলবাজি, দাম্ভিকতা, কাটমানি
মানুষ দেখেছে। এই কারনে তারা শিলিগুড়ির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই তৃণমূল কংগ্রস ও
বিজেপি—কে চায় না। তারা তাদের সুরক্ষা নিরাপত্তা, সম্মান, আত্মমর্যাদা, শান্তি
সম্প্রীতির জন্যেই চায় বামফ্রন্টকে পৌরবোর্ডে ফিরিয়ে আনতে। এই চর্চা আজ শহরের
সর্বত্রই দলমত নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে চর্চিত হচ্ছে।
শিলিগুড়ির
মানুষ আর একবার বামফ্রন্টের পক্ষে ইতিবাচক রায় দিয়ে ২০১৫সালের পুনরাবৃত্তির দিকে
তাকিয়ে আছে। শিলিগুড়ি চায় আরও উন্নততর শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি চায় আরও বসবাস উপযোগী
শহর। যেখানে গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে থাকবে ভারসাম্য। পরিবেশের সাথে
ভারসাম্য বজায় রেখেই হবে উন্নয়ন। গরিবদের বসবাসের ক্ষেত্রে থাকবে নিশ্চয়তা। পৌরসভা
হবে গরিব মধ্যবিত্ত অভিমুখী। বস্তি রেখেই হবে বস্তির উন্নয়ন। এইরকম এক পৌরসভা দিতে
পারে একমাত্র বামফ্রন্টই।
গণশক্তি, ১
ফেব্রুয়ারি, ২০২২
No comments:
Post a Comment