20220712

ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার লড়াই: সীতারাম ইয়েচুরি

 

------------------------------------------

৮ জুলাই জ্যোতি বসু স্মারক বক্তৃতায় ‘স্বাধীনতা: ৭৫’ শিরোনামে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির ভাষণের সম্পাদিত বয়ান।

------------------------------------------

আমার রাজনৈতিক জীবনে প্রায় তিন দশক জ্যোতি বসুর সঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ পেয়েছি তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে ফেরার পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে জ্যোতি বসু বাকিদের মতো ওকালতি পেশায় যুক্ত হবেন। কিন্তু তার বদলে তিনি আন্দোলনের ময়দানে পা রাখলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন যে দেশে ফেরার পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যুক্ত হবেন এবং সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সময় চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে যে স্বাধীন ভারতের চরিত্র কেমন হবে। এই নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত শুরু হয়েছিল। 

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল কংগ্রেসের। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে ভারতের বৈচিত্রকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ভারত বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কংগ্রেসের এই ধারণাকে সমর্থন করলেও দাবি তোলা হয় যে সাধারণ মানুষ যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবে তাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রূপ দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে, তবেই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা টিকে থাকবে। এভাবেই ভারত ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে চলবে। ভারতে বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে সেই সময় কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ভারত যদি সমাজতন্ত্রের দিকে, অর্থনৈতিক সমতার দিকে এগিয়ে না যায় তবে দেশের মানুষের মধ্যে ক্রমশ তৈরি হওয়া অসন্তোষ একটা সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করবে।

 


আর এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী মত হিসাবে উঠে আসে তৃতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তাতে বলা হয় যে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ব্যাখ্যা করতে হবে। একটি পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে ভারতে যেহেতু মুসলিমদের একটি বড়সড় জনসংখ্যা থাকে তাই একটি মুসলিম রাষ্ট্র দরকার আছে। অপর দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় যে ভারত নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবে। কে মুসলমান আর কে হিন্দু সেই নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব ছিল। যেমন কেরালার মোপলা মুসলিম আর আসামের সিলেটি মুসলিমের মধ্যে মিলের চেয়ে ফারাকই বেশি আছে। ভারতের হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই বৈচিত্র আরও বেশি। এইসময়ে হিন্দুত্বের ধারণা নিয়ে আসেন সাভারকার। ইংল্যান্ডে থাকাকালীনই সাভারকার হিন্দুত্ববাদ শীর্ষক একটি লেখায় উল্লেখ করেন যে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক নেই। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে হিন্দুত্ববাদ হলো একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। এর মাধ্যমে বলা হয় যে ভারত যাদের মাতৃভূমি পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি তারাই একমাত্র এখানে থাকতে পারবে। সাভারকার উল্লেখ করেন যে মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা মদিনা এবং খ্রিস্টানদের পুণ্যভূমি জেরুসালেম। আরএসএস তৈরি হওয়ার দুবছর আগেই এই ধারণা ধীরে ধীরে প্রচার হতে থাকে। হিন্দু রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্র এই দুই রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে মুসলিম লিগের সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্নাহও একই কথা বলেন। সেই সময়ে সাভারকার জানান যে তাঁর সঙ্গে জিন্নার কোনও মতবিরোধ নেই। এই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই স্বাধীন ভারত দুই ভাগে ভাগ হয়। সেই একই কথা এখন শোনা যাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আরএসএস নেতাদের মুখে। তাঁদের কথায়, পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতে বসবাস করছে হিন্দুরা। আর ১২০০ বছর ধরে তারা পরাধীন। কারণ সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। তারপর ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর সেই সময়ের লড়াইকে হিন্দু বনাম খ্রিস্টানের বলে উল্লেখ করতে চাইছে আরএসএস। আর এই সবের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাসে পরিবর্তন করা হচ্ছে। ভারতের ইতিহাসকে তারা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে, আর ভারতীয় দর্শনকে বদলে হিন্দু দর্শনের পাঠ দিতে চাইছে। এসবের কারণেই স্বাধীনতা পূর্ব ভারতের তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব। 

