শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
একটু একটু করে ষড়যন্ত্রের জাল
ক্রমে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের
সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ঘিরে
বি জে পি তথা আর এস এস-এর নখ দাঁত ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। নিজেদের উগ্র সাংস্কৃতিক
জাতীয়তাবাদের কর্মসূচিকে সফল করতে আর এস এস এখন ক্যাম্পাস দখলের নেশায় মত্ত। ২০১৪
সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসবার পর ভারতবর্ষের দীর্ঘদিন ধরে লালিত বহুত্ববাদের
সংস্কৃতি,
‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের’ ঐতিহ্য এই
উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির ধারাবাহিক আক্রমণের শিকার। গান্ধীজীর খুনি নাথুরাম
গডসে-কে এখন দেশপ্রেমিক বানিয়ে দেশদ্রোহী তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে নিরীহ সেই সব
ছাত্রছাত্রীদের গায়ে, যারা আর এস এস-এর এই হিন্দুত্ববাদী
সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ কর্মসূচির বিরোধিতায় সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘা
শুকোতে না শুকোতে আক্রান্ত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আগামী দিনে
অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠিত বা সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের আক্রমণের শিকার হতে
পারে। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক রোহিত ভেমুলাকে অসহায়ভাবে অকালে
হারিয়ে যেতে যারা বাধ্য করেছে বা প্রত্যক্ষ প্ররোচনা জুগিয়েছে তারাই ষড়যন্ত্রের
জাল পেতে কানহাইয়া ও তার সহযোগী ছাত্র রাজনীতির সংগঠকদের দেশদ্রোহী বানিয়ে জে এন
ইউ ক্যাম্পাসের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের
প্রধান সংগঠক ছিল রোহিত। হতদরিদ্র দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা এই গবেষক ছাত্রটি আজ
দেশজুড়ে বিপজ্জনকভাবে সংক্রামিত হওয়া অসহিষ্ণু সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায়
দরিদ্র আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করবার স্বপ্ন
দেখেছিল। শুধুমাত্র এই অপরাধে মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে রোহিতের উপর ধারাবাহিক মানসিক
নির্যাতন শুরু হয় — যার নেতৃত্ব দেন স্থানীয় সাংসদ তথা
কেন্দ্রের বি জে পি সরকারের শ্রমমন্ত্রী, যিনি আর এস এস-র
অন্যতম সংগঠকও বটে। রোহিতকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই এক ঘরে করে দেওয়া হয়
যাতে বন্ধুবান্ধবদের সাথেও দেখা করতে না পারে। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী
নজিরবিহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একের পর এক চিঠি লিখে রোহিতের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেওয়া ও তাকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন। শেষমেশ
মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এই সম্ভাবনাময় তরুণ গবেষকটি,
যার প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়ে ছিলেন বি জে পি তথা আর এস এস-র নেতা
মন্ত্রীরা। সেই রোহিত ভেমুলার খুনিরাই এখন নতুন উদ্যমে হিংস্র নখ দাঁত নিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে জে এন ইউ ক্যাম্পাসে। ওদের টার্গেট শুধু কানহাইয়া নয়, বরং তার চাইতেও অনেক বেশি বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন, যা
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। আর এস এস বাহিনীর টার্গেট এখন বামপন্থা ও
বামপন্থী রাজনীতি যার আদর্শগত অবস্থান ঠিক ওদের বিপরীত মেরুতে। সেই কারণেই
বামপন্থীরা বি জে পি তথা আর এস এস বাহিনীর প্রধান শত্রু। গত লোকসভা নির্বাচনের পর
স্বয়ং সংঘ প্রচারক মোদী প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার কারণে দেশজুড়ে বামপন্থীদের শক্ত
জমিতে আঁচড় কাটতে আর এস এস তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গ ওদের
দীর্ঘমেয়াদী টার্গেট। এরাজ্যে সাম্প্রতিককালে বেড়ে ওঠা ওদের নানাবিধ কর্মসূচিগুলি
লক্ষ্য করলে আরও বিপদের মাত্রা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যাদবপুরের আন্দোলনরত
ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এমন কি মাননীয় উপাচার্যকে যে
ভাষায় বি জে পি-র নেতারা আক্রমণ করেছেন, তাকে শুধু
নিম্নরুচির কাজ বলে থেমে গেলে আসল বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। দেশের বহুত্ববাদী
সংস্কৃতিকে রক্ষার তাগিদে আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ,
বি জে পি এবং তার সহযোগী শক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার তাগিদে
ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
মূলত সেই তাগিদ থেকেই জওহরলাল
নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। কোনো
একদিনের কর্মসূচি নয়, ধারাবাহিক আন্দোলন — যা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এতেই ভয়
পেয়েছে আর এস এস। ওদের হিন্দুরাষ্ট্র গঠন ও হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ
প্রচারের কর্মসূচিতে জে এন ইউ-র মতো দেশের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির
ছাত্র-শিক্ষকরা যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার প্রভাব পড়বে সারা
দেশজুড়ে। তাই ভয় পেয়েছে ওরা। আর সেই ভয় থেকেই সম্পূর্ণ মিথ্যা মনগড়া অভিযোগ সাজিয়ে
জে এন ইউ ক্যাম্পাসের মধ্যে পুলিশ ঢুকিয়ে এই ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সংগঠক তথা ঐ
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রসঙ্গত
উল্লেখ করা দরকার হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলার মতো এই কানহাইয়াও উঠে এসেছে বিহারের
এক অসহায় হতদরিদ্র অনগ্রসর পরিবার থেকে। রোহিতের মতো কানহাইয়ার বিরুদ্ধেও সংসদ
আক্রমণের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত আফজল গুরু বা সৈয়দ গিলানিদের সমর্থনে
স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। খোদ দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও বলবার চেষ্টা
করা হয় যে কানহাইয়ার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। অথচ
দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে এধরনের কোনো তথ্যই আদালতে পেশ করা সম্ভব হয়নি। উলটে পাতিয়ালা
আদালতে কানহাইয়াকে হাজির করার সময় পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সামনেই শারীরিক নিগ্রহ
করা হয়। আবারো দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে দিয়ে সংঘ প্রচারকের স্টাইলে বলবার চেষ্টা
করা হয় যে কানহাইয়াকে মারধর করা হয়নি। কিন্তু ওর মেডিক্যাল রিপোর্টে শরীরে আঘাতের
চিহ্ন স্পষ্ট বলে উল্লেখ করা আছে। এত সব কুকর্ম করে ধরা পড়বার পরেও আর এস এস দমবার
পাত্র নয়। সোস্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক-এ কানহাইয়ার বক্তৃতারত একটি ছবি জাল করে তার
সাথে ভারতের মানচিত্র বিকৃত করে জুড়ে দিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে
কানহাইয়া সম্পর্কে জনমানসে একটা ঘৃণা বা বিদ্বেষের মনোভাব তৈরি করা যায়। দেশজুড়ে
অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির চক্রান্তে যুক্ত দেশদ্রোহীরা রাষ্ট্রক্ষমতায়
এসে পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়ার একাংশের সাহায্য নিয়ে নিষ্পাপ, নির্দোষ কানহাইয়াসহ তার সহযোগী বন্ধুদের দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার
নোংরা খেলায় মেতেছে। সঙ্গত কারণে দেশ তথা আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে দেশ ও বিদেশের বহু খ্যাতনামা চিন্তাবিদ এই ঘটনার
নিন্দা করে কানহাইয়ার দ্রুত নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন। গুজরাট, মুজফ্ফরনগর, দাদরি বা অন্যবহু জায়গায় ধর্মীয়
সংখ্যালঘু মানুষদের যারা নির্বিচারে হত্যা করেছে, একের পর এক
মিশনারি স্কুল, চার্চ যারা পুড়িয়ে দিয়েছে, খ্রীষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষদের যারা জোর করে ভয় দেখিয়ে ঢাকঢোল
পিটিয়ে ধর্মান্তরিত করছে — তারা এখন এদেশে রাষ্ট্রের
পৃষ্টপোষকতায় দেশপ্রেমিক সেজেছে। আর দেশদ্রোহী বানানোর চেষ্টা চলছে রোহিত ভেমুলা,
কানহাইয়া কুমারকে, যারা ঐ দেশ বিরোধী শক্তির
প্রকৃত স্বরূপটা চিনিয়ে দিয়ে দেশ বাঁচানো ও সমাজ পালটানোর আন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্র
সমাজকে সংগঠিত করছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও বলতে বাধ্য
হয়েছে কানহাইয়াকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে এবং তা পূর্বপরিকল্পিত। প্রশ্ন উঠেছে
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঐভাবে পুলিশ ঢোকা নিয়েও। জে এন ইউ-র উপাচার্য প্রথম অস্বীকার
করলেও পরে জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশমতোই পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকেছে।
বুঝতে অসুবিধা হয় না জে এন ইউ-র মতো প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারও আজ
বিপন্ন, এ রাজ্যে যে ঘটনার প্রায় প্রতিনিয়ত সাক্ষী আমরা।
কানহাইয়া আজ না হোক কাল মুক্তি
পাবে একথা ঠিক। তবে তাতে বি জে পি, আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের হিন্দুত্ব কর্মসূচি
থেমে থাকবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ দেখি না। বরং আশঙ্কায় আছি, আবার নতুন করে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আক্রান্ত হয় এই
ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত শক্তির হাতে। কানহাইয়ারা আফজল গুরুর সমর্থনে সেদিন কোনো স্লোগান
দেয়নি বরং গোটা ব্যাপারটা সাজানো হয়েছিল ওদের ফাঁসাবার জন্য — এ সত্য আজ কারো জানতে বাকি নেই। গোটাটাই একটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। কিন্তু
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই কেউ বলেছে যে ‘আফজলকে ফাঁসি দেওয়া
ঠিক হয়নি’ — তাহলে কি সেই ছাত্র বা ছাত্রীটিকে সাথে সাথে
দেশদ্রোহী বলে দেওয়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয় নামক জ্ঞানচর্চা ও
মুক্তচিন্তার অঙ্গনে দাঁড়িয়ে সে কি তার স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পাবে না। শুধু
মাত্র এধরনের কথা বললেই কি সে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এমন দাবি করা যায়?
