গত ২০১১-র বিধানসভা
নির্বাচনের আগে প্রকাশিত তৃণমূল কংগ্রেসের ৬৪ পৃষ্ঠার
ইস্তেহারটি তাদের অন্যসব দলিলের মতোই বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা ও
ভিত্তিহীন অপপ্রচারের বস্তা। ইস্তেহারের কোন ইংরাজী
অনুবাদ তারা করেনি। তবে ইংরাজীতে প্রকাশ করেছিল ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ নামে ৫৯ পৃষ্ঠার
একটি পুস্তিকা। মূলত ঐ ভিশন ডকুমেন্টে এবং কিছুটা ঐ বাংলা ইস্তেহার মিলে তৃণমূলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটা তালিকা পাওয়া
যায়। কিছু বিষয় বাংলা ইস্তেহারে আছে, ইংরাজীতে নেই। কিছু ইংরাজীতে আছে, বাংলায়
নেই। তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এলে প্রথম ২০০ দিনে এবং প্রথম ১০০০ দিনে (৩৩ মাস ১০
দিন) কী কী কাজ করবে তার দুটো তালিকা
ইংরাজী ভিশন ডকুমেন্টে রয়েছে।
সব মিলিয়ে বাংলা
ইস্তেহার এবং ইংরাজী ভিশন ডকুমেন্টে তৃণমূলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে
বাছাই কয়কটি এখানে উল্লেখ করা হল:
১) শিল্পে হবে ‘সবুজ
বিপ্লব’। ২)
এককোটি বেকারের চাকরি। ৩)
তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য হবে ‘উন্নততর
কর্মসংস্থান’ সৃষ্টি করা। ৪) রাজ্যের প্রতিটি
জেলায় শিল্প হাব নির্মাণের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে। প্রথম একহাজার দিনের মধ্যে এই
প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। ৫) পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি মহকুমায় অন্তত ১০টি
করে বড়, মাঝারি শিল্প গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ৬) প্রথম দুশো দিনের মধ্যে তৃণমূল
সরকার রাজ্যজুড়ে শিল্পনগরী শৃঙ্খল গড়ে তুলবে। একহাজার দিনের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে যাবে।
৭) বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি খোলার প্রক্রিয়া প্রথম দুশো দিনের মধ্যে শুরু করা
হবে। ৮) তৃণমূল সরকার রাজ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশ ঘটাবে এবং
ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ‘‘ব্যাপক’’ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। ৯) তৃণমূল সরকার
ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ‘‘ব্যাপক কর্মসংস্থান’’-র ব্যবস্থা করবে।
১০) তথ্য প্রযুক্তি শিল্প হলদিয়া, দুর্গাপুর, খড়গপুর, কল্যানী ও শিলিগুড়িতে
সম্প্রসারিত করা হবে একহাজার দিনের মধ্যে।
২০১৫ সালের মধ্যে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প থেকে রাজস্ব আয়ের শতকরা ২৫ ভাগ দখল
করবে পশ্চিমবঙ্গ। ১১) প্রথম দুশো দিনের মধ্যে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান এবং রাজ্যের
জুটমিলগুলির পুনরিজ্জীবন ও আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। ১২) কলকাতাকে লন্ডন, হঙকঙ, সিঙ্গাপুরের মত
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উদ্যোগের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ১৩) ক্ষুদ্র, ছোট ও
মাঝারি শিল্পের জন্য রাজ্যজুড়ে ক্লাস্টার তৈরি করা হবে। প্রথম দুশো দিনের মধ্যেই
এরকম ১৭টি ক্লাস্টার নির্বাচন করা হবে। সেগুলি বিশ্বমানের উৎকর্ষ কেন্দ্র পরিণত
করা হবে। এক বছরের মধ্যেই তা গোটা রাজ্যে প্রসারিত করা হবে। ১৪) শিল্পের জন্য উপযুক্ত জমির মানচিত্র তৈরি করা
হবে। ১৫) ‘‘স্বচ্ছ ভূমি নীতি’’ তৈরি করা হবে। ১৬)
গুজরাট/মহারাষ্ট্রের মডেলে কৃষকদের নিয়ে
সমবায় গঠনের কর্মসূচী চালু করা হবে একহাজার দিনের মধ্যে। ১৭) ‘পূর্ণাঙ্গ ল্যান্ড
ব্যাঙ্ক’ তৈরি করা হবে। তৈরি করতে হবে
‘বেঙ্গল ল্যান্ড ব্যাঙ্ক অথরিটি’। ১৮) পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ শতাংশ জমিতে সেচ এবং ১০০
শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে।১৯) রাজ্যের বন্ধ কলকারখানাগুলির ‘‘৪৪ হাজার