জ্যোতি বসুর দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা  ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। সেই সময় থেকেই কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ভারতকে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি করতে চাইলেও পুঁজিবাদের ওপর কংগ্রেস নির্ভরশীল ছিল, কমিউনিস্টরা তার বিরোধিতা করে। ১৯৪০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর্বে এবং স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে বিদেশ থেকে জ্যোতি বসু যখন দেশে ফেরেন তখন তাঁর এবং কয়েকজন কমিউনিস্ট সদস্যের ওপরে ওপর মুখ্য দায়িত্ব পরে তৎকালীন ভারতে কৃষকদের দুর্দশার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার। যেমন বাংলায় তেভাগা আন্দোলন, কেরালায় পুন্নাপ্রা ভায়লার, মহারাষ্ট্রে ওরলি আদিবাসীদের জমির লড়াই, আসামের সুরমা উপত্যকায়, তেলেঙ্গানায় তখন ছড়িয়ে পড়তে থাকে কৃষি আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলিকে থেকে বলা যেতে পারে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অন্যদিকে কংগ্রেস জমিদার, জোতদারদের সাথে বোঝাপড়া করে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আনার চেষ্টা করেছে। এই বোঝাপড়া স্বাধীনতার পরেও টিকে থাকে এবং তার পরিণাম এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরোপুরি শেষ হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সামন্তবাদের সাথে আপস করে পুঁজিবাদ নিজেদের জমি তৈরি করতে চেয়েছে, ফলে সামন্তবাদের উচ্ছেদ হয়নি। জ্যোতি বসু বার বার বলতেন যে, এরফলে সামন্তবাদী ধারণার আধিপত্য সমাজে বজায় থাকে। যেমন ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা এবং জাতব্যবস্থা এই দুই ধারণা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সে পিতৃতন্ত্রের প্রশ্নে হোক বা আদিবাসী দলিতদের ওপর অত্যাচারের প্রশ্নে হোক, কমিউনিস্টদের এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। প্রসঙ্গত, এই সব ধারণা আরএসএস’এর মনুবাদী মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়, বিজেপি আরএসএস হিন্দুত্বের স্লোগানকে সামনে রেখে এইসব সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা ভাবনাকে এখন প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। 

বিজেপি জানে যে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির কথা তারা বলছে তা কোনোভাবে সম্ভব নয় বর্তমান ভারতীয় সংবিধান থাকলে। হিন্দু রাষ্ট্র করতে তাদের সংবিধান বদলাতে হবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে আমরা এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যখন কেন্দ্রে এমন এক সরকার ক্ষমতায় রয়েছে যারা ভারতের সংবিধানকে বদলাতে চাইছে। তাকে মান্যতা দিতে চাইছে না শুধুমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করবে বলে। সংবিধানের চার ভিত্তি আর্থিক সার্বভৌমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র। এই চার স্তম্ভই আজ আক্রমণের সামনে। তিস্তা শীতলবাদের ঘটনা চোখে  আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বর্তমান ভারতের গণতন্ত্রের পরিস্থিতি। বর্তমান সরকার বলতে চাইছে যে সত্যি কথা কেউ বলতে পারবে না। সত্যি প্রকাশের জন্য সাংবাদিক জুবেইরকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ২০১৪ সালের পর একের পর এক নতুন আইন তৈরি করে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সরকার কেড়ে নিয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে সরকার বলছে ভিন্নধর্মে বিবাহের আগের পুলিশ ভেরিফিকেশন করাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। যে সব আইন বিজেপি সরকার তৈরি করছে তার মধ্যে দিয়ে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যেখানে হিন্দু এবং মুসলমানরা একে অপরের সাথে খোলাখুলি মেলামেশা করতে পারবে না। সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন, আদিবাসী দলিতদের ওপর ক্রমশ আক্রমণ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। কর্পোরেট এবং সরকারের সখ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দুই বছরে আদানির সম্পদ ব্যাপক বেড়েছে। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে রয়েছি যেখানে সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে। অন্যদিকে খাদ্যের দিক থেকে হোক স্বাস্থ্যের দিক থেকে হোক বা অন্য যে কোনও বিষয়ে বিভিন্ন সূচকে ভারতের স্থান ক্রমশ নিম্নমুখী।

 


স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে এসে ভারত আবার সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে তারা স্বাধীনতার আগে ছিল। সেই সময় যে যে বিষয়ের বিরুদ্ধে ভারতকে লড়াই করতে হয়েছে আজও সেই একই বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু সময় বদলানোর সাথে সাথে লড়াইয়ের চরিত্র ধরন বদলে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে ভারতে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা এখন আবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে স্বাধীনতার রাতে মহাত্মা গান্ধী কোথায় ছিলেন। তিনি কলকাতায় ছিলেন, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, তারপর গিয়েছিলেন নোয়াখালিতে। আরএসএসের মতাদর্শের কারণে মহাত্মা গান্ধীকে খুন হতে হয়েছে। 