জে এন ইউ কাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার এক শিক্ষক সমাবেশে অধ্যাপক
সুকান্ত চৌধুরির পেশ করা লিখিত বক্তব্যের একাংশ এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে
পারে। উনি লিখেছেন, ‘‘সেই সঙ্গে শিক্ষক হিসাবে আমাদের উপর
একটা বিশেষ দায় বর্তায়, যাতে যে পক্ষ নির্বিশেষে যে কোনও
অনাচারের হোতাদের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা না হারাই। দেখা
যাচ্ছে, বাক্স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে সওয়াল করতে
নেমে আমরা প্রায় সকলে গোড়াতেই বলে নিচ্ছি যে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে বিশেষ
চরমপন্থী মতগুলি উচ্চারিত হয়েছে, সেগুলি আমরা নিন্দা করি।
অর্থাৎ আমাদের মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষার প্রচেষ্টায় কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে প্রচার
পাচ্ছে এমন কিছু মতবাদ যা আমরা অধিকাংশেই অনুচিত বা অন্যায় মনে করি, আইনগ্রাহ্য অপরাধ হোক চাই না হোক। এতে এই মতবাদগুলি একধরনের স্বীকৃতি পাচ্ছে, যার ফলে
বাক্স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার বৃহত্তর আন্দোলনের ক্ষতি হতে বাধ্য — কেবল সরকারি দমনপীড়নের বিপদ ডেকে এনে নয়, সাধারণ
মানুষের সমর্থন হারিয়ে এবং নিজেদেরও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে।
‘‘মানতেই হয়, যে মত আমরা নিজে পোষণ করি না এমনকি অন্যায় মনে করি, সেটা
বলতে দেওয়াই বাক্স্বাধীনতার চূড়ান্ত স্বীকৃতি। যাঁরা এইসব মত পোষণ করেন, তাঁরা নিজেদের মঞ্চ থেকে যত খুশি বলুন। তাঁদের প্রতি অন্যায় উৎপীড়ন হলে
অন্যান্য সৎ নাগরিকের মতো আমরাও আমাদের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে তার
নিন্দা-প্রতিবাদ করব। কিন্তু বাক্স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার সাধারণ আন্দোলনের একটা
প্রধান স্তম্ভ হিসাবে তাঁদের দেখলে বা দেখালে বৃহত্তর নাগরিক স্বার্থ, বা আজকের বিশেষ প্রসঙ্গে শিক্ষাজগতের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে।’’
জে এন ইউ কাণ্ডের সমর্থনে
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রাক্তনিদের মিছিল থেকে আজাদীর স্লোগান উঠেছে যা
নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে কেউ যদি কাশ্মীরের আজাদির প্রসঙ্গ
তোলে তাহলে মনে হতেই পারে সে বা তার বন্ধুরা ভারত অধিকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তানের
হাতে তুলে দিতে বলছে। সত্যি যদি তেমন দাবি উঠে আসে তবে তা সমর্থন যোগ্য নয়, এনিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমি যদি
এদেশে বসবাসকারি সব মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দাবি করি, খেয়ে
পড়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দাবি করি, তাহলেও কি
আমাকে দেশদ্রোহী বলা যায়? আমার কথা ছেড়ে দিলাম।
টাটা-বিড়লা-আম্বানিরা উত্তরোত্তর নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে
মুক্ত হয়ে দেশের মূল্যবান সম্পদ লুট করবার স্বাধীনতা দাবি করে — ওদেরকে কি দেশদ্রোহী বলবার সাহস দেখাতে পারে দেশের বর্তমান সরকার? এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। বছর পাঁচ ছয়েক আগে অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে এক সভায় এদেশের সর্বোচ্চ বিত্তশালী পরিবারের
কর্ত্রী নীতা আম্বানি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা দু’টো স্বাধীনতা পেয়েছি। প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৪৭ সালে। দেশ স্বাধীন
হয়েছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৯১ সালে। আমাদের দেশের অর্থনীতি স্বাধীন হয়েছে।
এখন আমরা তৃতীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো দেশের সামাজিক
অর্থনৈতিক যাবতীয় ক্রিয়াকর্মকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা।’
মানুষকে সর্বস্বান্ত করবার এই স্বাধীনতা যা দাবি করেন দেশের প্রথম
সারির শিল্পপতিরা, তাদের কি দেশদ্রোহী বলার সাহস দেখাতে
