চন্দন দাস
রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের
মাত্রা বদলে গেছে। ‘গ্রামের সরকার’ গড়ার সংগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র
রক্ষার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বোমায় ক্ষতবিক্ষত নলহাটির খেতমজুর হীরু লেট সেই
যুদ্ধের নিশান।
রাজ্যের অষ্টম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত
নির্বাচন শুরু আগামী ১লা মে। একমাসও বাকি নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচন ‘গ্রামের সরকার’
গড়ার নির্বাচন। নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই। ফলে গ্রামের উন্নয়ন
সম্পর্কে কোনও রাজনৈতিক দল বা পার্টির কী নীতি — তার
সংগ্রামই পঞ্চায়েত নির্বাচন। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামের উন্নয়ন, শাসকদলের নেতা কর্মীদের দুর্নীতি, গ্রামের বিকাশে
রাজ্য সরকার এবং সরকারে আসীন দলের ভূমিকাই এই নির্বাচনের প্রধান বিচারের বিষয়। আর
সেক্ষেত্রে গ্রামের মানুষই প্রধানত সেই বিচারের দায়িত্বে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ গত সাত বছর এক
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আছে। দিন যত যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতির সংকট বাড়ছে, বিপদ ছড়াচ্ছে। এখন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা
ঘনীভূত। এখন, এই পরিস্থিতিতে আমরা এক যুদ্ধে আছি। শুধু
গ্রামের যুদ্ধ আর নেই তা। নিঃসন্দেহে গ্রামবাসীদের দিকেই অধীর অপেক্ষায় রয়েছে সময়।
তবু, এই পরিস্থিতিতে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে রাজ্যের প্রায় দশ
কোটি মানুষ পাশাপাশি এক যুদ্ধে আছি। যুদ্ধ সরকার গড়ার নয় — এই
সংগ্রাম আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের।
যুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে। দুটি
পক্ষেরই কিছু মিত্র শক্তি থাকে। এই শেষ বসন্তে, এপার বাংলার প্রতি ইঞ্চি জমিতে যুযুধান
দুই পক্ষ। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস। আর একদিকে মানুষ — ছোট
দোকানদার, কৃষক, চাকরিজীবী, খেতমজুর, দিনমজুর, অসংগঠিত
শ্রমিকসহ আরও অনেকে। গরিব, মধ্যবিত্ত, ছোট
ব্যবসায়ী আর তৃণমূল কংগ্রেস মুখোমুখি।
তৃণমূল কংগ্রেসের মিত্র শক্তি
আছে — সংগোপনে, কৌশলে। নাম — বি জে
পি। বি জে পি-র পিছনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব
হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল। আর সম্মিলিত জনতার বন্ধু কারা?
যাঁরা ২৮শে মার্চ কাজের দাবিতে মিছিল করেছেন, তাঁরা
রাজ্যের জনতার মিত্র শক্তি। যাঁরা রামনবমীর আগে শোভাযাত্রা করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন — ‘ধর্ম যার যার/ দেশ সবার’
— তাঁরা মানুষের পক্ষে। তাঁরা বামপন্থী, তাঁরা
ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁরাই দেশপ্রেমিক।
কী আশ্চর্য সমাপতন! গত ২৫শে
মার্চ ছিল রামনবমী। যদিও ২৪শে মার্চ থেকে পরের প্রায় সাতদিন রামনবমী পালিত হয়েছে
রাজ্যে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং সেই রামনবমীতে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার
অনুমতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম কোনও শাসকদল রামনবমী পালনের
উদ্যোগ নিয়েছে। রামনবমী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মের সঙ্গে প্রশাসনকে এইভাবে
মিলিয়ে দেওয়ার কাজ দেখা গেল স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গে —
সেটিও তৃণমূল কংগ্রেসের দৌলতে। আলিপুরদুয়ারের মতো বেশ কিছু জায়গায়
বি জে পি আর তৃণমূল কংগ্রেস মিলিতভাবে রামনবমীর ধর্মীয় শোভাযাত্রা করল। কাঁকিনাড়ায়
শাসকদলের মিছিলেই খাপখোলা তরবারি দেখা গেল। রাজ্যে দাঙ্গা হলো — বেশ কয়েকটি জায়গায়। অন্তত তিনজনের প্রাণ গেল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায়।
পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।