জ্যোতি বসু এবং হরকিষেণ সিং সুরজিৎ উভয়েই প্রতি পদক্ষেপে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতেন। এই প্রশ্নে তাঁরা কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী দলগুলি ছাড়াও অন্যান্য দলগুলির কাছেও সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এই দুই নেতা দেশভাগের ক্ষত নিজেদের চোখে দেখেছেন, মরমে মরমে উপলবদ্ধি করেছেন। একজন বাংলায়, একজন পাঞ্জাবে। ভারত ভাগে আসল বিভাজিত হয়েছিল বাংলা এবং পাঞ্জাব। সেই বিভাজনের অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়, সাম্প্রদায়িকতার আগুন কীভাবে সবথেকে প্রগতিশীল বিচারধারাকে আক্রমণ করেছে। পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অগ্রসর, একইভাবে লাহোর শহর ছিল গোটা পাঞ্জাবের স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল। ভগৎ সিং লাহোরে কাজ করেছিলেন। সুরজিৎ নিজে লাহোর থেকে অমৃতসর অবধি সাইকেল চালিয়ে আসতেন বিপ্লবের কাজে। স্যার সিকান্দার হায়াত খান অবিভক্ত পাঞ্জাবের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কন্যা তাহিরা কমিউনিস্ট পার্টির পাঞ্জাব প্রদেশ কমিটির সদস্য ছিলেন। লাহোরে তাঁদের বাড়িতেই সাধারণত ক্যাবিনেট বৈঠক হতো, আবার কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠকও সেখানেই হতো। এমনও দিন গেছে, বাড়ির একতলায় পাঞ্জাব সরকারের ক্যাবিনেট বৈঠক চলছে, এবং দোতলায় কমিউনিস্ট পার্টির পিসি বৈঠক হচ্ছে। তো এমনই এক বৈঠক চলাকালীন খবর এল, পাঞ্জাব সরকারের ক্যাবিনেট বৈঠকে ঠিক হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। এমন সময় তাহিরা বলেন, আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনারা আমাদের বাড়িতেই থেকে যান। কারোর কল্পনাতেও আসা সম্ভব নয়, যে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেই কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠক চলছে! দেশভাগের পরে লাহোরের সেই ঐতিহ্য একেবারেই হারিয়ে গেল। ঢাকা শহরে আবার নতুন করে প্রগতিশীল আন্দোলন দানা বাঁধছে এবং বামপন্থীরা সেখানে ভূমিকা রাখছেন। 

সুরজিৎ, জ্যোতি বসুরা বারবার বলতেন, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতে চান, তাঁদের সবাইকে একজোট করতে হবে। যারা এমারজেন্সির বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক ছিলেন, তাঁদের সবাইকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলাম। আমরা এমন সরকারকে সমর্থন করেছিলাম, যে সরকারের বিদেশমন্ত্রীর নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর নাম লালকৃষ্ণ আদবানি। যদি প্রশ্ন করেন কেন এই সরকারকে সমর্থন করেছিলাম, তার উত্তর হলো— যে কোনও উপায়ে জরুরি অবস্থাকে রুখতেই হতো। সেই সময়কার সব কালাআইনকেও সংবিধান থেকে বাতিল করতে হতো। তাই এই সরকারকে আমরা সমর্থন করি। জ্যোতি বসু ১৯৬৭ সালে অজয় মুখার্জিকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাতে রাজি হয়েছিলেন, নিজে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, যদিও সেই সময় আমাদের বৃহত্তম সংখ্যক বিধায়ক ছিলেন। আমরা নিজেরা মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি জানাতে পারতাম। কিন্তু ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯- দুইবারই, বেশি বিধায়ক নিয়েও আমরা অজয় মুখার্জিকে মুখ্যমন্ত্রী হতে সাহায্য করি। কেন? কারণ তখন আমাদের মূল কাজ ছিল যে ভাবে সম্ভব কংগ্রেসকে হারানো এবং ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা। 

মূল বিষয় হলো, প্রতি যুগেই এমন একটা সময় আসে, যখন আমাদের শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে আশু লক্ষ্য চিহ্নিত করতে হয়। সেই মুহূর্তের পরিস্থিতির নিরিখে আমাদের চিহ্নিত করতে হয় শত্রুকে। কোন শক্তির কিংবা ব্যক্তির বিরোধিতা করতে পারলে গণআন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা সেই মুহূর্ত ঠিক করে দেয়। 