পারেন মাননীয় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহযোগীরা? তা যদি না
পারেন তা হলে শুধু শুধু জে এন ইউ বা যাদবপুরের এই সব নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের উপর
আস্ফালন দেখিয়ে কি লাভ? এরাজ্যের বি জে পি-র একনেতা বললেন জে
এন ইউ-র ছাত্রদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে দিল্লির বি জে পি বিধায়ক পুণ্য কাজ করেছেন। তার
মানে আমাদের সবার পাপপুণ্যের ব্যালান্সশিট বানাবার দায়িত্বটুকুও ওরা একতরফা নিয়ে
নিয়েছে। এরপর বাবরি মসজিদ ভাঙবার বিরোধিতা করে স্লোগান দিলেও দেশদ্রোহীর তকমা জুড়ে
দিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে আমাদের পেটাবার কর্মসূচি নিতে পারে ওরা।
নাইরোবিতে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দশম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর ভারতের শিক্ষা তথা
উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সমস্ত জরুরি মৌলিক পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি
এখন খোলা বাজারের সম্পত্তি। উচ্চশিক্ষায় সরকারি উদ্যোগে ঢালাও প্রত্যক্ষ বিদেশি
বিনিয়োগের বন্দোবস্ত পাশ করা হয়েছে। এর ফলে উচ্চশিক্ষা আগামী দিনে আরো মহার্ঘ হবে
একথা বলা বাহুল্য। ইউ জি সি, এ আই সি টি ই, এন সি টি ই-র মতো উচ্চশিক্ষার সঙ্গে
যুক্ত নিয়ামক সংস্থাগুলি খোলা বাজারের শর্তে তুলে দেওয়ার প্রস্তাবও বিবেচনা
করা শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশজুড়ে
শিক্ষার সর্বস্তরে পাঠ্যসূচির গেরুয়াকরণের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক
স্বচ্ছ ধারণাকে সরিয়ে আচার সর্বস্ব ধারণাকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়ে
কূপমণ্ডুক বানাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে পুরাণ বা মিথ-কে
ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চের দখল নিয়ে
অবিজ্ঞান কুসংস্কার প্রচারের চেষ্টা চলছে। এই সর্বনাশা নীতি ও সুস্থ চিন্তা বিরোধী
পরিকল্পনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রকার বাধার মুখে না পড়তে হয় এর জন্য
পরিকল্পনামাফিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিতে সচেতন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক
সমাজের উপর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত
সর্বস্তরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন ছাড়া
এই সর্বনাশা শক্তিকে রোখা সম্ভব নয়।
পরিশেষে আসি এরাজ্যের শাসকদল ও
তার সরকারের সুবিধাবাদি অবস্থান প্রসঙ্গে — জে এন ইউ কাণ্ডে যখন
দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদ করছেন, নিন্দায়
সরব হচ্ছেন চিন্তাবিদগণ, মিছিলে শামিল হচ্ছেন এরাজ্যের
ছাত্র-শিক্ষকসহ অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, তখন অদ্ভুত এক
নীরবতা গ্রাস করেছে শাসকদলকে। ব্যাপারটা শুধুমাত্র বেখেয়ালে ঘটেছে ভাবলে ভুল হবে।
প্রথমত, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হবার নতুন
সমীকরণের হিসেব নিকেশ — তাতে করে এক-আধটা রোহিত যদি অকালে
হারিয়ে যায় তা কানহাইয়ার মতো সুস্থ চিন্তার ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের তিহার জেলে
পচতে হয়, তাতে ওদের কিছু যায় আসে না। বি জে পি-কে চটানোর
ঝুঁকি ওরা নেবেন না, তা তাদের আচরণেই পরিষ্কার। দ্বিতীয়ত,
উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগ এরাজ্যেও ব্যাপক আকার নিয়েছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ করার সুনাম এদেরও তো কম নয়, তৃতীয়ত, হ্যাঁ ঠিকই, ধর্মের
দোহাই দিয়ে তা তারা করেন না, কিন্তু রাজনৈতিক দখলদারি
সুনিশ্চিত করতে গত প্রায় পাঁচ বছর জুড়ে যে অরাজক পরিস্থিতি তারা তৈরি করেছেন,
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিতে
তার দায় এড়াবেন কি করে? এ বিপদও আমাদের একইভাবে সর্বশক্তি
দিয়ে মোকাবিলা করা জরুরি। নতুবা আগামী প্রজন্ম সত্যিই আমাদের দেশদ্রোহী চিহ্নিত
করবে।
No comments:
Post a Comment