হিন্দুত্বের উগ্র বাসনা ছড়িয়ে
পড়ার সুযোগ পেল। অস্ত্র নিয়ে উন্মত্ত প্রকাশ বৈধতা পেল। প্রশ্ন উঠল সেই একটি পক্ষ
থেকে, যারা মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। সি পি আই (এম)
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্য মিশ্র বললেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রী
কী বাংলায় মোদীর গুজরাট মডেলের প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে চান?’’ আর
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মমতা
ব্যানার্জির উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন। কেন? কারণ — ‘গুজরাট মডেল’ হালে পানি পাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির
উদ্যোগে।
রাজ্যে যখন এমন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের
পরিবেশ, ঠিক তখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সূচি ঘোষিত হলো। অথচ আগের বার, ২০১৩-তে এই মুখ্যমন্ত্রীই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন
জুলাইয়ে। নির্বাচনের সূচি নিয়ে মামলা পৌঁছেছিল সুপ্রিম কোর্টে। পঞ্চায়েতগুলি গঠিত
হয়েছিল আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। এবার তার প্রায় বিপরীত। ধর্মীয় শোভাযাত্রার নামে
আস্ফালনের পরেই, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীনই পঞ্চায়েত
নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু। গ্রামে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব, চিহ্নকে ভোটের হিসাবে মান্যতা দেওয়া, বি জে পি-কে
গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মমতা ব্যানার্জির এত তৎপরতার কারণ
কী? তাঁর নিজের লুটের শাসন আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখা নিশ্চয়ই
একটি কারণ। আর একটি কারণ? নরেন্দ্র মোদীর শাসনে বিপর্যস্ত
দেশের সামনে প্রকৃত বিকল্প হাজির করার লক্ষ্যে অটল বামপন্থীরা। সেই লড়াই নয়া
মাত্রা পেতে চলেছে — মুম্বাইয়ে কৃষকদের লঙ মার্চ তার একটি
বহিঃপ্রকাশ। এমন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিক লড়াইয়ে থাকা বামপন্থীদের কৌশলে দুর্বল
প্রতিপন্ন করা আসলে বি জে পি এবং মমতা ব্যানার্জির যৌথ কর্মসূচি।
দেশের আগামীকাল পশ্চিমবঙ্গের
ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে। পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা দেশে ফ্যাসিবাদের
আগ্রাসনকে আরও শক্তি জোগাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গের এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন জন্মভূমি
রক্ষার সংগ্রামে সম্পৃক্ত।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। এমন
সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই নির্বাচনে হাঙ্গামা, সশস্ত্র হামলা চলছে। যে ‘কন্যাশ্রী’ বা ‘যুবশ্রী’
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন, পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন, তিনি কী দেখেছেন? আমরা, যাঁরা মমতা ব্যানার্জির পাঁশকুড়া-লাইন দেখেছি,
কিংবা যাঁরা অবরুদ্ধ-নন্দীগ্রামের কথা জানি, তাঁরা
বাইকবাহিনীর হামলায় গ্রাম দখল দেখেছি। একটি সাধারণ, স্বাভাবিক
অঞ্চল কিভাবে ‘দখলিকৃত এলাকা’ হয়ে ওঠে,
আমরা দেখেছি। আস্ত ব্লক এলাকার প্রতিটি পঞ্চায়েত শুধু বোমা, বুলেটের দাপটে মাসের পর মাস দাবিয়ে রাখা যায়? তালপাটি
খাল কিংবা কংসাবতীর পাড় — তা জানে। সবই পশ্চিমবঙ্গের জানা
হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সৌজন্যে।
কিন্তু ব্লক অফিস দখল? মহকুমাশাসকের
দপ্তর অস্ত্রের দাপটে অবরোধ? এবার দেখা গেল। ‘কৃতিত্ব’ — সেই তৃণমূল কংগ্রেসের। সদ্য বাবাকে
হারানো পাঁশকুড়ার যুবক গেছেন ব্লক অফিসের দিকে। পৌঁছাতে পারেননি ব্লক অফিসের
দরজায়। সেই যুবকের দরকার মৃত বাবার কিছু নথিতে সরকারি আধিকারিকের সই। তাঁকে ধাক্কা
দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির ‘দামাল’