১৯৯৬ সালে নরসিমা রাওয়ের সরকারের ঠিক পরেই বাজপেয়ীর সরকার ক্ষমতায় এল। আমরা বললাম এদের ঠেকাতে হবে। সেই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা বললেন, আমি সরকার গড়তে সর্ববৃহৎ দলকে ডাকবো। সেটা ছিল বিজেপি। বিজেপি ১৩দিন সরকার চালিয়েছিল। সেই সময় আমি এবং আমার সহকর্মীরা জ্যোতি বসু এবং সুরজিতের কাজ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে আমরা সেই সময় খুবই শঙ্কিত ছিলাম। বিজেপি একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে তাদের উৎখাত করা কঠিন হয়ে পড়বে। জ্যোতি বসু এবং সুরজিৎ আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, তোমরা চিন্তা কোরো না, আমরা এদের ঠিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ছাড়ব। ১৩দিন পরে সংসদে আস্থা ভোট হলো, এবং ভোটে হেরে বাজপেয়ী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। তারপর প্রথম ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো। 

মূল বিষয় বা প্রশ্ন হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের কী প্রয়োজন সেই নিরিখেই আমাদের পথ তৈরি হবে। ১৯৭৭ সালে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে এমারজেন্সি এবং ইন্দিরা গান্ধীকে পরাস্ত করতে হবে। তাই আমরা এমারজেন্সির বিরোধিতা করতে প্রস্তুত সব শক্তির সঙ্গে একজোট হই। একইভাবে আমাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে, আমাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। তাই বিজেপি’কে পরাস্ত করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক সমস্ত শক্তিকে একজোট করার দিকে আমরা এগোচ্ছি। জ্যোতি বসুই খুব সম্ভবত আমাদের দেশের জোট রাজনীতির স্থপতি ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বাংলার প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে শুরু। তারপরে বাংলায় এবং দেশে যতগুলি যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়েছে, প্রত্যেকটিতে জ্যোতি বসুর ভূমিকা ছিল। 

২০০৪ সালে এনডিএ সরকারকে হারানোর জন্য বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সুরজিৎ। সেই সময়ের মূল প্রশ্ন ছিল, কিভাবে বিজেপি-কে পরস্ত করতে পারার মতো সংখ্যা একত্রিত করা যায়। বিরোধীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ ছিল— নিজের নিজের রাজ্যে যাও। বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে যতটা সম্ভব একত্রিত করো। এই ফর্মুলাতে রাজ্যস্তরে নিশ্চিত করতে হবে যে যাতে প্রতিটি রাজ্য থেকে অধিক সংখ্যক বিজেপি বিরোধী সাংসদ জিতে আসতে পারেন। তারপর আমরা দিল্লিতে বসে ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করব। বাস্তবেও ঠিক এটাই হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের যুক্তফ্রন্টও কিন্তু নির্বাচনের পরেই গঠিত হয়েছিল। একই কায়দায় ২০০৪ সালের প্রথম ইউপিএ সরকার নির্বাচনের পরে গঠিত হয়। এই অভিজ্ঞতাগুলি থেকেই স্পষ্ট, ভারতে নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী বিজেপি বিরোধী কোনও মোর্চা গঠন সম্ভব নয়। কিছু মানুষ এখন থেকেই মোদীর এবং বিজেপি’র বিকল্প জোট ইত্যাদি গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হলো এই ধরনের বিকল্প রাজ্যস্তরে গড়ে তুলতে হবে। যেমন তামিলনাড়ুতে হয়েছে। প্রথমে রাজ্যস্তরে করে তারপরে সেটাকে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনতে হবে। 

এই মুহুর্তের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি? আমরা পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাম্প্রদায়িকতাকে হারাতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সর্বোচ্চ ঐক্য গঠন করতে হবে। আমাদের প্রাথমিক কাজ হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, তাকে দুর্বল করতে হবে এবং তাকে হারাতে হবে। সেই কাজ করতে গেলে সবার আগে আমাদের পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের পার্টির সংগঠন এবং জনভিত্তি মজবুত করতে হবে। দ্বিতীয়ত বামপন্থী ঐক্য মজবুত করতে হবে। তৃতীয়ত সেই জোরের উপর দাঁড়িয়ে বাম-গণতান্ত্রিক জোট গঠন করতে হবে। এই জোট কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সামাজিক ও ন্যায়ের দাবিতে আন্দোলনরত সংস্থা এবং শক্তিগুলিকেও এরমধ্যে শামিল করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে এক জায়গায় জড়ো করতে গেলে ন্যূনতম একটা বোঝাপড়ায় আমাদের পৌঁছাতেই হবে। 