একর’’ জমিতে হয় আগের কারখানার পুরুজ্জীবন নয়, নতুন কারখানা গড়ার উদ্যোগ নেওয়া
হবে। ২০) তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার দুশো
দিনের মধ্যে নতুন এক কৃষিপ্রক্রিয়াকরণ
বিপ্লবের সূচনা করবে। ২১) সংখ্যলঘুদের চাকরিতে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হবে।২২)
‘‘চাকরি ক্ষেত্রে তফসিলি আদিবাসী ও
ওবিসিদের সংরক্ষণ অনুযায়ী সমস্ত পদ ভর্তি করা হবে।’’ ২৩) মাদ্রাসা
শিক্ষকদের জন্য ‘উন্নত’ ও ‘বিশেষ’ বেতন কাঠামো করা হবে।
২৪) রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থাগুলির পুনর্গঠনের
কাজ শুরু করা হবে। (ভিশন ডকুমেন্ট, পৃষ্ঠা ৪৯)পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান হবে। ২৫)
কলকাতায় রেল বিকাশ করপোরেশন তৈরি হবে মেট্রো ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে। ২৬)
কলকাতাকে ‘লন্ডন’, দীঘাকে ‘গোয়া’,
দার্জিলিঙকে ‘সুইজারল্যান্ড’ বানানো হবে। ২৭) দুশো দিনের মধ্যে মালদা, কোচবিহার,
বালুরঘাট, আসানসোল-দুর্গাপুর, মেদিনীপুর,, বীরভূম ও সাগরে বিমানকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার
ঘোষণা করা হবে। ২৮) দুশো দিনের মধ্যে
তৃণমূল সরকার ১০টি নতুন মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করবে। ২৯) ‘মুসলিম
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ’ ( ইংরাজীতে বহুবচনে, মানে অনেকগুলি হবে), ‘মতুয়া সম্প্রদায়
বিশ্ববিদ্যালয়’ তৈরি করবে, আরও মাদ্রাসা, আরও উর্দু মাধ্যম স্কুল, আরও হিন্দি
মাধ্যম স্কুল তৈরি করবে। ৩০) তৃণমূল সরকারের লক্ষ্য রাজ্যে ৩০০ আই টি আই
প্রতিষ্ঠা করা। ৩১) আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলে রাজ্যে আরও বেশি সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্টা করা হবে একহাজার দিনের মধ্যে। ৩২) সারা রাজ্যে গ্রামীণ মানুষদের জন্য
হেলথ কার্ডের ব্যবস্থা করা হবে এবং প্রত্যেকটি মহকুমা হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার
ইউনিট তৈরি করা হবে। ৩৩) প্রতিটি মহকুমায়
অন্ততপক্ষে একটি মাল্টি-ফেসিলিটি হাসপাতাল চালু করা হবে একহাজার দিনের মধ্যে। ৩৪)
সরকার প্রথমেই রাজ্যে বি পি এল-র প্রকৃত সংখ্যা কত তা নির্ধারন করবে। ৫
বছরের মধ্যে সেই সংখ্য অন্তত ১০ শতাংশ কমাবে।
৩৫) পাঁছ বছরে ১০০ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ ও পানীয় জল। ৩৬) গরীব মানুষের জন্য
১০ লক্ষ আবাসন। ৩৭) নতুন নগর ও বন্দর তৈরি করা হবে।
নির্জলা মিথ্যাচার
ও বাগাড়ম্বর
তৃণমূল কংগ্রেসের ২০১১
সালের নির্বাচনের ইস্তেহার ও ভিশন ডকুমেন্ট পড়লে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নজরে আসে—
(১) বামফ্রন্ট সরকারের
কাজকর্ম সম্পর্কে নির্জলা মিথ্যা ও কুৎসার বন্যা। (২)জরুরী বিষয়গুলিতে অস্পষ্টতা
রেখে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছে করেই। যাতে প্রতিশ্রুতিগুলির
কতটা কি হল তা পাঁচ বছর পর মিলিয়ে নেওয়া
কঠিন হয়। (৩) বাগাড়ম্বর। চমকে দেওয়ার মত কথা, যেমন, ‘শিল্পে সবুজ বিপ্লব’,
কলকাতা হবে লন্ডন, দীঘা গোয়া, উত্তরবঙ্গ সুইজারল্যান্ড। বাস্তবে কী করা সম্ভব,
কোনটা কোন পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনবোধ করে নি।
তৃণমূল ক্রমাগত মিথ তৈরি করতে চায়। (৪)নয়া উদারবাদী পর্বে উন্নয়নের সমস্যা, গরীব
মানুষের বর্ধিত বিপদ ইত্যাদি সম্পর্কে পরিকল্পিতভাবেই তৃণমূল নীরব।
যে যে কাজ রাজ্য
সরকারের পক্ষে করা শক্ত, এমনকি সে সব কাজও তৃণমূল সদর্পে বলেছে।
কারণ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলেই তৃণমূলের
চলে; কাজটা করার কোনো দায় নেই। তৃণমূল এবারও ভোটের আগে আরও কিছু মিথ্যা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! আগের প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণের কোনো বালাই তাদের নেই।
No comments:
Post a Comment