ছেলেরা আঙুল উঁচিয়ে বলেছে,‘‘বাড়ি যা। এখন ঢোকা
যাবে না এখানে। সব ৯ তারিখের পরে।’’ এমন আরও অভিজ্ঞতা হয়েছে
অনেকের। কেন ‘৯ তারিখ’। সেদিন পর্যন্ত রাজ্যে
পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। আর ততদিন ব্লক অফিস পাহারা দেবে
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা,
কর্মীরা। তাদের জন্য ক্যাম্প হয়েছে ব্লক অফিসের রাস্তায়। সেই
ক্যাম্পে ঢালাও খানা এবং পিনার ব্যবস্থা হয়েছে। আর হাতে হাতে ধরানো হয়েছে বোমা,
মাস্কেট, পিস্তল।
গত সাত বছর রাজ্যে সরকার
পরিচালনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই বছরগুলিতে তাঁর সরকার রাজ্যের জন্য কী কী উন্নতি
ঘটিয়েছেন, তার একটি বিচার এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হওয়ার কথা। মমতা ব্যানার্জির
দাবি — তিনি ৮১লক্ষের উপর চাকরি দিয়েছেন। তাঁর আমলে গ্রামে
অনেক রাস্তা হয়েছে। অনেক ভাতা চলছে। মানুষ নানা নামের প্রকল্পে ঘর পাচ্ছেন। এমন
সময়ে মানুষ তাঁর এবং তাঁর সরকারের পাশে দাঁড়াবেন — সেটিই
স্বাভাবিক। যদি নিজের দাবির প্রতি তাঁর ভরসা থাকে, তাহলে
তাঁর সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার জন্য বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু তা
হলো না। তাঁর দলের সশস্ত্র কর্মীরা ব্লক অফিস অবরুদ্ধ করল — রাজ্যের
প্রায় প্রতিটি জায়গায়। কারণ আশঙ্কা আছে — ভোট দেওয়ার সুযোগ
পেলে মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করবে। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে তৃণমূল
কংগ্রেসের নেতা নান্টু প্রধানের গ্রামবাসীদের রোষে মৃত্যুর ঘটনা কী নিশ্চিত অশনি
সংকেত? বর্ধমানের কিছু গ্রামে ‘চোর’
তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের গ্রামবাসীদের সম্মিলিত তাড়া করা, আটকে রাখা, তোলাবাজির টাকা আদায় করার ঘটনা কী কোনও
ইঙ্গিত? গ্রামে মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন কাজ না পেয়ে, প্রাপ্য টাকা না পেয়ে, ন্যায্য বাড়ি না পেয়ে। তৃণমূল
কংগ্রেসের নেতাদের তোলার টাকা দিতে দিতে, নান্টু প্রধানের মত
লোকদের কাছে নিজের জমি হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া মানুষ ব্যালটে জবাব দেওয়ার জন্য
তৈরি হচ্ছিলেন। তাই কোথাও মনোনয়নপত্র জমা পড়ুক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা
হোক চাননি মমতা ব্যানার্জি। বুথ দখল করে ভোটে জেতা অভ্যাস হয়ে গেছে তৃণমূল
কংগ্রেসের। ফলে গ্রামবাসীদের কোনও অংশকেই তারা আর ভরসা করতে পারছে না। ফলে
প্রতিদ্বন্দ্বিতারই মুখোমুখি হতে চাইছেন না মমতা ব্যানার্জি। গত ২২শে মার্চ
মেদিনীপুরে প্রশাসনিক সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেদিন তিনি বলেন যে,
পঞ্চায়েত শাসকদলের হাতে না থাকলে কিভাবে কাজ হবে? তাই তাঁর আহ্বান ছিল — পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতিয়ে
কাজের সুযোগ দেবেন।
‘উন্নয়নের প্রতীক’ যিনি,
তাঁর এই আহ্বানের মানে কী? সব পঞ্চায়েতে,
সব আসনে জিততে হবে। ভোট লুট তো পরের কথা। ভোটই আটকাও — ‘উন্নয়নের জন্য।’ কার উন্নয়ন? গণতন্ত্র
খুন করে উন্নয়নের লালন? হতে পারে না। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর
কথায়,‘‘বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে অনেক সময় সাধারণ
মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষকেই
নির্বাচিত করতে চাই। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে
চাই।’’(১৯৭৮, ১৯শে এপ্রিল, কলকাতা)।
গ্রামের সরকার গড়ার সংগ্রামের
গুরুত্ব এখানে। রাজ্যের উন্নয়ন সেই গণতন্ত্রের বিকাশের উপর নির্ভরশীল। তাই-ই
রক্তাক্ত। নলহাটি লড়ছে। ভাঙড় লড়ছে। লড়ছে আরও অনেক জনপদ।
এ লড়াই শুধু নির্বাচন নয় — গণতন্ত্র রক্ষার
যুদ্ধ! নলহাটিতে বোমায় ক্ষতবিক্ষত খেতমজুর হীরু লেটের শরীর সেই যুদ্ধের প্রতীক।
গণশক্তি, ৭ই এপ্রিল, ২০১৮
No comments:
Post a Comment