বর্তমানে আমাদের দরজায় রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন কড়া নাড়ছে। এমন একজন প্রার্থী খুঁজে বের করতে হবে যাকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি সমর্থন জানাতে প্রস্তুত হবে। এই প্রার্থীকে সামনে রেখে আমরা বিজেপি’র প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং আদর্শগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারব। এটাই মূল ইস্যু। একাধিকবার আমাদের মধ্যে প্রার্থীর নাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যাকে অধিকাংশ দল সমর্থন জানাতে রাজি হবে। বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিজেপি’র বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছুঁড়ে দেওয়া। এই প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমাদের পূরণ করতেই হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারিনা অমুকে হলুদ জামা পরেছে বা তমুকে লাল জামা পরেছে বলে আমি তাঁকে সমর্থন করব না। কিংবা সেই ব্যক্তি আগে অমুক অমুক কাজ করেছে তাই তাঁকে সমর্থন করা যাবে না। জ্যোতি বসুদের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে অজয় মুখার্জি বাংলায় কি কি করেছিলেন, কিংবা জনতা পার্টির নেতা হওয়ার আগে জগজীবন রামের ভূমিকা কী ছিল, রাজীব গান্ধীর অর্থমন্ত্রী হিসাবে ভিপি সিংয়ের ভূমিকা কী ছিল, এইসব প্রশ্ন আমরা তুলিনি, আমরা তাঁদের প্রত্যেককে সমর্থন জানিয়েছি কোনও না কোনও সময়ে। আমরা রাষ্ট্রপতি পদে ভিভি গিরিকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু আমরা তাঁকে শর্ত দিয়েছিলাম। আপনি ব্যাঙ্ক, কয়লার রাষ্ট্রীয়করণ করুন, তাহলেই একমাত্র আপনাকে সমর্থন করব। এবং তাঁকে দিয়ে আমরা এগুলি করিয়ে নিয়েওছিলাম। 

জ্যোতিবাবু এবং সেই সময়ের নেতা যাঁদের আমরা পার্টির নবরত্ন বলে থাকি তাঁদের থেকে আমাদের শিখতে হবে, কীভাবে আশু লক্ষ্য পূরণ করে আমাদের আদর্শ এবং রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যই নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল গ্রহণ করতে হবে। একটি শক্তি কিংবা ব্যক্তিকে সমর্থন জানানোর মাপকাঠি কেবলমাত্র এটাই। একজন ব্যক্তি অতীতে কী করেছেন, বা ভবিষ্যতে কী করতে পারেন, সেই ভাবনা থেকে বর্তমানের রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ইতিহাস তাই-ই বলছে। এই সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করার ফলেই আমরা এমারজেন্সিকে পরাস্ত করতে পেরেছি। আমারা মোরারজী দেশাই সরকারকে সমর্থন না করলে এমারজেন্সি সরানো যেত না। আর এমারজেন্সি না সরলে পশ্চিমবাংলায় ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হত কিনা তা বলা সম্ভব নয়। জ্যোতিবাবুর ২৩বছরের রেকর্ড মুখ্যমন্ত্রিত্ব, হয়ত এর কোনওটাই হতো না। আমরা কাকে সমর্থন করছি সেটা বিষয় নয়, কেন সমর্থন করছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য কী?  উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন আসছে। আমরা এমন একজন প্রার্থীর খোঁজ করছি, যাঁকে সামনে রেখে বৃহত্তম বিরোধী ঐক্য গঠন সম্ভব। 

ইংল্যান্ড থেকে ফেরত আসার পরে জ্যোতি বসু ব্যারিস্টারির লোভনীয় পেশার হাতছানি উপেক্ষা করে রাজনীতিতে এলেন। শেষজীবনে তিনি একবার বলেছিলেন, সীতারাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করব। আর আজকে আমি আমার মরণোত্তর দেহদান করলাম, আমি জানতাম না যে মৃত্যুর পরেও আমি জনগণের সেবায় কিছু করতে পারি। এই ধরনের মূল্যবোধ এবং চিন্তাধারা বিরল। তাঁর এই চিন্তাধারার জন্য আমরা তাঁকে সেলাম জানাই। এবং শুধুমাত্র সেলাম জানানোই নয়, আমরা প্রতি মুহূর্তে তাঁর থেকে শিক্ষা নিই, নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করি। 

আমরা বর্তমানে একটি যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এর আগের যুগসন্ধিক্ষণে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল। এই সন্ধিক্ষণে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের কাঠামো রক্ষার লড়াইতে জিততে হবে। সেই ভিতের উপরে দাঁড়িয়েই আমাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। 

...........................................

গণশক্তি, উত্তর সম্পাদকীয়, ১০জুলাই, ২০২২

...........................................

No comments:

Post a Comment